Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

ওরা কিছু দূরে মাত্র এসেচে–এক জায়গায় দেখলে মাটির বুকে যেন চাঁদ খসে পড়েছে!

দুজনে কাছে গিয়ে দেখলে, পরমরূপসী এক দেবী ঘাসের ওপর। বসে হাপুস নয়নে কাঁদছেন। ওরা অবাক হয়ে গেল। এত উচ্চস্তরের দেবীর দুঃখ কিসের?

যতীন জিজ্ঞেস্ করলে–মা, আপনার কোনো সাহায্য করতে পারি?

দেবী ওদের দিকে চাইলেন। যতীনের মনে হোল দেবী কি সাধে হয়? এত রূপ এত জ্যোতি এত মহিমা–অথচ কি মমতা, করুণা, দীনতায় ভরা দৃষ্টি!

বল্লেন–পারবে?

দুজনেই বলে উঠলো–হুঁকুম করুন, আপনার আশীর্বাদে পারবো।

দেবী বল্লেন–কল্পপৰ্ব্বত থেকে ফিরচো? তোমরা কোথায় থাকো?

–আজ্ঞে হ্যাঁ। আমরা এর নীচের স্বর্গে থাকি, তৃতীয় স্তরে।

–কি মধুর সঙ্গীত! শুনলে?

যতীন বল্লে–শুনলাম, মা। আমি বেশীদিন পৃথিবী ছেড়ে আসিনি। এই ব্যাপারটা কি আমায় একটু বলবেন দয়া করে?

দেবী বল্লেন–বলবো এর পরে। এখন বলি শোনো। আমি থাকি অন্য নক্ষত্রলোকে। পৃথিবীর এক জায়গায় মানুষের ভয়ানক কষ্ট। আমি সে দেশে জন্মেছিলুম হাজার হাজার বছর আগে। তাদের দুঃখে, আর আজ কল্পপৰ্ব্বতের সঙ্গীত শুনে, আমার মন বড় ব্যাকুল হয়েছে। চলো যাই পৃথিবীতে, দেখি কি করা যায় কিন্তু মুশকিল হয়েছে এই যে আমি এতকাল আগে পৃথিবী থেকে চলে এসেছি, জড় জগতের সঙ্গে সম্পর্ক এতকাল হারিয়েছি যে, সরাসরি ভাবে কোনো কাজই সে জগতে করতে পারি নে। মধ্যবর্তী স্তরের আত্মার সাহায্য ভিন্ন আমি পৃথিবীতে গিয়ে কি করবো? তোমরা যদি যাও–

ওরা বলে উঠলো, নিশ্চয়ই যাবো মা!

দেবী বল্লেন–একটু অপেক্ষা কর। আমার এক সঙ্গী আছেন– তিনি আমার লোকেই থাকেন, উচ্চ স্তরের জীব, পৃথিবীতে গিয়ে শুধু আঁকুপাঁকু করেন, কিছু করতে পারেন না কাজে। পৃথিবীর জড়স্তরে আমরা সংস্পর্শ স্থাপন করতে পারি নে। তিনি প্রাচীন যুগের একজন বড় কবি ছিলেন। তাঁকে নিয়ে যাই চলো। এসো আমার সঙ্গে।

আবার নীল শূন্যে যাত্রা।…বহু দূরে একটা ক্ষীণ নক্ষত্র জ্বলছিল। দেবী সেই নক্ষত্র লক্ষ্য করে চললেন। পরক্ষণেই এক সুন্দর উপবন। এক ক্ষুদ্র নদী বয়ে যাচ্ছে উপবনের মধ্য দিয়ে–লতাপাতা কিন্তু পৃথিবীর মত শ্যামল–পৃথিবীরই যেন এক শান্ত প্রাচীনকালীন তপোবন। মৃগকুল নির্ভয়ে খেলা করে বেড়াচ্চে, লতায় লতায় বিচিত্র বন্য পুষ্প প্রস্ফুটিত। এক সৌম্যমূৰ্ত্তি জ্যোতির্ময় আত্মা লতাবিতানে বসে কি যেন লিখচেন। দেবী ওদের নিয়ে গিয়ে সামনে দাঁড় করালেন। মুখ তুলে চাইতেই যতীন ও পুষ্প এগিয়ে গিয়ে তাঁর পায়ের ধুলো নিয়ে প্রণাম করলে।

দেবী বল্লেন–কল্পপৰ্ব্বতের পথে এদের সঙ্গে দেখা। পৃথিবীতে নিয়ে যাবো তাই সঙ্গে করে আনলাম।

যতীন ও পুষ্পের দিকে চেয়ে দেবী বল্লেন–রামায়ণ-রচয়িতা কবি বাল্মীকি তোমাদের সামনে।

ওরা দুজনেই চমকে উঠলো। মহাকবি বাল্মীকি!

দেবতা স্মিতহাস্যে ওদের বসতে বল্লেন। আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বল্লেন–এই আমার আশ্রম। ওই পাশেই তমসা নদী। ওই আমার গৃহ। পৃথিবীতে যা আমার প্রিয় ছিল এখানে তাই সৃষ্টি করেচি, ওই আমার স্বর্গ। আর তোমাদের সামনে ইনি আমার মানসদুহিতা-সীতা, যিনি তোমাদের সঙ্গে করে এনেছেন।

পুষ্প, যতীন বিস্মিত, স্তব্ধ। ভারতবর্ষের ছেলেমেয়ে তারা। সীতার নামে ওদের সৰ্ব্ব শরীরে বিদ্যুতের ঢেউ বয়ে গেল। কত যুগ ধরে ভারতের আকাশ বাতাস যে পুণ্য নামে মুখরিত, সেখানকার বনের পাখীও যে নামে গান গায়, সেই ভগবতী দেবী জানকী তাদের সম্মুখে! এ কি স্বপ্ন, না মায়া, না মতিভ্রম?

বাল্মীকি বল্লেন–তোমরা বিস্মিত হয়েচ। বোধ হয় এ লোকে বেশী দিন আসনি। সীতাকে আমি সৃষ্টি করেচি। যা ছিলেন পৃথিবীতে আমার কল্পনার মধ্যে–এ লোকে তা মূর্তিমতী হয়েচেন।

যতীন বল্লে–বুঝতে পারলাম না, দেব।

–এ লোকে চিন্তার দ্বারা জীবের সৃষ্টি করা যায়। শুধু যে বাড়ীঘর করা যায় তাই নয়, স্থানের ও সময়েরও সৃষ্টি করা যায়। আমাদের। আশ্রমের সময় কি দেখছো?

–আজ্ঞে, সন্ধ্যা গোধূলি।

–আমার সময় সন্ধ্যা গোধূলি। আমি ভালবাসি গোধূলি। আমার কল্পনা এই সময় জাগ্রত হয়। তাই আমার আশ্রমে সব সময় গোধূলি।

–আচ্ছা দেব, শ্রীরামচন্দ্র তবে কোথায়?

–সীতাকে যত আন্তরিক আগ্রহ নিয়ে সৃষ্টি করেছিলাম, রামচন্দ্রকে তত সহানুভূতি নিয়ে গড়িনি। তাই আমার স্বর্গে আমার প্রিয়তম সৃষ্টি সীতাই আছেন, রামচন্দ্র নেই। লক্ষণ নেই, ভরত নেই, কেউ নেই।

–তবে কি, দেব, সীতা বা রামচন্দ্র সত্যি সত্যি কেউ ছিলেন না?

–হয়তো ছিলেন। আমি তাঁদের জানি না। আমার কাব্যের রাম, আমার কাব্যের সীতা–আমারই সৃষ্ট জীব। ও প্রায়ই আমার এখানে আসে। নানা কাজে সারা জগৎ ঘুরে বেড়ায়, কিন্তু আমায় ভোলে না।

করুণাদেবী বল্লেন–বাবা, ওসব এখন রাখো। পৃথিবীতে যাবে?

বাল্মীকি বল্লেন–তুই তো জানিস, পৃথিবীতে গিয়ে আমি কিছু করতে পারিনে। বহুঁকাল আগে ভবভূতিকে প্রভাবান্বিত করে একখানা কাব্য লিখিয়েছিলাম–চমৎকার কাব্য হয়েছিল। আর বাংলাদেশের মধুসুদনকে দিয়ে আর একখানা কাব্য লেখাতে গিয়েছিলুম–কিন্তু বেশি প্রভাবান্বিত করতে পারিনি–গিয়ে দেখি কয়েকটি ভিন্নদেশীয় কবি তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তাঁদের প্রভাবই তার উপর বেশী কাজের হোল। আমি গিয়ে ফিরে এলাম। তুই একাই যা মা–এদের নিয়ে যা–এই ছেলেমেয়ে দুটিকে। এরা নতুন পৃথিবী থেকে এসেছে এদের দিয়ে কাজ ভাল হবে।

পুষ্প বল্লে–চলুন দয়া করে, যেখানে আমাদের নিয়ে যান যাবো।

ওরা কিছুক্ষণ পরে পৃথিবীতে এসে পৌঁছলো। পৃথিবীতে তখন সকাল দশটা, কিন্তু দেশটা খুব শীতের দেশ। রৌদ্রের মুখ দেখা যায় না। কুয়াশায় চারিদিক ঘেরা। প্রথমে একটা গ্রামে ওরা গিয়ে পৌঁছলো–সেখানে ভয়ানক দুর্ভিক্ষ হয়েছে। প্রত্যেক বাড়ীতে অনাহার জীর্ণ বাপ মা ছেলে মেয়ে-পথের ধারে অনাহারে মৃত মানুষের দেহ। পাশাপাশি অধিকাংশ গ্রামেরই সেই অবস্থা। নিকটবর্তী একটা গ্রামে মোটরভ্যান এসেচে মৃতদেহ কুড়িয়ে ফেলবার জন্যে। পুলিশের লোক জেলের কয়েদীদের দিয়ে মৃতদেহ বহন করাচ্চে। তারা রাস্তার ধার থেকে ঘরের মধ্যে থেকে মৃতদেহের ঠ্যাং ধরে হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে মোটরভ্যান বোঝাই করচে! গাড়ীটা ময়লা ফেলা গাড়ীর মত বোঝাই হয়ে গিয়েচে মৃতদেহের স্থূপে। তার মধ্যে বালক, বৃদ্ধ, যুবা, শিশু সকলের মৃতদেহই আছে। পচামড়ার গন্ধে চারিদিক নিশ্চয়ই পূর্ণ, কারণ যে সব জেলকয়েদী মুদ্দাফরাসের কাজ করছে, তাদের নাকে মুখে কাপড় বাঁধা। বীভৎস দৃশ্য।

রোগজীর্ণ ও অনাহারশীর্ণ লোক দলে দলে শহরের দিকে চলেচে সকলের ভাগ্যে শহরে পৌঁছনো ঘটবে না, পথেই অর্ধেক লোক মরবে। তারপর আছে পুলিশের মোটরভ্যান ও জেলকয়েদী মুদ্দাফরাসের দল। যারা শহরে পৌঁছুচ্চে, তারা অনেকে সেখানে দুব্বল শরীরে দুরন্ত শীতের আক্রমণ সহ্য করতে না পেরে পেভমেন্টের ওপর ল্যাম্প পোস্টের তলায় মরে পড়ে থাকবে। বেচারীরা ল্যাম্পপোস্টের তলায় আশ্রয় নিচ্চে ওপরের আলোটা থেকে এতটুকু উত্তাপ পাবার মিথ্যা আশায়। তারপর তাদের জন্যে রয়েছে পুলিশের মোটরভ্যান ও সেই জেলকয়েদী শ্মশানবন্ধুর দল।

পথের ধারে বসে এক জায়গায় দুর্ভিক্ষক্লিষ্ট আট বছর বয়সের বড় ভাই পাঁচ বছর বয়েসের শীর্ণকায় কঙ্কালসার ছোটভাইকে একটা ভাঙা তোবড়ানো, রাস্তার ধারে কুড়োনো টিনের মধ্যে করে মুসুরির ডাল সিদ্ধ মুখে তুলে খাওয়াচ্চে। এই সব অসহায় ছেলেমেয়ের কষ্ট সকলের চেয়ে বেশী-দেবীর চোখে জল এল এদের কষ্টে। অধিকাংশ ছেলেমেয়ের বাপ-মা তাদের শহরে ছেড়ে দিয়ে পুলিশের ভয়ে পালিয়ে গিয়েচে–এই আশায় যে, শহরে থাকলে তবু তাদের পাঁচজনে দয়া। করবে, একেবারে না খেয়ে মরবে না, কোনো কোনো ছেলেমেয়ের বাপ-মা অনাহারের ও রোগের কষ্টে পথের ধারেই ইহলীলা সংবরণ। করে লাসবোঝাই মোটরভ্যানে নিরুদ্দেশযাত্রা করেচে—

আরও কয়েকটি আত্মা এদের মধ্যে কাজ করচে দেখা গেল।

দেবীকে দেখে একটি মেয়ে এগিয়ে এলেন। এঁর দেহ অতি সুন্দর, স্বচ্ছ সুনীল জ্যোতিমন্ডিত–দেখেই বোঝা যায় খুব উচ্চ শ্রেণীর আত্মা।

এঁদের কাজ দেখে মনে হোল দুর্ভিক্ষে মৃত ব্যক্তিদের আত্মা যাতে আত্মিকলোকে এসে দিশাহারা হয়ে কষ্ট না পায়–সেই দেখতেই এরা সমবেত হয়েছেন।

দেবী সেই মেয়েটির সঙ্গে আলাপ করলেন। মেয়েটি বল্লে–আমার এই দেশ। বহু দিন আগে ভলগা নদীর ধারে একটি গ্রামে এক কৃষকপরিবারে আমি জন্ম নিয়েছিলাম–জার আইভ্যানের রাজত্বকালে। রাশিয়ার কৃষকেরা চিরদিনই দুঃখী–সোভিয়েট গবর্ণমেন্টের আমলে এদের ক্ষেত্রের ফসলের ভাগ দিতে হয় কারখানার শ্রমিকদের ও শহরের সুবিধাপ্রাপ্ত নাগরিক শ্রেণীর জন্যে। এদের জন্যে যা থাকে, তাতে এদের কুলোয় না। তাই এই ঘোর দুর্ভিক্ষ। এদের ছেড়ে আমি যেতে পারিনে–তাই এদের সঙ্গে সঙ্গে থাকি। আর একজন লোকের সঙ্গে আপনাদের আলাপ করিয়ে দিই আসুন।

একজন অতি সুন্দর সুশ্রী যুবক কিছু দূরে একদল দুর্ভিক্ষপীড়িত বালক-বালিকার মধ্যে দাঁড়িয়ে কি করছিলেন।

মেয়েটি বল্লেন–ইনি ডাক্তার আমেন্ডো। রাশিয়ার কৃষকদের জন্যে ইনি সারা জীবন খেটেচেন পৃথিবীতে থাকতে। গবর্ণমেন্টের কুদৃষ্টিতে পড়ে লণ্ডনে পালিয়ে গিয়েছিলেন মহাযুদ্ধের পূৰ্ব্বে। সোভিয়েট গবর্ণমেন্টের সময়েও ফিরে এসে অনেক দুর্দশা ভোগ করেছেন। স্ট্যালিনের সুনজরে বড় একটা ছিলেন না। এঁর জীবনের একমাত্র কাম্য হচ্চে গরীব ও দুঃখী লোকের দুঃখ দূর করা। সোভিয়েট গবর্ণমেন্টের অনেক জিনিস ইনি সুদৃষ্টিতে দেখতেন না, তারাও এঁকে সুনজরে দেখতো না। আজ মাত্র পাঁচ বছর হোল আত্মিক লোকে এসেচেন, তাও সেই গরীবদেরই কাজে প্রাণ দিয়ে। আমাশা রোগে আক্রান্ত পল্লীতে ডাক্তারি করতে গিয়ে নিজে সংক্রামক আমাশা রোগেই প্রাণ হারান। এত বড় নিঃস্বার্থ দয়ালু আত্মা এ যুগে খুব কমই জন্মেচে। মরণের পরে এ লোকে এসেও সেই রাশিয়ার গরীব লোকদের নিয়েই থাকেন। যেখানে দুর্ভিক্ষ, যেখানে রোগ-শোক সেখানেই ছুটে আসছেন। চতুর্থ স্তরের আত্মা, কিন্তু পৃথিবী ছেড়ে যেতে চান না কোথাও।

ডাক্তার আমেন্ডো এদের সামনে এসে হাসিমুখে দাঁড়ালেন। বল্লেন– আপনারা ভারতবর্ষের লোক ছিলেন না? দেখলেই বোঝা যায়। এরা ভগবানকে খেদিয়ে দিচ্চে দেশ থেকে, যেন ইটপাথরের তৈরী গির্জা ভাঙলেই ভগবানকে তাড়ানো যায়! রাশিয়াতে উচ্চ শ্রেণীর ভারতীয় মুক্তাত্মা যদি দয়া করে আসেন, তবে কিছু কাজ করা যায়।

মেয়েটি বল্লেন–সে দু-একজনের কাজ নয়, ডাক্তার। অনেক আত্মার সমবেত চেষ্টার ফলে যদি চিন্তার চৌম্বক ঢেউ-এর সৃষ্টি করা যায়–খুব শক্তিশালী ঢেউ, তবে হয়তো কিছু হতে পারে। তোমার আমার দ্বারা তা হবে না।

ডাক্তার আমেন্ডো বল্লেন–আর একটা ব্যাপার। পৃথিবীতে এসে এখন দেখচি আমরা বড় অসহায় হয়ে পড়ি। দ্বিতীয় তৃতীয় স্তরের আত্মার সাহায্য না নিয়ে কিছু করতে পারিনে। জন কতক দ্বিতীয় স্তরের লোক আমরা যোগাড় করে এনেচি কিন্তু ওরা মন দিয়ে কাজ করছে না।

পুষ্প বল্লে–আমাদের দুজনকে নিন দয়া করে আপনার দলে। আমাদের দিয়ে যা সাহায্য হয় পাবেন। একটা কথা, আমাদের ভারতবর্ষেও দুর্ভিক্ষে আর বন্যায় বড় কষ্ট পায় লোকে। সেখানকার। জন্যেও আপনারা সাহায্য করবেন–তারা বড় দুঃখী।

ডাঃ আমেন্ডো বল্লেন–সে আপনি ভাববেন না। যেখানেই লোকে দুঃখ পাচ্ছে, সেখানেই আমরা থাকবো। দেশ, জাতি, ধৰ্ম্মের গণ্ডি নেই আমাদের কাছে। সারা পৃথিবী আমাদের দেশ। তবে কি জানেন, এই রাশিয়া আমাদের জন্মভূমি। এখানকার লোকের দুঃখ আমাদের প্রাণকে বড় স্পর্শ করে। ভারতবর্ষেও যখন যেতে বলবেন, তখনই আমরা যাবো। আমাদের দলে অনেক লোক আছেন–সবাইকে নিয়ে যাবো।

যতীন বল্লে–আরও উচ্চ স্তরের কোনো লোক আসেন না কেন? পঞ্চম বা ষষ্ঠ কি তারও ওপরের স্তরের কাউকে তো দেখতে পাইনে।

ডাঃ আমেন্ডো বল্লেন–তাঁরা কাজ করেন আমাদের মধ্যে দিয়ে। তাঁরা এলেও আপনি তাঁদের চোখে দেখতে পাবেন না। পৃথিবীতে এলে। তাঁরা আমাদের চেয়েও অসহায় হয়ে পড়েন। পৃথিবীর স্থূললোকের স্থূল মনের ওপর তাঁদের প্রভাব আদৌ কার্যকর হয় না। তাঁরা উৎসাহ ও প্রেরণা দেন আমাদের–আমরা কাজ করি।

মেয়েটি বল্লেন–এর মধ্যে আরও কথা আছে। বড় বড় দুর্ভিক্ষ, মড়ক, বন্যা, ভূমিকম্প প্রভৃতির যাতে দেশকে দেশ বা জাতিকে জাতি। কষ্ট পায়–এ সবের মূলে অতি উচ্চ দেবতা–যাঁরা গ্রহদেব প্ল্যানেটরি স্পিরিট–তাদের হাত রয়েছে। তাঁদের উদ্দেশ্য বা কৰ্ম্মপ্রণালী আমরা বুঝিনে। কিন্তু ঐ সব উচ্চ স্তরের বড় বড় লোকে তা বুঝতে পারেন। এর হয়তো কোথাও বড় একটা উদ্দেশ্য রয়েছে। আমাদের দৃষ্টি তত দূর পৌঁছোয় না–তাঁরা সেটা দেখতে পান, কাজেই গ্রহদেবদের কাজে হস্তক্ষেপ করতে যান না। আপনি কিছুদিন আমাদের সঙ্গে থাকুন ঘোরাফেরা করুন, অনেক কিছু দেখতে বা জানতে পারবেন। এ লোকের কান্ডকারখানা এত বিরাট ও জটিল যে নতুন পৃথিবী থেকে এসে মানুষে হতভম্ব হয়ে পড়ে–কিছুই ধারণা করতে পারে না।

যতীন বল্লে–কিন্তু জানবার আগ্রহ আমার অত্যন্ত বেশী, দেবী। আমি জানতে চাই কি করে এই বিরাট আত্মিকমন্ডলী কাজকর্ম চালাচ্চেন–এঁরা কি করেন, এঁদেরই বা কে চালাচ্চে, গ্রহদেব যাঁদের। বলছেন, তাঁরাই বা কে, কোথায় থাকেন, কত উচ্চ স্তরের আত্মা, তাঁদের দেখতে পাওয়া যায় না কেন, কোথা থেকে তাঁরা এলেন–এ সব না জানলে আমার মনে শান্তি নেই।

মেয়েটি বল্লেন–জানবার ইচ্ছে থাকলেই ক্রমে ক্রমে সব জানতে পারবেন। এই আগ্রহই আসল। বেশীর ভাগ মানুষ পৃথিবী থেকে এখানে এসে কিছুই জানে না, বোঝে না, বোঝবার চেষ্টাও করে না। জানবেন, জ্ঞান ভিন্ন উন্নতি নেই। এ লোকে আরও শক্ত নিয়ম। সেবা বলুন, ধৰ্ম্ম বলুন, প্রেম বলুন–ততদিন ঊর্ধ্বলোকে আপনার ঠাঁই হবে, যতদিন জ্ঞানের আলো আপনার মনের অন্ধতা দূর না করচে।

ডাক্তার আমেন্ডো বল্লেন–পৃথিবীতে কি জানেন, নানা মুনির নানা মতে সেখানে সত্যের সমাধিলাভ ঘটেছে। এখনও পৃথিবীর মন আপনার যায়নি। এ জীবনের বিরাট প্রসারতা এখনও আপনি দেখতে পাননি। আপনি অজর, অমর, আপনার জীবন শাশ্বত অফুরন্ত। আপনার জন্মগত অধিকার এই জীবনের অমৃতপানে। আপনি তৃতীয় স্তরের মানুষ, আপনি কি ছোট? আপনিও মুক্তাত্মা, আপনার সঙ্গে এই মহীয়সী মহিলা তো সাক্ষাৎ দেবী। এই সব পৃথিবীর হতভাগ্যদের ভরসার স্থল আপনারা। এরা যখন ভগবানের কাছে প্রার্থনা করে সে প্রার্থনা যাঁর কাছে পৌঁছোয়, তিনি আপনাদের মত পবিত্র মুক্তাদের মধ্যে দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করে এদের সাহায্য করেন। তিনি শক্তি বিকীর্ণ করচেন, আপনারা যন্ত্ররূপে সেই শক্তিকে ধরচেন, ধরে কাজে লাগাচ্চেন। বেতারের ঢেউএর আপনারা রিসিভার। যন্ত্র যত উঁচুদরের, যত নিখুঁৎ–তাঁর বাণীর প্রকাশ সেখানে তত সুস্পষ্ট, সুন্দর।

যতীন অদ্ভুত প্রেরণা পেলে, ডাক্তার আমেন্ডোর মত এত বড় আত্মার প্রশংসাতে। কিছু লজ্জিতও হোল। এতখানি প্রশংসার উপযুক্ত সে নয় তা সে জানে। তবে হবার চেষ্টা আজ থেকে তাকে করতেই হবে।

কিছু পরে পুষ্প ও যতীনের পায়ের তলায় বিশাল ভলগা একটা সরু রৌপ্যসূত্রের মত হয়ে ক্রমশঃ অদৃশ্য হয়ে গেল। সেদিনের মত ওরা বিদায় নিলে।

পুষ্পদের বুড়োশিবতলার বাড়ীতে আজকাল দেবী প্রায়ই আসেন। এঁকে আমরা করুণাদেবী বলে পরিচয় দেবো। করুণাদেবী অতি উচ্চ স্তরের নীলজ্যোতিবিশিষ্ট আত্মা–কিন্তু পৃথিবীর কাছাকাছি তিনি থাকতে ভালবাসেন, কারণ পৃথিবীর আর্ত জীবকুল ছেড়ে ঊর্ধ্বে স্বর্গে গিয়ে তিনি শান্তি পান না। এঁর চরিত্রের মাধুর্যে ও সুন্দর ব্যবহারের কথা শুনে পুষ্প ও যতীন এঁর প্রতি অত্যন্ত আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিল।

যখনই তিনি আসতেন, একরাশ ফুল ও ফল নিয়ে আসতেন ওপরের স্বর্গ থেকে। সে ফুল যেন স্পন্দনশীল আলোর তৈরী–খাওয়া যায়, খুব সুস্বাদু এবং ভারি চমৎকার ভুরভুরে সুগন্ধ তার। সে ফল খেলে মনে শক্তি ও পবিত্রতা আসে, এই তার গুণ। কিন্তু এই নিম্নতর তৃতীয় স্বর্গে সে ফল বেশী সময় থাকতো না–কিছুক্ষণ পরেই ঠিক কর্পূরের দলার মত উবে যেত। দেবী বলতেন, ওপরকার জগতের এই সব ফল পৃথিবীর ন্যায় স্থূল দেহের সৃষ্টির জন্যে জন্মায় না, মনের আধ্যাত্মিক পুষ্টির খোরাক যোগানোই এদের কাজ।

সেদিন তখন ওদের বাড়ীতে সকালবেলা করে রেখেছে পুষ্প। ঠিক যেন পৃথিবীর সকাল, লতাপাতায় শিশির, পাখী ডাকচে ও গঙ্গার

ওপারে সূর্য উদয় হচ্চে, পুষ্প সবে গঙ্গাস্নান করে শিবমন্দিরে পূজো। করতে যাচ্ছে, এমন সময় করুণাদেবী এলেন। পুষ্পকে বল্লেন–বেশ সকালটি করে রেখেচ তো! পূজো সেরে নাও, চল তুমি আর যতীন আমার সঙ্গে এক জায়গায় যাবে!

যতীন ঘরের মধ্যে বসে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে চেয়ে ছিল।

দেবীকে বসবার আসন দিয়ে সে দাঁড়িয়ে রইল। করুণাদেবী বল্লেন–তুমি পূজো কর না?

–ওতে আমার বিশ্বাস নেই। আমার মনে হয় পৃথিবীতে দেবতা ও ভগবান সম্বন্ধে আমাদের যে ধারণা গড়ে ওঠে, এখানে এসে তার আমূল সংস্কারের প্রয়োজন আছে। সে ভাবের দেবতা কই এখানে? সে ভাবের ভগবানই বা কোথায়? পুষ্প মেয়েমানুষ, ওর মনে ভক্তি ও পূজার্চনার প্রবৃত্তি কোনো প্রশ্ন ওঠায় না। বিনা দ্বিধায় বিনা প্রশ্নে সে পূজার ফুল তার মনগড়া ইষ্টদেবের পায়ে দেয়। আমি তা পারি না। আমার মনে হয়–

করুণাদেবী বল্লেন–তোমার এ কথার মধ্যে ভুল রয়েছে, যতীন। তুমি ভেবো না ভগবান সম্বন্ধে তুমি কোনো ধারণা কখনো করে উঠতে পারবে। তুমি কোথায়, আর সেই বিরাট বস্তু, যাঁকে পৃথিবীতে বলে ভগবান, তিনিই বা কোথায়? অতএব ভক্তি ও অর্চনাপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করতে হোলে তোমার মনের মত ভগবান তোমাকে গড়ে নিতে হবে। তোমার সেই মন-গড়া দেবতার মধ্যে দিয়েই অর্ঘ্য পৌঁছোবে সেই বিশ্বদেবের পায়ে। তুমি তৃতীয়-স্বর্গবাসী জীব, এর বেশী কি করতে পারো?

যতীন ছাড়তো না তর্ক করতো, এমন সময়ে পূজো শেষ করে পুষ্প ফিরে এল। দেবী ওদের দুজনকে নিয়ে পৃথিবীতে এলেন।

যে জায়গাটিতে তাঁরা এলেন, সেখানটা একটা নির্জন স্থান। ছোট্ট একটা নদী, তার ধারে অনেকদূরব্যাপী ঘন জঙ্গল।

যতীন বল্লে–এটা কোন দেশ?

দেবী বল্লেন-বাংলাদেশ, চিনতে পারচ না কেন? মধুমতী নদী, এইখানে ছিল বড় গঞ্জ নকীবপুর, রাজা সীতারাম রায়ের আমলে। ধ্বংস হয়ে জঙ্গল হয়ে রয়েছে। বাংলাদেশ ছাড়া তোমাদের আনতাম না–কারণ যে কাজ করতে হবে তাতে বাঙলা ভাষা বলা দরকার হবে। চল দেখাচ্চি।

নদীর ধারে জঙ্গলের মধ্যে এক জায়গায় ছোট একখানা খড়ের বাড়ী। কিন্তু বাড়ীখানা দেখেই যতীন অবাক হয়ে গেল। ঘরখানা পৃথিবীর বস্তু দিয়ে তৈরী নয়। আত্মিকলোকের চিন্তাশক্তিতে সূক্ষ্ম আত্মিকলোকের সূক্ষ্ম পদার্থে তৈরী ঘর। পৃথিবীতে এমন ঘর কি করে এল, যতীন জিজ্ঞাসা করতে যাচ্চে–এমন সময় একটি বৃদ্ধ এক বোঝা কঞ্চি বয়ে নিয়ে ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালো।

যতীন আরও অবাক হয়ে গেল।

বৃদ্ধটি পার্থিব স্থূল দেহধারী মানুষ নয়–খুব নিম্নস্তরের আত্মা পৃথিবীতে যাকে বলে প্রেত! তার হাতের কঞ্চির বোঝাও সত্যিকার কঞ্চির বোঝা নয়, সেটা চিন্তাশক্তিতে গড়া আত্মিকলোকের বস্তু দিয়ে তৈরী।

বৃদ্ধের ভাব দেখে মনে হোল সে তাদের কাউকে দেখতে পায়নি।

যতীন বিস্মিত ভাবে বল্লে–ব্যাপার কি? এ তো মানুষ নয়। এখানে। এ ভাবে কি করচে?

করুণাদেবী বল্লেন–সেই কথা বলবো বলেই তোমাদের আজ এনেচি। বড় করুণ ইতিহাস লোকটির। ওর নাম দীনু পাড়ই। স্ত্রীকে সন্দেহ হয় বলে খুন করে নিরুদ্দেশ হয়–দেশ থেকে পালিয়ে পুলিশের ভয়ে নাম ভাঁড়িয়ে নকীবপুরের এই জঙ্গলে অনেক দিন ঘর বেঁধে ছিল। আট-দশ বছর পরে ওর নিমোনিয়া হয়, তাতেই মারা পড়ে। মৃত্যুর পরে হয়ে গিয়েচে আজ ত্রিশ বছর। এই ত্রিশ বছরেও ও বুঝতে পারেনি যে ও মরে গিয়েচে। ভাবে, ওর কি অসুখ করেছে, তাই ওকে কেউ দেখতে পায় না। জঙ্গলের মধ্যে খুব কমই লোক আসে, কাজেই জীবন্ত মানুষের সঙ্গে ওর পার্থক্য কি, বুঝবার সুযোগ ঘটেনি। নিজেও পুলিশের ভয়ে জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে থাকে। অথচ এত স্থল ধরনের মন, এত নিম্নস্তরের আত্মা যে, আমি কতবার চেষ্টা করেও কিছু করতে পারিনি। আমাকে ও দেখতেও পায় না। ওর নিজের লোক যারা মারা গিয়েচে, কখনো কেউ আসে না। তাই তোমাদের এনেছি আজ।

যতীন বল্লে–আশ্চৰ্য্য!

দেবী বল্লেন–মরে গিয়ে বুঝতে না পারা আত্মিক লোকের এক রকম রোগ। পুরোনো হয়ে গেলে এ রোগ সারানো বড় কঠিন, কারণ মৃত্যুর প্রকৃত স্বরূপ কখনো না জানার দরুন এই সব অজ্ঞ নিম্ন আত্মারা বেঁচে থাকার সঙ্গে মৃত্যুর পরের অবস্থার সূক্ষ্ম পার্থক্যটুকু আদৌ বুঝতে পারে না। এমন কি, বুঝিয়ে না দিলে ষাট, সত্তর, একশো, দুশো বছর এ রকম কাটিয়ে দেয়, এমন ব্যাপারও বিচিত্র নয়।

যতীন এমন ব্যাপার কখনো শোনেনি। সঙ্গে সঙ্গে এই হতভাগ্য, বন্ধুহীন, স্বজনহীন, অসহায় বৃদ্ধের ওপর তার সহানুভূতি হোল। করুনাদেবী সত্যই করুণাময়ী বটে, পৃথিবীর এই সব হতভাগ্যদের খুঁজে খুঁজে বার করে তাদের সাহায্য করা তাঁর কাজ, তিনি যদি দেবী না হবেন, তবে কে হবে?

যতীন বল্লে–আচ্ছা এই খড়ের ঘরটা–

এবার উত্তর দিলে পুষ্প। বল্লে–বুঝলে না? ওর আসল পৃথিবীর ঘরখানা কোন্ কালে পড়ে ভূমিসাৎ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সেই ঘরখানার ছবি ওর মনে তো আছে–ওর চিন্তা সেই ছবির সাহায্যে ঘরটা গড়েচে যেমন আমার তৈরী গঙ্গা আর কেওটার বুড়োশিবতলার ঘাট। এ লোকে তো ও তৈরী করা কঠিন নয়। অনেক সময় আপনা-আপনি হয়।

দেবী বল্লেন–পুষ্পকে আর আমাকে ও তো দেখতে পাবেই না। যতীন এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াও তো ওর সামনে!

সন্ধ্যা হয়ে গেল। জঙ্গলের মধ্যে ঘন অন্ধকারে ঝোঁপঝাড়ে জোনাকি পোকা জ্বলে উঠলো। যতীন গিয়ে বুড়োর সামনে দাঁড়ালো, কিন্তু তার ফল হলো উল্টো। বৃদ্ধ ওকে হঠাৎ দেখতে পেয়ে ভয় পেয়ে চীৎকার করে উঠলো এবং ঠক্ ঠক্ করে কাঁপতে লাগলো। দেবী বল্লেন, ও তোমাকে দেখতে পেয়েছে, কিন্তু ভাবচে তুমি ভূত।

পুষ্প ভাবলে, কি মজার কাণ্ড দ্যাখো! ভূত হয়ে ভূতের ভয় করছে!

দেবী বল্লেন–ওর সঙ্গে কথা বলো–

যতীন বল্লে–ভয় কি বুড়োকৰ্ত্তা! ভয় পাচ্ছ কেন?

বৃদ্ধ ভয়ে কাঁপছে আর রাম রাম বলচে। যতীনের হাসি পেল কিন্তু দেবী সামনে রয়েছেন বলে সে অতি কষ্টে চেপে গেল।

যতীন আবার বল্লে–বুড়োকর্তা, ভয় কিসের, তুমি এখানে একলা আছ কেন?

এবার বোধহয় বৃদ্ধের কিছু সাহস হোল। সে বল্লে–আজ্ঞে কর্তা আপনি কে?

–আমার এখানেই বাড়ী। কাছেই থাকি। তুমি কতদিন এখানে। আছ? একলা থাকো কেন? তোমার কেউ নেই?

বৃদ্ধ এইবার একটু ভিজল। বল্লে–বাবু, আপনি পুলিশের লোক নয়? আমায় ধরিয়ে দেবেন না?

যতীন বল্লে না, কেন ধরিয়ে দেবো? কি করেছ তুমি? তা ছাড়া তোমার যা অবস্থা তাতে পুলিশে তোমাকে এখন আর কিছু করতে পারবে না।

বৃদ্ধ উৎকণ্ঠিত সুরে বল্লে–কি হয়েছে বলুন তো বাবু আমার? আপনি কি ডাক্তার? সত্যি বাবু, আমিও বুঝতে পারিনে যে আমার এ কি হোল। একবার অনেককাল আগে আমার শক্ত অসুখ হয়– তারপর অসুখ সেরে গেল, কিন্তু সেই থেকে আমার কি হয়েছে আমার কথা কেউ শুনতে পায় না, লোককে ডেকে দেখেছি আমার ডাক না। শুনে তারা চলে যায়। মামুদপুরের হাটে যাই, কেউ আমার সঙ্গে কথা বলে না। আমার শরীরে যেন খিদে তেষ্টা চলে গিয়েছে। আগে আগে। ভাত খেতাম, এখন খিদে হয় না বলে বহুঁকাল খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। শরীরটা কেমন হালকা মনে হয়, যেন তুলোর মত হালকা–মনে হয়, যেন আকাশে উড়ে যাবো। তেষ্টা নেই শরীরে। আর একটা জিনিস বাবু, কোনো কিছুতে হাত দিলে আগের মত আর আঁকড়ে ধরতে পারিনে। হাত গলিয়ে চলে যায়। এ কি রকম রোগ বাবুমশাই? পুলিশের ভয়ে কোথাও যেতে পারি নে, নইলে নলদীর সরকারী ডাক্তারখানায় গিয়ে একবার ডাক্তারবাবুকে দেখাবো ভেবেছিলাম।

যতীন বল্লে–বলছি সব কথা। কিন্তু পুলিশের ভয় কর কেন? কি করেছিলে?

বৃদ্ধ সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে বল্লে–কেন বাবু?

-বল না। আমি কাউকে বলবো না। আমার অবস্থা বুঝতে পারচ? আমিও তোমার দলের একজন। আমিও মানুষজনের সঙ্গে মিশতে পারিনে।

কথাটার মধ্যে দুরকম অর্থ ছিল। বৃদ্ধ সোজাটাই বুঝলে। বুঝে বল্লে আপনার নামেও গ্রেপ্তারী পরোয়ানা আছে না কি বাবু? কি করেছিলেন আপনি?

–আমি আমার স্ত্রীকে খেতে দিতাম না। বাপের বাড়ী ফেলে রেখেছিলাম। তার সঙ্গে আমার ঝগড়া হোত প্রায়ই। তারপর একদিন

বৃদ্ধ বল্লে–বাবু মশাই, আপনি পুলিশের লোক। আমি বুঝতে পেরেচি। আপনি সব জানেন দেখচি। তা ধরুন আমায়, আমার যে রোগ হয়েচে, বোধহয় বেশিদিন বাঁচবো না। এ রকম জ্যান্ত মরা হয়ে থাকার চেয়ে ফাঁসি যাই যাবো। এতদিনে আমার ভুল বুঝতে পেরেচি বাবু মশাই। আমার বৌ-এর কোনো দোষ ছিল না, সতীলক্ষ্মী ছিল সে। আমার মনে মিথ্যে ধুবুক ছিল কালীগয়লার ছোট ভাইটার সঙ্গে বড় হাসিঠাট্টা করতো। বারণও করে দেলাম অনেকবার, তাও শুনতো না। তাই একদিন রাগের মাথায়–কিন্তু দোহাই দরোগা বাবু, খুন করবো বলে মারিনি। মাঠ থেকে সবে এসে দিইচি বাড়ীতে দেখি কালীগয়লার ভাই ছিচরণ খিড়কী দোর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে; চাষার রাগ-বল্লাম–ও কেন বাড়ীর মধ্যে ঢুকেছিল; বউ উত্তর দেবার আগেই রাগের মাথায় তার মাথায় এক ঘা–

বৃদ্ধ হঠাৎ কেঁদে ফেললে। বল্লে–তারপর আমি সব বুঝতে পেরেছিলাম দারোগাবাবু। ছিচরণকে বউ ভাই-এর মত দেখতো। ছিচরণ হাসির গল্প বলতে পারতো, বউ তাই শুনতে ভালবাসতো। বৌ-এর কোন দোষ ছিল না। সেই পাপের ফলে আজ আমার এই ভয়ানক রোগ জন্মেচে শরীরে। আর আমার জীবনে মায়া নেই, সৰ্ব্বদা। বউড়ার কথা ভাবি আজকাল। অনেকদিন থেকেই ভাবি। একা একা এই জঙ্গলে এই রোগ নিয়ে আর কাটাতে পারিনে, দারোগাবাবু। জেলে গেলে তবুও পাঁচটা মানুষের সঙ্গে কথা বলে বাঁচবো।

দেবী বল্লেন–ওকে জিজ্ঞেস কর, ওকি বৌ-এর সঙ্গে দেখা করতে চায়?

যতীন বৃদ্ধকে কথাটা জিজ্ঞেস্ করতেই সে অবাক হয়ে ওর দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে বল্লে–তবে কি বাবু বৌ হাসপাতালে গিয়ে বেঁচে গিয়েছিল?

যতীন বল্লে–তা নয়, তুমিও আর বেঁচে নেই। তুমিও মরে গিয়ে, তোমার বৌও মরে গিয়েছে। আমিও মরে গিয়েছি। সবাই আমরা পরলোকে আছি এখন। তোমাকে উদ্ধার করতে আরও দু’জন দেবী এখানে এসেছেন, তুমি তাদের দেখতে পাচ্চ না। এখানেই তাঁরা আছেন। তোমার এ অবস্থা দেখে তাঁদের দয়া হয়েছে। এবার তোমার ভাবনা নেই, তোমার স্ত্রীর সঙ্গেও আমরা দেখা করিয়ে দেব।

বৃদ্ধ কিন্তু এসব কথা বিশ্বাস করলে না। সে সন্দিগ্ধ সুরে বল্লে তবে আমার এই রোগটা হোল কেন? এটা সারবার একটা ব্যবস্থা করে দিন দয়া করে। বৌ-এর সঙ্গে দেখা করে কি হবে বাবু? হাসপাতাল। থেকে সে যদি সেরে থাকে, তবে ত ভালই। তার ভাইএর বাড়ী আছে বুঝি? তা থাক, দেখা করে আর কি হবে বাবুমশাই, এ রোগ নিয়ে আর কারু সঙ্গে দেখা করতে চাইনে বাবু।

যতীন ওর কাছে পরলোক ও মৃত্যুর প্রকৃতি বর্ণনা করলে খানিকক্ষণ। করুণাদেবী বল্লেন–ও সব বলো না যতীন ওর কাছে। ওতে কোনো উপকার হবে না। ও কি বুঝবে ওসব কথা? দেখচো না কত নিম্ন। স্তরের আত্মা? বুদ্ধি বলে জিনিস নেই ওর মধ্যে। ওকে বোঝাতে হোলে অন্যপথে যেতে হবে। ওর স্ত্রীকে আনতে হবে খুঁজে পেতে কোনরকমে, তার সঙ্গে দেখা করিয়ে দিতে হবে। কিন্তু ওর তো দেখছি ভালবাসার কোনো বন্ধন নেই স্ত্রীর সঙ্গে। এ অবস্থায় দুজনের যোগ স্থাপন করানোই কঠিন কাজ। এ লোকে যার সঙ্গে যার ভালবাসা বা স্নেহ নেই, তার সঙ্গে তার কোনো যোগই যে সম্ভব নয়।

আরও কয়েকবার যাতায়াত ও অনবরত চেষ্টা করলে ওরা। বৃদ্ধ কিছুই বোঝে না। তাকে তার অবস্থা বোঝানো সাংঘাতিক কঠিন হয়ে দাঁড়ালো। তাকে কিছুতেই বোঝানো যায় না যে সে মরে গিয়েছে। কারো ওপর তার টান নেই–না স্ত্রী, না ছেলেমেয়ে, না অন্য কারো ওপর।

করুণাদেবী বল্লেন–শুধু বুদ্ধিহীন বলে নয়, এমন একটি অদ্ভুতধরনের হৃদয়হীন প্রেমহীন আত্মা আমি খুব কমই দেখেচি। মনে। প্রেম ভালবাসা স্নেহ এসব যদি থাকতো তা হলেও ওর উদ্ধার এত কঠিন হোত না। কি যে করি এখন!

কিন্তু কি অপূর্ব নিঃস্বার্থ দরদ করুণাদেবীর! পতিত হতভাগ্যদের ওপর কি তাঁর মায়ের মত গভীর সহানুভূতি! কত কষ্ট করে তিনি নিম্নস্তরের বহু জায়গা খুঁজে পেতে একদিন এক স্ত্রীলোককে এনে হাজির করলেন ওর সামনে। যতীন আর পুষ্প সব সময়েই ওঁকে সাহায্য করতো, ওঁর সঙ্গে সঙ্গে থাকতো। কারণ অত নিম্নস্তরে দেবী সম্পূর্ণরূপে অদৃশ্য–পুষ্প তাই-যতীনের বিনা সাহায্যে কোন কাজই সেখানে হবার উপায় ছিল না। স্ত্রীলোকটিরও তেমন বুদ্ধিশুদ্ধি নেই, মনে প্রেম ভালবাসাও তথৈবচ। ধূসরমিশ্রিত লাল রঙের দেহধারী আত্মা। তবে সে সক্রিয় ধরনের বা অনিষ্টকারী চরিত্রের মেয়ে নয়– মোটামুটি ভাল-মানুষ এবং ওর স্বামীর মতই প্রেম ভালবাসার ধার ধারে না।

খুব এমন কিছু উঁচুদরের আত্মা না হোলেও বৃদ্ধের অপেক্ষা কিছু উঁচু। কিন্তু হঠাৎ খুন হয়ে মৃত হওয়ার ফলে অনেকদিন পর্যন্ত তার এ লোকে জ্ঞান হয় নি। সম্প্রতি কিছু কিছু বুঝতে আরম্ভ করেচে।

যতীন বৃদ্ধকে বল্লে–চিনতে পারো? এগিয়ে এসে দ্যাখো তো—

বৃদ্ধ চমকে উঠলো, বল্লে–বড় বৌ যে!

ওর স্ত্রী হেসে বল্লে–হ্যাঁ, মুগুরের বাড়ি মাথায় দিয়ে ভেবেছিলি হাত থেকে বুঝি এড়ালি। তা আর হোল কৈ?

বৃদ্ধ অবাক হয়ে বল্লে–বড় বৌ, তুই তাহলে বেঁচে আছিস?

বড় বৌ বল্লে–তুইও যা আমিই তাই। দুজনেই মরে ভূত হয়ে গিয়েছি। আজ এঁরা সব এসেছেন তাই এঁদের দয়ায় উদ্ধার হয়ে গেলি। নে এঁদের গড় কর পায়ে।

–পুলিশের দারোগাবাবুকে?

–যমের অরুচিপুলিশের দারোগা আবার কে এর মধ্যে? মরচেন কেবল পুলিশ পুলিশ করে; অত যদি পুলিশের ভয় তবে রাগের সময় কান্ডজ্ঞান ছিল না কেন রে মুখপোড়া? এঁকে প্রণাম কর, আর দুজন আছেন, তাঁদের দেখবার ভাগ্যি তোর এখনও হয়নি, এই পিটুলি গাছের তলায় মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম কর। চল্ আমার সঙ্গে, তোকে সব বুঝিয়ে দিচ্চি–এখন কিছু বুঝবিনে।

বৃদ্ধ যতীনের পায়ে হাত দিয়া প্রণাম করলে। স্ত্রীর কথায় পিটুলি গাছের তলায় মাথা নীচু করে অদৃশ্য পুষ্পও দেবীর উদ্দেশে প্রণাম করলে। স্ত্রীলোকটিও সকলকে প্রণাম করলে–তারপর বৃদ্ধকে সঙ্গে করে নিয়ে চলে গেল।

ফেরবার পথে করুণাদেবী বল্লেন–যারা কিছুই বোঝে না, তাদের দিয়ে না হয় নিজের উপকার না হয় পরের উপকার। দেখলে তো চোখের সামনে? যারা এই বিরাট বিশ্বরহস্যের কিছুই বোঝে না, তারা নিজেদের মহান্ অদৃষ্টলিপি, আত্মার বিরাট ভবিষ্যৎ কি বুঝিবে? এসব লোকের এখনও কতবার পৃথিবীতে জন্মাতে হবে, তবে এরা উচ্চস্তরের উপযুক্ত হবে। এদের নিয়ে ভাবনায় পড়তে হয় এমন!

যতীন মনে মনে ভাবলে–পতিতের ওপর এমন দয়া না থাকলে সাধে কি আর দেবী হওয়া যায়!

পৃথিবী থেকে ফেরবার পথে এক জায়গায় শূন্যপথে ক্ষুদ্র একটি জগৎ মহাশূন্য-সমুদ্রের মধ্যে নির্জন দ্বীপের মত দেখা যাচ্ছে। তার কিছু ওপর দিয়ে যাবার সময় একটি দৃশ্য দেখে যতীন আর পুষ্প দুজনেই থেমে গেল। এ জগতে এসে পৰ্য্যন্ত ওরা অনেক উন্নত স্তরের জ্যোতির্ময়ী মহিমময়ী রূপসী দেবীদের দেখেছে, যেমন একজন। করুণাদেবী তাদের সঙ্গেই রয়েছেন। কিন্তু এই নির্জন ক্ষুদ্র জগৎটির একস্থানে প্রান্তরের মধ্যে শিলাখন্ডের ওপর যে নারীকে ওরা বসে থাকতে দেখলে, তাঁর শ্রী ও মহিমার কোনো তুলনা দেওয়া চলে না। কি তেজ, কি দীপ্তি, কি প্রজ্বলন্ত রূপ–অথচ মুখে কেমন একটা দুঃখ ও বিষাদের ছায়া–তাতে মুখশ্রী আরও সুন্দর হয়েছে দেখতে। স্বচ্ছ নীল আভা তাঁর সর্বাঙ্গ দিয়ে বার হয়ে শিলাখণ্ডটাকে পৰ্য্যন্ত যেন দামী পান্নায় পরিণত করেছে।

করুণাদেবীও সেদিকে চেয়ে চমকে থেমে গেলেন। বল্লেন–ওঁকে চেন না? বহু সৌভাগ্যে দেখা পেলে। বহু উচ্চস্তরের দেবী, চল, দেখা করিয়ে দিই। তোমাদের সঙ্গে দেখা করিয়ে দিলে উনি বিশেষ খুশি হবেন এই জন্যে যে, উনি প্রেমের দেবী। ওঁর কাজ পৃথিবীতে শুধু চলে না, বহু গ্রহে উপগ্রহে, স্থল ও আত্মিক জগতে, বিশ্বের বহু দূর দূর নক্ষত্রের মধ্যে যেখানেই জীব বাস করে–সেই সব স্থানেই দুটি প্রেমিক আত্মার মিলন সংঘটন করিয়ে বেড়ান। উনি একা নন, ওঁর দলবল খুব বড়। অনেক সঙ্গিনী আছে ওঁর। উনি অসীমশক্তিময়ী দেবী, আলাপ হোলে হঠাৎ কিছু বুঝতে পারবে না। অত বড় প্রাণ, অত উদার প্রেম-ভালবাসা ভরা আত্মা তোমরা কখনো দেখনি। খুব সৌভাগ্য তোমাদের যে চোখে ওঁকে দেখতে পেয়েচ আজ, এর একমাত্র কারণ আজ তোমরা পৃথিবীতে ওই আত্মাটির উদ্ধারের সাহায্য করে, সেই পুণ্যে এই মহাদেবীকে চোখে দেখার সৌভাগ্য লাভ করলে! নইলে সাধ্য কি তোমাদের ওঁকে দেখতে পাও। এসো আমার সঙ্গে, আলাপ করিয়ে দিই।

ওরা এসে সেই দেবীর সামনে প্রণাম করে দাঁড়িয়ে রইল।

–আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেচে–করুণাদেবী বল্লেন–এরা পৃথিবীর লোক, মেয়েটি এ’কে ভালবাসতো বড়। বাল্যপ্রেম। মেয়েটি আগে মারা যায়, তারপর এ লোকে সে বহুদিন প্রতীক্ষায় ছিল। সম্প্রতি মিলন হয়েছে।

প্রণয়দেবী স্নেহপূর্ণ দৃষ্টিতে ওদের দিকে চেয়ে হাসিমুখে বল্লেন– আমি জানি সখী। এর নাম পুষ্প, ওর নাম যতীন। আমি ওদের ওপরে দৃষ্টি রাখিনি ভেবেচ? এই একটি সত্যিকার প্রেমের উদাহরণ। যেখানেই সত্যিকার জিনিস, সেখানেই আমি আছি। চেষ্টা করি তাদের মিলিয়ে দিতে, কিন্তু সব সময় পারিনে। আরও ওপরে রয়েচেন কৰ্ম্মের দেবতারা-লিপিকদের দল। তাঁদের পাঁচ ছাড়ানো কত কঠিন তোমার তো জানতে বাকী নেই! এদের পূর্বজন্মের কৰ্ম্ম ছিল ভাল, তাও, এই ছেলেটির গোলমাল রয়েছে এখনও, পরে দেখতে পাবে। তা এনে ভালই করে। আমার মণ্ডলীতে এরা আসুক, কারণ এরা আমারই দলের উপযুক্ত লোক।

পুষ্প ও যতীন উল্লসিত হয়ে উঠল।

প্রেমের ব্যাপারে কি সাহায্য তাদের দিয়ে হবে তারা জানে না, কিন্তু একথা তাদের প্রাণের কথা যে তারা নিজেদের জীবন ধন্য মনে করবে যদি পৃথিবীর একটি ব্যর্থ প্রণয়ীর জীবনেও তারা সার্থকতার আলো জ্বালাতে পারে। এই তাদের অন্তরের কথা। যারা যে দলের, এতদিন পরে যতীন ও পুষ্প যেন সগোত্র আত্মার আত্মীয়মণ্ডলীকে আবিষ্কার করলে।

যতীন আশ্চর্য হয়ে ভাবছিল, বিশ্বের কি অদ্ভুত কাৰ্য্যপ্রণালী! অদৃশ্য জগতের কি বিরাট সংঘরাজি, কি বিরাট কৰ্ম্মপ্রবাহ। পুষ্প ভাবছিল– কিন্তু করুণাদেবীকে ছেড়ে ওরা কি করে যাবে? তাঁকে যে ওরা বড় ভালবাসে–কিন্তু তাঁর মনে কষ্ট দেওয়া হবে যে!…করুণাদেবী যেন ওর মনের কথা বুঝেই বল্লেন–তোমাদের প্রকৃত স্থান এ মণ্ডলীতে। আমার দেখা সৰ্ব্বদাই পাবে, যখন চাইবে তখনই দেখা দেবো, সেজন্য ভেবো না। তোমরা যাও এঁর সঙ্গে।

প্রণয়দেবী বল্লেন–উনি আর আমি পৃথক নই। উনি যেখানে, সেখানে আমি আছি; আমি যেখানে, সেখানে উনিও থাকেন। প্রেম আর করুণা পরস্পর ফুল আর সূতোর মত একসঙ্গে আছে। সূতোকে ফেলে মালা গাঁথা যায় না, ফুলকে বাদ দিয়ে সুতো নিয়ে মালা হয় না।

–কেন, বিনি সুতোয় মালা হয় না সখী?

–বড় সন্তর্পণে গলায় দিতে হয়। বড় ঠুনকো হয়। বড় অল্পে মরে বাঁচে। করুণা প্রেমকে সাহায্য না করলে প্রেম হয় ঠুনকো। এদিকে প্রেম পেছনে না থাকলে করুণা রক্তাল্পতা রোগে মারা পড়ে। ছলনা কেন করচো সখী, তুমি নাকি এ জান না!

আবার নীল শূন্যপথে, আবার বাধাহীন তড়িৎ-অভিযান। যতীন ও পুষ্প বুড়োশিবতলার ঘাটে পৌঁছে গেল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress