তিমির বিদার (Timir Bidar) : 17
ক’দিন খুব জ্বর এসেছে। জ্বর-ফর আমার কখনও হয় না। কোনও অসুখই আমার ধারে কাছে ঘেঁষে না। স্বাস্থ্য কিংবা মাসল বাতিক আমার নেই। সকাল বেলায় আধঘণ্টা ফ্রি-হ্যান্ড করি, তারপর কয়েকটা যোগাসন। সর্বাঙ্গাসন, পশ্চিমোত্তান, জানুশিরাসন, পদহস্তাসন, শেষে পদ্মাসনে বসে খানিকটা মনঃসংযোগ। এ আমার বহু দিনের অভ্যেস। দেড়তলার ঘরখানা একেবারে একলার জন্যে পাওয়ায় আমার এই সুবিধেটা হয়েছে। যতক্ষণ বাইরে আছি যেমন স্বাধীনভাবে কাটাতে পারি, বাড়িতেও যতক্ষণ থাকি আমি স্বাধীন। এই ঘরটায়। ঘরটা আমার মনের মতো করে সাজিয়ে রাখি। দেয়ালে একটা, দরজার পেছনে একটা— দুটো পোস্টার। দেয়ালেরটা একটা নিসর্গ দৃশ্য— পাহাড়, পাহাড়তলি, পাইন বন, নুড়ির ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া জলধারা, পেছনে আকাশটা নীল। এইটা দেখতে আমার ভাল লাগে, ৮ ফুট উচ্চতার ঘরে, পোস্টারের ওই পাহাড় যেন আরও অনেকটা উচ্চতা নিয়ে আসে। উচ্চতা, শীতলতা, বিস্তার, ক্লেদহীন বাতাস। কলেজে পড়বার সময়ে দু’বার এক্সকার্সনে গিয়েছিলাম বন্ধুদের সঙ্গে। একবার দার্জিলিং আর একবার পুরী। খুব সম্ভব এই ছবিটা আমাকে দার্জিলিঙের সেই উজ্জ্বল নীল শীতের আকাশ, ঝকঝকে কাঞ্চনজঙ্ঘায় নিয়ে যায়। ঘরে ঢুকেই আমি সুইচ টিপে আলোটা আগে জ্বেলে দিই। খাটের ওপর বসে পড়ি। তার পর দেয়াল জোড়া ওই নিসর্গের দিকে চেয়ে থাকি। প্রথম টুইশানির মাইনে পেয়ে ষাট টাকা দিয়ে ওটা কিনেছিলাম। বাঁধানো-টাঁধানো হয়নি, জাস্ট সেলোটেপ দিয়ে আটকানো। মাঝে মাঝে ফটাস করে খুলে যায়, তখন আবার ফ্রেশ সেলোটেপ লাগাতে হয়।
দ্বিতীয় পোস্টারটা আমার দরজার পেছন দিকে আটকানো। অর্থাৎ দরজা বন্ধ করলে তবে দেখতে পাই। এটা অত বড় নয়। ল্যান্ডস্কেপটার অর্ধেক। মারাদোনা। সবুজ মাঠ, অস্পষ্ট জনতার রঙিন উঠে দাঁড়ানো, মাঝখানে মারাদোনার ডান পা সটান মাটির সঙ্গে ৩০ ডিগ্রি কোণে উঠে গেছে, সাদা-কালো বলটা দূরে গোলপোস্টের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। গোলকিপার একটা শূন্যে উড়ন্ত লম্বা রেখা; প্রাণপণ চেষ্টা করেছে, কিন্তু রুখতে পারেনি।
এই ছবিটাও আমাকে কেমন উল্লাসে ভরে দেয়। যেন ওই জনতার মধ্যে আমি আছি। সব সময়ে ওই রকম উল্লাসে উল্লম্ফনে। মারাদোনার পায়ের তলার ওই ত্রিশ ডিগ্রি কোণে আছি। বলটার জ্যোতিষ্কের মতো ছুটে যাওয়ায় আছি। গোলকিপারের সটান ঊর্ধ্ব ঝাঁপে আছি। আর সমস্তর মধ্যে থেকে দুরন্ত হিরো-ওয়রশিপে শুষে নিচ্ছি মারাদোনার শক্তি, মারাদোনার কৌশল, তার প্রতিভা, তার শ্রেষ্ঠতা।
খুব যত্ন করি আমি ঘরটার। একটা পেডেস্ট্যাল ফ্যান আছে ঘরে, বউদি দিয়েছিল। দুটো জানলা, আমি ওগুলোতে সস্তা লনের মৃদু হলুদ রঙের পর্দা লাগিয়ে রাখি। দু’দিকেই তারের আটসাঁট বাঁধনে বাঁধা। আমি যদি ইচ্ছে করি ওরা সরবে, হাওয়া ইচ্ছে করলে সরবে না। একটা তক্তপোশ আছে, একজনের চেয়ে একটু বেশিই ধরে যায় তাতে। মাঝে মাঝে রিন্টি এসে শোয় তাই। রিন্টি শুলে সে-রাতটা আমার খুব ভাল কাটে, গল্পে, বাচ্চার স্পর্শে, প্রশ্নে, ঘ্রাণে। রিন্টিটা আমার ন্যাওটা খুবই। কিন্তু ওই যে! বহুৎ মা-ন্যাকরা। তাই অনেক দিন আমার কাছে শুয়ে গল্প করতে করতে হয় তো ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু মাঝরাতে আমাকে ঠেলে তোলে— কাকু ও কাকু, ছোট বাইরে। ছোট বাইরে যেতে হলে কয়েক ধাপ উঠে দোতলার কলঘরে যেতে হবে, এই সুযোগটাই ও নেয়। কলঘর থেকে বেরিয়ে শুট করে মা-বাবার ঘরে ঢুকে যায়।
তক্তপোশে একটা পাতলা তোশক তার ওপর একটা একটু হেভি চাদর পাতা থাকে। তলায় একটা নরম চাদর ওপরে আবার বেড কভার, এত বিলাসিতা আমার পোষায় না। দেয়ালে একটা আলনা আটকানো আছে, তাতে আমি হ্যাঙারে করে আমার শার্ট-প্যান্ট, ইভন গেঞ্জি পায়জামা, ঝুলিয়ে রাখি। সব আমার নিজের কাচা, ইস্ত্রি করা, খুব মাঝে মাঝে লন্ড্রিতে দিই।
একটা বেঁটে আলমারি আছে ঘরটায়। এটা আমার ঠাকুর্দার। কোনও নিলাম টিলাম থেকে কিনেছিলেন বোধহয়। ভাল টিক-উডের আসবাব। কখনও পোকা-মাকড় হতে দেখিনি। এর ভেতরের দুটো তাকে আমার যাবতীয় সম্পত্তি। এবং এর মাথাটা আমি টেবিল হিসেবে ব্যবহার করি। একটা পলিথিনের টেবল ক্লথ দিয়ে ঢাকা থাকে ওপরটা, পাশে একটা কাঠের চেয়ার। দেয়ালে একটা খোঁদল করা তাকে কিছু বই থাকে, পত্র-পত্রিকা থাকে। দুটো মোল্ডেড চেয়ারও এক কোণে থাকে, কেউ এলে, বসেটসে। ঘরটা আমি নিজে ঝাঁট দিই। নিজে মুছি। লাল মেঝে টুকটুক করে সব সময়ে। বাড়িতে কোনও চৌকো কিছু এলে তার কার্ডবোর্ডের বাকসোটা আমি ঘরের কোণে ওয়েস্টপেপার বক্স হিসেবে ব্যবহার করি। এই। আর একটা কথা— ঘরে আমি কক্ষনো সিগারেট খাই না। বিশ্রী গন্ধ একটা নিচু ঘরের সিলিং থেকে ঝোলে। সিগারেট খেতে হলে ছাদ। কলঘরে আগে খেতাম। বউদি আপত্তি করাতে সেটা বন্ধ করতে হয়েছে। সত্যিই, আমি একটা স্মোকার হয়েও যদি আমার ঘরে সিগারেটের গন্ধ সইতে না পারি, তা হলে এক চিলতে কলঘরে একজন নন-স্মোকার মেয়ে কী করে সইবে! মা-বাবা-দাদা কখনও বলেনি, চালিয়ে যাচ্ছিলাম, বউদিই একদিন আমাকে ডাক দিল— রুণু শোনো।
তখন নতুন বউদি। বাড়িতে একটা গোটা মেয়ে বন্ধু হাসছে, খলখল করে কথা বলছে, ব্যাপারই আলাদা। ডাকতেই বাধ্য ছেলেটির মতো গিয়ে দাঁড়াই। কলঘরের দরজাটা হাট করে খোলা, —কী ব্যাপার, বউদি?
—তুমি গিয়েছিলে তো!
—কেন? গন্ধ-টন্ধ বেরোচ্ছে না কী? আচ্ছাসে জল ঢেলেছি তো! —আমার লজ্জায় লাল হবার জোগাড়।
বউদি বলল— জল ঢেলেছ কিন্তু তোমার চারমিনারের গন্ধ ভাই হাজার জলে হাওয়ায়ও যায় না। প্লিজ, কলঘরে সিগারেট খেয়ো না।
আমি খুব বুঝদার মানুষ। সঙ্গে সঙ্গে বুঝে যাই। কোনও ইগোমূলক বিদ্রোহ আমার মধ্যে ফণা তোলে না। তা ছাড়া দোতলার কলঘর প্রতিদিন পরিষ্কার করাটাও আমার একটা অভ্যেস। এটাও নাকি আমার বাপ-ঠাকুর্দার থেকে পেয়েছি। মা বলে— তোর ঠাকুর্দা? তখন তো ইট পাতা, টালির চালের একটা দু’ কামরার ঘর, তো সেখানকার টিনের ঢাকনা দেওয়া কলঘরও তোর ঠাকুর্দা নিজে হাতে পরিষ্কার করতেন রোজ। তোর বাবাকে তো তুই নিজেই দেখেছিস।
—আচ্ছা মা, নিজের বলতে কি আমার কিছুই নেই! বাথরুম পরিষ্কার করা পিতৃ-পিতামহ থেকে প্রাপ্ত। ছবি আর হলুদ রং ভালবাসা মাতা এবং মাতামহ থেকে প্রাপ্ত, চেহারাটা দাদার মতো।
—কেন সিগারেট? সিগারেটটা তোর একদম নিজের।—মা হাসত।
জ্বর-ফর আমার হয় না। রোদে-জলে-ঝড়ে হরদম ঘুরছি। ছাতা-ফাতাও পোষায় না। গত পরশু একটা মুষলধার নেমেছিল। এমন মাঠের মাঝখান, মানে ময়দানে যে কোথাও আশ্রয় নিতে পারিনি। পুবে হাওয়া দিচ্ছে, খাচ্ছি। গাঢ় কালো মেঘ গুমগুম করতে করতে এগিয়ে আসছে, দেখছি। প্রাণে ফুর্তি জেগেছে আর কী। এত ছোট ঘরে, সরু গলিতে, অপরিসর ঘিঞ্জি এলাকায় থাকি যে, মাঝে মাঝে ময়দানে এসে না বসলে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। আর যে-দিন আসি, সে-দিন আর উঠতে ইচ্ছে করে না। চা-অলারা বিরক্ত করে, এক ভাঁড় হয়তো খেয়েছি, তবু আরও খেতে হবে। ঝালমুড়ি, বাদাম ভাজা এসব হেঁকে হেঁকে কাছ দিয়ে ঘুরে ঘুরে যায়। এক ঠোঙা হয়তো চিনেবাদাম কিনলাম। কুটকুট করে অনেকক্ষণ চলে বলে এটা আমার পছন্দ। সন্ধেটা গাঢ় হয়ে গেলেই কিন্তু মেয়েদের উৎপাত শুরু হয়ে যায়।
—যাবেন?
আমি চুপ।
—বলে দিন না হ্যাঁ কি না।
—না।
—চলুন না বাবা, বেশি নোব না।
—এই যে বললেন হ্যাঁ কি না বলে দিতে!
প্রায় ভেংচির মতো একটা মুখভঙ্গি করে মক্কেল কেটে পড়ে।
আবার কিছুক্ষণ পরে আসবে শার্ট-প্যান্ট পরা মিচকে টাইপের একটা লোক। এসে পাশে বসে পড়বে। সিগারেট ধরাবে। উশখুশ করবে। তারপর খাপ খুলবে।
—ওয়েট করছেন কারওর জন্য?
—না।
—তবে?
—তবে কী?
—কম্প্যানি চাই, কম্প্যানি! ভাল কলেজ গার্ল আছে। এই ধরুন সবে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে ঢুকেছে কলেজে। ভাল লাগবে গ্যারান্টি দিতে পারি।
এক তাড়া দিই—উঠবেন! এখান থেকে?
আরও একটু রাত হলে অনেকদিন পুলিশ এসে ধরে। রুক্ষ গলায় বলে—কী ব্যাপার? ময়দানে সেঁটে গেছেন যে দেখছি!
—তাতে আপনার কী? ময়দানটা আপনার?
—কোন ময়না আসবে?
—এলে আপনার দিকে উড়িয়ে দেব।
—আরে মশাই, এসব জায়গা সন্ধে সাতটার পরে ডেঞ্জারাস। উঠে চলে যান।
—কী আছে আমার, যে নেবে? সস্তা একটা ডিজিটাল ঘড়ি, এক প্যাকেট সিগারেট, একটা দেশলাই।
—প্রাণটা তো আছে?
—তা আছে, তা শুধু-শুধু প্রাণটা নিয়ে নেবে বলছেন! মেয়ে নই যে শরীরটা নেবে।
—আপনি তো আচ্ছা আহাম্মক! আমি সার্জেন্ট বলছি জায়গাটা ভাল নয়, উঠে পড়ুন। আপনি তবু স্টিক করে থাকবেন! আর একটা কথা ছেলেদের শরীরও নেয়, এমন ঘটনাও দেখছি। আজ ভাই উঠে যান।
তো গত পরশু মেঘ দেখতে দেখতে দেখতে দেখতে হঠাৎ দেখি বড় বড় চার পাঁচ ফোঁটা গায়ে পড়ল। এত বড় স্ফটিকের মতো দানাগুলো যে রীতিমতো চাপ পড়ল গায়ে। ব্যাপক লাগল। উঠে দাঁড়িয়ে হাওয়া যে-দিক থেকে বৃষ্টি তাড়িয়ে নিয়ে আসছে সে-দিকে পিঠ পেতে দাঁড়াই। আয় বিষ্টি ঝেঁপে ধান দেবো মেপে। আয় বিষ্টি। আর কোথায় যায়! সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো একটা জলের তোড় আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কনকনে, বরফের মতো ঠাণ্ডা ওই ছুরির ফলার মতো ধারালো, দাঁতে-নখে বৃষ্টির হাত থেকে ছাড়া পাবার জন্যে এবার দৌড়োই। দৌড়োতে দৌড়োতে বাস স্টপ পর্যন্ত পৌঁছে যাই। কোথাও কোনও ছাদ মেলেনি। তখন আমাকে নিংড়োলে পুরো একটা জাহ্নবী বেরোবে। সেই ভাবেই ভিড় বাসে দমসম হয়ে, লোকের গালাগাল খেতে খেতে বাড়ি এসেছি। বাড়ি আসার পথে আবার হাঁটুসমান ময়লাজল ঠেলেছি। বাড়ি এসে চান। জামা-কাপড় কাচা, আপাতত বৃষ্টিহীন ছাদে একটা সিগারেট এক কাপ গরম চা। তারপরই হ্যাঁচ্চো! যাচ্চলে আপাতত এইটুকুতেই ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করলে হবে?
রাত্তিরে দুধ রুটি খেয়ে শুয়ে পড়ি। মাঝরাত থেকে জোর কাঁপুনি। চাদরটা তুলে গায়ে দিই। তারপর তোশকটাও তুলে মুড়ি দিই। সকালে দরজায় দুমদাম ঘা। মাতৃদেবী। কী রে! ন’টা বেজে গেছে। কী হল? মুখ চোখ লাল?—দেখি।
—দেখতে হবে না, এসেছে।
—কী?
—ম্যালেরিয়া।
তা অবশ্য ম্যালেরিয়া নয়, ফুলু। হোমিওপ্যাথি ওষুধ খেয়েছি ইনফ্লুয়েঞ্জিনাম থার্টি। ক্যালপল খেয়েছি। ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ছে। চ্যাট চ্যাট করছে বিছানা। যাচ্ছেতাই লাগছে।
রিন্টি লাফাতে লাফাতে ঢুকল—কাকু তোমার চিঠি। তোমার চিঠি। তার পেছন পেছন অনিবার্যভাবে তার মা —রিন্টি, কাকুর ঘাড়ে পড়বে না। খবর্দার বলছি।
—চিঠি? আমার চিঠি? জীবনে কখনও আমার নামে কোনও চিঠি আসেনি। এল তাই ব্যাপারটা খেয়াল হল। তেইশ বছর সাত মাস সতেরো দিনের জীবনে একটাও চিঠি পাইনি! কী আশ্চর্য! চিঠি লিখেছি। পোস্ট কার্ড। মাকে দার্জিলিং থেকে…পুরী থেকে,—পৌঁছনো সংবাদ, তার সঙ্গে প্রকৃতিমুগ্ধতা! কিন্তু পাওয়ার সুযোগ কখনও হয়নি। বন্ধুরা সব আশেপাশেই থাকে। কলেজের বন্ধুরা? প্রায় যোগাযোগহীন। যে যার জীবনসংগ্রামে। এত চিঠি ছেড়েছি, একটাও ইনটারভিউয়ের চিঠি আজ পর্যন্ত আসেনি। আ-মা-র চিঠি?
উঠে বসি। রিন্টির হাত থেকে কোনওমতে খামটা উদ্ধার করে দেয় আমাকে বউদি। —ইনটারভিউ?
আমি ছোট আয়তাকার সাদাটে খামটা দেখাই, ওপরে কালি দিয়ে লেখা আমার নাম-ঠিকানা, যেন নামাবলির ছাঁদের লেখা মাত্রা টেনে টেনে। বলি—তুমিও যেমন! এমন খামে ইনটারভিউয়ের চিঠি আসে? টাইপ্ড্ নয়। কিছু নয়।
বউদি দাঁড়িয়ে থাকে, রিন্টি দরজা বন্ধ করে। হাতে রবারের বল, মারাদোনা-দর্শনে মগ্ন হয়ে যায়—আমি জ্বরকম্পিত হাতে জীবনের প্রথম চিঠি খুলি।
—আপনি বলেছিলেন প্রতিরোধ আমাকেই করতে হবে, আমার ফ্যামিলিকেই। আপনারা কেউ, আপনি, পারবেন না। আমার ফ্যামিলি ক্রীতদাস। পারবে না। প্রতিরোধ করলাম।
কোনও সম্বোধন নেই। কোনও সই নেই। জাস্ট দু’ লাইনের চিঠি।
—দ্যাখো তো বউদি, মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না।
বউদি উল্টে-পাল্টে দেখল। বলল—লেখার ছাঁদটা! আরে এ তো হাসির লেখা! তারপর আমার জ্বরো বিছানায় বউদি হতবুদ্ধির মতো বসে পড়ে। —হাসি কেন এই চিঠি লিখল? তোকে?
আমায় শামুর প্রস্তাব, তার রাগ, হতাশা মনে পড়ে যায়—তা-ও তুই আমার বোনটাকে রমজানের থাবা থেকে বাঁচাবি না?
বউদি বলল—মনে পড়েছে রুণু। ওকে বিয়ে করার জন্যে ওই রমজানটা খেপে উঠেছে বলে আমি তোকে, পাড়ার ছেলেদের কিছু করতে বলেছিলাম। তুই ওদের নিয়মকানুনের দোহাই দিয়ে বলেছিলি—ওদেরই রুখতে হবে এটা। তোদের কিছু করবার নেই! কথাটা আমি হাসিকে বলেওছিলাম, কেন না পাড়ার ছেলেদের, স্পেশ্যালি তোর সাহায্য ও মুখ ফুটে চেয়েছিল।
আমি উঠে দাঁড়াই, আলনার দিকে হাত বাড়াই, শার্টটা আমার হাতে; বউদি দু’ হাত দিয়ে আমাকে আটকায়—কী করছিস রুণু? কোথায় যাচ্ছিস? তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে? জ্বরে টলছিস! তা ছাড়া এই চিঠি, ওদের বাড়ি… ভয়ানক রিস্কি হয়ে যাবে…
—তুমি বুঝছ না বউদি, মেয়েটা যদি ছারপোকা মারার ওষুধ-ফসুদ খেয়ে থাকে, এখনও গেলে বাঁচানো যাবে। দিস ইজ টেরিবলি সিরিয়াস। তুমি মেয়ে, তুমিই ভাবো। আর কী উপায় ওর থাকতে পারে!
বউদি বলল—দাঁড়া দাঁড়া। একটু—একটু ভাবতে দে। রুণু তোর কালকেও চার জ্বর উঠেছিল। প্যারাসিটামল খেয়ে খেয়ে কমছে, আবার বাড়ছে, টাইফয়েড কি ভাইর্যাল ফিভার এখনও বোঝা যাচ্ছে না। শোন, তুই পারবি না। আমি…আমি যাচ্ছি।
—তুমি? তুমি কোথায় যাবে? পাগল নাকি! কখনও গিয়েছ? শনিতলার কাছে? এটা আরও রিস্কি। তা ছাড়া এটা আমার দায়। আমার দায়িত্বহীন কথাবার্তার ফল। তুমি কেন…
বউদি বলল—মেয়েটা আমার ছাত্রী! ছাত্রীদের জন্যে আমরা… আচ্ছা, তুই জামা কাপড় পর। দু’জনেই যাব। নে রেডি হ।
বলে বউদি বেরিয়ে গিয়ে বাইরে থেকে দরজাটা বন্ধ করে দিল।
দমাদ্দম করে দরজায় ঘা মারতে থাকি আমি। শরীর টলে, মুখ টক বিস্বাদ জলে ভরে যায়, তারপরে হঠাৎ ভেতর থেকে একটা অদ্ভুত ভয়ংকর অচেনা অসুখ পাক খেয়ে খেয়ে উঠে আসে, ব্যাঙের ছাতার মতো মাথার দিকে ছড়িয়ে যায়, আমি কিছু ধরবার প্রাণপণ চেষ্টা করি। মারাদোনার বল নিয়ে আমি দরজার গোড়ায় আছড়ে পড়ি।