Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » তেরো ভূতের কবলে || Syed Mustafa Siraj

তেরো ভূতের কবলে || Syed Mustafa Siraj

তেরো ভূতের কবলে

সবে চাঁদটা উঠেছে, আর তার ফিকে জ্যোৎস্নায় সার বেঁধে একদঙ্গল ছায়ামূর্তি আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তাদের কালো মুখে সাদা দাঁতগুলো ঝিকমিক করছে। তারপর তারা এক-পা এক-পা করে এগিয়ে আসতে থাকল।

কেকরাডিহির মাঠে অনেক বছর আগে এক সন্ধ্যাবেলায় এই ভয়ঙ্কর দৃশ্য মনে পড়লে এখনও আতঙ্কে আমার শরীর হিম হয়ে যায়। কথায় বলে বারো ভূতের পাল্লায় পড়া। আমি পড়েছিলুম তেরো ভূতের পাল্লায়।

ছিপ ফেলে মাছ ধরার বাতিক তত কম দুঃখে ঘোচেনি। অমন দামি বিলিতি হুইল মুচড়ে ভেঙে ট্রেনের জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলেছিলুম। তারপর নাক কান ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিলুম, আর কদাচ ছিপ হাতে করব না। সেই প্রতিজ্ঞা এখনও রেখেছি। উপরন্তু মাছ কেন, আমিষ খাওয়াই ছেড়ে দিয়েছি। তাই বেশ নিরাপদেই আছি বলতে গেলে।

ব্যাপারটা বললে কেউ বিশ্বাস করবে না জানি। কিন্তু এতদিন পরে কাগজে পড়লুম, কেকরাডিহির কাছে সেই কাকমারি ঝিলে সরকার মৎসচাষ প্রকল্প শুরু করবেন। কাজেই আগাগোড়া ছাপার হরফে সবটাই বলে দেওয়া উচিত–লোকেরা যদি সাবধান হয়। কিন্তু মাছখেকো বাঙালি পরলোকে গিয়েও মাছের জন্য ছোঁকছোঁক করে। আমার কথা শুনবে কি কেউ?

বছর-পাঁচেক আগের কথা। তখন আমার ছিপের নেশা ছিল প্রচণ্ড রকমের। আমাদের মফস্বল শহরটার আনাচে কানাচে এমন পুকুর বা জলা ছিল না, যেখানে আমি ছিপ ফেলিনি। নেশা তুঙ্গে উঠলে তখন দূরে যাওয়া শুরু করেছিলুম। কোথায় কোন গ্রামে কার পুকুরে কীরকম মাছ আছে, তক্কে তক্কে থেকে খবর নিতুম আর সেখানে গিয়ে হাজির হতুম।

মাছ তো বাজারে পয়সা দিয়ে কেনা যায়। আবার জাল ফেলেও মাছ ধরতে অসুবিধে নেই। কিন্তু ছিপ ফেলে মাছ ধরার কোনও তুলনা হয় না। তার চেয়ে বড় কথা, মাছ ধরার চেয়ে মাছের আশায় জলের ধারে বসে থাকার মতো আনন্দ আর কিছুতে নেই।

নিরিবিলি নিঝুম পরিবেশ। দামের ওপর একঠ্যাঙে সাদা বক বসে যেন ধ্যান করছে। মাছের প্রতীক্ষায় থেকে হঠাৎ কোনও তিতি-বিরক্ত মাছরাঙা ঠা-া চেঁচিয়ে উঠছে। জলের ওপর তরতরিয়ে খেলে বেড়াচ্ছে জলমাকড়সার ঝক। টুকটুকে লাল গাংফড়িংটা ফাতনার ওপর উড়ে-উড়ে ছোঁ মারছে। তারপর ফাতনার কাছে জলের বুজকুড়ি ফুটছে। হ্যাঁ, চারে মাছ এসেছে। এত মোটা বুজকুড়ি যখন, তখন মাছটা হয়তো কিলোদশেক হবে। উত্তেজনায় রক্ত চনমন করছে। ঝুঁকে বসে ছিপটা শক্ত করে ধরেছি। ফাতনা নড়লেই মারব এক জোরাল খাচ। তারপর…

ঠিক এই মুহূর্তে বিদঘুঁটে ঘটনাটা ঘটতে শুরু করেছিল। কিন্তু তখনও কিছু টের পাইনি।

তার আগের কথাটা বলে নিই।

শুনেছিলুম কেকরাডিহির ওদিকে একটা ঝিল আছে। তার নাম কাকমারি ঝিল। কাকের কথাটা কেন আসছে জানতুম না। পরে অবশ্য জেনেছিলুম। তো সেই ঝিলে নাকি আদ্যিকালের বিশাল বিশাল সব মাছ আছে। ছিপ ফেললে তারা এসে টোপ ঠোকরায় বটে, কিন্তু আজ পর্যন্ত কেউ একটা মাছও গাঁথতে পারেনি বঁড়শিতে। সেই শুনে আমার জেদ চড়ে গিয়েছিল।

আশ্বিনের এক দুপুরবেলা কেকরাডিহি স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে পড়লুম। নেমে দেখি, ছোট্ট এক স্টেশন। খাঁ-খাঁ করছে চারদিক। স্টেশনমাস্টার বয়সে প্রবীণ। আমাকে দেখে একটু হেসে বললেন,-কাকমারির ঝিলে ছিপ ফেলতে এসেছেন বুঝি? যান গিয়ে দেখুন যদি একটা গাঁথতে পারেন। তবে…

ওঁকে হঠাৎ চুপ করতে দেখে বললুম,–তবে কী?

উনি কেমন যেন গম্ভীর হয়ে বললেন,-কিছু না। বলছিলুম কী, একটু সাবধানে থাকবেন।

–কেন বলুন তো? ছিনতাইয়ের ভয় আছে নাকি?

স্টেশনমাস্টার এবার কেমন যেন হাসলেন, নানা। জঙ্গুলে জলা জায়গা। ওখানে ছিনতাইবাজরা যাবে কী আশায়? কাক। বুঝলেন? কাকের বড় উপদ্রব ওখানে। সেজন্যই তো কাকমারি ঝিল নাম হয়েছে। মাছ মারবেন, না কাক মারবেন, সেটাই প্রবলেম। যাক গে। এসেই পড়েছেন যখন, তখন আর দেরি করবেন না। সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসুন ভালোয়-ভালোয়।

এই সব অদ্ভুত কথাবার্তা শুনে মাথামুন্ডু কিছুই বুঝলাম না।

ভদ্রলোক স্টেশনঘরে ঢুকে গেছেন। চেঁচিয়ে জিগ্যেস করলুম, ঝিলটা কোনদিকে বলুন তো?

জানালায় মুখ বাড়িয়ে বললেন, নাক বরাবর হেঁটে যান। আর একটা কথা। মাছ যদি গাঁথতে পারেন, আমার কিন্তু ওয়ানথার্ড পাওনা রইল। তারপর হেঁ-হেঁ করে বিদঘুঁটে হাসতে লাগলেন।

প্রতিশ্রুতি দিয়ে নাক বরাবর হাঁটতে থাকলুম। রাস্তা-টাস্তা নেই। পোড় জমির ওপর ঘন ঘাস আর ঝোঁপঝাড় গজিয়ে রয়েছে। বেশ খানিকটা এগিয়ে ঝিলটা দেখা গেল। দারুণ সুন্দর পরিবেশ। জলজ গাছ আর দামে ঢাকা ঝিলটা আয়তনে প্রকাণ্ড বলা যায়। মস্ত বটগাছের তলায় মাছ ধরার ঘাটটা দেখে মনে আনন্দে নেমে উঠল। কিছুক্ষণের মধ্যে চার ছড়িয়ে টোপ গেঁথে ছিপ ফেলে আরাম করে ছায়ায় বসে পড়লুম।

কিছুক্ষণ পরে ফাতনার কাছে বুজকুড়ি কাটতে দেখে ছিপ বাগিয়ে ধরেছি। তারপর ফাতনাটা নড়ে ওঠা মাত্র যেই খাচ মারতে গেছি, অমনি কা-কা করে কোত্থেকে একঝাক কালো কুচকুচে কাক আমার মাথায় ওপর কালো চাকার মতো পাক খেতে শুরু করেছে। তাদের বিকট চ্যাঁচিমেচিতে কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে।

কাকের কথাটা পথে আসতে-আসতে ভুলেই গিয়েছিলুম। ছিপ ছেড়ে দিয়ে প্রচণ্ড খাপ্পা হয়ে পড়লুম। তারপর ঢিল কুড়িয়ে কাকগুলোকে তাড়াবার চেষ্টা করলুম। এই করতে গিয়ে আমার টুপিটা পড়ে গেল। আমার মাথায় বিরাট টাক। ধড়িবাজ কাকগুলো সেই টাক লক্ষ করে ঝাঁপিয়ে আসতে থাকল। তখন মরিয়া হয়ে ছিপ তুলে বাই-বাই করে ঘোরাতে শুরু করলুম। গাছের পাতায় শেষপর্যন্ত বঁড়শি আটকে গেল বটে, কিন্তু এবার কাকগুলো জব্দ হয়ে সরে গেল। বটগাছটার মাথায় গিয়ে বসল।

আগে জানলে গোটাকতক পটকা আনতুম সঙ্গে। কী আর করা যায়। অনেক কষ্টে পাতা থেকে বঁড়শি ছাড়িয়ে টোপ গেঁথে ঠিক জায়গায় ফেলে বসে রইলুম। কিন্তু এবার সতর্ক হয়েছি। বারবার পিছন ফিরে দেখে নিচ্ছি। কিন্তু কাকগুলো আর টু করছে না। ডালপালার ভেতর কোথায় বুঝি ঘাপটি মেরে বসে আছে। কয়েক মিনিট নির্ঞ্ঝাট কেটে গেলে বুঝলুম, বাছাধনরা ভয় পেয়ে গেছে। দৈবাৎ বঁড়শি গেঁথে গেলে কী অবস্থা হবে, নিশ্চয় আঁচ করেছে।

ফাতনার কাছে বুকুড়িগুলো মিলিয়ে গেছে কখন। মাছটা হয়তো ডাঙার ওপর ওই হুলুস্থুলু টের পেয়ে কেটে পড়েছে। কাকগুলোর ওপর রাগে খাপ্পা হয়ে গেলুম! তারপর খেয়াল হল, ওই যাঃ। টুপিটা কোথায় পড়েছে খুঁজে আনতে হয়। কাকের লক্ষ্যস্থল আমার এই বিরাট টাকাটাকে এখনও ঢাকিনি কোন্ আক্কেলে?

টুপিটা ঝোঁপের পাশে পড়ে ছিল। কুড়িয়ে মাথায় পরেছি, হঠাৎ বটতলার অন্যপাশ থেকে একটা কালো খেকুটে চেহারার লম্বানেকে তোক বেরিয়ে এল। পাড়াগাঁয়ের মাঠে খেতখামারে যারা কাজ করে, সত তাদেরই কেউ। কোমরে একটুখানি ন্যাকড়া জড়ানো শুধু, বাদবাকি শরীর নগ্ন। একগাল হেসে সে বলল, মাছ ধরতে পারলেন বাবুমশাই?

বিরক্ত হয়ে বললুম, কই আর পারলুম? যা কাকের উপদ্রব!

লোকটা খা-খা ধরনের হাসি হেসে বলল,–বলে দেব। আর ঝামেলা করবে না–তবে কিন্তু মাছের ভাগ দিতে হবে বাবুমশাই!

–তা না হয় দেব! কিন্তু বলে দেব মানে কী? কাকগুলো কি তোমার পোষা কাক নাকি?

–আজ্ঞে কতকটা।

–কতকটা মানে?

লোকটা তার লম্বা নাকের ডগা চুলকে বলল,–অত কথায় কাজ কী বাবুমশাই? যান, বসুন গে।

ছিপের কাছে বসলুম আবার। ভাবলুম লোকটা আসলে রসিকতা করছে। বললুম,–ওহে! মাছ ধরতে পারলে তোমাকে একটা অবশ্যই দেব! তুমি দেখ, যেন কাকগুলো আর বিরক্ত না করে, বরং গাছের ডাল ভেঙে নাও একটা।

লোকটা বলল–কিছু ভাববেন না। আপনি ফাতনার দিকে চোখ রাখুন।

ফাতটানার কাছে আবার বুকুড়ি ফুটে উঠল। ছিপ বাগিয়ে ধরলুম। ফাতনাটা নড়লেই খাচ মারব। কিন্তু সেই সময় পেছনে বটতলায় ধূপ ধূপ ধূপ ধূপ শব্দ হল এবং চেরাগলায় কারা চ্যাঁচামেচি করে দৌড়ে এল,–মাছ! মাছ! মাছ! মাছ!

ঘুরে দেখি, সেই লোকটার মতোই কালো কুচকুচে লম্বানেকো একদল লোক এসে হাজির। তারা মাছ-মাছ-বলে চাঁচেমেচি করছে এবং আগের লোকটা তাদের থামাবার চেষ্টা করছে। রাগে মহাখাপ্পা হয়ে উঠে দাঁড়ালুম। তারপর প্রচণ্ড ধমক দিয়ে বললুম,–চুপ সব। চুপ! পেয়েছ কী তোমরা? এখানে হইচই করছ কেন অত?

লোকগুলো একগলায় বলল, মাছ, মাছ।

তেড়ে গিয়ে বললুম,–মাছ ধরতে না ধরতেই মাছ চাইতে এসেছ। ধরলে তবে তো।

আগের লোকটা বলল,-বাবুমশাই বড় ভালোমানুষ। তোরা খামোকা চ্যাঁচিচ্ছিস কেন বাপু? মাছ আগে বঁড়শিতে ধরা পড়ুক। শুনুন বাবুমশাই, আমরা মোটমাট বারোজন আছি। বেশি নয়, মাথাপিছু একটা করে টুকরো দেবেন। ব্যাস। বলে সে ঠোঁট চেটে নিল! আহা! কতকাল আমরা মাছ খাইনি!

এসব লোকের সঙ্গে তর্ক করে লাভ নেই। একে আমি একা, আর ওরা বারোজন। তাই আবার ছিপের কাছে গিয়ে বসলুম। চারের মাছটা আবার পালিয়েছে। মাছ ধরতে বসার আনন্দটাও আর নেই। স্টেশনমাস্টারও কি এজন্যই সাবধানে থাকতে বলেছিলেন?

একটু পরে ওদের দেখার জন্য পেছনে তাকালুম। অবাক হয়ে দেখলুম ধেড়ে লোকগুলো বাচ্ছা ছেলেদের মতো বটগাছটার ঝুরি বেয়ে উঠছে কেউ, কেউ ডালে চড়ে বসেছে, কেউ ডাল থেকে ধুপ করে পড়ছে। আবার ঝুরি বেয়ে উঠে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে একপাল হনুমান যেন। বয়স্ক লোকেরা এমন কেন খেলে, কম্মিনকালে তো দেখিনি।

এতক্ষণে একটু খটকা লাগল। কিন্তু চারে বুজকুড়ি দেখা দিয়েছে। মাছটা টোপ না খেয়ে ছাড়বে না। ফাতনার দিকে মন না দিয়ে তারা কী করছে, তাই নিয়ে মাথা ঘামান বৃথা।

কিন্তু কিছুক্ষণ পরে-পরে পেছনে তাকাতে অবশ্য ভূলিনি। লোকগুলো যেন আপনমনে খেলায় মেতে রয়েছে। ব্যাপারটা বোঝা যাচ্ছে না। ফাতনাটা একবার নড়ল মনে হল। কিন্তু দোনামনার জন্য খ্যাচ মারতে পারলুম না। দুপুর ঘনিয়ে বিকেলে নামল। বিকেলও ক্রমশ ফুরিয়ে যাচ্ছিল। আলো কমে এল। পেছনে বটের ঝুরি এবং ডালপালায় লোকগুলো একই ভঙ্গিতে খেলায় মেতে আছে। তারপর ওদের কথা মন থেকে ঝেটিয়ে ফেললুম। চুলোয় যাক ওরা। ছিপে মাছ ধরতে একাগ্রতা দরকার। মনে আশা জেগেছে, অনেক মাছ ঠিক সন্ধ্যার মুখে টোপ ধরে মোক্ষম টান দেয়– এই মাছটাও তাই করবে।

কিন্তু হাতের রেখা মুছে ফেলার মতো ধূসরতা ঘনিয়ে উঠল এবং ফাতনাটাও অস্পষ্ট হয়ে উঠল, তখন হতাশ হয়ে ছিপ গুটিয়ে ফেললুম। ঝিলের জলের ওপর কুয়াশার পর্দা ঝুলছে। শূন্য ঝোলা আর ছিপটা হাতে নিয়ে ক্লান্তভাবে পা বাড়ালুম। বটতলায় আবছা আঁধার জমেছে। পোকামাকড় ডাকতে শুরু করেছে। কিন্তু লোকগুলো কোথায় গেল? ভাবলুম, মাছ গাঁথতে পারিনি লক্ষ করে ওরাও হতাশ হয়ে কেটে পড়েছে।

একটু দূরে কেকরাডিহি স্টেশনের সিগন্যাল বাতি জ্বলজ্বল করছিল। সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ আমার ফেরার ট্রেন। ধীরেসুস্থে হাঁটছিলুম। সবে চাঁদটা বেরিয়ে এসেছে। ফিকে জ্যোত্সা ছড়াচ্ছে কেকরাডিহির মাঠে। লোকগুলো এবং কাকগুলোর চেহারার মধ্যে কেমন যেন মিল আছে-ভাবতে-ভাবতে খটকাটা বেড়ে গিয়েছিল। তারপর মনে হল, আমারই দেখারই ভুল। রোদ-বৃষ্টিশীতে খেটে ওদের চেহারা অমন ঘেঁকুটে হয়ে গেছে। আর কাকের হামলাও কিছু অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। এদিকে মাছের ওপর গ্রামের লোকের অমন কাঙালপনা থাকতেই পারে। সব মাছ তো শহরে চালান যাচ্ছে আজকাল। কাজেই একটা অকারণ একটা স্বাভাবিক ব্যাপারকে রহস্যময় বলে ডাকছি।

কিন্তু হঠাৎ দেখি, সামনে একদঙ্গল ছায়ামূর্তি সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। থমকে দাঁড়ালুম। তাদের কালো মুখে সাদা দাঁত ঝিকমিক করছে। আতঙ্কে বোবাধরা গলায় বলে উঠলুম, কী কী চাই তোমাদের?

তখনকার মতো একগলায় ওরা চেঁচিয়ে উঠল, মাছ-মাছ!

এতক্ষণে নাকি স্বরে মাছ উচ্চারণ শুনেই শরীর হিম হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলুম ওরা কে। ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে বললুম,–মাছ তো পাইনি।

একসঙ্গে ব্যাটাচ্ছেলেরা চেঁচিয়ে উঠল,–মিছে কঁথা। মিছে কঁথা।

কাকুতিমিনতি করে বললুম,–বিশ্বাস করো, মাছ পাইনি।

একজন বলল,–ওঁরে। ওঁরে ঝোঁলাটা কেঁড়ে নেঁ!

তারপর দেখি, ওরা এক পা করে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। অমনি ঝোলাটা ছুঁড়ে ফেলে দিলুম। ওরা বিদঘুঁটে চ্যাঁচামেচি করে ঝাঁপিয়ে পড়ল ঝোলাটার ওপর। আর সেই সুযোগে আমি দৌড় দিলুম। দৌড়-দৌড়-দৌড়! একেবারে স্টেশনে পৌঁছে সোজা স্টেশনঘরে ঢুকে পড়লুম।

টেবিলের ওপর রেলের লণ্ঠন জ্বলছে। কিন্তু স্টেশনমাস্টার কোথায় গেলেন? হাঁফাতে-হাঁফাতে তাঁকে ডাকব ভাবছি, কোণার অন্ধকার জায়গা থেকে তার সাড়া পেলুম, কী মশাই, মাছ পেলেন নাকি?

বললুম,–মাছ তো দূরের কথা, কাকমারির ঝিলে গিয়ে জোর বেঁচে গিয়েছি। উঃ! আপনি ঠিকই বলেছিলেন।

কিন্তু আমার যে মাছের ভাগ চাই! কথা দিয়েছেন। বলে স্টেশন-মাস্টার অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এলেন। মুখে সেই অদ্ভুত হাসিটা। আমি মাছ খেতে ভালবাসি। মাছ আঁমার চাই।

শেষ বাক্যটি কী নাকিস্বরে উচ্চারণ করলেন? আর ঠিক সেই লম্বানেকো আজব প্রাণীগুলোর মতোই ওঁর গায়ের রং এবং উনি এক পা করে আমার দিকে এগুচ্ছেন দেখছি। এক লাফে বেরিয়ে যাব ভাবছি, হঠাৎ কেউ ঘরে ঢুকে হেঁড়ে গলায় গর্জন করল, তবে রে ব্যাটা মাছখেকো! আবার তুমি আমার আপিসে ঢুকে বসে আছ?

স্টেশনমাস্টাররূপী লোকটা অমনি জানালা গলিয়ে পালিয়ে গেল। আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি। আসল স্টেশনমাস্টার-যাঁর সঙ্গে তখন আলাপ হয়েছিল, হাসতে-হাসতে বললেন, ভয় পাননি তো? এই অখাদ্য স্টেশনে মশাই এইসব ঝামেলা লেগেই আছে। দেশে মাছের বড় আকাল। যাকগে, বসুন। মুখ দেখেই বুঝেছি কী ঘটেছে। যাই হোক, সেই আমার ছিপে মাছ ধরার নেশা ঘুচে গেছে তো গেছে! আসার সময় ছিপটা ভেঙে ট্রেনের জানলা গলিয়ে ফেলে দিয়েছি। এখন বেশ শান্তিতেই আছি। নিরামিষ খাই-দাই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress