০৩. দিবারাত্রির কাব্য
তৃতীয় ভাগ : দিবারাত্রির কাব্য
অন্ধকারে কাঁদিছে উর্বশী,
কান পেতে শোন বন্ধু শ্মশানচারিণী,
মৃত্যু-অভিসারিকার গান;
‘সব্যসাচি! আমি উপবাসী!’
বলি অঙ্গে ভষ্ম মাখে সৃষ্টির স্বৈরিণী,
হিমে তাপে মাগে পরিত্রাণ।
‘সব্যসাচি! আমি ক্ষুধাতুরা,
শ্মশানের প্রান্ত-ঘেঁষা উত্তর-বাহিনী
নদীস্রোতে চলেছি ভাসিয়া,
মোর সর্ব ভবিষ্যৎ-ভরা
ব্যর্থতার পরপারে।–কে কহে কাহিনী?
মোর লাগি রহিবে বসিয়া?’
জলের সমুদ্র নয়, আরো উন্মাদ হৃদয়-সমুদ্রের কলরবে মাঝরাত্রি পার না হলে হেরম্বের ঘুম আসে না। তবু আজ প্রত্যুষেই তার ঘুম ভেঙে গেল। ঘুমের প্রয়োজন আছে কিন্তু ঘুম আসবে না, শুয়ে শুয়ে সে কষ্ট ভোগ করার চেয়ে উঠে বসে চুরুট ধরানোই হেরম্ব ভালো মনে করল। কাল গিয়েছে। কৃষ্ণচতুর্দশীর রাত্রি। আনন্দের পূর্ণিমা নৃত্যের পরবর্তী অমাবস্যা সম্ভবত আজ দিনের বেলাই কোনো এক সময়ে শুরু হয়ে যাবে।
হেরম্ব উঠে গিয়ে জানালায় দাঁড়ায়। গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা যায় বাগানের অপর প্রান্তে আনন্দ ফুল তুলছে। দেখে হেরম্বের খুশি হয়ে ওঠার কথা, কিন্তু আগামী সমস্ত দিনটির কল্পনায় সে বিষণ্ণ হয়েই থাকে। দিনের বেলাটা এখানে হেরম্বের ভালো লাগে না। উৎসবের পর সামিয়ানা নামানোর মতো নিরুৎসব কর্মপদ্ধতিতে সারাদিন এখানকার সকলে ব্যাপৃত হয়ে থাকে, হেরম্বের সুদীর্ঘ সময় বিরক্তিতে পূর্ণ হয়ে যায়। সকালে মন্দিরে হয় ভক্ত-সমাগম। লাল চেলী পরে কপালে রক্তচন্দনের তিলক এঁকে মালতী তাদের বিতরণ করে পুণ্য, অভয় চরণামৃত এবং মাদুলি। চন্দন ঘষে, নৈবেদ্য সাজিয়ে, প্ৰদীপ জ্বেলে ও ধূপধুনো দিয়ে আনন্দ মাকে সাহায্য করে, হেরম্বকে খেতে দেয়, অনাথের জন্য এক-পাকের রান্না চড়ায় আর নিজের অসংখ্য বিস্ময়কর ছেলেমানুষ নিয়ে মেতে থাকে। ফুলগাছে জল দেয়, আঁকশি দিয়ে গাছের উঁচু ডালের ফল পাড়ে, কোঁচড়ভরা ফুল নিয়ে মালা গেঁথে গেথে অনাথের কাছে বসে গল্প শোনে।
হেরম্বের পাকা মন, যা আনন্দের সংস্রবে এসে উদ্বেল আনন্দে কাঁচা হয়ে যেতে শিখেছে, খারাপ হয়ে যায়। সে কোনোদিন ঘরে বসে ঝিমায়, কোনোদিন বেরিয়ে পড়ে পথে।
জগন্নাথের বিস্তীর্ণ মন্দির-চত্বরে, সাগরসৈকতের বিপুল উন্মুক্ততায়, আপনার হৃদয়ের খেলা নিয়ে সে মেতে থাকে। মিলন আর বিরহ, বিরহ আর মিলন। দেয়ালের আবেষ্টনীতে ধূপগন্ধী অন্ধকারে বন্দি জগন্নাথ, আকাশের সমুদ্রের দিকহীন ব্যাপ্তির দেবতা। পথে কয়েকটি বিশিষ্ট অবসরে সুপ্রিয়াকেও তার স্মরণ করতে হয়। কাব্যোপজীবীর দৈহিক ক্ষুধাতৃষ্ণ নিবারণের মতো এক অনিবাৰ্য বিচিত্র কারণে সুপ্রিয়ার চিন্তাও মাঝে মাঝে তার কাছে প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে। এই বাড়ি আর বাগানের আবেষ্টনীর মধ্যে সে যতক্ষণ থাকে, পৰ্যায়ক্রমে তীব্র আনন্দ ও গাঢ় বিষাদে সে এমনি আচ্ছন্ন হয়ে থাকে, যে তার চেতনা আনন্দকে অতিক্রম করে সুপ্রিয়াকে খুঁজে পায় না। পথে বার হয়ে অন্যমনে হাঁটতে হাঁটতে সে যখন শহরের শেষ সীমা সাদা বাড়িটার কাছে পৌছয়, তখন থেকে শুরু করে তার মন ধীরে ধীরে পার্থিব বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠতে থাকে। সে স্পষ্ট অনুভব করে, একটা রঙিন, স্তিমিত আলোর জগৎ থেকে সে পৃথিবীর দিবালোকে নেমে আসছে। ধূলিসমাচ্ছন্ন পথ, দুদিকের দোকানপাট, পথের জনতা তার কাছে এতক্ষণ ফোকাস-ছাড়া দূরবীনের দৃশ্যপটের মতো ঝাপসা হয়ে ছিল, এতক্ষণে ফোকাস ঠিক হয়ে সব উজ্জ্বল ও স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। পৃথিবীতে সে যে এক নয়, শোণিত-সুর-সন্তপ্ত হৃদয় নিয়ে জীবনের চিরন্তন ও অনভিনব সুখ-দুঃখে বিচলিত অসংখ্য নরনারী যে তাকে ঘিরে আছে, এই অনুভূতির শেষ পর্যায়ে জীবনের সাধারণ ও বাস্তব ভিত্তিগুলির সঙ্গে হেরম্বের নূতন করে পরিচয় হয়। সুপ্রিয়া হয়ে থাকে। এই পুরস্ক্রর মধ্যবর্তনী কান্ত, রৌদ্রতপ্ত দিনের ধূলিরুক্ষ কঠোর বাস্তবতায় একটি কাম্য পানীয়ের প্রতীক।
কোনোদিন বাইরে প্রবল বর্ষা নামে। মন্দির ও সমুদ্র জীবন থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে মিলিয়ে যায়। ঘরের মধ্যে বিছানো লোমশ কম্বলে বসে আনন্দ ঝিনুকের রাশি গোনে এবং বাছে, ডান হাত আর বাঁ হাতকে প্রতিপক্ষ করে খেলে জোড়-বিজোড়। দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে হেরম্ব চুরুট খায় আর নিরানন্দ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আনন্দের খেলা চেয়ে দেখে। এই বিরহ-বিপন্ন বিষণ্ণ মুহূর্তগুলিতে তার যে দৃষ্টির প্রখরতা কমে যায় তা নয়। আনন্দের স্বচ্ছাপ্রায় নখের তলে রক্তের আনাগোনা তার চোখে পড়ে, অধরোষ্ঠের নিগুঢ় অভিপ্ৰায়ের সে মর্মোদঘাটন করে, কপালে ছেলেখেলার হারজিতের হিসাবগুলিকে গোনে। ঘরের আলো বর্ষার মেঘে স্তিমিত হয়ে থাকে।
আনন্দ শ্ৰান্তস্বরে বলে, ‘কি বৃষ্টিই নেমেছে! সমুদ্রটা পর্যন্ত বোধহয় ভিজে গেল।’
হেরম্ব কথা বলে না। আনন্দের বর্ষা-বিরাগে তার দিন আরো কাটতে চায় না।
চুরুটের গন্ধে আনন্দ মুখ ফিরিয়ে জানালার দিকে তাকাল।. হেরম্ব ভাবল, আনন্দ হয়তো হাতছানি দিয়ে তাকে ডাকবে। এখন বাগানে যেতে অস্বীকার করার জন্য হেরম্ব নিজেকে প্রস্তুত করছে, আনন্দ মৃদু হেসে মাথা নাড়ল, যার সুস্পষ্ট অর্থ, এখন হেরম্বের বাগানে যাবার দরকার নেই : দূরত্বই ভালো, এই ব্যবধান। হেরম্ব চুরুটটা ফেলে দিয়ে সরে গেল। কাছাকাছি না গেলে চাওয়া-চাওয়িও এখন না হলে চলবে।
গামছা কাপড় নিয়ে হেরম্ব খিড়কির দরজা দিয়ে বার হয়ে বাড়ির পূর্বদিকের পুকুরে স্নান করে এল। বাড়িতে ঢুকে দেখল, বাগান থেকে ঘরে এসে আনন্দ অনাথের কাছে গল্প শুনতে বসেছে। হেরম্বও একপাশে বসে পড়ল। গল্প শোনার প্রত্যাশায় নয় ; অনাথের বলা ও আনন্দের শোনা দেখবার জন্য।
অনাথ আজ মেয়েকে নচিকেতার কাহিনী শোনাচ্ছে।
‘–তস্য হি নচিকেতা নাম পুত্ৰ আস। বাজশ্রবসের নচিকেতা নামে এক পুত্র ছিল! একবার এক যজ্ঞ করে বাজশ্রবস নিজের সর্বস্ব দান করলেন। দক্ষিণা দেবার সময় হলে নচিকেতা–স হোবাচ পিতরাং তত কৰ্ম্মৈ মান্দাস্যতীতি, আমায় কাকে দেবেন? নচিকেতা তিনবার এ প্রশ্ন করলে বাজশ্ৰবাস রাগ করে বললেন, তোমায় যমকে দেব।’
হেরম্ব মৃদুস্বরে বলল, ‘যম নয়, মৃত্যুকে।’
আনন্দ বলল, ‘তফাত কি হল?’
হেরম্ব বলল, ‘উপনিষদে মৃত্যু শব্দটা আছে।’
আনন্দ তার এই বিদ্যার পরিচয়ে মুগ্ধ হল না। বলল, ‘তারপর কি হল বাবা?’
হেরম্বের মনে হয়, আনন্দ তাকে অবহেলা করছে। তার অস্তিত্বকে আনন্দের এ পরিপূর্ণ বিস্মরণ। বাগানে আনন্দের ঘাড় নাড়া ধরলে এই নিয়ে দুবার হল। সকালের শুরু দেখে আজকের দিনটি হেরম্ব একটি মোটামুটি নিরানন্দের মধ্যে কাটিয়ে দেবারও আশা করতে পারে না।
এদিকে মালতী এসে নচিকেতার কাহিনীতে বাধা জন্মায়।
‘তারপর কি হল বাবা? কচি খুকির মতো সকালে উঠে গপ্পো গিলছিস? স্নান-টান করে মন্দিরটা খোল না গিয়ে! কাজের সময় গপ্পো কি?’
অনাথ বলে, ‘এমনি করে বুঝি বলতে হয়, মালতী?’
‘কি করে বলব। তবে? একটা কাজ করতে বলার জন্যে পেটের মেয়ের কাছে গলবস্ত্র হতে হবে?’
অনাথ চুপ করে যায়। আনন্দ স্নানের উদ্দেশ্যে চলে যায় পুকুরে। তাঁর পরিত্যক্ত স্থানটি দখল কুসুম মালতী। হেরণের মনে হয়, সেও খুব অনাথের কাছে গাই শুনতে চায়। যে কোনো কাহিনী।
হেরম্বের আবির্ভাবে এদের দুজনের সম্পর্কে বিশেষ কোনো পরিবর্তন ঘটে নি। অনাথের অসঙ্গত অবহেলার জবাবে মালতীর স্বেচ্ছাচারিতা যেমন উগ্র ছিল তেমনি উগ্র হয়েই আছে। কিন্তু তার সমস্ত রুক্ষ আচরণের মধ্যে একটি পিপাসু দীনতা, ক্ষীণতম আশ্বাসের প্রতিদানে নিজেকে আমূল পরিবর্তন করে ফেলবার একটা অনুচ্চারিত প্রতিজ্ঞা হেরম্ব আজকাল সর্বদা আবিষ্কার করতে পারে। বোঝা যায়, অনাথের প্রতি মালতীর সমস্ত ঔদ্ধত্য অনাথকে আশ্রয় করেই যেন দাঁড়িয়ে থাকে। নিজের জীবনে সে যে স্থূল অপরিচ্ছন্নতা আমদানি করেছে, অনাথের গায়ে তার নমুনাগুলি লেপন করে দেবার চেষ্টার মধ্যে যেন তার একটি প্রার্থনার আর্তনাদ গোপন হয়ে থাকে, আমাকে। শুদ্ধ করা, পবিত্র করা। অনাথের নিরুপদ্রব নির্বিকার ভাব মাঝে মাঝে হেরম্বকেও বিচলিত করে দেয়। সময় সময় তার মনে হয়, এও বুঝি এক ধরনের অসুখ। জ্বর। যেমন উত্তাপ বেড়েও হয়, কমেও হয়, এরা দুজনে তেমনি একই মানসিক বিকারের শান্ত ও অশান্ত অবস্থা দুটি ভাগ করে নিয়েছে।
কখনো কখনো এমন কথাও হেরম্বের মনে হয় যে, অনাথের চেয়ে মালতীরই বুঝি ধৈর্য বেশি, তিতিক্ষা কঠোরতর, অনাথের আধ্যাত্মিক তপস্যার চেয়ে মালতীর তপস্যাই বেশি বিরামবিহীন। অনাথের বিষয়ান্তরের আশ্রয় আছে, অন্যমনস্কতা আছে, যৌগিক বিশ্রাম আছে–-মালতীর জীবনের নিত্যনৈমিত্তিক লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও গতি নিরবচ্ছিন্নভাবে একনিষ্ঠ। অনাথকে কেন্দ্র করে সে পাক খাচ্ছে। অনাথ তার জগৎ অনাথ তার জীবন, অনাথকে নিয়ে তার রাগ-দুঃখ-হিংসা-ক্লেশ, অনাথ তার অমার্জিত পার্থিবতার প্রস্রবণ, তার মদের নেশার প্রেরণা। অনাথকে বাদ দিলে তার কিছুই থাকে না।
হেরম্বকে চোখ ঠেরে মালতী গম্ভীর মুখে অনাথকে বলল, ‘কাল এক স্বপন দেখলাম। তুমি আর আমি যেন কোথায় গেছি–অনেক দূর দেশে। পোড়া দেশে আমরা দুজন ছাড়া আর মানুষ নেই, রাস্তায়-ঘাটে, ঘরে-বাড়িতে সব মরে রয়েছে।’
অনাথ বলল, ‘ভুলেও তো সৎচিন্তা করবে না। তাই এরকম হিংসার ছবি দ্যাখ।’
মালতী এ কথা কানেও তুলল না, বলে চলল, ‘স্বপন দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেছে বাপু, যাই বল। আচ্ছা চল না। আমরা দুজনে একটু বেড়িয়ে আসি ক’দিন? ওদের কষ্ঠিবদলটা চুকিয়ে দিয়ে যাই, ওরা এখানে থাক। তুমি আমি বিন্দাবনে গিয়ে ঘর বাঁধি চল!’
মালতীর গাম্ভীৰ্যকে বিশ্বাস করে উপদেশ দেবার ভঙ্গিতে অনাথ বলল, ‘এখনো তোমার ঘর বাঁধবার শখ আছে, মালতী? বনে যদি যাও তো চল!’
মালতী তার আকস্মিক বিপুল হাসিতে অনাথের ক্ষণিকের অন্তরঙ্গতা চূৰ্ণ করে দিল। বলল, ‘কেন, বনে যাবার এমন কি বয়েসটা আমার হয়েছে শুনি? রাধাবিনোদ গোসাই কণ্ঠিবদলের জন্য সেদিনও আমায়। সেধে গেল না? মেয়ে টের পাবে বলে অপমান করে তাড়িয়ে দিলাম, ডাকলেই আবার আসে। তোমার চোখ নেই তাই আমাকে বুড়ি দ্যাখ! না কি বল, হেরম্ব? আমি বুড়ি?’
হেরম্বকে সে আবার চোখ ঠারল, ‘রাধাবিনোদ গোসাইকে জান হেরম্ব? মাঝে মাঝে আমায় দেখতে আর সাধতে আসে–লক্ষ্মীছাড়া ব্যাটা। চেহারা যেমন হোক, পয়সা আছে। সেবাদাসীর খাতিরও জানে বেশ–শৌখিন বৈরিগি কিনা। তোমাদের এই মাস্টারমশায়ের মতো কাটখোট্টা নয়।‘
অনাথ বলল, ‘কি সব বলছ মালতী?’
মালতী হঠাৎ ঢোক গিলে এদিক-ওদিক তাকায়। দৃষ্টি দিয়ে অনাথকে গ্ৰাস করতে তার এই দ্বিধা দেখে হেরম্ব অবাক হয়ে যায়। কিন্তু মালতী নিজেকে চোখের পলকে বদলে ফেলে। ঔদ্ধত্যের সীমা তার কোনোদিনই নেই। সে হেসে বলে, ‘বৈরিগি মানুষের মতো লজ্জা কেন? বলি না। হেরম্বকে কাণ্ডটা।–শোন হেরম্ব, বলি। এই যে গোবেচারি ভালো মানুষটিকে দেখছ, সাত চড়ে মুখে রা নেই, আমার জন্যে একদিন এ রাধাবিনোদ গোঁসাই-এর সঙ্গে মারামারি করেছে। হাতাহাতি চুলেচুলি সে কি কাণ্ড হেরম্ব, দেখলে তোমার গায়ে কঁটা দিত। আমি না। সামলালে সেদিন গোঁসাই খুন হয়ে যেত, হেরম্বা। আর আজকে আমি মরি-বাঁচি গ্রাহ্যি নেই!’
হেরম্ব বুঝতে পারে, কথার আড়ালে মালতী পুষ্পাঞ্জলির মতো অনাথের পায়ে নিবেদন বর্ষণ করছে–যেদিন ছিল সেদিন আবার ফিরে আসুক।
‘হ্যাঁ গো, চল না, আমরা যাই? মেয়ের মুখ চেয়ে আর কতকাল আমায় কষ্ট দেবে?’
‘তোমার সঙ্গে কথা কইলেই তুমি বড় বাজে বক, মালতী।’ বলে অনাথ উঠে গেল। মালতী ক্রুদ্ধকণ্ঠে বলল, ‘আমার সঙ্গে এমন করলে ভালো হবে না। বলছি। বস এসে, আমার আরো কথা আছে, ঢের কথা আছে।’
অনাথ চলে গেলে মালতী ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলল। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে তাঁর ঠোঁটের বাঁকা হাসিতে নিরুৎসাহ ও নিরুৎসব ভােব চাপা পড়ে গেল। এইমাত্র যে ছিল ভিখারিনী, সে হঠাৎ ক্ষমাদাত্রী হয়ে বলল, ‘লোকটা পাগল হেরম্ব, ক্ষ্যাপা। আর ছেলেমানুষ।’
‘আমি কিছু বলব, মালতী-বৌদি?’
‘চুপ! একটি কথা নয়।’—মালতী টেনে টেনে হাসল, ‘তুমি বোঝা ছাই, বলবেও ছাই। দেড় যুগ আঙুল দিয়ে ছোয় না, তাই বলে আমি কি মরে আছি? বুড়ো হয়ে গেলাম, শখ-টখ আমার আর নেই বাপু, এখন ধম্মেকম্মো সার। ঠাট্টা-তামাশা করি একটু, মিনসে তাও বোঝে না।’
স্নান করে এসে চাবি নিয়ে আনন্দ মন্দিরে গেল। মালতী ঘরে ঢুকে এই ভোরে বাসিমুখে গিলে এল খানিকটা কারণ। মালতী প্রকৃতপক্ষে বৈষ্ণবী, কিন্তু সবদিক দিয়ে অনাথের বিরুদ্ধাচরণ করার জন্য মালতী তান্ত্রিক গুরুর কাছে মন্ত্র নিয়েছে। মন্ত্র নিয়ে ধ্যানধারণা সমস্ত পর্যবসিত করেছে। কারণ-পানে। হেরম্বের প্রায় সহ্য হয়ে এসেছিল, তবু ঘুম থেকে উঠেই মালতীর মদ খাওয়া তার বরদাশত হল না। সে বাইরে চলে গেল।
মন্দিরের দরজায় দাঁড়িয়ে বলল, ‘তোমাকে হয়তো আজ ভক্তদের ব্যবস্থাও করতে হবে, না
আনন্দ?’
আনন্দ চন্দন ঘষছিল। কাজে আজ তার উৎসাহ নেই।
’না, মা আসবে।’
‘তিনি এইমাত্র খালি পেটে কারণ খেলেন! চোখ লাল হতে আরম্ভ করেছে।’
‘কারণ খেলে মার কিছু হয় না।’
হেরম্ব দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ আনন্দের অন্যমনস্ক কাজ করা চেয়ে দেখল। হাত-পা নাড়তে আনন্দের যেন বড় কষ্ট হচ্ছে। যেমন তেমন করে পূজার আয়োজন শেষ করে দিতে পারলে সে যেন আজ বাঁচে। তিন দিন আগে বর্ষা নেমেছিল। সেদিন থেকে আনন্দের কি যে হয়েছে। কেউ জানে না, হয়তো আনন্দ নিজেও নয়। অল্পে অল্পে সে গম্ভীর ও বিষণ্ণ হয়ে গিয়েছে। তার মধ্যে যে আবেগময় উদ্গ্ৰীব উল্লাস আপনা হতে উৎসারিত হতে পথ পেত না, হেরম্বের ডাকেও আজ তা সাড়া দিতে চায় না। সে ঝিমিয়ে পড়েছে, হেরম্বের কাছ থেকে গিয়েছে সরে। দূরে নয়, অন্তরালে। সেদিনের মেঘ-মেদুর আকাশের মতো কোথা থেকে সে একটি সজল বিষণ্ণ আবরণ সংগ্রহ করেছে, ভালবাসার পাখায় ভর করে হেরম্বের মন উর্ধের্ব, বহু ঊর্ধে উঠেও অবারিত নীল আকাশকে খুঁজে পাচ্ছে না।
এতদিন হেরম্ব কিছু জিজ্ঞাসা করে নি। আজ সে প্রশ্ন করল, ‘তোমার কি হয়েছে, আনন্দ?’
‘আমার অসুখ করেছে।’
হেরম্ব হতবাক হয়ে গেল। তার প্রশ্নের জবাবে এই যদি আনন্দের বক্তব্য হয়, তার ভালবাসাকে শুধু এই কৈফিয়ত যদি আনন্দ দিতে চায়, তবে আর কিছু তার জিজ্ঞাস্য নেই। সে কি জানে না আনন্দের অসুখ করে নি!
গুরুতর পরিশ্রমের কাজে মানুষ যেভাবে ক্ষণিকের বিরাম নেয়, চন্দন ঘষা বন্ধ করে আনন্দ তেমনি শিথিল অবসন্নভাবে মন্দিরের মেঝেতে হাঁটু মুড়ে বসল। বলল, ‘মাথাটা ঘুরছে, বুক ধড়ফড় করছে—’
নিষ্ক্রিয় অবসাদে হেরম্ব মাথা নেড়েও সায় দিল না।
‘–আর মন কেমন করছে। চন্দনটা ঘষে দেবো?’
আনন্দের বিষণ্ণতার সমগ্র ইতিহাস এইটুকু হয়তো এর বিশদ ব্যাখ্যা ছিল; কিন্তু আজো, এক পূর্ণিমা থেকে আরেক অমাবস্যা পর্যন্ত আনন্দের হৃদয়ে অতিথি হয়ে বাস করার পরেও বিশ্লেষণে যা ধরা পড়ে না, শুধু অনুমান দিয়ে আবিষ্কার করে তাকে গ্ৰহণ করার শক্তি হেরম্বের জন্মায় নি। আনন্দের মুখ দেখে হেরম্ব ছাড়া আর সকলের সন্দেহ হবার সম্ভাবনা আছে যে আনন্দের দাঁত কনকন করছে।
‘চন্দন তুমিই ঘষে নাও, আনন্দ।’–বলে হেরম্ব মন্দির ছেড়ে চলে এল। বহুদিন আগে। একবার এক বর্ষণ-ক্ষান্ত নিশীথ স্তব্ধতায় সজল বায়ুস্তর ভেদ করে হেরম্বের কলকাতার বাড়িতে বিনামেঘে বজ্ৰাঘাত হয়েছিল। স্ত্রীর ভয় তারও মনে সংক্রমিত হওয়াতে বাকি রাতটা হেরম্ব আতঙ্কে ঘুমাতে পারে নি। আজ কিছুক্ষণের জন্য তার অবিকল সেই রকম ভয় করতে লাগল।
ঘরে গিয়ে হেরম্ব বিছানায় আশ্রয় নিল। বারান্দা দিয়ে যাবার সময় দেখে গেল, অনাথ তার ঘরে ধ্যানস্থ হয়েছে। তার নিষ্পন্দ দেহের দিকে এক নজর তাকালেই বোঝা যায়, বাহ্যজ্ঞান নেই। অনাথের সুদীর্ঘ সাধনা হেরম্ব দেখে নি, এত দ্রুত তাকে সমাধিস্থ হতে দেখে তার বিস্ময়ের সীমা থাকে না। আনন্দের কাছে সে শুনেছে, গত বৎসরও অনাথের এ ক্ষমতা ছিল না। মাস চারেক আগে অনাথ একবার মাথার যন্ত্রণায় ক’দিন পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিল, তারপর থেকে আসনে বসলেই সে সমাধি পায়।
জীবনে মৃত্যুর স্বাদ ভোগ করবার শখ হেরম্বের কোনোদিন ছিল না, এ বিষয়ে কৌতূহলও তার নেই। বিছানায় চিৎ হয়ে সে ঘুমেরই তপস্যা আরম্ভ করল। আনন্দ যখন ঘরে এল ঘুমের আশা সে ত্যাগ করেছে, কিন্তু চোখ মেলে নি।
আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, ‘ঘুমিয়েছ?’
‘না।’
‘চন্দন ঘষে দিলে না যে?’
হেরম্ব উঠে বসল। বলল, ‘ওসব আমি পারি না। আমাদের সংসার হলে তুমি যে বলবে এটা করা ওটা কর তা চলবে না, আনন্দ। আলসেমিকে আমি প্রায় তোমার সমান ভালবাসি।’
‘ভালবাস নাকি আমাকে?’
আনন্দের কণ্ঠস্বর হেরম্বকে চমকে দিল।
সহজ ও সরল প্রশ্ন নয়। উচ্চারণের পর মরে যায় না। এমন সব কথা আনন্দ আজকাল এমনি অবহেলার সঙ্গে বলে। হেরম্বের মনশ্চক্ষে যে ছানি পড়তে আরম্ভ করেছিল চোখের পলকে তা স্বচ্ছ হয়ে গেল। আনন্দের মুখ দেখে সে বুঝতে পারল শুধু বিষণ্ণতা নয়, সেই প্রথম রাত্রিতে চন্দ্ৰকলানাচ শেষ করার পর আনন্দের যে যন্ত্রণা হয়েছিল। তেমনি একটি কষ্ট সে জোর করে চেপে রাখছে। হেরম্ব সভয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘এ কথা বলছি কেন, আনন্দ?’
‘আমার ক’দিন থেকে এরকম মনে হচ্ছে যে।’
‘আগে বল নি কেন?’
‘মনে এলেই বুঝি সব কথা বলা যায়? আগে বলি নি, এখন তো বলছি। তুমি বলেছিলে ভালবাসা বেশিদিন বাঁচে না। আমাদের ভালবাসা কি মরে যাচ্ছে?’
হেরম্ব জোর দিয়ে বলল, ‘তা যাচ্ছে না, আনন্দ। আমাদের ভালবাসা কি বেশিদিনের, যে মরে যাবে? এখনো যে ভালো করে আরম্ভই হয় নি?’
আনন্দ হতাশার সুরে বলল, ‘আমি কিছুই বুঝতে পারি না। সব হেঁয়ালির মতো লাগে। তুমি, আমি, আমাদের ভালবাসা, সব মিথ্যে মনে হয়। আচ্ছা, আমাদের ভালবাসাকে অনেকদিন, খুব অনেকদিন বাঁচিয়ে রাখা যায় না?’
হেরম্ব একবার ভাবল মিথ্যে বলে আনন্দকে সান্ত্বনা দেয়। কিন্তু সত্য, মিথ্যা কোনো সত্ত্বেনাই আত্মোপলব্ধির রূপান্তর দিতে পারে না, হেরম্ব তা জানে। সে স্বীকার করে বলল, ‘তা যায় না। আনন্দ, কিন্তু সেজন্য তুমি বিচলিত হচ্ছ কেন? বেশিদিন নাই-বা বীচল, যতদিন বাঁচবে তাতেই আমাদের ভালবাসা। ধন্য হয়ে যাবে। ভালবাসা মরে গেলে আমাদের যে অবস্থা হবে এখন তুমি তা যত ভয়ানক মনে করছ, তখন সে রকম মনে হবে না। ভালবাসা মরে কখন? যখন ভালবাসার শক্তি থাকে না। যে ভালবাসতে পারে না, প্ৰেম না থাকলে তার কি এসে যায়?’
আনন্দ বিস্মিত হয়ে বলল, ‘একি বলছ? যা নেই তার অভাববোধ থাকবে না?’
‘থাকবে, কিন্তু সেটা খুব কষ্টকর হবে না। আমাদের মন তখন বদলে যাবে।’
‘যাবেই? কিছুতেই ঠেকানো যাবে না?’
সোজাসুজি জবাব হেরম্ব দিল না। হঠাৎ উপদেষ্টার আসন নিয়ে বলল, ‘এসব কথা নিয়ে মন খারাপ কোরো না, আনন্দ। বেশিদিন বাঁচলে কি প্রেমের দাম থাকত? তোমার ফুলগাছের ফুল ফুটে ঝরে যায়, তুমি সেজন্য শোক কর নাকি?’
‘ফুল যে রোজ ফোটে।’
কিছুক্ষণের জন্য হেরম্ব বিপন্ন হয়ে রইল। তার মনে হল, আনন্দের কথায় একেবারে চরম সত্যটি রূপ নিয়েছে, এখন সে যাই বলুক সে শুধু তর্কের খাতিরে বলা হবে, তার কোনো মানে থাকবে না। ক’দিন থেকে প্রয়োজনীয় নিদ্রার অভাবে হেরম্বের মস্তিষ্ক অবসন্ন হয়ে পড়েছিল, জোর করে ভাবতে গিয়ে তার চিন্তাগুলি যেন জড়িয়ে যেতে লাগল। অথচ সত্যকে চিরদিন বিনা প্রতিবাদে গ্ৰহণ করে এসে আনন্দের উপমা-নিহিত অন্তিম সত্যকে কোনোরকমে মানতে পারছে না। দেখে তার আশা হল, বংশহীন ফুলের মতো একবার মাত্র বিকাশ লাভ করে ঝরে যাওয়ার ব্যর্থতাই মানব-হৃদয়ের চরম পরিচয় নয়, বিকাশের পুনরাবৃত্তি হয়তো আছে, হৃদয়ের পুনর্জন্ম হয়তো অবিরাম ঘটে চলেছে। মানুষের মৃত্যু-কবলিত জীবন যেমন সার্থক, তেমনি সার্থকতা ক্ষণজীবী হৃদয়েরও হয়তো আছে।
হেরম্ব যতক্ষণ ব্যাকুল হয়ে চারিদিকে অন্ধের মতো হাতড়ে খুঁজে বেড়াতে লাগল। এই সার্থকতার স্বরূপ তার কাছে ধরা পড়ল না। হেরম্বের নিদ্ৰাতুর মনও বেশিক্ষণ খেইহারা চিন্তার অর্থহীন বিড়ম্বনা ভোগ করবার মতো নয়। ক্রমে ক্ৰমে সে শান্ত হয়ে এলে এত সহজে হৃদয়ের মৃত্যু-রহস্য তার কাছে স্বচ্ছ হয়ে গেল যে, এই সুলভ জ্ঞানের জন্য ছেলেমানুষের মতো উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল বলে নিজের কাছেই সে লজ্জা পেল।
সে প্রীতিকর প্রসন্ন হাসি হেসে বলল, ‘মানুষও রোজ ভালবাসে, আনন্দ। প্রত্যেকটি ঝরে যাওয়া ভালবাসার জায়গায় আবার তেমনি একটি করে ভালবাসা জন্মায়। আমরা মানুষ, গাছপাথরের মতো সীমাবদ্ধ নই। আমাদের চেতনা সমস্ত বিশ্বে ছড়িয়ে আছে, পৃথিবীর সমস্ত মানুষের সঙ্গে এক হয়ে আমরা বেঁচে আছি। আমি যেমন সমস্ত মানুষের প্রতিনিধি, সমস্ত মানুষ তেমনি আমার প্রতিনিধি। একটা প্ৰকাণ্ড হৃদয় থেকে একটুকরো ভাগ করে নিয়ে আমার স্বতন্ত্র হৃদয় হয়েছে, কিন্তু নাড়ি কাটার পরেও মা আর ছেলের যেমন নাড়ির যোগ থাকে, সমস্ত মানুষের সমবেত অখণ্ড হৃদয়ের সঙ্গে আমারও তেমনি আত্মীয়তা আছে। তুমি ভাবছ। এ শুধু কল্পনার বাহার। তা নয়, আনন্দ। আকাশ আর বাতাস থেকে আমার মন, আমার হৃদয় নিজেকে সংগ্রহ ও সঞ্চয় করে নি, তাদের প্রত্যেকটি কণা এসেছে মানুষের ভাণ্ডার থেকে। আমরা জনাই একটা শূন্য, আজীবন মানুষের সাধারণ হৃদয়-মনের সম্পত্তি থেকে তিল তিল করে ঐশ্বৰ্য নিয়ে সেই শূন্য পূরণ করি।–আমরা তাই পরস্পর আত্মীয়, আমরা তাই প্রত্যেকে সমস্ত মানুষের মধ্যে নিজেদের অনুভব করতে পারি। তাই আমাদের ভালবাসা যখন মরে যাবে, অন্য মানুষ তখন ভালবাসবে। আমাদের প্রেম ব্যর্থ হবে না।’
আনন্দ মুহ্যমানের মতো তাকিয়ে ছিল। বলল, ‘যাবে না?’
‘কেন। যাবে? আমরা তো একদিন মরে যাব। আমরা যদি মানুষ না হতাম, যদি নিজেদের গণ্ডির মধ্যেই প্রত্যেকে নিজেদের জেল দিতাম তাহলে ভাবতাম, মরে যাব বলে আমাদের জীবন নিরর্থক। কিন্তু যে চেতনা থাকার জন্য আমরা পশুর মতো জীবনের কথা না ভেবে বাঁচি না, মরণের কথা না ভেবে মুরি না, সেই চেতনাই আমাদের বলে দেয় যে মানুষ মরে, মানবতার মৃত্যু নেই। মানুষের জীবন নিয়ে মানবতার অখণ্ড প্রবাহ চলে বলে জীবনও ব্যর্থ নয়। তেমনি —’
‘চুপ কর।’ হেরম্বকে তীব্র ধমক দিয়ে আনন্দ কেঁদে ফেলল।
ধমকের চেয়ে আনন্দের কান্না আরো তীব্র তিরস্কারের মতো হেরম্বকে আঘাত করল। আনন্দ তো। কবি নয়।
মেয়েরা কখনো কবি হয় না। পৌরুষ ও কবিত্ব একধর্ম। নিখিল মানবতার মধ্যে নিজেকে ছড়িয়ে দিয়ে স্তব্ধ হৃদয়ের একদা—রণিত ধ্বনির প্রতিধ্বনিকে সে কখনো খুঁজে বেড়াতে পারবে না। জগতে তার দ্বিতীয় প্রতিরূপ নেই, সে বৃহতের অংশ নয়; সম্পূর্ণ এবং ক্ষুদ্র। যে বংশপ্রবাহ মানবতার রূপ, সে তা বোঝে না। অতীত ভবিষ্যতের ভারে তাঁর জীবন পীড়িত নয়, সার্থকও নয়। সৃষ্টির অনন্ত সূত্রে সে গ্রন্থির মতো বিগত ও অনাগতকে নিজের জোরে যুক্ত করে রাখে না। পৃথিবী যেমন মানুষের জড় দেহকে দাঁড়াবার নির্ভর দেয়, মানুষের জীবনকে এরা তেমনি আশ্রয় যোগায়। পৃথিবী জুড়ে হেরম্বের আত্মীয় থাক, আনন্দের কেউ নেই। সে একা।
অনেকক্ষণ কারো মুখে কথা ছিল না। নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে প্রথম কথা বলার সাহস করে হত বলা যায় না। এমন সময় হঠাৎ মালতীর তীব্র আর্তনাদ শোনা গেল।
হেরম্ব চমকে বলল, ‘ওকি?’
‘মা বুঝি ডাকল।’
বারান্দায় গিয়ে হেরম্ব বুঝতে পারল, ব্যাপার যাই ঘটে থাক অনাথের ঘরে ঘটেছে। ঘরে ঢুকে সে দেখল, অনাথ অজ্ঞান হয়ে আসনে লুটিয়ে পড়ে আছে, মৃদু ও দ্রুত নিশ্বাস পড়ছে, অতিরিক্ত রক্তের চাপে মুখ অসুস্থ, রাঙা। মালতী পাগলের মতো সেই মুখে করে চলেছে চুম্বনবৃষ্টি!
‘ও মরে গেছে হেরম্ব, আমি ওকে মেরে ফেলেছি।’
হেরম্বের চিকিৎসা চলল আধঘণ্টা। তিনি কলসী জল খরচ হল, মালতীর আউন্সখানেক কারণও কাজে লাগল। তারপর অনাথ চোখ মেলে চাইল।
‘আঃ, কি কর মালতী!’ বলে আরো খানিকটা সচেতন হয়ে অনাথ বিস্মিত দৃষ্টিতে চারিদিকে তাকাতে লাগল।
হেরম্ব জিজ্ঞাসা করল, ‘কি হয়েছিল?’
মালতী কপাল চাপড়ে বলল, ‘আমার যেমন পোড়া কপাল। জন্মদিন বলে একটা প্ৰণাম করতে গিয়েছিলাম, কে জানে তাতেই ভড়কে গিয়ে ভিরমি খাবে?’
অনাথের স্বাভাবিক মৃদুকণ্ঠ আরো ঝিমিয়ে গেছে। সে বলল, ‘আসনে বসলে আমাকে ছুতে তোমায় কতবার বারণ করেছি, মালতী। কঠিন যোগাভ্যাস করছি, হঠাৎ অপবিত্ৰ স্পর্শ পেলে–’
মালতী ইতিমধ্যেই খানিকটা সামলেছে।
’কিসের অপবিত্র স্পর্শ? চান করে আসি নি। আমিঃ এমনি বিদঘুটে স্বভাব জানি বলেই না পুকুরে ড়ুব দিয়ে এলাম।’
‘পুকুরে ডুব দিয়ে এলেই মানুষ যদি পবিত্র হত—’
‘আমার পোড়া কপাল তাই মরণ নেই।’
অনাথ হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, ‘তুমি বুঝতে পার না, মালতী। পবিত্র-অপবিত্র স্পর্শের জন্য শুধু নয়, আসনে আমি যে রকম অবস্থায় থাকি আমাকে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক অবস্থায় আসতে হয়, কোনো কারণে হঠাৎ বাহ্যজ্ঞান ফিরলে বিপদ ঘটে। আমি আজ মরেও যেতে পারতাম।’
মালতী কোনো সময় হার স্বীকার করে না। বলল, ‘এমন আসনে তবে বসা কেন?’
অনাথ বলল, ‘সে তুমি বুঝবে না। কিন্তু আজ তোমার জন্মদিন নয়–কাল।’
‘আজ তো আগের দিন–আজ আমার জন্মদিনের পারণ।’
অনাথ আর তর্ক করল না। ঘরের কোণে টাঙানো দড়ি থেকে একখানা শুকনো কাপড় নিয়ে ঘর ছেড়ে চলে গেল। মালতী বসে রইল মুহ্যমান হয়ে। সেও আগাগোড়া ভিজেছে। তাকে কয়েকটা সদুপদেশ দেবার ইচ্ছা হেরম্ব জোর করে চেপে গেল। এত কাণ্ডের পরেও আনন্দ এ ঘরে আসে নি খেয়াল করে সে উসখুসি করতে লাগল।
‘দেখলে হেরম্ব?’
এ প্রশ্নের জবাব হয় না, মন্তব্য হয়। হেরম্ব সাহস পেল না।
‘এমন জানলে কে মিনাসেকে ঠাট্টা করতে যেত!’
‘এ আপনার ঠাট্টা নাকি মালতী—বৌদি?’
মালতী রেগে বলল, ‘কি তবে? সঙ্কেত্তন? আবোল তাবোল বোকো না বাপু, মাথায় আগুন জ্বলছে, মন্দ কিছু বলে বসব। কাল আমার জন্মদিন। জন্মদিনে শ্ৰীচরণে ঠাঁই পাই। বছরে ওর এই একটা দিন-রাক্রির আমার সঙ্গে সম্পর্ক, হেসে কথাও কয়, ভালোও বাসে।-গা ছুঁয়ে বলছি ভালবাসে, হেরম্ব!’ মালতী মুচকে মুচকে হাসে, ‘কেন, তা জান না বুঝি? শোন বলি। সেই গোড়াতে, মাথাটা যখন পর্যন্ত ওর খারাপ হয় নি, তখন পিতিজ্ঞে করিয়ে নিয়েছিলাম, আর যেদিন যা খুশি কর বাপু, কথাটি কাইব না, আমার জন্মদিনে সব হুকুম মেনে চলবে। পাগল হলে কি হবে হেরম্ব, পিতজ্ঞের কথাটি ভোলে নি। মুখ বুজে আজো মেনে চলে।’ মালতী বিজয়-গর্বে হাসে, ‘বিষ খেতে বললে তাও খায়, হেরম্ব।’
অনাথের এটুকু দুর্বলতা হেরম্ব কল্পনা করতে পারে।
‘এবার জন্মদিনে তাই বরং মাস্টারমশাইকে খেতে দেবেন, মালতী-বৌদি।’
শুনে মালতী আগুন হয়ে হেরম্বকে ঘর থেকে বার করে দেয়।
হেরম্ব আর কোথায় যাবে, প্রথম রাত্ৰিতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাড়ির পিছনে প্রাচীর ডিঙিয়ে অদূরবর্তী যে আমবাগান তার চোখে অরণ্যের মতো প্রতিভাত হয়েছিল, বানপ্ৰস্থাবলম্বীর মন নিয়ে হেরম্ব সেইখানে গেল। এখানে আছে ভোরের পাখির ডাক আর অসংখ্য কীটপতঙ্গের প্রণয়। পচা ডোবার জলে হয়তো অ্যামিবা আত্মপ্রণয়ে নিজেকে বিভক্ত করে ফেলেছে, তরু-বন্ধলের আড়ালে পিপীলিকার চলেছে শুড়ে শুড়ে প্রণয়ভাষণ, হেরম্বের পায়ের কাছ দিয়ে এক হয়ে এগিয়ে চলেছে। কর্ণজলৌক দম্পতি, গাছের ডালে ডালে একজোড়া অচেনা পাখির লীলাচাঞ্চল্য।
অনেকক্ষণ পরে সে ঘরে ফিরে আসে। জানালা দিয়ে তাকিয়ে মন্দির-চত্বরে সমবেত ভক্তবৃন্দের মধ্যে সুপ্রিয়াকে আবিষ্কার করতে তার বেশিক্ষণ দেরি হয় না। তখন পূজা ও আরতি শেষ হয়েছে। মালতী বিতরণ করছে মাদুলি। তার কাছে বসে সুপ্রিয়া তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আনন্দের দিকে। হেরম্ব মিলিয়ে দেখল ক’দিনের বর্ষার পর আজ যে বাঁজালো রোদ উঠেছে, সুপ্রিয়ার চোখের আলোর সঙ্গে তার প্রভেদ নেই।
প্রতিজ্ঞা পালনের জন্য মালতীর জন্মদিনে অনাথ তার সমস্ত হুকুম মেনে চলে, প্রতিজ্ঞ পালনের জন্যেই এখানে এসে হেরম্ব সুপ্রিয়াকে একখানা পত্র লিখেছিল। সুপ্রিয়া যে তাকে দিয়ে চিঠি লেখার প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিল তা নয়, কথা ছিল ঠিকানা জানাবার। চিঠি না লিখে একজনকে ঠিকানা জানানো যায় না বলে হেরম্ব বাধ্য হয়ে একখানা চিঠিই লিখেছিল। ঠিকানা দিয়ে তার দুটি দরকারের কথা সুপ্রিয়া স্বীকার করেছিল! প্রথম, মাঝে মাঝে চিঠি লিখে হেরম্বকে সে তার কথা ভুলতে দেবে না। দ্বিতীয়, হেরম্ব কোথায় আছে জানা না থাকলে তার যে কেবলি মনে হয়। সে হারিয়ে গেছে, অসুখে ভুগছে, বিপদে পড়েছে–এই দুশ্চিন্তাগুলির হাত থেকে সে রেহাই পাবে।
খুশিমতো কাছে এসে হাজির হওয়ার একটা তৃতীয় প্রয়োজনও যে তার থাকতে পারে হেরম্ব আগে তা খেয়াল করে নি। একটা নিশ্বাস ফেলে সে মন্দির-চত্বরে ভক্তদের সভায় গিয়ে বসল।
‘কবে এলি, সুপ্রিয়া?’
সে যেন জানত সুপ্রিয়া পুরীতে আসবে। কবে এসেছে তাই শুধু সে জানে না।
‘এসেছি। পরশু। আপনি এখানে ক’দিন আছেন?’
‘আজি নিয়ে পনের দিন।’
‘দিন গোনার স্বভাব তো আপনার ছিল না?’—বলে সুপ্রিয়া আনন্দের দিকে কুটিল কটাক্ষপাত করল।
হেরম্ব হেসে বলল, ‘এমনি অনেকগুলি স্বভাব আমি অর্জন করেছি। সুপ্রিয়া, যা আমার ছিল না। আগেই তোকে বলে রাখলাম। পরে আর গোল করিসনে।’
মালতী রুক্ষস্বরে বলল, ‘বড় গোল হচ্ছে। এদের ঘরে নিয়ে গিয়ে বস না, আনন্দ? এটা আড্ডা দেবার বৈঠকখানা নয়।’
সুপ্রিয়া এ কথায় অপমানিত বোধ করে বলল, ‘আমি বরং আজ যাই।’
আনন্দ বলল, ‘না না, যাবেন কেন? ঘরে গিয়ে বসবেন চলুন।’
হেরম্ব আমন্ত্রণ জানিয়ে বলল, ‘আয় সুপ্রিয়া।’
অপমান ভুলে সুপ্রিয়া ঘরে গিয়ে বসতে রাজি হল। হেরম্ব জানত রাজি সে হবেই। এতক্ষণ মালতী ও আনন্দের সঙ্গে সুকীৌশলে আলাপ করে সে কতখানি জ্ঞান সঞ্চয় করেছে হেরম্ব তা জানে না, কিন্তু আনন্দকে দেখার পর এই জ্ঞানলাভের পিপাসা তার অবশ্যই এমন তীব্র হয়ে উঠেছে যে, আরো ভালো করে সব জািনবার ও বুঝবার কোনো সুযোগই সহজে আজ সে ত্যাগ করবে না। তার ভালো করে জানা ও বোঝাটাই ঠিক কি ধরনের হবে হেরম্ব তাও অনুমান করতে পারছিল। অনুমান করে তার ভয় হচ্ছিল। ভয়ের কথাই। চোখের সামনে ভবিষ্যতকে ভেঙে গুড়ো হয়ে যেতে দেখে ভয়ঙ্কর না হয়ে ওঠার মতো নিরীহ সুপ্রিয়া এখন আর নেই। মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে। গল্প শুনে যে বড় হয়েছিল, বড় হয়ে ছোট ছোট কাজ করে, ছোট ছোট সেবা দিয়ে আর সর্বদা কথা শুনে চলে যে ভালবাসা জানিবার চেষ্টা করেছিল, আজ হেরম্বের সাধ্য নেই তাকে সামলে চলে। অথচ, আজকের এই সঙ্গিন প্রভাতটিতে সে আর আনন্দ দুজনকেই সামলে চলার দায়িত্ব পড়েছে তার উপরে। জীবন-সমুদ্রে তাকে লক্ষ্য করে দুটি বেগবতী অর্ণবপাত ছুটে আসছে, সে সরে দাঁড়ালে তাদের সংঘর্ষ অনিবাৰ্য, সরে না দাঁড়ালে তার যে অবস্থা হওয়া সম্ভব তাও একেবারেই লোভনীয় নয়। আজ পর্যন্ত হেরম্বের জীবনে অনেকবার অনেকগুলি সকাল ও সন্ধ্যায় কাব্যের অন্তৰ্ধান ঘটেছে। আজ সকালে কাব্যলক্ষ্মী শুধু যে পালিয়ে গেলেন তা নয়, তার সিংহাসন যে হৃদয় সেখানে প্রচুর অনর্থ ও রক্তপাতের সম্ভাবনাও ঘনিয়ে এল। অনাথের একটি কথা তার বারংবার মনে পড়তে লাগল : মানুষ যে এক পৃথিবীতে বাঁচতে আসে নি সব সময় তা যদি মানুষের খেয়াল থাকত!
তাদের দুজনকে হেরম্বের ঘরে পৌঁছে দিয়ে আনন্দ চলে গেল। সুপ্রিয়া স্নান হেসে বলল, ‘মেয়েটার বুদ্ধি আছে তো!
হেরম্ব অন্যমনস্ক ছিল। বলল, ‘কার বুদ্ধি আছে? ক্ষেপেছিস। আমাদের ও বুদ্ধি করে একা রেখে যায় নি। কাজ করতে গিয়েছে। কাজ না থাকলে এখান থেকে ও নড়ত না, বসে বসে তোর সঙ্গে গল্প করত।’
‘সত্যি? তাহলে মেয়েটা খুব সরল। আমি বুঝতে পারিনি।’
‘বুঝতে পারিস নি? তুই কি ওর সঙ্গে পাঁচ মিনিটও কথা বলিস নি, সুপ্রিয়া?’
সুপ্রিয়ার মুখ লাল হয়ে গেল। সে নিচু গলায় বলল, ‘তা বলেছি। আমারই বুদ্ধির দোষ। বুদ্ধি ঠিক থাকলে ওই মেয়েটা যে খুব সরল এটা বুঝতে পাঁচ মিনিট সময়ও লগত না।’
সুপ্রিয়ার অপলক দৃষ্টিপাতে হেরম্ব একটু লজ্জা বোধ করল। সরলতার হিসাবে সুপ্রিয়াও যে কারো চেয়ে ছোট নয় এও তো সে জানে। সুপ্রিয়ার অভিজ্ঞতা বেশি, মানুষের মনের জটিল প্রক্রিয়া অনুধাবন করার শক্তি বেশি, সে তাই সাবধানে কথা বলে, হিসাব করে কাজ করে। কিন্তু তার কথা ও কাজে সরলতার অভাব কোনোদিনই হেরন্থের কাছে ধরা পড়ে নি, মিথ্যার মানস-স্বৰ্গ ওর নেই। এও হয়তো সত্য যে, আনন্দের সহজাত সরলতার চেয়ে সুপ্রিয়ার মনোভিজাত্যের সরলতা বেশি। মূল্যবান। একটা ছেলেমানুষ, আর একটা সুশিক্ষা।
হেরম্ব সুর বদলাল।
’ভালো করে বোস সুপ্রিয়া, তোর কষ্ট হচ্ছে।’
‘কষ্ট হওয়া মন্দ কি? তাতে মানুষের দরদ পওয়া যায়। চোখে না দেখলে কেউ তো বোঝে না কারো কষ্ট আছে কি নেই।’
‘কারো কি নিজের কষ্টের কিছু অভাব আছে সুপ্রিয়া, যে পরের মধ্যে কষ্ট খুঁজে বেড়াবে?’
‘সবাই তো সকলের পর নয়।‘
হেরম্ব হেসে বলল, ‘নয়? তুই ছাই জনিস। মোহ-মুদগর, বৈরাগ্যশতক, মহানিৰ্বাণ—তন্ত্র সব লিখেছে—‘
সুপ্রিয়া অত্যন্ত মৃদুস্বরে বলল, ‘কাছে এসে বসুন না? দূরে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে লাভ কি?’
‘কোথায় বসব দেখিয়ে দে।’
‘তাহলে থাকুন দাঁড়িয়ে।’ সুপ্রিয়া জানালার সঙ্কীর্ণ স্থানটিতে অত্যন্ত অসুবিধার মধ্যে বসে ছিল; সেখানে তার কাছে বসা অসম্ভব। হেরম্ব বিছানায় বসে তাকে ডাকল, ‘আয় সুপ্রিয়া এখানে বোস। এখুনি এলি, এসেই ঝগড়া জুড়ে দিলি কেন?’
উঠে এসে বিছানায় বসে সুপ্রিয়া বলল, ‘আপনিই-বা শুধু হাল্কা কথা বলছেন কেন? পুরীতে কেন এলাম জিজ্ঞাসা করবেন। কখন?’
‘একেবারেই যদি জিজ্ঞাসা না করি?’
‘তাহলে একটু মুশকিলে পড়ব।’ সুপ্রিয়া এবার হাসল, ‘আপনি এ ঘরে থাকেন না?’
‘হ্যাঁ, একা। আমি এ ঘরে একা থাকি সুপ্রিয়া।’
‘তা জানি না নাকি!’
’জনিস বৈকি। তবু বললাম। রাগিস নে। তোকে তো গোড়াতেই বলেছি, আমার ছিল না। এমন অনেক স্বভাব ইতিমধ্যে আমি অর্জন করে ফেলেছি। বাহুল্য কথা বলা তার মধ্যে একটা। ’
কথা, কথা, কথা! শুধু কথা পাকানো, কথা মোচড়ানো, কথা নিয়ে লড়াই করা। সুপ্রিয়া মাথা নিত করল। এত কথা কি জন্য? পরিচয়ের জন্য নয়, উদ্দেশ্য নির্ণয়ের জন্য নয়, সময় কাটানোর জন্যও নয়। পরিচয় তাদের যা আছে আর তা বাড়বে না, পরস্পরের উদ্দেশ্য সম্বন্ধেও ভুল হবার তাদের কোনো কারণ নেই, কথা না বললেও তাদের সময় কাটবে। তবু প্ৰাণপণে তারা কথা বলছে। চিরকাল এমনিভাবে মানুষ কত কথা বলতে পারে? আজো অনিশ্চয়তা বজায় থাকার অভিমানে সুপ্রিয়া কথা বন্ধ রাখল। হেরম্ব চুপ করল বক্তব্যের অভাবে। এ কথা মিথ্যা নয় যে, কথা নিয়ে লড়াই করাটাই চরম উদ্দেশ্য দাঁড়িয়ে গেছে বলে সুপ্রিয়াকে বলার তার কিছুই নেই।
‘তোমার কাছে টাকা আছে? দশটা টাকা দিতে পারবো?’
‘টাকা কি হবে আনন্দ?’
‘বাবা চাইল।’
হেরম্ব অবাক হয়ে গেল। ’মাস্টারমশাই টাকা চাইলেন? টাকা দিয়ে তিনি কি করবেন?’
আনন্দ এ প্রশ্নের জবাব দিতে পারল না। সে জানে না। টাকা নিয়ে সে চলে গেলে হেরম্ব চেয়ে দেখল। সুপ্রিয়া খুব সরলভাবে অত্যন্ত কুটিল হাসি হাসছে। আনন্দের সঙ্গে হেরম্বের আর্থিক সম্পর্কটি আবিষ্কার করামাত্র তার যেন আর কিছু বুঝতে বাকি নেই। এতক্ষণে সে নির্ভয় ও নিশ্চিন্ত হল। প্রতিবাদ করতে গিয়ে হেরম্ব চুপ করে গেল। প্রতিবাদ শুধু নিম্ফল নয়, অশোভন।
সুপ্রিয়া উঠে দাঁড়াল। হাসিমুখে বলল, ‘বাড়ি পৌঁছে দেবেন না?’
‘এখুনি যাবি?’
‘আর বসে কি হবে? চলুন পৌঁছে দেবেন।’
‘তুই কি একা এসেছিস নাকি, সুপ্রিয়া? একা এসে থাকলে এক যাওয়াই তো ভালো।’
‘এক কেন আসব? চাকরকে সঙ্গে এনেছিলাম, আপনি আছেন শুনে তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি। চলুন, যাই।’
ছিলনা নয়, হেরম্ব সত্য সত্যই আলস্য বোধ করে বলল, ‘আর একটু বোস না সুপ্রিয়া?’
সুপ্রিয়া মাথা নেড়ে বলল, ‘না, আর একদণ্ড বসব না। কি করে বসতে বলছেন?’
হেরম্ব আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘তুই আসতে পারিস, আমি তোকে বসতে বলতে পারি না? আমার ভদ্রতা-জ্ঞান নেই?’
সুপ্রিয়া গম্ভীর হয়ে বলল, ‘ভদ্রতা-জ্ঞানটা কোনো কাজের জ্ঞান নয়। আমি এখানে কেন এসেছি। জানা দূরে থাক, পুরীতে কেন এসেছি ও জ্ঞান দিয়ে আপনি তাও অনুমান করতে পারবেন। না। না। যদি যান তো বলুন মুখ ফুটে, এখানে আমার গা কেমন করছে, আমি ছুটে পালিয়ে যাই। পুরী শহরে আপনি আমাকে আজ-কালের মধ্যে খুঁজে বার করতে পারবেন। সে ভরসা আছে।’
হেরম্ব আর কথা না বলে জামা গায়ে দিল। বারান্দা পার হয়ে তারা বাড়ির বাইরে যাবার সরু প্যাসেজটিতে ঢুকবে, ও ঘর থেকে বেরিয়ে এসে আনন্দ একরকম তাদের পথরোধ করে দাঁড়াল।
‘কোথায় যাচ্ছ?’
হেরম্ব বলল, ‘একে বাড়ি পৌঁছে দিতে যাচ্ছি।’
‘খেয়ে যাও।’
সুপ্রিয়া এর জবাব দিল। বলল, ‘আমার ওখানে খাবে।’
আনন্দ বলল, ‘পেটে খিদে নিয়ে অদূর যাবে? সকালে উঠে খেতে না পেলে ওর মাথা ঘোরে তা জানেন?
সুপ্রিয়া বলল, ‘মাথা না হয় একদিন ঘুরুলই।’
হেরম্ব অভিভূত হয়ে লক্ষ করল, পরস্পরের চোখের দিকে চেয়ে তারা আর চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে না। সুপ্রিয়ার চোখে গভীর বিদ্বেষ, তাই দেখে আনন্দ অবাক হয়ে গেছে। দুজনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে হেরম্ব সসঙ্কোচে বলল, ‘আমার খিদে পায় নি আনন্দ, একটুও পায় নি।’
আনন্দ অভিমান করে বলল, ‘পায় নি? তা পাবে কেন? আমি কিছু বুঝি নে কিনা!’
হেরম্ব তখন নিরুপায় হয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘এবার কি কর্তব্য, সুপ্রিয়া?’
তাকে মধ্যস্থ মেনে হেরম্ব একরকম স্পষ্টই ইঙ্গিত করল যে, সে যখন বয়সে বড়, আনন্দের কাছে হার স্বীকার করে তারই উদারতা দেখানো উচিত। সুপ্রিয়া রাগ করে বলল, ‘আমি জানিনে।’
‘এখান থেকেই খেয়ে যাই, কি বলিস?’
‘তাও আমি জানিনে।’
হেরম্ব নিৰ্বাক হয়ে গেল। আনন্দ একটু হেসে বলল, ‘আচ্ছা, আপনি যে এত জোর খাটাচ্ছেন, আপনার কি জোর আছে বলুন তো? ও আমাদের অতিথি, আপনার তো নয়।’
‘আমি ওর বন্ধু।’
আনন্দ আরো ব্যাপকভাবে হেসে বলল, ‘আমিও তো তাই!’
হেরম্ব কখনো কোনো কারণে সুপ্রিয়ার মুখে হিংস্র ব্যঙ্গ শোনে নি, আজ শুনল, হঠাৎ মুচকে হেসে সুপ্রিয়া বলল, ‘তুমি?’-বলে, এই একটিমাত্র শব্দে আনন্দকে একেবারে উড়িয়ে দিয়ে ক্ষণিকের বিরাম নিয়ে সে যোগ দিল, ‘ওর সঙ্গে, আমার যেদিন থেকে বন্ধুত্ব, তোমার তখন জন্মও হয় নি।’
আনন্দ আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘যান! আমার জন্মের সময় আপনার আর কত বয়স ছিল?–কত আর বড় হবেন আপনি আমার চেয়ে? আপনার বয়স উনিশ-কুড়ির বেশি। কখনো নয়।’
সুপ্রিয়া বুঝতে পারল না, হেরম্বই শুধু টের পেল আনন্দের এ প্রশ্ন কৃত্রিম নয়, সে পরিহাস করে নি। সুপ্রিয়ার মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। সে যেন হঠাৎ ধমক দিয়ে বলল, ‘তুমি ছেলেমানুষ, তাই তোমাকে কিছু বললাম না। বয়সে যারা বড় আর কখনো তাদের সঙ্গে এ রকম ঠাট্টা কোরো না।’
সুপ্রিয়ার ধমকে মুখ ম্লান করে আনন্দ যা বলেছিল তার কোনো মানে নেই। —শুধু একটি ‘আচ্ছা’। হেরম্ব ভালো করেই জানে সুপ্রিয়ার কাছে সে যে অপমান পেয়েছে তার জন্য আনন্দ তাকেই দায়ী করবে। দায়ী করে সে হয়ে থাকবে বিষণ্ণ। আনন্দের বর্তমান মানসিক অবস্থায় সহজে এর প্রতিকারও করা যাবে না।
গাড়িতে সুপ্রিয়ার সামনের আসনে বসে আনন্দের কথা ভাবা চলছিল। সে উঠে পাশে এসে বসায় হেরাম্বের আর সে ক্ষমতা রইল না।
‘পাশে বসাই নিয়ম, না?’
হেরম্ব একটু ভেবে বলল, ‘অন্তত অনিয়ম নয়।’
সুপ্রিয়া হেসে বলল, ‘আসল কথা, কথা বলব। কে একটা লোক পিছনে উঠে বসেছে, শুনতে পাবে বলে সামনে এগিয়ে এলাম।’
‘তোর প্রগতির অর্থ খুব গভীর, সুপ্রিয়া।’
সুপ্রিয়া একটু অসন্তুষ্ট হয়ে বলল, ‘আপনার এই কথা বলার ঢং মন্ত্রদাতা গুরুর মতো, চিরকাল এই সুর শুনে আসছি। হাক্কা কথা বলেন, তাও উপদেশের মতো ভারি। আওয়াজ।’
‘একটা কথা ভাবতে ভাবতে অন্য কথার জবাব অমনি করেই দিতে হয়।’
‘ও, আচ্ছ, ভাবুন; আমি চুপ করলাম।’
বাড়ির দরজায় গাড়ি থামা পর্যন্ত সুপ্রিয়া সত্যই চুপ করে রইল। যেখানে তারা বাড়ি নিয়েছে সেখান থেকে সমুদ্রের আওয়াজ শোনা যায় বটে, বাড়ির ছাদে না উঠলে সমুদ্র দেখা যায় না। এবারো সুপ্রিয়া হেরম্বকে বাড়ির বাজে অংশ পার করিয়ে একেবারে তার শোবার ঘরে নিয়ে হাজির করল। হেরম্ব লক্ষ করল ঘরখানা দোকানের মতো সাজানো নয়, শয়নঘরের মতোও নয়। বিদেশ বলে বোধহয় ঘরে আসবাব বেশি নেই, অস্থায়ী বলে সুপ্রিয়ার নেই ঘর সাজাবার উৎসাহী। উৎসাহের অভাব ছাড়া অন্য কারণও হয়তো আছে। এটা যদি সুপ্রিয়ারই শয়নকক্ষ হয় তবে সে এখানে একাই থাকে। ছোট চৌকিতে যে বিছানা পাতা আছে সেটা একজনের পক্ষেও ছোট। অশোক যদিও এখন বিছানায় চিৎ হয়ে পড়ে আছে, এ অধিকার হয়তো তার সাময়িক, হয়তো এ তার নিছক গায়ের জোর। এই সব পলকনিহিত অনুমানের মধ্যেও হেরম্ব কিন্তু টের পাচ্ছিল অশোকের গায়ের জোর বড় আর নেই। সে দুৰ্ভিক্ষপীড়িতের মতো শীর্ণ হয়ে গেছে।
অশোক উঠল না। বলল, ‘হেরম্ববাবু যে!’
হেরম্ব বলল, ‘আমিই। তোমাকে চেনা যাচ্ছে না, অশোক।’
‘যাবেও না। মরে ভৌতিক অবস্থাপ্রাপ্ত হয়েছি যে! এ যা দেখছেন, এ হল সূক্ষ্ম শরীর।’
‘সূক্ষ্ম সন্দেহ নেই।’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনার পত্রে জানা গেল এখানকার জল-হাওয়া ভালো। উনি মনে করলেন, আমার অবস্থা বুঝে পুরীতে আমাদের নেমন্তান্নাই বুঝি করছেন ওই কথা লিখে। তাই জোর করে টেনে এনেছেন। ছুটির জন্য বেশি লেখালেখি করতে গিয়ে চাকরিটি প্রায় গিয়েছিল, মশায়।’
আনন্দের সঙ্গে কথা বলবার সময় সুপ্রিয়ার কণ্ঠস্বরে যে ব্যঙ্গ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল, অশোকের কথায় যেন তারই ভদ্র, গোপন করা ধ্বনি শোনা যায়। হেরম্ব একটু সাবধান হল।
‘তোমার আঙুল কি হল, অশোক?’
অশোকের ডান হাতের মাঝের আঙুল দুটি কাটা। ঘা শুকিয়ে এসেছে কিন্তু আরক্তভাব এখনো যায় নি, শুকনো ঘায়ের মামড়ি তুলে ফেললে যেমন দেখায়। এ বিষয়ে অশোকের নিজের কৌতূহল বোধহয় এখনো যায় নি, হাতটা চোখের সামনে ধরে সে কাটা আঙুলের গোড়া দুটি পরীক্ষা করে নিল। বলল, ‘একজন ছোরা মেরে উড়িয়ে দিয়েছে।’
‘ছোরা, অশোক?’
‘উঁহু, দেশী দা—ভয়ানক ধার। আটকাতে গিয়ে আঙুল দুটো উড়ে গেছে। উড়ে যাওয়া উচিত ছিল মাথাটার, কেন যে গেল না, মাথাটা আজো গরম হয়ে ওঠে।’
সুপ্রিয়া বলল, ‘মাথা গরম করে আর কোজ নেই। দোষ তো তোমার। থানোভরা সেপাই জমাদার, তবু নিজে ডাকাতের সামনে গলা এগিয়ে দেবে, বিবেচনা তো নেই।’
অশোক নির্মমভাবে হাসল। বলল, ‘বিবেচনা করেই গলা বাড়িয়েছিলাম, কর্তব্যের খাতিরে। তুমি যা ভেবেছিলে তা একেবারেই সত্য নয়।’
‘আমি কিছুই ভাবি নি।’
‘ভাব নি? তবে যে ডাকাত ধরতে গেলেই বলতে জেনেশুনে প্ৰাণটা দিতে যাচ্ছি নিজের, খুন হতে যাচ্ছি সাধ করে? আমনি করে অমঙ্গল ডেকে আনতে বলেই তো আঙুল দুটো আমার গেল।’
সুপ্রিয়া বিবৰ্ণ মুখে বলল, ‘কি সব বলছি তুমি? চুপ কর।’
হেরম্ব এতক্ষণ ভেতরে ভেতরে রেগে আগুন হয়ে উঠেছে। মানুষকে ব্যঙ্গ করার যে ধারালো ক্ষমতা সে প্রায় পরিত্যাগ করেছিল, এবার তাই সে কাজে লাগল।
‘আহা বলুক না, সুপ্রিয়া, বলুক। অতিথিকে অশোক এন্টারটেন করছে বুঝতে পারিস না? গৃহস্বামীর এই তো প্রথম কর্তব্য। ওর কথা শুন না, অশোক, তোমার যা বলতে ইচ্ছা হয় এমনি রস দিয়ে বল। তোমার কর্তব্য তুমি করবে বৈকি!’
অশোকের স্তিমিত চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। হেরম্ব স্পষ্ট দেখল। অসুস্থ স্বামীর লাঞ্ছনায় সুপ্রিয়ার মুখও ব্যথায় স্নান হয়ে গেছে। কিন্তু হেরন্ধের মধ্যে যে নিষ্ঠুরতা মরে যাচ্ছিল আজ তা মরণ-কামড় দিতে চায়। গলা নামিয়ে সে যোগ দিল, ‘তুমি গৃহস্বামী যে!’
অশোক দেয়ালের দিকে মুখ করে বলল, ‘না না।’
হেরম্ব শান্তভাবে জিজ্ঞাসা করল, ‘কি না, অশোক?’
‘গৃহস্বামী অসুস্থ। তার কর্তব্য নেই।’ হেরম্ব বলল, ‘তাহলে তোমায় বিরক্ত করা উচিত হবে না। আমরা অন্য ঘরে যাই।’
হেরম্ব ঘর থেকে বেরিয়ে এল। সুপ্রিয়া তাকে অন্য একটি ঘরে যে ঘরের মেঝেতে শুধু মাদুর পাতা ছিল, নিয়ে গিয়ে বলল, ‘বসুন। ওকে একটু শান্ত করে আসি।’
‘পারবি না, সুপ্রিয়া, ও একটা আস্ত বাঁদর।’
‘গালাগালি কেন?’ বলে সুপ্রিয়া চলে গেল।
শুধু একটি মাদুর বিছানো, একটা বালিশ পর্যন্ত নেই। মাদুর দেয়ালের কাছে সরিয়ে নিয়ে দেয়ালে ঠেস দিয়ে হেরম্ব আরাম করে বসল। হেরম্বের প্রাণশক্তি অপরিমেয়া, ঘটনার ঘাতপ্রতিঘাত চেতনার বাদ-বিসংবাদ সহ্য করার ক্ষমতা তার অনমনীয়, কিন্তু আজ সে অপরিসীম শ্ৰান্তি বোধ করল। দুঃখ, বিষাদ বা আত্মগ্লানি নয়, শুধু শ্ৰান্তি। সুপ্রিয়ার প্রত্যাবর্তনের আগে এই বাড়ি ছেড়ে, আনন্দের সঙ্গে দেখা হবার আগে পুরী থেকে পালিয়ে চিরদিনের জন্য নিরুদ্দেশ যাত্রা করতে পেলে সে যেন এখন বেঁচে যায়। হেরম্বের ঘুম আসে–এক সদয় দেবতার আশীর্বাদের মতো। সে চোখ বোজে। একটা ব্যাপার সে বুঝতে পেরেছে। আনন্দের বিষণু, বিরস প্রহরগুলির জন্ম-ইতিহাস। আর এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, যে কারণে না মরে তার পুনর্জন্ম সম্ভব নয়, সেই কারণেই তার ক্ষয় পাওয়া হৃদয়ের পুনরুজ্জীবন অসম্ভব হয়ে গেছে। তার জীবনে প্রেম এসেছে অসময়ে। প্রেমের সে অনুপযুক্ত। বসন্ত-সমাগমে অর্ধমৃত তরুর কতকগুলি পল্লব কুসুমন্তীর্ণ হয়ে গেছে বটে, কিন্তু কত শুষ্ক শাখায় জীবন নেই, কত শাখার বন্ধুল পিপীলিকা—বাস জীর্ণ। তার অকাল বার্ধক্যের সঙ্গে আনন্দের অহরহ। পরিচয় ঘটে, আনন্দের কত খেলা তার প্রিয় নয়, আনন্দের কত উল্লাস তার কাছে অর্থহীন। আনন্দ তা টের পায়। কত দিক দিয়ে আনন্দ তার সাড়া পায় না, যদি-বা পায় তা কৃত্রিম, মন-রাখা সাড়া। আনন্দ বিমৰ্ষ হয়ে যায়। মনে করে, হেরম্বের প্রেম বুঝি মরে যাচ্ছে। হেরম্বের প্রেমই যে দুর্বল এখনো সে তা টের পায় নি।
সুতরাং আনন্দকে সে ঠকিয়েছে। জীৰ্ণবিশিষ্ট যৌবনের সবখানিই প্রায় তাকে ব্যয় করতে হয়েছে আনন্দকে জয় করতে, এখন তাকে দেবার তার কিছু নেই। এ কথা তার জানা ছিল না যে, পরিপূর্ণ প্রেমের অনন্ত দাবি মেটাবার ক্ষমতা আছে একমাত্র অবিলম্বিত অনপচয়িত, সুস্থ ও শুদ্ধ যৌবনের। অভিজ্ঞতার প্রেমের খোরাক নেই, মনস্তত্ত্বে বুৎপত্তি প্রেমকে টিকিয়ে রাখার শক্তি নয়। নারীকে নিয়ে একদিনের জন্যও যে খেয়ালের খেলা খেলেছে, তুচ্ছ সাময়িক খেলা, প্রেমের উপর্যুক্ততা তার ক্ষুন্ন হয়ে গেছে। মানুষের জীবনে তাই প্রেম আসে একবার, আর আসে না, কারণ একটি প্রেমই মানুষের যৌবনকে ব্যবহার করে জীৰ্ণ করে দিয়ে যায়। হৃদয় বলে মানুষের কাব্যে উল্লিখিত একটি যে শতদল আছে, তার বিকাশ স্বাভাবিক নিয়মে একবারই হয়, তারপর শুরু হয় ঝরে যাবার আয়োজন। সাধারণ হৃদয়, প্রতিভাবানের হৃদয়, সমস্ত হৃদয় এই অখণ্ডনীয় নিয়মের অধীন, কারো বেলা এর অন্যথা নেই।
সুপ্রিয়ার ফিরতে দেরি হল। সে একেবারে হেরন্ধের খাবার নিয়ে আসায় বোঝা গেল যে, অশোককে শান্ত করতেই তার এতক্ষণ সময় লাগে নি।
খাবার খেয়ে ঠাণ্ডা হয়ে হেরম্ব বলল, ‘তোর উপরে রাগ হচ্ছিল, সুপ্রিয়া।’
সুপ্রিয়া খুশি হয়ে বলল, ‘সত্যি? কখন?’
‘এই মাত্র। খিদেয় অন্ধকার দেখছিলাম।’
‘খিদেয়? আমাকে না দেখে নয়?’
হেরম্ব হাই তুলে বলল, ‘একটা বালিশ এনে দে তো, ঘুমোব।’
সুপ্রিয়া একটি অত্যন্ত কুটিল প্রশ্ন করল।
’কেন? রাত জাগেন বুঝি, ঘুমোবার সময় পান না?’
হেরম্বও সমান কুটিলতার সঙ্গে জবাব দিল, ‘সময় পাই বৈকি। রাত দশটা বাজতে না বাজতে ওখানকার সবাই, আনন্দসুদ্ধ, ঢুলতে ঢুলতে যে যার ঘরে গিয়ে দরজা দেয়। তারপর সারারাত নিষ্কর্মা ঘুম দিলে আমায় ঠেকায় কে!’
সুপ্রিয়া লজ্জা পেল।—‘বানিয়ে বানিয়ে এত কথা। আপনি বলতে পারেন! কিন্তু আপনার শরীর যে রেটে খারাপ হয়েছে তাতে মনে হয় না ঠিকমতো আহার-নিদ্রা হয়।’
‘রেটটা তোরও কম নয়, সুপ্রিয়া।’
‘আমার অসুখ, ফিটের ব্যারাম। আমার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আপনার শরীর খারাপ হবে কেন?’
‘আমারও হয়তো অসুখ, সুপ্রিয়া।’
সুপ্রিয়া হেসে বলল, ‘তর্কে হারাবার উপক্রমেই অসুখ হয়ে গেল? বসুন, বালিশ এনে দিচ্ছি–ওয়াড় পরিয়ে আনতে হবে। এমন আলসে হয়েছি আজকাল, ময়লা বালিশে শুয়ে থাকি তবুওয়াড় বদলাই না। এবার আমি মরব নাকি?’
বালিশ নিয়ে সুপ্রিয়া ফেরার আগে এল অশোক।
’দুপুরে এখানেই খাবেন দাদা।’
তার আমন্ত্রণেই এই অমায়িক সুরে হেরম্ব বুঝতে পারল সুপ্রিয়া সত্য সত্যই অশোককে শান্ত করতে পেরেছে। সুপ্রিয়ার এ ক্ষমতা তার অভিনব মনে হল না। অশোকের প্রতি সুপ্রিয়ার যে গভীর ও আন্তরিক মমতা আছে, অশোকের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতি যে নিবিড় মনোযোগ ও অক্লান্ত সেবায় তার এই মমতা প্ৰকাশ পায়, অশোকের অতিরিক্ত দুঃখ ও অপমান মুছে নেবার পক্ষে তাই যথেষ্ট। সুপ্রিয়ার প্রকৃতি শান্ত, সে বিশ্বাস করে মানুষ মাথাপগলা নয়, বাস্তব জগতে ভাব নিয়ে মানুষের দিন কাটে না। যার জীবনে যা কিছু প্রয়োজন তার সে সমস্তই পাওয়া চাই। জীবন নষ্ট করবার জন্য নয়, নিজের জন্য চাইতে এবং নিতে, যতটা পারা যায় পরকে পাইয়ে দিতে, কারো লজ্জা নেই। নিজের জীবন গুছিয়ে নেওয়া চাই, পরের জীবন সাজিয়ে দেওয়া চাই। হেরম্বের জন্য অশান্তি, উদ্বেগ, সন্দেহ, ঈৰ্ষা প্রভৃতি যতগুলি পীড়াদায়ক অনুভূতি আছে তার প্রায় সবগুলি অনুভব করে দিন কাটানোর ফলে ফিটের ব্যারাম জন্মে যাওয়া সত্ত্বেও উপরোক্ত মনোভাবের দরুন সুপ্রিয়ার কথায় ব্যবহারে সর্বদা এমন একটি কোমল ভাব ও সহানুভূতির সঙ্গে চারিদিক হিসাব করে চলবার আন্তরিক চেষ্টা প্রকাশ পায় যে, তার সম্বন্ধেও মানুষকে সে বিবেচনা করে চলতে শেখায়। সে যাকে ব্যথা দেয়, নিদারুণ ক্রোধের সময়ও তাকে স্মরণ রাখতে হয় যে উপায় থাকলে ব্যথা সে দিত না। সুপ্রিয়ার বিরুদ্ধে মনে নালিশ পুষে রাখা কঠিন।
হেরম্ব অশোকের নিমন্ত্রণ গ্রহণ করল। বলল, ‘বেশ তো।’
‘আর বিকেলে যদি পারেন। ওকে একবার মন্দির স্বৰ্গদ্বার-টার যা দেখবার আছে দেখিয়ে আনবেন। আমার নিজের তো ক্ষমতা নেই নিয়ে যাব।’
‘আচ্ছা।’
অশোক চুপিচুপি বলল, ‘আমার কি ভীষণ সেবাটাই যে ও করছে, দাদা, বললে আপনার বিশ্বাস হবে না। নাওয়া নেই, খাওয়া নেই, ঘুম নেই, নিজের চোখে যে না দেখেছে–এখনো যথেষ্ট করছে। ও মনে করে আমি বুঝি কিছুই চেয়ে দেখি না, আমার কৃতজ্ঞতা নেই! কিন্তু আপনাকে বলে রাখছি, ওর সেবা। আমি কখনো ভুলব না।’
হেরম্ব বলল, ‘তুমি ভুল করছ, অশোক, ও কৃতজ্ঞতা চায় না।’
‘জানি, জানি। ওর মন কত উঁচু আমি জানি না!’
সুপ্রিয়া বালিশ নিয়ে ফিরে আসায় এ প্রসঙ্গ থেমে গেল। অশোককে এ ঘরে দেখে সুপ্রিয়া সন্দিগ্ধভাবে দুজনের মুখের দিকে চেয়ে দেখতে লাগল। বালিশটা মাদুরে ফেলে দিয়ে বলল, ‘হেরম্ববাবু এখন ঘুমোবেন। চল আমরা যাই!’
অশোক উঠল।– ‘আমি ওঁকে এ বেলা খাবার নেমন্তশ্ন করেছি, সুপ্রিয়া।’
‘বেশ করেছি। নিজে রাধাগে, আমি পারব না।’
বলে সুপ্রিয়া হাসল। সুপ্রিয়াকে এত ঠাণ্ডা হেরম্ব আর কখনো দেখে নি।
বজ্ৰপাতের শব্দে ঘুম ভেঙে হেরম্ব দেখতে পায় তার ঘুমের অবসরে আকাশে মেঘের সঞ্চার হয়ে বাইরে দারুণ দুৰ্যোগ ঘনিয়ে এসেছে। বাতাস বইছে শী শী শব্দে, উত্তাল সমুদ্রের গর্জন বেড়ে গেছে। উঠে ঘরের বাইরে যেতে গিয়ে হেরম্ব অবাক হয়ে যায়। দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। ডাকাডাকি শুনে সুপ্রিয়া এসে দরজা খুলে দেয়। ভারি তালা খোলার শব্দ হেরম্ব শুনতে পায়।
দরজা খুললে তালাটিকে সে খুঁজে পায় না। সন্দিগ্ধ হয়ে বলে, ‘দেখি তোর হাত? ওটা নয়, আঁচলের নিচে যেটা লুকিয়েছিস।’
‘কেন?’
‘দেখা কি লুকিয়েছিস, তালা বুঝি, দরজায় তালা দেওয়ার মানে?’
সুপ্রিয়া হেসে বলে, ‘মানে আর কি, পালিয়ে না যেতে পারেন। তাই। যে পালাই—পালাই স্বভাব!’
হেরম্ব বলে, ‘আমার ঘুমের মধ্যে অশোক বুঝি ছোরা হাতে এদিকে আসছিল?’
সুপ্রিয়া গলা নামিয়ে বলে, ‘আস্তে কথা কইতে পারেন না?—তা আসে নি। আসতে পারত!’
হেরম্ব হেসে বলে, ‘ও, তোর শুধু সন্দেহ! তুই সত্যি দারগার বৌ, সুপ্রিয়া। সে গেছে কোথায়?’
‘ছাতে।’
‘এই ঝড়বৃষ্টির মধ্যে ছাতে?’
‘সমুদ্র দেখতে গেছে। বললে, ঝড় উঠলে সমুদ্র কেমন দেখায় দেখবার এ সুযোগ ছাড়া উচিত নয়। আমাকেও জোর করে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। একটু ধস্তাধস্তি করে পালিয়ে এসেছি।’
‘ধ্বস্তাধস্তি কেন?’
‘কারণ ছিল বৈকি। আমায় ধাক্কা দিয়ে ছাদ থেকে ফেলে দেবার চেষ্টা করেছিল। যত সব বিদঘুটে খেয়াল!’
হেরম্ব ফিরে গিয়ে মাদুরে বসল। ঘরের জানালা দুটি বায়ুর গতির দিকে খোলে, বন্ধ করার দরকার হয় নি। বাইরে এমন দুৰ্যোগ নামলে আনন্দ তাঁর ঘরে সমুদ্রের ঝিনুক নিয়ে খেলা করে, তার যখন খুশি তাকায়, যখন খুশি কথা বলে। তাদের নিজেদের প্রেমের সমস্যা ছাড়া সে ঘরে দুর্ভাবনার প্রবেশ নিষেধ। কারো জীবনের প্রভাব সেখানে নেই, সুপ্রিয়ারও নয়–তাকে সে ভুলে যায়। কিন্তু সুপ্রিয়ার কাছে থাকলে একটি বেলার জন্যও তার রেহাই নেই। আবহাওয়া অবিলম্বে বৈদ্যুতিক হয়ে ওঠে। দুৰ্ঘটনা ঘটে, দুঃসংবাদ পাওয়া যায়। তাদের মাঝখানে আর একটি জীবনের নাটকীয় অভিনয় ঘটে চলে। বাড়ির ছাদের ভয়ঙ্কর ঘটনাটুকুর সংবাদ সুপ্রিয়া তাকে কেন দিয়েছে বুঝে হেরম্বের বড় কষ্ট হয়। সুপ্রিয়াও কি মালতী হয়ে উঠল?
‘কি হয়েছিল?’ হেরম্ব জিজ্ঞাসা করল।
’শুনে অবিচার করবেন না। আমাকে ছাদে ডেকে নিয়ে যাবার সময় ওর কোনো মতলব ছিল। না, শুধু ছেলেমানুষি খেয়াল। আমাকে ধারে দাঁড়াতে দেখে লোভ সামলাতে পারে নি। হঠাৎ ‘সুপ্রিয়া’ বলে চেঁচিয়ে ধাঁ করে আমায় জড়িয়ে ধরলে। আর একটু হলেই দুজনে একসঙ্গে—’
‘তোর কথা আমি বিশ্বাস করি না, সুপ্রিয়া!’
সুপ্রিয়া কোনোদিন কলহ করে নি, আজো করল না। তার চোখে শুধু জল এল। হেরম্ব একটু মুগ্ধ হয়ে বল, ‘তুই ইচ্ছে করে মিথ্যে বলেছিস, তা বলছি না, সুপ্রিয়া। তুই বুঝতে পারিস নি।‘
‘আমি কিছুই বুঝতে পারি না।’
হেরম্ব খানিকক্ষণ স্তব্ধ থেকে বলল, ‘ঝড়বাদলে খোলা ছাদে তোকে কাছে পেয়ে হঠাৎ মনের আবেগে–’
সুপ্রিয়া হাত বাড়িয়ে হেরম্বের পা ছুঁয়ে বলল, ‘বিশ্লেষণ করবেন না, আপনার পায়ে পড়ি। আবেগ!—আকাশ থেকে বৃষ্টির মতো আবেগ গড়িয়ে পড়ছে।’
হেরম্ব আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘তুই বুঝি আবেগে বিশ্বাস করিস না, সুপ্রিয়া?’
সুপ্রিয়া জবাব না দিয়ে চোখ মুছে ফেলল।
এরা কেউ বিশ্লেষণ ভালবাসে না, সুপ্রিয়াও নয়, আনন্দও নয়। তার একি অভিশাপ যে, এরা কেন বিশ্লেষণ ভালবাসে না বসে বসে তাও বিশ্লেষণ করতে ইচ্ছা হয়? একি জ্ঞানের জন্য? নারীকে জেনে সে কি জীবনের নাড়িজ্ঞান আয়ত্ত করতে চায়? তার লাভ কি হবে? বরং আজ পর্যন্ত তার যা ক্ষতি হয়েছে তার তুলনা নেই। জীবনের সমস্ত সহজ উপভোগ তার বিষাক্ত বিস্বাদ হয়ে যায়।
সুপ্রিয়া তার মুখের ভাব লক্ষ করছিল। একটু ভয়ে ভয়ে বলল, ‘ওকে নামিয়ে আনবেন না? ভিজে ভিজে মারবে নাকি!’
‘না, সেটা ঘটতে দেওয়া উচিত হবে না।’ বলে হেরম্ব উঠে দাঁড়াল।
অশোককে নামিয়ে এনে স্নানাহার করতে বৃষ্টি থেমে গেল। হেরম্ব বিদায় নিল। বলে গেল বিকালে যদি পারে একবার আসবে সুপ্রিয়াকে যে সব জায়গা দেখিয়ে আনবার কথা আছে দেখিয়ে আনবে।
‘যদি পারি কেন?’
‘না পারলে কি করে আসব, সুপ্রিয়া?’
‘চারটের মধ্যে যদি না আসেন তাহলে ধরে নেব। আপনি আর এলেন না।’
‘যদি আসি চারটের মধ্যেই আসব।’
বাগানে ঢুকতেই আনন্দের দেখা পাওয়া গেল। সে রুদ্ধশ্বাসে বলল, ‘এত দেরি করলে! মা এদিকে ক্ষেপে গেছে।’
আনন্দ সংবাদটা এমনভাবে দিল যে হেরম্ব বুঝে নিল মালতীর ক্ষেপবার কারণ সুপ্রিয়ার সঙ্গে গিয়ে তার ফিরতে দেরি করা। সে রুক্ষম্বরে বলল, ‘ক্ষেপলে আমি কি করব?’
আনন্দ বলল, ‘মন্দির থেকে বাড়িতে এসে মা যেই দেখলে বাবা নেই, বাবার কম্বল, বই খাতা এসবও নেই, ঠিক যেন পাগল হয়ে গেল।’
হেরম্ব আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘মাস্টারমশায় গেলেন কোথায়?’
‘বাবা, চলে গেছে।’
‘কোথায় চলে গেছেন?’
আনন্দের চোখ ছলছল করে এল।
’তা জানিনে তো। তোমার কাছ থেকে যখন টাকা নিয়ে দিলাম তখন কিছু বললেন না। তোমরা চলে যাবার পর বাবা আমাকে ডেকে চুপিচুপি বললেন, আমি যাচ্ছি। আনন্দ, তোর মাকে বলিস না, গোল করবে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কোথায় যােচ্ছ বাবা, কবে ফিরবে? বাবা জবাবে বললেন, সে সব কিছু ঠিক নেই। আমি বুঝতে পেরে কাঁদিতে লাগলাম।’
বলে আনন্দ চোখ মুছতে লাগল। হেরম্ব তাকে একটি সান্ত্বনার কথাও বলতে পারল না। বাতাসের নাড়া খেয়ে গাছের পাতা থেকে জল ঝরে পড়ছে, আনন্দ প্ৰায় ভিজে গিয়েছিল। তাকে সঙ্গে করে হেরম্ব ঘরে গেল। জানালা কেউ বন্ধ করে নি। বৃষ্টির জলে মেঝে ভেসে গিয়েছে। হেরম্বের বিছানাও ভিজোছে। বিছানাটা উল্টে নিয়ে হেরম্ব তোশকের নিচে পাতা শুকনো শতরঞ্জিতে বসল। বলার অপেক্ষা না রেখে আনন্দও তার গা ঘেঁষে বসে পড়ল। সে অল্প অল্প কাঁপছিল, জলে ভিজে কিনা বলবার উপায় নেই। হেরম্বের মনে হল, সান্ত্বনার জন্য যত নয়, নির্ভরতার জন্যই আনন্দ ব্যাকুল হয়েছে বেশি। এরকম মনে হওয়ার কোনো সঙ্গত কারণ ভেবে না পেয়ে হেরম্ব তাকে সত্ত্বনাও দিল না, নির্ভরতাও দিল না। সে বরাবর লক্ষ করেছে এরকম অবস্থায় ঠিকমতো না বুঝে কিছু করতে গেলে হিতে বিপরীত হয়।
আনন্দ বলল, ‘মা কি করেছে জােন? বাবাকে টাকা দিয়েছি বলে আমাকে মেরেছে।’ হেরম্বের দিকে পিছন ফিরে পিঠের কাপড় সে সরিয়ে দিল, ‘দ্যাখ কি রকম মেরেছে। এখনো ব্যথা কমে নি। ঘষা লেগে জ্বালা করে বলে জামা গায়ে দিতে পারি নি, শীত করছে, তবু। কি দিয়ে মেরেছে। জান? বাবার ভাঙা ছড়িটা দিয়ে।’
তার সমস্ত পিঠ জুড়ে সত্যই ছড়ির মোটা মোটা দাগ লাল হয়ে উঠেছে। হেরম্ব নিশ্বাস রোধ করে বলল, ‘তোমায় এমন করে মেরেছে!’
আনন্দ পিঠ ঢেকে দিয়ে বলল, ‘আরো মারত, পালিয়ে গেলাম বলে পারে নি। বৃষ্টির সময় মন্দিরে বসে ছিলাম। তুমি যত আসছিলে না, আমি একেবারে মরে যাচ্ছিলাম। তিনি বুঝি আসতে দেন নি, যাঁর সঙ্গে গেলে?’
‘হ্যাঁ, তার স্বামী আমাকে না খাইয়ে ছাড়লে না। পিঠে হাত বুলিয়ে দেব আনন্দ?’
‘না, জ্বালা করবে।’
হেরম্ব ব্যাকুল হয়ে বলল, ‘একটা কিছু করতে হবে তো, নইলে জ্বালা কমবে কেন? আচ্ছা! সেঁক দিলে হয় না?’–বলে হেরম্ব নিজেই আবার বলল, ‘তাতে কি হবে?’
‘এখন জ্বালা কমেছে।’
‘কমে নি, জ্বালা টের পাচ্ছ না। তোমার পিঠ অসাড় হয়ে গেছে। বরফ ঘষে দিতে পারলে সবচেয়ে ভালো হত।’
‘তা হত। কিন্তু বরফ নেই। তুমি বরং আস্তে আস্তে হাত বুলিয়েই দাও।’
‘বস, বরফ নিয়ে আসছি।’
আনন্দের প্রতিবাদ কানে না তুলে হেরম্ব চলে গেল। শহর পর্যন্ত হেঁটে যেতে হল। বরফ কিনে সে ফিরে এল গাড়িতে। আনন্দ ইতিমধ্যে মেঝের জল মুছে ভিজে বিছানা বদলে ফেলেছি। সে যে সোনার পুতুল নয় এই তার প্রমাণ।
এত কষ্ট করে বরফ সংগ্রহ করে এনেও এক ঘণ্টার বেশি আনন্দের পিঠে ঘষে দেওয়া গোল না। বরফ বড় ঠাণ্ডা। আনন্দ চুপ করে শুয়ে রইল, হাত গুটিয়ে বসে রইল হেরম্ব। যে কোনো কারণেই হোক আনন্দকে মালতী যে এমনভাবে মারতে পারে সে যেন ভাবতেই পারছিল না।
মেঘ কেটে গিয়ে এখন আবার কড়া রোদ উঠেছে। পৃথিবীর উজ্জ্বল মূর্তি এখনো সিক্ত এবং নম। আনন্দকে শুয়ে থাকতে হুকুম দিয়ে হেরম্ব বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল।
মালতী কখন থেকে বারান্দায় এসে বসে ছিল। হেরম্বকে সে কাছে ডাকিল। হেরম্ব ফিরেও তাকাল না। মালতী টলতে টলতে কাছে এল। বেশ বোঝা যায়, মাত্রা রেখে আজ সে কারণ পান করে নি। কিন্তু নেশায় তার বুদ্ধি আচ্ছন্ন হয়েছে বলে মনে হল না।
‘সাড়া দাও না যে!’
‘কারণ আছে বৈকি।’
মালতী বোধহয় দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না। সেখানে দুপ করে বসল।—’শুনি, কারণটা শুনি।
‘সেটুকু বুঝবার শক্তি আপনার আছে, মালতী—বৌদি।’
মালতী এ প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেল। গলা যথাসাধ্য মোলায়েম করে বলল, ‘আর মালতী-বৌদি কেন, হেরম্ব?–কেমন খারাপ শোনায়। ভাবছি আজকালের মধ্যেই তোমাদের কষ্ঠিবদলটা সেরে দেব, আর দেরি করে লাভ কি? কঠিবদলে তোমার আপত্তি নেই তো? আপত্তি কোরো না হেরম্ব। আমরা বৈষ্ণব, তোমার মাস্টারমশায়ের সঙ্গে আমারও কঠিবদল হয়েছিল। তোমাদেরও তাই হোক, তারপর তুমি তোমার তিন আইন চার আইন যা খুশি কর, আমার দায়িত্ব নেই, ধর্মের কাছে আমি খালাস।’
সুপ্রিয়া যতদিন পুরীতে উপস্থিত আছে ততদিন এসব কিছু হওয়া সম্ভব নয়। সুপ্রিয়ার কাছে এখনো সে সেই ছ’মাসের প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ, তার সঙ্গে একটা বোঝাপড়া হয়ে যাওয়া দরকার। আনন্দকে চোখে দেখে গিয়েও সুপ্রিয়া তাকে রেহাই দেয় নি। স্পষ্টই বোঝা যায় সেকালের নবাব—বাদশার মতো সে যদি সুন্দরীদের একটি হারেমে রাখে, সুপ্রিয়া গ্রাহ্য করবে না, তার ভালবাসা পেলেই হল। এমন একদিন হয়তো ছিল যখন দেখা হওয়ামাত্র হেরম্ব সুপ্রিয়ার সঙ্গে তার সেই ছ’মাসের চুক্তি বাতিল করে দিতে পারত। এখন মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে দিতে তার সময় লাগে। কষ্ঠিবদল কিছুদিন এখন স্থগিত না রেখে উপায় নেই।
শুনে মালতী সন্দিগ্ধ হয়ে কারণ জানতে চাইল। হেরম্ব সোজাসুজি মিথ্যা বলল। বলল যে, ‘পূৰ্ণিমা আসুক, আগামী পূর্ণিমায় না হয় হবে। ইতিমধ্যে অনাথ ফিরে আসতে পারে। অনাথের জন্য কিছুদিন অপেক্ষা করা সঙ্গত নয় কি?’
মালতী সংগ্রহে জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার কি মনে হয় হেরম্ব ও আর ফিরবে?’
‘ফিরতে পারেন। বৈকি।’
মালতী বিশ্বাস করল না।’না, সে আর ফিরছে না, হেরম্ব। মিনসে জন্মের মতো গেছে।’
হেরম্ব বলল, ‘নাও যেতে পারেন, হয়তো কালকেই তিনি ফিরে আসবেন। আনন্দকে মিছামিছি মেরেছেন।’
মালতী অল্প একটু গরম হয়ে বলল, ‘মিছামিছি। ওর বাবার ভাগ্যি ভালো ওকে খুন করি নি। কে জানত পেটে আমার এমন শত্তুর হবে!’
হেরম্ব এবার রূঢ় কণ্ঠে বলল, ‘কি শক্ৰতা করল ভেবে পাই না। টাকা দশটা যোগাড় করে না। পুঞ্জ কি তাঁর যাওয়া হত না যে যেতে চায় অত সহজে তাকে আটকানো যায় না, মালতী-বৌদি।‘
মালতী বলল, ‘তুমি ছাই বোঝ। টাকা যোগাড় করে দেওয়ার জন্য নাকি! আমাকে না। জানিয়ে ও চুপ করে রইল কোন হিসাবে? আমি টের পেলে কি সে যেতে পারত, হেরম্ব!’
দুহাতে ভর দিয়ে পিছনে হেলে মালতী আবার বলল, ‘আদেষ্ট দেখেছ, হেরম্ব? আজ আমার জন্মদিন, জ্বালাতন করব, তাই পালিয়ে গেল।’ মালতীর গাল আর চিবুকের চামড়া কুঞ্চিত হয়ে আসছিল, রক্তবর্ণ চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল।’একেবারে পাগল, হেরম্ব, উন্মাদ। গেছে যাক, আজ দেখব কাল দেখব তারপর ঘরদোরে। আমিও ধরিয়ে দেব আগুন। ওলো সর্বনাশি, উঁকি মেরে দেখিস কোন লজ্জায়? আয়, ইদিকে আয়, হতভাগি!’
আনন্দ আসে না। হেরম্ব তাকে ডেকে বলল, ‘এস আনন্দ।’
আনন্দ কুণ্ঠিত পদে কাছে এলে মালতী খপ্ করে তার হাত ধরে ফেলল। কাছে বসিয়ে পিঠের কাপড় সরিয়ে আঘাতের চিহ্ন দেখে বলল, ‘তোর কি মাথা খারাপ হয়েছিল, আনন্দ? লক্ষ্মীছাড়া মেয়ে, তুই পালিয়ে যেতে পারলি না?’
আনন্দ মুখ গোজ করে বলল, ‘গোলাম তো পালিয়ে।’
‘পালিয়ে গেলি তো এমন করে তোকে মোরল কে শুনি?’ মালতীর গলা হতাশায় ভেঙে এল, ‘গোয়ার! যেমন গোয়ার বাপ তেমনি গোয়ার মেয়ে। ঠায় দাঁড়িয়ে মার খেয়েছে। যত বলি–যা আনন্দ, চোখের সমুখ থেকে সরে যা, মেয়ে তত এগিয়ে এসে মার খায়।’
মাতা ও কন্যার মিলন হল এইভাবে। হেরম্বের না হল আনন্দ, না হল স্বস্তি। নূতন ধরনের যে বিষাদ তার এসেছে তাতে সবই যেন তার মনে হচ্ছে সাধারণ, স্বাভাবিক।
তারপর মালতী জিজ্ঞাসা করল, ‘পিঠে নারকেল তেল দিতে পারিস নি একটু?’
বরফ দেওয়ার কথাটা কেউ উল্লেখ করল না। হেরম্বকে দিয়ে তেলের শিশি আনিয়ে মালতী মেয়ের পিঠে মাখিয়ে দিতে আরম্ভ করল।
আনন্দকে প্রহার করেই মালতী শান্ত হয়ে যাবে হেরম্ব সে আশা করে নি। অনাথ যে সত্যই চিরদিনের মতো চলে গেছে তাতে সেও সন্দেহ করে না। মৃত্যুর চেয়ে এভাবে প্রিয়জনকে হারানো বেশি শোকাবহ। এই শোক মালতীর মধ্যে ঠিক কি ধরনের উন্মত্ততায় অভিব্যক্ত হবে তাই ভেবে হেরম্ব ভয় পেয়ে গিয়েছিল। মালতীর শান্ত ভাবটা সে ঠিক বুঝতে পারল না। কারণের প্রভাব হওয়াও আশ্চৰ্য নয়।
ওদিকে সুপ্রিয়ার সমস্যা আছে। চারটের মধ্যে সুপ্রিয়ার কাছে তার হাজির হবার কথা। ঘড়ি দেখে বোঝা গেল এখন আর তা সম্ভব নয়, চারটে বাজে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গিয়ে উপস্থিত হলে দেরি করে যাওয়ার অপরাধ সুপ্রিয়া ধরবে না। যেতেই হেরন্থের ক্লান্তি বোধ হচ্ছে।
তাকে সামনে পেলে সুপ্রিয়া ক্ষণে ক্ষণে নবজাগ্ৰত আশায় উৎফুল্ল হয়, ক্ষণে ক্ষণে ব্যথায় মলিন হয়ে যায়। হেরম্বের চোখের দৃষ্টিতে মুখের কথায় আজো সে অদম্য আগ্রহে অনুসন্ধান করে প্ৰেম, নিজেরই সুদীর্ঘ তপস্যার অন্ধ-শক্তিতে পলে পলে হতাশাকে জয় করে চলে। তার কাছে হেরম্বকে প্রত্যেকটি মুহূর্ত সাবধান হয়ে থাকতে হয়। ক্রমাগত সুপ্রিয়ার চিত্তকে ভিন্নাভিমুখী করার চেষ্টায় মাঝে মাঝে তার ভ্রান্তি জন্মে যায়, সুপ্রিয়ার প্রেমকে হত্যা করার বদলে সে বুঝি প্রশ্ৰয় দিয়েই চলেছে। হেরম্বের সবচেয়ে মুশকিল হয়েছে এই যে, আনন্দের সংস্রবে এসে তার মন এমন দুর্বল হয়ে উঠেছে কারো প্রতি কল্যাণকর নিষ্ঠুরতা দেখাবার শক্তি তার নেই। রূপাইকুড়ায় গভীর রাত্রে সুপ্রিয়া যেমন সোজাসুজি তার দাবি জানিয়েছিল, আজো যদি সে তেমনিভাবে স্পষ্টভাষায় তাকে প্রার্থনা করে, জীবন থেকে বরখাস্ত করে দেওয়া হেরম্বের পক্ষে হয়তো সহজ হয়। কিন্তু সুপ্রিয়া তাদের সেই ছ’মাসের চুক্তিকে আঁকড়ে ধরে আছে। এদিকে আজকাল কেবল নিজের এবং একান্ত নিজস্ব যে, তার সুখদুঃখের কথা ভাবার মতো সঙ্গত স্বার্থপরতা হেরম্বের কাছে হয়ে উঠেছে লজ্জাকর। সুপ্রিয়া যদি দুদণ্ড তার সঙ্গে কথা বলে শান্তি পায়, তার দীর্ঘকালব্যাপী জীবনপণ ভালবাসার কথা স্মরণ করে তাকে বঞ্চিত করার অধিকার নিজের আছে বলে হেরম্ব ভাবতে পারে না। এদিক দিয়ে বিচার করে হেরম্ব চিনতে পারে না নিজেকে। সে ছিল কঠিন, মানুষের ছোটবড় সুখদুঃখের কোনো মূল্য তার কাছে ছিল না, কারো হৃদয়কে সে কোনোদিন খাতির করে চলে নি। আজ শুধু কোমল হওয়া নয়, গলিত বরফের মতো সে তরল হয়ে গেছে, যে যেখানে তৃষ্ণাৰ্ত আছে তারই অঞ্জলিতে নিজেকে সে বিলিয়ে দিতে চায়।
ঘরে বসে উদ্বেগ ও অশান্তিতে হেরম্ব কাতর হয়ে পড়ে। আবার তার পালিয়ে যেতে ইচ্ছে হয়। জীবন যখন রণক্ষেত্রে পরিণত হয়ে গেছে তখন আর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মার খেয়ে লাভ কি? সুপ্রিয়ার আবির্ভাব হওয়ামাত্র তার যদি এই অবস্থা হয়ে থাকে, শেষ পর্যন্ত কি অবস্থা দাঁড়াবে কে বলতে পারে?
যে তেজ, যে প্রচণ্ড গতির অবসান হয়ে গেছে তার জন্য হেরম্বের মন হাহাকার করে। একদিন যা দিয়ে সে মানুষের বুকও ভেঙেছে ঘরও ভেঙেছে, আজ সে শক্তি থাকলে সে মহামানবের মতো ভাঙা বুক জোড়া দিতে পারত, ভাঙা ঘর গড়ে তুলতে পারত। মনে জোর থাকলে জীবনে সমস্যা কোথায়? মালতী, সুপ্রিয়া ও আনন্দকে নিয়ে বিপুল পৃথিবীর এককোণে ঠাঁই বেছে নেওয়া কঠিন নয়, জীবনের দুটি প্রান্তে সুপ্রিয়া ও আনন্দকেও এমনভাবে রেখে দেওয়া অসম্ভব নয় যাতে নিজস্ব সীমা তাদের কোনোদিন চোখে পড়বে না, খণ্ডিত হেরম্বকে দিয়েও জীবনের পূর্ণতা সাধিত হওয়ায় কোনোদিন তারা অনুভব করতে পারবে না নিজেকে দুভাগে ভাগ করে দুজনকেই সে ঠকিয়েছে। একদিন হেরম্বের পক্ষে এ কাজ সম্ভব ছিল। আজ এ শুধু কল্পনা, অক্ষমের দিবাস্বপ্ন।
সত্যই কল্পনা। আজ সারাদিন, বিশেষভাবে আনন্দের পিঠে বরফ ঘষে দেবার সময়, এই দিবাস্বপ্নই সে দেখেছে। সুপ্রিয়া থাকে জনপদের একটি দ্বিতল গৃহে, তার ছবির মতো সাজানো ঘরে সারাদিন হেরম্ব গৃহস্থ সংসারী, সন্ধ্যায় সে ফিরে যায় আনন্দের স্বহস্তে রোপিত ফুলগাছে সাজানো বাগানে ঘেরা শান্ত নির্জন কুটিরে। সুপ্রিয়া তাকে রোধে খাওয়ায়, আনন্দ তাকে দেখায় চন্দ্ৰকলা নাচ। তার মধ্যে যে ক্ষুধিত অসন্তুষ্ট দেবতা আছেন হেরম্ব তাকে এমনি সব উদূত্রান্ত কল্পনার নৈবেদ্য নিবেদন করে। নিবেদন করে সসঙ্কোচে, প্রায় সজল চোখে। তার কি বুঝতে বাকি আছে যে, এই ভ্রান্ত আত্মপূজা তার বার্ধক্যের পরিচয়, এই সব রঙিন কল্পনা তার কৈশোরে ফিরে আসার লক্ষ্মণ নয়, যৌবন-অপরাষ্ট্রের মৃত্যু-উৎসব।
মালতী আজ হেরম্বকে বেদখল করেছে। দশ মিনিটের বেশি একা থাকতে দেয় না।
বলে, ‘মিন্সে যদি আর একটা দিন থেকে যেত, আমার জন্মদিনের উৎসবটা হতে পারত। যাক, কি আর হবে, গেছেই যখন মরুকগে যাক। তারও শান্তি, আমারও শান্তি।’
‘শান্তিই মানুষের সব। ’–হেরম্ব সংক্ষেপে বলে।
মালতী হেসে বলল, ‘খুব একটা মস্ত কথা বললে তো! আসল কথাটা জান, হেরম্ব? আমায় আর দেখতে পারত না। ওসব যোগটোেগ মিছে কথা, ভণ্ডামি। একজনকে দেখতে না পারলেই মানুষের ওসব ভণ্ডামি আসে। কই, সংসারে বিরাগ না এলে সন্ন্যাসী হতে দেখলাম না তো কাউকে! ভোগ ভালো না লাগলে তখন তোমাদের ধর্মে মতি হয়। তোমরা পুরুষ মানুষেরা হলে কি বলে গিয়ে সুখের পায়রা। যখন যাতে মজা লাগে তাই তোমাদের ধর্ম। ঘেন্নার জাত বাপু তোমরা।’
শেষ পর্যন্ত মালতীকে সহ্য করতে না পেরেই হেরম্ব পথে বেরিয়ে গেল।
আনন্দ জিজ্ঞসা করল, ‘তুমি বুঝি তাঁর বাড়ি যাচ্ছ?’
‘হ্যাঁ। তুমি বারণ করলে যাব না।’
‘বারণ করব কেন?’
আনন্দ ম্লানমুখে বলল, ‘তাই এস। আমার আজ বড় মন কেমন করছে।’
হেরম্ব ইতস্তত করে বলল, ‘তবে না হয় নাই গেলাম, আনন্দ। চল, আমরা সমুদ্রের ধার থেকে বেড়িয়ে আসি।’
আনন্দ বলল, ‘না, আমি মা’র কাছে থাকব।’
হেরম্ব আর দ্বিধা করল না।’থাক, আমি যাব না, আনন্দ। যেতে বলেছিল একবার, কাল গেলেই হবে।’
কিন্তু আনন্দ তাকে মত পরিবর্তন করতে দিল না। বলল, ‘না, যাও। না গেলে তিনি আবার এসে হাজির হবেন তো! এখন দেখা করে এস, সন্ধ্যার পরে তুমি আর কোথাও যেও না, আমার কাছে থেক।’
হেরম্ব জানত সুপ্রিয়া তার জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকবে। দেরি দেখে হয়তো মাঝে মাঝে পথের দিকেও তাকাবে। কিন্তু বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছানো মাত্র সুপ্রিয়া বেরিয়ে এসে তার সঙ্গে যোগ দেবে হেরম্ব তা ভাবতে পারে নি। সুপ্রিয়ার পক্ষে এতখানি অধীরতা কল্পনা করা কঠিন।
সুপ্রিয়া নিজে থেকে কৈফিয়ত দিল।’
ওঁর দাদা-বেঁদি এসে পড়েছে। চলুন আমরা পালাই।’
‘পালাই? পালাই কিরে?’
সুপ্রিয়া ব্যাকুল হয়ে বলল, ‘সরে চলুন। এখান থেকে, কেউ দেখতে পাবে! হেঁয়ালি বুঝবার সময় পাবেন ঢ়ের।’
সে দ্রুতপদে এগিয়ে গেল। মূঢ়ের মতো তাকে অনুসরণ করা ছাড়া হেরম্বের আর উপায় রইল না। সমুদ্রের ধারে পৌঁছানোর আগে পর্যন্ত সুপ্রিয়া মুহূর্তের জন্য তার গতিবেগ শ্রুথ করল না। সে যেন চুরি করে পালাচ্ছে। বঙ্গনারীর এই অস্বাভাবিক জোর চলনে পথের লোক অবাক হয়ে চেয়ে আছে লক্ষ করে হেরম্বের লজ্জা করতে লাগল। সুপ্রিয়ার পায়ে জুতো নেই, পরনের সাধারণ শাড়িখানা ময়লা, তার আলগা খোঁপা খুলে গেছে। বয়সও তার কম হয় নি, চার বছর আগে একবার সে মা হয়েছিল।
তবু সমুদ্রতীর অবধি হেরম্ব চুপ করে রইল। সেখানে সুপ্রিয়া দাঁড়াতে সে মৃদু ও কড়া সুরে বলল, ‘রাস্তার লোক হাসালি, সুপ্রিয়া।‘
‘হাসুক। মাগো, এইটুকু জোরে হেঁটে হাঁপ ধরে গেছে!’
বুক ফুলিয়ে ফুলিয়ে দুর্বিনীত ভঙ্গিতে সে নিশ্বাস নেয়। সমুদ্রের বাতাসে তার আলগা চুল, অনাবদ্ধ অঞ্চলপ্রান্ত উড়তে থাকে। হেরম্ব সভয়ে স্মরণ করে সুপ্রিয়ার এ রূপ প্রায় পাঁচ বছরের পুরোনো, যখন ছেলেমানুষ পেয়ে আনন্দের সমবয়সী সুপ্রিয়াকে সে ভুলিয়ে বিয়ে দিয়েছিল বলে রূপাইকুড়ায় সুপ্রিয়া অভিযোগ করেছে।
‘দাঁড়াবেন না, চলুন।’–বলে সমুদ্রের ঢেউ যেখানে পায়ের পাতা ভিজিয়ে দিয়ে যায়, সেখান দিয়ে সুপ্রিয়া হাঁটতে আরম্ভ করল। রোদের তেজ এখনো কমে নি, কিন্তু জোরালো বাতাস রোদের তাপ গা থেকে মুছে নিয়ে যাচ্ছে। হেরম্ব বলল, ‘ব্যাপার কি বলা তো, সুপ্রিয়া?’
‘ব্যাপার কঠিন কিছু নয়। বাড়িতে ভিড় জমেছে, নিরিবিলি কথা বলার জন্য সমুদ্রের ধারে বেড়াতে এলাম–শুধু এই।’
‘ফিরে গিয়ে কি কৈফিয়ত দিবি?’
‘তার দরকার হবে না।’
নীরবে দুজনে এগিয়ে চলল। সমুদ্রতীর পথ নয়। কিন্তু হেঁটে বড় আরাম। পাশে অনন্ত সমুদ্রের গা ঘেঁষে সমুদ্রতীরও কোথায় কতদূর চলে গেছে, শেষ নেই। সঙ্গী নিয়ে নিঃশব্দে হাঁটবার সুবিধাও এইখানে, সমুদ্রের কলরব নীরবতাকে প্রচ্ছন্ন করে রাখে, পীড়ন করতে দেয় না।
অনেক দূর গিয়ে সুপ্রিয়া জিজ্ঞাসা করল, ‘চিঠিতে ওই মেয়েটার কথা লেখেন নি কেন?’
‘লিখি নি? ভুল হয়ে গিয়েছিল।’
‘আমি খবর পেয়েছিলাম। ও সাক্ষী দিতে একবার পুরী এসেছিল। গিয়ে বলল, আপনি এক তান্ত্রিকের আড্ডায় ড়ুবতে বসেছেন।’
‘তান্ত্রিক নয়, বৈষ্ণব।’
‘মেয়েটাকে দেখেই আমার ভালো লাগে নি। ওর মা-টা আরো খারাপ।’
হেরম্ব গম্ভীর হয়ে বলল, ‘তুই বুঝি ভুলে গেছিস, সুপ্রিয়া, কতকগুলি কথা আছে মুখ ফুটে যা বলতে নেই?’
সুপ্রিয়া কলহের সুরে বলল, ‘চুপ করে থাকব, না? আমি তা পারব না। আমি মেয়েমানুষ, অত উদার আমি হতে চাই না। পারলে ওই রাক্ষসীকে আমি বিষ খাইয়ে গলা টিপে মেরে ফেলব, এই আপনাকে আমি স্পষ্ট বলে রাখলাম।’
হেরম্ব অনাথের মতো অনুত্তেজিত কণ্ঠে বলল, ‘তুই যে ক্রমেই মালতী—বৌদি হয়ে উঠছিস, সুপ্রিয়া!’
‘মালতী-বৌদি কে? ওই মা-টা বুঝি? হুঁ, ডাকের দেখি বাহার আছে!’
‘চেহারার বাহার আছে, সুপ্রিয়া।’
‘তা আছে। দুজনারই।’
খোঁচা খেয়ে হেরম্ব একটু বিরক্ত হল। সুপ্রিয়ার এবারকার পদ্ধতিটি ভালো নয়। রূপাইকুড়ায় সে তাদের বাহ্য-সম্পর্ককে প্রাণপণে ঠেলে তুলতে চেয়েছিল। সেই স্তরে যেখানে বাস্তবধর্ম মানুষের আবেগ ও স্বপ্ন বিছানো থাকে, যেখানে রস ও মাধুর্যের সমাবেশ। সাধারণ যুক্তি ও বিচারবুদ্ধিকে তুচ্ছ করে দেবার প্রবৃত্তি হেরম্ব যাতে দমন করতে না চায়, রূপাইকুড়ায় তাই ছিল সুপ্রিয়ার প্রাণপণ চেষ্টা। এবার সুপ্রিয়া তার সমস্ত নেশা টুটিয়ে দিতে চায়, সে যে প্রায় ভুলে যেতে বসেছে। সে রক্তমাংসের মানুষ, তার এই ভ্রান্তিকে সে টিকতে দেবে না। আত্মবিস্মৃত পাখির মতো নিঃসীম আকাশে পাখা মেলে অনন্ত-যাত্রায় তাকে প্রস্তুত হতে দেখে এই নীড়লুব্ধা বিহঙ্গমী তার কাছে পৃথিবীর আকর্ষণ টেনে এনেছে, তাকে মনে পড়িয়ে দিচ্ছে আকাশে আশ্রয় নেই, খাদ্য নেই, পানীয় নেই। হেরম্ব ধীরে ধীরে হীটে। সুপ্রিয়ার ইঙ্গিত মিথ্যা নয়, রূপের বাহার ছাড়া আনন্দের আর কিছুই নেই। আনন্দের ভিতর ও বাহির সুন্দর, অপার্থিব, অব্যবহার্য সৌন্দর্যে তার দেহ-মন মণ্ডিত হয়ে আছে; সে রঙিন কালিতে ছাপানো অনবদ্য কবিতার মতো। অথবা সে আকাশের মতো, তার মধ্যে ড়ুবে গিয়েও পাখিকে নিজের পাখায় ভর করে থাকতে হয়, পাখা অবশ হলে পৃথিবীতে পতন অনিবাৰ্য। আনন্দকে প্রেম ছাড়া আর কোনো পূজায় পাওয়া যায় না, প্রেমের শেষ অবশ্য নিশ্বাসের সঙ্গে সে হারিয়ে যাবে। সুপ্রিয়ার কাছে অভ্যস্ত বিরক্তি ও মমতার অবাধ খেলায় বিস্ময়কর স্বস্তিবোধ করে হেরম্ব কি এখন বুঝতে পারছে না। আনন্দের সান্নিধ্য তাকে অনির্বচনীয় সুতীব্র সুখের সঙ্গে কি অসহ্য যন্ত্রণা দেয়? তার অর্ধেক হৃদয় ভালবাসার যে পুলক সংগ্রহ করে, অপরার্ধ মরণাধিক কষ্ট সয়ে তার মূল্য দেয়? সুপ্রিয়ার কাছে সে উন্মাদনা পাবার সম্ভাবনা যেমন নেই, সেরকম অসহ্য দুঃখও সে দেয় না।
তবু সেই দুঃখই তার চাই, তাকে পরিহার করা যাবে না।
‘চল ফিরি।’
‘চলুন আর একটু। নির্জনতা গম্ভীর হয়ে আসছে।’
‘জলে ভিজে অশোকের কিছু হয় নি তো?’
হঠাৎ অশোকের কথা ওঠায় সুপ্রিয়া একটু বিস্মিত হয়ে হেরম্বের মুখের দিকে তাকাল।
’হু হু করে জ্বর এসেছে।’
‘তুই যে চলে এলি?’
‘ছোটলোক ভাবছেন, না? সেবা করার লোক না থাকলে আসতাম না। দাদা, বৌদি, ভাইঝি সবাই ঘিরে আছে, তারা আপনার জন্য। আমি তো পর!’
‘তোর কি হয়েছে বল তো?’
‘বুঝতে পারেন নি? আমার মন আগাগোড়া বদলে গেছে। আজকাল সর্বদা অন্যমনস্ক থাকি।’
হেরম্বের কাছে এটা সুপ্রিয়ার অনাবশ্যক আত্মনিন্দার মতো শোনাল। মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক হতে পারলেও সর্বদা অন্যমনস্ক থাকা সুপ্রিয়ার পক্ষে অসম্ভব। তার এ কথা হেরম্ব বিশ্বাস করল না।
‘তুই ইচ্ছা করলেই অশোককে সুখী করতে পারতিস, সুপ্রিয়া।’
সুপ্রিয়া থমকে দাঁড়াল।
’যদি কথা তুললেন, তাহলে বলি। আমি তা পারতাম না। কেউ পারে না। ছেলেখেলা হলে পারতাম, চব্বিশ ঘণ্টা একসঙ্গে থাকা ছেলেখেলা নয়। ও বিনাদোষে মারা গেল, কিন্তু উপায় কি, সংসারে অমন অনেক যায়। ওর সত্যি কোনো উপায় নেই।’
দূরদিগন্তে চোখ রেখে হেরম্ব বলল, ‘তবু অশোককে নিয়ে তুই যদি জীবনে সুখী হতে পারতিস, তাহলে তোর প্রশংসা করতাম, সুপ্রিয়া।’
‘কথাটা ভেবে বললেন?’
‘ভেবে বললাম। মনকে তুই একেবারে উন্মুক্ত করে দিলি, কিছু ঢাকবার চেষ্টা করলি না। সত্যকে সহ্য করবার স্পর্ধা দেখিয়েছিস বলেই কথাটা বললাম। বিচলিত হলে চলবে কেন? ওর ভালোমন্দের দায়িত্ব তোরও অনেকখানি আছে বৈকি।’
সুপ্রিয়া রুক্ষস্বরে বলল, ‘আপনার কথার মানে হয় না। ওর ভালোমন্দর সঙ্গে আমার সম্পর্ক কি? রূপাইকুড়াতেও আপনি আমাকে এসব বলে অপমান করতেন। আপনার ভুল হয়েছে, স্বামী আমার সমস্যা নয়, আপনিই তাকে শিখণ্ডীর মতো সামনে খাড়া করে রেখে আমার সঙ্গে লড়াই করেছেন।’
এবার হেরম্বের চুপ করে যাওয়াই উচিত ছিল। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই তর্কে হার মানা। হেরম্বের স্বভাব নয়।
‘লড়াই বাধাচ্ছিস তুই; আমি লড়াই করতে চাই নি, সুপ্রিয়া।’
এই কঠোর কথায় সুপ্রিয়া ক্ৰন্দনবিমুখ আহত শিশুর মতো মুখ করে বলল, ‘ইচ্ছে করে আমাকে অপমান করার জন্য এ কথা যদি বলতেন। ফিরে গিয়ে আমি বিষ খেতাম।’
হেরম্ব সংগ্রহে সায় দিয়ে বলল, ‘ফিরে গিয়ে আমরা দুজনেই তাই খাই চল, সুপ্রিয়া।’
সুপ্রিয়া অতি কষ্টে বলল, ‘তার চেয়ে এখানে একটু বাসা ভালো।’
জলের ধার থেকে খানিক সরে শুকনো বালিতে তারা নীরবে বসে থাকে। হেরম্ব বুঝতে পারে রূপাইকুড়ায় তাদের যে ছ’মাসের চুক্তি হয়েছিল সুপ্রিয়া এখনো তা অখণ্ডনীয় ধরে রেখেছে। এখন যে তাদের অন্তরঙ্গতা বেড়েছে তাতে সন্দেহ নেই। অশোকের সম্বন্ধে যে আলোচনা তাদের হয়ে গেল, পরস্পরের কাছে দাম কমে যাবার বিন্দুমাত্র আশঙ্কা থাকলে এ আলোচনা তাদের এত স্পষ্ট হয়ে উঠত না। উঠলেও এত সহজে সমাপ্তি লাভ না করে তাদের এমন কলহ হয়ে যেত যে, আগামীকাল পর্যন্ত পরস্পরকে তারা ঘৃণা করত। যাদের মধ্যে মনের চেনা নেই, শুদ্ধ শান্ত অপাপবিদ্ধ আত্মাকে পর্যন্ত এ অবস্থায় তারা ক্লেশ দেয়; বলে–এই দ্যাখা পাপ। তোমার পাপ তোমার মহৎ চিত্তের মহাব্যাধি! অশোকের মধ্যস্থতাতেই কি সে আর সুপ্রিয়া পরিচয়ের এই নিম্নতম স্তর অতিক্রম করে এল? মুহূর্তের তেজী, হিংসার বশে সুপ্রিয়াকে ছাদ থেকে ঠেলে ফেলে দিতে চেয়ে, অশোক কি তার আর সুপ্রিয়ার মধ্যে পরম সহিষ্ণুতা এনে দিয়েছে?
তাই যদি না হয় – সুপ্রিয়ার প্রশান্ত মুখের দিকে চেয়ে হেরম্ব মনে মনে তার এই চিন্তাকে ভাষায় উচ্চারণ করে —সুপ্রিয়ার মুখের আলো নিবে যাবার কথা। তার শেষ কথায় সুপ্রিয়া তো কাঁদত।
হেরম্বের সবচেয়ে বিস্ময় বোধ হয় সুপ্রিয়ার দীর্ঘ নীরবতায়। নিরিবিলিতে কথা বলতে এসে তার কথা যেন ইতিমধ্যেই ফুরিয়ে গিয়েছে। বেলা, শেষ হয়ে আসে, তবু সুপ্রিয়া কিছু বলে না। এই নীরবতা যে রাগ অথবা অভিমানের লক্ষণ নয় তাও সহজেই বোঝা যায় – সুপ্রিয়ার মুখে কোনো অভিব্যঞ্জনা নেই বলে শুধু নয়, সরে সরে অতি নিকটে এসে তার আধ-অন্যমনস্ক বসবার ভঙ্গিতে। খোলা চুল সে আর বাঁধে নি, আঁচল জড়িয়ে গলার সঙ্গে বেঁধে ফেলেছে, অনাবৃত মাথায় শুধু কয়েকটি আলগা চুল বাতাসে উড়ছে। হেরম্বের জামার যেটুকু বালিতে বিছানো হয়ে আছে তাতে সে পেতেছে হাত, সে হাতে দেহের উর্ধ্বাংশের ভর রেখে হাঁটু মুড়ে কত হয়ে বসেছে। সে যেন হেরম্বকে উঠতে দেবে না, জামা ধরে বসিয়ে রাখবে। অথবা বৃন্তচু্যত ফুলের মতো হেরম্বের কোলে ঝরে পড়ার জন্য সে শুধু হাতটির অবশ হওয়ার প্রতীক্ষা করছে।
এখন একটু চেষ্টা করলেই হেরম্ব আনন্দকে ভুলে যেতে পারে। ফেননন্দিতা সাগরকুলে জনহীন দিব্যাবসানের বৈরাগ্যকে একটু প্রশ্ৰয় দেওয়া, সরল মনে একবার স্মরণ করা পার্শ্ববর্তিনীর জীবনেতিহাস। সে তো কঠিন নয়। কত দিনের কত ক্ষুধা ও পিপাসা, কত স্বপ্ন ও সঙ্কল্প সঞ্চয় করে সুপ্রিয়া আজ এমন শিথিল ভঙ্গিতে এত কাছে বসেছে সে ছাড়া আর কার তা স্মরণীয়? নিজেকে হেরম্বের দুর্বল ও অসহায় মনে হয়।
সুপ্রিয়া হঠাৎ মৃদু হেসে বলল, ‘বাড়িতে এখন আমার খোঁজ পড়েছে।’
হেরম্ব বলল, ‘এবার ওঠা যাক।’
‘এখনি? আগে সন্ধ্যা হোক, রাজি হোক, তখন যদি উঠি তো উঠব।‘
‘যদি?’
‘হ্যাঁ। সারারাত নাও উঠতে পারি, কিছু ঠিক নেই। বেশ বালির বিছানা পাতা আছে। বসতে কষ্ট হলে আপনি শুতে পারবেন। বৃষ্টি নামলে কষ্ট হবে।’
হেরম্ব অভিভূত হয়ে বলল, ‘তারপর কি হবে?’
‘এখান থেকে স্টেশনে গিয়ে গাড়িতে উঠব। আপনার কলেজ অনেকদিন খুলে গেছে। আর বেশি কামাই করলে চাকরি যাবে।’
হেরম্ব কথা বলতে পারল না।
সুপ্রিয়া বলল, ‘চাকরি গেলে চলবে না, আমাদের টাকার দরকার হবে। ছোট বাড়িতে আমি থাকতে পারব না। সাত-আটখানা ঘর আর খুব বড় খোলা ছাদ থাকা চাই।’
সুপ্রিয়ার এই অন্তিম আবেদন।
ভীরু হেরম্ব পকেট হাতড়ে চুরুট বার করে। অনেকক্ষণ সময় নিয়ে চুরুটা ধরিয়ে বলল, ‘টিকিটের টাকা আনতে একবার কিন্তু আশ্রমে যেতে হবে, সুপ্রিয়া।’
সমস্ত রাত্রি সমুদ্রের ধারে কাটিয়ে পরদিন সকালে তাদের কলকাতা চলে যাবার মতো বৃহৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণের সঙ্গে টিকিটের টাকার জন্য চিন্তিত হওয়া এত বেশি তুচ্ছ যে, হেরম্ব ভাবতেও পারল না, সুপ্রিয়া বুঝবে না। এ শুধু তার সময়োচিত গভীর পরিহাস, সুপ্রিয়ার প্রস্তাবকে এমনিভাবে দুৰ্বল হেরেম্বের হেসে উড়িয়ে দেওয়া। সুধিয়া কিন্তু সত্য সভাই তার এই কথাকে স্বীকারোক্তি বলে ধরে নিল।
‘তার দরকার নেই, আমার গায়ে গহনা আছে।‘
একটু চিন্তা করে হেরম্ব বক্তব্য স্থির করে নিল।
’শোন, সুপ্রিয়া। তোর বিয়ের সময় তোকে একটা উপহারও কিনে দিই নি। আর আজ তোর গয়না বিক্রির টাকায় কলকাতা যাব? এমন কথা তুই ভাবতে পারলি! একবার তোর ভয় হল না, লজ্জায় ঘৃণায় আমি তাহলে চলন্ত ট্রেন থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করব?’
সুপ্রিয়ার হাত এতক্ষণে হয়তো অবশ হয়ে এসেছিল, হাত মুচড়ে তার শরীরের আশ্ৰয়াচুত উৰ্ব্বভাগ হেরম্বের কোলে হুমড়ি দিয়ে পড়লে অস্বাভাবিক হত না। কিন্তু সে সোজা হয়েই বসল। স্তব্ধ নিশ্চল, কাঠের মূর্তির মতো। রূপাইকুড়ায় হেরম্বের সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে শুকনো ঘাসে-ঢাকা মাঠে সে এমনিভাবে বসেছিল। হেরম্বের মনে আছে। তখন সূৰ্য অস্ত গিয়ে সন্ধ্যা হয়েছিল। আজ সূৰ্যাস্তের সূচনামাত্র হয়েছে। ছোট একটি মেঘ এত জোরে ছুটে আসছে যে, সূৰ্যাস্তের আগেই সূর্যকে ঢেকে ফেলবে। সুপ্রিয়ার মুখ থেকে আকাশে দৃষ্টিকে সরিয়ে নিয়ে যেতে যেতে হেরম্বের মুখও বিবৰ্ণ স্নান হয়ে গেল। দুহাতে ভর দিয়ে সে বসেছে। দুই করতলে সূক্ষ্ম শীতল বালির স্পর্শ অনুভব করে তার মনে হল, যে পৃথিবীর সবুজ তৃণাচ্ছাদিত হওয়ার কথা, তার আগাগোড়া হয়ে গেছে মরুভূমি।
অপরাধীর মতো মন্থরপদে হেরম্ব আশ্রমে ফিরে এল। অন্ধকার বাগান পার হয়ে বাড়ির রুদ্ধ দরজায় সে করাঘাত করল আস্তে। তারপর আনন্দের নাম ধরে ডাকল। অভিশপ্ত দেবদূতের মতো মর্তের প্রবাস সাঙ্গ করে সে যেন স্বর্গের প্রবেশ-পথে সসঙ্কোচে এসে দাঁড়িয়েছে। দরজা খোলার জোরালো দাবি জানাবার সাহসও নেই।
আলো হাতে এসে দরজা খুলে আনন্দ নীরবে একপাশে সরে দাঁড়াল। হেরম্ব মৃদুস্বরে বলল, ‘দেরি করে ফেলেছি, না?’
‘কোথায় ছিলে এতক্ষণ?’
‘সমুদ্রের ধারে খানিকক্ষণ বেড়িয়ে মন্দিরে গিয়েছিলাম।’
‘তাঁর বাড়ি যাও নি–সকালে যিনি এসেছিলেন?’
‘গিয়েছিলাম। তিনি আমার সঙ্গে সমুদ্রের ধারে বেড়াতে এলেন। তঁকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে। ঘুরতে ঘুরতে মন্দিরের সামনে এসে হাজির হয়েছি। মন্দিরে উঠে একটু বসলাম। মনটা ভালো ছিল। না, আনন্দ।’
‘কেন?’
‘তিনি বললেন, আমায় তিনি ভালবাসেন। আমি ভালবাসি না বলায় মনে খুব ব্যথা পেলেন। কারো মনে ব্যথা দিলে মন খারাপ হয়ে যায় না?’
দরজা বন্ধ করার জন্য আনন্দ হেরম্বের দিকে পিছন ফিরল। হেরন্ধের মনে হল, এই ছুতায় সে। বুঝি মুখের ভাব গোপন করছে। দরজায় খিল দিয়ে আনন্দ ঘুরে দাঁড়াতে বোঝা গেল, হেরম্বের অনুমান সত্য নয়। আনন্দ কখনো কিছু গোপন করে না।
‘তিনি অনেকদিন থেকে তোমায় ভালবাসেন, না?’
‘তাই বললেন।’
দুজনে তারা হেরম্বের ঘরে গেল। মালতীর কোনো সাড়াশব্দ নেই। সবগুলি আলো আজ জ্বালা হয় নি, বাড়িতে আজ অন্ধকার বেশি, স্তব্ধতা নিবিড়। আলগোছে মেঝেতে আলোটা নামিয়ে রেখে আনন্দ বলল, ‘আমার ভালবাসা দুদিনের!’
হেরম্ব অনুরাগ দিয়ে বলল, ‘কেন তুমি কেবলি দিনের হিসাব করছি আনন্দ?’
কথাগুলি হঠাৎ যেন আক্রমণ করার মতো শোনাল। আনন্দ থাতমত খেয়ে বলল, ‘না, তা করি নি। এমনি কথার কথা বললাম।’
হেরম্ব বিষণ্ণভাবে মাথা নাড়ল।’কথার কথা কেউ বলে না, আনন্দ, আজ পর্যন্ত কারো মুখে আমি অর্থহীন কথা শুনি নি। তোমার ঈর্ষা হয়েছে।’
হেরম্বকে আশ্চৰ্য করে দিয়ে সহজভাবে আনন্দ এ কথা স্বীকার করল, ‘কেন তা হয়? আমার মন ছোট বলে?’
‘ঈর্ষা খুব স্বাভাবিক, আনন্দ, সকলের হয়।’
‘সকলের হোক, আমার কেন হবে?’
প্রশ্নটা হেরম্ব ঠিক বুঝতে পারল না। এ যদি আনন্দের অহঙ্কার হয় তবে কোনো কথা নেই। কিন্তু সে যদি সরলভাবে বিশ্বাস করে থাকে যে তার অসাধারণ প্রেমে ঈর্ষারও স্থান নেই, তাহলে হয়তো তাকে অনেকক্ষণ বকতে হবে। বলতে হবে–তোমার খিদে পায় না আনন্দ? মাঝে মাঝে প্রকৃতি তোমাকে শাসন করে না? হিংসাকে তেমনি প্রকৃতির নিয়ম বলে জেনো।
হেরম্ব কথা বলল না দেখে আনন্দ বোধহয় একটু ক্ষুন্ন হল। যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানেই মেঝেতে সে বসল। তাকে চৌকিতে উঠে বসতে বলার মতো মনের জোর হেরম্ব আজ খুঁজে পেল না। সমুদ্রতীরের কলরব থেকে দূরে চলে আসার পর তার মনে যে স্তব্ধতার সৃষ্টি হয়েছিল, এখনো একটা ভারি আবরণের মতো তা তার মন চাপা দিয়ে রেখেছে। সুপ্রিয়ার সেই হাতে ভর দিয়ে বসবার শিথিল ভঙ্গি মনে পড়ে। আসন্ন সন্ধ্যায় সুপ্রিয়া স্থলিত পদে তার পরিত্যক্ত গৃহে প্রবেশ করার পর অন্ধকার পথে দাঁড়িয়ে তার অন্তরের অমৃত পিপাসাকে ছাপিয়ে যে কোটি ক্ষুধিত কামনার হাহাকার উঠেছিল মাটির মানুষ হেরম্বকে এখনো তা আচ্ছন্ন করে রেখেছে। তার দেহ শোকে অবসন্ন, মৃত্তিকার কীটদংশনে বিপন্ন তার মন।
‘আমার আজ কি হয়েছে জান?’–আনন্দ বলল।
হেরম্ব জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘বল, শুনছি।’
‘সকাল থেকে আমার অশুচি মনে হয়েছে। কেবলি ছোট কথা মনে হয়েছে, হীন অশুদ্ধ ভাব মনে এসেছে। রাগে হিংসায় ঘেন্নায় আমি অস্থির হয়ে পড়েছি। ঠিক যেন নরকবাস করেছি। সারাটা দিন। এমন কষ্ট পেয়েছি আমি! যে ছিল অবোধ নিষ্পাপ শিশু, আজ সে আত্মজ পাপে মাথা হেঁট করল, তাই তোমাকে বলছিলাম সন্ধ্যার পর আমার কাছে থেক, কোথাও যেও না। আমি নিচে নেমে গেছি, আমাকে তুমি তুলে নিতে পার?’
প্রথম দিন পূর্ণিমা রাত্রে নাচ শেষ করে আনন্দ যে অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করেছিল এখন তার নতমুখে তেমনি একটা যন্ত্রণার আভাস দেখে হেরম্ব ভয় পেল।
‘এসব কি বলছি, আনন্দ?’
‘মুখ দেখে বুঝতে পারছি না এখনো আমার মন নোংরা হয়ে আছে? একটা ভালো কথা ভাবতে পারছি না। আমার মনে এক ফোঁটা শান্তি নেই।’
হেরম্ব নির্বোধের মতো কথা খুঁজে খুঁজে বলল, ‘ঈর্ষায় তো এরকম হয় না, আনন্দ।’
আনন্দ বিরসা কণ্ঠে বলল, ‘কে বলেছে। ঈর্ষা–শুধু ঈর্ষা হলে তো বীচতাম, আমি সবদিক দিয়ে খারাপ হয়ে গেছি। একটু আগে কি ভাবছিলাম জান?’
‘কি ভাবছিলে?’
‘দেখ, বলতে আমার বুক ফেটে যাচ্ছে।’
‘ফাটবে না, বল।’
আনন্দ আঙুল দিয়ে মেঝেতে দাগ কাটতে কাটতে বলল, ‘বলা আমার উচিত নয়। অন্য মেয়ে হয়তো বলত না। তুমি তো জান আমি অন্য মেয়ের সঙ্গে বেশি মিশি নি। বলা অন্যায় হলে রাগ কোরো না, আমায় ক্ষমা কোরো। দেখ, আমি এত ছোট হয়ে গেছি, একটু আগে তোমাকে খারাপ লোক মনে করেছিলাম।’
আনন্দ যে তার ঠিক কি ধরনের মানসিক অপরাধের কথা স্বীকার করছে হেরম্ব বুঝতে পারল না। তার মনে হল আনন্দের কথায় সুপ্রিয়া সংক্রান্ত কোনো ইঙ্গিত আছে। আনন্দ না বুকুক তার ঈর্ষারই হয়তো একটা শোচনীয় রূপ। তবু কথাটা স্পষ্টভাবে না বুঝে সে কিছু বলতে সাহস পেল না। একটু উদ্বেগের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করল, ‘কেন তা ভাবলে?’
‘তা জানি না। আমার মনে হল আমাকে দেখে তোমার লোভ হয়েছিল। তাই আমাকে ভুলিয়েছ, আমার ছেলেমানুষের সুযোগ নিয়ে।’
হেরম্ব আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘তোমায় দেখে কার লোভ হবে না, আনন্দ? আমারও হয়েছিল। সেজন্য আমি খারাপ লোক হব কেন?’
‘লোভ হয়েছিল বলে নয়, শুধু লোভ হয়েছিল বলে। আমায় দেখে তোমার শুধু লোভ হয়েছিল, আর কিছু হয় নি?’
‘অর্থাৎ আমার ভালবাসা-টাসা সব মিছে?’
আনন্দ মুখ তুলে তিরস্কার করে বলল, ‘রাগ করবে না বলে রাগ করছ যে?’
‘রাগ করব না, এমন কথা আমি কখনো বলি নি।’
আনন্দের চোখ ছলছল করে এল। সে এবার মাথা নিচু করে বলল, ‘ঝগড়া করবার সুযোগ পেয়ে তুমি ছাড়তে চাইছ না। আমি গোড়াতেই বলি নি আমি ছোটলোক হয়ে গেছি? আমার একটা খারাপ অসুখ হলে কি তুমি এমনি করে ঝগড়া করবে?’
হেরম্বের কথা সত্য সত্যই রুক্ষ হয়ে উঠেছিল। সে গলা নরম করে বলল, ‘ঝগড়া করি নি, আনন্দ। তুমি আমার সম্বন্ধে যা ভেবেছ তাতেও আমি রাগ করি নি। তুমি নিজেকে কি যেন একটা ঠাওরে নিয়েছ, আমার রাগের কারণ তাই। তুমি কি ভাব তুমি মানুষ নও, স্বর্গের দেবী? কখনো খারাপ চিন্তা তোমার মনে আসবে না? মানুষের মনে হীনতা আসে, মানুষ সেজন্য আত্মগ্লানি ভোগ করে, কিন্তু এই তুচ্ছ সাময়িক ব্যাপারে তোমার মতো বিচলিত কেউ হয় না।’
আনন্দ বিবৰ্ণ মুখে বলল, ‘আমার কি ভয়ানক কষ্ট হচ্ছে যদি জানতে —’
‘জানি। হওয়া কিন্তু উচিত নয়। আজ তুমি একবার আমাকে বললে তোমার ভয় হচ্ছে, আমাদের ভালবাসা বুঝি মরেই গেল।–এখন বলছ আমি তোমাকে লোভ করেছি, ভালবাসি নি। এসব চিত্তচাঞ্চল্য, আনন্দ, বিচলিত হয়ে এ সমস্তকে প্রশ্ৰয় দিতে নেই।’
আনন্দ আবার মুখ তুলেছিল, তার তাকাবার ভঙ্গি দেখে হেরম্বের মন উদ্বেগে ভরে গেল। আনন্দ তাকে চিনছে, আনন্দের দামি দামি ভুল যেন ভেঙে যাচ্ছে একে একে, তার বিস্ময়ের, বেদনার সীমা নেই। হেরম্ব নিজের ভুল বুঝে সভয়ে স্তব্ধ হয়ে গেল। তার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? এ কথা তার স্মরণ নেই যে, তার মতো আনন্দ আজ বাইরের পৃথিবীতে বেড়াতে যায় নি, পরম সহিষ্ণুতায় আলো ও অন্ধকারের যে সমন্বয় নিজের মধ্যে করে নিয়ে পৃথিবীর মানুষ ধৈৰ্য ধরে থাকে আনন্দের কাছে সে সহিষ্ণুতার নাম পরাজয়? সুপ্রিয়ার আবির্ভাবের আগে সে নিজে কি মন নিয়ে এখানে দিন কাটাচ্ছিল হেরম্বের সে কথা মনে পড়ে। এখানে আসবার আগে মনের সেই উদাত্ত উৰ্ব্বগ অবস্থা তার কল্পনাতীত ছিল। কি সেই বিপুল একক পিপাসা–প্রশান্ত, নিবিড়, অনির্বচনীয়। এইখানে গৃহকোণে বসে সমগ্র অভিজাত মনোধর্মের বিরাট সমন্বয়ে চেতনার সেই অনাবিল নিরবচ্ছিন্ন পুলক-স্পন্দন, বিশ্বের এক প্রান্তের ভাঙা কুটির থেকে অন্য প্রান্তের রাজপ্রাসাদ পর্যন্ত প্রসারিত হৃদয়ে নিখিল-হৃদয়ের জীবনোৎসব – অনন্ত, উদার উপলব্ধির মেলা! সেই মনে ছোট স্নেহ, ছোট মমতাকে কে খুঁজে পেয়েছে? সে মনের আলো ছিল দিন, অন্ধকার ছিল রাত্রি–অঙ্গনে বিছানো এক টুকরো রোদ আর তরুতলের ক্ষীণ ছায়ার যোগাযোগ আগের মতো মনের আলো-ছায়ার খেলা সাঙ্গ হয়ে যেত না। সুপ্রিয়াকে মনে করতে হলে সেই মন নিয়ে হেরম্বকে শহরের ধূলিভরা পথে পথে বেড়াতে হত। আর আজ সুপ্রিয়ার কাছ থেকে পরিবর্তিত, ছোট মমতায় ছোট সুখদুঃখে উদ্বেলিত মন নিয়ে এসে সে কি বলে এত সহজে আনন্দের মনের বিচার করে রায় দিচ্ছে?
হেরম্বের অনুশোচনার সীমা রইল না। তাই আনন্দ যখন বলল, ‘তোমার আজ কি হয়েছে, তুমি কিছুই বুঝতে চাইছ না কেন?’—তখন সে বিহ্বলের মতো আনন্দের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, কথা বলতে পারল না।
আনন্দ তাকে বুঝিয়ে দেবার চেষ্টা করে বলল, ‘দেখ তুমি প্রথম যেদিন এলে সেদিন থেকে আমি যেন কেমন হয়ে গিয়েছিলাম। জেগে ঘুমিয়ে আমি যেন স্বপ্ন দেখতাম। সব সময় একটা আশ্চর্য সুর শুনছি, নানা রকম রঙিন আলো দেখছি, একটা কিসের ঢেউয়ে আস্তে আস্তে দোলা খাচ্ছি–বিস্ফারিত চোখে হেরম্বের দিকে চেয়ে আনন্দ মাথা নাড়ল–‘বলতে পারছি না যে! আমি যে সব ভুলে গেছি!’
তার ভুলে যাওয়ার অপরাধ যেন হেরম্বের এমনি তীব্রস্বরে সে হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল, ‘কেন ভুলে গেলাম? কেন বলতে পারছি না?’
হেরম্ব অস্ফুট স্বরে বলল, ‘ভোলো নি, আনন্দ। ওসব কথা মুখে বলা যায় না।’
কিন্তু আনন্দ একান্ত অবুঝ–‘কেন বলা যাবে না? না বললে তুমি যে কিছু বুঝবে না। সব কি রকম স্পষ্ট ছিল জােন? আমার এক এক সময় নিশ্বাস ফেলতে ভয় হত, পাছে সব শেষ হয়ে যায়।’
হেরম্ব কথা বলে না। উত্তেজিত আনন্দও অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে শান্ত হয়।
‘আমার আশপাশে কি ঘটত ভালো জ্ঞান ছিল না। কলের মতো নড়াচড়া করতাম। তারপর যেদিন থেকে মনে হল আমাদের ভালবাসা মরে যাচ্ছে সেদিন থেকে কি কষ্ট যে পাচ্ছি! আচ্ছা! শোন, তোমার কি খুব গরম লাগছে?’
‘না, আজ তো গরম নেই!’
আনন্দ উঠে এসে বলল, ‘দেখ, আমি ঘেমে নেয়ে উঠেছি। আমার কি হয়েছে?’
হেরম্ব গভীর বিষণ্ণ মুখে বলল, ‘শান্ত হয়ে বোসো। তোমার জ্বর হয়েছে।’
ধীরে ধীরে রাত্রি বেড়ে চলে। আশপাশে অসংখ্য ঝিঝি আর ব্যাঙের ডাক শোনা যায়। আনন্দকে সান্ত্বনা ও শান্তি দেবার দুঃসাধ্য প্রয়াস একবার প্রাণপণে করে দেখবার জন্য হেরম্বের ঝিমানো মন মাঝে মাঝে সচেতন হয়ে উঠতে চায়। কিন্তু আজ কোথায় সেই উদ্ধত উৎসাহ, অদম্য প্রাণশক্তি! চিন্তা কষ্টকর, জিহ্বা আড়ষ্ট, কথা সীসার মতো ভারি। মুখ খুঁজে সর্বনাশকে বারণ করা ছাড়া আর যেন উপায় নেই। স্বৰ্গ চারিদিকে ভেঙে পড়ুক। মোহে অন্ধ রক্তমাংসের মানুষের অমৃতের পুত্র হবার স্পর্ধা ধুলায় লুটিয়ে যাক।
প্রেম? মানুষের নব ইন্দ্ৰিয়ের নবলব্ধ ধর্ম? সে সৃষ্টি করেছে। এবার যে পারে বাঁচিয়ে রাখুক। তার আর ক্ষমতা নেই।
আনন্দ কাঁদ-কাঁদ হয়ে বলেছিল, ‘তুমিও আমায় ভাসিয়ে দিলে?’
হেরম্ব শ্ৰান্তস্বরে বলেছিল, ‘কাল সব ঠিক হয়ে যাবে, আনন্দ।’
এ স্পষ্ট প্রতারণা। কিন্তু উপায় কি?
আজ রান্না হয় নি। কিন্তু সেজন্য হেরম্বের আহারের কোনো ত্রুটি হল না। ফল, দুধ এবং বাসি মিষ্টির অভাব আশ্রমে কখনো হয় না, ভাতের চেয়ে এ সব আহার্যের মর্যাদাই এখানে বেশি, মালতীর স্থায়ী ব্যবস্থা করা আছে। আনন্দ প্রথমে কিছু খেতে চাইল না। কিন্তু হেরম্ব তার ক্ষুধার সঙ্গে তার মানসিক বিপর্যয়ের একটা সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করায় রাগ করে একরাশ খাবার নিয়ে সে খেতে বসিল।
হেরম্ব বলল, ‘সব খাবে?’
‘খাব।’
‘তোমার সুমতি দেখে খুশি হলাম, আনন্দ!’
সে চিৎ হয়ে শুয়ে চোখ বোজামাত্র আনন্দ সব খাবার নিয়ে বাইরে ফেলে মুখ-হাত ধুয়ে এল। হেরম্বের বালিশের পাশে এলাচ লবঙ্গ ছিল, একটি এলাচ ভেঙে অর্ধেক দানা সে হেরম্বের মুখে পুঁজে দিল। বাকিগুলি নিজের মুখে দিয়ে বলল, ‘আমি শুতে যাই?’
হেরম্ব চোখ মেলে বলল, ‘যাও।’
যেতে চাওয়া এবং যেতে বলা তাদের আজ উচ্চারিত শব্দগুলির মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে রইল।
হেরম্ব ভেবেছিল আজ বুঝি তার সহজে ঘুম আসবে। দেহমানের শিথিল অবসন্নতা অল্পক্ষণের মধ্যেই গভীর তন্দ্রীয় ড়ুবে যাবে। কিন্তু কোথায় ঘুম? কোথায় এই সকাতর জাগরণের অবসান? ঘরের কমানো আলোর মতো স্তিমিত চেতনা একভাবে বজায় থেকে যায়, বাড়েও না কমেও না। হেরম্ব উঠে বাইরে গেল। মালতী আজ তার নিজের ঘর ছেড়ে অনাথের ঘরে আশ্রয় নিয়েছে, মালতীর ঘরে শিকল তোলা। আনন্দই বোধহয় সন্ধ্যার সময় এ ঘরে একটি প্রদীপ জুেলে দিয়েছিল, জানালা দিয়ে হেরম্বের চোখ পড়ল। তেল নিঃশেষ হয়ে প্রদীপের বুকে দপূদপ্ত করে সলতে পুড়ছে। নিজের ঘর থেকে লণ্ঠন এনে হেরম্ব চোরের মতো শিকল খুলে মালতীর ঘরে ঢুকল। আলমারিতে ছিল মালতীর কারণের ভাণ্ডার, কিন্তু সবই সে প্রায় আজ অনাথের ঘরে সঙ্গে নিয়ে গেছে। খুঁজে খুঁজে কাশীর একটি কাজকরা ছোট কালেরঙের মাটির পাত্রে হেরম্ব অল্প একটু কারণ পেল। তাই এক নিশ্বাসে পান করে আবার চুপি চুপি ঘরের শিকল তুলে নিজের ঘরে ফিরে গেল।
কিন্তু মালতীর কারণে নেশা আছে, নিদ্রা নেই। হেরম্বের অবসাদ একটু কমল, ঘুম এল না। বিছানায় বসে জানোলা দিয়ে সে বাইরে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইল।
এমন সময় শোনা গেল মাতলীর ডাক। হেরম্ব এবং আনন্দ দুজনের নাম ধরে সে ফাটিয়ে চিৎকার করছে।
দুজনে তারা প্রায় একসঙ্গেই মালতীর ঘরে প্রবেশ করল। অনাথের প্রায় আসবাবশূন্য পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ঘরখানা মালতী এক বেলাতেই নোংরা করে ফেলেছে। সমস্ত মেঝেতে কাদামাখা পায়ের শুকনো ছাপ, এক কোণে অভুক্ত আহাৰ্য, এখানে-ওখানে ফলের খোসা ও আমের আঁটি। একটি মাটির পাত্র ভেঙে কারণের স্রোত নর্দমা পর্যন্ত গিয়েছিল, এখনো সেখানে খানিকটা জমা হয়ে আছে। ঘরে তীব্ৰ গন্ধ।
কিন্তু মালতীকে দেখেই বোঝা গেল বেশি কারণ সে খায় নি। তার দৃষ্টি অনেকটা স্বাভাবিক, কথাও স্পষ্ট।
বলল, ‘একা, আমার ভয় করছে, হেরম্ব।’
হেরম্ব জিজ্ঞাসা করল, ‘কিসের ভয়?’
মালতী বলল, ‘তা জানি নে, হেরম্ব, ভয়ে আমার হৃৎকম্প হচ্ছিল? তোমরা এ ঘরে শোও।’
হেরম্ব অবাক হয়ে বলল, ‘তার মানে?’
মালতী বলল, ‘মানে আবার কি, মানে? বলছি আমার ভয় করছে, একা থাকতে পারব না, আবার মানে কিসের? ঝাটা এনে ঘরটা একটু ঝাঁট দিয়ে বিছানা পাত, আনন্দ।’
হেরম্ব বলল, ‘আনন্দ আপনার কাছে থাক, আমার থাকবার দরকার নেই।’
মালতী বলল, ‘না বাপু না, আনন্দ থাকলে হবে না। ও ছেলেমানুষ, আমার ভয় করবে।’
হেরম্ব আনন্দের মুখের দিকে তাকাল। আনন্দের নির্বিকার মুখ থেকে কোনো ইঙ্গিত পাওয়া গেল না। হেরম্ব বলল, ‘তাহলে সবাই অন্য ঘরে যাই চলুন। এ ঘরে শোয়া যাবে না।’
মালতী রেগে বলল, ‘তুমি বড় বাজে বক, হেরম্ব। বাহাদুরি না করে যা বলছি তাই কর দিকি। যা, আনন্দ, ঝাঁটা নিয়ে আয়।’
ঝাঁটা এনে আনন্দ ঘর ঝাঁট দিল। মালতীর নির্দেশমতো মন্দিরের দিকে জানালা ঘেঁষে হেরম্বের বিছানা হল। মা’র অবাধ্য হয়ে মালতীর বিছানা থেকে যতটা পারে দূরে সরিয়ে শুধু একটি মাদুর পেতে আনন্দ নিজের বিছানা করল। মালতীর অনুযোগের জবাবে রুক্ষস্বরে বলল, ‘আমি কারো কাছে শুতে পারি না।’
যে যার শয্যায় আশ্ৰয় গ্ৰহণ করলে মালতী কাল, ‘সজাগ থেকে ঘুমিও, হেরম্ব, ডাকলে যেন সাড়া পাই।’
হেরম্ব বলল, ‘সজাগও থাকব, ডাকলে সাড়াও পাবেন, এরকম ঘুম ঘুমোব কি করে? তার চেয়ে আমি বসে থাকি।’
মালতী ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলল, ‘ইয়ার্কি দিও না, হেরম্ব। আমার এদিকে মাথার ঠিক নেই, উনি ঠাট্টা জুড়লেন!’
হেরম্ব বিনা চেষ্টাতেই সজাগ হয়ে রইল। দুটি নারীকে এভাবে পাহারা দিয়ে ঘুমানোর চেয়ে জেগে থাকাই সহজ।
ঘর স্তব্ধ হয়ে থাকে। আনন্দ নিজের আঁচলে মুখ ঢেকে শুয়েছে; লন্ঠনের আলো দেয়ালে তার যে ছায়া ফেলেছে তাকে মানুষের ছায়া বলে চেনা যায় না। অল্পক্ষণের মধ্যেই ঘরে কে ঘুমিয়েছে কে জেগে আছে টের পাওয়া অসম্ভব হয়।
মালতী আস্তে আস্তে হেরম্বের সাড়া নেয়। —‘হেরম্ব?’
‘ভয় নেই, জেগেই আছি।’
‘আচ্ছা, বল দিকি একটা কথা। মানুষকে খুঁজে বার করতে হলে কি করা উচিত?’
‘খুঁজতে বার হওয়া উচিত।’
‘যাবে, হেরম্ব? ক’দিন দেখ না একটু খোঁজ-টোজ করে। খরচ যা লাগে আমি দেব।’
হেরম্ব নির্মম হয়ে বলল, ‘মাস্টারমশায় কি ছোট ছেলে যে খুঁজে পেলে ধরে আনা যাবে? আপনি তো চেনেন। তাকে। ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো কাজ তাকে দিয়ে করানো যায়?’
মালতী খানিকক্ষণ চুপ করে থাকে।
’হেরম্ব?’
‘বলুন, শুনছি।’
পারছে না? ক্ষ্যাপা মানুষ ঝোকের মাথায় চলে গিয়ে হয়তো আফসোস করছে। কেউ গিয়ে ডাকলেই আসবে?’
হেরম্ব এবারো নির্মম হয়ে বলল, ‘এমনি যদিও-বা আসেন, খোঁজাখুঁজি করে বিরক্ত করলে একেবারেই আসবেন না।’
মালতীর কণ্ঠে হেরম্ব কান্নার আভাস পেল।
‘তোমার মুখে পোকা পড়ােক, হেরম্ব, পোকা পড়ুক। তুমিই শনি হয়ে এ বাড়িতে ঢুকেছ। তুমি যেই এলে অমনি একটা লোক গৃহত্যাগী হল। কই আগে তো যায় নি।’
হেরম্ব চুপ করে থাকে। আনন্দ মৃদুস্বরে বলে, ‘যুমোও না, মা।’
মালতী তাকে ধমক দিয়ে বলে, ‘তুই জেগে আছিস বুঝি? আমাদের পরামর্শ শুনছিস?’
‘তোমার পরামর্শের চোটেই যে ঘুম আসছে না।’
জবাবে স্বাভাবিক কড়া কথার বদলে মালতী হঠাৎ মিনতির সুরে যা বলল শুনে হেরম্বের বিস্ময়ের সীমা রইল না।
‘আনন্দ, আয় না। মা, আমার কাছে এসে একটু শো। আয়।’
হেরম্ব আরো বিস্মিত হল আনন্দের নিষ্ঠুরতায়।
‘রাতদুপুরে পাগলামি না করে ঘুমোও তো।’
হেরম্বের অভিজ্ঞতায় মালতী আজ প্রথম ধমক খেয়ে চুপ করে রইল। এতক্ষণে হেরম্বের মাথার মধ্যে ঝিমুঝিম্ করছে। এ আশ্ৰম অভিশপ্ত; মালতীর যুগব্যাপী অন্ধ অতৃপ্ত ক্ষুধায় এখানকার বাতাসও বিষাক্ত হয়ে আছে। গভীর নিশিতে এখানে মালতীর সঙ্গে একঘরে জেগে থাকলে দুদিনে মানুষ পাগল হয়ে যাবে।
অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে মালতী ডাকল, ‘আনন্দ, ঘুমুলি?’
আনন্দ সাড়া দিল না।
মালতী উঠে বসল।’হেরম্ব?’
‘জেগেই আছি।’
‘আমার বুকে আগুন জ্বলছে, হেরম্বা। আমি এখানে নিশ্বাস নিতে পারছি না। দিম আটকে আসছে।’
‘একটু ধৈৰ্য না ধরলে–’
মালতী বাধা দিয়ে বলল, ‘কিছু বোলো না, হেরম্ব। একবার ওঠ দিকি। শব্দ কোরো না বাপু, মেয়ের ঘুম ভাঙিও না।’
মালতী উঠে দাঁড়াল। আনন্দের কাছে গিয়ে সে ঘুমন্ত মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইল পলকহীন চোখে। হেরম্ব উঠে এলে ফিসফিস করে বলল, ‘দেখ, মুখ ঢেকে ঘুমিয়েছে। ওকে না জাগিয়ে মুখ থেকে কাপড় সরাতে পার হেরম্ব? একবার মুখখানা দেখি।’
হেরম্ব সন্তৰ্পণে আনন্দের মুখ থেকে আঁচল সরিয়ে দিল। খানিকক্ষণ একদৃষ্টি আনন্দের মুখ দেখে হাত দিয়ে তার চিবুক ষ্টুয়ে মালতী চুমো খেল। তারপর পা টিপে টিপে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
থামল সে একেবারে বাড়ির বাইরে বাগানে। হেরম্ব তাকে অনুসরণ করল নীরবে।
মালতী আঁচল থেকে চাবি খুলে হেরন্ধের হাতে দিল।
‘আমি চললাম, হেরম্ব।’
হেরম্ব শান্তকণ্ঠে বলল, ‘চলুন, আমিও যাচ্ছি।’
মালতী বলল, ‘তুমিও ক্ষেপলে নাকি? আনন্দ একা রইল, তুমিও যাচ্ছি। আনন্দের চেয়ে আমার জন্যই তোমার মায়া বুঝি উথলে উঠল?’
হেরম্ব বলল, ‘আপনার সম্বন্ধে আমার একটা দায়িত্ব আছে। রাতদুপুরে আপনাকে আমি একা যেতে দিতে পারি না। ’
মালতী বলল, ‘পাগলামি কোরো না, হেরম্ব। প্রথম বয়সে একবার রাতদুপুরে ঘর ছেড়েছিলাম, মা-বাবা ভাই-বোন কেউই ঠেকাতে পারে নি, পোড় খেয়ে খেয়ে এখন তো পেকে গেছি, তুমি আমাকে আটকাবে? শুধু যে নিজের জ্বালায় চলে যাচ্ছি তা ভেব না, হেরম্ব! আমার মতো মা কাছে থাকলে আনন্দ শান্তি পাবে না। আমি কারণ খাই, আমার মাথা খারাপ, আমার স্বভাব বড় মন্দ, হেরম্ব! তোমার মাস্টারমশাই আমাকে একেবারে নষ্ট করে দিয়েছে।’
হেরম্ব চুপ করে থাকে। আকাশে খণ্ড খণ্ড মেঘ বাতাসের বেগে ছুটে চলছিল। এখানে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের ডাক শোনা যায়।
‘আনন্দকে দেখা হেরম্ব। দুঃখ দিও না ওকে। তোমার মাস্টারমশায়ের হাতে আমার যে দুর্দশী হয়েছে ওরা যেন সে রকম না হয়। টাকা-পয়সা যা রোজগার করেছি। সব রেখে গেলাম। আমার ঘরে যে কাঠের সিন্দুক আছে, তাতে সোনার গয়না আর রূপার বাসন কোসন পাবে। সবচেয়ে বড় চাবিটা সিন্দুকের তালার। মন্দিরে ঠাকুরের আসনের পিছনে একটা ঘটিতে সতেরটা মোহর আছে, ঘরে নিয়ে রেখা। এখানে বেশি দেরি না করে তোমরা কলকাতায় চলে যেও। ঠাকুরের জন্যে ভেব না, আমি পূজার ব্যবস্থা করব।’
হেরম্ব জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি যাচ্ছেন কোথায়?’
মালতী বলল, ‘আনন্দকে বোলো আমি তার বাবাকে খুঁজতে গেছি। আর তোমার মাস্টারমশায় যদি কোনোদিন ফেরে তাকে বোলো আমি গোঁসাই ঠাকুরের আশ্রমে আছি, দেখা করতে গেলে কুকুর লেলিয়ে দেব।’
মালতী হাঁটতে আরম্ভ করল। বাগানের গেটের কাছে গিয়ে বলল, ‘ঘরে যাও হেরম্বা। আর শোন, আনন্দকে তুমি বিয়ে করবে তো?’
‘করব।’
‘কোরো তাতে দোষ নেই। আনন্দ জন্মাবার আগেই আমাদের বৈরাগী মতে বিয়ে হয়েছিল, হেরম্ব–সাক্ষী আছে। একদিন কেমন খেয়াল হল, দশজন বৈষ্ণব ডেকে অনুষ্ঠানটা করে ফেললাম। আনন্দকে তুমি যদি সমাজে দশজনের মধ্যে তুলে নিতে পার, হেরম্ব-’ অন্ধকারে মালতী ব্যাকুল দৃষ্টিতে হেরম্বের মুখের ভাব দেখবার চেষ্টা করল—‘ভদ্রলোকের সংসর্গ আলাদা।’
হেরম্ব মৃদুস্বরে বলল, ‘তাই, মালতী-বৌদি।’
ঘরে ফিরে গিয়ে হেরম্ব দেখল, আনন্দ বিছানায় উঠে বসে আছে।
হেরম্ব বিসল।
‘তোমার মা মাস্টারমশায়কে খুঁজতে গেছেন, আনন্দ।’
আনন্দ বলল, ‘জানি।’
‘তুমি জেগে ছিলে নাকি?’
‘এ বাড়িতে মানুষ ঘুমোতে পারে? এ তো পাগলা-গারদ।’
আনন্দের কথার সুরে হেরম্ব বিস্মিত হল। সে ভেবেছিল মালতী চলে গেছে শুনলে আনন্দ একটু কাঁদবে। মালতীকে এত রাত্রে এভাবে চলে যেতে দেওয়ার জন্য তাকে সহজে ক্ষমা করবে না। কিন্তু আনন্দের চোখে সে জলের আভাসটুকু দেখতে পেল না। বরং মনে হল কোমল উপাধীনে মাথা রেখে ওর যে দুটি চোখের এখন নিদ্ৰায় নিমীলিত হয়ে থাকার কথা, তাতে একটা অস্বাভাবিক দীপ্তি দেখা দিয়েছে।
‘কোন ভোলাচ্ছ আমাকে? আমি সব জানি। আমিও উঠে গিয়েছিলাম।’
হেরম্ব আনন্দের দিকে তাকাতে পারল না, আনন্দকে একটু মমতা জানাবার সাধও সে চেপে গেল। সে বড় বেমানান হবে। কাল হয়তো সে আনন্দের চোখে চোখে তাকিয়ে কথা বলতে পারবে, আনন্দের চুল নিয়ে নাড়াচাড়া করতে পারবে, আনন্দের বিবৰ্ণ কপোলে দিতে পারবে স্নেহচুম্বন। আজ স্নেহের চেয়ে সহানুভূতির চেয়ে বেখাপ্পা কিছু নেই। যতক্ষণ পারা যায়। এমনি চুপচাপ বসে থেকে, বাকি রাতটুকু আজ তাদের ঝিমিয়ে ঝিমিয়েই কাটিয়ে দিতে হবে। আজ রাত্রি প্রভাত হলে সে আর একটা দিনও এই অভিশপ্ত গৃহের বিষাক্ত আবহাওয়ায় বাস করবে না। আনন্দের হাত ধরে যেখানে খুশি চলে যাবে।
আনন্দ কথা বলল। ’আমি কি ভাবছি জান?’
‘কি ভাবছ আনন্দ?’
‘ভাবছি, আমারও যদি একদিন মা’র মতো দশা হয়!’
হেরম্ব সভয়ে বলল, ‘ওসব ভেব না, আনন্দ।‘
আনন্দ তার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ল। রুদ্ধ উত্তেজনায় তার দুচোখ জ্বলজ্বল করছে, তার পাণ্ডুর কপোলে অকস্মাৎ অতিরিক্ত রক্ত এসে সঙ্গে সঙ্গে বিবৰ্ণ হয়ে যাচ্ছে।
‘মানুষের ভাগ্যে আমার আর বিশ্বাস নেই। তোমার সঙ্গে আমার ক’দিনের পরিচয়, এর মধ্যে আমার শান্তি নষ্ট হয়ে গেছে। দুদিন পরে কি হবে কে জানে।’
‘শান্তি ফিরে আসবে, আনন্দ।’
আনন্দ বিশ্বাস করল না, ‘আসবে কিন্তু টিকবে কি! হয়তো আমিও একদিন তোমার দুচোখের বিষ হয়ে দাঁড়াব। প্রথম দিন তুমি আর আমি কত উঁচুতে উঠে গিয়েছিলাম, স্বর্গের কিনারায়। আজ কোথায় নেমে এসেছি!’
‘আমরা নামি নি, আনন্দ, সবাই মিলে আমাদের টেনে নামিয়েছে। আমরা আবার উঠিব। লোকালয়ের বাইরে আমরা ঘর বাঁধব, কেউ আমাদের বিরক্ত করতে পারবে না।’
আনন্দ বলল, ‘বিরক্ত আমরা নিজেদের নিজেরাই করব। আমরা মানুষ যে!’ আনন্দ কি মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা হারিয়েছে? স্বপ্ন ক্ষুন্ন হবার অপরাধে মানুষকে কি ঘৃণা করতে আরম্ভ করল? জেনে নিল বৃহত্তর জীবনে মানুষের অধিকার নেই? বিগত-যৌবন প্রেমিকের কাছে প্রতারিত হয়ে তাই যদি আনন্দ জেনে থাকে। তবে তার অপরাধ নেই, কিন্তু এই সাংঘাতিক জ্ঞান বহন করে সে দিন কাটাবে কি করে? হেরম্বের বুক হিম হয়ে আসে–কোথায় সেই প্রেম? পূর্ণিমা তিথির এক সন্ধ্যায় সে যা সৃষ্টি করেছিল? আজ রাত্রিটুকুর জন্য সেই অপার্থিব চেতনা যদি সে ফিরে পেত। হয়তো কোনো এক আগামী সন্ধ্যায়। সেই পূর্ণিমার সন্ধ্যাকে সে ফিরে পাবে। আজ সে আনন্দকে সান্ত্বনা দেবে কি দিয়ে?
হেরম্বের মুখের দিকে খানিকক্ষণ ব্যাকুল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে আনন্দ চোখ বুজল। ’ঘুমোবে?’–হেরম্ব বলল।
আনন্দ বলল, ‘না।’
হেরম্ব বলল, ‘না। যদি ঘুমোও, আনন্দ, তবে আমাকে নাচ দেখাও। তোমার নাচের মধ্যে আমাদের পুনর্জন্ম হোক।’
আনন্দ চোখ মেলে বলল, ‘নাচব?’
চোখের পলকে রক্তের আবির্ভাবে আনন্দের মুখের বিবর্ণিতা ঘুচে গেছে। হেরম্ব তা লক্ষ করল। তার বুকেও ক্ষীণ একটা উৎসাহের সাড়া উঠল।
‘তাই কর, আনন্দ, নাচ। আমরা একেবারে ঝিমিয়ে পড়েছি, না? আমাদের জড়তা কেটে যাক।’
আনন্দ উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘তাই ভালো। নাচই ভালো। উঃ ভাগ্যে তুমি বললে! নাচতে পেলে আমার মনের সব ময়লা কেটে যাবে, সব কষ্ট দূর হবে।’
আনন্দ টান দিয়ে আলগা খোঁপা খুলে ফেলল।—’চল উঠোনে যাই। আজ তোমাকে এমন নাচ দেখাব তুমি যা জীবনে কখনো দেখ নি। দেখ তোমার রক্ত টগবগা করে ফুটবে। এই দেখ, আমার পা চঞ্চল হয়ে উঠেছে।’
আনন্দের এই সংক্রামক উন্মাদনা আনন্দের নৃত্যপিপাসু চরণের মতো হেরম্বের বুকের রক্তকে চঞ্চল করে দিল। শক্ত করে পরস্পরের হাত ধরে তারা খোলা উঠোনে গিয়ে দাঁড়াল। সকালে ঝড়বৃষ্টির পর যে রোদ উঠেছিল তাতে উঠান শুকিয়ে গিয়েছিল, তবু উঠোনভরা বর্ষাকালের বড় বড় তৃণের স্পর্শসিক্ত ও শীতল। আনন্দের নাচের জন্যই নিশীথ আকাশের নিচে এই সরস কোমল গালিচা বিছানো আছে।
‘কি নাচ নাচবে, আনন্দ? চন্দ্ৰকলা?’
‘না। সে তো পূর্ণিমার নাচ। আজ অন্য নাচ নাচব।’
‘নাচের নাম নেই?’
আছে বৈকি। পরীনৃত্য। আকাশের পরীরা এই নাচ নাচে। কিন্তু আলো চাই যে?’
‘আলো জ্বালাচ্ছি, আনন্দ।’
ঘরে ঘরে অনুসন্ধান করে হেরম্ব তিনটি লণ্ঠন আর একটি ডিাবরি নিয়ে এল। আলোগুলি জ্বেলে সে ফাঁকে ফাঁকে বসিয়ে দিল।
আনন্দ বলল, ‘এ আলোতে হবে না। আরো আলো চাই। তুমি এক কাজ কর, রান্নাঘরে কাঠ। আছে, কাঠ এনে একটা ধুনি জ্বেলে দাও।’
‘ধুনি আনন্দ?’
আনন্দ অধীর হয়ে বলল, ‘কোন দেরি করছ? কথা কইতে আমার ভালো লাগছে না। ঝোক চলে গেলে কি করে নাচব?’
আনন্দ উত্তেজনায় থারথার করে কাঁপছিল। তার মুখ দেখে হেরম্বের একটু ভয় হল! ক’দিন থেকে যে বিষণ্ণতা আনন্দের মুখে আশ্রয় নিয়েছিল তার চিহ্নও নেই, প্রাণের ও পুলকের উচ্ছস তার চোখে-মুখে ফুটে বার হচ্ছে! দাঁড়িয়ে আনন্দকে দেখবার সাহস হেরম্বের হল না। রান্নাঘর থেকে সে এক বোঝা কাঠ নিয়ে এল।
আনন্দ বলল, ‘আরো আন, যত আছে সব।’
‘আর কি হবে?’
‘নিয়ে এস, আরো লাগবে। যত আলো হবে নাচ তত জমবে যে। পরী কি অন্ধকারে নাচে?’
রান্নাঘরে যত কাঠ ছিল বয়ে এনে হেরম্ব উঠানে জমা করল। আনন্দের মুখে আজ মিনতি নেই, অনুরোধ নেই, সে আদেশ দিচ্ছে। মনে মনে ভীত হয়ে উঠলেও প্রতিবাদ করার ইচ্ছা হেরম্ব দমন করল। আনন্দ যা বলল নীরবে সে তাই পালন করে গেল। মালতীর ঘর থেকে এক টিন ঘি এনে কাঠের স্তুপে ঢেলে দিয়ে কিন্তু সে চুপ করে থাকতে পারল না।
‘ভয়ানক আগুন হবে, আনন্দ!’
আনন্দ সংক্ষেপে বলল, ‘হোক।’
‘বাড়িতে আগুন লেগেছে ভেবে লোক হয়তো ছুটে আসবে।’
‘এদিকে লোক কোথায়? আর আসে তো আসবে। দাও, এবার জ্বেলে দাও।’
আগুন ধরিয়ে হেরম্ব আনন্দের পাশে এসে দাঁড়াল। বিরাট যজ্ঞােনলের মতো ঘূতসিক্ত কষ্ঠের স্তুপ হু হু করে জ্বলে উঠল। সমস্ত উঠোন সোনালি আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আনন্দ উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, ‘এই না হলে আলো!’
ওদিকের প্রাচীর, এদিকের বাড়ি উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। ঘি-পোড়া গন্ধ বাতাসে ভেসে কতদূরে গিয়ে পৌঁছল। কেউ জানে না। হেরম্ব আনন্দের একটা হাত চেপে ধরল।
হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আনন্দ বলল, ‘তুমি সিঁড়িতে বসে নাচ দেখ। আমায় ডেক না, আমার সঙ্গে কথা বোলো না।’
হেরম্ব সিঁড়িতে গিয়ে বসল। আনন্দ আগুনের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। হেরম্বের মনে হল আগুনের সে এত কাছে দাঁড়িয়েছে যে তার চোখের সামনে সে বুঝি ঝলসে পুড়ে যাবে। কিন্তু নৃত্যের বিপুল আয়োজন, আনন্দের উন্মত্ত উল্লাস তাকে মূক করে দিয়েছিল। আগুনের তাপে আনন্দের কষ্ট হচ্ছে বুঝেও সে কাঠের পুতুলের মতো বসে রইল।
খানিকক্ষণ আগুনের সান্নিধ্যে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে একে একে কাপড়জামা খুলে আনন্দ অর্ঘ্যের মতো আগুনে সমৰ্পণ করে দিল। তার গলায় সোনার হারে তাবিজ ছিল, বাহুতে তুলসীর মালা ছিল, হাতে ছিল সোনার চুড়ি। একে একে খুলে তাও সে আগুনে ফেলে দিল। নিরাবরণ ও নিরাভরণ হয়ে সে যে কি নৃত্য আজ দেখাবে হেরম্ব কল্পনা করে উঠতে পারল না।
আনন্দ ধীরে ধীরে আগুনকে প্রদক্ষিণ করতে আরম্ভ করল। অতি মৃদু তার গতি, কিন্তু চোখের পলকে ছন্দ চোখে পড়ে। এও সেই চন্দ্ৰকলা নাচেরই ছন্দ। সে নাচে তিল তিল করে আনন্দের দেহে জীবনের সঞ্চার হয়েছিল, আজ তেমনি ক্রমপদ্ধতিতে সে গতি সঞ্চয় করেছে। গতির সঙ্গে ধীরে ধীরে প্রকাশ পাচ্ছে তার অঙ্গ প্রত্যঙ্গের লীলাচাঞ্চল্যের সমন্বয়, যার জন্ম চোখে পড়ে না, শুধু মনে হয় সমগ্র নৃত্যের রূপ ক্রমে ক্রমে পরিস্ফুট হচ্ছে। প্রথমে আনন্দের দুটি হাত দেহের সঙ্গে মিশে ছিল, হাত দুটি যখন আগুনের কম্পিত আলোয় তরঙ্গ তুলে তুলে দুই দিগন্তের দিকে প্রসারিত হয়ে গেল, তখন আনন্দের পরিক্রমা অত্যন্ত দ্রুত হয়ে উঠেছে। এখন যে তার নৃত্যের পরিপূর্ণ বিকাশ, এই নৃত্যকে যে না চেনে তারও তা বোঝা কঠিন নয়। হেরম্ব বড় আরাম বোধ। করল। তার অশান্তি ও উদ্বেগ, শ্ৰান্তি ও জড়তা মিলিয়ে গিয়ে পরিতৃপ্তিতে সে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। : আনন্দের প্রথম নৃত্যের শেষে মন্দিরের সামনে সে প্রথম যে অলৌকিক অনুভূতির স্বাদ পেয়েছিল, আবার, তার আবির্ভাবের সম্ভাবনায় হেরম্বের দেহ হাল্কা, মন প্রশান্ত হয়ে গেল।
কিন্তু এবারো অকস্মাৎ আনন্দের নৃত্য থেমে গেল। আগুনের আরো নিকটে সে থমকে দাঁড়াল। আগুন। এখন তার মাথা ছাড়িয়ে আরো উঁচুতে উঠেছে, আনন্দকেও মনে হচ্ছে আগুনের শিখা! পরীক্ষণে আনন্দ কাত হয়ে সেই বিপুল ব্যাপক যজ্ঞানলে ঢলে পড়ল।
হেরম্ব নিশ্চল হয়ে তাকিয়ে রইল। কিছু করার নেই। আনন্দ অনেক আগে মারা গেছে। শুধু চিতায় উঠবার শক্তিটুকুই তার বজায় ছিল।