Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » তিন ভুবনের পারে || Samaresh Basu » Page 2

তিন ভুবনের পারে || Samaresh Basu

কিন্তু সেই মদ খেয়েই মধ্যরাত্রে এসে সুবীর দাঁড়িয়েছিল। সরসী দরজা খুলে দিয়ে, চলে যেতে গিয়ে, থমকে দাঁড়িয়ে দেখেছিল। দেখেছিল, স্থির দাঁড়ালেও, সুবীরের ঝুঁকে পড়ে দাঁড়াবার মধ্যে একটু টলায়মান ভাব। চোখ আরক্ত, শুকনো মুখে অপরাধের বিব্রত হাসি ঈষৎ ছোঁয়ানো।

কয়েক মুহূর্ত কথা বলতে পারেনি সরসী। শুধু যে রাগে ও বিস্ময়ে সে নির্বাক হয়ে গিয়েছিল তা নয়, তার সমস্ত আশা ও বিশ্বাসকে যেন সে মুহূর্তে পুড়ে ছাই হয়ে যেতে দেখেছিল নিজের চোখের সামনে। একটা তীব্র যন্ত্রণাও তার কণ্ঠরোধ করে ধরেছিল। কয়েক মুহূর্ত পরে সে অস্ফুট উচ্চারণ করেছিল, মদ খেয়ে এসেছ?

সুবীরও সেই মুহূর্তেই কোনও জবাব দিতে পারেনি। সে যে বদ্ধ মাতাল হয়ে এসেছিল, তা নয়। যদিচ, তার অবস্থা খুব একটা ভাল ছিল না। নেশার অস্বাভাবিকতা তার সর্বাঙ্গ জুড়েই ছিল। তবু দ্বিধা লজ্জা সংকোচ এবং ঈষৎ একটি ভয়ের চিহ্ন সেই সময়ে তার মুখে বিশেষ করে ফুটে উঠেছিল। সে আমতা আমতা করে বলেছিল, মানে, মানে

কথাটা সে শেষ করতে পারেনি। কথা জড়িয়ে যাবার জন্যে নয়, তার কিছু বলার ছিল না।

সরসী সেই একই ভাবে তার দিকে তাকিয়েছিল। আস্তে আস্তে তার চোখ থেকে দীর্ঘ সময়ের অপেক্ষাজনিত সঞ্চিত অভিমান ও ব্যথা সরে গিয়েছিল। বিস্ময় নিশ্চিহ্ন হয়েছিল। আগুনের ঝিলিক ফুটে উঠেছিল। তখন তাকে বাঘিনীর মতো দেখাচ্ছিল। তীব্র রোষ ও ঘৃণায় তার অনুসন্ধিৎসু চোখ দুটি দপদপিয়ে উঠেছিল। কিন্তু কোনও কথা বলেনি।

সুবীর দু পা অগ্রসর হয়েছিল, চোখ তুলে তাকাতে চেয়েছিল। সরসীর মুখের দিকে তাকিয়ে ডেকেছিল, সরো, আমি, মানে, তুমি খুব

কথা আর শেষ করতে পারেনি। সরসীর তীব্র নিচু গলায় কেবল শোনা গিয়েছিল, মাতাল হয়ে এসেছ তুমি?

সুবীর তখন বলেছিল, আজ কেমন হয়ে গেল। কিন্তু জান, জনি-ম্যাকদের সঙ্গে খাইনি, মাইরি বিশ্বাস করো। সরো।

সে হঠাৎ জোড়হাত প্রসারিত করে ধরেছিল সরসীর দিকে। সরসীর চোখের আগুন তাতে নেভেনি, আরও তীব্র হয়ে উঠেছিল। কেবল উচ্চারণ করেছিল, ছি!

বলেই মুহূর্তে সে সরে গিয়েছিল। সোজা শোবার ঘরে গিয়ে সশব্দে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল। দিয়ে দরজায় পিঠ রেখে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিল সে। একটা প্রবল বেগ তখন তার বুক ভেদ করে গলার কাছে ছুটে আসতে চেয়েছিল। যে বেগের প্রবল আঘাতে তার সর্বাঙ্গ থরথরিয়ে কাঁপছিল। সে দুহাতে মুখ চেপে ধরেছিল, এবং তার দুই চোখের কোল প্লাবিত হয়ে গিয়েছিল।

তখন দরজায় মৃদু আঘাতের শব্দ হয়েছিল, সুবীরের নিচু গলা শোনা গিয়েছিল, সরো, দরজা খোলো। আমার অন্যায় হয়ে গেছে, সত্যি বলছি, কিন্তু দরজা খোলো।

কথাগুলো যেন ভাল করে কানেও যায়নি। কারণ তার ভিতরে তখন অস্থির কান্নার প্রবল বেগ, চকিত যন্ত্রণার আঘাতে সমস্ত অনুভূতি যেন অসাড় করে দিয়েছিল। সে সরসী মিত্র, পূর্বের সরসী রায়, এম এ, ইস্কুলের শিক্ষয়িত্রী, তার মধ্যরাত্রের প্রতীক্ষিত দরজায় দাঁড়িয়েছিল একটি অর্ধশিক্ষিত, মাতাল, তার আজীবন পরিবেশ ও সংস্কারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে পাওয়া স্বামী। দরজায় আঘাত, কাতর অনুনয়, কিছুই তার কানে যায়নি। দরজার কাছ থেকে সরে গিয়ে বুক ও মুখ গুঁজে বিছানায় লুটিয়ে পড়েছিল।

সুবীর আবার ডেকেছিল, সরো, দরজা খোলো, একটু শোনো।

তখন সরসী তার শব্দহীন কান্নার মধ্যে খালি নিঃশব্দে উচ্চারণ করেছিল, না, না না, কখনও না, কখনও না।

সে বুঝতে পেরেছিল সুবীরের একটা চৈতন্য আছে, সে গলা তুলে কথা বলেনি, গৌরাঙ্গকে জানতে দিতে চায়নি। একটু নিচু স্বরে, অপরাধীর ব্যাকুল স্বরে সে অনেকবার ডেকেছিল সরসীকে। কিন্তু সরসী দরজা খোলেনি, ওঠেনি, একটি কথাও বলেনি। বলতে পারেনি। সে যেন তার সকল দিগন্ত জুড়ে কেবল অন্ধকারের বিভীষিকা দেখতে পাচ্ছিল। অকস্মাৎ ধাক্কায় গভীর নীচে পড়ে গিয়েছিল।

সুবীরের করুণ গলা সে শুনতে পেয়েছিল, সরো, আমার খুব খিদে পেয়েছে, আমায় খেতে দাও, দরজা খোলো।

কোনও নিষ্ঠুর কঠিন প্রাণ নিয়ে যে সরসী দরজা খুলে দিতে আসেনি, তা নয়। তখনও তার সকল অনুভূতি তেমনি অসাড় হয়েই ছিল। সে যেন ভাল করে শুনতেও পায়নি। চূর্ণ-বিচূর্ণ স্বপ্নের মধ্যে, হতাশার সহসা গহ্বরে, তখনও সে ডুবে ছিল।

কত সময় চলে গিয়েছিল, কিছুই মনে নেই। একই অবস্থায় কেটে গিয়েছিল দীর্ঘ সময়। কান্না বন্ধ হয়েছিল বটে, কিন্তু একটা অচৈতন্য ভাব অনেকক্ষণ ধরে ঘিরে ছিল। যে অচৈতন্য আচ্ছন্নতার মধ্যে, সরসী যেন নিজের জীবনের সমস্ত অতীতটাকে স্বপ্নের মতো দেখতে পেয়েছিল। যে স্বপ্নের মধ্যে, অনেক অনেক কিশোরী-জীবনের বিচিত্র মধুর ঘটনা, শৈশবের স্বপ্ন, যে স্বপ্নের মধ্যে শৈশবে সে নিজের জীবনকে কল্পনা করতে পারত। যখন মনের তিক্ত মধুর পরিপূর্ণতা আসেনি, তখনকার দিনের সেই স্বপ্নগুলো একে একে তার চোখের সামনে দিয়ে ভেসে গিয়েছিল। তাকে নিয়ে তার বাবা-মা যে স্বপ্ন দেখতেন সে কেমন সুখী হবে, কেমন সুন্দর তার ঘর ও বর হবে, সে কেমন আশ্চর্য বিদুষী হবে, রূপকথার মতো সেই দিনগুলো তার চোখের সামনে ছবির মতো ভেসে উঠেছিল। তার সঙ্গে কত মুখ, আত্মীয়স্বজন সখী ও সখা। আঃ, জীবনের সব কথা কি সত্যি খুলে লেখা যায়? যদিচ, তার মধ্যে বহু অবাস্তবতার ভিড়, হাস্যকর সব ঘটনার মিছিল, তবু, হায়, তার মধ্যে কত বিচিত্র মাধুর্য লুকিয়ে ছিল। যৌবনের প্রথম পদসঞ্চারের আলো যবে লেগেছিল শরীরে, চোখেমুখে, তখন থেকেই এই তুচ্ছ জীবনে কত ছোটখাটো নিবেদন। কী আশ্চর্যই না লাগত। মনে হত, সব ছেলে আমাকে ভালবাসে, শুধু আমার একটু চোখের ইশারা, একটু হাসির ইঙ্গিত, একটু কাছে ডাকার হাতছানি। আমি মহারানি, আর সব মাথানত বাধ্য প্রজা, যারা আমার রাজ্যের চারপাশে নতজানু হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

কিন্তু সে সব স্বপ্নই। বড় হতে হতে আস্তে আস্তে সবই জীবনচিন্যর কঠিন শানে ভেঙে গিয়েছে, ঘষে গিয়েছে। সেই তো সেদিনও, সুবীরের সঙ্গে আলাপের পরেও, উত্তর প্রদেশের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের নবীন অধ্যাপকের হাত পাণিপীড়নে এগিয়ে আসতে চেয়েছিল। পারিবারিক অনুসন্ধানের চৌহদ্দির মধ্যেও কম হাত ছিল না। কিন্তু সেসব সকলি সরল গরল ভেল, অমৃতের দুয়ার খুলে গিয়েছিল অতি অপ্রত্যাশিত হাতের কড়ানাড়ায়।

সেই সব স্বপ্নাচ্ছন্নতার মধ্যে, বারেবারেই চোখ অন্ধ হয়ে উঠেছিল। তারপর একসময়ে একটা শারীরিক অবসাদে, প্রায় তন্দ্রাঘোরে সে নিঝুম হয়ে গিয়েছিল।

তারপর কীসের শব্দে, সে জানে না, তার তন্দ্রা কেটে গিয়েছিল। তার যেন সহসা মনে পড়ছিল না, কী ঘটেছে। বহু দূরান্তে, শেষ রাত্রে, শহরের জেগে-ওঠার নানান শব্দ তার কানে আসছিল, এবং আস্তে আস্তে সুবীরের চেহারা তার চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল। ভেসে উঠতেই, প্রথমেই যেন তার কানে বেজে উঠেছিল, সরো, আমাকে খেতে দাও, দরজা খোলো। সে তৎক্ষণাৎ বিছানায় উঠে বসেছিল, এবং সেই মুহূর্তেই আবার আরক্ত চক্ষু, ঈষৎ অস্বাভাবিক, বিব্রত অপরাধী সুবীরের মুখখানি ভেসে উঠেছিল। সে নিজে নিজেই বলে উঠেছিল, কেন, কেন? কেন ও এমনি করে আচমকা আমার বিশ্বাসকে আঘাত করল?

এই চিন্তা থেকে বরং ওর মনে ভয়ের উদ্রেকই বেশি হয়েছিল। একদা সে সুবীরকে বলেছিল, মদ খাওয়াকে ঘৃণার চেয়ে, আমি ভয় করি বেশি। সেই ভয়টাই তখন সরসীর মনে জেগে উঠেছিল। সকলই কি তা হলে ভুল। দুজনের মিলিত সিদ্ধান্তের কোনও মূল্যই কি তা হলে সুবীরের কাছে নেই? একদিন মদ খেলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায় না, এটুকু উদারতা সরসীর ছিল। কিন্তু এমন বিনামেঘে বজ্রাঘাত কেন? সরসীকে একবারটি বলতে কী হয়েছিল? হয়তো সরসী তাতেও আপত্তি করত, রাগ করত, তবু আচমকা আঘাতের ধাক্কায় সহসা ভেঙে পড়ত না। বরং সুবীরের ব্যবহারে আশঙ্কা তীব্র হয়ে উঠেছিল, ভবিষ্যৎ আরও অন্ধকার, কঠিন ও কণ্টকাকীর্ণ।

সরসী খাট থেকে নেমে এসেছিল। কোথায় গিয়েছে সুবীর? বাড়ি থেকে চলে যায়নি তো? উৎকণ্ঠা ও কৌতূহল বোধ করেছিল সে। নিঃশব্দে দরজা খুলে ঘরের বাইরে এসেছিল। বারান্দা পেরিয়ে দেখেছিল, বাইরের ঘরের দরজা তেমনি ভোলা। পাঁচিল টপকে বাড়িতে ঢুকে যে কেউ সে ঘরে ঢুকতে পারত। প্রথমেই লক্ষ করেছিল, রাস্তার দিকের দরজা খোলা রয়েছে কিনা। দেখেছিল, বন্ধই রয়েছে। বাইরের ঘরের আলো জ্বেলেছিল সে।

আলো জ্বালতেই, দেখেছিল চেয়ারে বসা, টেবিলের ওপর মাথা নোয়ানো সুবীর হঠাৎ মুখ তুলে বলে উঠেছিল, কে?

সরসী বুঝতে পেরেছিল, সুবীরও ঠিক নিদ্রিত ছিল না। শেষরাত্রের দিকে একটা তন্দ্রার ঘোর মাত্র এসেছিল। সুবীর বলেছিল, ও, তুমি?

সরসী দেখেছিল, তখনও সুবীরের চোখ আরক্ত, মুখখানি আরও শীর্ণ, চোখের কোলগুলো গর্তে ঢোকানো। কিন্তু আশ্চর্য, সরসীর অন্তর আবার মুহূর্তে বিমুখ হয়ে উঠেছিল। অবিশ্বাস ও ভয় তখনও তার মধ্যে সমানভাবেই কাজ করছিল। তার প্রাণের কাঠিন্যে, তখনও কোথাও তেমন ফাটল ধরেনি। তবু সে নীরস ও নিস্পৃহ গলায় না জিজ্ঞেস করে পারেনি, খেয়েছিলে?

সুবীর বলেছিল, খেতে দিলে না তো।

কথা শুনে সরসীর চোখে অভিমানক্ষুব্ধ রোষবহ্নিই ফুটে উঠেছিল, বলেছিল, কেন, গৌরাঙ্গর কাছে। খেতে চাইলেই তো হত।

সুবীর বলেছিল, আজ–মানে–ও কী আবার ভাববে, তাই ওকে আর ডাকিনি। তোমারও তো খাওয়া হয়নি।

সরসীর রোষ কষায়িত চোখে বিদ্রূপ ফুটে উঠেছিল। যদিচ মনের মধ্যে একটা বিচিত্র অনুভূতিও জেগে উঠেছিল। কিন্তু সে মুখে বলেছিল, গৌরাঙ্গর কাছে লজ্জা করছিল বুঝি? আশ্চর্য সম্মানবোধ তো!

সুবীর বলেছিল, না, তা নয়, তবে

কথার মাঝপথেই সরসী বলে উঠেছিল, এখন কি খেতে দেব?

সুবীর হাত তুলে ঘড়ি দেখে বলেছিল, ও বাবা, সাড়ে চারটে বেজে গেছে? না, এখন আর খাব না। সরো!

সুবীরের গলায় আবেগের সুর শোনা গিয়েছিল। সরসীর অন্তরে নিঃশব্দে দৃঢ়স্বরে উচ্চারিত হয়েছিল, না। মুখে বলেছিল, কী?

আমার কথা একটু শুনবে না?

সরসী তৎক্ষণাৎ জবাব দিয়েছিল, না, শোনবার কিছু আছে বলে আমি বিশ্বাস করি না।

বলেই সে আবার শোবার ঘরে চলে গিয়েছিল। কিন্তু দরজা বন্ধ করেনি। বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়েছিল। নিজের মনের কাছে কিছুই গোপন নেই, সরসী আশা করেছিল, সুবীর শোবার ঘরে আসবে। কিন্তু সুবীর আসেনি। মিথ্যে নয়, সরসীর মনে সেই মুহূর্তে আবার কিছুটা তিক্ততা ঘনিয়ে এসেছিল। শেষ পর্যন্ত আবার তার চোখে তন্দ্রা নেমে এসেছিল। শুধু তন্দ্রা নয়, ভোরের দিকে ঘুম নিবিড় হয়েই নেমে এসেছিল। গৌরাঙ্গর ডাকে তার ঘুম ভেঙেছিল।

সরসীর হাতে আর সময় ছিল না। প্রাতঃকৃত্যাদি সেরে সে ইস্কুলে চলে গিয়েছিল। তার অপেক্ষা করার উপায় ছিল না, অপেক্ষা সে করতেও চায়নি। সে লক্ষ করেছিল, সুবীরও কাজে যাবার জন্যে স্নান করে তৈরি হচ্ছিল। এবং প্রতি মুহূর্তেই তার দিকে তাকিয়ে দেখছিল। দু-একবার কাছে এসে ডাকাডাকিও করেছিল, সরো, একটু কথা বলো না।

সরসী তার কোনও জবাবই দেয়নি। কেবল একবার বলেছিল, তোমার চা-জলখাবার ঢাকা দেওয়া রইল।

খেয়ে যেও এ কথাটাও সে বলেনি। সুবীর বলেছিল, আমার কথা একটু শুনবে না?

সরসী তেমনি নিরুত্তরে বেরুবার উদ্যোগ করছিল। সুবীর তবু বলেছিল, কথাটা শুনতে কী দোষ হয়েছে? ক্ষমা করে দাও সরসী।

সরসী বেরিয়ে গিয়েছিল। যদিচ, ইস্কুলে যেতে গিয়ে সারাটা পথই কানের কাছে বেজেছিল, ক্ষমা করে দাও, ক্ষমা করে দাও.তথাপি সরসীর মনটা বারেবারেই বিমুখ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু যেহেতু, সেই ব্যাপারে সুবীর সম্পূর্ণরূপেই নতি স্বীকার করেছিল, কোনও যুক্তি দেখাবার চেষ্টা করেনি, বারে বারে ক্ষমাপ্রার্থনা করেছিল, তাই সেই আড়ষ্ট অবস্থা বিলম্বিত হয়নি। সেই দিন রাত্রেই তাদের সন্ধি হয়েছিল।

হঠাৎ মিলিত গলার হাসির শব্দে চমকে উঠল সরসী। অনেকগুলো বছর পেরিয়ে সে বর্তমানে এসে যেন চমকে উঠল। চোখ তুলে দেখল, সুবীর হাসছে। তার সঙ্গে, অন্যান্যদের কণ্ঠস্বরও মিলেছে। ডক্টর সুবীররঞ্জন মিত্র হাসছেন। এখন কি তাঁর একবারও মনে পড়ছে সেই দিনের কথা? সেই দিন, আর এই দিন। জীবন যে বিচিত্র তাতে সন্দেহ নেই, কারণ মানুষ নিজে যে বিচিত্রতর। এই ডক্টর সুবীররঞ্জন মিত্রকে দেখে, তাঁর সঙ্গে কথা বলে, সেই একদা মধ্যরাত্রির বিব্রত অপরাধী মাতালকে কি কল্পনাও করা যায়।

অবিশ্যি সরসী একটা কথা সেদিনও ভুলে গিয়েছিল, আজও সম্যকরূপে তার মনে পড়ছে না, সেই লোকটির নিজের মনেও একটা অপরাধবোধ ছিল। ছিল বলেই সম্ভবত আজকের এই দিনটিকে কল্পনা করতে খুব অসুবিধা হয় না। হয়তো, সেই অপরাধবোধের উপলব্ধি, দুজনের কারুর মনেই তেমন অর্থময়রূপে দেখা দেয়নি। অথচ অপরাধবোধ ছিল বলেই, সুবীর আপনাকে সংবৃত করতে পেরেছিল, নিজের রাশ টেনে ধরতে পেরেছিল। যদিচ, সেরকম ঘটনা যে আর একদিনও ঘটেনি, তা নয়। আরও দু-একবার ঘটেছিল। তার জন্যেও সেই একই দুঃসহ অসহযোগ ও যন্ত্রণার মুখোমুখি দুজনকে দাঁড়াতে হয়েছিল। হয়তো সরসীর ভয় বাড়তে পারত; কিন্তু সুবীর ততখানি অচৈতন্য অসাড় ও স্থূল হয়ে ওঠেনি।

সেই ঘটনার পরদিন রাত্রে সুবীর শুধু ক্ষমা চায়নি, সকল ঘটনাই ও ব্যক্ত করেছিল। জনি বা ম্যাক-এর সঙ্গে ও মদ খেতে যায়নি, গিয়েছিল ওর অফিসের কয়েকটি বন্ধুর সঙ্গে। ওর যে শেষ অবধি মনের জোর ছিল না, ওর যে নিজেরও ভীষণ ঝোঁক হয়েছিল, কোনও কথাই গোপন করেনি। সরসী সেই রাত্রে আর একবার কেঁদেছিল। কিন্তু সে কান্নার রূপ ছিল আলাদা।

ওই যে, সেই মন্টু মিত্র, সেই জনি-ম্যাকদের বন্ধু। অথচ আশ্চর্য এই, সুবীর আজ তাকে নানারূপে নানাভাবে বিস্মিত করে। সে জানে, সুবীরের প্রাণে আজও ওর সেই সব বন্ধু, জনি-ম্যাকদের জন্যে একটি অতি স্পর্শকাতর নিবিড় কোণ রয়েছে। সুবীর এখনও বন্ধুদের সঙ্গে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলে, এবং এ কথাও সরসী জানে, জনি-ম্যাকদের প্রয়োজনে, সাধ্যমতো টাকা-পয়সাও দিয়ে থাকে। আর, ওর সেই বন্ধুরা, যারা দু-এক বছর আগেও ওর সম্পর্কে অত্যন্ত তিক্ত ও নিষ্ঠুর ছিল, তারা, শান্ত ও বন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠেছে। এখন আর ও বিষয়ে কোনও কথাই সরসী বলে না। যদিচ, সে অন্তর থেকে সুবীরের এ উদারতা ও বন্ধুবাৎসল্য মেনে নিতে পারে না। বিশেষ করে সে যখন সুবীরের সঙ্গে রাস্তায় চলে, তখন যদি ও ওই সব বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে, সরসী আরক্ত হয়ে ওঠে। তার অনিচ্ছা ও বিরক্তি চাপা থাকে না। কিন্তু সুবীরের সহজ স্বাভাবিক ব্যবহারের সামনে, সে কোনও কথাই বলতে পারে না।

শুধু বলতে পারে না নয়, সে তার মনের মনে এক অকারণ আশ্চর্য ব্যথা অনুভব করে। যে ব্যথাকে সে চেনে না। অভিযোগের সঠিক ভাষা তার জানা নেই, অথচ আজকের এই সুবীরকে ঘিরে কী এক ভাষাহীন অভিযোগ যেন পুঞ্জীভূত হয়ে উঠেছে, তার নিশ্বাসকে, সহজ হাসিকে রুদ্ধ করে রেখে দিয়েছে। কেন? সরসী যা চেয়েছিল, তাই তো সুবীর হয়েছে। সেই মন্টু মিত্তির, রকবাজ, অর্ধশিক্ষিত ছেলেটি, কোন এক কারখানার ডিপার্টমেন্টের নিতান্ত নামহীন কেরানি থেকে অধ্যাপকের পদে আপনাকে প্রতিষ্ঠা করেছে। সেই পদও ছেড়ে দিয়ে, কেন্দ্রীয় সরকারের এক বিশেষ পদে চাকরি নিয়েছে।

এই কথা ভাবতেই, মনের অন্ধকারের মধ্যে অজস্র কাঁটা যেন সহস্র মুখে তীক্ষ্ণ ঝিলিক দিয়ে উঠল। হেনা ব্যানার্জির সুন্দর, মুগ্ধ মুখখানিও তৎক্ষণাৎ চোখের সামনে ভেসে উঠল। কেন্দ্রীয় সরকারের, সামরিক বিভাগের বিশেষ গোপনীয় পদে যোগদান করবার জন্যে প্রস্তাব এসেছে ধীরানন্দ ব্যানার্জির কাছ থেকেই। বিশেষ করে, সেই চাকরিতে মনস্তত্ত্ববিশারদ ব্যক্তিই, পদে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। অধ্যাপনার কাজে সুবীরের কোথাও একটা বিরূপ মনোভাব আছে সেখানে যেন নিজেকে সে তেমন করে প্রকাশ করতে পারে না, তার ভিতর থেকে কোথাও একটা অস্বস্তি বোধ রয়ে গিয়েছে। বলেছে, সে কোনও স্পৃহা বোধ করে না। তার মনের গঠনই এমন নয় যে, বহু ছেলেমেয়েদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সে তাদের শিক্ষিত করে তুলবে। যদিচ, তার মিলিটারি সিক্রেট সার্ভিসেও মূল ব্যাপারটা শিক্ষাদানই বলা যায়।

সরসী তাকে জিজ্ঞেস করেছে, কেন, কলেজকে তোমার এত খারাপ লাগার কারণ কী? নিজের দেশের ছেলেমেয়েদের সামনে, তুমি নিজেই একটা শিক্ষা। তোমাকে দেখে তারা উৎসাহিত হবে।

তৎক্ষণাৎ বাধা দিয়ে বলে উঠেছে সুবীর, ও রকম করে বোলো না সরো, আমি লজ্জা পাই। আমি তো আমাকে চিনি। আমাকে দেখে, এ যুগের উৎসাহের কিছু নেই, আজকের ঠাকুমা দিদিমায়েরাও তাঁদের নাতি-নাতনিদের সঙ্গে বসে পরীক্ষা দিচ্ছেন, পাস করছেন, আমি নতুন কিছুই করছি না।

সরসীকে এ কথা অবশ্যই মানতে হবে, সুবীরের মনে অহংকারের কোনও স্পর্শই লাগেনি। তবু, সরসীর মনের মধ্যে একটি আশ্চর্য দ্বিধা ও সন্দেহ, সুবীরের এই সব কথার মধ্যে অহংকার যেন একটা ছদ্মবেশ ধরে লুকিয়ে আছে। সে ভাবে, সত্যি কি সুবীর নিজেকে এরকমই ভাবে? লোকচক্ষুর সামনে কি তার কোনও গর্বই নেই? লোকেরা যে আজ তার দিকে সপ্রশংস চোখে তাকিয়ে আছে, তা কি কোথাও তার মনে কোনও উচ্ছ্বাস আনে না? এবং আশ্চর্য এই, এই সব কথা যখনি তার মনে হয়, তখনই তার বুকের মধ্যে সেই অপরিচিত অজানা ব্যথা ও হতাশা জেগে ওঠে। তার সহসাই মনে হয়, সে যেন আর তার সেই দুটি বাহু দিয়ে সুবীরকে বেষ্টন করতে পারছে না। সে যে মানুষের স্বপ্ন দেখেছিল, এ যেন সে মানুষ নয়। আর কেউ, যার সম্যক পরিচয় সে উপলব্ধি করতে পারে না। তারই প্রাণের সীমায়, তারই অনুভবের বৃত্তে যে মানুষ আপনাকে বিকশিত করল, প্রসারিত করল, তাকে চিনে ওঠা যাচ্ছে না। কেন? হেনা? হেনা ব্যানার্জি কি? মনে হওয়া মাত্র একটি তীক্ষ্ণ বিষাক্ত শর যেন বিদ্ধ হল সরসীর বুকে। সন্দেহের থেকে সিদ্ধান্ত ভাল। কিন্তু সিদ্ধান্তে আসবার মতো কিছুই যে সরসীর হাতে নেই। অথচ সন্দেহ, কটু কুৎসিত সন্দেহ তার সমস্ত প্রাণকে অন্ধকারের ফাঁকে ফাঁকে জড়িয়ে ধরেছে। অত্যন্ত অসহায় ভাবে, তাকে তাই ভাবতে হয়, কোথায় ছিল এতদিন হেনা ব্যানার্জি? কোথায় ছিল এতদিন ধীরানন্দ ব্যানার্জি? আর আমন্ত্রণ মাত্রই, কেমন করে চলে যেতে চাইছে সুবীর? সরসী তো জানে, হেনা ব্যানার্জিও একই ধরনের পদে, চাকরিতে যোগদান করতে চলেছে কোচিনে। সুবীর চলেছে সিমলায়। যদিচ, ভূমণ্ডলের হিসাবে, উত্তর দক্ষিণের সীমানা বহু দূরে, এবং সুবীরের যাত্রার এখনও সাতদিন বিলম্ব আছে, হেনা চলে যাবে পরশুই, তবু–তবু সমস্ত ব্যাপারটা যেন কোথায় একটা যোগসূত্রের মতে, কেবল সরসীরই গলায় ফাঁস হয়ে চেপে বসছে। অবিশ্যি, এ কথাও ঠিক, চাকরিতে যোগদান করবার সময়ে, সুবীরের সপরিবারে যাবারই অনুমতি মিলেছে, বাসস্থানের ব্যবস্থা সেখানে পূর্বাহ্নেই স্থির হয়ে আছে। এবং এই সূত্র ধরেই, সকল ব্যথা ও সন্দেহের বিষ বিদ্রোহের রূপ ধরে দেখা দিয়েছে। সরসী জানিয়েছে, তার পক্ষে ইস্কুলের চাকরি ছেড়ে সুদূর সিমলায় যাওয়া সম্ভব নয়।

সরসী ভেবেছিল, সুবীর তা শুনবে না। যে সুবীর চিরদিন তাকে ছাড়া অসহায়, সে তাকে ছেড়ে যাবে কেমন করে। কিন্তু সুবীর বলেছে, সে কথা আমিও ভেবেছি। এক কথায়, এতদিনের চাকরি ছেড়ে, এখানকার বাস তুলে দিয়ে হঠাৎ চলে যাওয়ার অনেক অসুবিধা। তা হলে, কিছুদিন অপেক্ষা করে তুমি আসবে।

সরসী না বলে পারেনি, কেনই বা নিচ্ছ এই চাকরি? টাকার জন্যে?

সুবীর হেসে বলেছে, শুধু টাকার জন্যেই বা কেন? টাকাটা অবিশ্যি আমি অবহেলা করছি না।

কথার মাঝখানেই সরসী বলে উঠেছিল, তবে আরও কিছু আছে নাকি? অবিশ্যি তোমার মনের সব কথা তো আমার জানা নেই।

ঈষৎ তিক্ত হাসির মধ্যে, সরসীর মনের ঝাঁজ অস্পষ্ট ছিল না।

সুবীর বলেছে, কেন সরো, আর কী থাকবে?

সরসী সহসা তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে সুবীরের চোখের দিকে তাকিয়ে বলেছে, কিছু কি নেই? আর কোনও আকর্ষণ?

সুবীরের মুখ গম্ভীর হয়ে উঠেছে। সে হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলেছে, সরো, তোমার ওই দৃষ্টি আর বাচনভঙ্গিতে আমি এখন বড় ক্লান্ত বোধ করি।

সরসীর মনে হয়েছে, তার মুখটা যেন তৎক্ষণাৎ পুড়ে গেল। এবং মুহূর্তে আবার তীব্র ঝলকে জ্বলেও উঠেছে। বিদ্রূপ করে বলেছে, তাই নাকি? এখন সম্ভবত আমার সব কিছুতেই ক্লান্তি বোধ কর? কাকে দেখলে, কার বাচনভঙ্গিতে এখন তোমার মন রাঙিয়ে ওঠে জানতে পারি?

সুবীর আশ্চর্য শান্তভাবে বলেছে, তোমার মনের কথা জানি সরো। তোমার সন্দেহ বাস্তবে ঘটলে, আশ্চর্য হবার অবিশ্যি কিছুই ছিল না। তোমারই উৎসাহে, চেষ্টায়, সাইকোলজি পড়ে, মানুষের মনের কিছু সূত্র আমি পেয়েছি। কিন্তু একটু আশা করব, তুমি তোমার নিজের চোখে কোনও ঠুলি এঁটো না, বরং সে পরিণতিটাই ভয়ের।

সরসীর অবস্থাটা তখন হয়ে পড়েছিল অনেকটা সাপের মতো, বিষ উগরে দিয়ে, মুহূর্ত কয়েকের জন্যে যার আপন রক্তে কোনও শক্তিই ছিল না। সে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে ছিল, এবং নিজের কথিত ভাষার দায়িত্ব কতখানি, একবার ভাববার চেষ্টা করেছিল। যদিচ, তখন ভাববার অবকাশ তার ছিল না, বরং অনেকটা অসহায় ভাবেই বলে উঠেছিল, কলেজের চাকরি তুমি কেন করতে চাইছ না? শিক্ষার আদর্শ যদি কোথাও থেকে থাকে, তবে সে তো ইস্কুল কলেজেই।

সুবীর বলেছে, তোমাকে তো বলেছি অনেকবার, শিক্ষালাভ করলেই কি শিক্ষা দিতে ইচ্ছে করে? ব্যতিক্রম কি নেই সরো? যারা অধ্যাপনা করতে চায়, তাদের সঙ্গে আমার কোনও বিরোধ নেই। কিন্তু আমার মনটা থাকে বেঁকে। ওর মধ্যে আমি জীবনের কোনও স্বাদ পাই না, নিজেকে উপলব্ধি করার অবকাশ হারিয়ে ফেলি। হয়তো এমনও হতে পারে, ছেলেবেলা থেকেই শিক্ষায়তনের ওপর আমার মনে একটা বিরূপ ক্রিয়া করে এসেছে। তাই আমি ওখানে নিজেকে তেমন করে মেলে ধরতে পারি না।

সরসী তখন বলেছে, অথচ আমি তো এ যাবৎ সেই কাজই করে এলুম, আমার তো কখনও সে রকম কিছু মনে হয়নি।

সুবীর তখনও হেসেই বলেছে, স্বামী-স্ত্রী বলে আমাদের পরস্পরের বিভিন্নতাও থাকবে না?

কথাটার মধ্যে নিষ্ঠুর সত্যি ছিল, কিন্তু সত্যের চেয়ে নিষ্ঠুরতাই সরসীর মনে বিধেছিল বেশি। আজ আর সুবীরকে কেবল কথা দিয়ে থামানো যায় না। সুবীর তার মন বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতা দিয়ে কথা বলে। যদিচ, মন শুনতে চায় স্বামী-স্ত্রী একাত্মা, কিন্তু আপন শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে, এমন মূঢ় কথা সহসা বলা যায় না। অথচ এই বিভিন্নতার কথা শুনেই সরসীর মনটা আবার তরঙ্গায়িত হয়ে উঠেছে। হেনা ব্যানার্জির মুখ ভেসে উঠেছে, সন্দেহের চিকুর কেটে কেটে বসেছে। সুবীরের যুক্তির কাছে না দাঁড়াতে পেরেও সে জোর দিয়ে বলেছে, কিন্তু যাই বলল, তোমার এ চাকরি নেওয়াকে আমি মন থেকে কিছুতেই সমর্থন করতে পারছি না।

কেন?

তা জানি না। আমার মনে হয় তুমি যেন আর সে রকমটি নেই। অ্যামবিশনের শেকলে তুমি বাঁধা পড়েছ। অর্থ, বিত্ত, ভিন্ন পরিবেশ, সরকারি প্রাসাদ, আপস্টার্ট সমাজের দিকে তোমার লক্ষ্য।

তুমি যদি এ রকম ভাব, আমার কিছু বলার নেই। তোমার কথার মধ্যে অনেক অপমানের বিষ আছে, কিন্তু আমি জানি অপমান যে করে, মনের যন্ত্রণা তারই বেশি।

কিন্তু তোমার এ কথাগুলো খারাপ লাগে শুনতে। নিজেকে তুমি বড্ড বেশি বিজ্ঞ ভাবছ বলে মনে হচ্ছে ।

না, তা ভাবছি না। কিন্তু তোমার কথার জবাব এ ছাড়া আমার আর কিছু জানা নেই সরো। তবে, এখন একটা কথা না বলে পারছি না। মনে করেছিলাম, তুমি কিছুদিন পরে ইস্কুলের সব ব্যবস্থা করে আসবে। এখন দেখছি, তোমাকে আমার সঙ্গে নিয়ে যাওয়াই ভাল।

হঠাৎ, এত দয়া জাগছে কেন তোমার?

তোমার কষ্ট হবে থাকতে।

শুধু আমার কষ্টের কথা ভেবে, তোমার নিজের অসুবিধা কোরো না দয়া করে।

আমার কোনও অসুবিধাই নেই সরো। বরং তোমাকে আর মিন্টুকে নিয়ে একসঙ্গে যাব, সেই ভাবেই আমি কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। তখন বরং তোমার অসুবিধার কথা চিন্তা করিনি। নিজের কথাই কেবল ভেবেছি। একবারও মনে করতে পারিনি, তোমাদের ছাড়া একলাই আমি চলে যাব। পরে মনে হয়েছে, সত্যই তো, তোমার কাজকর্ম সবকিছু ফেলে দিয়ে এক কথায় আমার সঙ্গে যাবে কেমন করে। অবিচার বলেই মনে হয়েছে। কিন্তু এখন মনে হয়, তুমি আমার সঙ্গে গেলেই ভাল হয়।

সরসী বলেছে, না, আমি তোমার সঙ্গে যেতে পারব না।

.

আবার বাইরের ঘরে হাসি শোনা গেল। সরসী তাকিয়ে দেখল সুবীরের দিকে। ডক্টর সুবীররঞ্জন মিত্র, যার ওই গম্ভীর এবং প্রসন্ন মূর্তির দিকে তাকিয়ে স্বভাবতই স্ত্রীর মন গর্বে ও আনন্দে ভরে ওঠে, তবু একটা ব্যথা যেন বিধে থাকে। ওই পুরুষমূর্তি (রূপবান কিনা সরসী জানে না, রূপবান বলতে ঠিক যে রকম মূর্তি চোখের সামনে ভেসে ওঠে, নিঃসন্দেহে এ সেই মূর্তি নয়, যাদের বলা যায়, ভোগী বিলাসী সুবর্ণকান্তি জনমনোহারী, সুবীর সে রকম নয়। অথচ এই গম্ভীর মূর্তির মধ্যেও কোথায় যেন একটা রোমান্টিক ছাপ আছে, যে রোমান্টিক শব্দের এ ক্ষেত্রে সঠিক অর্থটা সরসী নিজেই ব্যাখ্যা করতে পারে না। তবু এই শব্দটাই মনে উদয় হয়। হয়তো, সুবীরের অল্প ঢেউ-খেলানো চুলের জন্যেই ও রকম দেখায়, অথবা ওর মুখের গড়ন, কিংবা ঋজু শক্ত শরীরের অনমনীয় ভঙ্গির মধ্যেও কোথায় যেন একটা স্বভাব-বিনয়ের নম্রতা, বা ওর মুখের একটি বিচিত্র ক্লান্তি বিষণ্ণতার ছাপ, হাসলেই যার চিহ্নমাত্র থাকে না, এক কথায় এ পুরুষকে সুন্দর বলে মনে হয়। হয়তো, পুরুষের সমগ্রটা মিলিয়েই তার রূপ। শুধু চেহারা নয়, তার ভঙ্গি ও চরিত্রের ভিতর দিয়েই, রূপের বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে।) একদা যে পুরুষমূর্তি সরসীর সম্পূর্ণ চেনা ছিল, আজ যেন তাতে কোথায় কিছু অপরিচয়ের চিহ্ন ফুটে উঠেছে।

সরসী জানে না, এই সব অপরিচয়ের চিহ্ন সবই আপন বিবেকবুদ্ধির দ্বারা চালিত, আত্মপ্রত্যয়সম্পন্ন নবজন্মলব্ধ এক পুরুষের ভিতর থেকে ফুটে উঠেছে, যে পুরুষ, বলতে গেলে, একদা ছিল তার ছাত্র। যে ছাত্র কখনও অবাধ্যতার চূড়ান্ত করেছে, কখনও বশংবদ থেকেছে। যে ছাত্র তার কাছ থেকে শুধু পরীক্ষার পাঠ গ্রহণ করেনি, জীবনের পাঠও গ্রহণ করেছে। সরসী জানে না, তার অবচেতনে রয়েছে। একটি মুখ ও দুটি চোখ, যে মুখের অভিব্যক্তিতে ফুটে রয়েছে সকল কিছু জানবার জন্যে প্রায় কিশোরের গভীর ঔৎসুক্য, সরল শিশুর মতো তীব্র কৌতূহল। নারী সরসীর প্রাণে প্রিয়তম পুরুষের, পরম পুরুষের সেই ছবিটিই আঁকা পড়ে আছে। সেই ছবির চোখ জুড়ে ছিল মুগ্ধ বিস্ময়। ছিল অনেক অবাধ্যতা দুষ্টুমি, অন্যায়বোধের সংকোচ আড়ষ্টতা শঙ্কা সংশয়, যাকে শাসন ভর্ৎসনা সবই করা যেত। প্রতিটি মুহূর্তেই যে ছিল তার চোখের সামনে সহজ সরল, সবকিছুই ছিল স্ফটিকস্বচ্ছ। কোনওখানেই কোনও জটিলতা অস্পষ্টতা ছিল না।

আজ সেই মানুষই, দেখতে দেখতে তার কাছে জটিল ও অস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সরসীর জগতে বাড়তে বাড়তে কখন সে আপন জগৎ তৈরি করে ফেলেছে। এখন সে আপন জগতের বিশ্বাসে ভাষায় ও স্বরে কথা বলে, আচরণ করে। সরসী তাকে চিনতে পারে না। কিন্তু এ কথা সরসী জানে না। জানে না বলেই, হেনা ব্যানার্জি তার কাছে একমাত্র কারণ হয়ে উঠতে চায়। তার সীমাবদ্ধ পরিসরের মধ্যে, এক জায়গাতেই সকল সংশয় কেন্দ্রীভূত হয়।

.

আবার পিছনে ফিরে যায় সরসীর মন। এই অপরিচিত পুরুষকে আসলে সে আপন জগতের সীমার মধ্যেই চিরদিন দেখতে চায়। আর মানুষের মানসিক জগতের বিড়ম্বনাগুলো এইভাবেই আবর্তিত হয়ে ওঠে, যে আবর্তের সামনে সে অসহায়, অথচ তার কোনও দোষ নেই। মানুষ বাইরের জগতের থেকে, আপনার কাছেই বেশি পরাধীন, কারণ সে সচরাচর নিজেকে অতিক্রম করে যেতে পারে না। অপরের প্রতি নিরীক্ষণ ও যাচাইটাও সে আপন জগতে বসেই করে।

তাই–তাই, সরসীর চোখ ফেটে জল আসে, এবং একটি তীব্র আকাঙ্ক্ষায় তার রক্ত তোলপাড় করে ওঠে। ওর (সুবীরের) কি আজ সেই দিনের কথা মনে পড়ে (হয়তো খুবই ছেলেমানুষি, হ্যাঁ, ছেলেমানুষিই তো, সরল প্রকৃতি ছেলেমানুষি।) মনের আবেগে, সরসীকে কোনও কারণে যখন ছুটে এসে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে চেয়েছে, সরসী সহসা ঠোঁট শক্ত করে, কঠিন মুখ ফিরিয়ে রেখেছে। বলেছে, না।

সুবীর অবাক হয়ে বলেছে, কেন?

তুমি কাল সন্ধেবেলা কলেজ ফাঁকি দিয়ে আড্ডা দিতে গিয়েছিলে?

কে বলল তোমাকে?

যেই বলুক, গিয়েছিলে কি না।

প্রফেসরই আসেননি, ফাঁকি দিতে যাব কেন?

তবে বাড়ি চলে আসোনি কেন? আর আমাকে সে কথা বলোনি কেন? সিনেমায় চলে গিয়েছিলে, না?

হ্যাঁ।

সে কথা বলনি তো?

বললেই তো তুমি রাগ করবে, তাই বলিনি।

তা হলে এখনও রাগ করে আছি, আমাকে ছেড়ে দাও।

সরসী এমন কঠিন নিষ্প্রাণ গলায় বলেছে যে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরা সুবীরের হাত আপনা থেকেই শিথিল হয়ে পড়েছে। সরসী দেখেছে, পুরুষের সেই ব্যাকুল চুম্বনোন্মুখ ঠোঁটের তৃষ্ণা কেমন করে আহত অসহায় ঠোঁটেই শুকিয়ে গিয়েছে, বুকের উচ্ছ্বসিত সুধা গলার কাছ থেকে আবার বুকেই নেমে গিয়েছে।

পুরুষের সেই মূর্তি দেখে, নারীর মন তখন স্বভাবতই কষ্টে টনটনিয়ে উঠেছে, কিন্তু ভয় তাকে শক্ত করে রেখেছে। ভয়, সুবীরের ভবিষ্যতের কথা ভেবে, সুবীর প্রশ্রয়ের সহজ স্রোতে ভেসে যাবে। যদি সরসীর আপন আকাঙ্ক্ষা তার মনের মধ্যে ধুইয়ে চুঁইয়ে উঠেছে।

সুবীর বলেছে, তার জন্যে তুমি এত রেগে গেছ? আচ্ছা, আর যাব না, হয়েছে?

সরসী তৎক্ষণাৎ জবাব দিতে পারেনি। সে কখনও কোনও কথাই সহজে ভুলতে পারত না। যে কোনও অন্যায়েরই লঘু-গুরু বিচার সে করত না, তারও একমাত্র কারণ ভয় ও অবিশ্বাস। নিয়মের কোনও ব্যত্যয় ঘটলেই, সামান্য মিথ্যে কিছু ধরা পড়লেই, সরসীর মনে হত, তার সকল স্বপ্ন বুঝি ধূলিসাৎ হয়ে গেল। তাই পুরুষকে শাস্তি দেবার, নারীর সেই চিরন্তন রূপটা সরসীও লুকিয়ে রাখতে পারেনি। বিশেষ সুবীরের মতো পুরুষ, যাকে প্রবৃত্তির দাস বলা যাবে না কোনওরকমেই, স্বাভাবিকতাই যার জীবনের বেগকে কেবল অস্থির তরঙ্গে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছে। আর সেই তরঙ্গ কেবলই সরসীর কূলে ছুটে এসে অজস্র ধারায় ভেঙে পড়েছে। এ কথা সরসী নিশ্চিত রূপেই অনুভব করেছিল, সুবীরের প্রাণের যে অশান্ত বেগ, যাকে সে দস্যুতা বলেছে আপন নারীত্বের গৌরবে, সেই অশান্ত বেগের সকল লীলা ওর সরসীকে কেন্দ্র করেই। তাই, তবু নারীর যে ভূমিকাকে সে পুরুষের কাছে মুখ্য বলে বিশ্বাস করতে চায়নি, সুবীরকে নিয়ে ওর স্বপ্ন সার্থকের জন্য, সেই ভূমিকাতেই অবতীর্ণ হয়েছে। সহজে শাস্তি দেবার সহজ পথটা সে অনেকবার বেছে নিয়েছে।

একদিন নয়, ও রকম অনেক অনেক দিন, সুবীরকে সে প্রত্যাখ্যান করেছে। এখন ভাবলেও হাসি পায়, ওই পুরুষ, আলোকে অন্ধকারে কতদিন কত ব্যাকুল প্রার্থনায় লুটিয়ে পড়েছে, নতজানু হয়ে কৃপাভিক্ষা করেছে। সরসীর বুক হয়তো ফেটেছে, মুখ ফোটেনি। রক্তধারা উদ্বেল হয়েছে, কিন্তু ওপরের কাঠিন্যের স্তব্ধতা কোথাও চিড় খায়নি। এ কথা একবারও ভাবেনি, তার প্রিয় পুরুষের জীব-প্রবৃত্তিকে নীচে নামিয়ে দেবার ভয় আছে কিনা। সে শুধু ভেবেছে, না, নানা-না, সুবীরের সবটাই ওর অতীতের অন্ধকারকে ঘিরে ফেরে। ওকে সম্পূর্ণ রূপে ফিরিয়ে আনতে হলে, নিজেকে কৃপণের মতো দিতে হবে, ওর কাছ থেকে নিতে হবে বেশি, ওর ফিরে আসার, নতুন জীবনে যাবার পাথেয়স্বরূপ।

তাই, এখন কত দিন ও রাত্রির ছবি মনে পড়ছে। যদিচ, আজকের সুবীরই প্রমাণ, জীব-প্রবৃত্তির তাড়নায় ওকে বিকারগ্রস্ত করে তুলতে পারেনি। কিন্তু যদি পারত, সরসী নিঃসন্দেহে শুধু ওর অতীত জীবনকেই দায়ী করত। তার আপন দায়িত্বের কথা একবারও মনে করত না। পারতও না, কারণ সে যে বিশ্বাস করেছিল, অন্যায় যা কিছু, তা সুবীরের দিকে।

সুবীরের প্রাণের বেগকে বুঝতে কোনও সময় সরসীর ভুল হয়েছিল। তাই শাস্তি যত দিয়েছে সে, সুবীর তার সবগুলোকে সব সময়ে শাস্তি বলে গ্রহণ করেনি। ওর জীবনবেগ সে সব চূর্ণ করে এগিয়ে গিয়েছে, যদিচ সেই জীবনবেগের মধ্যে কোনও চিন্তাবুদ্ধির শান ছিল না। ওর মনুষ্যত্বের মধ্যেই তা নিহিত ছিল।

এখন চোখে জল আসছে সেই সব দিন ও রাত্রির কথা ভেবে। না, তার কারণ এই নয় যে, আজকের দিন ও রাত্রি থেকে জীবনের উত্তাপ চলে গিয়েছে। সেই পরিপূর্ণ উত্তাপ বর্তমান সত্ত্বেও, এখন যেন তার শ্রী ও সুখ এবং অনুভূতির রূপ বদলে গিয়েছে। সরসী জানে না, আজ তার রক্ত কেন কান পেতে আছে সেই ব্যাকুল পুরুষটির জন্যে। তার প্রত্যাখ্যানে যে নিষ্প্রভ মলিন হয়ে পড়ত, আমন্ত্রণের আভাসে মাত্র জোয়ারে ঢেউ লাগত।

এখন, ওই ঘরের ওই পুরুষটিকে কেন্দ্র করে, সেসব দিনের কথা ভাবতেও যেন কেমন সংকোচ হয়। এই কি সে নয়, সকালবেলা দুজনের বিদায় নেবার আগে, যে নিবিড় চোখে তাকিয়ে ডাকত, এই দিলে না?

একবার, এক পলকের স্পর্শের একটু আদর। সেটুকু না পেলে, ওর সারাদিনের কাজে মন বসত না। আর এখন যে সকালবেলা বই থেকে মুখ তুলে তেমনি নিবিড় চোখেই তাকায়, কিন্তু দিলে না বলে কাছে ডাকে না, হয়তো একটু হাত ছোঁয়া, একটু স্পর্শমাত্র। এখন ও অন্য ভাবে চিন্তিত, ব্যস্ত। অবসরে হয়তো, একটু অল্প করে ছোঁয়ানো মাত্র, গভীর করে নয়।

অথচ আবার এ কথাও সত্যি, ওই যে পুরুষ, ডক্টর সুবীররঞ্জন মিত্র, তাঁকে ঠিক আগের সেই ব্যাকুল চঞ্চল রূপে মানায় না। সরসী যে তাই মানাবার জন্যে মনে মনে বড় ব্যগ্র, তাও ঠিক বলা যায় না। তবু, আশা আকাঙ্ক্ষার ভয়ে চোখের জলে রাগে বিক্ষোভে একদা তার প্রাণের সকল তন্ত্রী যেমন নানান সুরে বেজে উঠত, তেমন করে বাজে না। একদা সে যে সুখ অনুভব করেছে, অনেক অন্ধকারের মধ্যেও তার প্রাণের দিগন্ত জুড়ে সহসা যে আলোর ঝলক লাগত, এখন আর তেমন করে লাগে না। তাই আজ তার সকল সত্তা, সমগ্র অনুভূতি, পুরনো সেই মানুষটির জন্যই কান পেতে থাকে। তার প্রাণের এই জটিল সংকটকে কিছুতেই সে চিনে উঠতে পারে না, তাই কোনও ব্যাখ্যা করতে পারে না, আপন কর্তব্য স্থির করে উঠতে পারে না। সংশয় তাকে পাকে পাকে কেবলি জড়িয়ে ধরছে। আর, অতএব মন শুধু পেছনে ফিরে যায়। পেছনে, পেছনে…।

চলো সরো, একটু সিনেমা দেখে আসি।

আঁচল ধরে বুকের কাছে টেনে নেওয়া সেই সব ছবি ভেসে ওঠে। আর আপন স্থির দৃঢ় গলা সরসী শুনতে পায়, না।

কেন, মাসের প্রথম সপ্তাহে, একটা দিন না পড়লে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে? দুজনে মিলে একটু ছবি দেখতেও যেতে পারি না?

না, এখনও তার সময় হয়নি।

তারপরে মুখভার, কথাবার্তা বন্ধ, আবার সন্ধি। এমন কত অজস্র দিনের ছবি। শুধু কি এইটুকু? ভাল করে সাজতে প্রসাধন করতেও ভয় পেয়েছে সরসী, দ্বিধা করেছে। কারণ দেখেছে, সুবীর সব ভুলে, আত্মভোলা মুগ্ধ চোখে তার দিকে চেয়ে রয়েছে। তাকে নিয়েই মগ্ন হয়ে থাকতে চেয়েছে। তখন নারীর প্রাণের বিগলিত ধারা একদিকে অজস্র ধারে ঝরেছে, আর একদিকে শুকিয়ে উঠে, শঙ্কিত হয়ে সরে গিয়েছে, মনে মনে বলেছে, না না না, ওর ক্ষতি করতে পারব না, নিজের সর্বনাশ আমি করব না।

কতদিন সুবীর বলেছে, আজ একটু সাজো না সরো। না হয় ঘরেই থাকবে, বেরুতে হবে না।

না, আমার শরীর খারাপ, সাজতে ভাল লাগছে না।

মিথ্যে কথা। আসলে তুমি সাজতে চাও না।

বলতে বলতেই সুবীরের মুখে অভিযোগ ফুটে উঠেছে।

সরসী বলেছে, তবে তাই। সাজবার কী আছে, আমি তো বাড়িতে রয়েছি। তুমি তো এখন পড়তে বসবে।

না, আমি এখন পড়তে বসব না। সারাদিন অফিস, তারপরে মাস্টারের হুকুম, আমার অত ভাল লাগে না।

বেশ, বসো না।

ততক্ষণে সরসীর মুখও গম্ভীর হয়ে উঠেছে।

সুবীর আবার বলে উঠেছে, মাস্টারনিরা ভাবে, তারা সবসময়েই মাস্টারনি। বিশ্বসংসারে সবাই তাদের ছাত্রছাত্রী।

ও ধরনের কথা শুনলেই রেগে উঠত সরসী। সুবীরও ভীষণ রেগে উঠলেই ও ধরনের কথা বলত। আবার রাগ অভিমান, কথা বন্ধ, গুমোট আবহাওয়া। এবং সময় তার আপন নিয়মে আবার নতুন আবহাওয়া নিয়ে এসেছে।

তবু একেবারেই কি সাজত না সরসী? কোনওদিনই কি সিনেমায় বা বেড়াতে যায়নি? সবই করেছে, যতটা নিরুপায় হয়ে করতে হয়েছে, ততটাই। কিন্তু মনের মধ্যে সবসময়েই অস্বস্তি ও দ্বিধা হয়েছে, ভয় হয়েছে, পাছে দুজনের সাধনায় বাধা পড়ে।

অনেক তুচ্ছ, অনেক হাস্যকর (এখন তাই মনে হয়) ঘটনা ঘটেছে, সবকিছুর মূলে সেই একই ভাবনা, চিন্তা, ভয়। সুবীরকে একাগ্র করে তুলতে হবে। কত সামান্য ঘটনা নিয়ে কী প্রলয় না করেছে সুবীর। ডক্টর মিত্র, আপনি যে তখন কী অসম্ভব ছেলেমানুষের মতো জেদ করতেন, দাপাদাপি করতেন, আর কী আশ্চর্য সব কারণে, যা স্ত্রী হয়ে বলতেও লজ্জা করে, সে সব কি এখন আপনার একটুও মনে পড়ে? অন্ধকার ঘর থেকে সুবীরের দিকে তাকিয়ে মনে মনে জিজ্ঞেস করে সরসী। ডক্টর মিত্রের মনে পড়া দূরে থাক, সরসীই যেন আজ আর সে কথা ভাবতে পারে না স্বামীর দিকে তাকিয়ে।

তবু সেই পুরুষটিই বারে বারে ভেসে ওঠে চোখের সামনে।

সেই পুরুষটি–না, পুরুষ কোথায়, রকবাজ ছেলে বলাই তো ভাল। প্রথম দিনের সেই কথা কি কোনওদিন ভুলবে সরসী? প্রথম যখন এসেছিল নতুন পাড়ায়, প্রথম যেদিন সে ইস্কুল থেকে ফিরছিল, গলির মধ্যে ঢুকতেই, দূর থেকে লক্ষ করেছিল, কয়েকটি ছেলে বসে রয়েছে একটি পুরনো বাড়ির রকে। ইস্কুলে যাবার সময় ওদের দেখতে পায়নি সে। মধ্যবিত্তদের নতুন নতুন পাড়া তাকে কম দেখতে হয়নি ছেলেবেলা থেকে। পরিবারের আর্থিক কারণে, সুবিধার প্রয়োজনে, বাসাবদলের পালা অনেকবার হয়েছে। যেটা সাধারণ নিয়মে আজকাল ঘটে থাকে, তেমনি দেশ-বিভাগের পরে বাস্তু ছেড়ে তারা আসেনি। দক্ষিণ নদিয়া জেলা থেকে একদা ওর ঠাকুরদা এসেছিলেন ভাগ্যের সন্ধানে। তারপর থেকে, কলকাতার এপাড়া-ওপাড়া করে, বাসাড়ে জীবনের ভাগ্যটা দাদাদের আমলেও বদলানো যায়নি। অথচ কলকাতা ছেড়ে দেশের বাড়িতে থাকবার উপায় ছিল না। ছেলেমেয়েদের শিক্ষা-দীক্ষা জীবিকা, সবকিছুই কলকাতাকে ঘিরে শুরু হয়ে গিয়েছিল। হয়তো, দেশের ভিটায় মাটি কামড়ে পড়ে থাকলে, সমস্ত বছরের ধানটুকু তোলা যেত। কিন্তু ঠাকুরদার যদি বা দেশে গিয়ে স্থায়ী হয়ে বসবার ইচ্ছে হয়েছিল, বাবার একেবারেই হয়নি, উপায়ও ছিল না। তিনি লেখাপড়া করেছিলেন কলকাতায়, চাকরিও কলকাতাতেই। বাবা তবু বছরে কয়েকবার দেশে যাবার তাগিদ বোধ করতেন, দাদারা একেবারেই নয়। তাঁদের যাওয়া বছরে একবারই যথেষ্ট। একমাত্র সেই হিসেবেই, সরসী কয়েকবার তাদের দেশের বাড়িতে গিয়েছিল। নিজেদের গ্রামের থেকে জন্মস্থান কলকাতাকেই সে স্বাভাবিক ভাবে বেশি চিনত, বুঝত। কলকাতাকেই তার ভাল লেগেছে বেশি। বাবা কিংবা দাদাদের জীবনে একটি বসতবাড়ি নির্মাণের নৈরাশ্য আজও রয়ে গিয়েছে। কিন্তু বাসাড়ে জীবনে সরসী কিছু অস্বস্তি বোধ করেনি কখনও।

তাই নতুন বাসা নতুন পাড়াকে তার ভয় ছিল না। মনে মনে জেনেছিল, ও সবের চরিত্রটা সর্বত্রই প্রায় এক। অতএব, একলা মেয়ে, পাড়ায় ঢুকলে, রকের ছেলেরা একটু গুলতানি করে উঠবে, ওটাকে সে স্বাভাবিক বলেই জানত। দশ দিন করবে, তারপরে আর নয়। মনে মনে বলত, ও হতভাগার দল কোথায় নেই। বিদেশের সাহিত্য পড়ে তার ধারণা হয়েছিল, রকবাজিটা কেবল এদেশে নয়, পৃথিবীর সব দেশেই আছে, এমনকী সমাজতান্ত্রিক দেশের পাড়াগুলোতেও, চ্যাংড়া প্রাণে রেশমী চুড়ির ঠিনি ঠিনি। কিছুটা রকমফের মাত্র।

তবু ওদের কথায়, মস্তিষ্কটা ঝাঁ ঝাঁ করে ওঠে বইকী। হাতে পায়ে ক্ষমতা থাকলে, ইচ্ছে হয়, দুটি গালে দুটি চড় বসিয়ে দিতে পারলেই ভাল হত। ওদের কথায় কান গরম হয়ে ওঠে, অসহায় রাগে জ্বলতে হয়। সবথেকে কষ্ট হয়, যখন দেখা যায়, সে সব কথা অভিভাবককে বলা যায় না, কারণ তাতে নিজের লজ্জা, লোকলজ্জা, একটা অনর্থ, এবং ওদের আরও উসকে ভোলা।

নতুন পাড়ায় সেই প্রথম দিন ঢুকতে গিয়ে, রকের দিকে না তাকিয়েই চলে গিয়েছিল সরসী। কানে গিয়েছিল টুকরো কথা, ভিন্ন ভিন্ন স্বরে, নয়া আমদানি।

কেরানি নাকি?

উঁহু, জিজ্ঞেস করব নাকি?

তখনই কান দুটো ছাঁৎ করে উঠেছিল সরসীর, এবং সেই মুহূর্তেই একটা আশঙ্কায় প্রায় আড়ষ্ট হয়ে উঠেছিল। সত্যি কেউ ছুটে এসে জিজ্ঞেস করবে নাকি? যদিচ সে বেশ স্বাভাবিকভাবেই এগিয়ে চলে গিয়েছিল। আর পিছনে একটা হাসির হুল্লোড় শোনা গিয়েছিল।

সরসী বাড়ি ঢুকে মাকে বলেছিল, পাড়ার ছেলেগুলো সব জায়গায় এক। ইতর।

কিছু বলেছে নাকি?

ওই, যা বলে।

মূর্খ আর বাঁদরের দল সব।

নির্বিকার ভাবেই মা বলেছিলেন, কারণ ও সব তাঁরও জানা ছিল। সরসীও আর কিছু ভাবেনি, সে ভুলে গিয়েছিল।

কিন্তু ভুলে থাকতে পারেনি। কারণ ভুলে থাকতে দেওয়া হয়নি তাকে। তবে, ছেলেগুলোকে, সন্ধ্যাবেলাতেই বেশি দেখতে পাওয়া যেত। ছুটির দিনে প্রায় অষ্টপ্রহর। তাতে একটা বিষয় অনুমান করা গিয়েছিল, কোথাও কাজকর্ম করে। যদিচ দু-একজন সব সময়েই প্রায় থাকত। বোঝা যেত, সেগুলো বেকার।

কয়েকদিন পরেই ওদের বিভিন্ন গলায় শোনা যেত, দিদিমণি চলেছেন।

সরসী প্রথম যেদিন কথাটা শুনেছিল, হঠাৎ ভুরু কুঁচকে চোখ তুলে তাকিয়েছিল। মনে আছে, সেদিন যে মুখটি তার প্রথম চোখে পড়েছিল, সে মুখটি সুবীরের। এবং এ কথাও মনে আছে, হঠাৎ চোখ তুলে তাকাতেই সুবীর কী রকম বিব্রত হয়ে পড়েছিল। সরসী এগিয়ে যাবার পর, তার কানে এসেছিল, আমি বলিনি, মাইরি!

কথাটা শুনে প্রায় হাসিই পেয়েছিল। কিন্তু তার চেয়ে অনেক বেশি, রাগে ওর মাথার মধ্যে দপদপ করছিল। ভেবেছিল, মানুষের প্রবৃত্তিটা এ রকম হয় কেন? কোন পর্যায়ে এলে মানুষ এ রকম ব্যবহার করতে পারে? এর নিরসনই বা সম্ভব কী করে? কলেজে বা ইউনিভার্সিটিতে যে ছেলেরা একেবারেই কিছু করত না, তা নয়। চলতি কথায় যাকে বলে কমেন্টস সে রকম কিছু কিছু প্রায়ই শোনা যেত। কোএডুকেশন কলেজে পড়েছে সরসী, অতএব, একভাবে ছেলেদের মোটামুটি মতিগতিটা সে তখন অনুধাবন করেছিল। কলেজের বারান্দায়, লনে বা রাস্তায়, চলতে ফিরতে অনেক টুকরো কথাই কানে ভেসে এসেছে। প্রথম প্রথম তার রাগ হত। পরে রাগ হত না, যদিচ মন থেকে সে কখনওই পুরোপুরি সায় দিতে পারেনি। তারই সহপাঠিনীদের মধ্যে অনেকে, ছেলেদের কথা নিয়ে রীতিমতো গুলতানি ও হাসাহাসি করত। কেউ কেউ ছিল, ছেলেদের সঙ্গেই দল বেঁধে আড্ডা দিত। কফি হাউস রেস্তোরাঁয় আসর জমাত।

সরসীর ছেলে বন্ধু যে একেবারেই ছিল না, তা নয়। কিন্তু দল বেঁধে আড্ডা দেবার মধ্যে কোথাও একটা আড়ষ্টতা ছিল। ছেলেদের সঙ্গে হইহই করে বেড়ানো তার কখনওই হয়নি। সম্ভবত যে পরিবেশে সে মানুষ, আড়ষ্টতার কারণগুলো সেখান থেকেই তার ভিতরে বাসা বেঁধেছিল। কফি হাউস রেস্তোরাঁতে সে যে যায়নি, তা নয়। কিন্তু সেটা তার অভ্যাসে পরিণত হতে পারেনি বা টেবিল চাপড়ে চামচ বাজিয়ে দাপাদাপি করবার মতো স্বাচ্ছন্দ্যবোধও ছিল না।

ও সব ব্যাপারে অর্থাভাবের বাধাটা একটা বড় ব্যাপার ছিল নিঃসন্দেহে। আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য থাকলে, সম্ভবত মনও কিছুটা অন্যরকম হয়। আর যাদের আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য ছিল না, অথচ আসর জমাতে পারত, তাদের পিছনে একটা পরিবেশ ও মন কাজ করত নিশ্চয়ই।

তবু ছেলেবন্ধু ছিল সরসীর, দু-একজন তাদের বাড়িতেও যেত, মা-দাদাদের সঙ্গে আলাপ-পরিচয়ও হয়েছে। অচেনা ছেলেদের নানান কমেন্টস সম্পর্কে সে যখন তার ছেলেবন্ধুদের, অনেকটা অভিযোগ করেই বলেছে, তখন তারা হেসেছে। বিষয়টাকে তারা কেউ তেমন করে আমল দেয়নি। ও রকম একটু-আধটু বলেই থাকে, এই ছিল তাদের বক্তব্য। বলত, ওদের সঙ্গে আলাপ হলে দেখবে, কেউ আর কিছু বলছে না।

সরসী বলেছে, এ তো বড় অন্যায়। আলাপ না হলেই যদি ছেলেরা বিশেষণ দিতে আরম্ভ করে আর কবিতা কোট করতে থাকে, তা হলে তো মুশকিল।

বন্ধুরা তার জবাবে যা বলেছে, তা হলে এই, পৃথিবীটাকে খুব অমুশকিলের জায়গা বলেই বা ভাবছে কেন সরসী। জগৎসংসারের সবখানেই মুশকিল। যদি সে নিজে মুশকিল না মনে করে, তা হলে সবকিছুরই আসান হয়ে যায়।

কিন্তু সরসী এমন মেয়ে যে, মুশকিলটাকে মুশকিল বলেই সে মনে করে। অতএব মুশকিলকে মুশকিল না মনে করে কী ভাবে আসান করা যায়, সে পদ্ধতি তার জানা ছিল না। ও ব্যাপারে সে ছেলেদের সমর্থন করতে পারেনি।

সরসীর ছিটেফোঁটা রূপ যেটুকু ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল ওর স্বাস্থ্যের দীপ্তি। ওটাই বেশি করে চোখে পড়ত। রূপসী হলে, একটু সাজবার দরকার হয়, তা নইলে ঠিক ব্যালান্স হয় না। অনেকটা সাজানো বাগানের মতে, তার অনেক ছাঁটকাটের, মাপজোখের প্রয়োজন, নইলে তাকে মানায় না। স্বাস্থ্যের দীপ্তিটা বনফুলের ঝোপের মতো। অসাজই তার সাজ, তাতেই তাকে মানায়। সেই মানানোটাই ছিল ছেলেদের প্রতিক্রিয়ার আধার। সে হিসেবে, কলেজে, ছেলেদের চোরা কমেন্টস (মুখোমুখি না বলা) যদি প্রেম নিবেদনের প্রস্তাবনা-স্বরূপই হত, তা হলে বলতে হবে, তা কখনওই মূল নাটকে প্রবেশ করতে পারেনি। কারণ, সরসীর কাছে ও পদ্ধতিটা দূরে সরে যাবার, কাছে আসবার নয়। অশ্রদ্ধা আর বিদ্রুপের ভাগই মনে মনে বেশি জমেছিল। যদিচ, আটঘাট বেঁধে বেশ ধোপদুরস্ত কেতায় প্রেম-নিবেদনও ভাগ্যে কিছু জুটেছিল, সেগুলো আবার এত বেশি মেকি মনে হয়েছিল যে, প্রেম সম্পর্কে তেমন কোনও কনসেপশনই সরসীর মনে তৈরি হয়ে উঠতে পারেনি। অথচ স্বপ্ন একটা ছিল, যে স্বপ্নের কোনও তত্ত্ব বা তথ্য বা ব্যাখ্যা, কিছুই তার ছিল না। অবিশ্যি এর সঙ্গে, ওদের পারিবারিক পরিবেশটা সবসময়েই কাজ করেছে, এবং পারিবারিক পরিবেশে বর্ধিত মনটাও।

সেই স্বপ্নের সঙ্গে অনেক মুখের যে মিল ছিল না, তা নয়। কিন্তু নিতান্ত মুখেরই, তারা কেউ বা পরিচিত ছিল, কেউ বা অপরিচিত, তাদের অন্তরের সংবাদ নেবার সুযোগ কখনও আসেনি। কল্পনার জাল বোনা ছিল সে সব। সেই স্বপ্নের মতো, সেই সব মুখও আসলে অচেনা, অস্পষ্ট। দেখে মনে হয়েছে, বেশ। ওই পর্যন্তই।

অতএব, বিবাহ, জীবনযাপনের ভাবনায় ওর কোনও অসাধারণত্ব ছিল না। প্রজাপতির ছাপওলা চিঠি, পাকা দেখা, গায়ে হলুদ, অচেনা কোনও লোকের সঙ্গে অন্য সংসারে যাওয়া, এটাই ধারণা করেছিল। যা অতি সাধারণ, অসাধারণত্বের চিন্তা বড় একটা মনে স্থান পায়নি।

বরং কলেজের কোনও কোনও অধ্যাপকের চেহারা, শ্রী, ভঙ্গি ওর মনের মধ্যে পাক খেয়েছে। ওর আঠারো কুড়ির মনে সেটাই যা একটু অসাধারণ ছিল। কিন্তু সেই মনই শেষ পর্যন্ত মন্টু মিত্তিরের ওপর নিবিষ্ট হয়ে পড়েছিল, মানবী মনের বিস্ময়টা সেখানেই সব থেকে বেশি। অসাধারণত্বের ধাক্কাটা সেখানেই প্রায় প্রলয় করে দিয়েছিল। মানবী না বলে, মানবমনই বলা ভাল, কারণ বস্তুজগতের আবিষ্কারের তুলনায়, গোটা মানবমন এখনও অনেক বেশি আয়ত্তের বাইরে। একেবারে অধ্যাপক থেকে মন্টু মিত্তির, এমন বিশাল অমিলের মিলটা কোন ছন্দে বাঁধা ছিল, সরসী নিজেও তা জানত না। অথচ অসাধারণ কিছু করবার মতো কল্পনা-বিলাসিতাও ওর একেবারেই ছিল না। যাদের ছিল, তাদের কথা শুনে, ভাব-ভঙ্গি দেখে, সরসী বরাবর নিজেকে একটু খাটোই ভেবে এসেছিল, এবং মনের মধ্যে একটা সান্ত্বনা খুঁজে নিয়েছিল, পিতৃহীন জীবনে, বিধবা মা ও দাদা-বউদির সংসারে, একটু খাটো থেকে, স্বস্তিতে জীবনটা কাটিয়ে যেতে পারলেই হল।

বোধহয়, এমনি ভাবনা থেকেই, এম এ পাস করেই ইস্কুলের চাকরিটা নিতে সে দেরি করেনি। টাকার দরকার যে ছিল, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। দাদাদের দিক থেকে বোনের বিয়ের দরকারটা তার থেকে বেশি ছিল। তবে প্রজাপতির নির্বন্ধ, যতদিন বিয়েটা ঘটে না উঠছে, ততদিন মেয়েদের ইস্কুলে মাস্টারিটা চলুক, এই ছিল মোটামুটি ভাবনা। এ সবের থেকে সরসীর একটা চরিত্র টের পাওয়া যায়, যে চরিত্র স্বভাবতই, ছাত্র বন্ধুদের সঙ্গে হইহই করে বেড়াতে পারেনি, বা হঠাৎ আলোর ঝলকানি চলেছে কিংবা যৌবন সরসীনীরে কমেন্টস শুনে, বুকে দুরু দুরু খুশি, দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে হেসে, মন রঙিন করে তোলেনি। বরং ভ্রূকুটি করে তাকিয়েছে।

.

কিন্তু কলেজের ব্যাপারটা ছিল আলাদা। পাড়ার রকবাজদের ব্যাপারটা অন্যরকম। যদিচ অসহায়ত্ব সব জায়গাতেই সমান। দাদাদের আয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে, যে সব পাড়াতে সরসীরা বাস করেছে, ওদের দেখা সবখানেই পেয়েছে। মনে মনে ভাবত, ভাগ্য ভাল, নিজের কোনও ছোট ভাই নেই। থাকলে বোধহয় সে-ও পাড়ার রকে বসে ও রকমই করত। অবিশ্যি একদা নিজের ছোড়দাকে দেখেছে, পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে চায়ের দোকানে বসে আড্ডা মারতে। সেখানেও যে গোলমাল একেবারে না ছিল, তা নয়।

কিন্তু নতুন পাড়ার রকের চেহারাটা অনেক শ্রীহীন, নীচের ধাপের।

ছোড়দাদের সঙ্গে ওদের তুলনা ছিল না। যদিচ, তাতে সরসীর কোনও ক্ষতি বৃদ্ধি বা কম ছিল না। তবু কান দুটো ঝাঁ ঝাঁ করত বইকী। রাগে, প্রায় ওর নিটোল মেয়ে হাত দুটোই নিশপিশ করত। ইচ্ছে করত, ফিরে গিয়ে ঠাস করে একটা চড় কষিয়ে দেয়। চিৎকার করে গালাগাল দেয়, যা মুখে আসে তাই বলে। এবং রকের দলের সুবীরের মুখটা স্মরণ করে, সেই প্রথম দিন, অনেক নিষ্ঠুর কল্পনা সে করেছিল। সে কল্পনায় দেখেছিল, মার-খাওয়া মুখে, চোখের জলে, লোকটা তার কাছে পায়ে ধরে ক্ষমা চাইছে।

কিন্তু সে কল্পনা বাস্তবে রূপায়িত হওয়া তো দূরের কথা, নতুন পাড়ার বাঁদরামি ক্রমে বেড়েই চলেছিল। গানের কলি শোনা যেত নানানরকম, তবে এ-যুগে রবীন্দ্রসংগীতের কলি রকের আয়ত্তেও এসে গিয়েছে। অতএব, কখনও, হেনবীনা, প্রতিদিনের পথের ধূলায় হয় না চেনা। কিংবা, ..দেখেছি পথে যেতে তুলনাহীনারে।

কেউ গায়, পথ দিয়ে কে যায় গো চলে…।

এমন সব আশ্চর্য গানের কলি ওরা হেঁকে উঠত, যার মানে ওরা নিজেরাই হয়তো বুঝত না। যেমন এস আমার ঘরে এস…

চূড়ান্ত বলে মনে হত তখন, যখন পাশ দিয়ে যাবার সময় শুনিয়ে শুনিয়ে কেউ বলে উঠত, আমার আবার ইস্কুলে পড়তে যেতে ইচ্ছে করে, অন গড বলছি।

কথাটা যেদিন সরসী শুনেছিল, সেদিনও আবার সে কুটি চোখ তুলেছিল, এবং আবার সেই একই মুখ, ধরা পড়ে যাওয়া বিব্রত। এবং আবার শোনা গিয়েছিল, আমি কিন্তু বলিনি, সত্যি বলছি।

সরসী মনে মনে দাঁত পিষে বলেছিল, ছোটলোক। ভেবেছিল, ইস্কুলে যদি সত্যি ওরা আসত, তবে চাবকে ওদের পিঠের ছাল তুলে দিত। পরে সে সুবীরের মুখে শুনেছে, ও সত্যি চট করে কিছু বলত না, যে কারণে পরে বন্ধুদের সঙ্গে ওর ঝগড়া হয়েছে। বলেছে, যা মাইরি, তোরা বলিস, আর দিদিমণির চোখ পড়ে আমার ওপর। ভাবে, আমিই বলেছি।

ওদের মধ্যে সরসী দিদিমণি বলেই পরিচিত ছিল। অর্থাৎ নিজেদের মধ্যে ওরা সরসীকে ওই নামেই ডাকত। পাড়ার আরও কয়েকটি মেয়ের সঙ্গে আলাপ হতে, তাদের কাছেও শুনেছিল, সকলের সঙ্গেই কিছু কিছু ও রকম করে থাকে। আবার কোনও কোনও মেয়ের সঙ্গে ওদের বেশ কথোপকথন চলত, যারা ও পাড়ারই মেয়ে। ছেলেবেলা থেকে সবাই সবাইকে দেখে এসেছে। ক্রমে ক্রমে, রকের আড্ডাধারীদের অনেকেরই নাম পরিচয় সে জানতে পেরেছিল।

সরসী বুঝতে পেরেছিল, কোনও এককালে, পাড়াটা ছিল প্রাচীন সম্পন্ন পরিবারের বাসস্থান। শত বছরের পুরনো বাড়ি আর বাসিন্দাদের দেখলেই সেটা চেনা যেত। যে সব বাড়িতে একদা পরিবারের লোকেরা সম্মান ও শান্তিতে নিরিবিলিতে বাস করত, অবস্থার চাপে পড়ে এখন হয়ে উঠেছে, ভাড়াটে বাড়ির খাঁচা। কিংবা বংশবৃদ্ধির দৌলতে উপছে পড়ছে নিজেরাই। পরিবারগুলোর উত্থানের চেয়ে পতনের চিহ্নই বেশি। দু-চার ঘরের কপালে যে উত্থানের আলোক না ছিল তা নয়।

কিছুকাল চলেছিল ওভাবেই। হয়তো, ওদের ইতর আনন্দ আস্তে আস্তে জুড়িয়েই আসছিল। কেবল, কখনও-সখনও হঠাৎ কোনও ছেলেবন্ধুকে সঙ্গে দেখলেই, ওদের মুখ আবার খুলে যেত, বাগানে ঘুঘু দেখা দিয়েছে রে।

কিন্তু চেনা ছেলের সংখ্যা এমনিতেই কম ছিল, বাড়িতে দেখা করতে আসার মতো আরওই কম, এক-আধজন। নিতান্ত ছুটির দিনে হয়তো কেউ এসে পড়ত।

কিন্তু উপগ্রহ দেখা দিয়েছিল অন্যদিক থেকে। ভোরবেলা ইস্কুলে যাবার সময়ে, প্রায়ই দেখা যাচ্ছিল, সরু করে গোঁফ কামানো সেই বিব্রত মুখওয়ালাকে। যেমন তার টেরির বাহার, (ওগো ডক্টর সুবীররঞ্জন মিত্র, তোমার ওখানকার পুরনো সেই ফটোগ্রাফটি আমার এখন একবার দেখতে ইচ্ছে করছে। ইচ্ছে করছে, ট্রাঙ্কের নীচে থেকে বের করে, ওটা সামনে দিয়ে আসি, তুমি একবারটি দেখো, তোমার পণ্ডিত বন্ধুরা একবার দেখুন, ডক্টর মিস হেনা ব্যানার্জি একবার দেখুন)। তেমনি তার শার্ট প্যান্ট জুতো, কারখানার ডিপার্টমেন্টের কেরানি।

ভোরবেলার সেই সময়টা, পাড়াটা থাকত নিরালা। এবং প্রাচীন মিত্তিরবাড়ির দরজায় প্রায়ই দেখা যেত, মূর্তিমান বেরুচ্ছেন। আর, সময় বেছে সেই বেরুনোটা যে ইচ্ছাকৃত, তা অনুমান করতে অসুবিধা হয়নি। হঠাৎ নিশ্চয় কারখানার সময় এগিয়ে বা পেছিয়ে যায়নি। অথচ ঠিক দেখা হত, এবং পিছনে পিছনে চলত।

সরসী দাঁতে দাঁত চেপে থাকত। ভয় সে পেত না, তবু একটা রাগ ও অস্বস্তি তাকে শক্ত করে তুলত। সে টের পেত, কোনও কোনও দিন পশ্চাদগামীর জুতোর শব্দ, প্রায় তার পিছনে, অনেক কাছাকাছি। সরসীর বুক ঢিপ ঢিপ করত না, ইচ্ছে হত, জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে কিছু বলে দেয়। অথচ, বলবার কিছু ছিল না। ভোরবেলার সেই সময়টা, গলি থেকে বেরিয়ে, বড় রাস্তাটাও ভিড়-ভারাক্রান্ত থাকত না, বেশ ফাঁকাই থাকত। বড় রাস্তায় কিছুটা এগিয়ে বাসে উঠতে হত। সুবীরও সেই বাসেই যেত। সরসী নেমে যেত ইস্কুলের কাছে, সুবীর নিশ্চয় শেষ টারমিনাস পর্যন্ত যেত, কারণ কারখানা সেদিকেই।

সরসীর মনের মধ্যে রাগ পুঞ্জীভূত হয়ে উঠেছিল, এবং হঠাৎ একদিন সুযোগ এসেছিল ফেটে পড়ার। দুঃসাহস আর দুর্মতি লোকটার (সুবীরের), হঠাৎ গলির মোড়ের কাছে একদিন জিজ্ঞেস করে ফেলেছিল, ইস্কুলে চললেন?

মুহূর্তের মধ্যে, সরসীর চোখে আগুন জ্বলে উঠেছিল, এবং ফুঁসে উঠেছিল, হ্যাঁ, কেন, আপনার দরকার আছে কিছু?

চোখে ও স্বরে যেন রাগ ও ঘৃণা ফেটে পড়েছিল, আর মুহূর্তের মধ্যে আর একজনের মুখের হাসি যেন শোকের চমকে বিবর্ণ হয়ে উঠেছিল। তাড়াতাড়ি বলেছিল, না, মানে, রোজই দেখি কিনা।

আর তাই আজ আলাপ করতে এসেছেন, না? অচেনা মেয়ের সঙ্গে এভাবে কথা বলতে লজ্জা করে না?

সরসীর গলায় যতখানি তীক্ষ্ণতা ছিল, স্বরগ্রামের উচ্চতাও ততোধিক। সুবীরের মুখ তখন শুধু বিবর্ণ নয়, আলাপের আশা গলায় দড়ির মতো, ভীত ও ত্রস্ত করে তুলেছিল। একেবারে হাতজোড় করে বলে উঠেছিল, দোহাই মাইরি, চেঁচাবেন না। পাড়ায় থাকেন, তাই…।

সরসী গলার স্বর আরও তুলে, আরও তীব্র ঝাঁজে বলেছিল, পাড়ায় থাকি, তাই রকে বসে যা-তা বলেন। আবার বলছেন চেঁচাবেন না।

সুবীর যেন তখন চারিদিকে আগুনের লেলিহান শিখা দেখছিল। নিরালা রাস্তায় দু-একজন পথচারীর দৃষ্টি যে আকৃষ্ট হয়নি, তা নয়। সুবীর প্রায় আতঙ্কিত চোখে চারদিকে তাকিয়ে, ছটফট করে উঠেছিল। বলে উঠেছিল, এঃ, দোহাই চুপ করুন, আমি পালিয়ে যাচ্ছি বাবা। কী সাংঘাতিক!..

বলেই, কোনওদিকে না তাকিয়ে সে একেবারে উলটোদিকে হন হন করে চলতে আরম্ভ করেছিল। কী যে সে বিড়বিড় করছিল, সরসী শুনতেই পায়নি, প্রায় ছুটতে শুরু করে দিয়েছিল। আর সরসীর অবস্থাটা হয়েছিল যেন, বাঘিনীর মুখ থেকে শিকার ফসকে যাবার মতো। সুবীরকে একবারে উলটোদিকে সরে পড়তে দেখে, সে যেন সেই মুহূর্তে ক্রোধের চেয়ে বিস্মিত হতাশাতেই হকচকিয়ে গিয়েছিল বেশি। কিন্তু সেই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে ভাববার সময় ছিল না, বাস এসে গিয়েছিল। সে গিয়ে তাড়াতাড়ি বাসে উঠেছিল। দু-একজন তার দিকে জিজ্ঞাসু কৌতূহলে তাকাচ্ছিল, বিশেষ করে তার গলার স্বর যাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। তখনও সরসীর দ্রুত নিশ্বাস পড়ছিল, চোখমুখ রাগে উত্তেজনায় জ্বলছিল। রাগে সে কাউকেই কিছু বলেনি।

প্রায় যেন একটা আচ্ছন্নতার মধ্যেই সরসী তার স্টপেজে নেমে ইস্কুলে গিয়েছিল, এবং প্রথম ক্লাস নিয়ে, টিচার্স-রুমে ফিরতে গিয়ে, হঠাৎ তার চোখের সামনে, সেই বিব্রত ভীত পলাতক মূর্তি ভেসে উঠেছিল। ভেসে উঠতেই (আশ্চর্য) তার ভিতর থেকে এমন একটা প্রবল হাসি উছলে উঠেছিল যে, সেটা ফেটে পড়লে, তাকে সবাই পাগল ভাবত। তাড়াতাড়ি মুখে আঁচল চেপে সে কোনওরকমে রুদ্ধ হাসির বেগটা সামলে নিয়েছিল। কিন্তু নিলে কী হবে, কিছুতেই সেই দৃশ্য সে ভুলতে পারছিল না, আর প্রত্যেকবারেই তার হাসি ফেটে পড়বার উপক্রম করছিল। ঘটনাটা সে কাউকে গল্প করেনি। কারণ তার মধ্যেও সে কোনও গৌরব খুঁজে পাচ্ছিল না। খানিকটা হাসাহাসি করা যেত, কিন্তু পাছে কেউ অন্যরকম ভেবে বসে, তাই সে চুপচাপই ছিল। আসলে, ঘটনাটিকে সে তার একটা জয় মনে করেছিল। এবং লোকটার সমস্ত ভাবভঙ্গি এমন বিস্ময়কর রকমের করুণ ও হাস্যকর বোধ হচ্ছিল যে, না হেসে সে থাকতে পারছিল না। বাড়িতে গিয়ে মা বউদিকে বলার জন্যেই সে অপেক্ষা করছিল। থেকে থেকে রাগ এবং হাসি, দুই-ই আবর্তিত হচ্ছিল তার মধ্যে।

ইস্কুল ছুটির পর, বাড়ি ফেরবার পথে, সরসী একটু চিন্তিত হয়ে পড়েছিল। ভেবেছিল, মন্টু, (নামটা সে আগেই জেনেছিল)। এখনও ওখানে দাঁড়িয়ে নেই তো? অন্যভাবে প্রতিশোধ নেবার চেষ্টা করবে। হয়তো, বেড়াল ডাকবে, কুকুর ডাকবে, আরও নানারকম কথাবার্তা চেঁচিয়ে বলবে। ভাবতে ভাবতে সরসী একটু যেন চিন্তিত হয়ে পড়েছিল।

ফেরবার সময় বাস-স্টপেজে নেমে, চারদিকে তাকাতে তাকাতে ফিরেছিল সে। নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক ও চকিত রাখবার চেষ্টা করছিল সে। কিন্তু প্রতিমুহূর্তেই মনে হচ্ছিল, এই বুঝি মন্টু এসে সামনে দাঁড়াল। ভয়ের চেয়ে অস্বস্তিই বেশি হয়েছিল। দৃশ্যের অবতারণা সে করতে চায়নি, যদি সকালবেলার উত্তেজনায় সে কথা তার স্মরণ ছিল না।

কিন্তু বড় রাস্তায় বা গলিতে কোথাও সে মন্টুকে বা তার দলবলকে দেখতে পায়নি। স্বস্তি পেয়েছিল সরসী। বাড়ি ফিরেই মাকে ও বউদিকে ঘটনাটা বর্ণনা করেছিল। মা বউদিও খুব হেসেছিলেন। মা একটু ভয় পেয়ে বলেছিলেন, দরকার কী বাপু অত চোটপাট করবার। ও সব বাঁদরদের কি বিশ্বাস আছে? কোনদিন একটা কী ঘটিয়ে বসবে, ওদের এড়িয়ে চলাই ভাল।

কী করে এড়িয়ে যাব?

জবাব না দিলেই হল।

আরও বাড়াবে।

কদিন বাড়াবে। কুকুরেরও একদিন গলা ব্যথা করে।

মায়ের কথা মেনে নিতে পারলেই ভাল হত, কিন্তু সবসময়ে মাথার ঠিক থাকে না। মনে আছে, সেদিন সরসীর মনটা এত খুশি ছিল যে, সে গুনগুনিয়ে গান করেছিল স্নানের ঘরে। মনে মনে বলেছিল, আবার আসিস কোনওদিন, বাঁদর, পেছনে লাগা দেখিয়ে দেব।

তবু সেইদিনই যখন সন্ধ্যাবেলা একবার বেরোবার দরকার হয়েছিল, তখন সরসীর মন চমকে গিয়েছিল। ভেবেছিল, নিশ্চয় ওরা দল বেঁধে বসে আছে রকে, সামনে দিয়ে যাবার সময় রেহাই দেবে না। ভেবেও সে বেরিয়েছিল, এবং দূর থেকেই দেখে নিয়েছিল, রোজকার মতোই ওরা বসে রয়েছে। বিশেষ করে মন্টুকেই দেখে নিয়েছিল সে। মন্টুকে দেখে, একবার সে ফিরে যাবে ভেবেছিল, পরমুহূর্তেই নিজেকে যেন একটা ধাক্কা দিয়ে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।

কিন্তু আশ্চর্য, ওরা নিজেদের কথায় এতই ব্যস্ত ছিল, স্বাভাবিক নিয়মানুযায়ী, (প্রথম প্রথম যে রকম করত)। হঠাৎ চুপ করে গিয়ে, কিছু বলে ওঠেনি। কে একজন যেন শুধু বলে উঠেছিল, ইনগ্রিড চলে গেল।

ওই ধরনের, বিদেশি ছবির অভিনেত্রীদের নাম দিয়ে ওরা পাড়ার মেয়েদের বলত। কিন্তু সরসী অবাক হয়েছিল। বন্ধুর অপমানেও ওরা এত সহজে তাকে ছেড়ে দিল! ব্যাপারটা একটু অস্বাভাবিক লেগেছিল। না কি, মন্টু ঘটনাটা ব্যক্তই করেনি? অথবা ওরা পেছনে লাগবার জন্যে অন্যভাবে প্রস্তুত হচ্ছিল?

সরসী তখন সংশয়ের মধ্যে, ভবিষ্যতের জন্যেই অপেক্ষা করেছিল, এবং বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়নি। মাত্র আটচল্লিশ ঘণ্টা। পরদিন ভোরে, প্রত্যহের মতো মন্টুকে দেখা যায় নি। দেখা গিয়েছিল, ঘটনার দ্বিতীয় দিনে। আবার সেই পিছনে চেনা জুতোর শব্দ ঠকঠকিয়ে উঠেছিল। সরসীও ভিতরে ভিতরে শক্ত হয়ে উঠেছিল। একটা ব্যাপারে সে বুঝে নিয়েছিল, ঠিক পাড়ার গলির মধ্যে কিছু বলতে চাইত না মন্টু। বাইরে বড় রাস্তার কাছে এসে ওর মুখ খুলত, এবং গলির মোড়েই তার গলা শোনা গিয়েছিল, আচ্ছা, একটা কথা বলব?

সরসী তৎক্ষণাৎ পাশ ফিরে রুক্ষ ক্রুদ্ধ স্বরে বলে উঠেছিল, না, আপনার সঙ্গে আমার আবার কী কথা থাকতে পারে?

মন্টুও সঙ্গে সঙ্গে ভীত স্বরে বলে উঠেছিল, ওঃ, আপনার গলাটা–আচ্ছা থাক।

বলতে বলতে আবার উলটো দিকেই চলতে আরম্ভ করেছিল সে। এবং বেশ পরিষ্কারই শোনা গিয়েছিল ওর গলা, এম এ পাস করলে যে মেয়েদের এত অহংকার হয়…।

বাকিটা আর শোনবার ইচ্ছে হয়নি সরসীর, সে শুনিয়েই বলে উঠেছিল, মূর্খ, রকবাজ, ছোটলোক।

মন্টু একবার পিছন ফিরে তাকিয়েছিল, কিন্তু থামেনি, বড় রাস্তা ধরে উলটোদিকে এগিয়ে গিয়েছিল। সরসী গিয়েছিল স্টপেজে। এবং রাগের ঝাঁজের মধ্যেও, মনে মনে তার হাসি পাচ্ছিল। অবাক হয়ে ভেবেছিল, কী বলতে চায় ও? মাথা খারাপ নয় তো? পরমুহূর্তেই ভেবেছিল, মাথা খারাপ নয়, বদমাইশ। মনে করেছে, ওইভাবে আমার সঙ্গে আলাপ করবে, তারপরে…হাসতে গিয়ে, আবার রেগে উঠেছিল সরসী। প্রেম করার শখ! আর কী অদ্ভুত তার পদ্ধতি।

বাস এসেছিল, সরসী উঠে বসেছিল। নিতান্ত মেয়ে বলেই সিট পাওয়া যেত, নইলে ভোরবেলাতেই গাড়িটাতে দূরগামী কারখানার লোকের বেশ ভিড় হত। উঠে বসে, ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে মুখটা মুছে নিয়েও, মাথা নিচু করেই রেখেছিল, এবং সহসা একজোড়া জুতো প্রায় তার পায়ের কাছাকাছি দেখেই তার ভুরু কুঁচকে উঠেছিল। জুতোজোড়া চেনা মনে হতেই, প্যান্ট, তারপরে জামা, তারপরেই ডাণ্ডা ধরে দাঁড়ানো লোকটার মুখের দিকে তাকিয়েছিল সে, মন্টু মিত্তির। সরসী মুখ তুলতেই, চোখাচোখি হয়েছিল, আর চোখাচোখি হতেই, মন্টু চকিতে চোখ সরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়েছিল। সরসী সঙ্গে সঙ্গে অনুমান করে নিয়েছিল, মন্টু হেঁটে গিয়ে আগের স্টপেজ থেকে উঠেছিল। তার মুখ আবার শক্ত হয়ে উঠেছিল। অস্বস্তি বোধ করছিল। কারণ ওই ভিড়ের মধ্যে মন্টু কিছু বললেই একটা অঘটন ঘটে যাবার সম্ভাবনা ছিল।

কিন্তু মন্টু কিছুই বলেনি। সরসী নির্বিঘ্নেই নেমে গিয়েছিল তার জায়গায়। তারপরে দু-একদিন আর ভোরবেলা দেখা যায়নি মন্টুকে। রকের দলে দেখা গিয়েছিল। সরসী বুঝতে পেরেছিল, ও সব ঘটনা মন্টু ওর বন্ধুদের কিছুই বলেনি। তাতে সে মনে মনে স্বস্তি পেয়েছিল কিনা জানত না, কিন্তু অবাক হয়েছিল একটু। আর যাই হোক, নিজের অপমানকর ব্যাপার নিয়ে কোনও নির্লজ্জ ধৃষ্টতা দেখায়নি দল বেঁধে, যেটা ওদের পক্ষে খুবই স্বাভাবিক ছিল। অবিশ্যি, তাতেও মনের মধ্যে একটা পীড়া বোধ করেছিল সরসী। কারণ, একটা ঘটনা, মাত্র তার আর মন্টুর মধ্যে সীমাবদ্ধ, আর কেউ কিছু জানে না, এই ভেবেই পীড়া বোধ করছিল সে। যদিচ মাবউদিরা জানতেন।

দু-একদিন পরেই আবার মন্টুর আবির্ভাব হয়েছিল। আবির্ভাব হলেও, বোধহয় দু-একটা দিন চুপ করে থাকবার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল, এবং দুরত্বটাও বজায় রেখেছিল বেশি। কিন্তু দু-একদিনের বেশি পারেনি। হঠাৎ একদিন বলে উঠেছিল, মূর্খ, রকবাজ ছোটলোক, যা-তা বলে দিলেন একেবারে।

কথাটা এমনভাবে বলে উঠেছিল, যেন খুবই সহজভাবে আলাপ করছিল। সরসী যেন সেদিন গলা তুলতে গিয়েও, তেমন উচ্চগ্রামে উঠতে পারেনি। তবুতীক্ষ্ণ স্বরেই বলেছিল, তা ছাড়া আবার কী বলব, যারা মেয়েদের সঙ্গে রাস্তায় যেচে আলাপ করে, নোংরা কথা বলে–

মন্টু বলে উঠেছিল, আমি একদিনও বলিনি।

তাতে আমার কী? আমি ও সব শুনতে চাই না।

সরসীর স্বর উঠতে আরম্ভ করেছিল। মন্টু তাড়াতাড়ি বলে উঠেছিল, আচ্ছা, ঠিক আছে, ঠিক আছে, আমি আর কিছু বলছি না।

সরসীকে গলা তুলতে শুনেই মন্টু বিব্রত হয়ে আশপাশে তাকাতে আরম্ভ করেছিল। সরসী মনে মনে একটু কৌতূহল বোধ না করে পারেনি। যদিও তা প্রকাশ করার ইচ্ছে তার ছিল না। তবু সে রুষ্ট ও বিরক্ত স্বরে বলেছিল, তা ছাড়া আপনি কিছু বলবেনই বা কেন? আপনাকে আমি চিনি না জানি না, জানতেও চাই না। আপনি কেন কথা বলবেন আমার সঙ্গে?

মন্টু বলেছিল, তা ঠিক।

সরসী দৃঢ় গলায় বলেছিল, এবার থেকে কথাটা মনে রাখবেন।

বলতে বলতে সরসী লক্ষ করেছিল, মন্টু ঠাট্টা-বিদ্রূপ করার চেষ্টা করছে কিনা। মুখের চেহারা দেখে সে রকম কিছু মনে হয়নি। বরং ও যেন চিন্তিত হয়ে পড়েছিল, এবং হঠাৎ বলে উঠেছিল, লোকে তো কুলি কাবারির সঙ্গেও কথা বলে।

ভাগ্য ভাল, সরসীর হাসি পেয়ে যায়নি। বলেছিল, আপনি কি কুলি কাবারি নাকি? তাদের সঙ্গে দরকার হয়, তাই কথা বলতে হয়। আপনারা কুলি কাবারির থেকেও খারাপ?

কুলি কাবারির থেকে খারাপ?

নিশ্চয়ই। যারা অচেনা মেয়েদের পেছনে পেছনে ঘোরে আর যেচে কথা বলে, তাদের কী বলে তা জানেন না? একটু ভদ্রলোক হতে পারেন না?

কথা শেষ করবার আগেই সরসী দেখেছিল বাস আসছে। সে তাড়াতাড়ি এগিয়ে যেতে গিয়ে শুনতে পেয়েছিল, মন্টু উচ্চারণ করছে, ও!

গাড়িতে উঠতে গিয়ে সরসী দেখেছিল, মন্টু আসেনি। তার খুব ইচ্ছে করছিল, গাড়ির জানালা দিয়ে মন্টুর মুখটা দেখে নেয়। কিন্তু ইচ্ছেটাকে সে দমন করেছিল, একটু তৃপ্তি বোধ করেছিল উপদেশ দিতে পেরে।

.

আবার দু-একদিন, মন্টুর দেখা পাওয়া যায়নি। সরসী আশা করেছিল, আর বোধহয় ও পথের মাঝে তার সঙ্গে কথা বলতে আসবে না। কিন্তু কয়েকদিন পরেই সন্ধ্যাবেলা গলির মোড় ছাড়িয়ে ফুটপাতের ওপর সরসী দাঁড়িয়েছিল, মন্টুর আবির্ভাব হয়েছিল সেখানেই। ইস্কুলের এক টিচারের ছেলের অন্নপ্রাশনের নিমন্ত্রণে যাবার জন্যে ট্যাক্সির অপেক্ষায় ছিল সে। মন্টু এসে হাজির। এবং ওর আসবার ভঙ্গিটাও ছিল অদ্ভুত। কাছাকাছি এসে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল, এবং অন্যদিকে ফিরে একটু সরে গিয়ে আবার তাকিয়েছিল। রাস্তায় তখন সন্ধ্যাবেলার ভিড়। সবে মাত্র রাস্তার আলো জ্বলে উঠেছিল। সরসী সোজাসুজি না তাকিয়েও টের পাচ্ছিল, মন্টু তাকেই দেখছে।

সন্ধ্যাবেলায় ট্যাক্সি পাওয়া যে কী দুষ্কর, সবাই জানে। মন্টু আসার আগে থেকেই সে অপেক্ষা করছিল। অনেক ট্যাক্সি চোখের সামনে দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে, কিন্তু কোনওটাই খালি ছিল না। ভুল করে, কয়েকবার সে যাত্রী-ভরতি ট্যাক্সিকেই হাত তুলে ডেকেছিল। মন্টু আসবার পরেও সে ভুল একবার করেছিল। দেরি হয়ে যাওয়ার জন্যে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিল সে। আবার তাকে তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে।

ইতিমধ্যে, রাস্তার উলটোদিক দিয়ে একটা খালি ট্যাক্সি চলে যেতে দেখে, সরসী হাত তুলে ডেকেছিল, ট্যাক্সি।

ওর মেয়ে-গলা বোধহয় ড্রাইভারের কানে পৌঁছয়নি। সেই মুহূর্তেই মন্টুর গলার হাঁক শোনা গিয়েছিল, ট্যাক্সি।

তারপরেই ও দৌড়ে গিয়েছিল, এবং অনেকটা দূরেই, ট্যাক্সি ধরে, ড্রাইভারের পাশে বসে, ঘুরিয়ে নিয়ে এসেছিল সরসীর কাছে। সরসী কিছু ভাববার অবকাশই পায়নি। মন্টু নেমে, পিছনের দরজা খুলে ধরে বলেছিল, ট্যাক্সি ডাকছিলেন তো, উঠে পড়ুন।

উপকার নিঃসন্দেহে, তবু ধন্যবাদ দেবার জন্যে সরসী মুখ খুলতে পারেনি। উঠে বসবে কিনা, সে বিষয়ে দ্বিধা করেছিল। না উঠে উপায় ছিল না। উঠে বসতে না বসতেই, মন্টু আবার বলেছিল, কোথায় চললেন?

তা শুনে আপনার কী হবে?

বলে, সরসী নিজেই দরজাটা টেনে বন্ধ করে ড্রাইভারকে বলেছিল চলুন। গাড়িটা ছেড়ে যেতে, উইন্ডস্ক্রিনের কাচের ভিতর দিয়ে চকিতে একবার দেখেছিল সরসী। মন্টু খানিকটা যেন ভ্যাবাচাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ড্রাইভারকে আড়াল করে মুখে আঁচল চেপে একটু না হেসে পারেনি সে। তবু, নিজের ব্যবহারের জন্যে কোথায় যেন তার একটু খচখচ করছিল। সেই খচখচানির সঙ্গে আবার মন্টুর প্রতি বিরক্তও হয়েছিল। কেন-ই বা ও ডেকে দিলে ট্যাক্সি? কে ওকে অনুরোধ করেছিল? সব মিলিয়ে একটা অস্বস্তি। এবং সেই ট্যাক্সি ডেকে দেবার ব্যাপারটা মাবউদির সঙ্গে সরসী আর গল্প করেনি। কোথায় যেন একটু সংকোচ বোধ করেছিল সে।

আর একদিন, ইস্কুলের টিচার বন্ধুদের সঙ্গে ছুটির দিনে সিনেমা দেখে, দল বেঁধে রাস্তায় চলতে চলতে, হঠাৎ সরসী আবিষ্কার করেছিল, মন্টু উলটোদিকের ফুটপাত দিয়ে হাঁটছে। লক্ষ ওর সরসীর দিকে। মন্টুকে দেখেই সরসী অস্বস্তিবোধ করতে আরম্ভ করেছিল। বিশ্বাস কী, টিচারদের সামনেই ও যদি এসে কথা বলতে আরম্ভ করত। সে তৎক্ষণাৎ বান্ধবীদের কাছে প্রস্তাব করেছিল, রেস্টুরেন্টে ঢুকে একটু চা খাওয়া যাক। সবাই রাজি হতেই, কাছেই একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়েছিল সবাই। কিন্তু মন্টুকে সত্যি দেখা যায়নি। বাড়ি ফেরবার পথে দেখেছিল, গলির মোড়ের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। মন্টু তার দিকেই তাকিয়ে ছিল। মন্টুর গলা শুনতে পেয়েছিল, কেমন দেখলেন?– সরসী অস্বস্তি ও বিরক্তি বোধ করেছিল। যেন শুনতেই পায়নি এমনি ভাবে চলে গিয়েছিল। গলিতে ঢুকে দেখেছিল, রকের আড্ডা চলেছে ঠিকই, মন্টু অনুপস্থিত। সে সময়ে প্রায়ই লক্ষ করেছে সরসী, রকের আড্ডায় মন্টুকে তেমন দেখা যায় না। আরও একটা ক্ষুব্ধ সন্দেহে ভ্রুকুটি করেছিল সরসী, মন্টু তাকে যখন তখন অনুসরণ করে কিনা। কেন না, প্রায়ই এদিকে ওদিকে ওকে হঠাৎ হঠাৎ দেখা যাচ্ছিল। সন্দেহ হতেই মনে মনে স্থির করেছিল, সুযোগ পেলে, আবার ওকে একদিন ধমক দিতে হবে।

পরের দিনই সেই সুযোগ এসেছিল। ভোরবেলা যথানিয়মে মন্টুর পায়ের শব্দ বেজে উঠেছিল পিছনে। সে সময়টা শীতকাল, ভোরবেলাটা আরও বেশি নিঝুম মনে হত। বাড়িতে রীতিমতো আলো জ্বালিয়ে, সরসীকে জামা-কাপড় পরে বেরুতে হত। বারো মাসই মর্নিং ইস্কুল, বিরক্তি ধরে যেত মাঝে মাঝে। অথচ উপায়ও ছিল না। দুপুরে ছেলেদের ইস্কুল হত।

মন্টুর গলা প্রথম শোনা গিয়েছিল, কেমন দেখলেন জিজ্ঞেস করলাম কাল, একটা জবাবও দিলেন না।

সরসীর গলা প্রথম থেকেই বেশ শক্ত হয়ে উঠেছিল, বলেছিল, কেন দেব, বলতে পারেন? আপনি জিজ্ঞেস করেনই বা কেন? আপনাকে বারণ করে দিয়েছি না?

মন্টু বলেছিল, দিয়েছেন, কিন্তু

সরসী মুখ ফিরিয়ে, তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়েছিল। বলেছিল, কিন্তু কী? আপনি তবু কথা বলবেন?

না তা নয়, মানে, আচ্ছা–আপনি এত চটে যান কেন? আমি তো আপনাকে খারাপ কিছু বলিনি।

নাই বা বললেন, আমার ইচ্ছে নয়, আপনি কথা বলেন।

মন্টু একটু চুপ করে ছিল, অথচ চলতে চলতেই কথা হচ্ছিল, এবং সরসীর পদক্ষেপও মন্থর হয়ে এসেছিল, এটা বোধহয় সে নিজেই লক্ষ করেনি।

মন্টু হঠাৎ বলে উঠেছিল, কিন্তু, আমার খুব ইচ্ছে করে।

সরসী অবাক হয়ে বলেছিল, ইচ্ছে করে? কী ইচ্ছে করে আপনার?

কথা বলতে।

সরসী যেন অসহায় বিস্ময়েই ভ্রুকুটি করে তাকিয়েছিল, সহসা কোনও কথা বলতে পারেনি।

মন্টু আবার বলে উঠেছিল, মানে, ভাল লাগে।

হঠাৎ ধমকে উঠতে গিয়েও, সরসী কথা বলতে পারেনি। ভিতরে ভিতরে তার ঈষৎ হাসির ছোঁয়াও লাগছিল। পাগল নাকি? অনেক রকম ছেলে তো সে দেখেছিল, অমন সোজা সরল, প্রায় গবেট তো দেখেনি। নাকি নিতান্ত নির্লজ্জ বেহেড শয়তান? কিন্তু নির্লজ্জ বেহেডও তো কম দেখেনি সরসী। ওই পাড়াতেই তো ছিল, জনি বা ম্যাক-এর দল।

সরসী একটু চুপ করে ছিল, এবং সেই প্রসঙ্গ একেবারে ত্যাগ করে সে তীক্ষ্ণ গলায় জিজ্ঞেস করেছিল, তা ছাড়া, আপনি আমাকে যখন-তখন ফলো করেন কেন?

মন্টু অবাক হয়ে বলেছিল, ফলো করি?

নিশ্চয়ই। আমি কয়েক দিনই লক্ষ করেছি।

মন্টু অত্যন্ত ব্যাকুলভাবেই প্রতিবাদ করে উঠেছিল, মাইরি বলছি, আমি কোনওদিন আপনাকে ফলো করিনি।

সরসী বলেছিল, ও সব মাইরি-টাইরি রাখুন। আমি কি তা হলে ভুল দেখেছি?

না না, ভুল দেখবেন কেন। সে তো আপনাকে আমি আচমকা দেখে ফেলেছি কোথাও। পেছু নেব বলে তো কোনওদিনই বেরুইনি।

ও! দেখে ফেললেই পেছু নিতে চেষ্টা করেন?

না না, তা নয়, মাইরি

আবার মাইরি বলছেন?

সত্যি ধমকে উঠেছিল সরসী। মন্টু তাড়াতাড়ি বলে উঠেছিল ওঃ থুড়ি আর বলব না, কিন্তু বিশ্বাস করুন, আপন গড়। তবে হ্যাঁ, আপনাকে কোথাও দেখলে মানে আপনার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করে।

কিন্তু আমি তা পছন্দ করি না।

আপনি পছন্দ করেন না, কিন্তু বীরেশ্বরদা তো আমার সঙ্গে কথা বলেন।

বীরেশ্বরদা নামটা শুনে সরসী অবাক হয়ে গিয়েছিল। বীরেশ্বরদা মানে সরসীর বড়দার কথা বলেছিল মন্টু। তাই সে ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে বলেছিল, আমার বড়দা?

হ্যাঁ। জানেন, আমি বলেছিলাম বলে, উনি এবার পুজোয় কুড়ি টাকা চাঁদা দিয়েছিলেন। জনিদের তো পাঁচ টাকা দিতে চেয়েছিলেন।

সরসী কথাটা বিশ্বাস করবে কিনা ভাবছিল। তবুমন্টুর মুখ দেখে, এবং অনায়াসে সহজে বলার ভঙ্গি দেখে বিশ্বাস না করে উপায় ছিল না। কিন্তু সে তৎক্ষণাৎ বলেছিল, সে হয়তো বড়দা আপনাদের ভয় পেয়ে দিয়েছিলেন।

ভয় পেয়ে? আপনি জিজ্ঞেস করে দেখবেন তো বীরেশ্বরদাকে।

থাক, আমার জিজ্ঞেস করবার দরকার হবে না। মোটের ওপর আমি পছন্দ করি না, আপনি রাস্তা-ঘাটে আমার সঙ্গে কথা বলেন।

তা হলে আপনাদের বাড়িতে যাব?

সরসী অবাক হয়ে তাকিয়েছিল। দুঃসাহস তো কম নয়! তীক্ষ্ণ চোখে লক্ষ করেছিল, মন্টু ঠাট্টা করছে কিনা। কিন্তু ঠাট্টা সে করছিল না, এবং হঠাৎ একদিন বাড়িতে গিয়ে উদয় হওয়া বোধহয় ওর পক্ষে অসম্ভব ছিল না। সরসী সহসা প্রসঙ্গ বদলে বলেছিল, এ সব মাথায় ঘুরছে কেন? রকের আড্ডা আর ভাল লাগছে না?

নাঃ! আপনি তো রাগ করেন।

আমি রাগ করি, তাতে আপনার কী? যে কোনও ভদ্রলোকেই রকবাজদের ওপর অসন্তুষ্ট, সবাই রাগ করে, আমি বলে কী কথা আছে।

সেই জন্যেই ভাবছি, আর ও সব আড্ডা- টাঙ্ দেব না।

তবে কী করবেন কী?

বিদ্রূপ করেই সরসী বলেছিল। মন্টু যেন খুবই অসহায় হয়ে পড়েছিল। বলেছিল, সত্যি, কী যে করি, তাও জানি না। চাকরির পরে হয় সিনেমা,নয় আচ্ছা, তা ছাড়া আর করবারই বা কী আছে বলুন।

মন্টুর কথার মধ্যে এমন একটা অনুসন্ধিৎসু অসহায়তার সুর ছিল যে, সরসী হঠাৎ একটা কিছু বলে উঠতে পারেনি। যদিচ তার ভাববার কিছুই ছিল না, তবু কিছু না করতে পারাটা যেন মন্টুর গলায় একটা পীড়াদায়ক সুরে বেজে উঠেছিল। সে তখনও বলছিল, রোজ রোজ আর সিনেমা দেখা, রেস্তোরাঁয় খাওয়া, বেড়াতে যাওয়া চলে না, অত পয়সাই নেই। নবাবি তো মাইনে পাওয়ার পর দুদিন…।

কিন্তু সরসী কেন শুনছিল এত কথা? সে হঠাৎ বলে উঠেছিল, অত কথা শোনবার আমার দরকার নেই।

সরসী তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে বাস স্টপে চলে গিয়েছিল। মনের মধ্যে কোথায় তার একটা অস্বস্তি হচ্ছিল, যার কারণটা সে ঠিক অনুমান করতে পারছিল না। বাসে উঠে সে আর তাকিয়ে দেখেনি, মন্টু কোথায় উঠেছে। জানত, কোথাও উঠেছে এবং সেখান থেকে নিশ্চয়ই তার দিকে তাকিয়ে আছে। আর সেই তাকিয়ে থাকা মূর্তিটা তার চোখের সামনে ভাসছিল। এবং মনে মনে সে মন্টুর কথারই যেন জবাব দিচ্ছিল, মানুষের কাজের কোনও শেষ আছে? সময় কাটাবার ভাবনা? আচ্ছা ছাড়া কি মানুষের সময় অতিবাহিত করার আর কোনও উপায় নেই? ও কতদূর লেখাপড়া করেছে সরসী জানে না। কিন্তু যতটাই করুক, ওদের বাড়িতে তো এক গাদা ছোট ছোট বাচ্চা আছে, তাদের পড়াতে পারে। নিজেও নিশ্চয়ই পড়াশুনা করতে পারে। পার্ট টাইম কাজও করতে পারে, পয়সার অভাব যখন রয়েছে। কিছু করবার নেই, ও সব বাজে কথা।

পরমুহূর্তেই ও বিরক্ত হয়ে উঠেছিল নিজের ওপর। কেন, এ সব ভাবছে কেন সে! মন্টুর কৈফিয়ত নিয়ে সে কেন চিন্তা করছে? ছি! একটা বাজে ছেলে কী কতকগুলো বাজে কথা বলে গেল, আর তাই নিয়ে ভাবছে সে! বাজে কথা ছাড়া কী? লোকে যদি কিছু করতে চায়, তার যদি ইচ্ছে থাকে, তা হলে সে একটা রকবাজ অভদ্র না হয়ে নিশ্চয়ই পারে। ও সব হচ্ছে শয়তানের যুক্তি। অসহায় ভালমানুষ ভাবটা আসলে ছলনা। নইলে, অপরিচিত মেয়েদের শুনিয়ে কেউ গান গায়, যেচে কথা বলে? না, ও সব ভাববে না সরসী, মনে মনে স্থির করেছিল, এবং কোনওদিকে না তাকিয়ে স্টপে নেমে পড়েছিল।

কয়েকদিন পরে সত্যি মন্টু তাদের বাড়ি এসে উপস্থিত হয়েছিল। কী বিস্ময় আর অস্বস্তি সরসীর। সন্ধের পরে তার বড়দার সঙ্গে মন্টু এসেছিল, এবং বসবার ঘরে বসিয়ে, ভিতরে এসে বলেছিলেন, সররা, একটু কাগজ কলম নিয়ে বাইরের ঘরে আয় তো।

সরসী বলেছিল, কী হবে?

দাদা বলেছিলেন, একটা দরখাস্ত লিখতে হবে। ওই মন্টু এসেছে, ও-ই লিখবে, তুই একটু ডিকটেশান দে। আমাদের অফিসে একটা টেম্পোরারি ক্লার্কের পোস্ট খালি হয়েছে, পাড়ার একটা ছেলের জন্য ওরা ধরেছে। দরখাস্তটা কালই আমাকে হাতে করে নিয়ে যেতে হবে।

সরসী কাগজ কলম সংগ্রহ করতে করতেই বলেছিল, ওরা লিখে দিতে পারল না?

দাদার বিদ্রূপ শোনা গিয়েছিল, সেই তো বলছি, একটা দরখাস্ত লিখতে পারে না শুদ্ধ করে, এরা চাকরি করবে। যাকগে, তুই একটু দ্যাখ।

সরসী বাইরের ঘরে এসেছিল। মন্টু হেসে বলেছিল, ভাল আছেন?

সরসী কোনও জবাব না দিয়ে, কাগজ কলম এগিয়ে দিয়ে বলেছিল, কার চাকরি?

আমার এক ভাইয়ের।

আপনার ভাই কোথায়?

তার কথা আর বলবেন না, কোথায় গেছে কে জানে।

আপনি দাদার কর্তব্য করছেন?

বীরেশ্বর এসেছিলেন ঘরে। কোম্পানির ম্যানেজারের নামে দরখাস্ত লিখতে বলেছিলেন, তারপর মন্টুকে বলেছিলেন, দেখো, আমি দরখাস্ত নিয়ে যাব, তারপরে তোমার ভাই বলবে চাকরি করব না, তা যেন না হয়।

মন্টু বলেছিল, না না, পেলে বর্তে যাবে।

বীরেশ্বর : তোমাদের তো বিশ্বাস নেই।

সরসী বলে উঠেছিল, তুমি এ সব ঝুঁকির মধ্যে যাচ্ছ কেন দাদা?

বীরেশ্বর : বলছে অনেকদিন থেকে, সুযোগও এসে গেল, তাই। দেখা যাক কী হয়। নে, তুই একটু বল, ও লিখে নিক, আমি জামাকাপড় ছাড়ি গিয়ে। হলে, ফেয়ার করবার আগে আমাকে একবার দেখিও।

তিনি চলে গিয়েছিলেন, সরসী প্রথমেই জিজ্ঞেস করেছিল, আপনার ভাইয়ের কোয়ালিফিকেশন কী বলুন।

মন্টু বলেছিল, সে ব্যাপারে আমরা সব এক, ম্যাট্রিক, থার্ড ডিভিশন।

সরসী বলেছিল, বাঃ চমৎকার, কমপার্টমেন্টালও নিশ্চয় আছে?

তা আছে তবে আমার নয়। আমি একেবারে–!

তবু একটা দরখাস্ত লিখতে পারেন না?

মন্টু মাথা চুলকে বলেছিল, কিছুতেই কায়দা করতে পারি না, মা

মাইরি বলতে গিয়ে জিভ কেটেছিল মন্টু, আর সরসী বলেছিল, লিখুন, টু দি ম্যানেজার…।

এই ঘটনার পর থেকে প্রায়ই দেখা যেত মন্টু তাদের বাড়িতে আসছে। যেভাবেই হোক, দাদা ওর প্রতি প্রসন্ন ছিল। কেবল সরসীই জানত না, সেই প্রসন্নতার ছোঁয়া কবে তার মনেও লেগে গিয়েছিল। শুধু কথা বলাই সহজ হয়ে আসেনি, মন্টু কিছুটা প্রয়োজনীয়ও হয়ে উঠেছিল।

সরসীর মনে আছে, সে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায়, প্রথম প্রয়োজন হয়েছিল, ইস্কুলে হেডমিস্ট্রেসের কাছে চিঠি পাঠানোর জন্যে। মন্টুকেই পাঠিয়েছিল সরসী, কাজে যাবার পথে চিঠিটা দিয়ে যেতে ওর-ই সুবিধা ছিল সব থেকে বেশি। তারপরেও দেখা গিয়েছিল, কোনও দূরস্থানে যাবার প্রয়োজনে, স্বয়ং দাদা মন্টুকে তার সঙ্গে নিতে বলতেন। বলতেন, মন্টুটাকে নিয়ে যাস।

সরসীরই বরং আপত্তি হয়েছিল, কিন্তু দাদা বলতেন, আরে দরোয়ানের কাজ তো, অত ভাববার কী আছে।

দরোয়ান! সরসী বোধহয় অতটা নিচু ভাবতে পারেনি। ওটা নিতান্ত দাদারই চিন্তা ছিল। দাদা অনেকটা ওই চোখেই দেখতেন।… যে দাদা এখন সুবীরের সঙ্গে কথা বলতে গেলে, গলায় রীতিমত শ্রদ্ধা ফুটে ওঠে।

তারপরে, মন্টুরই অনুরোধে, সরসী ওর সঙ্গে এদিকে-ওদিকে সন্ধ্যাবেলার দিকে বেড়াতে যেত। সে সময়েই মন্টুর পড়াশুনো করার কথাটা বিশেষভাবে উঠেছিল। এখনও মনে আছে, দক্ষিণেশ্বর বেড়াতে গিয়ে মন্টু অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাটিয়ে বলে ফেলেছিল, আচ্ছা, শিক্ষিতা মেয়েরা কখনও অশিক্ষিতকে ভালবাসতে পারে না, না?

তার আগে, বিচিত্র চিন্তায় সরসীর অনেক বিনিদ্র রজনী কেটেছিল। আর যাই হোক, সে মেয়ে, মন্টুর প্রাণের সংবাদ তার অজানা ছিল না। শুধু কি মন্টুরই? তার নিজের প্রাণের খবর কি একেবারেই অজানা ছিল তার? তার নিজের যে প্রাণ পৃথিবীর সকল বিস্ময়ের চেয়ে প্রম বিস্ময় হয়ে উঠেছিল। তার নিজের কাছেই যে নিজের কোনও কৈফিয়ত ছিল না। লোকসমাজ তো দূরের কথা, পরিবারের কথা তো আরও দূরের। কেন, কেন? অনেকবার নিজেকে জিজ্ঞেস করেছিল সরসী, তার পরিমার্জিত শিক্ষিত রুচিশীল মনের এ কেমন অন্ধকারে ঘুরে মরা? কেবলই কি মন্টুর সহজ অকপট আবেদন? না কি নির্লজ্জ পুরুষের ভিক্ষাবৃত্তির কাছে, বিকৃত মন নারীর আত্মসমর্পণ মাত্র? সত্যি কি বিকারগ্রস্ত হয়েছিল সরসীর মন? কিন্তু কিছুতেই যে নিজের কাছ থেকে তার কোনও সমর্থন খুঁজে পায়নি সে। নিতান্ত শরীর দিয়ে মন্টুকে কখনও চিন্তা করতে পারেনি সে। বিনিদ্র রাত্রিগুলোতে, এই সব চিন্তাতেই নিজেকে সে তন্ন তন্ন করে খুঁজেছে। ভেবেছে, রকবাজ মন্টুর মধ্যে নিতান্ত জীবনধারণের চেহারায় কিছু পরিবর্তন লক্ষ করেই কি তার প্রাণের বরফ গলে গিয়ে, ঢল খেয়ে নেমে গিয়েছে।

আপনাকে ব্যাখ্যা করা সরসীর কাছেও কঠিন হয়ে উঠেছিল। আবিষ্কার করা এক, ব্যাখ্যা করা আর-এক। সে দেখেছিল, তার পারিবারিক, সামাজিক, পেশা, কোনও পরিবেশেই মানায় না এমন একটি যুবক তার সামনে ব্যাকুল হয়ে দাঁড়িয়ে, যার দাঁড়ানোটার মধ্যে ছিল নতুন করে বাঁচবার একটা আকাঙ্ক্ষা। যে ছিল জীবনধারণের ছকে আবদ্ধ ক্লান্ত অসহায়, অথচ ভিতরে তার শক্তি, যার ছায়া পড়েছিল চোখে। নিতান্ত একটা মিথ্যে ছিল না সে, সহজ সরলতার মধ্যে একটা সত্য ছিল। সে সত্যটাকে উত্থানের স্বপ্ন বলা যাকে কিনা, জানত না, নিজের পুরনো দেওয়ালটাকে ভাঙবার জন্যে ছটফট করছিল। সহজ স্রোতে নয়, সুবীর যে উজানগামী, এ বিষয়ে সন্দেহ ছিল না সরসীর। সেই উজানগামীকেই সে চোখ বুজলে দেখতে পেত।

সুবীরের সেদিনের কথার জবাব দিয়েছিল সে, ভাল নিশ্চয়ই বাসতে পারে, লোকেরা অবাক হয়, তারা মেনে নিতে চায় না।

সুবীর কয়েক মুহূর্ত চুপ করে গঙ্গার দিকে তাকিয়ে ছিল। তারপরে বলেছিল, তা ঠিক। লোকেরা এইরকমই। কেন?

তারা সবকিছু মানানসই চায়।

কিন্তু দেখুন, টাকা থাকলে এ সব কথা লোকেরা ভাবে না।

ভাবে, কিন্তু টাকার কাছে মানুষ বড় দীন, ভীরু, অসহায়, সেটা খুব খারাপ জিনিস।

মন্টু তার পাশেই বসে ছিল, এবং অনেকক্ষণ চুপ করে ছিল। কিন্তু সরসীই নির্বিকার থাকতে পারেনি। সে সহসা সুবীরের হাতের ওপর হাত রেখেছিল। বলেছিল, এ সব কথা ভাবতে হচ্ছে কেন?

সুবীর সহজ ভাবেই বলেছিল, এ সব কথাই সবসময় ভাবি।

সরসী টের পেয়েছিল, সুবীরের হাতটা অস্থির হয়ে উঠতে চাইছে।

কেন?

বুঝিয়ে বলতে পারি না।

সরসী বুঝেছিল, বুঝিয়ে বলার থেকেও ভরসা কম ছিল সুবীরের। সংশয় ও দ্বিধা ছিল ওর মনে। সরসী বলেছিল এইটুকুই যদি একমাত্র বাধা হয়, তবে অশিক্ষিত যদি কেউ নিজেকে মনে করে, সে নিজেকে শিক্ষিত করে তুলুক। লোকসমাজের তা হলে আর কিছুই বলবার থাকবে না।

সুবীর ব্যগ্র হয়ে বলেছিল, কিন্তু সময় লাগবে যে। আর একজন কি ততদিন অপেক্ষা করবে?

মনের দায় থাকলে, নিশ্চয়ই করবে।

সুবীর ব্যাকুল অনুসন্ধিৎসু চোখে সরসীর দিকে তাকিয়েছিল। সেই বুঝি প্রথম, সরসী সুবীরের চোখের প্রতি চোখ রাখতে পারেনি, যাকে সে বরাবর অনড় অকম্পিত পক্ষ্মছায়ে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে বিদ্ধ করে এসেছে। সেই বোধহয় প্রথম, দক্ষিণেশ্বরের ঘনায়মান সন্ধ্যার কৃষ্ণরক্তিম আকাশ ও গঙ্গার মতো তার চোখের রং বদলে গিয়েছিল, এবং কুয়াশা বাষ্পে ঝাপসা হয়ে এসেছিল।

সুবীর তার হাতের ওপর হাত রেখেছিল, আর বলেছিল, আমি জানি না, আমি কী বলব।

সরসী তবু হেসেছিল, বলেছিল, মাইরি বলতে পারলেই বোধহয়…।

কখখনও না। সুবীর প্রায় ভাঙা গলায় বলে উঠেছিল, তোমার পায়ে হাত দিয়ে বলছি।

সরসী বলেছিল, ছি, মাথা খারাপ।

ওই যে, দক্ষিণেশ্বরে, সরসীর পায়ে মাথা লুটোতে চাওয়া সেই মানুষটি, ডক্টর সুবীররঞ্জন মিত্র। তাঁর কি সেই দিনগুলোর কথা মনে আছে? সরসীর জীবনে সেই এক ভুবন। অবিনাশী আত্মা যেমন ত্রিভুবন বিচরণ করে, তেমনি সরসীর জীবনে, সুবীরের সঙ্গে পরিচয় ও নীড় বাঁধা, এক ভুবন বিচরণ। আর এক ভুবন বিচরণ করেছে সে সুবীরের নতুন জন্মের কাল ধরে, যে কাল অতিক্রান্ত হয়ে গিয়েছে, তৃতীয় ভুবনের বিচরণ চলেছে আজ। শেষ বিচরণ, মুক্তির আলো যেখানে নেই, সম্ভবত ভাগ্যই ত্রিশঙ্কুর অন্ধকারে টেনে নিয়ে চলেছে।

তারপরেই ক্রমে বাড়িতে প্রশ্ন উঠেছিল। সুবীর তার কলেজের পাঠ নিতে শুরু করেছিল সরসীর কাছে। সকলের কাছেই সেটা আপত্তিকর বোধ হয়েছিল। মা দাদা বউদি, সকলের বিরক্তি ক্রোধ উপহাস ফেটে পড়ছিল। পাড়ায়ও ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের অন্ত ছিল না। তার একমাত্র জবাব ওরা দিয়েছিল, বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে। শুধু সিদ্ধান্ত নয়, আগ্নেয়গিরির ওপরে দাঁড়িয়ে, সিদ্ধান্তকে কাজে পরিণত করেছিল।

সরসীর চোখে জল বাধা মানল না। সে ঝাপসা চোখে দূরে সুবীরের দিকে তাকাল। (ডক্টর মিত্র, আপনার মনে আছে সে সব কথা? সেই দিনগুলোর কথা?) তার মনে পড়ল, সাতদিন আগে স্বয়ং ধীরানন্দ ব্যানার্জি এই বাড়িতে এসেছিলেন সুবীরের সঙ্গে দেখা করতে। সেই শক্তিশালী ব্যক্তি, যিনি শাসনের অভ্যন্তরে, পুতুলখেলা খেলেন। যিনি কোটিপতি বললে কম বলা হয়, তাঁর সীমাহীন ক্ষমতার ব্যাপারে লোকে যেন এক অলৌকিকতায় বিস্মিত। কেন? বিদ্যা প্রতিভা কি বাংলা দেশে আর কোথাও আবিষ্কার করতে পারেননি তিনি? মেয়ে হেনা ব্যানার্জির পিছনে পিছনে, তিনি সুবীর মিত্রকে আবিষ্কার করতে এগিয়ে এসেছেন কেন? তাঁকে তো কেউ প্রতিভার আবিষ্কারক বলে না। তাঁকে কেউ গরিবের বন্ধু, শিক্ষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল, প্রতিভার প্রতি সুবিচারক ভাবে না? তবে?

সেই সংশয়ের যন্ত্রণাটাই বেড়ে ওঠে সরসীর। তার মনে হয়, সকল কিছুকে আড়ালে রেখে ধীরানন্দ ব্যানার্জির কঠিন সবল বিশাল থাবা যেন সুবীরকে ছিনিয়ে নিতে এসেছে। কিন্তু ধীরানন্দ ব্যানার্জিও কি সেই অতীত দিনের সংবাদ জানেন?

একেবারেই জানেন না বললে সত্যের অপলাপ হয়। জানেন বলেই, তিনি এসে সরসীকে বলতে পেরেছিলেন, আমি শুনেছি, সুবীরের উত্থানের পেছনে আপনার শক্ত হাত কাজ করেছে। সে জন্যে ও চিরদিন আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে।

শুধু শক্ত হাতই কাজ করেছে? কেবল কৃতজ্ঞতা মাত্র? আর কিছু নয়? সুবীর তখন সামনেই ছিল, কোনও প্রতিবাদ করেনি, একটু হেসেছিল। সরসীও হেসেছিল, নিষ্প্রাণ কুণ্ঠিত হাসি। ধীরানন্দ আরও বলেছিলেন, এবার আপনার ফসল দেশ ভাগ করে নেবে। নাউ, হি ইজ প্রপার্টি অব দি পাবলিক। আশা করি, এ বিষয়ে আপনার দ্বিমত নেই।

কথাগুলো ভাল লাগেনি সরসীর। কথাগুলোর উদ্দেশ্য কী, সে ঠিক বুঝতে পারেনি। কেবল একটা অস্বস্তিকর সংশয়ের সৃষ্টি করেছে। ওঁর কথার থেকে মনে হয়েছে, সুবীরকে যেন সে আটকে রাখতে চায়, ওর উন্নতিতে বাধা দিতে চায়, তাই আগের থেকেই তিনি জমি তৈরি করে রাখতে চান। কেন, ওঁকে কি সুবীর কিছু বলেছে? বিশ্বাস করতে মন চায় না। সম্ভবত হেনা বলেছে, সম্ভবত হেনাই তার বাবার মনে এরকম ধারণার সৃষ্টি করেছে, সুবীরের ইচ্ছানুযায়ী কাজে সরসী বাধা দেবে।

এই সব ব্যাপারের সঙ্গে, সুবীরের কিছু কথা, সংশয়কে কোনও কোনও ক্ষেত্রে যেন দৃঢ় করে তোলে। যেমন এই কয়েকদিন আগেই ছুটির দিনে সকালবেলাই হেনা এসেছিল। সুবীর সরসী হেনা তিনজনেই নানান গল্পগুজব করছিল। তার মধ্যেই প্রসঙ্গক্রমে, নরনারীর সম্পর্কের কথা উঠে পড়েছিল। সেদিন সুবীর যে সব কথা বলেছিল, তা কোনওরকমেই সরসী ভুলতে পারছে না।

সুবীর বলেছিল, মেয়ে বা পুরুষ, সকল মানুষেরই কতগুলো অতি গভীর অসহায়তা আছে, এটা ঠিকই, মেটিরিয়াল জগতের থেকেও মানুষ নিজেকে আবিষ্কার করতে পেরেছে কম। কিন্তু আইডেন্টিফিকেশন যে একেবারেই করতে পারেনি, সে কথাটা এ যুগে আর বলা যাবে না। এ যুগের মানুষ এখন অন্তত বলতে পারে, সে নিজেকে কিছুটা আবিষ্কার করতে পেরেছে, আর বোধহয় সেজন্যেই, এ যুগের মানুষের যন্ত্রণাটাও বেড়েছে, সে ক্রমাগত অত্যধিক বিচ্ছিন্ন নিঃসঙ্গ ভেবে বিষণ্ণ হয়ে পড়ছে। যদিও এই আবিষ্কারটা এ যুগেই হঠাৎ ঘটেছে তা নয়, আগেও ঘটেছে, আর যে দু-চারজনের মধ্যে ঘটেছে, তারা এত বেশি বিস্মিত ও বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন, এত বেশি অসহায় ভেবেছিলেন নিজেদের যে তৎক্ষণাৎ ঈশ্বরের কাছেই নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন। যেহেতু মানবসমাজের প্রতি তারা একটা দায়িত্ব বোধ করেছিল, সেই হেতু, আত্মদর্শনের স্বরূপটাকে অন্যভাবে প্রকাশ করেছেন, যাতে সাধারণ মানুষ, যারা কখনওই আত্মদর্শনের ভয়ংকরতা সহ্য করতে পারবে না, তারা কতগুলো বিশ্বাস নিয়ে, এই সংসারে চলতে পারে। সেগুলোকেই আমরা মুনি-ঋষিদের সারমনস্ বলতে পারি। কিন্তু এ যুগের মানুষের অসুবিধে হচ্ছে, সে ঈশ্বরের দ্বারস্থ হওয়াটাকে সমাধান বলে মনে করতে পারছে না, সমাধান সে নিজের মধ্যেই খুঁজছে।

হেনা বলেছিল, কথাটা একটু বুঝিয়ে বলুন।

হেনার কথাটা সরসীরও ছিল। হেনা যেন অনেকটা মুগ্ধা ছাত্রীর মতো শুনছিল। সরসীর কাছে কথাগুলো কেমন যেন অর্থহীন জটিল বোধ হচ্ছিল।

সুবীর বলেছিল, যেমন ধরা যাক, আবিষ্কারের একটা প্রথম সোপান, পুরুষ আকাঙ্ক্ষা করতে চায়, নারী আকাঙ্ক্ষিতা হতে চায়। একজন করতে চায়, একজন হতে চায়, এটা তাদের প্রকৃতিগত।

সরসী তৎক্ষণাৎ বলে উঠেছিল, এটা বিশ্বাসযোগ্য কথা নয়, এ কথা আমি মানি না।

সুবীর বলেছিল, জানি, কথাটা অধিকাংশ লোকের মনে হবে, মানবসমাজকে একটা আক্রমণ করা হচ্ছে। তার এতদিনের সভ্যতার শিক্ষার সংস্কৃতির ভ্যানিটিতে লাগে। কিন্তু তাতেই কথাটা মিথ্যে হয়ে যায় না। সত্যকে সত্য বলে জানা, আর তারই ভিত্তিতে পথ তৈরি করে চলা খুব কঠিন। অথচ আমরা চলি, পথ তৈরি করেই চলি, কিন্তু না জেনে চলি বলেই, আমরা অধিকাংশের দল, সভ্যতার মিনারে বসেও, ঈর্ষা হিংসা লোভ হানাহানি করে মরি, কেবলি পা হড়কে যায়।

সরসী বলেছিল, এ সব চিন্তা মানুষকে ভয় দেখায়, হতাশ করে, নীচে নামায় বলে আমার বিশ্বাস। একজন আকাঙ্ক্ষা করতে চায়, আর একজন আকাঙিক্ষতা হতে চায়, এই প্রকৃতিটাকে মেনে নিলে, পৃথিবীতে সুন্দর কিছুই সৃষ্টি হত না।

কিন্তু কথাটা তা নয়। যাঁরা এ সত্যটাকে উপলব্ধি করেছেন, সমাজের সাহায্য নিয়ে পৃথিবীটাকে সুন্দর করেছেন তাঁরাই।

সরসী বারে বারে ঘাড় নেড়েছিল, সে মানতে পারেনি। কিন্তু তার মনের ভিতরে তখন একটা প্রবল সংশয়ের জ্বালা পুড়িয়ে মারছিল। তার মনে হচ্ছিল, ওই কথার দ্বারা সুবীর যেন সরসীর সঙ্গে ওর সম্পর্কের বনিয়াদটাকে যুক্তিসিদ্ধ করতে চাইছিল।

হেনা সুবীরের কথা শুনে চুপ করে ছিল। সরসীর কথায় সে কোনও মন্তব্য করেনি। সরসী চুপ করার পর, সে যেন খানিকটা শঙ্কিত বিষণ্ণতায় বলেছিল, যা বললেন, তা কিন্তু ভয়ের আর কষ্টের। অবিশ্যি এ কথা আমি আগেও পড়েছি।

সুবীর বলেছিল, পড়বেন তো নিশ্চয়ই, কারণ কথাগুলো আমার নয়।

হেনা : কিন্তু আপনি বলছেন যখন, তখন বিশ্বাস করেন নিশ্চয়ই?

সুবীর : নিশ্চয়ই, হানড্রেড পার্সেন্ট। আর এ কথাটা লোককে বলার থেকে মানুষ নিজের বললেই বেশি লাভবান হবে, কারণ, তার প্রকৃতির সমস্যাটা একান্তই তার নিজের। এটা যদি সত্য বলে অনুভব করতে পারে, তা হলে এই সত্যের ভিত্তিতে সে নিজের পথ ঠিক করতে পারে। তা নইলে কী হয়? অনাবিষ্কৃত অন্ধকারে সে পচে মরে, নিজের ভিতরের পচানির দুর্গন্ধে তার মুখটা বেঁকে থাকে, আর ঘা চেপে রেখে দেবার মতো, সর্বদাই মুখে পবিত্রতার বুলি বলে। আমাদের মধ্যে এ সংখ্যাটাই বেশি। যে জানে না, তারই বাঁচোয়া, কারণ পাপটাকে সে ধুয়ে ফেলার কায়দা শিখে গেছে, অনেকটা বাইরে কোঁচার পত্তনের মতে, ওটাই তার ধুয়ে ফিটফাট হবার এবং সমাজে চলবার একমাত্র কায়দা। কিন্তু যে এটাকে আবিষ্কার করে, বিস্ময়ে বিহ্বল হয়ে, অসহায় হয়ে নিজের দিকে তাকাচ্ছে, এমনকী চোখের জল ফেলছে, কাঁদছে, অথচ আপনার এই প্রকৃতির জন্যে, দায়ী করবার পাত্র কাউকে খুঁজে পাচ্ছে না, এমনকী ঈশ্বরকেও না, তার কথাটাই আমাদের ভেবে দেখতে হবে।

সরসীর ভ্রুকুটি চোখে তখন একটা কটু সন্দেহ যেন নিবিড় হয়ে এসেছিল। সে দেখেছিল, ওই কথা শোনার পরে হেনার যেন একটা বিষয় নিশ্বাস পড়েছিল। সরসী তীক্ষ্ণ গলায় জিজ্ঞেস করেছিল, তা হলে তুমি বলতে চাও, ভালবাসা বলে কিছুই নেই?

সুবীর বলেছিল, আছে। এইবারই তো ভালবাসার জন্ম। সে যখন জানতে পারল, এই হল প্রকৃতি, তখনই সে হাহাকার করে উঠল, তা হলে ভালবাসা কোথায়, ভালবাসা কোথায়, আমার মধ্যে ভালবাসা কোথায়? এই খোঁজাটাই ভালবাসা।

সরসী বলে উঠেছিল, গাঁজাখুরি বলে মনে হচ্ছে আমার।

বলেই সে সেখান থেকে উঠে সরে পড়েছিল। তার বিরক্তি রাগ কোনওটাই সে গোপন করতে পারেনি।

হেনা কিন্তু মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়েছিল সুবীরের দিকে। যদিচ, চোখের বিষণ্ণতাকে সে গোপন করতে পারছিল না। এবং সেই সঙ্গেই, স্বামী-স্ত্রীর মাঝখানে স্বস্তিও বোধ করছিল। সে সরসীকে বলেছিল, সরসীদি, কথাটা কিন্তু খারাপ কিছু বলেননি, আমি যা বুঝেছি

সরসী বলে উঠেছিল, আপনি যা বুঝেছেন, আমি হয়তো তা বুঝতে পারব না। ওঁর কথা মানতে গেলে, বলতে হয়, আত্মানুসন্ধানের নামই ভালবাসা, অর্থাৎ ভালবাসা বলে কিছু নেই। এই যে মানুষের বিবাহ প্রেম, চারিদিকে এত ঘটনা, এত কাব্য সাহিত্য ছবি, সবই তা হলে বাজে, মিথ্যে। এ সব কথার কারসাজি ছাড়া আমার কাছে আর কিছুই মনে হয় না।

সুবীর হেসে উঠে বলেছিল, শুধু শুধু তোমার কাছে কথার কারসাজি করতে যাব কেন?

সরসী ঠোঁট বাঁকিয়ে বলেছিল, তা তুমিই জান, কেন কথার কারসাজি।

সরসী মুখ তুলে তাকায়নি। হেনা তাকিয়েছিল সুবীরের দিকে। সুবীর আবার হেসেছিল অন্যদিকে তাকিয়ে। বলেছিল, তোমার কথার মূল্য তুমি ভেবে দেখলে না, আত্মানুসন্ধানের নামই ভালবাসা। কথাটা ঠিকই, অচেতনের ভালবাসার চেয়ে চেতনের ভালবাসাই ভাল। যে নিজেকে খোঁজে, সে-ই ভালবাসতে পারে, কারণ তখন তার একটা আইডেন্টিফিকেশন হয়। তাকে আর প্রকৃতির দরজায় দরজায় বারে বারে ভুল করে মাথা কুটে মরতে হয় না। যাই হোক, এত আলোচনার মধ্যে আমাদের গিয়েই বা কী হবে। আমরা যে তত্ত্বের আলোচনা করছিলাম, সেই তত্ত্বকে মানতে গেলে, এ কথাগুলো আসে। আজ পর্যন্ত পৃথিবী এটা প্রমাণ করতে পারেনি, পুরুষ আকাঙ্ক্ষা করতে চায়, নারী চায় আকাঙিক্ষত হতে, এ তত্ত্বটা ভুল। কিন্তু মানুষের তত্ত্বটাই বা কাজে লাগে কোথায়, যখন মানুষ মানুষের কাছেই বারে বারে ফিরে না আসে। মানুষ যা কিছুই আবিষ্কার করুক, মানুষের কাছ থেকে সরে গিয়ে নয়।

কিন্তু এ সব কথা আর তেমন মনে ছিল না সরসীর। তার শুধু করতে চাওয়া ও হতে চাওয়াতেই সমস্ত চিন্তা কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়েছিল, এবং এই সন্দেহ ও সংশয় থেকে সে রেহাই পায়নি যে, কথাগুলোর সঙ্গে কোথায় যেন হেনার সঙ্গে সম্পর্কের সূত্র ছিল। কথাগুলো যেন হেনাকেই শোনানো হয়েছিল। কেন না, ওই কথা মানতে গেলে, যে কোনও পুরুষের সঙ্গে যে কোনও নারীর সম্পর্ক একটা সহজ ঘটনা হয়ে ওঠে। সরসীর তাই বিশ্বাস। তাতে, তার মনের সকল ঐতিহ্যই কেবল আঘাত পায়নি, তার বুকের অন্ধকার জমে উঠেছে, যন্ত্রণায় ছিন্নভিন্ন হচ্ছে। সুবীর যাই বলুক, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই, আবহমানকাল ধরে মানুষ যাকে প্রেম ভালবাসা বলে এসেছে, জেনে এসেছে, ও তা স্বীকার করতে চাইছে না। তা যদি না চায়, তবে এই জীবনটা কী? সুবীর-সরসীই বা কী, তাদের সম্পর্কটাই বা কী? সেখানে কি প্রেম-ভালবাসা বলে কিছু নেই? এই হতে চাওয়া করতে চাওয়াই যদি ভালবাসা হয়, তা হলে মেনে নিতে হয়, প্রেমের একনিষ্ঠতা বলে কিছু নেই। আকাঙ্ক্ষার নিবৃত্তি কোথায়? আকাঙ্ক্ষার কি শেষ আছে? নেই বলেই মেনে নিতে হবে, মানুষ নিরন্তর পরিবর্তনের অভিলাষী। তা হলে সে মানুষ কেন? সুবীর বলে, এই চিন্তা থেকেই, একদা মানুষ তার সেই অসহায়তা থেকে মুক্তির উপায় খুঁজছে। সেই জন্যেই আজকের মানুষ বিষণ্ণ। সে দেখছে, আমি যা চাই না, তার সব ইন্ধনই আমার নিজের মধ্যেই রয়ে গেছে। এ জন্যেই মানুষ অতি বিচিত্র, বিচিত্র বলেই সে মানুষ। সে বিজ্ঞান শিল্প সাহিত্য, যা বলো, সবকিছুর নায়ক।

না, এত কথা, এমন জটিল করে কিছু শুনতে চায় না সরসী। সে ঐতিহ্যে বিশ্বাসী থাকতে চায়, সে প্রেম, একনিষ্ঠতা ইত্যাদিকে পরিপূর্ণ গ্রহণ করেই বাঁচতে চায়। মনুসংহিতার পরিবর্তে, রাষ্ট্রবিধানে যে কোনও নতুন চিন্তার দরজাই খুলে দিক, তবু তত্ত্বের চেয়ে আপন জীবন বড়।

আজকের সভা ভঙ্গ হল। সবাই চলে যাবার পর, সুবীর ঘরে এসে আলো জ্বালাল। সরসী উঠে বসতে ও বলল, তুমি ঘুমোওনি?

না।

আমি ভেবেছি, ঘুমিয়ে পড়েছ। অনেক রাত হয়েছে। শরীর কেমন?

ভাল।

সংক্ষিপ্ত উত্তর ছাড়া সরসী কিছুই বলল না। সে গৌরাঙ্গকে ডেকে সুবীরকে খেতে দেবার উদ্যোগ করল। সুবীর অনেক কথা বলে চলল, এতক্ষণ কী বিষয়ে কথা হচ্ছিল। সরসী অবিকৃত মুখে শুনে চলল। কারণ, চাকরি নেওয়া ও সিমলা যাওয়া নিয়ে দুজনের মাঝখানে, কয়েকদিন ধরেই একটা অলঙ্ঘনীয় বাধা, পর্বতের মতো দাঁড়িয়ে আছে।

কিছুক্ষণ বাদে সুবীরও চুপ করল। সরসী যে কথাটা উঠবে বলে আশা করছিল, সুবীরের সঙ্গে তার সিমলায় যাবার, সে প্রসঙ্গ উত্থাপিত হল না। এখন কেবল, একজনের যাওয়া আর একজনের এখানেই অবস্থান এই দুই পর্বের প্রস্তুতি।

কয়েকদিন পরে, সুবীর বেরিয়ে যাবার পর ময়লা জামা ধুতে দিতে গিয়ে সরসী একটি চিঠি আবিষ্কার করল। চিঠিটা খোলা। ভাঁজ খুলেই প্রথমে দেখল, শ্রীমতী হেনা এই নামে চিঠির সম্বোধন। সরসীর বুকের মধ্যে কেঁপে উঠল, নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এল। তাড়াতাড়ি চিঠিটা সে বন্ধ করে ফেলল। হাতের লেখা দেখেই চিনেছে, সুবীরের লেখা চিঠি। হেনাকে লেখা। পকেটে ঢুকিয়ে রাখতে গিয়ে রাখতে পারল না সরসী। কৌতূহল যেন একটা অসহ্য যন্ত্রণার মতো তার বুকের সকল নাড়ি ধরে টান দিল, ছিঁড়ে পড়তে চাইল। সে খুলে ফেলল চিঠিটা, খুলে পড়তে আরম্ভ করল, অথচ তার বুকের মধ্যে জপ চলতে লাগল, হে ভগবান! হে ভগবান!

চিঠির তারিখ, গতকালের। গতকাল রাত্রেই তা হলে লেখা হয়েছে।

শ্রীমতী হেনা,
ভুল বোঝবার সম্ভাবনা আমার দিক থেকে কিছু নেই, অতএব আপনি নিশ্চিন্ত থাকবেন। আপনার চিঠিটি একান্তই মানবীর চিঠি, সুস্থ স্বাভাবিক মানবীর, তাতে আমি কোথাও অন্যায় বা কুরুচি কিছু দেখতে পাইনি। এবং একান্ত মানবী বলাটাকে আপনি ছোট করে দেখবেন না, ওটা গর্বেরই বিষয়।

আমি একেবারেই দুঃখিত হইনি, বরং কৃতজ্ঞতা বোধ করেছি আপনার চিঠির জন্যে, আপনার অন্তরের কথা সহজ করে বলবার জন্যে। সহজ করে তিনিই বলতে পারেন, যখন সম্যক জেনে কেউ কিছু বলেন। তাই বলব, এ পত্রকে প্রত্যাখ্যান বলে আমার প্রতি অবিচার করবেন না। প্রত্যাখ্যানের মন কিংবা বলা যাক সাহস, কোনওটাই আমার নেই, কারণ, আমার ভিতরে তার কোনও ইন্ধন নেই। বরং যদি পারতাম, রবিবাবুর শেষের কবিতা থেকে কিছু উদ্ধৃতি দিয়ে আপনার জবাব শেষ করতে পারতাম, এবং আপনার পক্ষে হৃদয়ঙ্গম করতে তা খুব দুরূহ হত না। কিন্তু অতটা কাব্যিক হয়ে, এড়িয়ে যেতে চাই না।

ধরা যাক, একটি মেয়ে একটি পুরুষকে ভালবেসেছে, যে পুরুষ বিবাহিত। মেয়েটি তাকে জানাল, তোমাকে ভালবাসি, এই কথাটা জানিয়ে রাখলাম, যদি একে আকাঙিক্ষতা হতে চাওয়া বলল, ক্ষতি নেই। ভালবাসা হোক আমার আকাঙ্ক্ষার নাম, তার সঙ্গে জুড়ে দিতে চাই, এ কথা জানিয়ে যেন তোমাকে শ্রদ্ধা না করবার কোনও কারণ না ঘটে। বরং আকাঙ্ক্ষা হোক আমার আপনাকে তুষানলে পুড়িয়ে পুড়িয়ে মারার সুখ। ভবিষ্যতের অন্ধকারে কী আছে জানি না, আপাতত এ দেহ-মন তোমাকে দিলাম। এ বিক্রি করা যায় না, অন্য কাউকে তুমি দান করতেও পার না, আর যা খুশি, তাই করো।

এই মোদ্দা কথা? আরও অনেক কথা আছে নিশ্চয়ই, যেমন সরসীর বিষয় লিখেছেন। যেমন সরসীকে দেখে আপনি বুঝেছেন, ওর প্রেম খাঁটি, তাই ওর ভয় ও যন্ত্রণা বেশি। সে বিষয়ে আমি একমত। ওর আকাঙিক্ষত হতে চাওয়ার মধ্যে কোনও ফাঁক নেই। আকাঙিক্ষত হতে চাওয়া, সুবীর মিত্রের সঙ্গে, আপাতত সেই কথাটাও ভুললে চলবে না।

কিন্তু আপনাকে তো আমি আগেই জানিয়েছি, এই করতে চাওয়া, হতে চাওয়ার চেয়েও, মানুষের অনেক বড় কর্তব্য পৃথিবীতে আছে। সেই বড় কর্তব্যের দায়িত্ব নিয়ে, সরসী আমাকে রেখেছে অচ্ছেদ্য বন্ধনের সীমায়, যে বন্ধন আমার গতিকে করেছে সংহত। অতএব, আমার প্রতি আপনার শ্রদ্ধাকে নষ্ট করে, কেবলমাত্র আপনার সকল দানকে গণ্ডষে পান করতে ছুটব না।

আর আপনি হতে চেয়েও যে পুড়তে চেয়েছেন, সেজন্যে নত মাথায় চিরদিন আপনাকে স্মরণ করব। যে আমরা, সসাগরা পৃথিবীকে চেয়েছি বুকের কুলায়, অথচ ঘর করেছি এক ধুলার গৃহকোণে, সেই সসাগরা পৃথিবীর আঙিনায় আমার নিঃশব্দ পদসঞ্চার বাজবে।….

সরসীকে এ কথা বোঝাতে পারিনি, গৃহকোণের আঙিনাটায় অনেক অকারণ ধুলা জমবে ওর অনুপস্থিতিতে, তা হলে হয়তো ওকে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারতাম। বিশ্বাস বিসর্জন দিয়ে, মিথ্যে কথা–

সরসী চমকে উঠল ঘরের দরজায় ছায়া পড়তে। চোখ তুলে দেখল, সুবীর। ঘর্মাক্ত কলেবরে ও ছুটে এসে দাঁড়িয়েছে। কখন গৌরাঙ্গ দরজা খুলে দিয়েছে, কিছুই টের পায়নি। সুবীর এসে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে, ওর দৃষ্টি সরসীর হাতের চিঠিটার দিকে।

সরসী কয়েক মুহূর্ত চোখ নামাতে ভুলে গেল, তারপর একটা অসীম লজ্জায় ও ব্যথায় তার মাথা নুয়ে পড়ল।

সুবীর এগিয়ে এল। নিচু স্বরে বলল, ফিরে আসতে হল, এই চিঠিটার জন্যেই, ফেলে গিয়েছিলাম। দাও ওটা।

মাথা নত রেখেই চিঠিটা বাড়িয়ে দিল সরসী। সুবীর নিয়ে সেটা পকেটে রাখল। সরসী মুখ তুলল, যদিচ ওর চোখে জল, তবু যেন একটি দূরাগত আলোর ধারে চিকচিক করছিল। সে সুবীরের একটা হাত ধরল, বুকের কাছে ঘন হয়ে দাঁড়াল। অস্ফুটে বলল, আমাকে ফেলে যেও না, আমি থাকতে পারব না।

সুবীর তার গায়ে হাত দিয়ে, আরও কাছে টেনে নিল। কোনও কথা বলল না।

বাইরে মিন্টুর ইস্কুলের গাড়ি এসে দাঁড়াবার শব্দ শোনা গেল।

Pages: 1 2

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress