Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

পরের দিন সোয়া নটা নাগাদ

পরের দিন সোয়া নটা নাগাদ সুশীল চক্রবর্তী এসে হাজির হলেন কিরীটীর বাড়িতে।

কিরীটী প্রস্তুত হয়েই ছিল, সুশীল চক্রবর্তীর জীপে উঠে বসল।

হিন্দুস্থান রোডের বাড়ির দরজায় দুজন সেপাই পাহারায় ছিল এবং একজন অন্দরে ছিল। জীপ থেকে সুশীল চক্রবর্তীকে নামতে দেখে তারা সেলাম জানাল। কিরীটীকে নিয়ে সুশীল চক্রবর্তী বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করলেন।

প্রথমেই ওরা সুশান্ত মল্লিক যে ঘরটায় থাকে সেই নীচের ঘরটায় উঁকি দিলেন। সুশান্ত মল্লিককে ঘরের মধ্যে দেখা গেল না। ইতিমধ্যে জীপের শব্দে রতন ওপর থেকে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে এসেছিল। সুশীল চক্রবর্তী রতনকেই প্রশ্ন করলেন, সুশান্তবাবুকে দেখছি না, কোথায় তিনি?

—আজ্ঞে সকালে যখন চা দিই তখন তো ছিলেন। তবে গতকাল তিনি বলেছিলেন এ বাড়িতে তিনি আর থাকবেন না, চলে যাবেন।

-কেন, তার কোন অসুবিধা হচ্ছে নাকি?

—না বাবু অসুবিধা হবে কেন। মানদার হাতেই তো সংসার খরচের টাকা থাকত, এখন যা আছে এ মাসটা চলে যাবে। তবে ওনার তো আবার বোতলের ব্যাপার আছে। সন্ধ্যেবেলা—মানদা তো সে সব কিছু দিচ্ছে না। বোধ হয় সেইজন্যেই–

সুশীল চক্রবর্তী হাসলেন। ঠিক সেই সময় দেখা গেল সুশান্ত মল্লিক দোতলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে। সুশীল চক্রবর্তীকে দেখে সুশান্ত বললে, এই যে দারোগাবাবু, আপনি আমার ওপরে কেন জুলুম করছেন বলুন তো?

-জুলুম?

–নয়? বাড়ি থেকে বেরুতে পারব না, এটা জুলুম ছাড়া আর কি বলুন তো?

কিরীটী চেয়ে চেয়ে দেখছিল লোকটাকে। মুখে বেশ দাড়ি গজিয়েছে খোঁচা খোঁচা। বোধ হয় কয়েকদিন কোন ক্ষৌরকর্ম না করায়। পরনের জামা ও পায়জামাটা ময়লা। একমাথা ঝাকড়া ঝাকড়া চুল, মনে হয় অনেকদিন চিরুনির স্পর্শও পড়েনি।

কিরীটী চুপিচুপি সুশীল চক্রবর্তীকে বললে, এই বোধ হল মালঞ্চর স্বামী?

-হাঁ দাদা।

–লোকটাকে ছেড়ে দাও। তবে নজর রেখো-

-কিন্তু দাদা, যদি ভাগে, আমি তো ভেবেছিলাম এবারে ওকে অ্যারেস্ট করব। নিম্নকণ্ঠে কথাগুলো বললেন সুশীল।

–সুশান্তবাবু—

কিরীটীর ডাকে সুশান্ত মল্লিক তাকাল জাকুটি করে।

–আপনাকে আমরা ছেড়ে দেবার কথা ভাবতে পারি, যদি ঠিক ঠিক আপনার কাছ থেকে যেগুলো জানবার জন্যে এসেছি সেগুলোর জবাব দেন।

-মানে আপনি সেদিন সে সব কথা বলেছেন, সব আমরা একেবারে পুরোপুরি সত্য বলে মেনে নিতে পারছি না। কিরীটীই জবাব দিল।

—আমি কিছু জানি না—বলতে বলতে কিছুক্ষণ কিরীটীর দিকে তাকিয়ে থেকে সোজা নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকল সুশান্ত মল্লিক।

সুশীল চক্রবর্তী ঐ ঘরের দিকেই এগুচ্ছিলেন কিন্তু বাধা দিল কিরীটী। বললে, আগে চল সুশীল, বাড়িটা একবার ঘুরে দেখি, আর সেই ঘরটা

সুশীল চক্রবর্তী সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন, কিরীটী সুশীল চক্রবর্তীর পিছনে এগোলেন। হঠাৎ কিরীটীর নজর পড়ল নীচের একটা তালাবন্ধ ঘরের বন্ধ জানলার দিকে—কবাট দুটো ঈষৎ ফাঁক, আর সেই সামান্য ফাঁকের মধ্যে দিয়ে উঁকি মারছে চোখ। সেই চোখের দৃষ্টিতে যেন তীক্ষ্ণ সন্ধানী দৃষ্টি। কিরীটী থমকে দাঁড়াল।

কিরীটীকে থামতে দেখে সুশীল বললেন, কি হল দাদা, ওপরে চলুন—

–সুশীল, চল তো নীচের ঐ ঘরটা আগে দেখি। বলে বন্ধ দরজার ঘরটা কিরীটী দেখিয়ে দিল।

—ঐ তালাবন্ধ ঘরটা?

–হ্যাঁ। চাবি নেই তোমার কাছে?

–না তো।

—তাহলে ঐ ঘরের তালার চাবি কোথায় পাওয়া যাবে?

ওদের কাছেই অল্প দূরে রতন দাঁড়িয়ে ছিল। তার দিকে তাকিয়ে সুশীল চক্রবর্তী। শুধালেন, ঐ ঘরের তালার চাবি কোথায়?

—তা তো জানি না হুজুর–

—ঐ ঘরে তালা দেওয়া কেন?

–তা জানি না হুজুর, ঐ ঘরটা তালা দেওয়াই থাকে, বরাবর–

—মানদাকে ডাকো তো, সে হয়তো জানে ঐ ঘরের তালার চাবি কোথায়।

ঠিক ঐ সময় মানদাকে দোতলার সিঁড়ির মাথায় দেখা গেল। রতন মানদাকে দেখতে পেয়ে বললে, বাবু, ঐ যে মানদা—

বলতে বলতে মানা সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসে।

–মানদা, ঐ ঘরের তালার চাবিটা কোথায়?

—আমি তো জানি না বাবু। মানদা বলল।

—ঐ ঘরের তালার চাবিটা কোথায় তুমি জানো না? কিরীটীর আবার প্রশ্ন?

—না, আমি এখানে আসা অবধি দেখছি, ঐ দরজায় ঐ ভাবেই তালা ঝোলে।

—কখনো কাউকে দরজা খুলতে দেখনি?

—না বাবু—

কিরীটী এবার সুশীল চক্রবর্তীর দিকে তাকাল—সুশীল, তোমার কাছে তো সেই– চাবির রিংটা আছে, সঙ্গে এনেছ?

—হ্যাঁ, এই নিন। সুশীল চক্রবর্তী অনেকগুলো চাবি সমেত একটা রুপোর চাবির রিং পকেট থেকে বের করে কিরীটীর হাতে তুলে দিল। কিন্তু রিংয়ের কোন চাবির সাহায্যেই . ঘরের তালাটা খোলা গেল না। এমন কি চাবির থোকার কোন চাবিই তালাতে প্রবেশ করানোও গেল না। অথচ তালাটা দেখে কিরীটীর মনে হয় তালাটা সর্বদাই খোলা হয়। তালাটার চেহারা দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকার মত নয়।

—কোন চাবিতেই তো তালাটা খুলছে না দাদা।

—কোন চাবি না লাগলে আর কি করা যাবে, তালাটা ভাঙতে হবে—কিরীটী শান্ত গলায় কথাগুলো বলে পর্যায়ক্রমে একবার অদূরে দণ্ডায়মান রতন আর মানদার মুখের দিকে তাকাল।

গভরেজের মজবুত বড় তালা, তালাটা ভাঙা অত সহজ হল না। একটা লোহার রড দিয়ে প্রায় পনেরো-কুড়ি মিনিট ধস্তাধস্তি করার পর তালাটা ভাঙা গেল, তাও দুজন সিপাইয়ের সাহায্যে। এবং অত যে শব্দ করে তালাটা ভাঙা হল তবু ঠিক তার পাশের ঘরে থেকেও সুশান্ত. মল্লিকের কোন সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না বা সে এসে ব্যাপারটা জানবারও কোন চেষ্টা করল না।

ঘরটা অন্ধকার ছিল, জানালা দরজা বন্ধ থাকায় কিরীটী সুশীল চক্রবর্তীকে বলল, দেখ তো সুশীল, ঘরের আলোর সুইচটা কোথায়

হাতড়াতে হাতড়াতে সুইচটা পাওয়া গেল। খুট করে সুইচ টিপতেই একটা ড়ুম ঢাকা একশো পাওয়ারের বাতি জ্বলে উঠল।

ঐ ঘরটা ঠিক মালঞ্চর দোতলার শোবার ঘরের নীচেই। পরে সেটা বুঝেছিল কিরীটী। মাঝারি সাইজের ঘরটি, ঘরের মধ্যে মাত্র একটি দেওয়াল-আলমারি, তার পাল্লায় চাবি লাগানো। এ ছাড়া ঘরের মধ্যে আর অন্য কোন আসবাবপত্র নেই।

দেখলে মনে হয় ঘরটা কেউ কখনও ব্যবহার করে না। গোটাচারেক জানালা, সব জানালারই পাল্লা বন্ধ। দুটি দরজা, যে দরজার তালা ভেঙে একটু আগে তারা প্রবেশ করেছে তার ঠিক উল্টো দিকে আর একটা দরজা।

দরজাটা খোলাই ছিল, এবং পাল্লা ধরে টানতেই খুলে গেল। দরজাটার পিছনে একটা সরু ফালিমত যাতায়াতের পথ এবং সেই পথের ওপরেই মেথরদের দোতলায় যাবার ঘোরানো লোহার সিঁড়ি।

কিরীটীর বুঝতে কষ্ট হল না ব্যাপারটা। সে ভুল দেখেনি, কিছুক্ষণ আগে ঐ ঘরের ঈষৎ ফাঁক করা জানালার কপাটের আড়াল থেকে যে চক্ষুর দৃষ্টি সে দেখেছিল, সে যে-ই হোক, এই ঘরের মধ্যেই সে ছিল এবং পিছনের ঐ দরজাপথেই সে অন্তর্হিত হয়েছে।

—সুশীল—

—কিছু বলছেন দাদা?

-এখন বুঝতে পারছ তো, সে রাত্রে ঐ গলিপথ দিয়েই দীপ্তেন ভৌমিক সকলের অজ্ঞাতে বের হয়ে গিয়েছিল!

-ঐ সিঁড়িটা দিয়ে?

-খুব সম্ভবত, কিরীটী বললে, হা সে রাত্রে ঐ সিঁড়ি দিয়েই দীপ্তেন মালঞ্চর ঘর থেকে বের হয়ে এসেছিল। আর আজ কিছুক্ষণ আগে এই ঘরের মধ্যে যে ছিল সে-ও ঐ দরজা আর ঐ সিঁড়ি ব্যবহার করেছে–

—এই ঘরের মধ্যে কেউ ছিল নাকি?

–হ্যাঁ। আর এ বাড়িতে এখন যারা আছে সে তাদেরই মধ্যে একজন কেউ।

–কে বলুন তো দাদা?

—জানি না, তবে এ সময় এই ঘরের মধ্যে সে কেন এসেছিল তাই ভাবছি—

—হয়তো আমাদের প্রতি নজর রাখবার জন্য।

–না। আমার ধারণা তার এ ঘরে আসার অন্য কোন উদ্দেশ্য ছিল এবং আমাদের। সাড়া পেয়ে এবং জানলার কপাট ঈষৎ ফাঁক করে আমাদের দেখতে পেয়েই সরে পড়েছে। তবে বাড়ির বাইরে সে নিশ্চয়ই যায়নি। চল তো, ঘরের আলমারিটা একবার পরীক্ষা করে দেখা যাক।

ঐ চাবির রিংয়ের মধ্যেই একটা চাবি দিয়ে আলমারিটা খুলে ফেলা গেল। একটা তাকে থরে থরে সাজানো কতকগুলো কার্ড-বোর্ডের বাক্স। অনেকটা সিগারেটের বাক্সর মত।

কিরীটী হাত বাড়িয়ে একটা বাক্স নিয়ে বাক্সর ঢাকনাটা খুলতেই দেখা গেল তার দেখা সুন্দর পরিপাটী করে সাজানো সব লম্বা লম্বা সিগারেট।

সুশীল চক্রবর্তী বললেন, এ সব তো সিগারেট দেখছি—

কিরীটী কোন কথা না বলে একে একে সব বাক্সগুলোই খুলে ফেলল। গোটা দশেক বাক্সের মধ্যে ছটা খালি, বাকি চারটের মধ্যে সিগারেট রয়েছে, তার মধ্যে একটায় অর্ধেক।

–কি ব্যাপার বলুন তো দাদা, এখানে এই আলমারিতে এত সিগারেট কেন?

–আমার অনুমান যদি মিথ্যে না হয় তো কিরীটী মৃদু কণ্ঠে বলল, এগুলো সাধারণ সিগারেট নয় সুশীল, এগুলো মনে হচ্ছে নিষিদ্ধ নেশার সিগারেট-হ্যাসিস–চরস ইত্যাদি দিয়ে যে-সব নেশার জন্য তৈরী সিগারেট গোপন পথে চলাচল করে এগুলো তাই—সেই জাতীয় সিগারেট–নিষিদ্ধ বস্তু–

সুশীল চক্রবর্তী নিঃশব্দে সিগারেটগুলোর দিকে একভাবে তাকিয়ে থাকে।

কিরীটী বললে, মনে হচ্ছে এ বাড়িতে থেকে এই নিষিদ্ধ বস্তুর লেনদেন হত। আমি ভাবছি সুশীল, শেষ পর্যন্ত এর মধ্যেই মালঞ্চর হত্যার বীজ লুকিয়ে ছিল না তো!

—এই সিগারেটের মধ্যে?

–হ্যাঁ। এই সিগারেটকে কেন্দ্র করেই হয়তো মৃত্যুগরল ফেনিয়ে উঠেছিল। এগুলো নিয়ে চল। আর এই সিগারেটগুলোর মধ্যে থেকে আজই একটা অ্যানালিসিসের জন্যে

পাঠিয়ে দাও।

তারপর একটু থেমে কিরীটী বললে, হয়তো এগুলো সরাবার জন্যেই এখানে সে এসেছিল আজও। কয়দিন ধরেই হয়তো চেষ্টা করছিল এগুলো সরাবার, কিন্তু চাবির রিং তোমার পকেটে থাকায় সুবিধা করতে পারেনি। চল, এবার ওপরে যাওয়া যাক।

সুশীল চক্রবর্তী ভাঙা দরজাটার দিকে এগুচ্ছিলেন। কিরীটী বাঁধা দিয়ে বললে, না, ও দরজা দিয়ে না, চল পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে লোহার সিঁড়ি দিয়ে আমরা ওপরে যাব–

সেই মতই ওরা ওপরে উঠে এলো, লোহার ঘোরানো সিঁড়ি পথ।

কিরীটীর অনুমান মিথ্যা নয়। দেখা গেল নীচের সেই ঘরটার ওপরের ঘরটাই মালঞ্চর শয়নকক্ষ। বাথরুম দিয়েই ওরা ঘরে ঢুকল, দরজা খোলাই ছিল বাথরুমের।

—দাদা, আপনি সত্যিই নীচের ঘরে কাউকে দেখেছেন?

—একটি চক্ষু—শ্যেন দৃষ্টি ছিল সেই চোখের তারায়—কিরীটী বললে, চোখাচোখি যখন একবার হয়েছে তখন পালাতে সে পারবে না। চল, ঘরের ভিতরটা আর একবার আজ দুজনে মিলে খুঁটিয়ে দেখা যাক।

ঘরের মধ্যে পা দিয়েই কিরীটীর নজর পড়ল ঘরের মধ্যে অ্যাশট্রেটার ওপরে-সোফাসেটের মাঝখানে একটি ছোট ত্রিপয়ের বেলজিয়ামের কাটগ্লাসের সুদশ্য একটি অ্যাশট্রে, তার মধ্যে চার-পাঁচটা দগ্ধাবশেষ সিগারেটের টুকরো পড়ে আছে। একটা টুকরো হাতে তুলে নিয়ে কিরীটী দেখল—বিলাতী সিগারেট-স্টেট এক্সপ্রেস ৫৫৫।

সুশীল, তোমার নিহত নায়িকার ধূমপানের অভ্যাস ছিল নাকি?

–জানি না তো–

—জিজ্ঞাসা করনি?

–না।

–জিজ্ঞাসা করাটা উচিত ছিল ভায়া। তার যদি ধূমপানের অভ্যাস না থাকে তবে এগুলো কার সিগারেটের দগ্ধাবশেষ? হয় সুরজিৎ ঘোষালের, না হয় দীপ্তেন ভৌমিকের নিশ্চয়।

—সুশান্ত মল্লিকেরও তো হতে পারে দাদা–

–মনে হয় না। কারণ যে পরমুখাপেক্ষী, তার ভাগ্যে স্মাল করা বিলাতী সিগারেট জুটত বলে মনে হয় না। স্পেশাল ব্রান্ডের সিগারেট যখন, তখন এই বঁড়শীর সাহায্যেই মাছকে খেলিয়ে ডাঙায় টেনে তোলা কষ্টকর হবে না—কথাগুলো বলে কতকটা যেন আপন মনেই কিরীটী ঘরের চতুর্দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাতে লাগল। সুশীল চক্রবর্তীর মুখে শোনা ঘরের বর্ণনার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে সব কিছু।

—সুশীল, তুমি এই ঘরের বাইরে থেকে লক করে গেলেও এ ঘরে প্রবেশাধিকার তুমি বন্ধ করতে পারনি, বুঝতে পারছ বোধ হয়! কই দেখি তোমার চাবির গোছা–

সুশীল চক্রবর্তী পকেট থেকে চাবির রিংটা কিরীটীর হাতে তুলে দিলেন।

-ঐ আলমারির চাবি কোন্‌টা সুশীল?

সুশীল চাবিটা দেখিয়ে দিলেন এবং চাবির সাহায্যে কিরীটী আলমারিটা খুলে ফেলল। দুটি ড্রয়ার, দুটি ড্রয়ারই একে একে খুলে তার ভেতরের সব কিছু পরীক্ষা করে দেখতে লাগল কিরীটী।

কিন্তু ড্রয়ারের মধ্যে সুশীল চক্রবর্তী সেদিন অনুসন্ধান চালিয়ে যা পেয়েছিলেন তার চাইতে বেশী কিছু পাওয়া গেল না। কিরীটী তবু অনুসন্ধান চালিয়ে যায়…

—কি খুঁজছেন দাদা? সুশীল প্রশ্ন করল।

–ব্যাঙ্কের পাসবই। মালঞ্চর নিশ্চয়ই একাধিক ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট ছিল।

—একটা তত পেলেন।

–যেখানে নিষিদ্ধ চোরাই দ্রব্যের কারবার, সেখানে ব্যাঙ্ক-ব্যালেন্স মাত্র হাজার দুইতিন থাকাটা ঠিক যেন বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না। চোরাই কারবারের লেনদেনের নিট ফল অত সামান্য তো হতে পারে না।

শেষ পর্যন্ত দেখা গেল কিরীটীর অনুমানই ঠিক। মালঞ্চর নামে চার-পাঁচটা ব্যাঙ্কের পাসবই পাওয়া গেল। কিছু ফিক্স ডিপোজিটের কাগজপত্র পাওয়া গেল সেই সঙ্গে।

সুশীল চক্রবর্তী বললেন, এ যে দেখছি অনেক টাকা দাদা—

কিরীটী বলল, হ্যাঁ যোগফল তাই দাঁড়াচ্ছে। শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা দেখা যাচ্ছে বেশ জটিলই হয়ে উঠল সুশীল—চোরাকারবার, হত্যা, সুন্দরী এক নারী, তিনটি পুরুষ মক্ষিকা সেই নারীকে ঘিরে, ভুলে যেও না।

ব্যাঙ্কের পাসবইগুলো সঙ্গে নিয়ে ওরা দুজনে দোতলা থেকে আগে সিঁড়ি পথেই নীচের তলায় নেমে এসে সুশান্ত মল্লিকের ঘরে ঢুকল।

সুশান্ত মল্লিক তার ঘরের মধ্যে বসে ধূমপান করছিল; সামনেই চৌকির ওপরে একটা সোনার সিগারেট কেস ও একটা ম্যাচ। ওরা ঘরে ঢুকতেই সুশান্ত মল্লিক ওদের দিকে– তাকাল। তার মুখের দিকে তাকালেই বোঝা যায় সুশান্ত মল্লিক একটু যেন বিরক্ত হয়েছে, কিন্তু কোন কথা বলল না।

—কি সুশান্তবাবু, কি ঠিক করলেন? কিরীটী বলল।

—কিসের কি ঠিক করব?

—পুলিসকে সাহায্য করলে হয়তো আপনি এই ফ্যাসাদ থেকে মুক্তি পেলেও পেয়ে যেতে পারেন।

-আমি যা জানি সবই তো বলেছি—

—কিন্তু আপনার কাছ থেকে আমাদের আরো যে কিছু জানবার আছে। সুশান্তবাবু—কিরীটী বলল।

—আমি আর কিছুই জানি না।

–বেশ, তাই না হয় মেনে নিলাম। এবার আমার কয়েকটা প্রশ্নের জবাব দিন।

——কি প্রশ্ন?

–মালঞ্চ নিজেই নিজের গাড়ি ড্রাইভ করতেন, গাড়ি নিয়ে তিনি মাঝেমধ্যে নিশ্চয়ই বেরুতেন, তিনি কোথায় যেতেন জানেন?

—সিনেমা, থিয়েটার, বন্ধুবান্ধবদের বাড়িতে যেতে হয়তো।

—আর কোথাও যেতেন না—যেমন ধরুন কোন ক্লাব বা রেস্তোরাঁ–

—একটা নাইট ক্লাবে মাঝে-মধ্যে সে যেতো জানি। ক্লাবটা বালিগঞ্জ সারকুলার। রোডে

–হুঁ বুঝেছি। ক্লাবটার নাম দি রিট্রিট, তাই না? A notorious night club! আচ্ছা, মালঞ্চদেবী ড্রিংক করতেন না মিঃ মল্লিক?

–করত বোধ হয়—

–আপনি দেখেননি কখনো?

–সামান্য বেসামাল অবস্থায় মাঝে-মধ্যে অনেক রাত্রে বাড়ি ফিরতে দেখেছি তাকে, কিন্তু মদ্যপান করতে দেখিনি।

–দীপ্তেনবাবু আর সুরজিৎ ছাড়া অন্য কোন পুরুষের এ বাড়িতে যাতায়াত ছিল কি?

–সমীর রায় নামে একজন বিলেত ফেরত ডাক্তার আর এক তরুণ মারোয়াড়ীকে কালেভদ্রে এখানে আসতে দেখেছি।

–আর কেউ?

—একজন অভিনেত্রী দু-একবার এসেছে—

–কি নাম তার?

–ডলি দত্ত, বোধ হয় তার নাম।

–আচ্ছা মালঞ্চ দেবী ধূমপান করতেন?

—কখনো দেখিনি

—হুঁ! আপনি এ বাড়ি থেকে বেরুতে চান মাঝে-মধ্যে-তাই না সুশান্তবাবু? কিরীটী বলল।

-মাঝে-মধ্যে না, আমি একেবারেই চলে যেতে চাই। আপনারা না আটকালে চলে যেতামও, সুশান্ত মল্লিক বলল।

–কিন্তু যাবেন কোথায়?

—হোক একটা ব্যবস্থা তো করতেই হবে থাকবার–

—কেন এই বাড়িটা তো আপনার স্ত্রীরই নামে।

দপ্ করে যেন সুশান্ত মল্লিক জ্বলে উঠল, কি বললেন? স্ত্রী কে আমার স্ত্রী—ঐ বাজারের বেশ্যাটা! হ্যাঁ, বলতে পারেন অবিশ্যি সেই স্ত্রীলোকটারই কাছে মুষ্টিভিক্ষা নিয়ে আজও বেঁচে আছি আমি, কিন্তু আর না। তারপর একটু থেমে ভাঙা গলায় সুশান্ত মল্লিক বলল, চলে যেতাম অনেক আগেই, কিন্তু কেন পারিনি জানেন? যখনই ভেবেছি ওই বোকা মেয়েটার দেহটাকে দশজনে খুবলে খুবলে খাচ্ছে তখনই মনে হয়েছে এই ঘেঁড়াছিড়ি একদিন ওকে শেষ করে দেবে। আর দেখলেন তো, হলও তাই। কিন্তু কি হল, একেবারেই পারলাম না তো ওকে রক্ষা করতে

শেষের দিকে কিরীটীর মনে হল যেন কান্না ঝরে পড়ছিল সুশান্ত মল্লিকের কণ্ঠ থেকে। কিরীটী বলল, সুশান্তবাবু, সেদিন সকালবেলা যখন মালঞ্চর ঘরের দরজা খুলছিল না, আপনি কেন তখন রতনকে বলেছিলেন মালঞ্চ দেবী শেষ হয়ে গিয়েছেন?

-বলেছিলাম নাকি! আমার ঠিক মনে নেই

-হ্যাঁ, আপনি বলেছিলেন। আচ্ছা, আর একটা কথা সুশান্তবাবু, কিরীটী বলল, ঐ দুর্ঘটনার আগে হঠাৎ কেন আপনি এ বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন?

–বুঝতে পেরেছিলাম এ বাড়িতে আর আমার থাকা হবে না, কারণ মালঞ্চ তা চায়। —

—মালঞ্চ কিছু বলেছিলেন? —

–হ্যাঁ–

—কি বলেছিলেন?

সুশান্ত মল্লিক সেই সন্ধ্যার ঘটনাটা বলে গেল। তারপর বলল, আপনিই বলুন মশাই, তারপরও কি থাকা যায়?

–তবে আবার এখানে ফিরে এলেন কেন?

—ফিরে আসতাম না, কিন্তু হঠাৎ কেন যেন আমার মন বলছিল, তার বড় বিপদ, আর আমার মন যে মিথ্যা বলেনি, সে তো প্রমাণিতই হয়েছে।

—তা বটে! দুটো রাত কোথায় ছিলেন আপনি?

–পথে পথে, আর কোথায় থাকব? আমার আবার জায়গা কোথায়?

—আচ্ছা সুশান্তবাবু, আপনার স্ত্রী হত্যার ব্যাপারে কাউকে আপনি সন্দেহ করেন? কিরীটীই পুনরায় প্রশ্নটা করল।

—না, তবে ঐ ধরনের মেয়েছেলেদের শেষ পরিণাম ঐ রকমই যে হবে অর্থাৎ অপঘাত মৃত্যু, তা আমার জানা ছিল।

—ঠিক আছে সুশান্তবাবু, আপনি বেরুতে পারেন—অবশ্যই যদি আপনি কথা দেন যে পুলিসের অনুমতি ছাড়া এ বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবেন না।

-তাই হবে। আর যাবই বা কোথায়-যতদিন না একটা আস্তানা মেলে মাথা গুজবার মত।

হঠাৎ সুশান্ত বলে ওঠে, ঐ মানদা, ওকে একদম বিশ্বাস করবেন না মশাই, she is a dangerous type.

কিরীটী মৃদু হাসে। সুশান্ত বলে, আপনি হাসছেন স্যার, ঐ ধরনের উয়োম্যানরা can do anything for money.

–তার মানে আপনি কি বলতে চান ওকে টাকা দিয়ে—

—কিছুই আমি বলতে চাই না স্যার, শুধু বলছিলাম ওর ওপর নজর রাখবেন। দুজনে ঘর থেকে বের হয়ে এলো। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে উঠতে সুশীল বললেন, লোকটা মনে হচ্ছে একটা বাস্তুঘুঘু–

–সুশান্ত মল্লিকের ওপর নজর রেখেছ তো?

—হ্যাঁ, বিনোদকে বলেছি—

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *