প্রথম ক্যাপটেনসি
এইবারই আমার প্রথম ক্যাপটেনসি। রীতিমতো ভয় ভয় করছে। এতকাল ননীদার আওতায় খেলে এসেছি, কোনও ভাবনাচিন্তা ছিল না। পাহাড়ের আড়ালে ছিলাম। এখন বুঝতে পারছি ননীদাকে কতখানি দরকার। আমার অনভিজ্ঞতার কথা বলে ওঁর সাহায্য প্রার্থনা করতেই, ননীদা একগাল হেসে পিঠে গোটা চারেক থাপ্পড় মারলেন।
অত ঘাবড়াবার কী আছে! এবারের টিম তো খুব খারাপ নয়! তা ছাড়া ম্যাচ জেতা কিংবা হার বাঁচানো, সেটা তো আর সব সময় টিমের শক্তি দিয়ে হয় না, হয়— ননীদা আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন, অনুক্ত শব্দটি পূরণ করে দেব এই আশায়।।
আমি বললাম, স্ট্র্যাটেজি।
ননীদা ভীষণ খুশি চাপতে চাপতে বললেন, পারবে, তুমি পারবে। তবে তুমি একটু ভিতু গোছের আর চক্ষুলজ্জাটা একটু বেশি। ওসব থাকলে কিন্তু বিপদ কাটিয়ে বেরোতে পারবে না।
সেইজন্যই তো আপনার কাছে এলাম।
ননীদা কয়েক মুহূর্ত ভেবে বললেন, স্ট্র্যাটেজি নির্ভর করবে স্থান, কাল আর পাত্র। বিচার করে। এজন্য তিনটে জিনিসের উপর জোর দেবে; এক আইনের ফাঁক খুঁজে বার করে তার সুযোগ নেওয়া। বেশির ভাগই তো ক্রিকেট আইন না জেনে খেলতে নামে, তা ছাড়া আইনের নানান ব্যাখ্যাও করা যায়। তুমি দেখো, অনেক ফাঁক বেরিয়ে পড়বে যেখান দিয়ে গলে যেতে পারবে। দুই, আম্পায়ারদের স্টাডি করবে। উকিলরা যেমন জজকে স্টাডি করে, তার মনের প্রবণতা, দুর্বলতার সুযোগ নেয়, তেমনি। সব আম্পায়ার যে আইনের মারপ্যাঁচ বোঝে তাও নয়। তা ছাড়া আইনের ব্যাখ্যা আর প্রয়োগ বেশ শক্ত ব্যাপার। মানুষ মাত্রই চাটু কথা পছন্দ করে, এটা ভুলে যেয়ো না। তিন অপোনেন্ট প্লেয়ারদের ঘাবড়ে দিয়ে নার্ভাস করা, ধাঁধায় ফেলা। ডবলু জি গ্রেস। এটা করত। জিততে হলে সব কিছু করতে হবে। ভদ্রতা করলে কোনও কিছুতেই জেতা যায় না, এই কথাটা বরাবর মনে রাখবে।
ননীদার উপদেশ শিরোধার্য করে বিদায় নিয়েছিলাম। না করে উপায় নেই। ওই তিন থিওরি অনুসরণ করে ননীদা যে কতবার সি সি এইচ-কে উদ্ধার করেছেন তার ইয়ত্তা নেই। কয়েকটার কথা জীবনে ভুলব না।
তরুণ মিলনের সঙ্গে খেলার কথা মনে পড়ল। ওদের ৪৮ রানে নামিয়ে দেওয়ার পর আমরা করলাম ৮ উইকেটে ৩২। হার অবধারিত। ননীদা তখন খেলতে নামলেন। আর একদিকে ব্যাট করছে অঞ্জন। ননীদা-নির্দেশিত টিউবওয়েল টেপা ফরোয়ার্ড ডিফেনসিভ খেলে প্রায় আধঘণ্টা উইকেটে রয়েছে। ননীদা ক্রিজে পৌঁছে বলে দিলেন, বলের লাইনে পা, মাথা নিচু, স্ট্রেট ব্যাট। বাকি যা করার আমি করছি।
এরপর ননীদা ননস্ট্রাইকার এন্ডে গিয়ে এগারো রানে ছয় উইকেট পাওয়া তরুণ মিলনের ওয়েস স হলের সঙ্গে আলাপ শুরু করলেন। আমাদের দুজনের কপালে আলু তৈরি এবং একজনের দুটি দাঁত কমিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে এই বোলারটিই দায়ী। বাইশপা দূরের বোলিং মার্কে ফিরে যাচ্ছে বোলারটি, ননীদাও তার সঙ্গে চললেন কথা বলতে বলতে।
অনেক বড় বড় স্পিনার দেখেছি—ভেরিটি থেকে শুরু করে প্রসন্ন পর্যন্ত, কিন্তু কোনও স্পিনারকে আপনার মতো এতটা দৌড়ে এসে বল করতে দেখিনি! ননীদা দারুণ বিস্মিত স্বরে বললেন।
স্পিনার! বোলারটি থেমে গেল। আমি স্পিনার? আপনি অন্ধ নাকি! আমার বল দেখে কি আপনার তাই মনে হল?
সেই রকমই তো লাগছে। নিরীহ মুখে ননীদা একগাল হাসলেন।
রাগে বোলারটির চোখ দুটি ঠিকরে বেরিয়ে আসার উপক্রম। কথা না বলে সে আবার বোলিং মার্কের দিকে চলল, সঙ্গে ননীদাও।
তবে মানতেই হবে, গুপ্তে কি রামাধিন কি বেনোর থেকে কিছুটা জোরে বল করেন।
মার্কে পৌঁছে বোলারটি ঘুরে দাঁড়াল। দুচোখ দিয়ে এবার আগুন বেরোচ্ছে। ননীদা ভ্রূক্ষেপ না করে বলে চললেন, আপনার বোলিং অ্যাকশন অনেকটা ফাস্ট বোলারেরই মতো, চেহারাটাও বেশ, তা হলে জোরে বল করেন না কেন?
আম্পায়ার? তরুণ মিলনের ওয়েস হল বাইশ পা দূর থেকে চিৎকার করে উঠল।
আপনি কি এ লোকটার কাণ্ড দেখতে পাচ্ছেন না? একে থামাবেন তো!
আম্পায়ার কী একটা বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই ননীদা চিৎকার করলেন, আম্পায়ার, আইনে কোথাও কি বলা আছে যে, বোলারের সঙ্গে কেউ হাঁটতে পারবে না?
মাথায় টোকা দিতে দিতে আম্পায়ার খুবই বিজ্ঞের মতো বলল, ঠিক ঠিক। আইনে বারণ করা নেই।
বোলারটি বিড়বিড়িয়ে কতকগুলো অনুচ্চার্য শব্দ মুখ থেকে নির্গত করে ছুটতে শুরু করা মাত্র ননীদাও ওর সঙ্গে সঙ্গে ছুটতে লাগলেন–নো বল যেন না হয়। বোলিং ক্রিজের দিকে নজর রাখুন।
তখনি বোলারটির দৌড়ের মধ্যে কী একটা গোলমাল হয়ে গেল, ফলে ডেলিভারির সময় ডান পা-টি বোলিং ক্রিজের এক হাত বাইরে বেরিয়ে গেল। অঞ্জন নো বল শোনামাত্র ননীদার নির্দেশ ভুলে গিয়ে চোখ বুজে ব্যাট চালাল। মাঠের সবাই মাথা তুলে দেখল, বলটি চমৎকারভাবে মিড উইকেট বাউন্ডারি টপকে ছটা রান সংগ্রহ করছে।
বোলারটি কটমট করে ননীদার দিকে তাকাতেই, ননীদা বিমর্ষ কণ্ঠে বললেন, বলেছিলুম বোলিং ক্রিজের দিকে নজর রাখুন। কথাটা শুনলেন না।
পরের বল দেবার জন্য বোলার বোলিং মার্কে যাবার সময় ননীদা আবার তার সঙ্গ নিল।
আম্পায়ার, দেখতে পাচ্ছেন না লোকটা কী করছে!
দেখেছি, আম্পায়ার উদাসী গলায় বলল, সঙ্গে সঙ্গে যাচ্ছে। আইনে বারণ করা নেই।
বল করার জন্য ছুটতে শুরু করামাত্র ননীদা চাপাস্বরে বললেন, এবার যেন নো বল না হয়, বোলিং ক্রিজে নজর রাখুন।
এবার নো বল হল না। কিন্তু বোলিং ক্রিজে চোখ রাখার ফলেই, বল হাত থেকে বেরিয়ে যে-পথ ধরে এগোল তাতে থার্ড স্লিপের পরলোকগমন অবশ্যম্ভাবী ছিল, যদি না সে বাপরে বলে গালির ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ত। আম্পায়ার ওয়াইড সঙ্কেত দেখাতে গিয়ে বাই বাউন্ডারির সঙ্কেত দেখাল।
আট উইকেটে ৪২। আর সাত রান করলেই আমাদের জিত। ননীদা ছায়ার মতো বোলারকে অনুসরণ করে চললেন। এবার বোলারটি আর সহ্য করতে না পেরে হাতা গুটিয়ে ননীদার দিকে এগোতেই, ননীদা ছুটে আম্পায়ারের কাছে এসে বললেন, দেখুন, মারতে আসছে।
ইউ ব্লাডি…(ছাপার অযোগ্য) …ইউ উল্লুক…(ছাপার অযোগ্য)…খুন করে ফেলব।
শুনলেন আম্পায়ার, শুনলেন!ননীদা ঢালের মতো আম্পায়ারকে সামনে রেখে চেঁচাতে লাগলেন। ক্রিকেটের মতো খেলায় এই রকম অসভ্য গালাগাল!
নিকুচি করেছে তোর ক্রিকেটের। বোলারটি সোজা এক রাইট হুক চালাল। ননীদা দক্ষতার সঙ্গে ঢালের আড়ালে আশ্রয় নিলেন। আম্পায়ার বাবা রে আর্তনাদ করে ধীরে ধীরে বাঁ গালে হাত চেপে বসে পড়ল।
এক সপ্তাহ পরে আম্পায়ারের রিপোর্টের ভিত্তিতে সি এ বি লিগ সাব কমিটি আমাদের পুরো পয়েন্ট দেয়। বোলারটি এক বছরের জন্য সাসপেন্ড হয়। তখন ননীদা শুধু বললেন, ট্যাকটিকস্।
স্বীকার করতে লজ্জা নেই, আমার দ্বারা এইরকম ট্যাকটিকস্ উদ্ভাবন সম্ভব নয়। কথাবার্তা ভাল করে গুছিয়ে বলতে পারি না, গায়ে পড়ে আলাপও জমাতে পারি না। অথচ ননীদার ট্যাকটিকস্ প্রয়োগ করতে হলে কথা বলাটাকে যে শিল্পের পর্যায়ে উঠিয়ে আনতে হবে, সেটা একবার হৃদয়ঙ্গম করেছিলাম ইস্ট সাবার্বানের সঙ্গে খেলায়।
মাঠে নামার মুখে আম্পায়ার দুজনের মধ্যে যে বয়স্ক, ননীদা তার সঙ্গে আলাপ শুরু করে দিলেন।
আরে অনেকদিন পর দাদার সঙ্গে দেখা হল, আছেন কেমন?
আর থাকা। চলে যাচ্ছে একরকম করে। আপনি কেমন আছেন? আম্পায়ার যথোচিত সৌজন্য দেখাল।
আপনি যা বললেন, চলে যাচ্ছে একরকম করে। ননীদা ঝট করে গলা নামিয়ে ফেলে বললেন, বুড়ো বয়সেও খেলতে নামতে হচ্ছে। এখনকার ছোকরারা কিসসু জানে না। বোঝেও না। আমাকে এখনও ঠেকা দিয়ে যেতে হচ্ছে। স্টান্ডার্ড যে কোথায় নেমে গেছে, আপনাকে আর বোঝাব কী, নিজের চোখেই তো দেখছেন।
আম্পায়ার অনুমোদনসূচক মাথা নাড়ল।
ক্রিকেট খেলতে আসে অথচ ক্রিকেটের আইন জানে না। আজেবাজে অ্যাপিল করে, ঝগড়া করে, জোচ্চুরি করে, খেলাটাকেই মাটি করে দেয়; যাকগে ওসব কথা, বাতের ব্যথাটা এখন কেমন?
মাঝে মাঝে চাগাড় দিচ্ছে। আম্পায়ার যথেষ্ট অবাক হয়েই বলল। অবাক হবার কারণ, ননীদা জানল কী করে?
আমাদের পাড়ায় এক কোবরেজের অদ্ভুত একটা তেল আছে। আমার কাকিমার পনেরো বছরের পুরনো বাত, মাত্র দু হপ্তা ব্যবহার করেই সেরে গেল।
সত্যি! আম্পায়ার ব্যস্ত হয়ে বলল, ঠিকানাটা দেবেন?
উহুঁ। ননীদা দুষ্টু দুষ্টু হেসে বললেন, কোবরেজের ঠিকানা নয়, আপনার ঠিকানা দিন। তৈরি করিয়ে আমি নিজে আপনাকে দিয়ে আসব। খেলার শেষে বরং আমাকে লিখে দেবেন।
এইখান থেকেই ইস্ট সাবার্বানের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেল। ননীদা যখন বল করতে এলেন, তখন সাবার্বানের বিনা উইকেটে ৪১ রান। ওর প্রথম বলটা অনেকখানি ঘুরল, অফ স্টাম্প থেকে শর্ট ফাইন লেগে। সুইপ করতে গিয়ে ব্যাটসম্যান ফসকাল এবং প্যাডে লাগল। আম্পায়ারের দিকে ঘুরে ননীদা দুহাত ভুলেই জিভ কাটলেন। তারপর মাথা নাড়তে নাড়তে যেন নিজের মনেই বললেন, হয়নি হয়নি, আপিল করা চলে না। বেরিয়ে যাচ্ছিল বল। তারপর বেশ গম্ভীর হয়ে আম্পায়ারকে বললেন, এখনকার ছোকরারা আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করত।
বাতের হাত থেকে মুক্তিকামী আম্পায়ার দ্রুত ঘাড় নেড়ে ননীদাকে খুশি করল। দুটি বল পরেই অফ স্টাম্পের এক হাত বাইরে, ব্যাটসম্যান প্যাড প্লে করতেই ননীদা ফিয়ে হা-আ-আ-উ বলেই হাত দিয়ে মুখ চেপে আপিলটা আর সম্পূর্ণ করলেন না। ঘাড় বেঁকিয়ে বলের পিচের দিকে ২৫ সেকেন্ড তাকিয়ে রইলেন। তারপর প্রায় অনুনয়ের সুরে বললেন, ইগনোর ইট আম্পায়ার, কমপ্লিটলি ইগনোর দ্য আপিল। সরি, ভেরি সরি আপনাকে বিরক্ত করার জন্য।
তাতে কী হয়েছে, উত্তেজনায় ও রকম মুখ থেকে বেরিয়ে যায়ই। আম্পায়ার সান্ত্বনা দিয়ে বলল।
কিন্তু কেন বেরোবে? ননীদা অনুশোচনায় দগ্ধ হতে হতে বললেন, ডেড শিওর না হয়ে কেন আপিল করব?
ওভার শেষে মাথা নাড়তে নাড়তে ননীদা মিড অনে গিয়ে দাঁড়ালেন। আম্পায়ার গেল স্কোয়ার লেগে। পরের ওভারের দ্বিতীয় বলে ব্যাটসম্যানরা বিপজ্জনক একটি রান নিল। ননীদা বলটা উইকেটকিপারকে ছুড়তেই সে যখন উইকেট ভেঙে দিল, নন-স্ট্রাইকার তখন পপিং ক্রিজে পৌঁছে, পেরিয়ে গেছে। ননীদা চিৎকার করে উঠলেন রান আউটের আপিল করে। স্কোয়ার লেগ আম্পায়ার দ্বিধা না করে আঙুল তুলল।
গুড ডিসিশ্যান। ননীদা আম্পায়ারকে শুনিয়ে তারিফ করলেন। বিস্মিত ব্যাটসম্যানটি আম্পায়ারের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে রওনা হল। আমি ছিলাম সেকেন্ড শ্লিপে। এমন ডাহা বাজে রানআউট কল্পনা করা যায় না। একসময় ননীদাকে চাপা গলায় বললাম, ব্যাপার কী?
সাইকোলজি। ননীদা জবাব দিলেন।
ওর বাত আছে, সেটা কি জানতেন?
একদমই নয়। তবে পঞ্চাশ বয়সের উপর শতকরা ষাটটা বাঙালিরই তো বাত, নয়তো অম্বল আছে। তেল নয়তো বড়ি, দুটোর একটা লেগে যাবেই।
যদি লোকটার বাত না থাকত?
তা হলে ওর বাবা মা জ্যাঠা জ্যাঠি কারুর না কারুর তো পাওয়া যাবেই।
ননীদার আপিলে সেই আম্পায়ারের কাছ থেকে চারটি এল বি ডবল্যু, দুটি কট বিহাইন্ড, একটি স্টাম্পিং ও দুটি রানআউট পেয়ে আমরা বিনা উইকেটে ৪১ রানের ইস্ট সাবার্বানকে ৬২ রানে নামিয়ে দিলাম।
কয়েকদিন পরে ননীদাকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম, তিসির তেলে রসুন, গোবর, কাঁচা লঙ্কাবাটা মিশিয়ে এক শিশি পাঠিয়ে দিয়েছেন আম্পায়ারকে। আমরা পরে ননীদার এই সব ট্যাকটিকসের নাম দিয়েছিলাম—ননীটিক্স্।
আর একটি ননীটিকসও সিজনের প্রথম খেলার দিন সকালে মনে পড়ে গেল। ব্যাটসম্যান যখন খেলার জন্য তৈরি হচ্ছে এবং বোলার বল করায় উদ্যত, তখন সেকেন্ড শ্লিপ থেকে উইকেটকিপারের সঙ্গে ননীদার কথা বলে যাওয়া। ব্যাটসম্যান বল খেলুক, খেলতে গিয়ে ফসকাক বা ইচ্ছে করে ছেড়ে দিক ননীদা কিন্তু সমানে আ হ হ হ, উ হ হ হ, ই স্ স্ স, আর একচুল যদি বলটা ঘুরত, এবার নির্ঘাত গালিতে হয়ে যাবে ইত্যাদি রানিং কমেন্টারি করে যাবেনই। স্টাম্পের এক গজ বাইরে দিয়ে বল বেরিয়ে গেলেও এমন করবেন যেন উইকেট ভেদ করে গেল।
নতুন ব্যাটসম্যান উইকেটে এসে দেখত ননীদা ভুরু কুঁচকে গম্ভীর মুখে গুডলেংথের কাছাকাছি একটা জায়গার দিকে তাকিয়ে। তারপর ব্যাটসম্যানকে শুনিয়ে আমাকেই বলতেন, একই রকম আছে হে মতি, ঠিক সেই রকম। কালও দুর্যোধনকে পইপই বলেছি, ভাল করে রোলার টানবি, নয়তো কোনদিন যে মানুষ খুন হবে কে জানে।
এই সময় আমার কাজ হল লক্ষ করা–ব্যাটসম্যান উৎকর্ণ হয়েছে কি না। যদি হয় তা হলে বলব, সত্যিই খেলা যায় না। তপনের কথা ভাবলে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে…ভাল কথা, ননীদা কাল হাসপাতালে গেছলেন?
না গেলেই ভাল ছিল, চোয়ালটা ঠিকমতো সেট হয়নি, মুখটা বেঁকে আছে। সামনের দাঁত দুটোরও কিছুই করার নেই।
তা হলে চিত্তকে আস্তে বল করতে বলুন। আমি ভীষণভাবে উদ্বেগ দেখাই।
এখনও তো বল লাফায়নি। আগে দেখি লাফায় কি না।
এরপর ব্যাটসম্যানের টিকে থাকা বা না থাকা নির্ভর করে তার নার্ভের ক্ষমতার উপর। তবে প্রায় ক্ষেত্রেই দু ওভারের মধ্যেই তারা ফিরে যায়। ননীদা তাঁর এই ট্যাকটিককে বলেন—প্রােপাগান্ডা।
আমার প্রথম ম্যাচ, ভ্রাতৃসঙ্ঘের বিরুদ্ধে ননীদার প্রােপাগান্ডা ট্যাকটিকস্ প্রয়োগ করলাম। ওদের সাত নম্বর ব্যাটসম্যানটি এগারো রান করে আট ঘন্টা ধরে অটল অনড় হয়ে রীতিমতো জ্বালাচ্ছে। শুরু করলাম নতুন উইকেটকিপার বিষ্টু মিশ্রের সঙ্গে পিচের ভয়াবহতা এবং গত ম্যাচে তপনের মুখমণ্ডল কী আকৃতি ধারণ করেছে, সেই বিষয়ে উদ্বেগজনক আলোচনা। বিষ্টু রীতিমতো অবাক হয়ে বলল, তপন তো লং অনে ফিল্ডিং করছে।
চট করে লক্ষ করলাম, ব্যাটসম্যানটি আমাদের দিকে তাকিয়ে লাজুক হাসি হাসছে। তাতে বেশ খানিকটা ঘাবড়ে গেলাম। অবশেষে আর থাকতে না পেরে পরের ওভারে তাকে বললাম, পিচটা খুবই খারাপ, তাই না?
ব্যাটসম্যান লাজুক হাসল।
আগের ম্যাচে আমাদের বেস্ট ডিফেনসিভ ব্যাট তপন ঘোষের চোয়াল আর দাঁত ভেঙেছে। মালীটাকে এবার তাড়াতেই হবে, কিসসু কাজ করে না।
ব্যাটসম্যান আবার লাজুক হাসল। তারককে অবশ্য বলে দিয়েছি, ওভারপিচ হয় হোক, তবু ওই স্পটে যেন বল না ফেলে। ম্যাচ জেতার জন্য তো আর মানুষ খুন করা যায় না?
ব্যাটসম্যান এবারও হাসল আরও জড়োসড়ো হয়ে। আমি অপ্রতিভ হয়ে চুপ করে গেলাম। পরের ওভার শুরুর আগে অপর ব্যাটসম্যানকে বললাম, আপনার পার্টনারটি কেমন লোক মশাই, একটা কথারও জবাব দেয় না, শুধু হাসে?
সখেদে উত্তর পেলাম, আমাদেরও এই একই মুশকিল হয়, হাবু একদমই কালা আর বোবা।
ননীটিকসকে এই প্রথম ব্যর্থ হতে দেখলাম!