দুলতে-দুলতে যাওয়া
বাড়িটা খুঁজে বের করতে বেশ সন্ধে হয়ে গেল। অনেকদিন পরে কলকাতায় আসা–রাস্তাগুলো কেমন গুলিয়ে যায়। তা ছাড়া বিজনবাবুর বাড়িতে আমি কোনওদিন আসিনি–আসার কোনও কথাও নয়। বছর তিনেক আগে একবার নৈনিতালে বেড়াতে গিয়েছিলাম। হোটেলের ডাবল সিটের শরিক হয়েছিলেন বিজনবাবু। আমি থাকি চণ্ডীগড়ে, কলকাতার লোক পেয়ে বেশ জমে। গিয়েছিলাম। দেখা গেল আমাদের বয়স এক, দুজনেরই একটিমাত্র সন্তান। তা নৈনিতাল থেকে উনি আগেই চলে এসেছিলেন। আর আমারই মতো অন্যমনস্ক লোক বোধ হয়, চলে যাওয়ার পর ওঁর একটা নতুন দামি প্যান্ট খাটের তলায় আবিষ্কার করেছিলাম। তারপর চিঠিপত্রে যোগাযোগ হয়েছিল। চণ্ডীগড় থেকে প্যান্টটা পার্সেল করে পাঠাতে চেয়েছিলাম আমি, উনি ঠাট্টা করে লিখেছিলেন পরের ছুটিতে সিমলা যাওয়ার পথে নিয়ে যাবেন, সুটকেসের বোঝা কমবে। ওঁর আর যাওয়া হয়নি, আমারও খেয়াল ছিল না। এবার অফিসের কাজে কলকাতায় আসার সময় ওটা সঙ্গে করে এনেছি, বিজনবাবুকে লিখেছিলাম, অন্যলোকের প্যান্ট বাড়িতে রাখা বিশ্রী ব্যাপার।
ছোট গলির মধ্যে বাড়ি। পাড়াটা বেশ নিরিবিলি। দরজা খোলা, সামনে দুটি লোক গম্ভী মুখে দাঁড়িয়ে। আমি বিজনবাবু বলতেই ওরা ভেতরের দিকে ইঙ্গিত করল। হয়তো অন্য ভাড়াটে হবে–আমি দেখলাম একটা সিঁড়ি উপরে উঠে গেছে। দোতলায় উঠতেই কান্নার শব্দ পেলাম। স্ত্রী-কণ্ঠের ইনিয়েবিনিয়ে কান্না। খুব অস্বস্তি হল। একটি কিশোরকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে। দেখে বললাম, বিজনবাবু– সে আমাকে পাশের ঘরের দিকে আঙুল তুলে দেখাল। দরজার কাছে দাঁড়াতেই আমি চমকে উঠলাম। ঘরের মেঝেতে বিজনবাবু শুয়ে আছেন। নতুন ধুতি পাঞ্জাবি পরানো হয়ে গেছে। কপালে চন্দনের টিপ। একজন, আমার স্ত্রী-র বয়সি মহিলা বিজনবাবুর বুকে মাথা রেখে কাঁদছেন, ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে পাথর হয়ে বসে একটি বছর দশেকের মেয়ে। ঘরের চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম কয়েকটি শোকগ্রস্ত মুখ ছড়ানো, আমার দিকে ওঁরা তাকালেন। আমি বিজনবাবুর প্যান্ট প্যাকেটে নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলাম।
বিজনবাবুর মুখচোখ অবিকল সেইরকম যেমন নৈনিতালে দেখেছিলাম। শেষ চিঠিতেও অসুখের উল্লেখ নেই। একজন আমার কাছে উঠে আসতেই জিজ্ঞাসা করলাম, কখন?
খুব বিষণ্ণ গলায় তিনি বললেন, দুপুরে। খেয়েদেয়ে উঠে বুকে ব্যথা হল–ডাক্তার ডাকার সময় পাওয়া যায়নি।
মনে পড়ল নৈনিতালে বিজনবাবু বলতেন, দূর মশাই, আমার তো ছুটোছুটি একদম ভালো লাগে না–শুয়ে থাকার মতো আনন্দ আছে নাকি! মনে হল এখন উনি সেইরকম কিছু বলে উঠবেন। খানিক বাদে একটু হই-চই উঠল, পাড়ার ছেলেরা এসেছে খাঁটিয়া ফুল নিয়ে। দেহনামাতে হবে। আমার মতো ভারী শরীর, ওদের নামাতে কষ্ট হচ্ছে। বিজনবাবুর স্ত্রী-কে কোনওরকমে সরিয়ে দেওয়া হল। একটি ছোঁকরা আমায় বলল, দাদা একটু হাত লাগান। আমি প্যান্টের প্যাকেটটা সামলে বিজনবাবুর পা ধরলাম। এর মধ্যেই বেশ ঠান্ডা হয়ে গেছে। সিঁড়ি দিয়ে নামাতে কষ্ট হচ্ছে। দেওয়ালে ধাক্কা লাগতে যাচ্ছিল আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, দেখবেন যেন না লাগে। ছেলেগুলো আমার দিকে তাকাল, মনে হল ওদের ঠোঁটে একচিলতে হাসির ভাঁজ।
নিচে খাঁটিয়া ধূপকাঠি জ্বালা হয়ে গেছে। বিজনবাবুকে শুইয়ে দিলাম আমরা। ওরা ফুল ছড়িয়ে দিল বুকে। একটি ছেলে দড়ি দিয়ে বাঁধতে যাচ্ছিল বিজনবাবুকে খাঁটিয়ার সঙ্গে, আমি বললাম, না বাঁধলেই নয়?
ও বলল, লাশ পড়ে যাবে না হলে।
ডুকরে-ওঠা কান্নাটা ততক্ষণে নিচে নেমে এসেছে। বিজনবাবুর স্ত্রী-কে কয়েকজন মহিলা জড়িয়ে ধরেছেন। সেই ছোট মেয়েটি বোবা হয়ে আমার পাশে দাঁড়িয়ে। আমি বললাম, তোমার বাবা? সে ঘাড় নাড়ল, তারপর হঠাৎ বাবা বলে চিৎকার করে কেঁদে উঠল। আমি তাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে চাইলাম–সে পাগলের মতো ছটফট করছিল। খানিক বাদে ওরা বিজনবাবুকে তুলে হাঁটতে শুরু করল।
একজন আমার কাঁধে হাত রেখে বলল, চলুন দাদা, নইলে ফিরতে ভোর হয়ে যাবে।
নিজের অজান্তেই ওদের সঙ্গে হাঁটতে শুরু করলাম। একহাতে যে আমার বিজনবাবুর প্যান্টের প্যাকেট সেটা আর খেয়াল নেই। এরা কোথায় যাবে? কোন শ্মশানে? আমি জানি না। ছেলেগুলো ভালো, চিৎকার-চেঁচামেচি করছে না মৃতদেহ নিয়ে যাওয়ার সময়। বরং বড্ড বেশি চুপচাপ। এভাবে বিজনবাবুকে নিয়ে যাওয়া উচিত নয়। আমি চাপাগলায় বললাম, হরিবোল! ওরা যেন প্রস্তুত হয়েই ছিল, চাপাগলায় জানান দিল, হরিবোল।
আমার খুব ভালো লাগল। এত বাস-ট্রাম জনতার মধ্যে দিয়ে আমরা বিজনবাবুর হাতে ফুলের তোড়া তুলে দেওয়ার মতো করে চাপাগলায় হরিবোল বলছি বুকভরে। রাস্তার দুপাশে মানুষজন। বিজনবাবুকে দুহাত তুলে নমস্কার করছে। আমার ভালো লাগছে। একটা চৌমাথার মোড়ে লালবাতি জ্বলছিল। ওপাশের রাস্তা দিয়ে দ্রুত ট্রাফিক ছুটছে। আমাদের দেখে পুলিশ হাত। বাড়িয়ে সব থামিয়ে দিল। সম্রাটের মতো বিজনবাবুরা রাস্তা পেরিয়ে গেলেন। আমার ভালো লাগল।
হঠাৎ মনে হল পেছনের ছেলেটি বোধ হয় কাঁধে ভার রাখতে পারছে না। ছুটে গিয়ে তাকে বললাম, অসুবিধে হচ্ছে?
সে ঘাড় নাড়ল, যা ভারী! আমি তার মুখ দেখলাম, বেশ ঘেমে গেছে। ছেলেটি বলল, একটু নেবেন? আমি কিছু বলার আগেই সে বিজনবাবুকে সামান্য তুলে ধরল। আমি কাঁধ দিলাম। একহাতে বিজনবাবুর খাঁটিয়া অন্য হাতে তাঁর প্যান্ট। হরিধ্বনি চলছে। চলার বেগ বেড়েছে। আমি তাল রাখতে পারছি না। বিজনবাবুর মুখটা ঝাঁকুনিতে আমার দিকে ঘোরানো। চোখ বন্ধ। মনে পড়ল একদিন ওঁর প্যান্টটা পরে দেখেছিলাম আমার হয় কিনা। ওঁকে লিখেছিলাম যে কোমরের কাছটা একদম ফিট করে গেছে। উনি লিখেছিলেন, তাহলে আপনি ডুপ্লিকেট বিজন হতে পারেন।
এখন এই মুহূর্তে আমার স্ত্রী চণ্ডীগড়ে বসে টিভি দেখছেন, আবার দশ বছরের মেয়ে পরীক্ষার পড়া করছে। আর আমি এখন খাঁটিয়ায় দুলতে-দুলতে যাচ্ছি। বিজনবাবুর মুখের দিকে তাকালাম। হ্যাঁ মশাই, আমি ডুপ্লিকেট বিজন হয়ে যেতে পারি যে-কোনও মুহূর্তেই। পারি কেন, হয়েই গেছি। শুধু শ্মশানের পথটাই জানি না।
ওই একটি জায়গায় যেতে যে অন্যের ওপর নির্ভর করতে হয় মশাই।