Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

দীনরাজ্যের এক রাজকন্যা-কথা – 2

যে সত্য  ঘটনা অবলম্বনে দীনরাজ্যের  রাজকন্যা কথা লিখেছিলাম—- সে রাজকন্যা  হারিয়ে গেলো, আর কোনদিন ত পেলাম না, কিন্তু —- আমি যখন জীবিত, আশা করা যায়, সেও বেঁচে আছে, প্রায় সমবয়সীই ত ছিলাম। “নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে , রয়েছ নয়নে নয়নে ” তিনটি সম্ভাবনার  কথা ঘিরে কল্পনাবিলাস– সে কল্পনা বিস্তার অধিকারের  প্রকাশ। কি সেই কথা,কোথায় এখন গৌরী? অনেক পথের বাঁকে শুধু তিনটি পথের হদিশ লিখেছিলাম আমি, আমার উদ্ধৃতি আমি। কোথায়  আছে গৌরী? “……..হয়ত মনের মতো রাজপুত্রের দেখা পেয়েছিল, অথবা অন্য  কোন উচ্চতর দীন আস্তানা, অথবা কানাঘুষায়  চলতি খবর যেটা সবার প্রিয় মুখরোচক চানাচুরের স্বাদে —- পতিতা পল্লী। গৌরী কি পতিতা হতে পারে , না, আসলে কোন নারীই পতিতা হয় না, পতিত হয় পুরুষ।……. ” গত শতাব্দীর  ষাটের দশকের মাঝে অল্প কয়েকদিনের পরিচিত সেই রাজকন্যা চিরকালের মতো হারিয়ে গিয়েছিল!!! না, সে রাজকন্যা  আছে। আবছা আলোর রেখায় নয়নমনিতে ঘনীভূত  সে এখন স্পষ্ট প্রতিভাত।

চিত্র (১)

“তুমি গৌরী…. না?”…… কতদি—–ন  পর— ঠিক চিনতে পেরেছি। ” হাসলো,সে না, মুক্তোর ঝিলিক  নয়, হলদে বাদামী ছোপ, সময়ের কোপ। “ছা-পোষা”  জীবের কি রেহাই  আছে। মুখখানা এক পটেই  স্থির  তবে পরিধি বেড়েছে। উজ্জ্বল  গৌরবর্ণের গৌরী , বর্তমানে লালচে আভার প্রৌড়ত্ব ছাড়িয়ে বার্ধক্যের পথে হামাগুড়ি। “কেমন আছো, কোথায় আছো, আর কে আছে…. উফ্, কতদিন পর, চিনতে পারছ না?” প্রশ্নফুলঝুড়ির  দাপটে,  গৌরী দাঁড়িয়ে গেলো, সেই তালতলার ভাঙাবাড়ির দরজার ফ্রেমে। পেছনে ছাইরঙা সেই সচল পরদা। তখনকার মতোই  শ্বেত সিঁথি,  দুধরঙা হাতদুখানাও সাদা….. ” ওমা, তুমি , পূরবী!!! কেমন তুমি এক আছো গো—-” “যাঃ, তা কখনও  হয়, বয়স আমাকে ছেড়ে দেবে? সে তো অসম্মান।” ” সত্যি বলছি  মাইরি,  হ্যাঁ,একটু মোটা হয়েছ ভাই।” দারিদ্রের ঘেরাটোপে খেঁটেখুটেখাওয়া সপ্রতিভ কুঁড়ি একুশ বছরের ছেলেটি একদম ভ্যাবাচ্যাকা যাকে বলে, হাঁ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে , মুখে যার মিনিটে মিনিটে সুরের টান—ও  দিদিভাই, ও বৌদিমনি, ও মাসিমা হাঁক— স্তব্ধ  কেমন! সেদিন অপরাহ্নে , চৈত্রের প্রচণ্ড তাপ, হালকা উদাসী বসন্ত  বাতাস। ফুটপাথে চলছে, চৈত্রসংক্রান্তি সেল। গৌরী কিনছে,   মধ্যবিত্তের  তথাকথিত  সখের “নাইটি”। স্নেহভরে ছেলেটি আমাদের  কথোপকথন সুযোগের কপাট ফাঁক করে দিলো, এ দরদ তার যেন এক বিলাসি মনের  খেয়াল। কত কথা হলো, হলো ঠিকানা  বিনিময়, দুজনে দুজনের হাত ধরে থাকলাম। বাবা? জানি না গো মা? নেই! ভাইয়েরা? জানা নেই!!! সংসার? মৃদু হাসি সে যে আপনার মনে চলে , জোড়া পা কদমচালে। গতিতে ঘনায় দিনমনি তার পথে। রাজপুত্রের  নাগাল গৌরী পায় নি—- নাকি পেয়েছিলো– গৌরী এখন কি বেণীমাধবের সেলাই দিদিমনি? না, সে এখন গর্বিত সফল , সত্যি স্বচ্ছল এক রাধুনী।

চিত্র-২

দেশপ্রিয় পার্কে মাঝে মাঝে নেহাতই  খেয়াল হয় তিন পাক খাবার,  নেহাতই  সখের সান্ধ্যভ্রমণ। গোধূলি আলো যেন কনে দেখার এক ঝলক— কে ও, কে উনি , কে, কে!! কেমন চেনা সেই হাসি, সেই মুক্তোর ঝিলিক। এতো সেই , একটু এগিয়ে যাই, বসে আছে মহিলা, আর চারদিক আলো ছড়াচ্ছে তার  সোনা মুগ ডাল রঙ। কে উদ্ধার করেছিল তোমায় গৌরী? শুভ্র পক্ষ্মীরাজ ঘোটক চেপে স্বপ্নের  রাজপুত্র!!! বড়ো বড়ো চোখে সেও চিনতে পারল তার খুব ভালো লাগার স্বল্প  পরিচয়ের —কয়েকটা পাস দেওয়া সেই মেয়েটিকেও। বিস্ময় কাটিয়ে দুজনের অনেক কথা চাঁপা সুরঙ্গ পথের আনাগোনায়— কিছু, কথায়, কিছু অনুভবের, কিছু হাতনাড়ায়। না, রাজপুত্র  নয়, এসেছিল নিরীহ মধ্যবিত্তের  আওতায় ধরা,  মুখ বুজে সমাজশাসন মেনে নেবার দলের একজন। গৌরীরা তালতলা থেকে উৎখাত হয়ে, এসেছিল বন্ডেল রোডের বস্তীতে, যার স্বীকৃতি স্লাম , কিন্তু সভ্য পোষাকি ভাষায় বলা যায়, কসমোপলিটন এরিয়া। তলিয়ে যাওয়া বা খড়খুটো ধরে ভেসে উঠে শক্ত ডাঙার  সন্ধান পাওয়া, এ দুনিয়ায় সবই সম্ভব সেখানে। চরম দুর্দিনে, দৈব সংযোগবশে আলাপ হলো মাটির এক রাজপুত্র-পুতুলের—- তারপর সংসার বন্ধনের দায় বর্তায় মন্দিরের। এদিক  ওদিক  ঘুরে অবশেষে কেয়াতলা। মেয়ে, জামাই, নাতি, স্বামী চার পিলারের ব্যবিলন- ঝুলন্ত শূন্যদ্যান তথা স্বর্গদ্যান। গৌরী সুখী,  সুখের মেদবর্ধন। ভালো লাগলো আমার এ কল্পনা বিলাস,তবে না,  এক ঝটকায় রূঢ় বাস্তব  নিয়ে গেলো আর এক জগতে, যেখানে গত্যন্তর  সব থেকে সম্ভাব্য, এক বাস্তব আস্তানা।

চিত্র–৩

প্রথম কলকাতাতে আগমন আমার  এক বৈশিষ্টপূর্ণ সন্ধিক্ষণ — প্রথম কলকাতা দর্শন, প্রথম প্লেনভ্রমণ, প্রথম  কলেজ, আর প্রথম বাবার বাড়ি পদার্পণ— সে সময়ে জানবার আকাঙ্খাও চূড়ান্ত …… বউবাজারের  তস্য বাই তস্য লেনে এক বিশাল তিনতলার বাড়িতে   পরিবারের বহু সদস্যদের  সাথে বাসকালীন পরিচয়  হয় শহর  কলকাতার কিছু পড়তি অবস্থার বনেদী বনিক সম্প্রদায়ের    প্রতিবেশী পরিবারগুলোর  সাথেও। এমন গলি, যেখানে টানা রিকশা , মানুষ, গরু, কুকুর , বেড়াল ছাড়া আর কিছু ঢুকতে পারত না। সে বাড়িতে ছিল সংলগ্ন দুটি খোলা ছাদ, ঘরের বিরাট দরজা সমান জানালার পাশে দাঁড়ালে দেখা যেতো শুধু বাড়ি আর বাড়ি, দোতলা বা তিনতলা। সূর্যাস্ত, সূর্যোদয়ের খোলা আকাশ, পেতাম গঙ্গার  মনোরম হাওয়া। আকাশের রঙ পাল্টানোর সাথে নানা পাখি বাজ চিল, কাক শালিক,  কবুতর ঘোরা। সকালে প্রায় সব বাড়ির ছাদেই  ফট ফট হাততালির সাথে সখের পায়রা ওড়ানো। বর্ষাকালে, “ভোকাট্টা” ও তীক্ষ্ণ শীষ ধ্বনি—- সন্ধ্যার  আলোআঁধারিতে ঘুঘনি, মালাই বরফ আর বেলফুল হকার, নাকে ভেসে আসত  সুবাস। আরও রাতে ঠুন ঠুন রিক্সা চলা, জানলা দিয়ে দেখা যেতো সোজা গলিতে– সওয়ারী সাদা ধূতী পাঞ্জাবী পরিহিত আধশোয়া ভঙ্গীতে, রসিক সমাজের রসিক কোন এক জন, হাতে বোতল অথবা সুগন্ধি জুঁই ফুলমালা, মেজাজও খোলামেলা। খোশ্ মনেতে, পরম সাথী ত রিকশাওয়ালা। অথবা গভীর রাতে, কোন প্রতিবেশীর দরজায় দড়াম দড়াম লাথি, “এই শুয়োরের বাচ্চা  , দরজা খোল্ ।” “আঃ, কি হচ্ছে কি, আস্তে কথা বলো” “কেন বলব? তোর বাপের বাড়ি?” হয়ত তা সহধর্মিনীর সাথে প্রেমালাপ। ঘুম ভেঙ্গে যেতো। কিন্তু বেশিদিন থাকতে হয় নি, চলে এসেছিলাম কলেজ স্ট্রীটে। তবে আমাদের  বড়ো পরিবারের জন্য  অত সস্তায় অত বৃহৎ বাড়ি বাবা পরে আর পান নি। তখন ত জানতাম না— হাড়কাটা গলি, সোনাগাছি, সোনাগাছিতে নাম লেখানো এসব কাকে বলে। প্রথম  শুনলাম,  পাশের বাড়ির সুমিত্রাদি নাকি বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছে। বনেদী বাড়িতে তখন ত ছেঁড়া বেনারসীর  সোনার আঁচল মেঝেতে , তাতে পেট ভরে না, বাড়ির কারোর ভ্রুক্ষেপ  আছে কি, বরং শান্তি, একটা পেট কমলো। দিন সাতেক পর  খবর এলো, সুমিত্রাদি হাড়কাটা গলিতে রীতিমত নাম লিখিয়ে ঠাই নিয়েছে । কিন্ত এসব কথা কেন লিখছি? কারণ…… দেখতে পাচ্ছি যে গৌরীকে!!! লাল গামছা গায়ে জড়িয়ে গৌরী দাঁড়িয়ে আছে গোল চত্বর উঠোনের একপাশে। সকালে প্রকৃতির ডাকে লাইন, এতঘর লাইনের মেয়েদের যে ঐ একটাই  শৌচালয় ব্যবস্থা। গৌরী বয়সের কাছে এখন বড়ো কাবু। ফর্সা শরীরে চামড়ার তলে “cellulite”এর দানা রূপের প্রতিবন্ধক,  আর এখন ব্যবসা চলে না, বাকি মেয়েদের সেবা করেই দুটো খেতে হয়। তার এখন ঘরও নেই, বারান্দার ধারে ঘুমোয়, পকেট যখন শুন্য, তখন বাটপাড়কে ভয় কি? তবু ব্যতিক্রমী কিছু আছে, তাই  আয়ও কিছু…… সে এখন প্রায় খরচার খাতায় একটু একটু করে ইতি….. কোন অন্যায় নয়, তার যে শুধু রূপ আর পিশাচ ভাষায় “গতর” ছিল  শুধু। কে ভিক্ষা দেবে, কেনই বা দেবে মাগনায়? আর গৌরীই বা ভিক্ষা চাইবে কেন? সেও ত বাঁকা পথেই পতিতা হওয়া।  “পতিতা” কি কখনও কেউ হয়? নয়, শব্দটি একপেশে, প্রগতি প্রসারে কর্মী , যার যা আছে তাই দিয়ে “আয় “, সোজা বাংলায়। ক্ষুধা প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তি জীবন চক্রে নিহিত। যার প্রয়োজন তিনি পয়সা খরচ করে কিনে নেবেন। সুখী বিলাসী পুরুষ  তবে নিশ্চয়  হয় “পতিত”। শত শত শিশুর প্রতিনিয়ত জন্ম হচ্ছে, পিতৃ পরিচয়হীন, এ দায় কার!!!! পতিত শব্দবিন্যাসের ব্যাখ্যা  অভিধানে ঠাই পাবে, পাওয়া উচিত। নয় “পতিতা” শব্দ। কোন নারী পতিতা হয় না, তাদের রোজগার ডাল রুটি আনে বয়ে —– মেধা , প্রতিভা, কারিগরি  শিক্ষার বিকল্পে কায়িক শ্রম বিনিময়ে। গৌরী তার শেষ  পুঁজি তথা শেষ সম্বল  ব্যবহারে ভাতকাপড়ের সংস্থান  বোধকরি করেছিল। আর যারা তার কাছে  কিনতে আসত, পয়সা দিয়ে , তারা কিন্তু পরে সুন্দর সংসার করে—- সাধুভান ভদ্দরজন। আসলে “পতিত” কথাটি তাদেরই বহন করা উচিত। ভবিষ্যত  জবাব দেবে। গৌরী পতিতা নয়, অনন্যোপায়ে সে বাধ্য হয়েছিল, সে আছে, থাকবে।

Pages: 1 2

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress