Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » দানিয়েলকুঠির হত্যারহস্য || Syed Mustafa Siraj » Page 2

দানিয়েলকুঠির হত্যারহস্য || Syed Mustafa Siraj

টেবিলের একদিকে বিজন, রঞ্জন, শেখর ও সেলিম বসেছে, অন্যদিকে অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বসেছেন। বয়স ষাটের কোঠায়। মুখে সাদা গোঁফ-দাড়ি, মাথায় টাক, হাসিখুশি বুড়ো মানুষটির খ্যাতি অপরাধতাত্ত্বিক হিসেবে প্রচুর।

তাঁর ইলিয়ট রোডের বাসায় বসে বিজন বিবৃতি দিচ্ছিল। একই বিবৃতি পুলিশকেও সে দিয়েছে। দানিয়েল কুঠির জোড়া খুনের কিনারা এখনও করতে পারেনি পুলিশ। এমনকি চোরের কাণ্ড বলে চালানোর চেষ্টাও চলছে। সত্যি তো! চোর-ডাকাত ছাড়া আর কে খুন করবে গুপ্টাদম্পতিকে? কী চুরি হয়েছে, সেটা বলা কঠিন। আপাতদৃষ্টে তেমন কোন প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না। ঊর্মি। গহনা পরতেন সামান্যই। শুধু গলায় একটা দামী পাথরের হার ছিল, তা চোর নেয়নি। কানে বা হাতে যা সোনা ছিল, তাও ঠিকঠাক আছে!

আজকাল এত বেশি মানুষ খুন হয় যে পুলিশ তেমন আর গা করে না। নাক গলিয়ে অহেতুক ঝামেলা বরদাস্ত করতে চায় না তারা। কাজেই গুপ্টাদম্পতির হত্যাকাণ্ডের কিনারা বেশিদূর এগোয়নি।

কর্নেল মন দিয়ে শুনছিলেন বিজনের স্টেটমেন্ট। বিজন থামলে এবার বললেন–ঊর্মি বা মিলি সেনের ব্যাকগ্রাউন্ড জানা থাকলে খুনের কিনারা হত, এ বিষয়ে আমি আপনাদের সঙ্গে একমত ইয়ং ফ্রেন্ডস! কিন্তু পুলিশকে আজকাল কাজ করতে হলে প্রভাবশালী লোক কিংবা গোষ্ঠীর দরকার হয়। …বলে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে সকৌতুকে হেসে উঠলেন।

কর্নেলকে যাঁরা চেনেন, তাঁরাই জানেন–মানুষটি মোটেও বদমেজাজি গোমড়ামুখো গোয়েন্দা নন। যেমন খামখেয়ালি, তেমনি মিশুক আর কৌতুকপরায়ণ। বিশেষ করে একালের যুবক-যুবতীদের সঙ্গে চমৎকার মিশে যেতে পারেন।

বিজন বলল–কর্নেল, আপনি ঠিকই বলেছেন। কিন্তু এ খুনের ব্যাপারে আমরা চারজনে এক অদ্ভুত অবস্থায় পড়েছি। মোটেও এটা বরদাস্ত করতে পারছি না যে আমাদের নাকের জগায় এমন সাংঘাতিক কাণ্ড করে কেউ নিরাপদে কেটে পড়বে আর আমরা কিছু করতে পারব না।

শেখর বলল–রিয়্যালি কর্নেল! একটা কিছু না করলে আমাদের ভীষণ কষ্ট হবে।

রঞ্জন ও সেলিমও সায় দিল। –হ্যাঁ, ভীষণ কষ্ট পাব।

কর্নেল সকৌতুকে বললেন–আপনাদের বয়সের পক্ষে নিশ্চয় সেটা স্বাভাবিক। যৌবনের মূল্য যৌবন ছাড়া কেউ বুঝতে পারে না। তাছাড়া ঊর্মি দেবীর সেই দামী সেন্টও সম্ভবত একটা হিপ্নোটিক ব্যাপার–তাই না? আপনারা হিপ্নোটাইজড হয়ে পড়বেন, তাও কিছু দোষের নয়। আই এগ্রি ইতিহাসে ও পুরাণে সুন্দরীদের জন্যে অনেক বড় যুদ্ধ হয়ে গেছে!

বলে ফের হো হো করে হেসে উঠলেন। এ সময় তাঁর বিশ্বস্ত পরিচারক ষষ্ঠীচরণ ট্রেতে চা ও স্ন্যাক্স রেখে গেল। সবাই কাপ তুলে নিল। নিঃশব্দে কিছুক্ষণ চা খাওয়ার পর কর্নেল হঠাৎ বললেন–অচ্ছা বিজনবাবু, সেই সন্ধ্যা রাত্রে আপনারা কেউ কোন অস্বাভাবিক বা দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতো কিছু লক্ষ্য করেছিলেন কি? বেশ ভেবে বলবেন কিন্তু। যত তুচ্ছ হোক, এমন কোন ব্যাপার নজরে পড়েছিল?

বিজন একটু ভেবে বলল কই, তেমন কিছু তো…নাঃ। দেখিনি।

রঞ্জন বলল–আমিও দেখিনি।

শেখর বলল কই? আমার চোখে কিছু পড়েনি।

সেলিম বলল–না!

কর্নেল একটু হেসে বললেন–আপনারা প্রত্যেকেই কিন্তু ঠিক কথা বলছেন না ভাই!

ওরা চমকে উঠল। বিজন বলল–কেন কেন কর্নেল?

–আপনাদের স্টেটমেন্ট কিন্তু ভিন্ন কথা বলছে। আপনারা প্রত্যেকেই অন্তত একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার লক্ষ্য করেছিলেন!

ওরা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। সেলিম অস্ফুট স্বরে বলল– অস্বাভাবিক ব্যাপার!

-হ্যাঁ। মিঃ এবং মিসেস গুপ্টার সঙ্গে আপনাদের অন্তরঙ্গতা হয়েছিল। আপনারা যখন কুঠিবাড়িতে গেলেন, আশা করেছিলেন ওঁরা আপনাদের হইহল্লা শুনে বেরিয়ে এসে আপনাদের সঙ্গে আড্ডা দেবেন। আপনারা পৌঁছান সন্ধ্যা পৌনে ছটা নাগাদ। তারপর অত কাণ্ড হল, ওঁরা কেউ এলেন না। এটা আপনাদের অস্বাভাবিক লেগেছিল। তাই না?

এবার সবাই হইচই করে বলল–ঠিক, ঠিক। ঠিকই তো!

এবং সেজন্যেই বিজনবাবু ও রঞ্জনবাবু ওঁদের ঘরে গিয়ে হানা দেন!

বিজন বলল–সেটা তো বলেইছি। এছাড়া কিছু অস্বাভাবিক তো দেখিনি।

কর্নেল হাসলেন। ওকে, ফ্রেন্ডস। তাহলে এবার আমাদের সভা ভঙ্গ হোক। আপনাদের প্রয়োজন আমার নিশ্চয় হবে, তখন ডাকব। অপাতত আমি পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে দেখি, ওঁরা কী বলেন।

ওরা উঠে দাঁড়াল। সেলিম হতাশ মুখে বলল–পুলিশ কিছু করবে না কর্নেল!

কর্নেল সে বিষয়ে কোন মন্তব্য না করে হঠাৎ বললেন–আচ্ছা মিঃ সেলিম, আপনার সেই অবনীদা ভদ্রলোক কি এখনও আছেন কলকাতায়?

সেলিম বলল–না। ঘটনার পরদিন অর্থাৎ গতকাল দুপুরের ফ্লাইটে বোম্বে চলে গেছেন শুনেছি। কুঠিবাড়ি থেকে ফিরে ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে চেষ্টা করেছিলুম। হয়নি। ভীষণ ব্যস্ত মানুষ তো! হোটেল ছেড়ে এক বন্ধুর বাসায় উঠেছিলেন। ঠিকানা যোগাড় করে গেলুম, বেরিয়ে গেছেন ওখান থেকে। তারপর কাল দুপুরে ফোন করলুমবলল, রওনা হয়ে গেছেন।

কর্নেল বললেন–হুম! আচ্ছা, আপাতত এই।

ওরা বেরিয়ে গেলে কর্নেল কিছুক্ষণ জানালার কাছে দাঁড়িয়ে থাকলেন। সেই সময় ফোন বেজে উঠল। এগিয়ে এসে রিসিভার তুললেন–সত্যেন্দ্র নাকি? মেঘ না চাইতেই জল। আশ্চর্য যোগাযোগ বটে। এক্ষুণি তোমাকে রিঙ করব ভাবছিলুম।

কর্নেল, আমি বিপন্ন।

তুমি কি দানিয়েল কুঠির মার্ডার কেসের ব্যাপারে কথা বলছ?

–আশ্চর্য কর্নেল, আশ্চর্য!

কেন?

–আপনি নিশ্চয় টেলিপ্যাথি জানেন।

–নিছক দৈবাৎ যোগাযোগ বলতে পারো।

–যাকগে, শুনুন। আপনি কেসটার কতখানি জানেন, জানি না। গত রাত্রে হঠাৎ কেসটা ব্যারাকপুর পুলিশ লালবাজার ডিটেকটিভ ডিপার্টে পেশ করেছে। কারণ…

–কারণ মর্গের রিপোর্টে অস্বাভাবিক কিছু পাওয়া গেছে। কেসটা বার্গলারি নয়।

–আশ্চর্য, কর্নেল!

–একটু কম আশ্চর্য হওয়া ভাল, সত্যেন্দ্র।

–আমি আসছি, কর্নেল। পনের মিনিটের মধ্যেই।

এসো।…

কর্নেল একটু হেসে ফোন রাখলেন। আজকের সকালটা বেশ চমৎকার ছিল। সব গুলিয়ে গেল। আসলে সেই চিরকালের ধুরন্ধর হত্যাকারীটি তাকে নিয়ে অদ্ভুত খেলা করে চলেছে। একটি নির্মল বিশুদ্ধ সময়ের অংশও সে হত্যার রক্ত ছড়িয়ে লাল না করে ছাড়বে না। বয়স এদিকে বেড়ে যাচ্ছে। এই খেলায়। জড়িয়ে পড়তে আর ইচ্ছে করে না। অথচ ক্রমশ মানুষের জীবন এত মূল্যবান মনে হয়ে উঠছে যে জীবনবিরোধী ওই হন্তারক শক্তির বিরুদ্ধে লড়ে যেতে ইচ্ছে করছে ক্লান্তিহীনভাবে। এমন কোন সমাজ কি সম্ভব, যেখানে মানুষের এই ভয়ংকর বৃত্তিটা লোক পাবে? হননবৃত্তি যেন প্রকৃতির একটা আইন, যার নাম আমরা দিয়েছি পশুত্ব।

কিন্তু দেবত্ব বলেও একটা আইনকানুন প্রকৃতি মানুষের জন্য দিয়েছেন। পশুত্বের সঙ্গে তার লড়াই চলেছে আবহমানকাল ধরে। খ্রিস্টানিটিতে এই পশুত্বকেই বলা হয়েছে শয়তান। শয়তান অজর অমর। …

ঘণ্টা বাজল বাইরের ঘরের দরজায়। গোয়েন্দা বিভাগের ইন্সপেক্টর সত্যেন্দ্র ব্যানার্জির সাড়া পাওয়া গেল।

–হ্যাল্লো ওল্ড বস!

–এস সত্যেন্দ্র, তোমার ওই ফাইলটা দেখে অস্বস্তি হচ্ছে কিন্তু।

সত্যেন্দ্র তরুণ অফিসার। সে গোয়েন্দা বিভাগের অন্য অফিসারদের মতো গোমড়ামুখো নয়। প্রচণ্ড হাসতে পারে। কর্নেলের সঙ্গে কৌতুকে ও হাসিতে সে ছাড়া আর কেউ পাল্লা দিতে পারে না। সে বসে ফাইলটা রাখল। তারপর কপালের ঘাম মুছে বলল–অস্বস্তি হবেই। কারণ কে কবে শুনেছে যে ভিকটিমের দেহ খুবলে হত্যাকারী মাংস তুলে খেয়েছে!

–খেয়েছে! বল কী?

তাছাড়া কী? দানিয়েল কুঠির কেসটা চুরিচামারি বলেই মনে করা হচ্ছিল। লাশ দুটোর গায়ে মারাত্মক ক্ষতচিহ্ন, মেঝেয় রক্ত। দেখলে মনে হয়, ছোরাটোরা মারা হয়েছে। অথচ মর্গের রিপোর্টে বলছে–মোটেও তেমন কিছু নয়। মারাত্মক বিষ পটাসিয়াম সাইনায়েডই মৃত্যুর কারণ। গুপ্টা দম্পতির হাতের কাছে ছোট ছোট্ট টেবিলে মদের বোতল ছিল। গ্লাস দুটো মেঝেয় পড়ে ছিল–দুটোই ভেঙে গেছে। একটা গ্লাসের টুকরোয় লিপস্টিকের দাগ পাওয়া গেছে। তার মানে দুজনে মদের গ্লাসে চুমুক দিয়েই বিষক্রিয়ার ফলে ঢলে পড়ে। এবার অদ্ভুত ব্যাপার হল, মারা যাবার আন্দাজ ঘণ্টা দুই পরে কেউ মিঃ গুপ্টার পিঠ কোন ধারাল কিছুতে খুবলে মাংস তুলেছে। বিছানায় ঊর্মি গুপ্টার লাশটা কিন্তু যত্ন করে শোয়ানো ছিল। বিষক্রিয়ার পরে ওভাবে সটান চমৎকার শুয়ে থাকা সম্ভব নয় কারো পক্ষে। তারপর কেউ ওঁর বুকের কাপড় সরিয়ে একইভাবে কিছু কিছু মাংস খুবলে নিয়েছে। কিন্তু কুঠির সমস্ত ঘর তন্নতন্ন করে দেখা হয়েছে আজ সকালে। ফোরেনসিক এক্সপার্ট টিম ওখানে এখনও রয়েছে। ফোনে জানলাম, আর কোথাও এক ছিটে রক্ত,ওঁদের নজরে পড়েনি, কোন রকম ক্লও ওঁরা পাচ্ছেন না। কুকুর স্কোয়াডও কোন সুবিধে করতে পারেনি। শুধু বোঝা গেছে যে খুনী বাইরে থেকে এসেছিল।

ভাঙা গেলাস দুটোয় তাহলে সাইনায়েড পাওয়া গেছে?

–হ্যাঁ।

মৃত্যুর সময় ঠিক করতে পেরেছেন ডাক্তাররা?

–বিকেল পাঁচটার কাছাকাছি। তার আগে নয় এবং ছ’টার পরেও নয়! তারপর মাংস খুবলে নেওয়া হয়েছে সাড়ে সাতটার মধ্যেই। কারণ…

–পারুল অ্যাডভারটাইজার্সের ছেলেরা ঠিক সাড়ে সাতটায় লাশ দুটো আবিষ্কার করে!

–সে কী! আপনি কেমন করে জানলেন?

–জানি। পরে বলব’খন। আর কী ফ্যাক্ট আছে, বলো।

-ফ্যাক্ট আপাতত কিছু হাতে নেই। সব দিকে যোগাযোগের ব্যবস্থা করা হয়েছে। দুপুরের মধ্যে গুপ্টা ফ্যামিলির ব্যাকগ্রাউন্ড পেয়ে যাব, আশা করছি।

এবার বলো, আমি কী করতে পারি?

–আপনি আমার সঙ্গে বেরিয়ে পড়ুন কর্নেল, প্লিজ!

কর্নেল, একটু ভেবে নিয়ে বললেন–কেসটা বেশ ইন্টারেস্টিং। ঠিক আছে, চলো–বেরিয়ে পড়া যাক্। ইয়ে–ব্যারাকপুর যাচ্ছি আমরা, তাই না?

–হ্যাঁ কর্নেল। আপনারই থিওরি-হত্যাকাণ্ডের জায়গাটাই হত্যাকারীকে সনাক্ত করে।

সারা পথ আর মুখ খুললেন না কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। চুরুটও খেলেন না অভ্যাসমতো, গম্ভীর হয়ে বসে থাকলেন। গভীর চিন্তায় মাঝে মাঝে এমনভাবে ওঁকে ডুবে যেতে দেখেছে সত্যেন্দ্র ব্যানার্জি। এসময় ডাকলে সাড়া পাওয়া যায় না।

দানিয়েলকুঠির সামনে কিছু পুলিশ ছিল। উত্তরের বারান্দায় ফেরেনসিকের লোকেরা ফিতে দিয়ে মাপজোক করছিলেন। দু’জনে কাছে যেতেই ওঁরা কাজ থামিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। সত্যেন্দ্র পরিচয় করিয়ে দেবার আগেই কর্নেল তার সমবয়সী একজনের দিকে হাত বাড়িয়ে বলে উঠলেন–হ্যালো, হ্যালো! ডাঃ পট্টনায়ক যে!

কর্নেল সরকার! আপনাকেও তাহলে পাকড়াও করা হল!

ফোরেনসিক বিশেষজ্ঞ ডাঃ সীতানাথ পট্টনায়ক জড়িয়ে ধরলেন কর্নেলকে। তারপর কর্নেল বললেন–আপনাদের কাজের ব্যাঘাত ঘটালাম নিশ্চয়, ডাঃ পট্টনায়ক?

–মোটেও না। আসলে কী জানেন? ফ্যাক্টস একটা মার্ডারের কেসের পক্ষে মুখ্য উপাদান। কিন্তু ফ্যাক্টস থেকে ডিডাকশান করে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানোটাই হল কৃতিত্বের পরিচয়। ডিডাকশানের বোধ তো অনেকের থাকে না। একই ফ্যাক্টস থেকে একজন একরকম সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেন, আরেকজন তার উল্টোও যেতে পারেন এসব ব্যাপারে আপনার কৃতিত্ব অস্বীকার করে কে? ইউ আর ওয়েলকাম, কর্নেল সরকার।

সত্যেন্দ্র কর্নেল আর ডাঃ পট্টনায়ক এবার ভিতরে ঢুকলেন। প্রথমে বসার। ঘর। বেশ বড়। যথারীতি ফায়ার প্লেস আছে। সেকালে ইউরোপীয়রা এই গ্রীষ্মপ্রধান দেশেও স্বদেশের পরিবেশ তৈরি করে বাস করতেন। জানালাগুলো এমনভাবে তৈরি যে বন্ধ করে দিলে ঘর ঘন অন্ধকার হয়ে যায়। এখন সব খোলা ছিল। ঘরে আলো ছিল যথেষ্ট। কর্নেল ঘরের ভিতরটা দেখছেন লক্ষ্য করে, এগিয়ে গেলেন সোফা সেটটার দিকে। তারপর একটা কিছু লক্ষ্য করে বললেন–ঘরের কোন কিছু আশা করি নাড়াচড়া করা হয়নি।

–মোটেও না। সব ঠিকঠাক আছে।

কর্নেল হাঁটু দুমড়ে সোফার নীচের দিকটা দেখতে থাকলেন। তারপর বললেন–দারোয়ান বাহাদুর আর তার বউ তো দক্ষিণের পাঁচিলের কাছে। থাকে?

–হ্যাঁ।

–এখানে আসার পর কেউ মিঃ গুপ্টার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল কি না বলেনি? নিশ্চয় তাদের স্টেটমেন্ট নেওয়া হয়েছে?

হয়েছে। কাকেও আসতে দেখেনি ওরা।

এলেও ওদের চোখে পড়ার কথা নয়!

–কিন্তু গেট তো দক্ষিণে! ওদের ঘরের কাছাকাছি।

–আমি দেখলুম উত্তরের পাঁচিলে একজায়গায় একটা ভাঙা জায়গা রয়েছে। যে কেউ ওপথে এদিকে আসতে পারে। ওরা টের পাবে না।

সত্যেন্দ্র চিন্তিতমুখে বলল–তা পারে!

আমার মনে হচ্ছে, এই সোফাটায় কেউ বসেছিল–যে বাইরের লোক। কারণ, তার জুতোর তলায় সুরকি গুঁড়ো ছিল। ..বলে কর্নেল পকেট থেকে একটা আতস কাঁচ বের করে পরীক্ষা করতে থাকলেন। –হুঁউ! তাই বটে। তুমি প্লিজ দেখে এসো তো সত্যেন্দ্র, ওই ভাঙা পাঁচিলের ফাঁক গলিয়ে এলে জুতোর তলায় সুরকি গুঁড়ো লাগে কি না।

সত্যেন্দ্র বেরিয়ে গেল। ডাঃ পট্টনায়ক বললেন–ওটা আমিও লক্ষ্য করেছি। তবে মিঃ গুপ্টার কর্মচারী আনন্দবাবু আসতে পারেন!

–পারেন। কিন্তু ওইভাবে আসেননি–তা চোখ বুজে বলা যায়। কেন লুকিয়ে আসবেন তিনি? আনন্দবাবুর ব্যাকগ্রাউন্ডে কিছু আছে বলে মনে হয় না। অন্তত আমার যা শোনাজানা আছে!

ডাঃ পট্টনায়ক একটু হাসলেন। কোন গ্যারান্টি নেই কর্নেল। সন্দেহ সকলকেই করা উচিত। যে চার বন্ধু খুনের দিনে পিকনিক করেছিলেন বা লাশ দেখতে পান, তাঁদেরও সন্দেহের আওতায় রাখা কর্তব্য।

রাইট, রাইট! বলে কর্নেল সোফার চারপাশটা ঘুরে দেখতে থাকলেন। সদর দরজা অব্দি মেঝে পরীক্ষা করলেন।

এই সময় সত্যেন্দ্র ফিরে এসে নিজের জুতোর তলায় আঙুল ঘষে বলল কর্নেল, ইউ আর কারেক্ট।

কর্নেল ও ডাঃ পট্টনায়ক পরীক্ষা করে মাথা নাড়লেন। তারপর কর্নেল হঠাৎ ফায়ার প্লেসের দিকে এগিয়ে গেলেন। তারপর কী একটা কুড়িয়ে নিলেন। ডাকলেন–সত্যেন্দ্র শোন, এবং আতস কাঁচে সেটা পরীক্ষা করতে থাকলেন।

সত্যেন্দ্র এগিয়ে গিয়ে বলল–কী ব্যাপার?

–মিঃ গুপ্টা কী ব্র্যান্ডের সিগারেট খেতেন জানা আছে তোমাদের?

হা। ব্যারনেস-৪০। বিদেশে রপ্তানি হয়। বেশ দাম আছে।

–কিন্তু এই সিগারেটটা সে ব্র্যান্ড নয়। এটা ফাইভ স্টার। এও দামী কিন্তু।

–ফাইভ স্টার। এ তো ফিল্ম মহলে খুব চালু সিগারেট!

–সত্যেন্দ্র প্লিজ। তোমাকে একটু কষ্ট করতে হবে।

বলুন না!

–তুমি লোকাল থানা থেকে তোমার অফিসে কনট্যাক্ট করো।

অফিসকে বলো এখনই বোম্বে পুলিসকে কনট্যাক্ট করতে। প্রখ্যাত ফিল্ম ডিরেক্টের অবনী ভরদ্বাজের এ ব্যাপারে কিছু বলার থাকতে পারে। ওঁর একটা বিবৃতি চাই। কলকাতা এসে কোথায়-কোথায় গেছেন বা কী করেছেন, সব ওঁর নিজের মুখের কথায় জানা দরকার। তারপর বিবৃতিটা তোমরা ভেরিফাই করবে।

–আসার আগে সে কাজটা করে এসেছি। রাত্রে বিজনবাবু নামে পারুল অ্যাডের সেই ভদ্রলোকের স্টেটমেন্ট পড়েই আমার সন্দেহ তীব্র হয়েছিল। এই; খুনের সঙ্গে ফিল্ম হিরো রূপেশকুমারের খুন হওয়ার কোন যোগসূত্র না থেকে পারে না।

কর্নেল ওর পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললেন–চলুন ডাঃ পট্টনায়ক। আমরা এবার বেডরুমে যাই।

বেডরুমটা মাঝারি শুধু পূবদিকটা ছাড়া জানালায় আলো আসার উপায় নেই। একটা ডবলবেড খাট রয়েছে। চাদর ইত্যাদি সবকিছু ফোরেনসিকের জিম্মায় চলে গেছে। গ্লাসের টুকরো, মদের বোতলটাও। কর্নেল মেঝেয় হাঁটু দুমড়ে আতস কাঁচটা পেতে অদ্ভুত ভঙ্গিতে পরীক্ষা করছিলেন। ডাঃ পট্টনায়কের ঠোঁটে একটু হাসি দেখা গেল। তিনি বললেন কর্নেল কি এ ঘরে সেই সুরকির ধুলো আশা করছেন?

কর্নেল পাল্টা হেসে বললেন–জানি না।

কিছুক্ষণ পরীক্ষা করার পর তিনি উঠে দাঁড়ালেন। তারপর এগিয়ে সংলগ্ন বাথরুমটা দেখলেন। অব্যবহার্য হয়ে পড়ে ছিল বোঝা যায়। সম্প্রতি সামান্য ব্যবহার করা হয়েছে। কোমোড বেসিন সব ভাঙা। জলের একটা চৌবাচ্চা আছে। সেটা ধুয়ে পরিষ্কার করা হয়েছে কিন্তু জল নেই। জলের পাইপে মরচে ধরে রয়েছে। একটা বড় প্ল্যাস্টিকের বালতিতে তলায় কিছু জল রয়েছে, সম্ভবত বাইরে থেকে আনা হয়েছে।

এবার বাঁদিকে আরেকটা ঘরে ঢুকলেন। কিচেন কাম ডাইনিং ঘর। তার পাশে স্টোর। স্টোরের ভিতর ঢুকে কর্নেল বললেন–মাই গুনেস! ওপাশে জানালাটা ভাঙা। যে কেউ বাইরে থেকে ঢুকে পড়তে পারে। কিংবা পালাতে পারে। ডাঃ পট্টনায়ক, এসব ঘরের দরজা কি ভোলা ছিল?

–সেটাই তো অদ্ভুত। ভোলা ছিল। তার মানে খুনী ওই পথে পালিয়েছে। অবশ্য আমরা কোন সুরকি পাইনি কোথাও! বলে ডাঃ পট্টনায়ক হেসে উঠলেন।

কর্নেল বললেন–প্রিয় ডঃ পট্টনায়ক! পটাসিয়াম সাইনায়েড যে দিয়েছে, সেই খুনী কিন্তু। তার অমনভাবে না পালালেও চলত।

–তাহলে কি মাংস খুবলেছে যে, সে আলাদা লোক বলে মনে করেন?

–এখনও আমি কিছু মনে করি না ডাঃ পট্টনায়ক। শুধু সম্ভাবনার কথাই বলছি। পটাসিয়াম সাইনায়েড মেশানো মদ কিন্তু বোতলে নেই–গ্লাসে পাওয়া গেছে, তার মানে গ্লাস দুটোর তলায় আগে থেকে রাখা ছিল বিষ, অথবা মদ ঢালার পর মেশানো হয়েছে। আগে থেকে রাখার চান্স শয়ে এক। সেটার চেয়ে বরং মদ ঢালবার পর মেশানোটাই সম্ভাব্য।

তাহলে তৃতীয় একজন ছিল মদ্যপানের সময়।

–রাইট। এবং তার কোন গ্লাস আমরা পাচ্ছি না। অথচ খুনী নিজে মদ না খেলে বিষ মেশানোর চান্স নেবে কীভাবে? এটাই অবাক লাগছে।

–আপনি কি তাহলে বলতে চান যে সেই ফিল্ম ডিরেক্টর ভদ্রলোকও ওদের মদ্যপানের সময় উপস্থিত ছিলেন এবং তিনিই খুনী?

–কিছু বলতে চাইনি ডাঃ পট্টনায়ক। শুধু সম্ভাবনাগুলো নেড়েচেড়ে দেখছি। তবে একটা ব্যাপার পরিষ্কার যে লোকটি পাঁচিলের ফোকর গলিয়ে এসেছিল, সে ফিল্মের নোক হতেও পারে–চান্স অন্তত সেভেনটি ফাইভ পারসেন্ট। দুই? সে অসম্ভব ধূর্ত। তাই আসার সময়ই জুতো পরে ঢুকলেও খালি পায়ে বেরিয়েছে-সদর দরজার পথেই হোক কিংবা ওই স্টোরের পিছনকার জানালা। গলিয়েই হোক। কারণ, জুতোর সুরকির ছাপ বেডরুমে নেই। আবার, বসবার ঘরের জুতোর ছাপগুলো সব ঘরে ঢোকার, বেরিয়ে যাবার নয়। তিন : সে গুপ্টা দম্পতির সঙ্গে মদ খেতে বসেছিল, তা না হলে বিষ মেশানোর সুযোগ করা খুবই কঠিন। এবং বিষ মেশাতে হলে ওঁদের অন্যমনস্কতা থাকা চাই। আমার ধারণা, এমন সিরিয়াস ব্যাপার নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল–যাতে উভয়েই গুপ্টা দম্পতি ভীষণভাবে ইনভলভড। এমনও হতে পারে, একটা গুরুতর জীবনমরণ প্রশ্ন জড়িত ছিল আলোচনায়।

সত্যেন্দ্র বলল কারেক্ট। আমি একমত।

ডাঃ পট্টনায়ক সন্দিগ্ধভাবে মাথা নেড়ে বললেন কিন্তু মৃত মানুষকে আঘাত করতে গেল কেন খুনী?

কর্নেল বললেন–পুলিশকে বিভ্রান্ত করার জন্য। এটা আজকালকার চুরিডাকাতির ঘটনা বলে চালিয়ে দিতে চেয়েছিল সম্ভবত।

–কিন্তু সে যদি অত ধূর্ত, তাহলে কিছু চুরির নমুনা রাখেনি কেন?

–সময় পায়নি।

–কেন?

মনে রাখবেন, ডাক্তারের হিসেবে ওঁদের মৃত্যু হয়েছে সম্ভবত পাঁচটা থেকে ছ’টার মধ্যে। পাঁচটা পঁয়তাল্লিশে পারুল অ্যাডের ছেলেরা এসে পৌঁছেছে। এখানে, সবদিক বিচার করে আমার অনুমান, ওঁদের মৃত্যু পাঁচটা পঁয়ত্রিশ থেকে পঁয়তাল্লিশের মধ্যে হয়ে থাকবে। তারপর খুনী ডেডবডিতে ছুরি বা ধারালো কিছু চালিয়েছে। কিন্তু চুরির অজুহাত দেখানোর সুযোগ পায়নি বিজনবাবুরা এসে পড়ায়। ওরা খুনীকে দেখতে পেত না। দিব্যি ঊর্মিদেবীর হার বা চুড়ি নিয়ে পালাতে পারত। কিন্তু মনে রাখবেন, খুনের পর খুনীর মানসিক অবস্থা কেমন থাকে। সে একটু শব্দেই তখন চমকে ওঠে। হঠাৎ সেই সময় বিজনবাবুরা হল্লা করে পৌঁছেছিলেন। কাজেই তীর তখনই বিভ্রান্ত হয়ে পালানো স্বাভাবিক। অবশ্য, সবই আমার হাইপোথিসিস যাকে বলে।

–কিন্তু তাহলে শেষ অব্দি অবনী ভরদ্বাজই আপনার ধারণা অনুসারে এই কেসের আসামী। আমি অবাক হচ্ছি যে অমন নামী ভদ্রলোক নিজের কেরিয়ার নষ্ট করার চান্স নেবেন এভাবে? এটা উদ্ভট লাগে না কি? নিশ্চয় ওঁর হাতে একগাদা ফিল্মের দায়িত্ব রয়েছে–আর উনি… কর্নেল হাত তুলে বললেন–আমরা এখনও সত্যে পৌঁছাইনি ডাঃ পট্টনায়ক। সত্যে পৌঁছাতে হলে অনেক ঘুরপথে যেতে হয়।

Pages: 1 2 3 4

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress