তৃষ্ণার্ত শরীর
রুদ্রশেখর বাবু তার স্ত্রী ও বৃদ্ধা মাকে নিয়ে মোটামুটি ভালোই আছেন। রুদ্রশেখর বাবু পেশায় ছিলেন একটি বেসরকারি সংস্থার সাধারণ কর্মচারী। এইতো বছর পাঁচেক আগে অবসর নিয়েছেন। ষাট ঊর্ধ্ব রুদ্রশেখর বাবুর ছেলেমেয়েদের বিয়ে হয়ে ওরা যে যার মত পৃথক আছে। সুখী পরিবারের কর্তা রুদ্রশেখর বাবু শরতের রোদে শরীর ভাসিয়ে ভাসিয়ে বেশ খুশির মেজাজেই স্ত্রী ও বৃদ্ধা মায়ের জন্য কিছু নতুন জামা ও কাপড়-চোপড় কেনাকাটা করে বাড়ি ফিরছিলেন। শত হলেও দুর্গাপূজা বলে কথা। গড়িয়াহাট ক্রস করে ঢাকুরিয়ার দিকে আসতে না আসতেই রুদ্র বাবুর স্ত্রী তমালিকা ম্যাডামের ফোন বেজে উঠলো রুদ্রশেখর বাবুর পকেটে।
স্ত্রী তমালিকা ম্যাডাম : কিগো …কতদূর..?
রুদ্র শেখর বাবু : হ্যাঁ…; হ্যাঁগো এইতো বাড়িতেই আসছি”।সব কেনাকাটা করা হয়ে গেছে।
গিন্নি/তমালিকা ম্যাডাম: “ঐ যেটা বলেছিলাম ওটা এনেছো তো”?
রুদ্রশেখর বাবু: “এ মা! যাহ, একেবারে খেয়াল ছিল না যাচ্ছি যাচ্ছি। এক্ষুনি নিয়ে আসছি”।
মাঝ রাস্তা থেকে আবার মাথা নিচু করে ক্লান্ত শরীরে সঙ্গে থাকা নতুন কাপড়-চোপড় গুলোকে সাথে নিয়ে ফেরত চললেন গড়িয়াহাটের উদ্দেশ্যে। বউয়ের আদেশ মেনে না চললে যে গুষ্টির ষষ্ঠী পুজো হয়ে যাবে। রুদ্রশেখর বাবুর স্ত্রী তমালিকা ম্যাডাম বহুদিন আগে থেকেই একটা লাল পাড়ের সাদা শাড়ি ও লাল ব্লাউজ আনার কথা বলে রেখেছিলেন রুদ্রশেখর বাবুকে। লালপাড়ের শাড়ি ও লাল ব্লাউজ পড়ে বিজয় দশমীর দিনে তিনি মা দুর্গাকে বরণ করতে যাবেন। অবশেষে ঠিক তেমনটাই হলো যেমনটা তমালিকা ম্যাডাম চেয়েছিলেন। পুজোর ৫ দিন তমালিকা ম্যাডামের কি সাজ পোশাক..! প্রত্যেকদিন দুবেলা ভিন্ন ভিন্ন ধরনের রকমারি পোশাক। এভাবেই পুজোর কদিন কাটতে না কাটতেই এবার এসে গেল সেই দীর্ঘ প্রত্যাশিত বিজয় দশমীর দিন। লাল পাড়ের শাড়ি ও লাল ব্লাউজ পড়ে মা দুর্গাকে মিষ্টিমুখ ও সিঁদুর পরানোর পালা। মা দুর্গাকে মিষ্ট মুখ করানোর সাথে সাথে মহিলাদের মধ্যে সিঁদুর খেলাও হবে পুরো দমে। ম্যাডাম তমালিকা আর রিস্ক না নিয়ে দশমীর দিন দুপুর বেলাতেই ভীষণ সাজুগুজু করে ঠোটে লিপস্টিক, বরের দেয়া লাল পাড়ের শাড়ি ও লাল ব্লাউজ পরিধান করে একপ্রকার নাচতে নাচতে চলে গেলেন পুজো মণ্ডপে। বিকেল যত গড়িয়ে যাচ্ছে ভিড় তত বাড়ছে। এরকম হতে হতে যখন মায়ের বরণ শুরু হলো ততক্ষণে মন্ডপ চত্বর মহিলাদের ভিড়ে থই থই অবস্থা। ওদিকে মা দুর্গাকে সবাই মিষ্টি খাওয়াতে খাওয়াতে মায়ের পায়ের উপর সন্দেশ জমে জমে সন্দেশের পাহাড় হয়ে গেছে। কারণ মা দুর্গা তো একটা মিষ্টিও খাচ্ছেন না। সব মিষ্টি মায়ের পায়ের উপর পড়ে আছে। এরপরে হলো সব মহিলারা মিলে সিঁদুর খেলা। কি হইহুল্লোড় …!মাতামাতি…! তা না দেখলে বিশ্বাস করা অসম্ভব। এরকম আনন্দ উপভোগ করতে করতে একটা সময় তমালিকা ম্যাডাম সহ অন্যান্য মহিলারাও ঘেমে নেয়ে স্নান। ততক্ষণে সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত হতে চলল। অতঃপর সারাদিন মায়ের বরণ, সিঁদুর খেলা এগুলো সব সেরে চোখে মুখে আনন্দের এক সাগর ঢেউ নিয়ে বাড়ি ফিরলেন তমালিকা ম্যাডাম। এদিকে তমালিকা ম্যাডামের শাশুড়ি মা অর্থাৎ রুদ্রশেখর বাবুর বৃদ্ধা মা পুষ্পা দেবী সারাদিন ঘরে একা একা রয়েছেন। সিঁদুর খেলা শেষে রাত্রিবেলা এসে তমালিকা ম্যাডাম ঘরে প্রবেশ করতেই পাশের ঘর হতে বৃদ্ধা শাশুড়ি মা পুষ্পা দেবীর কাঁপা কাঁপা কন্ঠ,”
পুষ্পা দেবী: কে বৌমা? এক গ্লাস জল দেবে মা? সেই দুপুর থেকে জল পিপাসা পেয়েছে বড্ড”।
ব্যাস, অমনি তমালিকা ম্যাডাম খোঁচে বোম। যেন শাশুড়ি মাকে এই গিলে খায় প্রায়। তমালিকা ম্যাডামের গলায় ঠিক এমনটাই সোনা গিয়েছিল।
তমালিকা ম্যাডাম: “এতক্ষণ আপনার জল খাওয়ার কথা মনে ছিল না? যেই আমাকে দেখলেন অমনি জল পিপাসা পেয়ে গেল আপনার? যত্তসব ন্যাকামো, একে সারাদিন ধরে আমি গরমে মরে যাচ্ছি”।
পুষ্পা দেবীর গলা শুনে মনে হচ্ছিল সত্যি সত্যি পিপাসায় ওনার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। শেষমেষ পুষ্পাদেবী তমালিকার হাতে জল পেলেন না। বার্ধক্য জনিত কারণে তিনি নিজেও এক গ্লাস জল নিয়ে পান করতে পারছেন না। ছেলেকে বললে যদি আবার কোন বড় ধরনের অশান্তির সৃষ্টি হয় এই কথা ভেবে বৃদ্ধা পুষ্পা দেবী ছেলে রুদ্রশেখরকেও কিছু জানান নি। বৃদ্ধা শাশুড়ির তৃষ্ণার্ত শরীর তৃষ্ণার্তই থেকে গেল।