রাত্রের খাওয়ার পর
রাত্রের খাওয়ার পর বিছানায় শুয়ে টেল-ল্যাম্প জ্বেলে বলরাম খবরের কাগজ পড়েন। পাতাগুলোয় চোখ বুলিয়ে পড়ার মতো কিছু না পেয়ে, স্পোর্টস টাইম পত্রিকাটা তুলে ছবি দেখতে লাগলেন। দেখতে দেখতে শেষের দিকে এসে পেলেন একটা লেখা এবং তার সঙ্গে চারটি ছবি। প্রথম ছবিতে একটি কিশোরী সমুদ্রতীরে বালির ওপর দৌড়চ্ছে। পরনে কালো জামা, লাল শর্টস, কেড়স, পিঠের ওপর বেণী, বাঁ হাতে ঘড়ি এবং নাকে নাকছাবি। মুখের গড়ন অনেকটাই তুলসীর মতো।
আর-একটি ছবিতে: মেয়েটি একটি রেসিং সাইকেল চালাচ্ছে সমুদ্রতীরের একটি রাস্তায়। তার পেছনে একটি বালক হাসতে হাসতে দৌড়চ্ছে।
আৱ-একটি ছবিতে: মেয়েটি কস্টিউম পরা, মাথায় আঁট করে বসানো রবারের টুপি। সমুদ্রের কিনারে দাঁড়িয়ে।
আর-একটি ছবিতে: ক্যারামবোর্ড ঘিরে মেঝেয় ছজন বসে। ছবিতে বোঝা যায়, এরা একটি পরিবার। স্বামী-স্ত্রী, দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। আগের ছবিগুলির মেয়েটিও এর মধ্যে রয়েছে।
বলরাম একটু কৌতূহল বোধ করলেন প্রথম তিনটি ছবির জন্য। একটি মেয়ে তিনটি খেলায়। হয়তো সাঁতারুই, দৌড় আর সাইক্লিংটা বোধ হয় সাঁতারের ট্রেনিংয়েরই অঙ্গ। পাতা উলটে যাওয়ার আগে লেখার শুরুতে মোটা অক্ষরে কয়েক লাইনের ভূমিকাটা তিনি পড়তে শুরু করলেন।
ইন অ্যান এরা হয়্যার সাকসেস ইন ইন্ডিয়ান স্পোর্টস ইজ অলমোস্ট নন-এগজিসট্যান্ট, সেভেনটিন ইয়ার ওল্ড সি. আমুদা হ্যাজ ওন দ্য এশিয়ান জুনিয়ার ট্রায়াথলন চ্যাম্পিয়ানশিপ ইন চায়না রিসেন্টলি। হোয়াট মেস হার অ্যাচিভমেন্ট অল দ্য মোর কমান্ডেবল ইজ দ্যাট, শি কামস ফ্রম অ্যান আন্ডারপ্রিভিলেজড ব্যাকগ্রাউন্ড অ্যান্ড হ্যাড টু স্ট্রাগল এগেনস্ট রিয়েল অডস টু ট্রায়াম্ফ।
বলরামের হাত দুটো একবার কেঁপে উঠল। চোখ বন্ধ করে উত্তেজনা কমানোর জন্য সময় নিলেন। একেই কি বলে জ্যাকপট পাওয়া। মেঘ না চাইতেই জল। এই ট্রায়াথলনের কথাই তো আজ তুলসী বলল। তিনি পত্রিকাটা চোখের আরও কাছে নিয়ে এলেন।
হার ফাদার ওয়াজ আহেল্পার ইন দ্য আন্না সুইমিং পুল ইন ম্যাড্রাস। হার মাদার কুঞ্জুম্মা স্টিল সেলস সুগারকেন জুস ফ্রম এ পুশ কার্ট অন মেরিনা বিচ। দ্য ফ্যামিলি অব টু ডটারস অ্যান্ড টু সনস, বিলংগড টু দ্য ফিশারমেন কমিউনিটি। দে লিভড ইন আ স্মল হাট ইন ট্রিপলিকেন…
দ্য ফাদারস ইনকাম ওয়াজ পুয়োর। ফুড ওয়াজ নট আ রেগুলার অকারেন্স। ইট ওয়াজ দ্য টিপিক্যাল ইন্ডিয়ান স্টোরি অব আ লাইফ স্টিপড ইন পভার্টি অ্যান্ড আনসারটেনিটি। বাট দ্য গার্ল আমুদা ওয়াজ পজেজড অব হাই স্পিরিটস। ডেস্পাইট দ্য ল্যাক অব ফুড…
বলরাম বিছানায় উঠে বসলেন। গোগ্রাসে রচনাটি প্রথমবার প্রায় গিলে ফেললেন। তারপর আবার পড়তে শুরু করলেন ধীরে ধীরে। সেই জায়গাটা তিনি দুবার-তিনবার পড়লেন যেখানে আমুদা চিনের তিয়ানজিনে তার এশিয়ান চ্যাম্পিয়ান হওয়ার কথা বলেছে।
চিনে রওনা হওয়ার আগে আমুদাকে কে যেন বলেছিল, হয় মেডেল নিয়ে ফিরবি, নয়তো ওখানেই মরবি। তাই সে ঠিক করেছিল, মরতে হয় তো মরব কিন্তু শেষ একটা চেষ্টা করে যাব। তিয়ানজিন সামার লেক-এ দেড় কিলোমিটার সাঁতার শেষে আমুদা রইল তৃতীয় স্থানে। তারপর চল্লিশ কিলোমিটার সাইক্লিং শেষে সে আরও পিছিয়ে গিয়ে রইল অষ্টম স্থানে। এর পর শুরু হল দশ কিলোমিটার দৌড়! ওর সামনে সাতটি মেয়ে দৌড়চ্ছে। অনেক পিছিয়ে আমুদা।
বলরামের মনে হল, তখন এই মেয়েটার নিশ্চয়ই মনে পড়ছিল, মরতে হয় তো মরব কিন্তু শেষ একটা চেষ্টা করে যাব। হাল না ছেড়ে আমুদা দৌড়তে থাকে। পাঁচ কিলোমিটার দৌড় যখন সম্পূর্ণ হল তখন সে ছজনকে অতিক্রম করে গেছে। তবুও অনেকদূর এগিয়ে রয়েছে লিন ইয়েন নামে চিনা মেয়েটি। ইয়েন সাঁতারে ও সাইক্লিংয়ে প্রথম হয়েছে। আমুদা তখন, কে প্রথম হয়েছে না হয়েছে, মনে করে রাখেনি। নিশ্চয়ই তখন তার দৃষ্টিতে সামনের চিনা মেয়েটি ছাড়া বিশ্বচরাচরে আর কিছু ছিল না। গতি, গতি, গতি, সে শুধু গতি বাড়িয়ে গেছে। আট কিলোমিটারের মাথায় আমুদা ধরে ফেলল ইয়েনকে। তারপর সে আরও গতি বাড়াল। যখন আমুদা টেপ ছিঁড়ল তখন সে নিঃশেষিত। শ্বাস নেওয়ার ক্ষমতাটুকু আর তার নেই। অজ্ঞান হয়ে সে লুটিয়ে পড়ল। সে জানে না ইয়েনকে শেষ পর্যন্ত হারাতে পেরেছে কি না। সঙ্গে সঙ্গে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। দু ঘণ্টা পর আমুদার জ্ঞান ফিরে আসতেই সে দেখল, তার দিকে তাক করা ক্যামেরার আলো ঝলসে উঠছে। আমুদা ভাবল, তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে বলে কাগজের ফোটোগ্রাফাররা তার ছবি তুলছে। কনগ্রাচুলেশনস, আমুদা, তুমিই জিতেছ। এই কথা শোনার পর মেয়েটির মনের অবস্থা কীরকম হয়েছিল?
অনেকক্ষণ পত্রিকাটার খোলা পাতার দিকে তাকিয়ে বলরাম আনমনার মতো বসে রইলেন। একসময় তাঁর চোখ ভিজে এল। বাড়ি থেকে, দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে বির্ভুয়ে, কী লড়াইটাই না করে এল আধপেটা খাওয়া এই গরিবঘরের মেয়েটি।
বলরাম পত্রিকাটি আবার তুলে নিয়ে ভূমিকাটা মনে মনে তর্জমা করলেন: যে আমলে ভারতীয় খেলাধুলায় সাফল্যের কোনও অস্তিত্বই নেই, তখন সতেরো বছরের আমুদা চিন থেকে জিতে এল এশিয়ান খেতাব। তার এই সাফল্য আরও বেশি সমীহ জাগায় এইজন্যই যে, সে উঠে এসেছে সুযোগ-সুবিধে না পাওয়া পটভূমি থেকে, বিজয়ী হওয়ার জন্য সত্যিকারের প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে তাকে লড়াই করতে হয়েছে।
দিনের আলো ফোটার আগেই বলরাম সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। তুলসীদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে যখন তুলসী, তুলসী বলে চেঁচিয়ে ডাকলেন, তখনও কুলডাঙা গ্রামের ঘুম ভাঙেনি। দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন তুলসীর মা। বলরামকে দেখে তো তিনি অবাক।
এত ভোরে, আপনি?
বলরাম একটু উত্তেজিত স্বরে বললেন, তুলসী একটা ব্যাপার জানার জন্য খোঁজ করছিল, আমি সেটা পেয়ে গেছি, বউদি।
সাইকেলের হ্যান্ডেলে ঝোলানো ঝুলিটা থেকে তিনি স্পোর্টস টাইম পত্রিকাটি বের করলেন। ওকে একটু ডেকে দেবেন?
একটু পরেই ঘুমজড়ানো চোখে তুলসী বেরিয়ে এল। কুণ্ঠিতভাবে সে বলল, মেসোমশাই, জানেনই তো কেউ এলে ঘরে বসানোর জায়গা নেই।
আরে বসার জন্য আমি আসিনি। এই লেখাটা পড়ানোর জন্য এসেছি। পড়ে দ্যাখো। ট্রায়াথলন কী, তা তুমি জানতে পারবে। বলেছিলে না, কতটা দৌড়তে হবে, কতটা সাঁতার কাটতে হবে, কতটা সাইকেল চালাতে হবে তা তুমি জানো না। সব এতে পাবে, আর পাবে একটা মেয়ের কথা।
কিন্তু মেসোমশাই— পত্রিকাটা হাতে নিয়ে তুলসী ইতস্তত করল।
দেড় কিলোমিটার সাঁতারের পর চল্লিশ কিলোমিটার সাইকেল তারপর দশ কিলোমিটার দৌড়, এর মধ্যে কিন্তুর কী আছে? তুমি তো সেদিনই দশ কিলোমিটার দৌড়লে। রানিসায়রে একবার এপার-ওপার করলেই দেড় কিলোমিটার হয়ে যাবে, আর সেটা তুমি পারো। বাকি রইল চল্লিশ কিলোমিটার সাইকেলে। হ্যাঁ, এতটা তোমার অভ্যাস নেই। এটা তোমায় রেগুলার প্র্যাকটিস করতে হবে।
কিন্তু মেসোমশাই—
এতে আর একটা জিনিস পাবে। তুলসীর কথা গ্রাহ্যে না এনে, হাত থেকে পত্রিকাটি টেনে নিয়ে বলরাম পাতা উলটিয়ে বললেন, আমুদা, মানে যে মেয়েটির কথা এতে আছে, সে রোজ কীরকম প্র্যাকটিস করেছে, তা এখানে লেখা আছে। শোনো, ভোর সাড়ে চারটেয় সে সাইকেল নিয়ে দেড়ঘণ্টা চালায়, তারপর দৌড়য় একঘণ্টা। বাড়ি এসে সে স্কুলে যায়। সওয়া আটটা থেকে দুপুর আড়াইটে পর্যন্ত স্কুল। বাড়ি ফিরে সামান্য কিছু খেয়ে সে সুইমিং পুলে গিয়ে তিন ঘণ্টা সাঁতার কাটে। বাড়ি ফিরে একটু পড়াশুননা, তারপরই শুয়ে পড়া।
কিন্তু মেসোমশাই, এই পত্রিকাটা যে ইংরেজিতে লেখা। অবশেষে তুলসী তার বাক্যটি সম্পূর্ণ বলতে পারল।
কিন্তু তুমি তো উচ্চ মাধ্যমিক পাস।
তা হলেই কি ইংরেজি পড়ে মানে বুঝতে পারব? পড়ার বইয়ের বাইরে তো পড়েছি শুধু নোটবই।
বলরামকে অপ্রতিভ দেখাল। তা বটে, তা বটে। তা হলে বাবাকে ধরো। ওঁকে দিয়ে মানে করে নিয়ো। মোটকথা, এটা তোমায় পড়তেই হবে।
বাড়ি থেকে বাবু বেরিয়ে এসে বলল, মা চা কচ্ছে, মেসোমশাই খেয়ে যাবেন।
অবশ্যই। আজ আর ইচ্ছে করছে না, কাল থেকে রানিসায়রে যাব। আর তুলসী, তুমিও কাল থেকে লেগে পড়ো। ভোরে সাইকেল নিয়ে— বলরাম থেমে গেলেন তুলসীর মুখভাব দেখে।
সাইকেলটা না সারিয়ে, চল্লিশ কিলোমিটার, মানে চব্বিশ মাইল, ওটা দিয়ে চালানো সম্ভব নয়।
বলরামের ভ্রূ কুঁচকে উঠল। খুব দ্রুত কী যেন ভেবে নিলেন।
টেপরেকর্ডারটা কোথায়, বাড়িতে আছে?
হ্যাঁ।
ওটা নিয়ে যাব। মনে হয় খদ্দের একজন আছে।
তুলসী বাড়ি থেকে টেপরেকর্ডার-ভরা বাক্সটা আনল, আর বাবু আনল কাপে ভরা। চা।
বলরাম চা খেয়ে সাইকেলে ওঠার সময় বললেন, জগন্নাথকাকার কাছে আজকালের মধ্যেই যেয়ো। ট্রায়াথলন কোথাও হচ্ছে কি না জানার জন্য আমিও খোঁজ নেব।
বাড়ি পৌঁছে বলরাম টেপরেকর্ডারটা বিমলার হাতে দিয়ে বললেন, তোমার জন্য আনলাম। খুব সস্তায়, মাত্র আড়াইশো টাকায় পেয়েছি। তুমি তো নাটক শুনতে ভালবাস, কালই সিরাজ-উদ-দৌলার ক্যাসেট এনে দেব।
অফিসে তিনি মনোজ সামন্তর কাছে খোঁজ নিলেন। ট্রায়াথালন ব্যাপারটা কী তুমি জানো? এখানে কোনও ক্লাব আছে কি?
মনোজ জানালেন, জীবনে এই প্রথম শব্দটা শুনলেন। তবে দোতলায় বিল্ডিং সেকশনের সমরেশবাবু ক্লাবটাব করেন, উনি হয়তো জানতে পারেন।
একসময় বলরাম দোতলায় বিল্ডিং সেকশনে গিয়ে সমরেশবাবুকে ধরলেন। আপনি তো খেলাধুলোর লাইনে আছেন, বলতে পারেন ট্রায়াথলনের কোনও ক্লাব এখানে আছে কি না, বা কম্পিটিশন হয় কি না?
সমরেশবাবু তখন খুবই ব্যস্ত অফিস এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের দুজন কর্তার সঙ্গে আলোচনায়। খুব সংক্ষেপে তিনি বলরামকে জানালেন, ক্লাব আছে কি না বলতে পারব না, তবে একটা অ্যাসোসিয়েশন আছে, স্টেট চ্যাম্পিয়ানশিপও নাকি করেছে। ওদের অফিস বোধ হয় বিডন স্ট্রিটে। এর বেশি কিছু জানি না।
বলরাম চেয়ারে ফিরে আসতেই মনোজ সামন্ত জিজ্ঞেস করলেন, খোঁজ পেলেন?
শুধু বললেন, বিডন স্ট্রিটে নাকি অ্যাসোসিয়েশন আছে।
আচ্ছা আমি সামন্তপুরে আমাদের ক্লাবে খোঁজ নেব। আমাদের প্রেসিডেন্ট ডাক্তার পাত্র খেলাটেলার খুব খবর রাখেন, বই টইও পড়েন, ওঁকেই বরং জিজ্ঞেস করব।
আর একটা কথা জানার আছে, সামন্ত। একটা টেপরেকর্ডারের দাম কত পড়বে বলতে পারো?
নানা দামের আছে। আটশো, হাজার, দেড় হাজার, দুহাজার…কিনবেন তো? তা হলে একটু বেশি দামেরটাই।
আরে না না, কিনব না। একজন বেচবে। এই মোটা একটা বইয়ের মতো দেখতে, বোধ হয় সস্তা দামেরই হবে। শপাঁচেক টাকা চাইলে অন্যায় হবে না, ব্র্যান্ড নিউ। কী বলো?
পরদিন সকালে তুলসীদের বাড়িতে গিয়ে বলরাম পাঁচটি একশো টাকার নোট তাকে দিলেন।
যে কিনল এর বেশি দেওয়ার সামর্থ্য তার নেই। কুণ্ঠিত স্বরে তিনি বললেন, আমি প্রথমে আটশো টাকা চেয়েছিলাম।
কী উপকার যে করলেন। রেকর্ডার-টা তো টাকা দিয়ে কিনিনি, এর থেকে যা পাওয়া যায়, তাই লাভ। সাইকেলটা এবার সারাতে পারব।
রানিসায়রে যাবে নাকি?
যাব, আপনি এগোন।
দুদিন পর মনোজ সামন্তের সঙ্গে বলরামের দেখা হল অফিসে ঢোকার মুখে।
এই যে গড়গড়িদা, ডাক্তারবাবুকে ট্রায়াথলনের কথা জিজ্ঞেস করেছি। আপনি খোঁজ করছেন শুনেই তো উনি রীতিমতো তেতে উঠলেন।
তেতে ওঠার কারণ? বলরাম হালকা চালে বললেন।
ওই যে সেদিন আমাদের ওখানে বলে এলেন এই কাজ আবার করব, যতদিন। পারব করে যাব, এটাই ডাক্তারবাবুকে ভীষণ নাড়া দিয়েছে। ওঁর বাড়িতে আজই সকালে গেছিলাম। চেম্বারে যাবেন বলে বেরোচ্ছিলেন, যাওয়া বন্ধ রেখে বসে পড়লেন। বললেন, বলরামবাবুর নামা উচিত ট্রায়াথলনে। ওঁর মতো লোকেরাই পারবে। পড়াশুনো করা লোক তো, ট্রায়াথলন শুরুর ইতিহাসই বলে দিলেন। ভাবতে পারেন, উনিশশো আটাত্তর সালে, তার মানে মাত্র ক বছর আগে হাওয়াইয়ে এই স্পোর্টস-টার জন্ম দিয়েছে নেভি-র দুটি লোক। চলুন ভেতরে যাই, টেবিলে না বসলে এসব কথা গুছিয়ে বলা যায় না।
চেয়ারে বসেও মনোজ সামন্ত গুছিয়ে বলতে পারলেন না। বুঝলেন দাদা, অতসব কথা মনে থাকে না। আমি বরং দু চারটে পয়েন্ট লিখে নিয়ে আসব। তবে ওই দুটো লোক নিজেদের মধ্যে চ্যালেঞ্জ দিয়েছিল এই বলে যে, শরীরের সবকটা প্রধান প্রধান মাসসের ক্ষমতা আর সহনশক্তি কার কত বেশি তার একটা পরীক্ষা শুরু হয়ে যাক। আর সেই পরীক্ষার জন্য ওরা ঠিক করে।
দেড় কিলোমিটার সাঁতার, চল্লিশ কিলো—।
আরে না না গড়গড়িদা, এসব তো নস্যি। কত দূরত্ব দিয়ে ট্রায়াথলনের শুরুটা হয়েছিল, জানেন? …সমুদ্রে আড়াই মাইল সাঁতার, একশো বারো মাইল সাইকেল রেস আর তারপর পুরো ম্যারাথন দৌড় অর্থাৎ ছাব্বিশ মাইল তিনশো পঁচাশি গজ। বাপস। শুনেই তো আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেছিল। এই ভাবে শরীরের ক্ষমতার পরীক্ষা মানুষে দিতে পারে। এর নাম হল আয়রনম্যান ট্রায়াথলন। আপনি যেটার কথা বলছেন তার নাম টিনম্যান ট্রায়াথলন।
আয়রনই হোক আর টিনই হোক, লোকে তো স্বেচ্ছায় পরীক্ষা দিতে কম্পিটিশনে নামছে। বলরাম গম্ভীর স্বরে বিষয়টির ওপর গুরুত্ব আরোপ করলেন।
নামছে বলে নামছে। মনোজের দুই চোখের মণি বিস্ফারিত হল। শয়েশয়ে ট্রায়াথলন বছরে হচ্ছে পৃথিবীর বহু দেশে, আর আমরাই এ-সম্পর্কে কিছু জানি না। আর লোক বলতে শুধু কি পুরুষ? মেয়েরাও আয়রনম্যান-এ নামছে। কোথায় পড়ে আছি আমরা। মনোজ মাথা নেড়ে আক্ষেপের সঙ্গে চুকচুক ধরনের একটা শব্দ মুখ দিয়ে বের করলেন।
বলরাম সান্ত্বনা দেবার মতো করে বললেন, আমাদের দেশে শুরু হোক, দেখবে প্রচুর ছেলেমেয়ে নামবে। দুঃখ হয় কী জানেনা, এসব স্পোর্টস আমাদের অল্পবয়সে ছিল না।
ছিল না তো কী হয়েছে, এখন তো হয়েছে। আপনি নামুন।
আমি নামব? বলরাম হেসে উঠতে গিয়েও হাসলেন না। শুধু মাথা নাড়লেন, এত কঠিন পরীক্ষা এই বয়সে শরীর দিতে পারবে না।
মনোজের মুখ এবার হাসিতে উদ্ভাসিত হল। পারবে না বলছেন? তা হলে এই বছরেরই গোড়ায় মাদ্রাজে যে ন্যাশনাল ট্রায়াথলন চ্যাম্পিয়ানশিপ হল, তার সঙ্গেই হল এশিয়ান কাপ সিরিজের প্রথম দফায় কম্পিটিশন। তাতে নেমেছিলেন জাপান ট্রায়াথলন ফেডারেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট। তাঁর বয়স কত জানেন?মনোজ একটা নাটকীয় মুহূর্ত তৈরি করলেন। বলুন, কত হতে পারে?
বলরাম বুঝলেন, ভাইস প্রেসিডেন্ট মশাই অবশ্যই বয়স্ক, নয়তো মনোেজ রহস্যময় করে তুলত না প্রশ্নটাকে। কত হবে বলব কী করে, এই ধরো পঞ্চাশ-বাহান্ন। বলরাম যথাসাধ্য বাড়িয়েই বললেন।
বাহাত্তর।
বলরামের বিস্ময়ে কোনও ভেজাল নেই। তিনি শুধু অ্যাঁ বলে তাকিয়ে। রইলেন।
অ্যা নয়, সত্যিই। বুড়ো পুরো ফিনিশ করেছে, তবে সবার শেষে। মনোজের গলায় প্রচ্ছন্ন একটা শ্রদ্ধা আবিষ্কার করলেন বলরাম বাহাত্তর বছরের এক জাপানির জন্য।
এই যে পঞ্চাশ বাহান্ন বললেন, আমেরিকার একটি লোক তাঁর বাহান্নতম জন্মদিনের বছরটা পালন করেছেন কীভাবে জানেন? মনোজ উত্তেজিত দৃষ্টিতে বলরামের দিকে তাকিয়ে রইল উত্তরের জন্য।
আমি কী করে জানব? ডাক্তারবাবুর সঙ্গে তো আমার কথা হয়নি।
বাহান্নটা ট্রায়াথলনে কম্পিট করে। তার মানে হপ্তায় একটা করে। চোখ বুজে ব্যাপারটা ভাবুন তো। আমরা পারব?
লোকটাকে কি লোকাল ট্রেনে ডেলি প্যাসেঞ্জারি করে কেরানির চাকরি করতে হয়?
মনোজ থতমত হয়ে আমতা আমতা করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, সুযোগ না দিয়ে বলরাম বললেন, সবসময় ওই ডেভেলপড কান্ট্রির লোকেদের সঙ্গে আমাদের মতো পিছিয়ে থাকা গরিব দেশের তুলনা কোরো না; নিজেদের ছোট চোখে দেখা উচিত নয়।
বলরামের চাহনিতে এমন কিছু একটা রয়েছে, যেটা মনোজের মাথা নত করে দিল। টেবিলের ড্রয়ার খুলে তিনি কলম, পিনকুশন, পেপার-ওয়েট ইত্যাদি বের করে টেবিলে সাজিয়ে রাখতে লাগলেন।
মনোজ, কোথাও যদি ট্রায়াথলন হয় আমি নামব। কথাটা কিন্তু এখন কাউকে বোলো না, তবে ডাক্তারবাবুকে জানিয়ে দিয়ো।
বলরাম তাঁর এই সিদ্ধান্তের কথা বিমলাকেও জানাননি। তুলসীকেও নয়।
.
স্পোর্টস টাইম পত্রিকাটি নামিয়ে রেখে জগন্নাথবাবু বললেন, এতে তো যা জানার তা সবই রয়েছে। তুই ভাল করে তা হলে প্র্যাকটিস শুরু কর।
শুরু মোটামুটি করেছি। সাইকেলটা মেরামত করতে দিয়েছি ওপারে জটাধারী রিপেয়ারিং শপে। কাল পরশু দেবে। ভোরে এখন সাইকেলের বদলে দৌড়চ্ছি। আমাদের ভেতর দিকে চালতাতলা, রাইহাটা, দেবীপুর যাওয়ার রাস্তাটা পাকা, ভাঙাচোরা নয়। ওটা ধরে গত দুদিন একঘণ্টা দৌড়ে এসে, জলে নেমে দুবার রানিসায়রটা এপার-ওপার করেছি। যেন অনুমোদন চায় এমনভাবে তুলসী তাকিয়ে রইল জগন্নাথবাবুর দিকে। তিনি মাথা নেড়ে বোঝালেন সন্তুষ্ট হয়েছেন।
তবে সাইকেলটা পেলে আগে সাইকেল তারপর দৌড়, যেভাবে আমুদা করে। আর বিকেলে সাঁতার। সকালে দৌড়বার আগে কিছু খেয়ে নিস। খালি পেটে দৌড়বি না, ভেজানো ছোলা বা বাদাম খাবি।
তুলসী মাথা নাড়ল।
খবর নিয়েছি, ডিসেম্বরের মাঝামাঝি ট্রায়াথলনের স্টেট চ্যাম্পিয়ানশিপ হবে। এন্ট্রি ফর্ম আনাবার ব্যবস্থা করে রেখেছি, বিডন স্ট্রিটে আমাদের অফিসের একটা ছেলে থাকে। তুই এখন বাড়ি যাবি কী করে, সাইকেলটা তো নেই।
হাঁটব। বিদ্যাসাগর ছাড়লেই তো অন্ধকার, তখন ছুটব।
জগন্নাথবাবুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে তুলসী এল জটাধারী হালদারের রিপেয়ারিং শপে।
কতদূর হল জটুবাবু? কাল পাব তো?
সিলিং থেকে চেন দিয়ে ঝোলানো একটা সাইকেল, তার দুটি চাকাই ভোলা। জটাধারী সেটি নিয়ে ব্যস্ত। তুলসীর দিকে না তাকিয়েই বলল, যা বদলাতে হবে তাতে পাঁচশো টাকার বেশি পড়ে যাবে। হ্যান্ডেলের নীচের রডটা মরচে ধরে ক্ষয়ে গেছে, চেনটা পালটাতে হবে, পেছনের ব্রেক কাজ করে না, সামনের চাকার রিমটা তো গেছে, দুটো স্পোক ভাঙা। চালাতেন কী করে। খুব কম করে আরও তিন-চারশো টাকা লাগবে। বলেন তো করে দিচ্ছি। আর নয়তো ঝালাই করে জোড়া লাগিয়ে কাজ চলার মতো করে দিতে পারি। পাঁচশোর মধ্যেই হয়ে যাবে। এবার বলুন, কী করবেন?
বিপন্ন বোধ করল তুলসী। আরও তিন চারশো টাকা দেওয়া সম্ভব নয়। তা ছাড়া, কাজ চলার মতো বলতেই বা কী বোঝায়?
দেখুন, এটা নিয়ে একটা কম্পিটিশনে নামব। জোড়াতালি দিয়ে সারালে ভেঙে যাবে না তো?
কীরকম কম্পিটিশন সেটা, যাতে এই সাইকেল নিয়ে নামার কথা ভাবছেন? জটাধারী অবিশ্বাসভরে তাকিয়ে রইল।
অস্বস্তিতে পড়ল তুলসী। এই লোককে এখন ট্রায়াথালন ব্যাপারটা বোঝানোর সময় তার নেই। বাড়ি ফিরতে হবে চার মাইল হেঁটে বা দৌড়ে।
তুলসীর মুখ দেখে জটাধারীর মনে হল, মাঠে বা রাস্তা বন্ধ করে যেসব অবিরাম সাইকেল চালানোর প্রতিযোগিতা হয়, তেমন কিছুতে বোধ হয় নামবে। তা ছাড়া সাইকেল কম্পিটিশন, তাও এইরকম সাইকেলে চড়ে, এ রাজ্যে কোথাও হয়ে থাকে বলে তো সে শোনেনি। তুলসীকে আশ্বস্ত করার জন্য সে বলল, চলে যাবে। পঁচিশ-তিরিশ ঘণ্টা টানা চালালেও কিছু হবে না। এ ব্যাপারে গ্যারান্টি দিচ্ছি।
ঠিক তো?
ঠিক।
তা হলে যা বললেন ওইভাবেই করে দিন। পাঁচশোর বেশি দেওয়ার সামর্থ্য আমার নেই। আমি কখন পাব?
কাল নয়, পরশু এই সময় আসুন। কাল কলকাতায় গিয়ে জিনিসপত্র কিনব। আর একটা কথা, ভাল কন্ডিশনে যদি সেকেন্ড হ্যান্ড পার্টস পাই, আনব কি? এতে টাকা বাঁচবে।
আনুন। আমি কিন্তু পরশু ঠিক রাত আটটায় আসছি।
.
বলরাম রাত থাকতেই বিছানা থেকে ওঠেন। ঘড়ি ধরে সাড়ে চারটের সময়, তাঁর ছেলে বলাইয়ের পরিত্যক্ত একটা পশমের টুপি মাথায় বসিয়ে সাইকেল নিয়ে বেরোন। তিনি যান বিদ্যানগর স্টেশনের দিকে। লেভেলক্রসিং পেরিয়ে আরও পশ্চিমের বি. টি. রোডে পৌঁছন। অতঃপর বাঁ দিকে ঘুরে, ফাঁকা মসৃণ রাস্তায় বেশ জোরে চালিয়েই বরানগরের টবিন রোড পর্যন্ত এলে পঁচিশ মিনিট সময় সম্পূর্ণ হয়। দূরত্ব ক্রমশ বাড়িয়ে আপাতত তিনি এই পর্যন্ত আসছেন। তারপর আবার একই পথ ধরে তিনি ফিরে আসেন। ঠিক পঞ্চাশ মিনিটে তিনি রামপ্রসাদ হস্টেলের সামনে এসে পৌঁছন এবং না থেমে আরও চোদ্দো মিনিটে কুলডাঙায় এবং রানিসায়রে। ঘড়ি ধরে এক ঘণ্টা চার মিনিটে তিনি সাইকেলের ওপরে থাকেন। অবশ্য কয়েক মিনিটের হেরফের কোনও কোনওদিন হয়। তাঁর লক্ষ্য সাইক্লিংয়ের সময়টাকে দেড়ঘণ্টা করা। এজন্য তিনি নিজেকে পাঁচদিন সময় দিয়েছেন।
একঘণ্টা সাইকেল চালিয়ে আসার পর রানিসায়রে পারাপার তাঁর কাছে কষ্টকর হয়। তিনি জানেন পারাপারে যতটা দূরত্ব, প্রায় ততটাই তাঁকে ট্রায়াথলনে অতিক্রম। করতে হবে। গঙ্গায় স্রোতের সঙ্গে সাঁতরানো আর স্থির জলে সাঁতার কাটার মধ্যে শারীরিক তাগদের পার্থক্য ঘটে। তাই ওপারে গিয়ে ফিরে আসার সময় তাঁর হাত ভার লাগে, সায়রের মাঝামাঝি বিশ্রাম নেওয়ার জন্য থেমে যান। কিছুক্ষণ জলে ভেসে থেকে আবার সাঁতার শুরু করেন। কিন্তু তাঁকে না থেমে পারাপার করতেই হবে যত মন্থর ভাবেই হোক না কেন। এজন্য তিনি নিজেকে সারাদিন সময় দিয়েছেন।
বলরাম রানিসায়র থেকে ফিরে যাওয়ার আগেই তুলসী বাড়ির সামনে সাইক্লিং শেষ করে। সাইকেলটা বাবুর হাতে দিয়েই সে দৌড় শুরু করে। বাবু সাইকেল চালিয়ে দিদির সঙ্গে রাইহাটা পর্যন্ত মাইল তিনেক গিয়ে আবার তার সঙ্গেই ফিরে আসে।
জটাধারী কথামতো নির্দিষ্ট দিনেই সাইকেল মেরামত করে তুলসীকে দিয়েছিলেন। দেওয়ার সময় বলেছিলেন, দেখবেন দিদি, এই সাইকেলই কম্পিটিশনে আপনাকে ফার্স্ট করে দেবে। শুনে তুলসীর মন খুশিতে ভরে গেছিল। সাইকেলের কিছু কিছু অংশ জটাধারী বদলে দিয়েছেন, কয়েক জায়গায় ঝালাই করেছেন। দুটো মাডগার্ডে এবং রডগুলোর কালো রংও করে দিয়েছেন, যেটা করার কথা ছিল না।
বলরাম কাউকে জানাতে চান না যে, তিনি ট্রায়াথলনে নামতে চান এবং সেজন্য নিজেকে তৈরি করছেন। যেহেতু তিনি মনে করেন, লোকে এ কথা জানলে হাসবে বা আড়ালে হাসাহাসি করবে। এমনিতেই তো তাঁর চেহারা আর হাঁটা নিয়ে লোকে হাসত। হাঁটাটা সংযত করেছেন। কেউ আর তাঁর দিকে এখন তাকায় না। কিন্তু ট্রায়াথলনে নামবেন শুনলে আবার হাসিটা শুরু হয়ে যাবে। তুলসীকেও তিনি বলেননি। কথায় কথায় পাছে বলে ফেলেন, সেজন্য তিনি ওর সঙ্গে দেখা করেন না, বাড়িতে গিয়ে খবরও নেন না। রানিসায়রে যাওয়ার একটা নতুন পথ তিনি বের করে ফেলেছেন, যেটা তুলসীদের বাড়ির ত্রিসীমানায় নয়। তিনি জানেন, আমুদার ট্রেনিংসূচি তুলসী অনুসরণ করবে। সে ভোরে সাইকেল আর দৌড় নিয়ে ব্যস্ত থাকবে, রানিসায়রে আসবে বিকেলে। তাই তিনি সাইক্লিং সেরে ভোরেই রানিসায়রে আসেন। তাঁদের মধ্যে আর দেখা হয় না।
বলরাম দৌড়চ্ছেন রাতে। ধাক্কাধাক্কি করে ট্রেনে উঠে তিনি অফিস থেকে সাড়ে ছটার মধ্যে বাড়ি ফেরার চেষ্টা করেন। আটটায় তিনি বাড়ি থেকে দৌড়তে বেরোন। এজন্য তিনি নতুন কেডস, হাফ প্যান্ট এবং স্পোর্টস গেঞ্জি কিনেছেন। মাথায় পশমের টুপিটা পরে তিনি ছুটতে যান গ্রামের দিকে, যেখানে রাত্রে রাস্তায় লোক প্রায় থাকেই না।
কিছু আলো-জ্বলা দোকান পথে পড়ে। দোকানে যারা থাকে, মুখ ফিরিয়ে তাঁর দিকে তাকায়। আর কিছু নয়। পথচলতি মানুষরাও তাকায়। বলরাম অন্ধকারে হোঁচট খান, গর্তে পা পড়ে, খোয়া, ইট পায়ে ফোটে। মাঝে মাঝে হাতঘড়ি দ্যাখেন আর একই গতিতে ছুটতে থাকেন এবং গতিটি খুবই মন্থর। তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েন। দাঁড়িয়ে হাঁপান। সারা শরীর অবসন্ন লাগে। সকালে সাইকেল, সাঁতার, অফিস করা, ট্রেনের ভিড় আর ধাক্কাধাক্কি; তারপর রাতে এই ছোটা। এক একসময় রাস্তার ধারের গাছে দুহাতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে তিনি জিরোন। তিনি জানেন, প্রথম হওয়ার জন্য তিনি ট্রায়াথলনে নামতে চান না। আর এই বয়সে তা সম্ভবও নয়। তিনি চান সমাপ্ত করতে, সকলের শেষে পৌঁছেও।
তুলসী এবং বলরাম একই দিনে খবর পেলেন, রাজা ট্রায়াথলন চ্যাম্পিয়ানশিপ হবে কলকাতার পুবে বেলেঘাটায় সুভাষ সরোবরে, ডিসেম্বরের উনিশ তারিখ রবিবারে।
বলরামকে খবরটা দিলেন মনোজ সামন্ত।
গড়গড়িদা, আপনাকে ডাক্তারবাবু দেখা করতে বলেছেন, পারলে আজই। উনি। ফর্ম আনিয়ে রেখেছেন। আপনি আমাদের সামন্তপুর স্পোর্টিংয়ের হয়ে ট্রায়াথলনে নামবেন।
তা হলে ছুটির পর তোমার সঙ্গেই যাব। ওঁর বাড়ি তো আমি জানি না।
মনোজের সঙ্গেই বলরাম ডাক্তারবাবুর চেম্বারে পৌঁছলেন। রোগীতে তখন অপেক্ষার ঘর ভর্তি। বাইরেও অনেকে দাঁড়িয়ে। মনোজ চেম্বারের মধ্যে ঢুকে আধ মিনিটেই বেরিয়ে এসে বলরামকে হাত নেড়ে ডাকলেন। ডাক্তারবাবুর সামনে তখন এক মহিলা তাঁর অসুস্থ ছেলেকে নিয়ে বসে।
আপনার এন্ট্রি ফর্ম—ডাক্তারবাবু ড্রয়ার খুলে ব্যস্তভাবে ফর্ম বের করলেন। কোনও এন্ট্রি ফি নেই। স্পোর্টসটা পপুলারাইজ করার জন্যই ওরা কোনও ফি নিচ্ছে না। ডাক্তারের সার্টিফিকেট লাগবে, সেজন্য তো আমি আছিই। আর সাইক্লিং ইভেন্টের জন্য মাথায় দিতে হবে একটা সেফটি হেলমেট। জোগাড় করতে পারবেন?
বলরাম অসহায়ভাবে মাথা নাড়লেন। এ জিনিস আমি পাব কোথায়?
ডাক্তারবাবু কয়েক সেকেন্ড ভেবে নিয়ে বললেন, অবশ্য না হলেও চলবে। একেবারে নতুন স্পোর্টস তো, ওরা বলেছে এটাকে পপুলার করার জন্য নিয়মকানুনের কড়াকড়ি করবে না। নিজের রিসকে কেউ যদি হেলমেট ছাড়াই সাইকেল চালায় তো চালাক, আপনি এই ওয়েভার অ্যান্ড ইনডেমনিটি ফর্মটায় সই করে দিন। মারা গেলে, পঙ্গু হয়ে গেলে, কি কোনও জিনিস হারালে সেজন্য স্টেট অ্যাসোসিয়েশন দায়ী থাকবে না বলে এতে লেখা আছে।
বলরাম দু পাতা জোড়া ইংরেজি ফর্ম না পড়েই সই করে দিলেন। ডাক্তারবাবু ফর্মটা আবার ড্রয়ারে রেখে বললেন, কিছু জানার থাকলে মনোজবাবুকে দিয়ে খবর দেব, আর উনিশে ডিসেম্বর আমি নিজে সুভাষ সরোবরে থাকব।
ডাক্তারবাবুর চেম্বার থেকে বলরাম যখন বেরোলেন, তুলসীও তখন জগন্নাথবাবুর বসার ঘর থেকে বেরোনোর জন্য সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে।
অনুকে তো তুই জানিস, আমার ভাগ্নি। ওর শ্বশুরবাড়ি সুভাষ সরোবরের খুব কাছে, হেঁটে তিন-চার মিনিট। আমি ফোন করে বলে রাখব, আগের দিন রাতে ওর বাড়িতে গিয়ে থাকবি। সাইকেলটা সঙ্গে নিয়ে যেতে ভুলিস না।
তুলসী হেসে মাথা নাড়ল। আর যে ভুলই করি না কেন, এটা করব না।
কম্পিটিশনের আগের দিন সকালে কিন্তু অবশ্যই সুভাষ সরোবরে যাবি। সব কম্পিটিটারদের ওরা নিয়মকানুন আর রুট বুঝিয়ে দেবে। এটা খুব ইম্পট্যান্ট। চিনে যেতে পারবি তো?
পারব। আপনি অনুদির ঠিকানাটা দিন। গ্রামে থাকি বলে কলকাতা চিনি না নাকি? কম্পিটিশনের দিন আপনি ওখানে থাকবেন তো কাকাবাবু?তুলসী অসহায়। চোখে তাকাল। এই ট্রায়াথলন তার জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হতে চলেছে। একদম একা হয়ে, নিজের পরিচিত পরিবেশ থেকে দূরে, ভরসা পাওয়ার মতো। একটা চেনা মুখও যদি তখন থাকে, তা হলে মনে কিছুটা জোর সে পাবে। কিন্তু সেখানে হাজির থাকার জন্য কাকে সে পাবে? ছোট ভাই বাবু ছাড়া এখান থেকে যাওয়ার মতো আর একজনই, এই জগন্নাথকাকা।
যাব না মানে? ঠাণ্ডা মাথার জগন্নাথবাবু উত্তেজিত স্বরে বললেন। আমাদের স্পোর্টস কমিটিতে দু-তিনজন কথা তুলেছে ট্রায়াথলনে আবার রিক্রুট করা কেন? আমার নাকি মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আমার মাথা যে ঠিক আছে, সেটা তোকে প্রমাণ করে দিতে হবে। দিল্লি থেকে বোর্ডের অ্যাপ্রুভাল আমি পেয়ে যাব। এখন বোর্ডে যিনি সেক্রেটারি তাঁর আউটলুকটা খুব মডার্ন, খেলার সব খবরাখবর রাখেন। এই রাজ্যে কোনও ট্রায়াথলনিস্ট এখনও কোথাও চাকরি পায়নি। আমার অফিস প্রথম চাকরি দেবে, এটাই হবে আমার সাফল্য। জগন্নাথবাবু বাঁ হাতের তালুতে ডান হাতের ঘুসি মারলেন।
স্টেট চ্যাম্পিয়ানশিপের আগের দিন বলরাম বাজার করে দিয়ে বাড়ি থেকে বেরোলেন সকাল সাতটায়। শনিবার তাঁর অফিস বন্ধ। তিনি লেভেলক্রসিং থেকে দেখতে পেলেন কলকাতার দিকে একটা ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে বেরিয়ে গেল। ওই ট্রেনেই উঠেছে তুলসী। সে জানত না, বলরামও ট্রায়াথলনের একজন প্রতিযোগী। তাই সুভাষ সরোবরে স্পোর্টস কাউন্সিলের সুইমিং পুলে জমায়েত ছোট-বড় মিলিয়ে বয়সভিত্তিক তিনটি বিভাগের ষাট-সত্তরজন প্রতিযোগীর মধ্যে হঠাৎ বলরামকে দেখতে পেয়ে সে ভীষণ অবাক হয়ে গেল।
মেসোমশাই, আপনি এখানে?
প্রথমে বলরাম অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করলেন। তারপর মনে হল, আর গোপন রেখে কোনও লাভ নেই। কালই তো তুলসী দেখতে পাবে এই প্রতিযোগিতায় তিনিও একজন প্রতিযোগী। এবার সত্যি কথাটা বলে দেওয়াই ভাল।
আমি তো কাল এখানে নামছি।
যাঃ। তুলসী বিশ্বাস করল না। বলরাম মুহূর্তের জন্য বেদনা বোধ করলেন। তাঁর যোগ্যতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করছে। সঙ্গে সঙ্গে এটাও বুঝলেন, তুলসীর অবিশ্বাস করাটা খুবই স্বাভাবিক। ট্রায়াথলনের মতো কষ্টসাধ্য খেলায় এদেশে তাঁর। মতো বয়সের কেউ যে নামতে পারে, কে সেকথা বিশ্বাস করবে?
বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি, বেশ, কালই দেখতে পাবে।
বেশ, দেখব। তুলসী হেসে বলল বটে, কিন্তু ওর মুখ দেখে বলরাম বুঝলেন, তাঁর নামার কথাটাকে ঠাট্টা হিসেবেই নিয়েছে।
সুভাষ সরোবর ওরা কেউই আগে দেখেনি। প্রথম দর্শনেই তুলসী বলল, মেসোমশাই, এটা কিন্তু রানিসায়রের থেকে অনেক বড়।
হোক না বড়, সেজন্য দেড় কিলোমিটারের বেশি তো আর সাঁতরাতে হবে না।
সরোবরটি গোল বা চৌকো নয়, কিছুটা ডিম্বাকৃতির। এর পুবে একটি বড় এবং পশ্চিমে অপেক্ষাকৃত একটি ছোট দ্বীপ রয়েছে। ওই দ্বীপ দুটিতে হরিণ রাখা ছিল। এখন আর নেই। রানিসায়রের ঘাট বলতে যা বোঝায়, এখানেও সেইরকম। পাড় থেকে ঢালু হয়ে নেমে যাওয়া ভাঙাচোরা জমি, সেটাই হল প্রতিযোগিতার প্রথম বিষয় সাঁতারের শুরুর জায়গা। সংগঠকরা সবাইকে বুঝিয়ে দিলেন, সাব-জুনিয়ার, জুনিয়ার ও সিনিয়ারদের কোন পথ ধরে কতটা সাঁতরাতে হবে। সিনিয়ারদের অর্থাৎ তুলসী ও বলরামকে প্রথমে বড় দ্বীপটা বেড় দিয়ে বাঁ দিকে পশ্চিমে ছোট দ্বীপের দিকে যেতে হবে। ছোট দ্বীপটিকেও বেড় দিয়ে আরও এগিয়ে ভাসমান একটি পতাকা ঘুরে আবার ফিরে আসতে হবে শুরুর এই জায়গায়। মোট দেড় কিলোমিটার সাঁতার কেটে জল থেকেই উঠেই প্রায় তিরিশ মিটার ছুটে গিয়ে উঠতে হবে সাইকেলে। তার মধ্যেই চটপট পরে নিতে হবে জুতো আর একটা গেঞ্জি। নম্বর লেখা সাঁতারের টুপিটা অবশ্য মাথায় বাঁধাই থাকবে।
সরোবর বেড় দিয়ে যে আড়াই কিলোমিটার পিচের রাস্তা, তাই ধরে সাইকেলে তাদের যোলোবার পাক দিতে হবে। ওরা সবাই চাক্ষুষ করবার জন্য রাস্তা ধরে হাঁটল। সাইকেল চালাবার পর এই রাস্তা ধরেই তাদের দৌড়তে হবে চারপাক। রাস্তাটি, বলরামের মনে হল, বিদ্যানগরের থেকে অনেক ভাল। তবে অনেক জায়গায় ভাঙাও রয়েছে। কিন্তু যে জিনিসটি তাঁর কাছে মসৃণ গতিতে স্থিরভাবে সাইকেল চালাবার পথে বিঘ্নকারী বলে মনে হল, সেটি হচ্ছে স্পিড ব্রেকার।
মেসোমশাই, ওই দেখুন, সল্ট লেক স্টেডিয়াম দেখা যাচ্ছে। রাস্তা দেখার থেকেও তুলসীর চোখ আশপাশের দিকেই বেশি। আপনি ওখানে কখনও খেলা দেখেছেন? আমি দেখিনি। খুব ইচ্ছে করে, একবার অন্তত রাত্রে একটা ফুটবল ম্যাচ দেখতে।
কিন্তু এখন ভাল করে দেখে নাও এই স্পিড ব্রেকারগুলোকে। ফুটবল ম্যাচ দেখার কথা পরে ভেবো। এই দ্যাখো, বলরাম আঙুল দিয়ে দেখালেন, রাস্তার মাঝে আড়াআড়ি স্ফীত হয়ে থাকা জায়গাটি।
অসুবিধের তো কিছু নেই। তুলসীর সহজ ও সরল স্বর বুঝিয়ে দিল স্পিড ব্রেকার কোনও সমস্যা নয় তার কাছে। স্পিড কমিয়ে সাইকেল আস্তে করে নিলেই হবে। কেমন রাস্তা দিয়ে কুলডাঙা থেকে যাতায়াত করতে হয় তা তো জানেন। আচ্ছা মেসোমশাই, এটা কীসের মন্দির বলুন তো?
গিয়ে দেখে এসো।
রাস্তা থেকে সরোবরের দিকের জমিতে সাদা একটি মন্দির গৃহ। তুলসী ছুটে গিয়ে ভেতরে উঁকি দিয়েই ফিরে এল।
লেখা রয়েছে লোকের বাবার পুরাতন মন্দির। ভেতরে শিবলিঙ্গ। হনুমান মূর্তিও রয়েছে। আচ্ছা মেসোমশাই, আপনি ভগবান মানেন?
মানি না, তবে কাল মানব।
আপনি কি কাল নামছেন?
হ্যাঁ। বলেই তুলসীর মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝলেন, এখনও বিশ্বাস করেনি।
আচ্ছা, এই যে বিরাট বিরাট কংক্রিটের এত পাইপ পড়ে রয়েছে, এগুলো কী জন্য?
তুলসীর কৌতূহল মেটাবার চেষ্টা না করে বলরাম তার নজর টেনে বললেন, রাস্তাটা দ্যাখো, এখানেও একটা স্পিড ব্রেকার।
তুলসী দেখে বলল, এসব এখন দেখে কী হবে মেসোমশাই, যখন চালাব তখন চোখ রেখেই চালাব। সরোবরের এই দিকটা দেখে আমার কিন্তু রানিসায়রের কথা মনে পড়ছে। বেলা হলে রানিসায়রে চান করার জন্য যেরকম লোক হয়, গোরু বাছুর এনে গা ধোওয়ায়, তাকিয়ে দেখুন অনেকটা সেইরকম। ওরে বাবা কতগুলো মোষও রয়েছে, কেন জানি এদের আমার খুব ভয় করে। আচ্ছা, মোষেরা কি খুব হিংস্র হয়?
বোধ হয়, হয়। শুনেছ তো, ওঁরা বললেন আজ রাত্রে এখানে সাইকেল রাখার ব্যবস্থা আছে। তুমি সঙ্গে করে আনলে না কেন? তা হলে আর কাল সকালে ট্রেনে চড়িয়ে আসতে হবে না।
তুলসী মুচকি হেসে বলল, সে ব্যবস্থা আমার আছে। এখানে জগন্নাথকাকার ভাগ্নি অনুদির বাড়িতে আজ রাতে আমি আর ভাই থাকব। সাইকেল নিয়ে আজই রাতের ট্রেনে চলে আসব।
বলরাম ভাবলেন, সাইকেল এনে রেখে দিয়ে আবার তাঁর বিদ্যানগর ফিরে যাওয়ার থেকে বরং কাল প্রথম ট্রেনেই ভেণ্ডার কামরায় উঠে চলে আসাই ভাল। রোজই তো ভোরে সাইকেল নিয়ে বাড়ি থেকে বেরোন, সুতরাং বিমলা বুঝতেই পারবে না কোথায় যাচ্ছি। নিশ্চয়ই দুপুরের মধ্যেই বাড়ি ফিরে যাওয়া যাবে। দোকান বাজার আজ রাতেই সেরে রাখতে হবে।
মেসোমশাই, এই দেখুন একটা মসজিদ। জলের এপারে আর ওপারে মুখোমুখি মন্দির আর মসজিদ, অদ্ভুত নয়?
তুলসী, কাল তোমাকে যাদের সঙ্গে পাল্লা দিতে হবে তাদের সম্পর্কে কোনও খোঁজখবর কি নিয়েছ? এই যে কুড়ি-পঁচিশজন মেয়েকে দেখছি, এদের মধ্যে মনে হচ্ছে সিনিয়ার মেয়ে খুবই কম, সাত-আটজন বড়জোর। তোমার কী মনে হচ্ছে ওদের দেখে?
কিছুই মনে হচ্ছে না। নির্বিকার মুখে তুলসী বলল। আগে থাকতে মনের মধ্যে ভয় ধরিয়ে রাখলে সেটা ঘণ্টায় ঘণ্টায় বেড়েই যায়। তিনটে বিষয়ে কম্পিটিশন, সবাই তিনটেতে দড় হবে আপনি কি তাই মনে করেন?
না।
সাঁতারে কলকাতার মেয়েরা ভাল। ওরা রেগুলার শেখে, প্র্যাকটিস করে, কম্পিটিশনে নামে। আমি শিখিনি, কম্পিটিশনে কখনও নামিনি। আমি জানি সাঁতারে আমি পিছিয়ে থাকব, কিন্তু সাইকেলে আমি অনেকটা মেক-আপ করে নেব। মাঝের এটাই খুব গুরুত্বপূর্ণ। তবে আমার ভরসা রানিং। দশ কিলোমিটার দৌড়েছি তো, আমি জানি কীভাবে দৌড়তে হবে। আমুদার কথা মনে আছে আপনার?
আছে। কিন্তু তুমি কি জানেনা মাদ্রাজে একজন বাহাত্তর বছরের জাপানি ট্রায়াথলনে কম্পিট করে ফিনিশও করেছেন?
কই না তো।তুলসী বিস্মিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। বাহাত্তর বছরের?
বলরাম আলতো হেসে বললেন, তা হলে তুমি আমার কথা অবিশ্বাস করছ কেন? আমি তো বাহাত্তরের অনেক কম।
মেসোমশাই…সত্যি।
তুলসী আবেগের বশে বলরামের দুই হাত চেপে ধরল। কী দারুণ ব্যাপার, আমরা দুজনেই কাল নামছি।
হ্যাঁ নামছি। আর আমার মন বলছে তুমি জিতবে।
তুলসী ঝপ করে বলরামকে প্রণাম করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমার মন বলছে আপনি ফিনিশ করবেন।
তুলসীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলরাম মনে মনে বললেন, চাকরি যেন পায়। কাল নয়, ভগবান, আজ থেকেই তোমায় আমি মানছি।
.
বেলেঘাটা সুইমিং অ্যাসোসিয়েশনের ঘাটে, সুভাষ সরোবরের হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে বারোটি ছেলে ও চারটি মেয়ে। তাদের পেছনে পায়ের পাতা জলে ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে, মাথায় কাপড়ের টুপি ও কস্টিউম-পরা একজন পুরুষ প্রতিযোগী। তাঁর আচরণের মধ্যে কোনওরকম অধৈর্যের বা নার্ভাস হওয়ার ভাব প্রকাশ পাচ্ছে না। ইনি বলরাম গড়গড়ি। চারটি মেয়ের অন্যতম তুলসী। তার ভাই বাবু উৎকণ্ঠা আর উত্তেজনা নিয়ে দিদির দিকে তাকিয়ে। ভিড়ের পেছনে দাঁড়িয়ে জগন্নাথবাবু।
সকাল আটটা থেকে রাজ্য ট্রায়াথলন চ্যাম্পিয়নশিপ প্রথমে সাব-জুনিয়ার ছেলে ও মেয়েদের দিয়ে শুরু হয়। তারপর হয় জুনিয়ার ছেলে ও মেয়েদের। এখন শুরু হতে চলেছে সিনিয়ারদের প্রতিযোগিতা। অভিভাবক, সংগঠক, ভলান্টিয়ার আর দর্শকদের ভিড় ও ব্যস্ততায় সরোবরের দক্ষিণ দিকটা সরগরম। না উষ্ণ না শীতল, এমন একটা বাতাবরণ বিরাজ করছে সরোবর ঘিরে। ছুটির দিন; তাই প্রচুর মানুষ। তারা ব্যস্ত হয়ে পথ চলছে, ঘাসে বসে গল্প করছে অথবা জলে নেমে স্নান করছে। একটা কিছু প্রতিযোগিতা হচ্ছে জানতে পেরে বহু মানুষ ধারেকাছের বাড়ি থেকে এসে দর্শক হয়েছে।
শুরুর সঙ্গে সঙ্গে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল প্রতিযোগীরা। বলরাম কোমর জলে নেমে গিয়ে সামনে তাকালেন। যোলাজোড়া হাত ও পায়ের তাড়নায় জলে ফেনা কাটছে। যোলোটি লাল টুপির মধ্যে বাইশ নম্বর লেখা টুপিটিকে খুঁজলেন, কিন্তু দেখতে পেলেন না। একবার পেছনে তাকিয়ে খুঁজলেন ডাক্তারবাবুকে। বলেছিলেন তো। আসবেন। অতঃপর সময় নষ্ট না করে তিনি জলের হাতে নিজেকে ছেড়ে দিলেন।
বড় দ্বীপটা প্রায় দেড়শো মিটার দূরে। বলরাম সেটিকে বেড় দিয়ে যখন ছোট দ্বীপটার দিকে যাচ্ছেন তখন সামনের ষােলো জনের ঝাঁক থেকে বেরিয়ে সাত-আটটি ছেলে এগিয়ে গেছে। সব থেকে পিছিয়ে থাকা সাঁতারুটির থেকেও বলরাম একশো। মিটার পিছিয়ে। তিনি জানেন, ওদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার কোনও তাগিদ তাঁর নেই। তাঁকে দম আর ক্ষমতা সঞ্চয় করে রাখতে হবে।
তুলসী ছেলেদের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে না, সে সিনিয়ার মেয়েদের বিভাগের চারজনের একজন। তার প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাকি তিনজনের সঙ্গে এবং তার পূর্ব-অনুমান মতোই সে তাদের থেকে পিছিয়ে পড়েছে। দ্বিতীয় দ্বীপ ছাড়িয়ে আরও প্রায় দুশো মিটার দূরের ফ্ল্যাগটার দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় সে একবার মুখ তুলে দেখল অন্তত বারোটা লাল টুপি ফ্ল্যাগটাকে ঘুরে স্টার্টিং পয়েন্টে ফিরে যাচ্ছে। এখন তার পাশে শুধু দুটি ছেলে, যারা অর্ধেক পথ এসেই শ্রান্ত হয়ে পড়েছে। সে চেষ্টা করল ওদের টুপিতে তিপ্পান্ন নম্বর লেখা আছে কি না দেখতে। কিন্তু দেখতে পেল না। দেখার কথাও নয়, কেননা বলরাম তখন তার প্রায় তিনশো মিটার পেছনে। তুলসী অন্য তিনটি মেয়ের নম্বর মনে করে রেখেছে। একুশ নম্বর একটু বেঁটে, পায়ের ডিমদুটো খুব পুষ্ট, নাকটা বসা। তেইশ নম্বর তারই মতো ছিপছিপে, চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা, দাঁত উঁচু। চব্বিশ নম্বর বোধ হয় নেপালি মেয়ে, চোখ-মুখ গায়ের রং সেইরকমই। এরা তিনজনই এখন তার থেকে অনেক এগিয়ে।
বলরাম ফ্ল্যাগটাকে ঘুরে যখন প্রায় এক কিলোমিটার অতিক্রম করেছেন তখন প্রথম ছেলেটি সাঁতার শেষ করে জল থেকে উঠল এবং তার অর্ধ মিনিটের মধ্যে আরও সাতজন। এই সময় দেখলেন তাঁর সামনের ছেলেটি জলে ডুবে গিয়ে আবার ভেসে উঠল। দু হাত তুলে মাথা নেড়ে হাঁ করছে আর ডুবছে। ডাঙায় দর্শকদের মধ্যে চাঞ্চল্য। একজন লাইফ সেভার জলে ঝাঁপিয়ে সাঁতারে ছেলেটির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তাই দেখে বলরাম থমকে গেলেন। ছেলেটিকে ধরে লাইফ সেভার ডাঙার দিকে নিয়ে যাচ্ছে দেখে তিনি আবার সাঁতার শুরু করলেন।
তুলসী সাঁতার শেষ করল দুটি ছেলের সঙ্গে, কিন্তু তিনজন মেয়েরই পেছনে। জল থেকে উঠেই সে দৌড়ে গেল সাইকেলের দিকে। দ্রুত হাতে কস্টিউমের ওপরই পরে নিল হাফ প্যান্টটা, পায়ে পরে নিল কেডস জোড়া এবং গায়ে দিল গেঞ্জিটা। এক মিনিটের মধ্যেই তিনটি কাজ শেষ করে সে সাইকেলে চেপে বসল। তখন তেইশ নম্বর এক কিলোমিটার এগিয়ে গেছে এবং তার পেছনেই চব্বিশ ও একুশ নম্বর।
সকলের শেষে বলরাম জল থেকে উঠে দেখলেন বুকে ব্যাজ আঁটা চার-পাঁচজন লোক তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে। সবচেয়ে বর্ষীয়ান প্রতিযোগী হিসেবে ইতিমধ্যেই তিনি খ্যাত হয়ে গেছেন। তাঁর প্রতি একটু বেশিই যেন নজর দেওয়া হচ্ছে বলে তাঁর মনে হল।
অপেক্ষমাণদের একজন রাজ্য ট্রায়াথলন অ্যাসোসিয়েশনের সচিব। তিনি ব্যস্তভাবে বললেন, বলরামবাবু, চটপট জুতো আর গেঞ্জিটা পরে নিন। প্রথম ছেলেটি দুপাক এই শেষ করল।
শ্রান্তিভরা মুখে একটু হেসে বলরাম কেডস পরলেন। গেঞ্জির ঝুলটা তাঁর প্রায় হাঁটুর কাছাকাছি পৌঁছল। হাফ প্যান্ট পরার দরকার হল না। তিনি সাইকেলে উঠতে উঠতে দেখলেন ডাক্তারবাবু আসছেন প্রায় ছুটেই।
বেরোবার মুখে হঠাৎ এক হার্ট অ্যাটাকের কল…। তিনি কথা সম্পূর্ণ করার আগেই বলরাম তাঁর পাশ দিয়ে চলে গেলেন।
অনেক পিছিয়ে গেছি, ব্যবধানটা আমাকে কমাতেই হবে, এই চিন্তাটা মাথায় নিয়ে তুলসী সাইক্লিং শুরু করল। বহুদূরে তিন-চারজন সাইক্লিস্টের পিঠের দিকে তাকিয়ে সে জোরে জোরে প্যাডেল করে একশো মিটার যাওয়ার পরই সাইকেলটা ছিটকে লাফিয়ে উঠল। ঘুরে যাওয়া হ্যান্ডেল শক্ত হাতে বশে এনে তুলসী স্পিড ব্রেকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে গেল। আরও দুশো মিটার পর লোকেশ্বর বাবার মন্দিরের আগে আর-একটি স্পিড ব্রেকার। সাইকেলের গতি কমিয়ে সেটা অতিক্রম করে সে। গতি বাড়াল এবং ক্রমশই বাড়াতে থাকল।
রাস্তা থেকে ধারে সরে যাচ্ছে পথচারীরা। বাইরে থেকে যেসব রাস্তা এসে ঢুকেছে। সরোবরের এই রাস্তায়, তার মুখগুলিতে পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। হঠাৎ কোনও সাইকেল, মোটরবাইক ঢুকে এসে বিপত্তি তৈরি যেন না করে, সেটা রোধ করাই তাদের কাজ। কিন্তু বিঘ্ন ঘটায় তো মানুষই। দুটি বাচ্চা মেয়ে এমন সময়ে রাস্তা পার হচ্ছিল যখন এক পুরুষ সাইক্লিস্ট প্রায় তাদের ওপর এসে পড়ছিল। ব্রেক কষে সে টলে পড়ে গেল। মেয়ে দুটি ভয় পেয়ে দৌড় দিল আর তুলসী তখনই সেই সাইক্লিস্টকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেল।
ডান দিকে কলকাতা কর্পোরেশনের কর্মীদের জন্য বোধ হয়, সারি দিয়ে একতলা টালির চালের কোয়ার্টার। বড় বড় কংক্রিট পাইপ পড়ে রয়েছে, তারপর সরোবরের বাইরে থেকে ভেতরে ঢোকার একটা চওড়া প্রবেশ পথ। তার আগে একটা স্পিড ব্রেকার। তারপর মসজিদ। তুলসী কুঁজো হয়ে প্যাডেল করতে করতে একবার মুখ তুলে দেখে নিল তার পঞ্চাশ মিটার দূরে একটি মেয়ের পিঠ। এইবার একে আমি পেছনে ফেলব, নিজেকে এই বলে সে আরও ঝুঁকে, সিট থেকে নিজেকে সামান্য তুলে প্যাডেলে চাপ দিল। পিস্টনের মতো ওঠানামা করতে লাগল তার দুই পা।
একুশ নম্বর পেছনে পড়ে গেল। মুখ ফিরিয়ে তার দিকে তুলসী যখন তাকাল তখনই একটা স্পিড ব্রেকারের উপর উঠল তার সাইকেল। একটা বড় ঝাঁকুনি খেল সে। মনে মনে সে বলল, ভাগ্যিস সাইকেলটা সারিয়ে নিয়েছিলাম, নয়তো এতক্ষণে চাকাটাকা খুলে বেরিয়ে যেত। একুশ গেল, এবার ধরতে হবে তেইশ বা চব্বিশকে।
বলরামের কাউকে ধরার জন্য তাড়া নেই। তাঁকে বনবন করে পেরিয়ে গেল এক সাইক্লিস্ট। বলরাম মুচকি হাসলেন এবং ধাওয়া করলেন। ছেলেটা কত পাক দিয়ে ফেলেছে কে জানে। কিন্তু খুব বেশি পিছিয়ে থেকে কম্পিটিশন শেষ করাটা মর্যাদাকর হবে না। এবার একটু স্পিড বাড়ানো যেতে পারে। এই ভেবে বলরাম গতি বাড়ালেন, আর তখনই তাঁর পাশ দিয়ে যাওয়া সাইকেল থেকে তুলসী চেঁচিয়ে বলল, মেসোমশাই, আর একটু জোর লাগান।
ফিনিশিং পয়েন্টে এখন ভিড়। গণ্যমান্য অতিথিরা রাস্তার ধারে চেয়ারে বসে। সেখানে টাইমকিপার আর রেকর্ডাররা। নম্বর দেখে তাঁরা চেঁচিয়ে জানিয়ে দিচ্ছেন প্রতিযোগিদের, আর কত পাক সাইকেল তাদের চালাতে হবে। প্রত্যেকের নামের পাশে সংখ্যার ঘরে টিক পড়ছে। মেয়েদের মধ্যে এগিয়ে আছে তেইশ নম্বর। টাইমকিপারদের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় তুলসী শুনল, চিৎকার করে কে বলল ইলেভেন টু গো। আর শুনল, দিদি, সামনেই তেইশ। সে আড়চোখে দেখল জগন্নাথকাকা ভিড় থেকে একটু দূরে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে, মুখ ফ্যাকাশে। তুলসী, আরও জোরে, এইটুকু ছাড়া আর কিছু তিনি বলতে পারলেন না।
আরও জোরে। সামনে তেইশকে সে দেখতে পাচ্ছে। স্পিড ব্রেকার দেখেও সে গতি কমাল না, শুধু সিট থেকে নিজেকে তুলে দিল। এতটা ঝাঁকুনি সহ্য করল সাইকেলটা… আরও জোরে। প্রথম তাকে হতেই হবে।
ডান দিকে কর্পোরেশনের কোয়ার্টারগুলো। তারপর সিমেন্টের পাইপগুলো, তারপর বাইরে যাওয়ার চওড়া রাস্তা। তুলসী এগোচ্ছে রাস্তার দিকে। আর ঠিক তখনই সার দিয়ে বাইরে থেকে সরোবর এলাকায় ঢুকল তিনটি মোষ, তাদের সঙ্গে একটি বাচ্চা মোষ। কী খেয়াল হল বাচ্চাটার সে হঠাৎ ওদের সঙ্গ ছেড়ে বাঁ দিকে ছুট দিল যেদিক থেকে তুলসী আসছে। তিনটি মোষের একটি, বোধ হয় বাচ্চার মা, মুখ ফিরিয়ে বাচ্চাটার উদ্দেশে একটা ডাক দিল।
তুলসী দেখল, বাচ্চা মোষটা তার দিকেই লাফিয়ে লাফিয়ে আসছে আর তার মা, থলথলে মাংসল চেহারায়, শিংওয়ালা একটি মোষ, বিস্ফারিত চোখে, বোধ হয় তার দিকেই তাকিয়ে ছুটে আসছে, হয়তো ধরে নিয়েছে তার বাচ্চাকে সাইকেল আরোহী আক্রমণ করবে।
কী করব এখন? প্রশ্নটা মাথার মধ্যে ঝলসে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তুলসী সাইকেলের হ্যান্ডেল ডান দিকে ঘোরাল। সেইদিকেই পড়ে রয়েছে কংক্রিটের পাইপ। সামনের
চাকা পড়ল স্পিড ব্রেকারে, সে ব্রেক কষল।
এর পর তুলসী নিজেকে দেখতে পেল সাইকেল থেকে উড়ে গিয়ে জমির ওপর পড়তে আর সাইকেলটি পাইপে সজোরে ধাক্কা খেয়ে তার থেকে দশ মিটার দূরে পড়ে আছে। মোষটি তুলসীর দিকে না তাকিয়ে সোজা ছুটে গেল বাচ্চার দিকে। কিছু লোক ঘটনাটি দেখল, কিন্তু তুলসীকে চটপট উঠে দাঁড়াতে দেখে তারা সাহায্যের জন্য আর এগিয়ে এল না। পরপর দুজন সাইক্লিস্ট তার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তাকিয়ে দেখে গেল।
সময় নষ্ট হল। মোটা মোটেই হিংস্র নয়, এই ধারণা নিয়ে তুলসী এগিয়ে গিয়ে হ্যান্ডেল ধরে সাইকেলটি তুলেই বজ্রাহত হল! হ্যান্ডেলসহ সাইকেলটি তার হাতে উঠল সামনের চাকাটিকে জমিতে রেখে। হ্যান্ডেল থেকে সামনের চাকায় নেমে যাওয়া রডের যেখানে ঝালাই করা হয়েছে, সেখানেই রডটা দু টুকরো হয়ে গেছে। শুধু সরোবর আর তাকে ঘিরে যাবতীয় জড় ও চলমান দৃশ্যই নয়, তার সারা জীবনটাই যেন পুড়ে খাক হয়ে গেল। অন্ধকার ছাড়া চোখে আর কিছু সে এখন দেখতে পাচ্ছে না। ধীরে ধীরে সে রাস্তার ধারে বসে পড়ল।
ঠিক সেই সময় বলরাম ছিলেন সরোবরের বিপরীতে, তুলসীর থেকে প্রায় এক কিলোমিটার পেছনে। তিনি বারবার শুধু নিজেকে বলে যাচ্ছিলেন: আঁকুপাকু নয়, মাথা গরম নয়, পাশ দিয়ে সবাই চলে যাচ্ছে তো যাক। নির্দিষ্ট একটা স্পিড় ধরে রেখে চালিয়ে যেতে হবে। সেই কচ্ছপ আর খরগোশের গল্পটা মনে রাখা দরকার। স্লো অ্যান্ড স্টেডি উইনস…. কম্পিটিশনের এখনও অর্ধেকও হয়নি। এর পর আছে দৌড়। সেজন্য দম জমা করে রাখতে হবে, পা দুটোর ক্ষমতা ধরে রাখতে হবে, এই ট্রায়াথলন শেষ করতেই হবে।
বলরাম ব্রেক কষলেন তুলসীকে ঘাসের ওপর বসে থাকতে দেখে। তার সামনে দু খণ্ড হওয়া সাইকেলটি।
এ কী হল? বলরাম সাইকেল থেকে নেমে এগিয়ে এলেন। ভাঙল কী করে?
তুলসী শূন্য চোখে বলরামের মুখের দিকে তাকাল। ধীরে ধীরে শুধু মাথা নাড়ল। মাথাটি নামিয়ে নিল। টসটস করে জল পড়ল গাল বেয়ে।
মেসোমশাই, আমার ভাগ্য। বলেছিলেন, আমি নাকি জিতব। এই আমার জেতা দেখুন। আঙুল দিয়ে সে ভাঙা সাইকেলটিকে দেখাল।
আমার কথা মিথ্যে হবে না তুলসী, ওঠো।
তুলসী মুখ নামিয়ে মাথা নাড়ল।
ওঠো, ওঠো। বলরাম চাপা স্বরে চিৎকার করে উঠলেন। তেইশ নম্বর এই সময় সাইকেল নিয়ে তাদের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার সময় আড়চোখে তাকাল।
বলরাম খপ করে তুলসীর ঘাড়ের কাছে গেঞ্জিটা বাঁ মুঠোয় ধরে তাকে টানলেন। হকচকিয়ে তুলসী উঠে দাঁড়াল।
সময় নষ্ট কোরো না, সবাই এগিয়ে যাচ্ছে, এক্ষুনি ওঠো। নিজের সাইকেলটি বলরাম এগিয়ে দিলেন। তুলসী কিছু বলতে যাচ্ছিল, বলরাম তার আগেই তার ডান হাতটা তুলে হ্যান্ডেলে রেখে সাইকেল ছেড়ে দিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন সরোবরের জলের দিকে। সাইকেল পড়ে যাচ্ছিল, তুলসী শৃক্ত মুঠোয়। হ্যান্ডেলটা ধরে ফেলল আর সঙ্গে সঙ্গে একটা কঠিন ইচ্ছা তড়িৎগতিতে তার ডান হাত বেয়ে চেতনায় ঢুকে গেল। সে শক্ত দু হাতে হ্যান্ডেল ধরে প্যাডেলে পা রাখল।
বলরাম জলের দিকে যেতে যেতে থেমে গেলেন। মুখ ঘুরিয়ে দেখতে পেলেন, তাঁর সাইকেলকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে কুঁজো হয়ে থাকা একটি পিঠ, যার দুই পা ওঠানামা করছে শিকার তাড়া করা চিতাবাঘের মতো। বলরাম দ্বিখণ্ডিত সাইকেলের কাছে ফিরে এলেন।
তেরো পাক শেষ হওয়ার আগেই তুলসী ধরে ফেলল মেয়েদের মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে থাকা চব্বিশ নম্বরকে। বহু আগেই সে একুশ নম্বরকে পেছনে ফেলে দিয়ে এসেছে। এখনও বাকি তিন পাক। তেইশ নম্বর ভাল চালায়, সাইকেলটাও দামি। তুলসীর সাইকেল বদলে যাওয়াটা বাবু প্রথম লক্ষ করে বলল, দেখুন দেখুন, দিদি মেসোমশাইয়ের সাইকেল দিয়ে চালাচ্ছে।
তাই তো। তা হলে বলরামবাবু গেলেন কোথায়? ডাক্তারবাবু হতবুদ্ধি হয়ে পড়লেন। লোকটা কি উবে গেল?
সেইসঙ্গে তুলসীর সাইকেলটারও তো পাত্তা নেই।
তা হলে তো খোঁজ করে দেখতে হয়। ডাক্তারবাবুকে উদ্বিগ্ন দেখাল। আমি বরং একটা চক্কর দিয়ে আসি।
পুরুষ বিভাগে প্রতিদ্বন্দ্বিতা পাঁচজনের মধ্যে চলেছে। প্রথম ছেলেটি সাইকেল থেকে নেমে দৌড় শুরু করার দুমিনিটের মধ্যে আরও তিনটি ছেলে নামল। ওদের পাশ দিয়ে তুলসীর সাইকেল বেরিয়ে গেল। সরোবরের একদিক থেকে বিপরীত দিকের রাস্তায় চলাচল দেখা যায়। তুলসী লোকের বাবার মন্দিরের কাছ থেকে সরোবরের অপর দিকে তাকিয়ে দেখল, কয়েকটা সাইকেল চলেছে। মসজিদের সামনের সাইকেল-আরোহীটিকে তার মনে হল, তেইশ নম্বর হলেও হতে পারে।
অনেক দূর। ওকে ধরতে হলে তাকে অনেক পথের ব্যবধান ঘোচাতে হবে। এটাই ওর শেষ পাক। সাইকেলের ফিনিশিং পয়েন্টে নেমে ও দৌড় শুরু করে দেওয়ার অনেক পরে আমি নামব, তারপর—তুলসী মনে মনে চমকে উঠল। তারপর কী? সূর্য সঙ্ঘের দশ কিলোমিটার রেসের সেই দৃশ্যটা পলকের জন্য চোখে ভেসে উঠল— মেয়েটি হুমড়ি খেয়ে রেল লাইনের আপ তিন নম্বর ট্র্যাকের পাশে, জমিতে দু হাত রেখে ওঠার চেষ্টা করছে।
ভাগ্য সেদিন তাকে সাহায্য করেছিল। আজও ভাগ্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে তার হাতে তুলে দিয়েছে সাইকেলটা। কিন্তু বারবার তিনবার ভাগ্য কারও পাশে এসে দাঁড়ায় না। এবার আমাকে নিজেই জিততে হবে, নিজে, নিজে, নিজে…। জিততে হবে এই লোকটির জন্য। বাহাত্তর বছরে যদি ফিনিশ করতে পারে… আমার কথা অবিশ্বাস করছ কেন? আমি তো বাহাত্তরের অনেক কম। আমাকে জিততে হবে। একটা মানুষ নিজের গড়া স্বপ্ন নিজের হাতেই ভাঙলেন… আর আমি অবিশ্বাস করছি না মেসোমশাই। ওহহও তুলসী, আরও জোরে, আরও জোরে।
সাইক্লিংয়ের সমাপ্তিসীমার দুধারে ভিড়। দু-তিনজন হাত তুলে তুলসীকে থামতে সঙ্কেত দিচ্ছে। ছুটে এল ভলান্টিয়াররা। সাইকেল থেকে নেমেই সেটি তাদের হাতে প্রায় ছুড়ে দিয়ে তুলসী দৌড়তে শুরু করল। তার মাত্র পঁচাত্তর মিটার দূরে তেইশ নম্বর দৌড়ে যাচ্ছে। এবার দশ কিলোমিটার দৌড়তে হবে। এটা আমার নিজের ইভেন্ট।
ডাক্তারবাবু হাঁটতে হাঁটতে দুধারে তাকাচ্ছেন। কোথায় বলরাম। রাস্তা থেকে সরোবরের পাড় পর্যন্ত ঘাসের জমিতে প্রচুর লোক। সবাই স্নান করতে এসেছে। বলরাম এমনই এক চেহারার, চট করে খুঁজে বের করাই মুশকিল। তবে হাঁটু পর্যন্ত। গেঞ্জি আর মাথায় তিপ্পান্ন সংখ্যা দেওয়া কাপড়ের টুপিটা তাঁকে খোঁজ দিতে সাহায্য করতে পারে।
দাঁড়িয়ে পড়লেন ডাক্তারবাবু। বহু লোক ঘাসে বসে রয়েছে, কেউ কেউ শুয়ে। একটা বিরাট অশ্বত্থ গাছ, নীচে বিশাল ছায়া। তিনি দেখলেন, ছায়াতে একটা সাইকেল পড়ে রয়েছে। গুটি গুটি এগিয়ে গিয়ে চমকে উঠলেন। বলরাম চিত হয়ে শুয়ে, চোখ দুটি বোজা। তাঁর পাশে দু খণ্ড হওয়া একটা সাইকেল।
কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বোঝার চেষ্টা করলেন, ব্যাপারটা কী? কিছুই বুঝতে না পেরে ডাকলেন বলরামবাবু, ও বলরামবাবু।
চোখ খুললেন বলরাম, ভুরু কুঁচকে কয়েক সেকেন্ড লোকটিকে চেনার চেষ্টা করে ধড়মড়িয়ে উঠে বসলেন। লজ্জিতভাবে বললেন, একটু ঘুমের মতো এসে গেছিল। জলের ওপর দিয়ে কী সুন্দর হাওয়া আর মিষ্টি রোদ…
কিন্তু এখন তো আপনার হাওয়া খাওয়ার কথা নয়, ঘামার কথা।
এই দেখুন। বলরাম ভাঙা সাইকেলটা দেখালেন।
এটা তো তুলসীর।
হ্যাঁ, ভেঙে গেছে। তাই আমারটা দিলাম। বলরাম খুবই সাধারণ একটা ব্যাপার জানাবার মতো স্বরে কথাটা বললেন।
দিয়ে দিলেন?
বলরাম অবাক হয়ে তাকালেন। দেব না? আমার মাথায় চুল থাকলে সেগুলো সব সাদা হত। আমিই তো দেব।
কিন্তু ফিনিশ করলে দেশে আপনিই প্রথম সব থেকে বয়স্ক ট্রায়াথলিস্ট হওয়ার গৌরব পেতেন, একটা দৃষ্টান্ত হতে পারতেন। ডাক্তারবাবু ক্ষুব্ধস্বরে বললেন, আমি কত আশা করে এসেছি অত দূর থেকে। আমাদের দেশে পঞ্চাশ পেরোলেই বুড়ো বলে বাতিল করে দেওয়া হয়, এটা যে কত ভুল ধারণা, সেটাই আজ স্বচক্ষে দেখব বলে এসেছি।
বলরাম কথাটা শুনতে শুনতে দূরে রাস্তার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। একটি মেয়ে দৌড়ে চলেছে। একটি মেয়ে তার পেছনে দৌড়ে আসছে। বলরাম চোখ তীক্ষ করে বিড়বিড় করলেন, ওটা তুলসী।
দুটি মেয়ে পাশাপাশি হয়েছে। প্রথমজন পাশে তাকিয়ে দৌড়ের বেগ বাড়াবার চেষ্টা করছে। বলরাম হেসে মাথা নাড়লেন। পারবে না। বৃথা চেষ্টা। তারপর ডাক্তারবাবুর দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বললেন, মেয়েদের কম্পিটিশনটা শেষ হয়ে গেল। ডাক্তারবাবু, এখানে এমন জল, এমন বাতাস, এমন রোদ, এত ভাল ছায়া, এবার একটু ঘুমিয়ে নিন। এ জিনিস চট করে পাবেন না।
ডাক্তারবাবুও দূরে তাকিয়ে দৌড় দেখছিলেন। বললেন, সেকেন্ড মেয়েটা কে, তুলসী? ফাস্টকে বিট করে বেরিয়ে গেল।
কথাটা কানে না দিয়ে বলরাম বললেন, এটা ওর সাইকেল।
দুজনে তাকালেন সাইকেলটার দিকে।
কম্পিটিশন থেকে ও বেরিয়ে গেছিল। আমি ফিরিয়ে আনলাম। ও ফাস্ট হচ্ছে। ডাক্তারবাবু, আমার মনে হয় এটাই বয়সের ধর্ম, আমি তা পালন করেছি মাত্র। তুলসী আমাকে মর্যাদা দিয়ে জেতার জন্য চেষ্টা করছে। দৃষ্টান্ত হওয়ার থেকে এই পাওয়াটাই বা কম কী? বলতে বলতে বলরাম মুখ ফিরিয়ে রাস্তার দিকে তাকালেন।
তুলসী ছুটে আসছে। তার অন্তত পঞ্চাশ মিটার পেছনে তেইশ নম্বর। তুলসী সোজা তাকিয়ে ছুটে যাচ্ছে তাই দেখতে পেল না, তার বাঁ দিকে একটু দূরেই অশ্বত্থের গুড়ির আড়াল থেকে এক জোড়া স্নিগ্ধ চোখ তাকে অনুসরণ করে চলেছে।
এবার হয়তো চাকরি পাবে। বলরাম অস্ফুটে বললেন।
বলরামবাবু, আর আমার থাকার দরকার নেই, আমি এবার চলি। ডাক্তারবাবু উঠে দাঁড়ালেন, একটা সিরিয়াস হার্ট পেশেন্ট ফেলে এসেছি।
ডাক্তারবাবু চলে যাচ্ছেন। বলরাম তাঁকে ডাকলেন, এক মাঘেই শীত পালায় না, আমিও পালাব না। সামনের বছর— বলরামের মুখ হাসিতে ভরে উঠল। তারপর আলতো করে ঘাসের ওপর নিজেকে বিছিয়ে দিয়ে তিনি চোখ বুজলেন।
.
বলরাম ঘুমিয়ে পড়েছিলেন।
মেসোমশাই, মেসোমশাই। উঠুন, উঠুন, আমি তুলসী। এই দেখুন ট্রফি।
বলরাম চোখ খুললেন। তার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে রয়েছে তুলসী, পাশে সাইকেল হাতে ধরে দাঁড়িয়ে বাবু।
কী খোঁজা যে খুঁজেছি আপনাকে। সারা সরোবরটা দুজনে মিলে চক্কর দিয়েছি। মাথাটা তুলুন, প্রণাম করব।
বলরাম উঠে বসলেন। তাঁর দুই পায়ের পাতার ওপর তুলসীর কপাল নেমে এল। বলরামের হাত নেমে এল তার মাথায়।
জগন্নাথবাবু কোথায়?
উনি ওঁর ভাগ্নির বাড়িতে গেলেন।
কিছু বললেন?
বললেন, চাকরির জন্য চিন্তা কোরো না, হয়ে যাবে। মেসোমশাই, আমি কিন্তু ফিনিশিং লাইনে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাইনি। ঝকঝকে চোখে অহঙ্কার ফুটিয়ে তুলসী বলল। তেইশ নম্বরকে আধ পাক পেছনে রেখে শেষ করেছি।
অজ্ঞান হলে না কেন? তা হলে ছবি উঠত। বলরাম উঠে দাঁড়ালেন।
অজ্ঞান হব কেন? আমি কুলডাঙার তুলসী রায় না?
তা হলে তুলসী রায়, এখন এই ভাঙা সাইকেল নিয়ে কী করব?
ট্যাক্সি করে বিধাননগর স্টেশন, সেখান থেকে ট্রেনে বিদ্যানগর আর তারপর জটাধারীর দোকানে গিয়ে তার পিণ্ডি চটকানো।