ধৈর্যের পরীক্ষা
যে কোনও স্কুলপাঠ্য রচনা বইয়ে ধৈর্য, অধ্যবসায় ইত্যাদি বিষয়ে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ পাওয়া যাবে। সেখানে পাওয়া যাবে সেই রবার্ট ব্রুস না কী এক সাহেবের গল্প, যে ব্রুস সাহেব মাকড়সার জাল বোনা অনুধাবন করে গভীর ধৈর্য সহকারে বহুবার পরাজয়ের পর অবশেষে জয়লাভ করেন।
প্রচলিত প্রবাদবাক্য আছে, ধৈর্যহীন মানুষ তৈলহীন প্রদীপের মতো। এদিকে বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন বলেছিলেন, ‘যার ধৈর্য আছে তার সবই আছে, সে যা চায় সবই পাবে।’
‘কোনও ক্ষত কি একদিনে শুকোয়? সে ধীরে ধীরে শুকোয়।’ ‘ওথেলো’ নাটকে স্বয়ং শেক্সপিয়র বলেছিলেন, ‘তার মতো দরিদ্র আর কেউ নেই যার ধৈর্য নেই।’
কোটেশন দিয়ে তাড়াতাড়ি করে রম্যরচনায় লাভ নেই। যথাসময়ে আবার না হয় কোটেশনে ফেরা যাবে। বরং ধৈর্যের প্রসঙ্গে সেই গাধার গল্পটায় আসি।
কলুর গাধার পুরনো গল্প। কলু বড় অত্যাচার করত গাধাটাকে, ভাল করে খেতে দিত না। মারধর করত। অন্যান্য জীবজন্তুর কাছে কলুর এহেন আচরণ নিয়ে গাধা খুবই দুঃখ করত।
একদিন পাশের বাড়ির গোরুর কাছে গাধাটি বলল, ‘আজ সারাদিন কলু খেতে দেয়নি, তার ওপরে লাঠি দিয়ে নির্মম পিটিয়েছে।’ গোরু বলল, ‘তুমি পালিয়ে যাচ্ছ না কেন?’
গাধা বলল, ‘শুধু একটা আশায় ধৈর্য ধরে আছি।’ ‘আশাটা কী?’ গোরু জিজ্ঞাসা করায় গাধা গলা নামিয়ে বলল, ‘কলূর মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে হবে। খুব সুন্দরী মেয়ে সে। সেই জন্য ধৈর্য ধরে আছি।
‘ধৈর্য ধরে আছ, তা বেশ।’ গোরু বলল, ‘কী করে বুঝলে কলু তার মেয়ের সঙ্গে তোমার বিয়ে দেবে?’ গাধা বলল, ‘কলু যখন তার মেয়েকে পেটায় সে বারবার বলে ওই গাধার সঙ্গে তোর আমি বিয়ে দেব।’
ধৈর্য মানে অপেক্ষা করবার, সহ্য করবার ক্ষমতা। অভিধান এককথায় বলছে সহিষ্ণুতা। আর কবি বলেছিলেন, যত দিক থেকে যত বাধা, যত বিপত্তিই আসুক,
‘ধৈর্য ধরো, ধৈর্য ধরো বাঁধো বাঁধো বুক।’
আমার মতো চঞ্চল লোকের পক্ষে ধৈর্য সম্পর্কে লিখতে বসাই ভুল হয়েছে। এমন লোক অনেক আছেন যাঁরা কিছুতেই ধৈর্য হারান না, আবার ঠিক উলটো দিকে এমন লোক অনেক আছেন যাঁরা অল্পেই সব কিছুতেই ধৈর্য হারান।
আমি নিশ্চয়ই ওই দ্বিতীয় দলে পড়ি। তবু ধৈর্য সম্পর্কে যখন লিখতে বসেছি ধৈর্য ধরে লিখতেই হবে। আবার যেহেতু এটা হালকা লেখা, নিতান্তই রম্যরচনা, গুরুগম্ভীর প্রসঙ্গ তোলাও অনুচিত হবে। আর একটা তরল কাহিনী দিয়ে তাই ধৈর্য ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করি।
ঘটনাটা ঘটেছিল মফস্বলের এক স্ট্যান্ডে। কয়েকটা বাসের রুট এখানেই শেষ। এই পর্যন্ত সব গাড়ি এসে তারপর গাড়ি ফিরে যায় বিভিন্ন শহরে।
একদিন সকালবেলা পার্শ্ববর্তী একটি গ্রাম থেকে সৌদামিনী দেবী নাম্নী এক ভদ্রমহিলা রিকশায় করে সেই বাসস্ট্যান্ডে এলেন। তিনি কলকাতায় কালীঘাটের মন্দিরে পুজো দিতে যাবেন, তাঁর নাতির খুব জ্বর হয়েছিল একেবারে যমে-মানুষে, যমদূতে-বৈদ্যে টানাটানি। সৌদামিনী দেবী সে সময় তার নাতির আরোগ্যের জন্য কালীঘাটের কালীমায়ের কাছে পুজো মানত করেছিলেন মনে মনে গোপনে, আজ কয়েকদিন হল মা কালীর আশীর্বাদে নাতিটির জ্বর ছেড়েছে, সে সুস্থ হয়েছে।
মা কালীর কাছে মানত করে মানত রক্ষা না করলে মহাপাপ, পরের জন্মে কালীঘাটের রাস্তায় কুকুর হয়ে জন্মাতে হয়। সুতরাং নাতিটি সুস্থ হওয়ামাত্রই সৌদামিনী দেবী বাড়ির এবং তারপরে পাড়ার অনেককে অনুরোধ করেছেন তাঁকে কলকাতায় কালীঘাটে নিয়ে যেতে, কিন্তু কেউই তাঁকে সময় দিয়ে উঠতে পারেনি।
অবশেষে আজ সৌদামিনী দেবী নিজেই বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন একা একাই কালীঘাট যাবেন বলে।
এ আর কঠিন কী?
সৌদামিনী দেবী আজ পর্যন্ত কতবার যে কালীঘাট গিয়েছেন তার হিসেব নেই। আগে তবু অসুবিধা ছিল, পাতাল রেল হওয়ার পরে এখন একেবারে যাতায়াতটা জলের মতো হয়ে গেছে। পিতামহী হলে কী হবে সৌদামিনী দেবী রীতিমতো শক্ত সমর্থ, ডাকসাইটে মহিলা।
তিনি জানেন শহরের বাসস্ট্যান্ড থেকে এক বাসে ধর্মতলায় পৌঁছাবেন। সেখানে যে কাউকে বলবেন পাতাল রেলের সিঁড়ি দেখিয়ে দেবে এবং তারপরে পাতাল রেলে চড়ে ঠিক দশ মিনিটে কালীঘাট। ফিরবেনও সেই একইভাবে।
নিজেই সাহস করে আজ বাড়ি থেকে বেরিয়ে রিকশা করে বাসস্ট্যান্ডে এসে পৌঁছেছেন।
বাসস্ট্যান্ডের মুখেই দু’জন পুলিশ ডিউটি করে। সৌদামিনী দেবী তাঁদের কাছে রিকশাটা নিয়ে গিয়ে দাঁড় করালেন, তারপর রিকশা থেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাবা, কলকাতা যাওয়ার বাস কোনটা? একেবারে ধর্মতলা পর্যন্ত যাবে?’
পুলিশ দু’জনের একজন বলল, ‘বুড়িমা আপনি ওই সব থেকে পেছনে অশ্বথ গাছটার নীচে চলে যান, ওখান থেকে আটাত্তর নম্বর বাস ছাড়বে। সে বাস আপনাকে সোজা কলকাতায় ধর্মতলা পর্যন্ত নিয়ে যাবে।’
অশ্বথতলায় গিয়ে বুড়িমা রিকশা ছেড়ে দিয়ে বাসের জন্যে দাঁড়ালেন।
বুড়িমা বলা ঠিক হল না, পুলিশেরা বুড়িমা বললেও আমরা তাঁকে সৌদামিনী দেবীই বলব।
সে যা হোক, সৌদামিনী দেবী বাসস্ট্যান্ডে এসে পৌঁছেছেন ভর সকালে, ‘পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল। কাননে কুসুম কলি সকলি ফুটিল’ ঠিক তার দুদন্ডের মাথায়।
অতঃপর আরও বহু দণ্ড কেটে গেছে। মোড়ের সেপাইদের ডিউটি বদলের সময় হয়েছে। বেলা দুপুর।
যে সেপাইটি আটাত্তর নম্বর বাসের কথা বুড়িমা অর্থাৎ সৌদামিনী দেবীকে বলেছিলেন তিনি বিনিভাড়ায় একটা রিকশায় চড়ে বাড়ির পানে যেতে যেতে হঠাৎ দেখলেন সৌদামিনী দেবী অশ্বখতলায় তখনও দাঁড়িয়ে। ঘন রোদ্দুরের মধ্যে ভাদ্রের অভিষেক আবহাওয়ায় বাসস্ট্যান্ডে দাড়িয়ে অনতিবৃদ্ধা সৌদামিনী দেবী দরদর করে ঘামছেন।
সেপাই বাবাজি রিকশা থেকে নেমে এগিয়ে এলেন, ‘বুড়িমা আপনি এখনও দাঁড়িয়ে।
সৌদামিনী দেবী মানে বুড়িমা হেসে বললেন, ‘বাহাতুরটা বাস ছেড়ে দিয়েছি, আর মাত্র ছয়টা বাস পরেই আমার বাস, তুমিই বলেছিলে। আটাত্তুর নম্বর, সেই আটাত্তুরের জন্যে দাঁড়িয়ে আছি। সরাসরি ধর্মতলায় পাতাল রেলের পাশে নামতে হবে তো?
স্তম্ভিত সেপাই বুড়িমায়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। আটাত্তর নম্বর বাস কথাটার এই রকম একটা মানে হতে পারে সে তা ভাবেনি।
আব্রাহাম লিঙ্কন বলেছিলেন, ‘একজন মানুষ দিনের পর দিন তার ফলের গাছটিকে দেখে, কখনও অধৈর্য হয়ে পড়ে, কবে ফল আসবে, কবে ফল পাকবে সেই আশায়।’ সে চেষ্টা করুক এই ফল আসা, ফল পাকার পদ্ধতিকে দ্রুততর করতে, সে বৃক্ষ এবং ফল দুইয়েরই ক্ষতি করবে। কিন্তু সে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করুক যথা সময়ে সুপক্ক ফলটি তার কেঁচায় এসে পড়বে।’
খুব দামি কথা এবং গোছানো কথা। ধৈর্য সম্পর্কে বেঞ্জামিন ডিজরেলি যা বলেছিলেন, সেও প্রায় একইরকম তবে ডিজরেলির বক্তব্যে কিঞ্চিৎ কাব্যসুষমা ছিল।
ডিজরেলি বলেছিলেন, ‘যখন গাছ মুকুলে ছেয়ে গেছে তখন ফল পাওয়া যাবে না, ফল পাওয়ার জন্যে মুকুলের শোভা উপভোগ করতে করতে অপেক্ষা করতে হবে।’
এসব তাত্ত্বিক কথা নিয়ে বাড়াবাড়ি করে লাভ নেই।
ধৈর্য বিষয়ে ঐতিহাসিক গল্পটিতে যাই। গল্পটি বিলিতি, তবে বাংলা ভাষায় মহামহিম শিবরাম চক্রবর্তী সমেত আরও কেউ কেউ গল্পটি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে লিখেছেন।
এক বাস কন্ডাক্টরের গালে এক ভদ্রমহিলা, ওই বাসেরই যাত্রিনী একটা চড় মেরেছিলেন। তাই নিয়ে হইচই গণ্ডগোল, পুলিশ, অবশেষে আদালত।
আদালতে কাঠগড়ায় ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে, বিচারক মহোদয় প্রশ্ন করছেন, ‘আপনি হঠাৎ বিনা কারণে বাস কন্ডাক্টরকে চড় মারতে গেলেন কেন?’
ভদ্রমহিলা সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলেন, ‘বিনা কারণে নয়। আমি সহ্যের সীমা অতিক্রম করে ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছিলাম।’
বিচারক মহোদয় অতঃপর স্বভাবতই জানতে চাইলেন, ‘বাসের মধ্যে চলতে চলতে হঠাৎ কী করে এমন ধৈর্যহারা হয়ে গেলেন?
ভদ্রমহিলা বললেন, ‘কন্ডাক্টরটি তিন-তিনবার আমার সিটের দিকে আসে, আমি ভাবি ভাড়া নিতে এসেছে, কিন্তু তিনবারই ভাড়া না নিয়ে ফিরে যায়।’
বিচারক মহোদয় বললেন, ‘আশ্চর্য! এই সামান্যতেই আপনি ধৈর্য হারিয়ে কন্ডাক্টরকে চড় মারলেন?’
ভদ্রমহিলা বললেন, ‘খুব সামান্য নয় ব্যাপারটা, একটু ভাল করে শুনুন।’
‘একটা কাপড়ের ছোট বটুয়ার মধ্যে আমি খুচরো পয়সা, কয়েন এইসব আলাদা করে রাখি ট্রাম-বাস ভাড়া, মুচির চটি সেলাই, মিঠেপান এইসব টুকটাক খরচের জন্যে।’
‘এই ছোট বটুয়াটা থাকে আমার চামড়ার হাতব্যাগের মধ্যে। আমার চামড়ার হাতব্যাগটায় এবং তার মধ্যে ভেতরের খোপটায় চেন লাগানো। পয়সার বটুয়াটা ওই চেন লাগানো খোপটার মধ্যে রাখি।’
‘এদিকে চামড়ার হাতব্যাগ হাতে করে কলকাতার ট্রামে-বাসের ভিড়ে যাতায়াত কঠিন। তাই আমি একটা শান্তিনিকেতনী হ্যান্ডলুমের ঝোলা, সেটা আবার খুব শক্তসমর্থ, রাস্তাঘাটে পকেটমার যাতে হাত গলাতে না পারে তাই শক্ত চেন টানা, সেই সঙ্গে আষ্টে-পৃষ্টে বোতাম লাগানো, সেই ঝোলায় হাতব্যাগটা ভরে ঝোলাটা কাঁধে ঝুলিয়ে রাস্তাঘাটে বেরই।’
ইতিমধ্যে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব অধৈর্য হয়ে উঠেছিলেন, তিনি বাধা দিয়ে বললেন, ‘এসব কথার মানে কী? এর সঙ্গে এই মামলার সম্পর্ক কী?’
ভদ্রমহিলা বললেন, ‘একটু ধৈর্য ধরুন, প্রায় সেরে এনেছি, এখুনি বুঝতে পারবেন মামলার ব্যাপারটা।’
এরপর একটু গলা খাঁকাড়ি দিয়ে কণ্ঠ সাফ করে ভদ্রমহিলা আবার শুরু করলেন, ‘প্রথমবার যখন দেখলাম কন্ডাক্টর আমার সিটের দিকে আসছেন, আমি কাঁধ থেকে শান্তিনিকেতনী ঝোলা নামালাম, চেন টানলাম। বোতাম খুললাম। তারপর ভেতর থেকে চামড়ার হাতব্যাগ বার করলাম। চামড়ার হাতব্যাগ বার করে শান্তিনিকেতনী ঝোলার বোতাম আটকালাম, চেন টেনে দিলাম। ঝোলা বন্ধ করে কাঁধে রাখলাম। তারপর চামড়ার হাতব্যাগটা খুললাম তার ভেতরের খোপটায় চেন লাগানো, সেই চেন খুললাম। খুচরো পয়সার কাপড়ের বটুয়াটা বার করলাম। তারপর চামড়ার হাতব্যাগের ভেতরের খোপের চেনটা বন্ধ করলাম। তারপর চামড়ার হাতব্যাগটা বুজিয়ে শান্তিনিকেতনী ব্যাগটা কাঁধ থেকে নামিয়ে এবং চেনটা, বোতামগুলো খুললাম। এবার চামড়ার হাতব্যাগটা শান্তিনিকেতনী ঝোলায় ঢুকিয়ে ঝোলার চেন, বোতাম বন্ধ করলাম। তারপর ঝোলাটা আবার কাঁধে নিলাম। তখন হাতের কাপড়ের বটুয়ার দড়ির গিঁটটা খুললাম, খুলে আমার ভাড়া সত্তর পয়সা বার করে কাপড়ের বটুয়াটা বন্ধ করলাম।
‘এবার কাঁধ থেকে শান্তিনিকেতনী ঝোলাটা নামালাম…’
ধৈর্যহারা জজসাহেব বাধা দিলেন, ‘আপনি আমার মাথা খারাপ করে দিয়েছেন।’
ভদ্রমহিলা বললেন, ‘এখনই মাথা খারাপের কী হয়েছে, এখনও প্রথম কিস্তি হয়নি। আর একটু শুনুন।’
জজসাহেব বললেন, ‘আর কী শুনব? এরপরে আপনি শান্তিনিকেতনী ঝোলাটা কাঁধ থেকে নামাবেন তার মধ্যের চামড়ার ব্যাগটা বার করবেন।’
ভদ্রমহিলা বললেন, ‘এত তাড়াতাড়ি করবেন না। শান্তিনিকেতনী ঝোলাটা কাঁধ থেকে নামালেই চলবে না, তার চেন খুলতে হবে, বোতাম খুলতে হবে। চামড়ার ব্যাগ বার করে তার চেন বন্ধ করতে হবে, বোতাম বন্ধ করতে হবে। চামড়ার ব্যাগ খুলে তার ভেতরের খোপের চেন খুলতে হবে সেখানে খুচরো পয়সার বটুয়াটা রাখতে হবে, ভেতরের খোপের চেন বন্ধ করতে হবে।’
জজসাহেব ততক্ষণে ক্ষিপ্ত হয়ে গেছেন, চেঁচিয়ে বললেন, ‘অসম্ভব।’
ভদ্রমহিলা বললেন, ‘এখনই অসম্ভবের কী হয়েছে, অপেক্ষা করুন। সেই পয়সার বটুয়াটা ভাড়া বার করে তারপর বন্ধ করে শান্তিনিকেতনী ঝোলায় ভরতে যাব দেখি কন্ডাক্টর আমার পর্যন্ত না এসে আবার সামনের দিকে ফিরে গেছেন। পয়সা হাতে নিয়ে কতক্ষণ বসে থাকব? আবার চামড়ার ব্যাগের মধ্যের খোপ খুললাম।’
জজসাহেব তখন চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়েছেন, কপালের চুল ছিঁড়ছেন, মুখে বলছেন, ‘আমি আর পারছি না। আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে। কাউকে থাপ্পড় লাগাতে ইচ্ছে করছে।’মৃদু হেসে মহিলা বললেন, ‘তা হলে? এখনও তো প্রথম দফার অর্ধেক হয়নি। এ রকম তিন দফার পরে আমি চড় মেরেছিলাম।’
বহুকাল আগে ‘সচিত্র ভারত’ সাহিত্য পত্রিকায় অবিস্মরণীয় প্রমথ সমাদ্দারের একটি কার্টুন দেখেছিলাম। অন্য সূত্রে এই অসামান্য কার্টুনটির উল্লেখ আমি আগেও করেছি।
এবার ধৈর্যের সূত্রে যাই।
একটি ক্ষৌরকর্মশালায় ক্ষৌরকার মহোদয় সযত্নে চুল কাটছেন। আর ঠিক তাঁর পায়ের কাছে নিঃশব্দে, ধৈর্য ধরে একটি বিরাট কুকুর খুব মনোযোগ সহকারে প্রভুর কেশকর্তন দেখছে।
আজকের খদ্দেরটি নতুন। তিনি কেশচর্চায় কুকুরটির এই অভিনিবেশ দেখে ক্ষৌরকারকে বললেন, ‘দাদা আপনার কুকুরটি কিন্তু খুব শিক্ষিত। কীরকম চুপচাপ বসে, কোনও গোলমাল-না করে আপনার চুল কাটা দেখে যাচ্ছে।’
ক্ষৌরকার বললেন, ‘শিক্ষিত না ছাই! ও একটা লোভী, অতি লোভী কুকুর।’
সরল প্রকৃতির খদ্দের বললেন, ‘লোভ? ‘লোভ আবার কী? চুলকাটা দেখার মধ্যে লোভের কী আছে?’
মৃদু হেসে ক্ষৌরকার বললেন, ‘আমি আবার একটু অন্যমনস্ক কি না, অনেক সময় চুল কাটতে কাটতে কাস্টমারদের ঘাড়ের মাংস, কানের লতি এই সব হঠাৎ কেটে ফেলে বসি। ও আবার কাঁচা মাংস খুব ভালবাসে। তাই ধৈর্য ধরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাড়িয়ে থাকে।’
ঈশপের উপকথায় শেয়াল প্রচুর ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছিল, প্রচুর অধ্যবসায় দেখিয়েছিল। কিন্তু আখেরে তার লাভ হয়নি অবশেষে সে আঙুরফলের নামে অপবাদ দিয়ে ‘আঙুরফল টক’ নামক সেই বিখ্যাত মন্তব্যটি করে চলে যায়।
রুশো বলেছিলেন, ‘ধৈর্য ধরে থাকা একটা খুবই তিক্ততার ব্যাপার, কিন্তু এর ফল খুব মধুর।’ ঈশপের শেয়ালের ক্ষেত্রে ফল মধুর হয়নি, ফল টক হয়েছিল। আর ওই সেলুনের কুকুর, সে নিশ্চয় দু’-একটা ছিঁটেফোঁটা মাংস কখনও-সখনও পেয়ে যায় তাই অমন ভক্তের মতো বসে আছে।
এবং শুধু ওই কার্টুনের কুকুরটি নয় সামান্য একটু ছিঁটেফোঁটার জন্যে ভক্তের মতো ধৈর্য ধরে কত মানুষ কত জায়গায় অপেক্ষা করছে।
পুনশ্চঃ
গত শতকের গল্প। উত্তর কলকাতায় এক বনেদিবাড়ির বড়বাবু কিছুদিন বিগতদার হয়েছেন। তাঁর দেখভাল করে এক মধ্য বয়সিনী দেহবতী পরিচারিকা যার নাম ধৈর্য। কালোকেলো, ঢলোমলো।
শূন্য বিছানায় সারারাত বড়বাবুর ঘুম হয় না। ধৈর্য রাতে এসে জানলা দিয়ে বারবার তাঁকে দেখে যায়। একদিন ঘুমের চোখে জানলা দিয়ে ধৈর্যকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বড়বাবু বললেন, ‘তুমি কে?’
সে বলল, ‘আমি ধৈর্য।’
বড়বাবু বললেন, ‘আমিও ধৈর্য।’