চাঁদমোহন শ্রীমানী জানিয়ে দিয়েছে
চাঁদমোহন শ্রীমানী জানিয়ে দিয়েছে তার ব্যবসায় এখন মন্দা যাচ্ছে, পাঁচশো ;কার বেশি দিতে পারবে না। আমরা বুঝলাম তন্ময়ের জন্যই ক্লাবের হাজার টাকা জরিমানা হল। এত বড় ধাক্কা সামলানো ক্লাবের পক্ষে অসম্ভব ব্যাপার। ননীদা দারুণ মুষড়ে পড়লেন। আমি বললাম, গোটা চার-পাঁচ ম্যাচ খেলে বরং এই সিজনের মতো খেলা বন্ধ করে দেওয়া যাক, তাতে খরচ বাঁচবে।
সে কী কথা! ননীদা যতটা না অবাক হলেন তার থেকে বেশি রেগে উঠলেন। একটা বাঁদরের উৎপাতে সি সি এইচ খেলা বন্ধ করে দেবে? আমাদের ট্র্যাডিশন আছে, তা থেকে সরে আসব আমি বেঁচে থাকতে?।
এরপর আর আমি সাহস পাইনি জিজ্ঞাসা করতে বাঁদরটা কে, শ্রীমানী না তন্ময়?
দ্বিতীয় লিগ ম্যাচে তন্ময় ১০৮ নট আউট রইল। ম্যাচ জিতলাম। এগারো বছর পর এই প্রথম সি সি এইচ-এর কেউ সেঞ্চুরি করল। ক্লাবের ট্র্যাডিশন, কেউ সেঞ্চুরি করলেই একটা নতুন ব্যাট পায়। এ কথাটা ননীদা প্রতি বছর সিজনের শুরুতেই জানিয়ে দেন। এ বছরও দিয়েছেন।
খেলা শেষে তন্ময় কথাটা মনে করিয়ে দিল ননীদাকে। খুব মেজাজে ছিলেন ননীদা, বললেন, আলবৎ পাবে। কথার খেলাপ আমার হয় না।
তাই বলে কাঁঠাল কাঠের ব্যাট যেন দেবেন না। জি কে-র ব্যাট চাই।
নিশ্চয় নিশ্চয়।
কবে দিচ্ছেন?
সামনের হপ্তায়ই পেয়ে যাবে।
ননীদাকে একসময় বললাম, শখানেক টাকার কমে তো ব্যাট হবে না। পাবেন কোত্থেকে? ক্লাবের যা অবস্থা!
আরে, টাকা ঠিক জোগাড় হয়ে যাবে। দেখলে, ফাস্ট বোলারটাকে যে ছয়টা মারল সেকেন্ড ওভারে? এগিয়ে যেই দেখল পাবে না, সঙ্গে সঙ্গে পিছিয়ে ব্যাকফুটে স্ট্রেট বোলারের ওপর দিয়ে। ছেলেটার হবে, বুঝলে মতি! এত বছর গড়ের মাঠের ঘাসে চরছি, বুঝতে ঠিকই পারি। তবে বড় ডেয়ারিং, অধৈর্য, রিস্কি শট নেয়। ওকে
তুমি একটু কন্ট্রোল করো। আমার কথা তো শুনবে না।
বললাম, আমার কথাও শুনবে না। আজকাল ছেলেরা একটু অন্য রকম, বোঝেনই তো।
পরের ম্যাচ খেলতে নামার আগে তন্ময় তাঁবুর মধ্যে চিৎকার করে সবাইকে শুনিয়েই বলল, ব্যাটটা যে এখনও পেলুম না। দেবেন তো, নাকি ক্যালকাটা কর্পোরেশন হয়ে থাকবেন?
না, না, অবশ্যই দোব।ননীদা খানিকটা কাঁচুমাচু হয়ে বললেন।
এ খেলায় তন্ময় ১০১ করল। ননীদা আহ্লাদে যে কী করবেন, ভেবে পেলেন না। আমি শুধু বললাম, আর একখানা ব্যাট দিতে হবে, মনে থাকে যেন!
রেখে দাও তোমার ব্যাট!ননীদা ধমকে উঠলেন। কলকাতার কটা ব্যাটসম্যান পারে লেগ স্টাম্পের বাইরে সরে এসে লেগের বল অমন করে স্কোয়ার কাট করতে? মতি, তুমি ব্যাটের কথাই শুধু ভাবছ, ছেলেটা যে আর্টিস্ট সেটা বলছ না!
চুপ করে রইলাম। লাঞ্চের সময়ই, যা আন্দাজ করেছিলাম তাই ঘটল। তন্ময় টেবিলে বসেই হেঁকে বলল, আগের ব্যাটটা তো এখনও পেলুম না। আর কতদিন সময় দিতে হবে, ননীদা?
পাবে, পাবে! এক সঙ্গেই দুটো পাবে!
ঠিক আছে! তবে সামনের ম্যাচের আগে না পেলে আমি আর আসছি না। কথামতোই তন্ময় এল না পরের ম্যাচে। দুটো কেন, একটা ব্যাট দেওয়ার সামর্থ্যও সি সি এইচ-এর নেই। তন্ময় ব্যাট না পাওয়ায় অন্য প্লেয়াররাও গুঞ্জন তুলল। আমরা চার উইকেটে ত্রিবেণী ইউনাইটেডের কাছে হারলাম। পরের খেলা রূপোলি সঙ্ঘের সঙ্গে। এখন রূপোলির ক্যাপ্টেন চিতু। দুটো ম্যাচ খেলে, তন্ময় একাই ম্যাচ দুটো জিতিয়ে দিয়েছে। মনের মধ্যে একটা ক্ষীণ আশা জেগেছে, সি সি এইচ চ্যাম্পিয়ন। হবার চেষ্টা করলে এবার বোধ হয় হতে পারবে। শক্ত গাঁট রূপোলি সঙ্ঘ। ওরা আর আমরা যেন মোহনবাগান আর ইস্টবেঙ্গল। একের কাছে অন্যের হার কল্পনাতীত ব্যাপার।
রূপোলি সঙ্ঘের সঙ্গে সি সি এইচ-এর হাড্ডাহাড্ডির শুরু পঁচিশ বছর আগে শনিবারের একটা ফ্রেন্ডলি হাফ-ডে খেলা থেকে। ননীদা এমন এক ননীটিকস প্রয়োগ করে ম্যাচটিকে ড্র করান, যার ফলে এগারো বছর রূপোলি সঙ্ঘ আমাদের সঙ্গে আর খেলেনি। গল্পটা শুনেছি মোনা চৌধুরীর (অধুনা মৃত) কাছে। মোনাদা এ খেলায় ক্যাপ্টেন ছিলেন। উনি না বললে, এটাকে শিব্রাম চকরবরতির লেখা গল্প বলেই ধরে নিতাম।
সি সি এইচ প্রথম ব্যাট করে ১৪ রানে সব আউট হয়ে যায়। মোনাদা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন ড্রেসিং রুমে। সবারই মুখ থমথম। এক ওভার কি দু ওভারেই রূপোলি সঙ্ঘ রানটা তুলে নেবে। ওদের ড্রেসিংরুম থেকে নানান ঠাট্টা এদিকে পাঠানো হচ্ছে। কটা বলের মধ্যে খেলা শেষ হবে তাই নিয়ে বাজি ধরছে। রূপোলির ক্যাপ্টেন এসে বলল, মোনা, আমরা সেকেন্ড ইনিংস খেলে জিততে চাই, রাজি? মোনাদা জবাব দেবার আগেই ননীদা বলে উঠলেন, নিশ্চয় আমরা খেলব। তবে ফাস্ট ইনিংসটা আগে শেষ হোক তো!
সবাই অবাক হয়ে তাকাল ননীদার দিকে। রূপোলির ক্যাপ্টেন মুচকি হেসে, তাই নাকি? বলে চলে গেল। ননীদা বললেন, এ ম্যাচ রূপোলি জিততে পারবে না। তবে আমি যা বলব তাই করতে হবে।
মোনাদা খুবই অপমানিত বোধ করছিলেন রূপোলির ক্যাপ্টেনের কথায়, তাই রাজি হয়ে গেলেন। তখন বিষ্টুকে একধারে ডেকে নিয়ে ননীদা তাকে কী সব বাঝাতে শুরু করলেন আর বিষ্ঠু শুধু ঘাড় নেড়ে যেতে থাকল। তিরিশ মাইল রোড রেসে বিষ্টু পর পর তিন বছর চ্যাম্পিয়ন। শুধু ফিলডিংয়ের জন্যই ওকে মাঝে মাঝে দলে নেওয়া হয়। ব্যাট চালায় গাঁইতির মতো, তাতে অনেক সময় একটা-দুটো ছক্কা উঠে আসে।
রূপোলি ব্যাট করতে নামল। ননীদা প্রথম ওভার নিজে বল করতে এলেন। প্রথম শটা লেগস্টাম্পের এত বাইরে যে, ওয়াইড সঙ্কেত দেখাল আম্পায়ার। দ্বিতীয় বলে ননীদার মাথার দশ হাত উপর দিয়ে ছয়। তৃতীয় বলে পয়েন্ট দিয়ে চার। পরের দুটি বলে, আশ্চর্য রকমের ফিল্ডিংয়ে কোনও রান হল না। শেষ বলেই লেগবাই। বিষ্টু লং অন থেকে ডিপ ফাইন লেগে যেভাবে দৌড়ে এসে বল ধরে, তাতে নাকি রোম ওলিম্পিকের ১০০ মিটারে সোনার মেডেল পাওয়া যেত। তা না পেলেও বিষ্ঠু নির্ঘাত বাউন্ডারি বাঁচিয়ে যখন উইকেটকিপারকে বল ছুড়ে দিল, রূপোলির দুই ব্যাটসম্যান তখন তিনটি রান শেষ করে হাঁফাচ্ছে।
ওভার শেষ স্কোর এখন সমান-সমান। দু দলেরই ১৪। বিষণ্ণতায় সি সি এইচ-এর সকলের মুখ ম্লান। শুধু ননীদার মুখে কোনও বিকার নেই। সাধারণত অতুল মুখুজ্জেই এরপর বল করে। সে এগিয়ে আসছে কিন্তু তাকে হাত তুলে নিষেধ করে ননীদা বলটা দিলেন বিষ্টুর হাতে। সবাই অবাক। বিষ্টু তো জীবনে বল করেনি! কিন্তু কথা দেওয়া হয়েছে, ননীদা যা বলবেন তাই করতে দিতে হবে। বিষ্টু গুনে গুনে ছাব্বিশ কদম গিয়ে মাটিতে বুটের ডগা দিয়ে বোলিং মার্ক কাটল। ব্যাটসম্যান খেলার জন্য তৈরি। বিষ্টু তারপর উইকেটের দিকে ছুটতে শুরু করল।
বোলিং ক্রিজে পৌঁছবার আগে অদ্ভুত এক কাণ্ড ঘটল। বিষ্টু আবার পিছু হটতে শুরু করেছে। তারপর গোল হয়ে ঘুরতে শুরু করল। সারা মাঠ অবাক, শুধু ননীদা ছাড়া।
বিষ্টু কি পাগল হয়ে গেল? ঘুরছে, পাক খাচ্ছে, ঘুরছে আবার পাক খাচ্ছে, লাফাচ্ছে, বোলিং মার্কে ফিরে যাচ্ছে, ডাইনে যাচ্ছে, বাঁয়ে যাচ্ছে কিন্তু বল হাতেই রয়েছে।
এ কী ব্যাপার! রূপোলির ব্যাটসম্যান কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়াল, বোলার এভাবে ছুটোছুটি করছে কেন?
ননীদা গম্ভীর হয়ে বললেন, বল করতে আসছে।
এসে পৌঁছবে কখন?
পাঁচটার পর। যখন খেলা শেষ হয়ে যাবে।
এরপরই আম্পায়ারকে ঘিরে তর্কাতর্কি শুরু হল। ননীদা যেন তৈরিই ছিলেন, ফস করে পকেট থেকে ক্রিকেট আইনের বই বার করে দেখিয়ে দিলেন, বোলার কতখানি দূরত্ব ছুটে এসে বল করবে, সে সম্পর্কে কিছু লেখা নেই। সারাদিন সে ছুটতে পারে বল ডেলিভারির আগে পর্যন্ত।
বিষ্টু যা করে যাচ্ছিল তাই করে যেতে লাগল। ব্যাটসম্যান ক্রিজ ছাড়তে ভরসা পাচ্ছেনা, যদি তখন বোল্ড করে দেয়! ফিল্ডাররা কেউ শুয়ে, কেউ বসে। ননীদা মাঝে মাঝে ঘড়ি দেখছেন আর হিসেব করে বিষ্টুকে চেঁচিয়ে বলছেন, আর দেড় ঘণ্টা! আরও এক ঘণ্টা!..মাত্র পঁয়তাল্লিশ মিনিট!
কথা আছে পাঁচটায় খেলা শেষ হবে। পাঁচটা বাজতে পাঁচে নতুন এক সমস্যার উদ্ভব হল। বল ডেলিভারি দিতে বোলার ছুটছে, তার মাঝেই খেলা শেষ করা যায় কি না? দুই আম্পায়ার কিছুক্ষণ আলোচনা করে ঠিক করলেন, তা হলে সেটা বেআইনি হবে।
সুতরাং বিষ্টুর পাক দিয়ে দিয়ে দৌড়নো বন্ধ হল না। মাঠের ধারে লোক জমেছে। তাদের অনেকে বাড়ি চলে গেল। অনেক লোক খবর পেয়ে দেখতে এল। ব্যাটসম্যান। সান্ত্রীর মতো উইকেট পাহারা দিয়ে দাঁড়িয়ে। সন্ধ্যা নামল। বিষ্টু ছুটেই চলেছে। চাঁদ উঠল আকাশে। ফিল্ডাররা শুয়েছিল মাটিতে। ননীদা তাদের তুলে ছজনকে উইকেটকিপারের পিছনে দাঁড় করালেন, বাই রান বাঁচাবার জন্য। এরপর বিষ্টু বল ডেলিভারি দিল।
রূপোলির ব্যাটসম্যান অন্ধকারে ব্যাট চালাল এবং ফসকাল। সেকেন্ড শিপের পেটে লেগে বলটা জমে গেল। ননীদা চেঁচিয়ে উঠলেন, ম্যাচ ড্র।
রূপোলির ব্যাটসম্যান প্রতিবাদ জানিয়ে বলল, বল ডেলিভারির মাঝে যদি খেলা শেষ করা না যায়, তা হলে ওভারের মাঝেও খেলা শেষ করা যাবে না। শুরু হল। তর্কাতর্কি। বিষ্টুকে আরও পাঁচটা বল করে ওভার শেষ করতে হলে, জেতার জন্য রূপোলি একটা রান করে ফেলবেইবাই, লেগবাই, ওয়াইড যেভাবেই হোক। কিন্তু ননীদাকে দমানো সহজ কথা নয়। ফস্ করে তিনি আলোর অভাবের আপিল করে বসলেন। চটপট মঞ্জুর হয়ে গেল।
আমার ধারণা, মোনাদা কিছুটা রং ফলিয়ে আমাকে গল্পটা বলেছেন। আম্পায়ারদের সিদ্ধান্তগুলো, ফ্রেন্ডলি ম্যাচে হলেও, সঠিক হয়েছে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। কিন্তু ননীদাকে যারা ঘনিষ্ঠভাবে জানে, তারা কেউ এই ঘটনার সত্যতা নিয়ে খুব বেশি প্রশ্ন তুলবে না।