দেনা পাওনা : ০৯
মন্দির-সংক্রান্ত গোলযোগটা যে ওখানেই মিটিয়া শেষ হইয়া গেল না ষোড়শী তাহা ভাল করিয়াই জানিত; কিন্তু বিপত্তি যেদিক দিয়া তাহাকে পুনশ্চ আক্রমণ করিল তাহা সম্পূর্ণ অভাবনীয়। এখানে থাকিলে ফকিরসাহেব মাঝে মাঝে এমন আসিতেন বটে, কিন্তু মাত্র কাল সন্ধ্যাকালে তিনি গিয়াছেন, মাঝে একটা দিন কেবল গিয়াছে, আবার আজই প্রত্যুষে আসিয়া উপস্থিত হইবেন, এইরূপ তাঁহার কোনদিন নিয়ম নয়। ষোড়শী সেইমাত্র স্নান করিয়া আসিয়া নিত্যক্রিয়াগুলি সারিয়া লইতে ঘরে ঢুকিতেছিল, অসময়ে হঠাৎ তাঁহাকে দেখিয়া চিন্তিত হইল। তাড়াতাড়ি প্রণাম করিয়া, একটা আসন পাতিয়া দিয়া উদ্বিগ্ন-স্বরে জিজ্ঞাসা করিল, এত সকালে যে?
তিনি উপবেশন করিয়া একটু হাসির চেষ্টা করিয়া কহিলেন, ফকির মানুষ, সংসারে সুখ-দুঃখের ধার বড় ধারিনে মা, তবুও কাল রাত্রিটায় ভাল করে ঘুমোতে পারিনি, ষোড়শী, দেহধারণের এমনই বিড়ম্বনা। কবে যে এটা মাটির তলায় যাবে!
ষোড়শী শারীরিক পীড়ার কথাই মনে করিয়া কহিল, আপনার কি কোন অসুখ করেচে?
ফকির ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, না আমার শরীর ভালই আছে। কাল বিকেলে এঁরা সকলেই আমার কুটীরে পায়ের ধূলো দিয়েছিলেন, সঙ্গে জামাইবাবু-সাহেবও ছিলেন, এককড়িও ছিল। তাকে চিনি এই যা—নইলে সে অনেক কথাই বললে। তবুও দু-একটা কথা তোমাকে জিজ্ঞাসা না করে থাকতে পারলাম না মা!
ষোড়শী কহিল, বলুন।
ফকির বলিলেন, দেখ মা, আমি মুসলমান, তোমাদের দেব-দেবীর সম্বন্ধে আমার কৌতূহল থাকা উচিতও নয়, নেইও—কিন্তু তোমাকে আমি মা বলে ডাকি; তুমি কি জানিয়েছ স্বহস্তে আর কখনো চণ্ডীর পূজা করতে পারবে না?
ষোড়শী ঘাড় নাড়িয়া জানাইল, এ কথা সত্য।
ফকির বলিলেন, কিন্তু এতকাল ত তোমার সে বাধা ছিল না?
ইহার উত্তরে ষোড়শী যখন মৌন হইয়া রহিল, তখন তিনি কহিলেন, যাঁরা তোমাকে চান না তাঁরা যদি তোমার এই নূতন আচরণটা মন্দ বলেই গ্রহণ করেন, তাতে ত কোন জবাব দেওয়া যায় না ষোড়শী?
ইহারও কোনরূপ সদুত্তর দিবার চেষ্টা না করিয়া ষোড়শী যখন তেমনি নীরব হইয়া রহিল, তখন ফকিরের মুখও অত্যন্ত গম্ভীর হইয়া উঠিল; তিনি নিজেও কিছুক্ষণ নিঃশব্দে থাকিয়া কহিলেন, এর কারণ বলবার হলে তুমি আমাকে নিশ্চয়ই বলতে। এ ছাড়া এককড়ি আরও একটা কথা বললে। সে বললে, জমিদারবাবু ভারী আশা করেছিলেন, তুমি তার সঙ্গে যাবে। এমন কি, আর একটা পালকি আনিয়ে যাই যাই করেও তাঁর শেষ পর্যন্ত ভরসা ছিল হয়ত তুমি ফিরে আসবে।
এবার ষোড়শী কথা কহিল, বলিল, তাঁর আশা-ভরসার জন্যও কি আমাকে দায়ী হতে হবে?
ফকির তৎক্ষণাৎ মাথা নাড়িয়া কহিলেন, নিশ্চয় না, নিশ্চয় না। কিন্তু কথাটা শুনতেও নাকি বিশ্রী, তাই উল্লেখ করলাম। আচ্ছা মা, যে ব্যাপারটায় সকল কুৎসিত কথার সৃষ্টি তার যথার্থ হেতুটা কি তুমি আমাকে বলতে পারো না? ও লোকটাকে যে তুমি কেন এমন করে বাঁচিয়ে দিলে এর কোন মীমাংসাই ত খুঁজে পাইনে ষোড়শী?
ষোড়শীর প্রথমে মনে হইল এ প্রশ্নেরও সে কোন উত্তর দিবে না, কিন্তু বৃদ্ধের উদ্বিগ্ন মুখের স্নেহ-করুণ চোখ-দুটির প্রতি চাহিয়া সে চুপ করিয়া থাকিতে পারিল না, কহিল, ফকিরসাহেব, ওই পীড়িত লোকটিকে জেলে পাঠানোই কি উচিত হতো?
ফকির বিস্মিত হইলেন, মনে মনে বোধ করি বা একটু বিরক্তও হইলেন, বলিলেন, সে বিবেচনার ভার ত তোমার নয় মা, সে রাজার। তাই তাঁর জেলেও হাসপাতাল আছে, পীড়িত অপরাধীরও তিনি চিকিৎসা করান। কিন্তু এই যদি হয়ে থাকে, তুমি অন্যায় করেচ বলতে হবে।
ষোড়শী তাঁহার মুখের প্রতি চাহিয়া রহিল।
ফকির বলিলেন, যা হবার হয়ে গেছে, কিন্তু ভবিষ্যতে এর ত্রুটি শুধরে নিতে হবে।
ষোড়শী তাঁহার মুখের প্রতি চাহিয়া কহিল, তার অর্থ?
ফকির বলিলেন, ওই লোকটার অপরাধ ও অত্যাচারের অন্ত নেই, এ ত তুমি জানো! তার শাস্তি হওয়া উচিত।
এবার ষোড়শী বহুক্ষণ পর্যন্ত নিস্তব্ধ হইয়া রহিল, তারপরে মাথা নাড়িয়া আস্তে আস্তে বলিল, আমি সমস্ত জানি। তাঁকে শাস্তি দেওয়াই হয়ত আপনাদের উচিত, কিন্তু আমার কথা কাউকে বলবার নয়—তাঁর বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে আমি কোনদিন পারব না।
ফকির কহিলেন, ব্যাপার কি ষোড়শী?
ষোড়শী অধোমুখে স্তব্ধ হইয়া রহিল, এবং বহুক্ষণ পর্যন্ত কাহারও মুখ দিয়া কোন বাক্যই বাহির হইল না। দাসী সংসারের কাজ করিতে আসিতেছিল, দ্বারের কাছে তাহাকে দেখিতে পাইয়া ফকির আপনাকে সংবরণ করিয়া লইয়া মৃদুকণ্ঠে কহিলেন, এখন তা হলে আমি চললাম।
ষোড়শী কেবল হেঁট হইয়া তাঁহাকে নমস্কার করিল; তিনি ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেলেন।
তাঁহার প্রশান্ত মুখের গম্ভীর বিষণ্ণতাই শুধু যে কেবল ষোড়শীর সমস্ত দিন সকল কাজকর্মের মধ্যেই যখন-তখন মনে হইতে লাগিল তাই নয়, যে অনুচ্চারিত বাক্য তিনি সহসা দমন করিয়া লইয়া নীরবে নিষ্ক্রান্ত হইয়া গেলেন, তাহাও নানা আকারে নানা ছন্দে তাহার কানে বাজিতে লাগিল। সে যেন স্পষ্ট দেখিতে লাগিল এই সাধু ব্যক্তি যে শ্রদ্ধা, যে স্নেহ এতদিন তাহার প্রতি ন্যস্ত রাখিয়াছিলেন ঠিক কিছু না জানিয়াও আজ যেন তাহাকে খর্ব করিয়া লইয়া গেলেন। এই ক্ষতি যে কত বড়, তাহার পরিমাণ সে নিজে ছাড়া আর কেহই অধিক জানিত না।
কিন্তু তথাপি ইহাকে ফিরিয়া পাইবারও কোন পন্থা তাহার চোখে পড়িল না। তাহার বাল্য ইতিহাস কাহারও কাছে ব্যক্ত করা চলে না, এমন কি এই ফকিরের কাছেও না। কারণ ইহাতে যে-সকল পুরাতন কাহিনী উঠিয়া পড়িবে তাহা মেয়ের পক্ষে যতবড় লজ্জার কথাই হোক, তাহার যে মা আজ পরলোকে তাঁহাকেই সমস্ত পৃথিবীর সম্মুখে একেবারে পথের ধূলায় টানিয়া আনা হইবে। এবং এইখানেই ইহার শেষ নয়। স্বামিস্পর্শ ভৈরবীর একান্ত নিষিদ্ধ। কত যুগ হইতে এই নিষ্ঠুর অনুশাসন ইহাদিগকে অঙ্গীকার করিয়া আসিতে হইয়াছে। সুতরাং ভাল-মন্দ যাই হোক, জীবনানন্দের শয্যাপ্রান্তে বসিয়া একটা রাত্রির জন্যও তাহাকে যে-হাত দিয়া তাঁহার সেবা করিতে হইয়াছে, সেই হাত দিয়া আর যে দেবীর সেবা করা চলিবে না তাহা নিশ্চিত, অথচ এইখানেই এই দেবীর প্রাঙ্গণতলেই তারাদাস যখন তাহাকে অজ্ঞাতকুলশীল একজনের হস্তে সমর্পণ করিয়াছিল তখন সে কোন আপত্তিই করে নাই; এবং সমস্ত জানিয়াও যে সে নিঃসঙ্কোচে এতকাল ভৈরবীর কার্য করিয়া আসিয়াছে, ইহার জবাবদিহি আজ যদি সমস্ত ক্রুদ্ধ হিন্দুসমাজের কাছে করিতে হয়, ত সে যে কি হইবে সে তাহার চিন্তাতীত। আবার এ-সকল ত গেল কেবল একটা দিকের কথা, কিন্তু যে দিকটা একেবারেই তাহার আয়ত্তাতীত, তথায় কি যে হইবে সে তাহার কি জানে? যে জীবানন্দ একদিন তাহাদের বিবাহটাকে কেবল পরিহাস করিয়া গিয়াছিল, সে যদি আজ সমস্ত ইতিহাসটাকে নিছক গল্প বলিয়া হাসিয়া উড়াইয়া দেয়, ত তাহাকে সত্য বলিয়া সপ্রমাণ করিতে সে নিজে ছাড়া আর দ্বিতীয় ব্যক্তি জীবিত নাই।
গৃহস্থালী-সম্বন্ধে রানীর মায়ের দুই-একটা কথার উত্তরে ষোড়শী কি যে জবাব দিল তাহার ঠিকানা নাই। মন্দিরের পুরোহিত কি একটা বিশেষ আদেশ গ্রহণ করিতে আসিয়া অন্যমনস্ক ভৈরবীর কাছে কি যে হুকুম পাইল তাহা ভাল বুঝিতেই পারিল না। নিত্যনিয়মিত পূজা-আহ্নিকে বসিয়া আজ ষোড়শী কোনমতেই মনস্থির করিতে পারিল না, অথচ যে জন্য তাহার সমস্ত চিত্ত উদ্ভ্রান্ত এবং চঞ্চল হইয়া রহিল, তাহার যথার্থ রূপটাও তাহাকে ধরা দিল না—কেবলমাত্র কতকগুলা অস্ফুট অনুচ্চারিত বাক্যই সমস্ত সকালটা একটা অর্থহীন প্রলাপে তাহাকে আচ্ছন্ন করিয়া রাখিল। রান্নার উদ্যোগ-আয়োজন পড়িয়া রহিল, সে রান্নাঘরে প্রবেশ করিল না – এ-সকল তাহার ভালই লাগিল না। এমনি করিয়া সমস্ত দিনটা যখন কোথা দিয়া কিভাবে কাটিয়া গেল, একপ্রকার ঘোলাটে মেঘলায় শীতের দিনের অপরাহ্ণ যখন অসময়েই গাঢ়তর হইয়া আসিতে লাগিল, তখন সে একাকী ঘরের মধ্যে আর থাকিতে না পারিয়া হঠাৎ বাহির হইয়া আসিল, এবং ফকিরসাহেবকে স্মরণ করিয়া বারুইয়ের প্রপারে তাঁহারই আশ্রমের উদ্দেশে যাত্রা করিল। এমন অনেকদিন হইয়াছে সে একটুখানি ঘুরিয়া তাহার অনুগত বিপিন কিংবা দিগম্বরকে তাহাদের বাটীর সম্মুখ হইতে ডাক দিয়া সঙ্গে লইয়া গিয়াছে; কিন্তু আজ পাড়ার পথ দিয়া তাহাদিগকে ডাকিতে যাইতে তাহার সাহসও হইল না, প্রবৃত্তিও হইল না—একাকীই মাঠের পথ ধরিয়া নদীর অভিমুখে দ্রুতপদে অগ্রসর হইয়া গেল। তাহার মনেও পড়িল না যে, ঘরগুলা খোলাই পড়িয়া রহিল।
এই পথটা বেশী নহে, বোধ করি অর্ধ ক্রোশের মধ্যেই, এবং নদীতেও এমন জল এসময়ে ছিল না যাহা স্বচ্ছন্দে হাঁটিয়া পার হওয়া না যায়, সুতরাং অভ্যাসবশত: এদিকে চিন্তিত হইবার কিছুই ছিল না। কেবল ফিরিয়া আসার কথাটাই একবার মনে হইল, অথচ ভিতরে ভিতরে বোধ হয় তাহার ভরসা ছিল যদি সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া অন্ধকার হইয়াই আসে ত ফকিরসাহেব কিছুতেই তাহাকে নিঃসঙ্গ ছাড়িয়া দিবেন না, কিছু একটা উপায় করিবেনই। মনের এই অবস্থাই তাহাকে জনহীন পথ ও ততোধিক নির্জন বালুময় নদীর উপকূলে আসন্ন সন্ধ্যা জানিয়াও দ্বিধামাত্র করিতে দিল না, বারুইয়ের প্রপারে সোজা সেই বিপুল বটবৃক্ষতলে সাধুর আশ্রমে আনিয়া উপনীত করিল এবং প্রথমেই যাঁহার সহিত সাক্ষাৎ হইয়া একেবারে হতবুদ্ধি হইয়া গেল, তিনি ফকিরসাহেব নহেন, রায়মহাশয়ের জামাতা ব্যারিস্টার-সাহেব। আজ তাঁহার পরিধানে কোট-প্যান্টের পরিবর্তে সাধারণ ভদ্রবাঙালীর ধুতি-চাদর প্রভৃতি ছিল। তিনিও ঠিক ইহার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না; কি করিবেন সহসা ভাবিয়া না পাইয়া বোধ হয় কেবলমাত্র অভ্যাসবশতই উঠিয়া দাঁড়াইয়া কোনমতে একটা নমস্কার করিলেন।
ভৈরবী চারিদিকে একবার চাহিয়া লইয়া মৃদুকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, ইনি কোথায়?
বসুসাহেব কহিলেন, আমারও জিজ্ঞাস্য তাই। হয়ত কাছাকাছি কোথাও গেছেন মনে করে আমিও প্রায় ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করে আছি।
ভৈরবী মাথা নাড়িয়া আস্তে আস্তে বলিল, তিনি সন্ধ্যার সময় কোথাও থাকেন না, বোধ হয় এখুনি এসে পড়বেন।
বসুসাহেব কহিলেন, এখানে থাকলে তাই তাঁর নিয়ম বটে, আমিও শুনে এসেচি। কিন্তু সন্ধ্যা ত হলো। আকাশের গতিকও তেমন ভাল নয়, বলিয়া তিনি সম্মুখে মাঠের প্রান্তে দৃষ্টিপাত করিলেন। ষোড়শীও তাঁহার দৃষ্টি অনুসরণ করিয়া সেইদিকে চাহিয়া নীরব হইল।
পশ্চিম দিগন্তে তখন কালো কালো খণ্ড মেঘ ধীরে ধীরে জমা হইয়া উঠিতেছিল। এই নিস্তব্ধ জনহীন প্রান্তরে ছায়াচ্ছন্ন বৃক্ষতলের ঘনায়মান অন্ধকারে দাঁড়াইয়া উভয়ের কেহই কিছুক্ষণের জন্য কথা খুঁজিয়া পাইলেন না, অথচ এই বিসদৃশ অবস্থায় দুজনেই কেমন যেন সঙ্কুচিত হইয়া উঠিলেন। এবং বোধ হয় এই মৌনতার সঙ্কট হইতে অব্যাহতি লাভের জন্যই যেন বসুসাহেব হঠাৎ বলিয়া উঠিলেন, কাল আমি চলে যাচ্চি, শীঘ্র আর আসা হবে কিনা জানিনে, কিন্তু ফকিরের সঙ্গে আর একবার দেখা না করে চলে যেতে হৈম আমাকে কিছুতেই দিলে না, তাই—কিন্তু তিনি ত কোথাও চলে যাননি? এই বলিয়া তিনি দু-এক পদ অগ্রসর হইয়া গেলেন, এবং অনতিদূরবর্তী কুটীরের সম্মুখে আসিয়া গলা বাড়াইয়া ক্ষণকাল ঘরের মধ্যে নিরীক্ষণ করিয়া কহিলেন, ভাল দেখা যায় না, কিন্তু কোথাও কিছু আছে বলেও মনে হয় না।
মুসলমান ফকিরেরা ধুনি জ্বালে কিনা জানিনে, কিন্তু এই রকম কি একটা জল দিয়ে কে যেন নিবিয়ে দিয়ে গেছে বলে মনে হচ্চে। আপনি দেখুন দেখি, আমি আর ভিতরে যাবো না। তা হলে নিরর্থক অপেক্ষা করে কোন লাভ নেই। বলিয়া তিনি ষোড়শীর প্রতি চাহিয়া ফিরিয়া আসিলেন।
কথাটা শুনিয়াই ষোড়শীর বুকের মধ্যে ধড়াস্ করিয়া উঠিল, এবং তাঁহার থাকা-না-থাকার পরীক্ষা না করিয়াই তাহার নিশ্চয় মনে হইল সংসারে তাহার একমাত্র শুভাকাঙ্ক্ষী আজ নিঃশব্দে চলিয়া গেছেন, এবং এই নীরব প্রস্থানের হেতু জগতে সে ছাড়া আর কেহ জানে না। ষোড়শী যন্ত্রচালিতের ন্যায় সন্ন্যাসীর কুটীরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া মাঝখানে স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। কোথাও যে কিছু নাই, এই ছোট ঘরখানি আজ যে একেবারে একান্ত শূন্য, সে তাহার প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই চোখে পড়িয়াছিল, কিন্তু তবুও সে তৎক্ষণাৎ বাহির হইয়া আসিতে পারিল না। তাহার বুকের মধ্যে কেবল এই কথাটাই অঙ্গারের ন্যায় জ্বলিতে লাগিল, তিনি যথার্থ-ই দোষীজ্ঞানে তাহাকে ত্যাগ করিয়া গেছেন, এবং তাহার আভাসমাত্র দিবারও প্রয়োজন বোধ করেন নাই। সেইখানে পাষাণ-মূর্তির ন্যায় নিশ্চল দাঁড়াইয়া তাহার অনেক কথাই মনে হইতে লাগিল। ফকির যে তাহাকে কত ভালবাসিতেন, তাহা তাহার চেয়ে বেশী আর কে জানে? তথাপি না জানিয়া যে তিনি অপরাধীর পক্ষ লইয়া বিবাদ করিয়াছেন, এই লজ্জা ও গ্লানি সেই সত্যাশ্রয়ী সন্ন্যাসীকে এমন করিয়া আজ স্থানত্যাগ করিতে বাধ্য করিয়াছে, ইহা সে নিঃসংশয়ে অনুভব করিল, এবং যে বেদনা লইয়া তিনি নীরবে বিদায় লইয়াছেন, ইহার গুরুত্ব উপলব্ধি করিতেও তাহার বিলম্ব হইল না। অথচ একথা জানাইবার অবকাশ যে তাহার কবে মিলিবে, কিংবা কোনদিন মিলিবে কি না, তাহাও ভবিষ্যতের গর্ভে আজ সম্পূর্ণ লুক্কায়িত। এমনি একইভাবে তাহার অনেকক্ষণ কাটিল, এবং বোধ হয় আরও কিছুক্ষণ কাটিত, সহসা মুক্তদ্বার দিয়া ঘরের মধ্যে একটা দমকা বাতাস অনুভব করিয়া তাহার চৈতন্য হইল, বাহিরে আর একজন হয়ত এখনও তাহার অপেক্ষা করিয়া আছেন।কিন্তু ইতিমধ্যে যে আকাশ এমন মেঘাচ্ছন্ন, অন্ধকার এত প্রগাঢ় হইয়া উঠিতে পারে এবং বাতাস প্রবল হইয়া ঝড় ও জলের সম্ভাবনা আসন্ন হইয়া উঠিতে পারে, ইহা তাহার মনেও আসে নাই। বাহিরে আসিয়া দেখিল অনতিদূরে একটা শুষ্ক বৃক্ষকান্ডের উপর বসুসাহেব বসিয়া আছেন, তাঁহার শুভ্র পরিচ্ছদ ভিন্ন আর কিছুই প্রায় দেখা যায় না। তাঁহাকে এইভাবে বাস্তবিক অপেক্ষা করিতে দেখিয়া ষোড়শী মনে মনে অতিশয় সঙ্কোচ বোধ করিল।
সাহেব উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিলেন, কৈ, ফকির ত এখনো এলেন না, আসবেন বলে কি আপনার আশা হয়?
ষোড়শী অতি মৃদুস্বরে উত্তর দিল, কি জানি, বোধ হয় না-ও আসতে পারেন।
বসু কহিলেন, ফকিরসাহেবের জিনিসপত্র কি ছিল আমি জানিনে, কিন্তু তাঁর ঘরটি ত একেবারে খালি – এমন হঠাৎ চলে যাওয়া কি আপনার সম্ভব মনে হয়?
ষোড়শী তেমনি আস্তে আস্তে বলিল, একেবারে অসম্ভবও নয়। এমনি সহসা তিনি মাঝে মাঝে কোথায় চলে যান।
আবার কতদিনে ফিরে আসেন?
কিছু ঠিক নেই। এবার ত প্রায় বছর-তিনেক পরে ফিরে এসেছিলেন।
বসু কহিলেন, তা হলে চলুন আমরা বাড়ি ফিরে যাই।
চলুন, বলিয়া ষোড়শী অগ্রসর হইতেই বসু কহিলেন, কিন্তু যাবার সুযোগ ত দেখচি ষোল আনাই হয়েচে। একে ত বালির ওপর পথের চিহ্নমাত্র নেই, তাতে অন্ধকার এমনি যে নিজের হাত-পা পর্যন্ত দেখা যায় না।
ষোড়শী নীরবে ধীরে ধীরে চলিতে শুরু করিয়াছিল, কিছুই বলিল না।
বসু কহিলেন, হাওয়ার শব্দে বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু বৃষ্টি পড়চে। গাছতলা পার হলেই ভিজতে হবে। এ কথাতেও ষোড়শী যখন কথা কহিল না, তখন বসু কহিলেন, দেখুন, পথঘাট আমি কিছুই চিনিনে, তা ছাড়া শুনেচি এ অঞ্চলে সাপখোপের ভয়টাও খুব বেশী। এই ভয়ানক অন্ধকারে কি—
ষোড়শী থামিল না, চলিতে চলিতেই কহিল, পথ আমি চিনি। আপনি আমার ঠিক পিছনে পিছনে আসুন।
বসুসাহেব হাসিলেন, কহিলেন, অর্থাৎ সর্পাঘাতের দুর্ঘটনা ঘটে ত আপনার উপর দিয়েই যাক। তা বটে! আপনি সন্ন্যাসিনী, এ প্রস্তাব আপনি করতেও পারেন, কিন্তু আমার মুশকিল এই যে, আমিও পুরুষমানুষ। অবশ্য এ কথা আপনি কাউকে বলবেন না জানি, এমন কি হৈমকেও না, কিন্তু তবুও ওটা ঠিক পেরে উঠব না।
এবার ষোড়শী থমকিয়া দাঁড়াইল। অন্ধকারে দেখা গেল না বটে, কিন্তু সাহেবের কথা শুনিয়া তাহারও মুখে হাসি ফুটিল। মুহূর্তকাল মৌন থাকিয়া কহিল, আপনি তা হলে কি-রকম করতে বলেন?
সাহেব কহিলেন, বলা শক্ত। কিন্তু পরামর্শ স্থির হবার পূর্বেই ভিজে উঠতে হবে। বটপত্রে আর বৃষ্টি মানচে না।
কথাটা সত্য। কারণ উপরের জলধারা ফোঁটায় ফোঁটায় নীচে নামিতে শুরু করিয়াছিল। ষোড়শী কহিল, আপনি বরঞ্চ ওই ঘরটার মধ্যে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন, আমি হৈমকে খবর দিয়ে আলো এবং লোক পাঠানোর ব্যবস্থা করে দিই গে। আমার অভ্যাস আছে, এ জলে বিশেষ ক্ষতি হবে না।
সাহেব কহিলেন, অত্যন্ত মনোরম প্রস্তাব। কারণ, বাঙালী সাহেব হয়ে উঠলে যা হন সে আপনি বেশ জানেন দেখচি। কিন্তু আমার সম্বন্ধে আজও একটুখানি ত্রুটি রয়ে গেছে, হৈম মাঝে থাকায় আমার ভেতরের সঙ্গে বাইরের এখনও সম্পূর্ণ একাকার হয়ে উঠতে পায়নি। এ প্রস্তাবও অচল, সুতরাং চলাই স্থির। চলুন।
বৃক্ষতল ছাড়িয়া বাহিরে আসিয়া দু’জনেই বুঝিলেন, অগ্রসর হওয়া প্রায় অসম্ভব, কারণ, বায়ুবেগে বৃষ্টিধারাই যে কেবল গায়ে সূচের মত বিঁধিতেছে তাই নয়, ইতিপূর্বে যে শুষ্ক বালুকারাশি আকাশ ব্যাপ্ত করিয়া শূন্যে উড়িয়াছে জলধারায় ধুইয়া মাটিতে না পড়া পর্যন্ত চোখ চাহিয়া পথ চলা দুঃসাধ্য।
নিঃশব্দে চলিতে চলিতে ষোড়শী হঠাৎ পিছনে শব্দ শুনিয়া থমকিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, আপনার লাগল নাকি?
বসুসাহেব কোনমতে সামলাইয়া লইয়া সোজা হইয়া কহিলেন, হাঁ, কিন্তু প্রত্যাশার অতিরিক্ত কিছু নয়। চশমাসুদ্ধ চোখ আমার চারটে বটে, কিন্তু দৃষ্টিশক্তিটা চার ভাগের এক ভাগ থাকলেও বাঁচতাম। চলুন।
ষোড়শী চলিল না, একমুহূর্ত চুপ করিয়া থাকিয়া ধীরে ধীরে জিজ্ঞাসা করিল, আপনি কি সত্যিই ভাল দেখতে পাচ্চেন না?
বসু কহিলেন, সত্যি। তারপরে ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন, বিস্তর ইংরাজী বই মুখস্ত করে সাহেব হতে হয়েচে—তার দক্ষিণাটাও তারা বেশ বড় করেই নিয়েচে। কিন্তু তাই বলে আর দাঁড়িয়ে ভেজাবেন না—এগোন, দু’চক্ষু বুজে চললে যতটা দেখতে পাওয়া যায়, আমি ততটা দেখতে পাবই, এ আমি আপনাকে নিশ্চয় ভরসা দিচ্চি।
ষোড়শীর কণ্ঠস্বর করুণায় কোমল হইয়া উঠিল, কহিল, তা হলে নদীটা পার হতে আপনার ত ভারী কষ্ট হবে!
বসু বলিলেন, তা ঠিক জানিনে। তবে নদী পার হবার পূর্বেও বিশেষ আরাম পাচ্চিনে। কিন্তু তাই বলে এই মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকলেও সমস্যার মীমাংসা হবে না।
ষোড়শী এক পা অগ্রসর হইয়া আসিয়া কহিল, আপনি আমার হাত ধরে আস্তে আস্তে আসুন, এই বলিয়া সে তাহার হাতখানি বাড়াইয়া দিল।
এই অপরিচিতা নারীর আচরণ ও সাহস দেখিয়া বাক্পটু ব্যারিস্টার ক্ষণকালের জন্য বিস্ময়ে নির্বাক্ হইয়া গেলেন। কিন্তু সে ওই ক্ষণকালমাত্রই। তারপরে সেই প্রসারিত হাতখানি নিঃশব্দ ব্যগ্রতায় আশ্রয় করিয়া আস্তে আস্তে কহিলেন, চলুন। এইবার আমি সত্যি সত্যিই দু’চক্ষু বুজে চলতে পারব।
ষোড়শী ইহার কোন উত্তর দিল না। উভয়ে ধীরে ধীরে কিছুদূর অগ্রসর হইলে বসুসাহেব অকস্মাৎ বলিয়া উঠিলেন, আপনার প্রতি আমি সেদিন ভদ্র ব্যবহার করিনি। তার জন্যে ক্ষমা চাইচি, আপনি আমাকে মাপ করবেন।
ষোড়শী এ কথার উত্তরেও কিছুই বলিল না, তেমনি নিঃশব্দে ধীরে ধীরে চলিতে লাগিল।
বসু কহিলেন, আপনি হৈমর ছেলেবেলার বন্ধু। আমার সেদিনের আচরণ যাই হোক, আমাকেও ঠিক শত্রু বলেই মনে রাখবেন না। বলিয়া তাহার হাতের উপর একটুখানি চাপ দিলেন।
ষোড়শী একেবারেই নির্বাক। বসুসাহেব নিজেও কিছুক্ষণ নীরবে থাকিয়া পুনশ্চ কহিলেন, এঁরা যে আপনাকে সহজে ছাড়বেন তা মনে হয় না। খুব সম্ভব মামলা-মকদ্দমাও হবে। ফকিরসাহেব হয়ত সত্যিই চলে গেছেন, আমিও বোধ হয় থাকব না—
ষোড়শী কিছুই বলিল না। তিনি নিজেও একটু মৌন থাকিয়া পুনশ্চ কহিলেন, আপনি নিজে আর দেবীর পূজো করবেন না বলেচেন, এ কি রাগ করে?
ষোড়শী এবার জবাব দিল, কহিল, না।
তা হলে এর কি সত্যিই কোন কারণ আছে?
ষোড়শী এ প্রশ্নের উত্তর দিল না, কিন্তু কথা কহিল, বলিল, আমরা এবার নদীতে এসেচি, আপনাকে একটু সাবধানে নামতে হবে।
ইহার পরে অনেকক্ষণ পর্যন্ত কোন কথাই হইল না। ষোড়শী সযত্নে সাবধানে তাঁহাকে জল পার করিয়া লইয়া গেল। আসিবার সময় সাহেব জুতা খুলিয়া আসিয়াছেন, কিন্তু এই দুর্ভেদ্য অন্ধকারে আর সাহস করিলেন না, যেমন ছিলেন তেমনই গিয়া পরপারে উঠিলেন। একটি তৃপ্তির দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, একটা মস্ত ফাঁড়া কেটে গেল, বাঁচলাম।
এই মস্ত ফাঁড়া কাটাইয়া দিয়া সাহেব অপেক্ষাকৃত নিশ্চিন্ত হইয়া কহিলেন, পূজারী একজন আছেন বটে, কিন্তু পূজাটা আপনারও একটা কাজের মধ্যেই। অথচ সে প্রশ্নটা আপনি চাপা দিলেন। এদিকে যে ভীষণ দুর্দান্ত শয়তান জমিদারটাকে বাঁচানো আপনার কর্তব্যের অঙ্গ ছিল না, তাঁকে যে উপায়ে বাঁচালেন তা কেবল আশ্চর্য নয়, অদ্ভুত। এই দুটো ব্যাপারই এমন দুর্বোধ্য যে, গ্রামের লোক বুঝলে না বলে অভিমান করা চলে না।
ষোড়শী তেমনি মৃদুস্বরেই এ অনুযোগের জবাব দিয়া কহিল, অভিমান আমি করিনি।
বসু বলিলেন, করেন নি! সেও অদ্ভুত। আপনার বাবার আচরণ আবার আরও অদ্ভুত। হৈম বলে—কিন্তু হৈমর কথা এখন থাক। কিন্তু আমি বলি, এদের সমস্ত অপরাধটা কেন বুঝিয়েই বলুন না? তাতে কতটা কাজ হবে আমি জানিনে, কিন্তু সে যাই হোক, নারীর সুনামটা ত অবহেলার বস্তু নয়! বলিয়া তিনি কিছুক্ষণ উত্তরের প্রতীক্ষা করিয়া রহিলেন; কিন্তু ষোড়শী কোন প্রত্যুত্তরই যখন দিল না, তখন একটা নিঃশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন, বুঝা গেল এই সুনাম-দুর্নাম সম্বন্ধে সাধারণ রমণীর মত আপনার বিশেষ কোন মাথাব্যথা নেই। আর সাধারণও ত আপনি নন। তা ছাড়া চুপ করে থাকার এই এও অদ্ভুত! বাস্তবিক, আপনার সকলই অদ্ভুত। বলিয়া নিজে একটুখানি চুপবজিদ— করিয়া কহিলেন, সেদিন একটিবার মাত্র আপনাকে দেখেচি, আর আজ হাত ধরে এগিয়ে চলেচি। যাকে আশ্রয় করেচি, তিনিও আমার কাছে যেমন অন্ধকার, যার মধ্যে দিয়ে চলেচি সেও তেমনি অন্ধকার। তবুও নির্ভয়ে নিঃসঙ্কোচে যাত্রা করার কোন বাধা হয়নি। আপনাকে ভক্তি না করে থাকবার জো নেই। এই বলিয়া আবার কিছুক্ষণ কোন একটা কথার প্রত্যাশায় থাকিয়া হঠাৎ বলিয়া উঠিলেন, আচ্ছা, আপনি ত সন্ন্যাসিনী। শ্বশুরমশাই আমার যাই কেন করুন না, বিষয়-সম্পত্তি নিয়ে এই-সব মামলা-মকদ্দমা করায় আপনার গরজ কি?
ষোড়শী এতক্ষণে কথা কহিল, বলিল, কোন গরজ নেই।
তা হলে?
ষোড়শী কহিল, আপনি কোন আশঙ্কা করবেন না; নিরুপায় দুর্বল নারীর ভাগ্যে চিরদিন যা হয়ে আসচে, এ ক্ষেত্রেও তার কোন ব্যতিক্রম হবে না।
কথার খোঁচাটা বসুসাহেবের বিঁধিল কিন্তু তিনি প্রতিবাদও করিলেন না, প্রতিঘাতও করিলেন না। তারপর উভয়েই নিঃশব্দে চলিতে লাগিলেন। ঝড় এবং জল কোনটাই থামে নাই বটে, কিন্তু গ্রামের মধ্যে ঢুকিয়া তাহার প্রকোপ মন্দীভূত হইল, এবং পথে বাঁকটা ঘুরিতেই অদূরে সনাতন মাইতির কুটীরের আলোক দু’জনেরই চোখে পড়িল। আরও কিছুদূর অগ্রসর হইয়া ষোড়শী থমকিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, তেমন অন্ধকার আর নেই, আপনি এই পথ ধরে সোজা গেলেই রায়মশায়ের দোরগোড়ায় গিয়ে পৌঁছুবেন।
আর আপনি?
আমার পথ এই বাঁ দিকের বাগানের ভেতর দিয়ে।
বসু হাত ছাড়িলেন না, কহিলেন, পরের মুখে শুনেচি আপনি অতিশয় শিক্ষিতা, আমি নিজে কতটুকু জেনেচি সে উল্লেখ নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু এর বেশী জানবার অবকাশ আর যদি কখনো ভাগ্যে নাও ঘটে, আজকের এই অভিযানের স্মৃতিটা আমার চিরদিন বড় শ্রদ্ধার সঙ্গেই মনে থাকবে।
ষোড়শী মৃদু হাসিয়া কহিল, কিন্তু, কেবলমাত্র এইটুকুই যদি কেউ বাইরে থেকে দেখে থাকে, তার সঙ্গে আপনার মতের মিল হবে না।
সাহেব মনে মনে চমকিয়া গেলেন। তারপরে সেই ধরা-হাতটির উপর আর একটুখানি চাপ দিয়া ছাড়িয়া দিয়া ধীরে ধীরে কহিলেন, না, বানিয়ে বলা গল্পের মত শোনাবে। তাই একে ঘুলিয়ে নোংরা করে না তুলে বরঞ্চ চুপ করে থাকাই ভাল। এই না?
ষোড়শী ইহার জবাব না দিয়া কহিল, আমার জন্যে অপেক্ষা করে অনেক ভিজেছেন, অনেক দুঃখ পেয়েচেন—আর না। আমিও চললুম।
হৈমকে কি কিছু বলে পাঠাবেন না??বসু কহিলেন, এই কথাটাই হয়ত আমাকে অনেকদিন ধরে ভাবতে হবে। কাল আমরা যাচ্চি—
ষোড়শী একমুহূর্ত কি ভাবিয়া কহিল, না। কেবল তার ছেলেকে আশীর্বাদ করচি, যদি ইচ্ছে হয় এইটুকু জানাবেন। বলিয়াই সে আর কোন প্রশ্নোত্তরের অপেক্ষা না করিয়া অন্ধকার বনপথ ধরিয়া নিমেষে অদৃশ্য হইয়া গেল।
সাহেব সেইখানে বিমূঢ়ের মত কিছুক্ষণ স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন। একটা নমস্কার পর্যন্ত করা হইল যে ফকিরের জন্য এই, তাঁহার উদ্দেশে একটা নমস্কার পর্যন্তও জানানো হইলতনা— না। তাহার পরে নির্দিষ্ট পথ ধরিয়া ধীরে ধীরে অগ্রসর হইলেন।