ধাত্রী দেবতা : 20
রামকিঙ্করবাবু সামাজিক বা আত্মীয়তার ধার কোনো দিনই ধরিতেন না। প্রাতঃকাল হইতে রাত্রি দ্বিপ্রহরে নিদ্রাভিভূত হইবার মুহূর্তটি পর্যন্ত তাহার একমাত্র চিন্তা—বিষয়ের চিন্তা, ব্যবসায়ের চিন্তা, অর্থের আরাধনা। ইহার মধ্যে আত্মীয়তা কুটুম্বিতা, এমনকি সামাজিক সৌজন্য প্রকাশের পর্যন্ত অবকাশ তাহার হইত না। ধনী পিতার সন্তান, শৈশব হইতেই তাবেদারের কাঁধে কাঁধে মানুষ হইয়াছেন, যৌবনের প্রারম্ভ হইতেই তাহাদের মালিক ও প্রতিপালকের আসনে। বসিয়া কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করিয়াছেন, ফলে প্রভুত্বের দাবি, মানসিক উগ্রতা তাঁহার অভ্যাসগত স্বভাব হইয়া দাঁড়াইয়াছে। আর একটি বস্তু—সেটি বোধহয় তাঁহার জন্মগত, কর্মী পিতার সন্তান তিনি, কর্মের নেশা তাঁহার রক্তের ধারায় বর্তমান। এই কর্মের উন্মত্ত নেশায় তিনি সবকিছু ভুলিয়া থাকেন; আত্মীয়তা কুটুম্বিতা সামাজিক সৌজন্য প্রকাশের অভ্যাস পর্যন্ত এমনই করিয়া ভুলিয়া থাকার ফলে অনভ্যাসে দাঁড়াইয়া গিয়াছে। কিন্তু আসল মানুষটি এমন নয়। এই কৃত্রিম অভ্যাসকরা জীবনের মধ্যে সে মানুষের দেখা মাঝে মাঝে পাওয়া যায়, যে মানুষের আপনার জনের জন্য অফুরন্ত মমতা; অদ্ভুত তাহার খেয়াল, যে খেয়ালের বশবর্তী হইয়া স্বর্ণমুষ্টিও ধুলায় ফেলিয়া দিতে পারেন। কাশীতে অকস্মাৎ প্লেগ দেখা দিতে কমলেশ তাহার দিদিমা ও গৌরীকে লইয়া কলিকাতায় আসিতেই রামকিঙ্করবাবু গৌরীকে দেখিয়া সবিস্ময়ে বলিলেন, নান্তি যে অনেক বড় হয়ে গেলি রে, অ্যাঁ!
গৌরী মামাকে প্রণাম করিয়া মুখ নিচু করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। এই দুই মাসের মধ্যেই গৌরীর সর্ব অবয়ব হইতে জীবনের গতির স্বাচ্ছন্দ্য পর্যন্ত ঈষৎ ক্ষুণ্ণ ম্লান হইয়া গিয়াছে। শিবনাথকে যে পত্র সে লিখিয়াছিল, সে পত্রের ভাষা তাহার স্বকীয় অভিব্যক্তি নয়, সে ভাষা অপরের, সে তিরস্কার অন্যের; শিবনাথের প্রতি তাহার নিজের অকথিত সকল কথা ধীরে ধীরে তাহার রূপের মধ্যে এমনই করিয়া ব্যক্ত হইয়া উঠিতেছে। গৌরীর রূপের সে অভিনব অভিব্যক্তি রামকিঙ্করবাবুর চোখে পড়িল, তিনি পরমুহূর্তেই বলিলেন, কিন্তু এমন শুকনো শুকনো কেন রে তুই?
নান্তির দিদিমারামকিঙ্করবাবুর মা এতক্ষণ পর্যন্ত ব্যস্ত ছিলেন আপনার পূজার ঝোলাটির সন্ধানে; ঝোলাটি লইয়া উপরে উঠিতে উঠিতে তিনি রামকিঙ্করের কথাগুলি শুনিয়া সিঁড়ি হইতেই বলিলেন, তুমিই তো তার কারণ বাবা। মেয়েটাকে হাতে-পায়ে বেঁধে জলে দিলে তোমরা। আবার বলছ, এমন শুকনো কেন?
গৌরী দিদিমার কথার ধারা লক্ষ্য করিয়া সেখান হইতে সরিয়া বাড়ির ভিতরের দিকে চলিয়া গেল। রামকিঙ্করবাবু চমকিয়া উঠিলেন, তাঁহার সব মনে পড়িয়া গেল—শিবনাথের মায়ের কথা, পিসিমার কথা, সঙ্গে সঙ্গে শিবনাথের সেবাকার্যের পরম প্রশংসার কথাও মনে পড়িল। আরও মনে পড়িল, শিবনাথের সঙ্গে গৌরীর দেখা-সাক্ষাৎ পর্যন্ত নাই। তিনি বলিলেন, দাঁড়াও, আজই খোঁজ করছি, শিবনাথ কোন্ কলেজে পড়ে, কোথায় থাকে। আজই নিয়ে আসছি তাকে।
কমলেশ বলিয়া উঠিল, না মামা।
কেন?–রামকিঙ্করবাবু আশ্চর্যান্বিত হইয়া গেলেন।
রামকিঙ্করবাবুর মা ঝঙ্কার দিয়া উঠিলেন, না, নিয়ে আসতে হবে না তাকে, সে একটা ছোটলোক, ইতর; একটা ডোমেদের মেয়ের মোহে
বাধা দিয়া রামকিঙ্কর বলিলেন, ছি ছি, কী বলছ মা তুমি? কে, কার কথা বলছ তুমি?
ক্রোধ হইলে নান্তির দিদিমার আর দিগ্বিদিক জ্ঞান থাকে না, তিনি দারুণ ক্রোধে আত্মহারা হইয়া ডোমবধূর সমুদয় ইতিবৃত্ত উচ্চকণ্ঠে বিবৃত করিয়া কহিলেন, তুই করেছিস এ সম্বন্ধ, তোকেই এর দায় পুরোতে হবে! কী বিধান তুই করছিস বল আমাকে, তবে আমি জলগ্ৰহণ করব।
রামকিঙ্কর বলিলেন, কথাটা একেবারে বাজে কথা বলেই মনে হচ্ছে মা। আমি আজই আমাদের ম্যানেজারকে লিখছি, সঠিক খবর জেনে তিনি লিখবেন। আমার কিন্তু একেবারেই বিশ্বাস হয় না মা।
চিঠি সেই দিনই লেখা হইল; কয়দিন পরে উত্তরও আসিল। ম্যানেজার লিখিয়াছেন, খবর আমি যথাসাধ্য ভাল রকম লইয়াছি; এমনকি এখানকার দারোগাবাবুর কাছেও জানিয়াছি, ওটা নিতান্ত গুজবই। দারোগা বলিলেন, ওসব ছেলের নাম পাপের পাতায় থাকে না। ওদের জন্য আলাদা খাতা আছে। কথাটা ভাঙিয়া বলিতে বলায় তিনি বলিলেন, সে ভাঙিয়া বলা যায় না, তবে এইটুকু জানাই যে, ও রটনাটা রটাইয়াছে ওই বউটার শাশুড়ি এবং ভাসুর; মেয়েটা আসলে পলাইয়াছে তাহার বাপের বাড়ির গ্রামের একজন স্বজাতীয়ের সঙ্গে। সে লোকটা কলিকাতায় থাকে, সেখানে মেথর বা ঝাড়ুদারের কাজ করে। এখানে সর্বসাধারণের মধ্যেও কোনো ব্যক্তিই কথাটা বিশ্বাস করেন নাই। বরং শিবনাথবাবুর এই সেবাকার্যের জন্য এতদঞ্চল তাহার প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
চিঠিখানা পড়িয়া কমলেশকে ডাকিয়া রামকিঙ্করবাবু হাসিয়া বলিলেন, পড়। ম্যানেজার সেখান থেকে পত্র দিয়েছেন।
চিঠিখানা পড়িতে পড়িতে কান্নার আবেগে কমলেশের কণ্ঠ রুদ্ধ হইয়া আসিতেছিল। শিবনাথ তাহার বাল্যবন্ধু, তাহার উপর গৌরীর বিবাহের ফলে তাহার পরম প্রিয়জন, তাহার প্রতি অবিচার করার অপরাধবোধ অন্তরের মধ্যে এমনই একটা পীড়াদায়ক আবেগের সৃষ্টি করিল। কমলেশ শিবনাথকে খুব ভাল করিয়া জানি, উলঙ্গ শৈশব হইতে তাহারা দুই জনে খেলার সাথী, বাল্যকাল হইতে তাহাদের মধ্যে প্রগাঢ় অন্তরঙ্গতা সত্ত্বেও শ্রেষ্ঠত্বের প্রতিযোগিতা জাগিয়াছে, কৈশোরের প্রারম্ভে তাহারা কর্মের সহযোগিতার মধ্যে পরস্পরের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে যৌবন জীবনে প্রবেশ করিয়াছে; একের শক্তি দুৰ্বলতা দোষ গুণ অন্যে যত জানে, সে নিজেও আপনাকে তেমন ভাল করিয়া জানে না। তাই কমলেশের অপরাধবোধ এত তীক্ষ্ণ হইয়া আপনার মর্মকে বিদ্ধ করিল। সে যেন কত ছোট হইয়া গেল! শিবনাথের নিকট, গৌরীর নিকট সে মুখ দেখাইবে কী করিয়া!
রামকিঙ্কর বলিলেন, যাও, মাকে চিঠিখানা পড়ে শুনিয়ে এসো। আর দেখো, নান্তিকে। চিঠিখানা পড়তে দিও।
চিঠিখানা শুনিয়া নান্তির দিদিমা খুব খুশি হইয়া উঠিলেন; তিনি সঙ্গে সঙ্গে হাঁকডাক শুরু করিয়া বলিলেন, নান্তি নান্তি অনান্তি!
নান্তি তাহার সমবয়সী মামাতো মাসতুতো বোনদের সহিত গল্প করিতেছিল, দিদিমার হাঁকডাক শুনিয়া সে তাড়াতাড়ি আসিয়া দাঁড়াইতেই তিনি বলিলেন, এই নে হারামজাদী, এই পড়ু। চিলে কান নিয়ে গেল বলে সেই কে চিলের পেছনে পেছনে ছুটেছিল, তোর হল সেই বিত্তান্ত। কে কোথা থেকে কী লিখলে, আর তুই বিশ্বেস করে কেঁদে কেটে-বাবাং, একালের মেয়েদের চরণে দণ্ডবত মা!
গৌরী রুদ্ধশ্বাসে চিঠিখানা হাতে লইয়া পড়িতে আরম্ভ করিল। দিদিমার মনের আবেগ তখনও শেষ হয় নাই, তিনি তাঁহার অপরাধটুকু গৌরীর স্কন্ধে আরোপিত করিয়া কহিলেন, তা একাল অনেক ভাল মা, তাই পরিবার এখন স্বামীর ওপর রাগ করতে পারছে। সেকালে বাবুদের তো ওসব ছিল কুকুর-বেড়াল পোষর শামিল। ওই কি বলে শ্যামাদাসবাবুর ভালবাসার লোক ছিল—কাদম্বিনী, সে বলেছিল, বাবু, তোমার পরিবারের গোবরের ছাঁচ তুলে এনে আমাকে দেখাও, সে কেমন সুন্দরী! তোরা হলে তো তা হলে গলায় দড়ি দিতিস, না হয় বিষ খেতিস।
গৌরীর চোখ দুইটি জলে ভরিয়া উঠিয়াছিল। চোখের জলের লজ্জা গোপন করিতেই সে চিঠিখানা ফেলিয়া দ্রুত সেখান হইতে চলিয়া গিয়া আপনার বিছানায় মুখ লুকাইয়া শুইয়া পড়িল।
কমলেশ নতমুখেই বলিল, দিদিমা!
দিদিমা ঝঙ্কার দিয়া বলিলেন, তুই ছেড়াই হচ্ছিস ভারি ভেঁপো। একেবারে রেগে আগুন হয়ে লেকচার-মেকচার ঝেড়ে এই কাণ্ড করে বসে থাকিস। যা এখন, যা, খোঁজখবর করে নিয়ে আয় তাকে।
সে যদি না আসে?
আসবে না? কান ধরে নিয়ে আসবি। গৌরী কি আমার ফেলনা নাকি? সে বিয়ে করেছে। কেন আমার গৌরীকে?
তারপর তাহার ক্ৰোধ পড়িল কলিকাতার বাসায় যাহারা থাকেন, তাহাদের ওপর। কেন তাহারা এতদিন শিবনাথের সংবাদ লন নাই? তাহাদের নিজেদের জামাই হইলে কি তাহারা এমন করিয়া সংবাদ লইতে ভুলিয়া বসিয়া থাকিতেন? শেষ পর্যন্ত তিনি মৃতা কন্যা গৌরীর মার জন্য কাঁদয়া ফেলিলেন। এ কী দারুণ বোঝা সে তার উপর চাপাইয়া দিয়া গেল?
ইহারই ফলে কমলেশ ও রামকিঙ্করবাবু শিবনাথের নিকট আসিয়াছিলেন, সমাদর করিয়া শিবনাথকে লইয়া যাইবার জন্য, কিন্তু শিবনাথ একটা তন্ময় শক্তির আবেগে তাহাদিগকে পিছনে ফেলিয়া মেঘ মাথায় করিয়া ভিজিতে ভিজিতে আপন পথে চলিয়া গেল, তাহারা যেন তাহার নাগাল পর্যন্ত ধরিতে পারিলেন না।
নান্তির দিদিমার নির্বাপিত ক্ৰোধবহ্নি আবার জ্বলিয়া উঠিল। তাহার ক্ৰোধ পড়িল শিবনাথের পিসিমা ও মার ওপর। শিবনাথ যে তহাদিগকে এমন করিয়া লঙ্ন করিয়া গেল, এ শিক্ষা যে তাহাদেরই, তাহাতে আর তাহার বিন্দুমাত্র সন্দেহ রহিল না। তিনি অত্যন্ত রূঢ় ভঙ্গিতে বাৰ্ধক্যনত দেহখানিকে সোজা করিয়া তুলিয়া বলিলেন, আমি আমার নান্তিকে রানী করে দিয়ে যাব। আসতে হয় কি না-হয় আমার নান্তির কাছে, আমি মলেও যেখানে থাকি সেইখান থেকে দেখব।
রামকিঙ্করবাবুও মনে মনে অত্যন্ত আহত হইয়াছিলেন, তিনি মার কথায় প্রতিবাদ করিলেন। না, গম্ভীরভাবে নিচে নামিয়া গেলেন। কমলেশ চুপ করিয়া বারান্দার রেলিঙে ভর দিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। গৌরী ঘরের মধ্যে জানালার ধারে বসিয়া উল বুনিতেছিল; জানালাটা দিয়া পথের উপরটা বেশ দেখা যায়, তাহার হাতের আঙুল রচনা করিতেছিল উল দিয়া হঁদের পর ছাদ, দেখিতেছিল সে পথের জনতা। সমস্ত শুনিয়া তাহার হাতের কাজটি থামিয়া গেল, পথের দিকে চাহিয়া সে শুধু বসিয়াই রহিল।
সেদিন সন্ধ্যায় সমগ্র পরিবারটিকেই রামকিঙ্করবাবু থিয়েটার দেখিবার জন্য পাঠাইয়া দিলেন।
ঠিক মাসখানেক পর।
বিদ্যুৎ তরঙ্গে তরঙ্গে সংবাদ আসিয়া পৌঁছিল, চৌঠা আগস্ট ব্রিটেন-জার্মান ও অস্ট্রিয়া হাঙ্গেরীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করিয়া ফ্রান্স রাশিয়া বেলজিয়াম সার্ভিয়ার সহিত মিলিত হইয়াছে। সমগ্র কলিকাতা যেন চঞ্চল সমুদ্রের মত বিক্ষুব্ধ হইয়া উঠিল। হাজার হাজার মাইল পশ্চিমের মানুষের অন্তরের বিক্ষোভ আকাশ-তরঙ্গে আসিয়া এখানকার মানুষকেও ছোঁয়াচ লাগাইয়া দিল। শেয়ার মার্কেটে সেদিনের সে ভিড়, ব্যবসায়ীমহলে সেদিনের ছুটাছুটি দেখিয়া কমলেশের মন বিপুল উত্তেজনায় ভরিয়া উঠিল। প্রত্যেক মানুষটি যেন উত্তেজনার স্পর্শে দৃঢ় দ্রুত পদক্ষেপে সোজা হইয়া চলিয়াছে।
কয়লার বাজার নাকি হুহু করিয়া চড়িয়া যাইবে, প্রচুর ধন, অতুল ঐশ্বর্যে বাড়িঘর ভরিয়া উঠিবে। সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীর আসনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করিবার কল্পনা করিতে করিতে অকস্মাৎ তাহার শিবনাথকে মনে পড়িয়া গেল; তাহার মনে হইল, আর একবার খোঁজ করিতে দোষ কী? সেদিন সত্যই হয়ত তাহার কোনো কাজ ছিল। আর তাহার সহিত একবার মুখামুখি সকল কথা পরিষ্কার করিয়া বলিয়া লওয়ারও তো প্রয়োজন আছে। মোট কথা, যুক্তি তাহার যাহাই হউক না কেন, যাওয়ার উত্তেজিত প্রবৃত্তিই হইল আসল কথা। তাহাদের ভাবী সৌভাগ্যের সম্ভাবনার কথাটাও শিবনাথকে জানানো হইবে।
শিবনাথ ঘরে বসিয়া আপনমনে কী লিখিতেছিল। কমলেশ ঘরে ঢুকিয়া বলিল, এই যে!
মুখ তুলিয়া শিবনাথ তাহাকে দেখিয়া লেখা কাগজখানা বাক্সের মধ্যে পুরিয়া অতি মৃদু হাসিয়া বলিল, এস।
তাহার মুখের দিকে চাহিয়া কমলেশ সবিস্ময়ে বলিল, এ কী, এমন উচ্চখুষ্ক চেহারা কেন তোমার? অসুখ করেছে নাকি?
সত্যই শিবনাথের রুক্ষ চুল, মার্জনাহীন শুষ্ক মুখশ্ৰী, দেহও যেন ঈষৎ শীর্ণ বলিয়া মনে হইতেছিল।
হাসিয়া শিবনাথ বলিল, না, অসুখ কিছু নয়। আজ নাওয়া-খাওয়াটা হয়ে ওঠে নি।
এই সামান্য বিস্ময়ের হেতুটুকু লইয়া কমলেশ বেশ স্বচ্ছন্দ হইয়া উঠিল, সে বলিল, কেন? নাওয়া-খাওয়া হল না কেন?
কাজ ছিল একটু, সকালে বেরিয়ে এই মিনিট পনের হল ফিরেছি।
কলেজ যাও নি?
যাগে সে কথা। তারপর দেশে কবে যাবে বল?
দেশে এখন যাব না, এইখানেই পড়ব ঠিক হয়েছে। কিন্তু তোমার খবর কী বল তো? সেদিন মামা নিজে এলেন, আর তুমি অমন করে চলে গেলে যে?
বলেছিলাম তো, কাজ ছিল। কী এমন কাজ যে, দুটো কথা বলবার জন্যে তুমি দাঁড়াতে পারলে না?
এবার শিবনাথ হাসিয়া বলিল, যদি বলি, কোনো নতুন লাভ অ্যাফেয়ার, যার মোহে মানুষ আপনাকে একেবারে হারিয়ে ফেলে।
কমলেশ একটু চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, যাক, বুঝলাম, বলতে বাধা আছে।
শিবনাথ এ কথার কোনো জবাব না দিয়া একটা পেপারওয়েট লুফিতে লুফিতে বলিল, চা খাবে একটু?—বলিতে বলিতেই সে বারান্দায় বাহির হইয়া কিল, গোবিন্দ, দু পেয়ালা চা।
কমলেশ খবরের কাগজটা টানিয়া লইয়া বলিল, আজকের নিউজ একটা গ্ৰেট নিউজ।
হাসিয়া শিবনাথ বলিল, নতুন ইতিহাসের সন তারিখ বন্ধু-নাইন্টিন ফোবৃটিন-ফোর্থ আগস্ট।
আজই বিজনেস মার্কেটে অদ্ভুত ব্যাপার হয়ে গেল। কয়লার দর তো হু-হু করে বেড়ে যাবে। মামা বলছিলেন, পড়ে কী হবে, এবার বিজনেসে ঢুকে পড়। তোমার কথাও বলছিলেন। অবশ্য তোমার যদি পছন্দ হয়।
বিজনেস অবশ্য খুব ভাল জিনিস।
হাসিয়া কমলেশ বলিল, কিন্তু কবিতা লেখা ছাড়তে হবে তা হলে। আমাকে দেখে। লুকোলে, ওটা কী লিখছিলে? কবিতা নিশ্চয়?
না।
তবে? কী, দেখিই না ওটা কী?
এবার শিবনাথ হাসিয়া বলিল, ওটা নতুন লাভ অ্যাফেয়ার-প্রেমপত্র একখানা; সুতরাং ওটা দেখানো যায় না।
কমলেশ আবার নীরব হইয়া গেল। চাকরটা আসিয়া চা নামাইয়া দিল, কমলেশ নীরবে চায়ের কাপ তুলিয়া লইয়া তাহাতে চুমুক দিল। তাহার নীরবতার মধ্যে শিবনাথও অন্যমনস্ক হইয়া জানালার দিকে নীরবেই চাহিয়া রহিল।
এ অশোভন নীরবতা ভঙ্গ করিয়া সে-ই প্রথম বলিল, তোমরা কি কাশীর বাসা তুলে দিয়েছ?
হ্যাঁ।
অ।
কমলেশ বলিল, দিদিমা নান্তি এইখানেই চলে এসেছে আমার সঙ্গে।
শিবনাথ নীরব হইয়া গেল।
কমলেশ একবার বলিল, আমাদের বাসায় চল একদিন।
হাঁটুর উপর মুখ রাখিয়া বাইরের দিকে চাহিয়া শিবনাথ যেন তন্ময় হইয়া গিয়াছে।
কমলেশ বলিল, গৌরী দিন দিন যেন কেমন হয়ে যাচ্ছে। তার মুখ দেখলে আমাদের কান্না আসে।
একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া শিবনাথ বলিল, আজও আমার কলঙ্কমোচন হয় নি কমলেশ, আমি যেতে পারি না।
কমলেশ যেন উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিল, মিথ্যে কথা, মিথ্যে কথা। মিচিভাস লোকের রটনা ওসব—আমরা খবর নিয়ে জেনেছি।
শিবনাথের মুখ-চোখ অকস্মাৎ তীক্ষ্ণ দীপ্তিতে প্রখর হইয়া উঠিল। সে বলিল, কিন্তু আমায় তো বিশ্বাস করতে পার নি। যেদিন নিজেকে তেমনই বিশ্বাসের পাত্র বলে প্রমাণ করতে পারব, সেইদিন আমার সত্যকার কলঙ্কমোচন হবে।
কমলেশের মাথাটা আপনা হইতেই লজ্জায় নত হইয়া পড়িল। সে নীরবে ঘরের মেঝের দিকে চাহিয়া বসিয়া রহিল। শিবনাথ মৃদু হাসিয়া আবার বলিল, সময় যেদিন আসিবে আপনি যাইব তোমার কুঞ্জে।
একটি ছেলে দরজার সম্মুখেই বারান্দায় রেলিঙে ঠেস দিয়া নিতান্ত উদাসীনভাবেই দাঁড়াইয়া ছিল; তাহাকে দেখিয়াই শিবনাথ ঈষৎ চঞ্চল হইয়া বলিল, এখানেই যখন থাকবে, মাঝে মাঝে এসো যেন। এক দিনে সকল কথা ফুরিয়ে দিলে চলবে কেন?
উঠিতে বলার এমন সুস্পষ্ট ইঙ্গিত কমলেশ বুঝিতে ভুল করিল না, সে উঠিয়া একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া নীরবে বাহির হইয়া গেল। কমলেশ বাহির হইয়া যাইতেই ছেলেটি শিবনাথের ঘরে আসিয়া বলিল, হয়ে গেছে সেটা?
শিবনাথ বাক্স খুলিয়া সেই কাগজখানা তাহার হাতে দিয়া বলিল, সুশীলদাকে একটু দেখে দিতে বলবেন।
কাগজখানা একটা বৈপ্লবিক ইস্তাহারের খসড়া।
কাগজখানি সযত্নে মুড়িয়া পরনের কাপড়ের মধ্যে লুকাইয়া ছেলেটি বলিল, পূর্ণদার সঙ্গে একবার দেখা করবেন আপনিজরুরি দরকার।
করব।
ছেলেটি আর কথা কহিল না, বাহির হইয়া চলিয়া গেল।
পূর্ণ যেমন মৃদুভাষী, কথাবার্তাও তাহার তেমনই সংক্ষিপ্ত প্রয়োজনের অধিক একটি কথাও সে বলে না। শিবনাথের জন্যই সে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করিতেছিল। শিবনাথ আসিতেই ঘরের দরজাটা বন্ধ করিয়া দিয়া সে বলিল, আপনাকে এইবার একটা বিপদের সম্মুখীন হতে হবে শিবনাথবাবু।
শিবনাথ প্রশান্তভাবে বলিল, কী বলুন?
পূর্ণ বলিল, অরুণের ওপর পুলিশের বড় বেশি নজর পড়েছে। তার কাছে কিছু আর্মস্ আছে আমাদের। সেগুলো এখন সরাবার উপায় করতে পারছি না। আপনি মেস বদল করে অরুণের মেসে যান। আর্মসগুলো আপনার কাছে থেকে যাবে, অরুণ অন্য মেসে চলে যাক। তা হলে অরুণের জিনিসপত্র সার্চ করলে তার আর ধরা পড়বার ভয় থাকবে না। পরে আপনার কাছ থেকে ওগুলো সরিয়ে ফেলব।
শিবনাথের বুক যেন মুহূর্তের জন্য কাঁপিয়া উঠিল। ওই মুহূর্তটির মধ্যে তাহার মাকে, পিসিমাকে মনে পড়িয়া গেল। স্লানমুখী গৌরীও একবার উঁকি মারিয়া চলিয়া গেল।
পূর্ণ বলিল, আপনি তা হলে দু-তিন দিনের মধ্যেই চলে যান। সম্ভব হলে কালই। এই হল অরুণের মেসের ঠিকানা। অরুণ চলে যাবে, ছোট একটা সুটকেস ঘরের কোণে কাগজঢাকা থাকবে। সেই ঘরেই আপনার সিটের বন্দোবস্ত আমরা করে রাখব।
ততক্ষণে শিবনাথ নিজেকে সামলাইয়া লইয়াছে। সে এবার বলিল, বেশ।
পূর্ণ তাহার হাতখানি ধরিয়া বলিল, গুড লাক।
সমস্ত রাত্রিটা শিবনাথের জাগরণের মধ্যে কাটিয়া গেল।
নানা উত্তেজিত কল্পনার মধ্যেও বারবার তাহার প্রিয়জনদের মনে পড়িতেছিল। সহসা এক সময় তাহার মনে হইল, যদি ধরাই পড়িতে হয়, তবে পূর্বাহ্নে মা—পিসিমার চরণে প্ৰণাম জানাইয়া বিদায় লইয়া রাখিবে না?—গৌরী—আজিকার দিনেও কি গৌরীকে সে বঞ্চনা করিয়া রাখিবে? না, সে কৰ্তব্য তাহাকে সুশেষ করিতেই হইবে। মাকে ও পিসিমাকে খুলিয়া না। লিখিয়াও ইঙ্গিতে সে বিদায় জানাইয়া মার্জনা ভিক্ষা করিয়া পত্ৰ লিখিল। তারপর পত্ৰ লিখিতে আরম্ভ করিল গৌরীকে। লিখিতে লিখিতে বুকের ভিতরটা একটা উন্মত্ত আবেগে যেন তোলপাড় করিয়া উঠিল। এত নিকটে গৌরী, দশ মিনিটের পথ, একবার তাহার সহিত দেখা করিয়া আসিলে কী হয়, হয়ত জীবনে আর ঘটিবে না! অর্ধসমাপ্ত পত্ৰখানা ছিঁড়িয়া ফেলিয়া সে জামাটা টানিয়া লইয়া গায়ে দিতে দিতেই নিচে নামিয়া গেল।
গেট বন্ধ। রাত্রি এগারটায় গেট বন্ধ হইয়া গিয়াছে। মেসটি নামে মেস হইলেও কলেজ কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত, মেস-সুপারিন্টেন্ডেন্টের কাছে চাবি থাকে। রুদ্ধ দুয়ারের সম্মুখে কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকিয়া শিবনাথ উপরে আসিয়া আবার চিঠি লিখিতে বসিল। চিঠিখানি শেষ করিয়া বিছ নায় সে গড়াইয়া পড়িল শ্ৰান্ত-ক্লান্তের মত। কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর তাহার মনে হইল, সে করিয়াছে কী? ছি, এত দুর্বল সে! এ বিদায় লওয়ার কি কোনো প্রয়োজন আছে? কিসের বিদায়, আর কেন এ বিদায় লওয়া? আবার সে উঠিয়া বসিয়া দেশলাই জ্বালিয়া পত্রগুলি নিঃশেষে পুড়াইয়া ফেলিল।
কোথায় কোন্ দূরের টাওয়ার-ক্লকে ঢং ঢং করিয়া তিনটা বাজিয়া গেল। মনকে দৃঢ় করিয়া সে আবার শুইয়া পড়িল। অভ্যাসমত ভোরেই তাহার ঘুম ভাঙিয়া যাইতেই সে অনুভব করিল, সমস্ত শরীর যেন অবসাদে ভাঙিয়া পড়িতেছে। তবু সে আর বিছানায় থাকিল না, মন এই অল্প বিশ্রামেই বেশ স্থির হইয়াছে, সম্মুখের গুরুদায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়া উঠিয়া পড়িল। মনের মধ্যে আর কোনো চিন্তা নাই, আছে শুধু ওই কর্মের চিন্তা। কেমন করিয়া কোন অজুহাতে কলেজের মেস পরিত্যাগ করিয়া অন্যত্র যাইবে?
একে একে ছেলেরা উঠিতেছিল। সঞ্জয় উঠিয়া বাহিরে আসিল, সঞ্জয় তাহার অন্তরঙ্গ হইয়া ওঠে নাই, কিন্তু দূরত্বের ব্যবধানও আর নাই। সঞ্জয় তাহাকে দেখিয়াই বলিল, হ্যালো শিবনাথ, তোমার ব্যাপার কী বল তো? কলেজেও যাচ্ছ না, এখানেও প্রায় থাক না! এ কী, তোমার চেহারা এমন কেন হে? অসুখ নাকি? ঠাণ্ডা লাগিও না, ঘরে চল, ঘরে চল।
শিবনাথ সঞ্জয়ের সঙ্গে তাহারই ঘরে আসিয়া ঢুকিল। সম্মুখেই দেওয়ালে একখানা প্রকাণ্ড বড় আয়না। পূর্বদিন হইতে অস্নাত অভুক্ত রাত্রিজাগরণক্লিষ্ট শিবনাথ আপন প্রতিবিম্ব দেখিয়া। অবাক হইয়া গেল। সত্যই তো, এ কী চেহারা হইয়াছে তাহার! কিন্তু সে তো কোনো অসুস্থতা অনুভব করে নাই!
সঞ্জয় বলিল, অনিয়ম করে শরীরটা খারাপ করে ফেললে তুমি শিবনাথ। কী যে কর তুমি, তুমিই জান। সত্যি বলতে কি, তুমি রীতিমত একটা মিস্ট্রি হয়ে উঠেছ। প্রত্যেকের নোটিশ অ্যাট্রাক্টেড হয়েছে তোমার ওপর।
শিবনাথ হাসিয়া বলিল, জান, জীবনে আমি এই প্রথম কলকাতায় এসেছি। কলকাতা যেন একটা নেশার মত পেয়ে বসেছে আমাকে। সোজা কথায় পাড়াগাঁয়ের ছেলে কলকাত্তাই হয়ে উঠছি আর কি।
ঘাড় নাড়িয়া সঞ্জয় বলিল, নট অ্যাট অল, বিশ্বাস হল না আমার। হাউএভার, আমি তোমার সিক্রেট জানতে চাই না। কিন্তু আমার একটা কথা তুমি শোন, তুমি বাড়ি চলে যাও, ইউ রিকোয়্যার রেস্ট, শরীরটা সুস্থ করা প্রয়োজন হয়েছে।
শিবনাথের মন মুহূর্তে উল্লসিত হইয়া উঠিল; শরীর-অসুস্থতার অজুহাতে বাড়ি চলিয়া যাওয়ার ছলেই তো মেস ত্যাগ করা যায়। সঙ্গে সঙ্গে সঙ্কল্প তাহার স্থির হইয়া গেল। সে হাতের আঙুল দিয়া মাথার রুক্ষ চুলগুলি পিছনের দিকে ঠেলিয়া দিতে দিতে বলিল, তাই ঠিক করেছি ভাই, শরীর যেন খুব দুর্বল হয়ে গেছে, আজই আমি বাড়ি চলে যাব। দেখি, আবার সুপার মশায় কী বলেন?
বলবে? কী বলবে? চল, আমি যাচ্ছি তোমার সঙ্গে। আমাদের দেশটাই এমনই, হেলথের দাম এখানে কিছু নয়, ডিগ্রি ইজ এভরিথিং হিয়ার; ননসেন্স! জান, আমি এইজন্যে ঠিক করে ফেলেছি, অ্যান্ড ইট ইজ সার্টেন, এই আই. এ. এগ্জামিনেশনের পরই আমি বিলেতে যাব। মামা ওয়ারের জন্যে আপত্তি করেছিলেন, কিন্তু টাইম ইজ মানি, পড়ার বয়স চলে গেলে বিলেত গিয়ে কী হবে?
শিবনাথ সঞ্জয়কে শত ধন্যবাদ দিল তাহার সুপরামর্শের জন্য, তাহার সাহায্যের জন্য। সঞ্জয় নিজেই তাহার জিনিসপত্র গুছাইয়া দিল, বিদায়ের সময় বলিল, বেশিদিন বাড়িতে থেকে না যেন। পার্সেন্টেজ কোনো রকমে দু বছরে কুলিয়ে যাবে।
শিবনাথ হাসিয়া বলিল, যত শিগগির পারি ফিরব।
হাসিয়া সঞ্জয় বলিল, তোমার বেটার হাফকে আমার নমস্কার জানিও।
জানাব।
এদিকে অরুণের মেসে সকল বন্দোবস্ত হইয়াই ছিল। অরুণ তাহার কিছুক্ষণ পূর্বেই মেস। পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গিয়াছে। মারাত্মক অস্ত্রের ছোট সুটকেসটি ঘরের কোণে কাগজের মধ্যে চাপা ছিল। শিবনাথ সেটিকে তাহার নিজের ট্রাঙ্কের মধ্যে বন্ধ করিয়া ফেলিয়া নিশ্চিন্ত হইয়া আপনার জিনিসপত্র গুছাইতে মনোনিবেশ করিল।
জিনিসপত্র গুছাইয়া সে চাকরকে ডাকিয়া বলিল, ঘরটা একবার পরিষ্কার করে দাও দেখি; বড্ড নোংরা হয়ে রয়েছে।
চাকর বলিল, অরুণবাবুওই যে বাবুটি এ ঘরে ছিলেন, তাঁর মশাই ওই এক ধরন ছিল। কিছুতেই ঘর ভাল করে পরিষ্কার করতে দিতেন না। তা দিচ্ছি পরিষ্কার করে।
কিছুক্ষণ পর সে মেসের ঝাড়ুদারনীকে সঙ্গে করিয়া ঘরে আসিয়া তাহাকে বলিল, এক টুকরো কাগজ যেন না পড়ে থাকে! ভাল করে পরিষ্কার করে দাও।
শিবনাথ স্তম্ভিত বিস্ময়ে মেয়েটির দিকে চাহিয়া ছিল। এ কে? এ যে সেই নিরুদ্দিষ্টা ডোমবউ। শরীর তাহার সুস্থ সবল, শহরের জল-হাওয়ায় বর্ণশ্রী উজ্জ্বল, কলিকাতার জমাদারনীদের মত তাহার গায়ে পরিষ্কার জামা, সৌষ্ঠবযুক্ত শাড়িখানা ফের দিয়া অ্যাঁটাট করিয়া পরা, তাহাকে আর সেই ডোমবধূ বলিয়া চেনা যায় না, তবুও শিবনাথের ভুল হইল না, প্রথম দৃষ্টিতেই তাহাকে চিনিয়া ফেলিল।
মেয়েটিও তাহার মুখের দিকে চাহিয়া প্রথমটা বিস্ময়ে যেন হতবাক হইয়া গিয়াছিল। কিন্তু সে মুহূর্তের জন্য, পর মুহূর্তেই তাহার মুখখানি যেন দীপালোকের মত উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল, মুখখানি ভরিয়া হাসিয়া সে পরম ব্যগ্রতাভরে সম্ভাষণ করিল, বাবু! জামাইবাবু! সঙ্গে সঙ্গে হাতের ঝাঁটাটা সেইখানে ফেলিয়া দিয়া সে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্ৰণাম করিল।