দিদিমাসির জিন (Didimasir Jin) : 13
কদম গাছের পেছন থেকে কৃষ্ণ-টৃষ্ণ বেরোতে পারে। নিদেন সুদামা বা সুবল সখা, কিন্তু অশোক সাঁতরা যে বেরোতে পারে এ কথা তীর্ণা স্বপ্নেও ভাবেনি। সে ভীষণ অবাক হয়ে পশ্চাদপসরণ করল।
—ও কী? ও কী? পালাচ্ছেন কেন? পালালে আমার নিজেকে খুব খারাপ লোক মনে হবে। অশোক সাঁতরা বেশ সপ্রতিভভাবে বলল— গোলঞ্চ গাছ দেখছিলেন দেখুন না!
—এটা গুলঞ্চ নয়। এটা কদম।
—ওই হলো। যাঁহা গোলঞ্চ তাঁহা কদম— বলতে বলতে অশোক সাঁতরা তীর্ণার দিকে ক্যামেরা তাক করতে লাগল।
—ও কী? আমার ছবি নিচ্ছেন কেন? অনুমতি নিয়েছেন? তীর্ণা ভীষণ রেগে গেছে।
—রিপোর্টাররা ছবি তুলতে কক্ষনো অনুমতি নেয় না। কারণ ওটা না পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। বুঝলেন রাংতাদিদি?
—আমার নাম রাংতা নয়। আমি কারুর দিদি-টিদিও নই।
—আহা রাগ করছেন কেন? আপনারা দুজনেই এমন একরকম যে কে রাংতা আর কে পান্তা আমার বড় গুলিয়ে যায়।
তীর্ণার এত রাগ হল যে সে তৎক্ষণাৎ পেছন ফিরে নিজেদের আস্তানার পথ ধরল। প্রথমত পান্তা। তার মা বিয়ের আগে থেকে ভেবে ভেবে তার এমন একখানা নাম দিয়েছে যে সব্বাই শুনে এক বাক্যে বলে বাঃ, আর এই নোকটা তাকে পান্তা বলল? তা ছাড়া রাংতার সঙ্গে তার মিল? কোন খানটায়? রাংতার বয়-ছাঁট, তার স্টেপ, রাংতা ফর্সা, সে কালো। রাংতার ফীচার্স একটু ভোঁতা ভোঁতা যে যাই বলুক, তার গুলো চোখা চোখা। খালি দৈর্ঘ্যে দুজনে মাথায় মাথায়। আর এই লোকটা স্বচ্ছন্দে দুজনকে এক দেখল? পেছন থেকে কে বলল— এই ধরুন ঘুঘু আর পায়রায় যেমন মিল? কিংবা ধরুন ময়ূরে আর মাছরাঙায়, কিংবা বাঘে আর বেড়ালে, বা নেকড়ে আর অ্যালসেশিয়ানে!
আড়চোখে চেয়ে তীর্ণা দেখল অশোক সাঁতরা তার পেছু পেছু আসছে। তার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই বলল— ছবি নেওয়া হয়ে গেছে। কদমতলায় কৃষ্ণা। ক্যাপশনটা কেমন?
তীর্ণা প্রচণ্ড রেগে বলল— আর ফটোগ্রাফারের নামটাও লিখবেন তো?
—নিশ্চয়, ছবিটা তো প্রাইজ পাচ্ছে, এটা রিপোর্টের ছবি নয় তো!
—তা হলে সেই নামের জায়গায় লিখবেন পান্তভূত।
অশোক মাথা চুলকে বলল, পুরোটা লিখব না বলছেন? ‘পান্তভূতের জ্যান্ত ছানা’ না বললে কি পরিচয়টা কমপ্লিট হয় দিদি?
তীর্ণা এবার এমন তড়বড় করে হাঁটতে লাগল, এবং এমন এঁকেবেঁকে যে তাকে হাঁটা না বলে ছোটাই বলা উচিত। যতক্ষণ না অশোক সাঁতরা গাছের ফাঁকে অদর্শন হল সে এইভাবে চলল, তারপর হঠাৎ হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল।
উঃ!!!
তীর্ণার চোখে জল এসে গেছে। একটা ছোট ইঁটের টুকরো উঠে আছে মাটি থেকে। হাঁটুটা বোধ হয় ছেচে গেল। সে উঠতে পারছে না। চেষ্টা করছে অথচ পারছে না।
—আমি কি আপনাকে কোনও সাহায্য করতে পারি?— চেনা-চেনা গলা না? গোপালগোবিন্দ কোথা থেকে বেরিয়ে এসে তীর্ণাকে একেবারে পাঁজাকোলা করে তুলে নিল।
—বলুন এবার কোথায় পৌঁছে দিতে হবে।
তীর্ণা প্রথমটা বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ পরে সে নিজের কণ্ঠস্বর ফিরে পেল। বলল আমায় নামিয়ে দিন। আমি একাই যেতে পারবো।
—আপনার পা ভীষণ মচকেছে, পারবেন না।
—না পারলে হামাগুড়ি দিয়ে যাবো।
—হামা দিতে হলে তো আপনাকে মাটিতে নামতে হবে, যেই না নামবেন এমন ঝনকা দিয়ে উঠবে যে …
—আপনি এখানে কী করে এলেন?
—যেভাবে সবাই আসে? আপনিই বা কী করে এলেন? যদি জিজ্ঞেস করি।
এমন সুন্দর শীতের দিন, শান্তিনিকেতন না দেখে কি আর ফেরা যায়? আপনিই বলুন না! এখন কোন দিকে যাবেন সেটা বলে দিন।
গাঁয়ের হাট্টাকাট্টা জোয়ান বটে গোপালগোবিন্দটা। অমন ম্যাদামারা মুখ হলে কী হবে! গায়ে খুব জোর। অগত্যা তীর্ণা তাকে রতনপল্লীর বাংলোবাড়ির পথ বাৎলে দিতে থাকে।
—হ্যাঁ হ্যাঁ, ডাইনে চলুন, ওই যে দেওয়ালে বড় বড় সব ছবি আঁকা … ওইটে হচ্ছে ল্যান্ডমার্ক। এবারে ঢুকুন, রাস্তাটা এবড়োখেবড়ো দেখে-দেখে,— হেই হেই হ্যাট হ্যাট।
গোপালগোবিন্দ বলল— আপনি শেষ পর্যন্ত আমাকে হ্যাট হ্যাট করলেন? ছিঃ দিদি!
—কী আশ্চর্য! আপনাকে হ্যাট হ্যাট করব কেন? গরু আসছে দেখছেন না? মমতাদিদের গরু, চরতে বেরিয়েছে।
—মমতাদি কে?
—কে জানে কে! সবাই বলে ওইরে মমতাদিদের গরু বেরিয়েছে, তাই আমিও বলি।
—সব গরুকেই বলেন নাকি?
—গরু আবার আলাদা করে চেনা যায় না কি? তা ছাড়া আপনি গেঁয়ো ভূতের মতো আমাকে দিদি-দিদি করবেন না, আমার একটা নাম আছে। —তীর্ণা। বুঝলেন! মাতৃপ্রদত্ত নাম।
—আচ্ছা তীর্ণাদেবী …
—আপনি কি উপন্যাসের ডায়ালগ দিচ্ছেন? আমার মাকে কলেজ ডেজ-এ একজন কাজলদেবী বলে ডেকেছিল বলে তার কী হয়েছিল জানেন?
—কী?
—বন্ধুরা নাম পাল্টে দিয়েছিল।
—মলাট তো আর পাল্টায়নি …ইস … সরি … আপনার সামনে …
—সরি? কিসের জন্যে? মলাট পাল্টানো? ওসব আমি আমরা জানি, ব্যবহারও করি।
—ব্যবহারও করেন?
—মাঝে মাঝে।
—ভালো ভালো, তা আপনার মাকে যে দেবী বলে ডেকেছিল, বন্ধুরা তার নাম কী দিয়েছিল? জানা হল না তো!
—দেবীপদ।
—আসল নামটা কী ছিল?
—হরিপদ।
—কী অদ্ভুত মিল!
—কিসের মিল?
—আমার বাবারও নাম ছিল হরিপদ, অ্যাফিডাভিট করে সেটাকে দেবীপদ করে নিয়েছিলেন।
—তাই নাকি? তা হলে তো আমার মায়ের সঙ্গে আপনার বাবার আলাপ করিয়ে দিতে হচ্ছেই! কে জানে কোনও কলেজি রোম্যান্সের সন্ধান পাওয়া যাবে কি না!
—আচ্ছা তীর মানে তীর্ণা। আপনার মায়ের সরলবালা বোস বলে কোনও আত্মীয় আছে?
—আপনি কী করে জানলেন?— তীর্ণা তড়াক করে জি.জি-র কোল থেকে নামতে গিয়ে প্রায় ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠল। আর সেই ডাকে সামনের বাংলোর ভেতর থেকে ফাদার জেনকিনস আর এডিথ বেরিয়ে এলো।
—কী হয়েছে আমার সোনাটি, মণিটি! ফাদার জেনকিনস ব্যস্ত হয়ে এগিয়ে এলেন। তীর্ণাকে ধরে ধরে তাঁর পায়ের কাছে নামিয়ে দিয়ে গোপালগোবিন্দ বলল— কিছু না, মগডালে বউ-কথা-কও দেখতে গিয়ে পা মচকে গেছে। চুনে হলুদে গরম করে দিতে বলুন, কদিনেই সেরে যাবে।
তীর্ণা অবাক হয়ে দেখল এডিথের একপাশে অশোক সাঁতরা, আর এক পাশে গোপালগোবিন্দ গিয়ে দাঁড়াচ্ছে।
—গোপালগোবিন্দ বলল— উই অ্যারেস্ট ইউ।
এডিথ একবার এর দিকে আর একবার ওর দিকে চেয়ে বলল— অ্যারেস্ট। মানে গ্রেপ্তার? কেন? কারণ কী? হোয়াট ইজ দা রিজন?
অশোক সাঁতরা বলল— অন চার্জেজ অফ হাই ট্রিজন এগেনস্ট আওয়ার কানট্রি।
গোপালগোবিন্দ গোঁয়ারগোবিন্দর মতো বলল— অন চার্জেজ অফ স্মাগলিং হেরইন ইন অ্যান্ড আউট অফ আওয়ার কানট্রি।
ফাদার জেনকিনস ভ্যাবচ্যাকা খেয়ে বললেন— অপেক্ষা করো, অপেক্ষা করুন।
প্রোফেসর মিত্র? ও প্রোফেসর মিত্র?
দ্বিতীয়বারের ডাকটা খুব জোরালো হওয়ায় অভিধানে-মগ্ন গঙ্গাপ্রসাদ বেরিয়ে এলেন।
কাঁদো কাঁদো মুখে ফাদার জেনকিনস বললেন— আপনি এবার সত্য সত্য মিত্র হোন অধ্যাপক ফ্রেন্ড সার, এরা আমার শিষ্যা এডিথকে কোতল করছে।
—কোতল! সর্বনাশ! তাড়াতাড়ি আসতে গিয়ে গঙ্গাসপ্রসাদ একটা সিঁড়ি ফসকে চিৎপটাং হয়ে পড়ে গেলেন।
তীর্ণা প্রায় কেঁদে ফেলে বলল— বাঁবাঁ, এই নিয়ে দুঁবার হলো। তুমি কি পঁপাত হবার জন্যেই শান্তিনিকেতন এসেছো?
গঙ্গাপ্রসাদ ফাদার জেনকিনসের সাহায্যে উঠতে উঠতে বললেন— তুইও তো পড়েছিস দেখছি, জিন যাবে কোথায়, বল! তবে হ্যাঁ পুরোপুরি আমার ধাত পেতিস যদি তোরও সারা গায়ে ডানলোপিলো ফিট করা থাকত, পড়লেও চট করে লাগত না। কিন্তু চেহারায় তোর মায়ের জিন প্রবল, তাই পড়লেই পট-পটাং।
—অধ্যাপক বন্ধু, অধ্যাপক বন্ধু আপনি পারিবারিক সমস্যা বৈজ্ঞানিক সমস্যা ইত্যাদি এখন বিস্মৃত হোন, — ফাদার জেনকিনস করুণস্বরে আপীল করেন— এখন এখানে গুরুচণ্ডালি সমস্যা দেখা দিয়েছে, এডিথকে যে এরা নিয়ে যায়! এডিথ ওদিক থেকে একটা তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি চারদিকে হেনে বলল— হু ইজ অ্যারেস্টিং হুম? কে হচ্ছো আপনারা?
—আমরা সি আই ডি ডিপার্টমেন্ট থেকে আসছি,— অশোক সাঁতরা বুক ফুলিয়ে বলল।
—বলতে হচ্ছে না, বলতে হচ্ছে না, হোয়্যার আ ইয়ো ক্রেডেনশ্যালস? গেট দেম আউট! কুইক!
এ-পকেট ও-পকেট হাতড়ে সাঁতরা একটা কার্ড বার করে, এবং সেটাকে সবাইকার নাগালের বাইরে রেখে নাচাতে থাকে।
এডিথের দু হাত দুজনে ধরেছিল, কিন্তু এডিথ কী কায়দায় কে জানে ঝট করে ডান হাতটা মুক্ত করে কার্ডটা ছিনিয়ে নেয়। এবং জোরে জোরে পড়তে থাকে— ট্রাবল শুটার্স ডিটেকটিভ এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড।
পড়ে-উড়ে সে অট্টহাস্য হাসতে থাকে— স্ল্যুথ! প্রাইভেট! হেঃ হো, হাঃ হা, আমার বিরুদ্ধে আনফাউন্ডেড চার্জ আছে, তিন উইটনেস আছে। আমি ল জানি। তোমাদের স্যু করবো। ইয়র কম্প্যানি উইল হ্যাভ টু পে মি থ্রু দা নোজ। বুঝেছিলে?
—গোপালগোবিন্দ তখনও বলতে থাকে—নেভার দি লেস উই অ্যারেস্ট য়ু … এডিথ সিংহ কাপুর অন চার্জেজ অফ হাই ট্রিজন এগেনস্ট …
তীর্ণা চেঁচিয়ে বলে— গোঁয়ারগোবিন্দ।
—তুমাদের কার এনগেজ করার সাহস হল? বলো কুইক!
এডিথ গোপালগোবিন্দর মুখের সামনে একটা তুড়ি মেরে বলল— স্পিল আউট! ফাস্ট, ম্যান ফাস্ট!
ফাদার জেনকিনস বললেন— শীগ্র শীগ্র শীগ্রং কুরু, অধ্যাপক বন্ধু স্যানস্কৃটো উচ্চারণটা সাউথের হয়েছে তো? আমি মহান শ্রী পট্টাভি রাম শাস্ত্রীর শিষ্যর নিকট শিক্ষিত হচ্ছি।
এডিথ ততক্ষণে অশোক সাঁতরার কার্ড, ক্যামেরা ছিনিয়ে নিয়েছে এবং গোপালগোবিন্দকে বলছে— হে য়ু ডাবল গড, আ য়ু প্লান্টেড হিয়া! সে প্রাণপণে গোপালগোবিন্দকে নড়াবার চেষ্টা করেও পারছে না। শেষ কালে কী একটা প্যাঁচ মারল গোপালগোবিন্দ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ধড়াস করে পড়ে গেল যেন পা-ভাঙা পুতুল।
—নাও য়ু টেল আস হু এমপ্লয়েড য়ু।
—দুজনেই চুপ। তখন এডিথ বলল— ও রাইট, আমি বলছে। তুমাদের চাকরি দিচ্ছে ইদার দলজিৎ সিংহ অর মাধু কাপুর, রাইট?
গোপালগোবিন্দ উঠে দাঁড়িয়ে চুপ করে অশোকের দিকে চাইল। অশোক বলল— ঠিক আছে। এখন প্রাইভেট। কিন্তু অপরাধ প্রমাণ করতে পারলেই পুলিশের কাছে যেতে কতক্ষণ? তখন পুলিশ, কোর্ট। এখানকার পুলিশ আর কোর্ট তো জানো না? টাডার আসামী জেলে বন্দী থাকবে কদ্দিন তার ঠিক নেই! কোর্টে মামলা উঠতে উঠতে জন্ম কাবার।
—কাবা মেক্কায়, কাবায় আমার জন্ম হচ্ছে না। বুঝলেন মেশা?— এতক্ষণ ধরে ভালো বাংলা বলতে পেরে এডিথ গর্বে দশ হাত।
তীর্ণা ককাতে ককাতে বলল— দলজিৎ সিংহ আর মাধু কাপুর কে এডিথ?
—সাপোজড টু বি মাই পেরেন্টস অলদো আমি কারো রক্ত বইছি না, কারো জিন না।
—সে আবার কী?
—আমি সোমস্তটা ক্লীয়ার করবে, যখন তুমরা আমাকে সোরোলাওয়ালা বোসের কাছে নিয়ে যেতে পারছে।
গোপালগোবিন্দ সটান দাঁড়িয়ে উঠে বলল— আমিও যাচ্ছি। কারো চাদর মুড়ি দিয়ে নয়। সোজা সোজা হেঁটে হেঁটে যাবো।
অশোক সাঁতরা বলল— আমিও। ওই সরলা বোসই এদের দলপতি মক্ষিরানি। মিসেস বোসকে ধরতে পারলেই …
তার কথা শেষ হল না, একটা অদ্ভুত শব্দ। গঙ্গাপ্রসাদ কেমন লুটিয়ে লুটিয়ে পড়ছেন। তাঁর ভুঁড়ি কাঁপছে। শেষকালে তিনি কোনও মতে বললেন— বাবা জেনকিনস, আপনি আমায় একটু ধরুন, আমার পেটটা এবার ফেটে যাবে।
তখন বোঝা গেল গঙ্গাপ্রসাদ হাসছেন। একটু পরেই পায়ের ব্যথা ভুলে তীর্ণা সেই হাসিতে যোগ দিল।