তিন আঙুলে দাদা
বেচারাম এসে ঠাকুমাকে গড় করে বলল,-এবার একটা কিছু করুন ৫দিদিঠাকরুন! ব্যাটাছেলে বড্ড বেশি জ্বালাচ্ছে। আমি যে এর পর ফতুর হয়ে যাব।
আমি বারান্দায় শতরঞ্চিতে বসে ভমাস্টারের ধমক খাচ্ছিলাম। ঠাকুমা কাছাকাছি থাকলেই দেখেছি ওঁর তর্জনগর্জন বেড়ে যায়। কিন্তু এই সাতসকালে বিস্কুটওয়ালা বেচারামের হঠাৎ মুখ চুন করে এসে ঠাকুমাকে গড় এবং ওই নালিশ! ভত্তমাস্টার আমাকে ভুলে গিয়ে চোখ টেরিয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
ঠাকুমা ফুলবাগানের সেবাযত্ন করছিলেন। হাতে একটা খুরপি। বললেন, নাক কাটা না তিন-আঙুলে?
বেচারাম করুণমুখে বলল, আজ্ঞে তিনআঙুলে। নাককাটা তো মানুষজনের সাড়া পেলেই লজ্জায় লুকিয়ে পড়ে। কিন্তু তিন-আঙুলে মহা ধড়িবাজ। গাছের ডালে ঘাপটি মেরে বসে থাকে। তলা দিয়ে কেউ গেলেই হয় চুল টেনে দেয়, নয়তো কানে খিমচি কাটে। মিওিরমশাইয়ের জামাইয়ের কানে–
ঠাকুমা তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, কখানা বিস্কুট নিয়েছে তা-ই বল।
তিনখানা খাস্তা, একখানা কিরিমকেক, আড়াইখানা নিমকি।-বেচারাম ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে ফের বলল, এখনও পুরো হিসেব করে দেখিনি। মাথার ঝাঁকায় পেলাস্টিক মোড়া ছিল। সেই পেলাস্টিক তুলে, কীরকম হাতসাফাই ভাবুন।
ঠাকুমা গম্ভীরমুখে বললেন,-প্লাস্টিক তুললেই তো শব্দ হবে। তোর ভুল হচ্ছে না তো বেচু?
বেচারাম জোরে মাথা নেড়ে বলল,–তিন-আঙুলে কে ছিল মনে নেই দিদিঠাকরুণ?
–হুঁ। শুনেছি পকেটমার ছিল। বাবুগঞ্জের হাটে ধরা পড়ে নাকি ওই অবস্থা।
ভন্তুমাস্টার বলে উঠলেন,–আমি স্বচক্ষে দেখেছিলাম মাসিমা। মারের চোটে একখানা হাত ভেঙে গিয়েছিল। অন্য হাতের আঙুলের দুটো হাড় গুড়ো হয়ে গিয়েছিল। হাসপাতালে সেই হাতখানা আর অন্য হাতের দুটো আঙুল কেটে বাদ দিয়েছিলেন ডাক্তারবাবুরা। সেইজন্যই তো তিন-আঙুলে নাম হয়েছিল।
ঠাকুমা চোখ কটমটিয়ে বললেন,–ভন্তু, পুঁটুকে আঁক কষাও। হাফইয়ারলিতে আঁকে গোল্লা পেয়েছে।
ভন্তুমাস্টার ঘুরে গর্জন করলেন।–একটা বানর ছয় ফুট উচ্চ খুঁটিতে উঠিবার চেষ্টা করিতেছে। মিনিটে ছয় ইঞ্চি উঠিয়া দুই ইঞ্চি নামিয়া যাইতেছে। এইরূপে ছয় ফুট উঠিতে তাহার কতক্ষণ সময় লাগিবে?
আমার কান ঠাকুমা এবং বেচারামের দিকে। বেচারাম বলল,–মাথার আঁকায় যে টান পড়েছিল দিদিঠাকরুন!
ঠাকুমা বললেন,–তুই ওকে দেখতে পেলি?
–নাহ। ঘুরঘুঁটে আঁধার। তার ওপর টিপটিপিয়ে বিষ্টি। ষষ্ঠীতলা কেমন জায়গা তা তো জানেন।
তুই এখন আয় বেচু। আমি দেখছি কী করা যায়। বলে ঠাকুমা একটা ফুলগাছের মাটিতে খুরপির কোপ বসালেন। বেচারাম তুষোমুখে চলে গেল।
বানরটাকে খুঁটির ডগায় ভমাস্টার চড়াতে পারলেও আমি পারলাম না। ষষ্ঠীতলার পর একটা খাল আছে। খালের ওপর কাঠের সাঁকো। ওই পথেই আমাকে রোজ স্কুল যেতে-আসতে হয়। ছুটির পর স্কুলের মাঠে ফুটবল খেলে বাড়ি ফিরতে আঁধার ঘনিয়ে আসে। খালটা গ্রামের শেষদিকটায়। এ পাড়ায় আমার স্কুলের সঙ্গী বলতে কেতো আর টোটো। টোটো ব্যাকে খেলে। কেতো গোলে। আমি কোনও কোনওদিন হাফব্যাকে চান্স পাই। কিন্তু টোটো যতই গোঁয়ার হোক, ওর ওপর ভরসা রাখা কঠিন। খুব দৌড়বাজ যে! বেগতিক দেখলেই উধাও হয়ে যায়।
আর কেতোর স্বভাব হল ভয় পেলেই আমাকে জাপটে ধরা। ভাবনায় পড়ে গেলাম।
আমাদের গাঁয়ে অনেকরকম ভূত আছে জানতাম। কিন্তু কখনও তাদের সামনাসামনি দেখতে পাইনি। একজনের নাম ছিল কাদুনে। সে নাকি খালের ধারে কেঁদে-কেঁদে বেড়ায়। একজনের নাম হাসুনে। সে রাতবিরেতে খালি হেসে বেড়ায় হিহি করে। কাতুকুতু নামে এক বেজায় দুই ভূত ছিল। সে একলা-দোকলা মানুষজন পেলেই তাকে কাতুকুতু দিয়ে অস্থির করত। হেঁচো ভূত আমাদের বাগানে এসে নাকি খুব হাঁচত। আর রামবাবুদের বাঁশবনে ছিল এক বেহালা-বাজিয়ে ভূত। দিনদুপুরেও তার বাজনা শোনা যেত। একবার কেতের সঙ্গে কঞ্চি কাটতে ঢুকে তার বেহালা শুনে ভয়ে পালিয়ে এসেছিলাম। তার বাজনার সুর বড় বিচ্ছিরি।
কিন্তু নাককাটা আর তিন-আঙুলে-র কথা সেই প্রথম শুনলাম।
বোঝা গেল এক পকেটমার মরে তিন-আঙুলে হয়েছে। কিন্তু নাক কাটাটা কে? ভন্তুমাস্টার চলে যাওয়ার পর ঠাকুমার কাছে জেনে নেব ভাবছি, এমন সময় বেচারামের দাদা কেনারাম এসে গড় করল। ঠাকুমা বললেন,–তোর আবার কী হল রে কিনু? দুধে জল মিশিয়ে সিঙ্গিমশাইয়ের চঁটি খেয়েছিস নাকি?
কেনারাম কাদোকঁদো মুখে বলল, না দিদিঠাকরুন! সর্বনাশ হয়ে গেছে। নাককাটা আমার এক হাঁড়ি দুধ নাক দিয়ে টেনে নিয়েছে। কাল সন্ধেবেলা দুধটা জ্বাল দিয়ে রেখেছিলাম। সকালে দেখি একটি ফোঁটাও নেই।
–তুই কী করে জানলি নাককাটাই দুধ খেয়েছে?
আজ্ঞে, আমার মেয়ে ইমলি দেখেছে। আমি গিয়েছিলাম রামবাবুদের গরু দুইতে। ইমলির মা পুকুরঘাটে বাসন মাজতে গিয়েছিল। ইমলি একা ছিল। বলল কী, একটা রোগাটে কালো কুচকুচে লোক পাঁচিল ডিঙিয়ে এসেছিল। তার নাক নেই। ইমলি তাই দেখে তো ভয়ে কাঠ। লোকটা দুধের হাঁড়িতে মুখ ঢুকিয়ে চেঁ-ঠো করে সব শুষে নিয়ে পালিয়ে গেল।
ঠাকুমা গুম হয়ে বললেন,–হুঁ। দেখছি।
কেনারাম কাকুতিমিনতি করে বলল,–দেখছি নয় দিদিঠাকরুন। এর একটা পিতিকার আপনি ছাড়া আর কেউ পারবে না। শুনলাম কাল সন্ধেবেলা বেচুরও সর্বনাশ হয়েছে। আমি বুঝতে পারছি না দিদিঠাকরুন, নাককাটা আর তিন-আঙুলে সবাইকে ছেড়ে আমাদের দু-ভাইয়ের পেছনে লাগল কেন? আমরা ওদের কী করেছি?
ঠাকুমা একটু ভেবে বললেন,–হ্যাঁ রে কিনু, পাঁচুকে তুই তো দেখেছিস?
কোরাম ভুরু কুঁচকে বলল,–পাঁচু, মানে ঝাপুইহাটির সেই পাঁচু-চোর?
–আবার কে? ঠাকুমা একটু কষ্টমাখা হাসি ফোঁটালেন মুখে। –পঞ্চগ্রামী বিচারে পাঁচুর নাক কেটে দিয়েছিল। তা পাঁচুর বিরুদ্ধে দুই সাক্ষী দিসনি তো?
কেনারাম প্রথমে হকচকিয়ে গেল। তারপর আস্তে বলল,–সে তো অনেকদিনের কথা। সাক্ষী দিইনি, তবে পঞ্চগেরামির সময় বারোয়ারিতলায় ছিলাম বটে। সবাই পাঁচুর নাক কাটার বিচারে হইচই করে সায় দিল। তখন আমিও দিয়ে থাকব। কিন্তু কথা হচ্ছে, নাক কেটেছিল তো নোলে। তার কোনও ক্ষতি আজ পর্যন্ত হয়েছে বলে তো শুনিনি দিদিঠাকরুন!
ঠাকুমা কেমন রহস্যময় হাসলেন এবার। হবে কী করে? হলেও বা জানবি কী করে? নোলেও তো কবে মরে গেছে শুনেছি।
কেনারাম আবার ঠাকুমাকে প্রতিকারের নালিশ জানিয়ে চলে গেল। আমার এতক্ষণে অবাক লাগল। আজ বেচারাম-কেনারাম ঠাকুমার কাছে নালিশ জানাতে এল। সেদিন মিত্তিরমশাই তার জামাইয়ের কানে কে চিমটি কেটেছে বলতে এসেছিলেন। কাল ভেঁটুবাবুও ক্রাচে ভর করে ঠাকুমার কাছে কী যেন বলতে এসেছিলেন। সারারাত নাকি ঘুম হয়নি এবং হাঁচি কথাটাও কানে এসেছিল। কিন্তু সবাই ঠাকুমার কাছে ভূতের বিরুদ্ধে নালিশ জানাতে আসছে কেন?
না বলে পারলাম না, ঠাকুমা, তুমি বুঝি ভূত জব্দ করতে পারো?
ঠাকুমা চোখ কটমটিয়ে বললেন, স্কুলের সময় হয়ে এল। চান করতে যাও।
সেদিনই স্কুলের ছুটির পর ফুটবল খেলে কেতো আর টোটোর সঙ্গে বাড়ি ফেরার পথে কেনারাম-বেচারামের গল্প শোনাচ্ছিলাম। খালের সাঁকোর কাছে এসে টোটো বলল, আজ এসপার-ওসপার করে তবে বাড়ি যাব। পুঁটু, আমার বই-খাতা ধর। কেতো, সেদিনকার মতো পুঁটুকে জাপটে ধরবিনে বলে দিচ্ছি। এক কিকে তোকে মাঠে ফেরত পাঠাব, হ্যাঁ!
কেতো ভয়েভয়ে বলল,–তোর প্ল্যানটা কী?
টোটো চাপা গলায় বলল,-তোরা ওই শিবমন্দিরের আড়ালে ঘাপটি মেরে বসে থাকবি। আমি ষষ্ঠীতলার গাছে উঠে ওত পাতব। মনে হচ্ছে, তিন-আঙুলে বেচুদার বিস্কুটের লোভে ওই গাছে উঠবে। বেচুদা তো ওখান দিয়েই যাবে। ক্লিয়ার?
কেতো বলল,–টোটো, তিন-আঙুলে যদি তোকে গাছ থেকে ঠেলে ফেলে দেয়?
টোটো ঘুসি দেখিয়ে বলল,–একখানা আপারকাট অ্যায়সা মারব যে, তিন আঙুলে এসে খালের জলে পড়বে।
বেলা পড়ে এসেছে। নিরিবিলি খালের দুধারে গাছপালা কালো হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। পাখিদের হা কমে যাচ্ছে। ভাঙা শিবমন্দিরের আড়ালে কেতের সঙ্গে চলে গেলাম। ষষ্ঠীতলায় একটা ঝাকড়া বটগাছ। টোটো গাছে উঠে গেল। তারপর আর সময় কাটতে চায় না। আঁধারে সব অস্পষ্ট হয়ে গেছে। বুক ঢিপঢিপ করছে অজানা ভয়ে। গোঁয়ার টোটোর পাল্লায় পড়ে কী বিপদ কোনদিক থেকে এসে যাবে, কে জানে! পোকামাকড়ের ডাক বেড়ে গেল এতক্ষণে। জোনাকি জ্বলতে দেখছিলাম এখানে ওখানে। কেতো ফিসফিস করে বলল, পুঁটু, বেচুদা এখনও ফিরতে না কেন রে?
সেই সময় ষষ্ঠীতলার গাছের ওপর টোটোর চেঁচানি শোনা গেল। অ্যাই! কী হচ্ছে? হি হি হি হি…আবার?…হি হি হি হি…আরে, মরে যাব!…হি হি হি…ওরে বাবা। হি হি হি হি…
তারপর ধপাস শব্দ। চেঁচিয়ে উঠলাম,-টোটো! টোটো।
–হি হি হি হি…মরে যাব! সত্যি! হি হি হি হি…ওরে বাবা! হি হি হি হি… বললাম,-কেতো! আয় তো দেখি।
কেতো পাছে আমাকে জাপটে ধরে, তার সঙ্গে দূরত্ব রেখে দৌড়ে গেলাম। গিয়ে দেখি, টোটো হি হি হি হি করে হাসতে-হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। কেতো বলল,–সর্বনাশ। টোটো কাতুকুতুর পাল্লায় পড়েছে। পালিয়ে আয় পুঁটু!
কেতো পালানোর আগেই গাছ থেকে পাতা খসে পড়ার মতো কেউ পড়ল এবং কেমন বিচ্ছিরি গলায় বলে উঠল,-চোখ গেলে দেব! কান মলে দেব। ছাড় হতভাগা!
টোটোর হাসি থেমে গেল। সে ফোঁস-ফোঁস করে হাঁপাতে হাঁপাতে উঠে দাঁড়াল। তারপর সটান উধাও হয়ে গেল। কেতো আমাকে জাপটে ধরে বলল–পুটু, এবার কী হবে?
গাছ থেকে সদ্য লাফিয়ে পড়া ছায়ামূর্তি তেমনই বিদঘুঁটে গলায় বলল, তিন-আঙুলে থাকতে ভয় কী খোকাবাবুরা? কাতুকুতু ব্যাটাচ্ছেলে আমাকে দেখেই পিঠটান দিয়েছে।
কেতো কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,–তু-তুমি তি-তিন-আঙুলে?
ছায়ামূর্তি একটা হাত তুলল। আঁধারে স্পষ্ট দেখলাম তার হাতে মোটে তিনটে আঙুল। সে সেই তিনটে আঙুল নেড়ে বলল,–শিগগির কেটে পড়ো তোমরা, বেচারাম আসছে। আমার বড্ড খিদে পেয়েছে।
খালের দিকে টর্চের আলোর ঝলক। কেতো বলল,–পুঁটু, চলে আয়। বেচুদা জব্দ হোক। ও বিস্কুটের ডবল দাম নেয়, তা জানিস? তিন-আঙুলে দাদা, আজ ওর ঝাঁকাসুদু তুলে নিয়ো।
তা আর বলতে? –বলে তিন-আঙুলে তড়াক করে গাছে উঠে গেল।
আমরা হনহন করে হাঁটতে থাকলাম। বাড়ির আশেপাশে কাতুকুতু গিয়ে লুকিয়ে থাকলে কী করব, সে একটা ভাবনা। তবে সে কাতুকুতু দিলেই ঠাকুমাকে চেঁচিয়ে ডাকব। নয়তো তিনআঙুলে দাদা তো আছেই।
কেতো চাপা গলায় বলল,–তিন-আঙুলে দাদা কিন্তু খুব ভালো। তাই না রে? টোটোকে কাতুকুতুর হাত থেকে না বাঁচালে কী হতো বল?
সায় দিতে যাচ্ছি, কাছাকাছি কেউ হাজ্জো করে হেঁচে উঠল। তারপর আর সেই হাঁচি থামতে চায় না। চেঁচিয়ে ডাকলাম,-ঠাকুমা, ঠাকুমা!
অমনি হাঁচি থেমে গেল। ঠাকুমাকে ওরা এত ভয় পায় কেন?
পরদিন সকালে পড়তে বসেছি, এমন সময় দেখি, কেনারাম-বেচারাম দুই ভাই এক আলখাল্লাধারী ফকিরকে সঙ্গে নিয়ে হাজির। ঠাকুমা হাসিমুখে ডাকলেন,–এসো! বাবা এসো! তোমার জন্য কতদিন থেকে পথ চেয়ে বসে আছি। আসছ না দেখে কিনু আর বেচুকে পাঠিয়েছিলাম।
বেচারাম বলল,–তিন-আঙুলে কাল সন্ধ্যায় আমার আঁকাসুদু তুলে নিয়েছে। আগে ওই ব্যাটাচ্ছেলেকে জব্দ করুন ফকিরবাবা!
কেনারাম বলল, না। আগে নাক কাটাকে।
ফকিরবাবা বিড়বিড় করে মন্তর আওড়াতে আওড়াতে বাগানের মাটিতে বসলেন। তারপর একটু হেসে ঠাকুমাকে বললেন, বেটি, সেবার তোকে বলেছিলাম শয়তানদের এই ঝুলিতে ভরে পদ্মার ওপারে ফেলে দিয়ে আসি। তুই বললি, না, না, গঙ্গা পার করে দিলেই যথেষ্ট। এখন দ্যাখ বেটি, ওরা গঙ্গা পেরিয়ে আবার ফিরে এসেছে। পদ্মাপারে দেশের বর্ডার। বর্ডার পেরনোর ঝক্কি আছে। বুঝলি কিছু? পাসপোর্ট-ভিসার হাঙ্গামা আছে না?
ঠাকুমা হাসলেন। বুঝেছি বাবা, খুব বুঝেছি। এবার তুমি ওদের পদ্মাপার করেই দিয়ে এসো।
মুচকি হেসে ফকিরবাবা বললেন, আগে দই-চিড়ে-কলা দে বেটি! ফলার করি। তারপর হচ্ছে।
ভন্তুমাস্টার বললেন, কিন্তু ফকিরবাবা, শুনেছি বর্ডারে ঘুষ দিলে নাকি পেরনো যায়।
ঠাকুমা চোখ পাকিয়ে বললেন,–ভন্তু, পুটুকে আঁক কষাও।
ভন্তুমাস্টার গর্জন করলেন, একটি চৌবাচ্চায় দশ গ্যালন জল ধরে। সেই চৌবাচ্চায় একটি ছিদ্র আছে। ছিদ্র দিয়া–
ফকিরবাবার খবর ততক্ষণে রটে গেছে। একজন-দুজন করে লোকের ভিড় জমতে শুরু করেছে। কলার পাতায় ফলার সেরে ফরিবাবা যখন ভূত ধরতে বেরোলেন, তখন তার পেছনে বিশাল মিছিল। ভন্তুমাস্টারকে খুঁজে পেলাম না আর। সেই ফাঁকে আমিও দৌড়ে গিয়ে মিছিলে ঢুকে পড়লাম। দেখলাম কেতো আর টোটোও এসে গেছে কখন।
ষষ্ঠীতলার কিছু আগে, রাস্তায় ফকিরবাবা তার প্রকাণ্ড লোহার চিমটে দিয়ে দাগ এঁকে বললেন,–খবরদার, খবরদার, এই দাগ পেরিয়ে কেউ যেন আসবে না। দাগ পেরিয়েছ কী মরেছ। খবরদার, খবরদার!
ফকিরবাবা ষষ্ঠীতলার পেছনের জঙ্গলে উধাও হয়ে গেলেন। সবাই চুপ করে আছে। শুনলাম, মিত্তিরমশাই মুচকি হেসে চুপিচুপি ভেঁটুবাবুকে বলছেন, রামবাবুর বাঁশবনের বেহালাদারকে পেলে হয়। মহা ধূর্ত। খাল পেরিয়ে হয়তো সিঙ্গিমশাইয়ের বাঁশবনে গিয়ে ঢুকে পড়েছে।
সিঙ্গিমশাই পেছনেই ছিলেন। বলে উঠলেন,–বাজে কথা বোলো না মিত্তির! আমার বাঁশবনে কে আছে তা জানো?
তর্কাতর্কি বেধে গেল। অন্যেরা চুপ! চুপ! বলে থামানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু সিঙ্গিমশাইকে থামানো শক্ত। শেষপর্যন্ত ফকিরবাবাকে ষষ্ঠীতলায় ফিরতে দেখে তর্কাতর্কি থেমে গেল। ফকিরবাবার কাঁধের তাপ্লিমারা রংবেরঙের ঝুলিটি এখন প্রায় পুঁটুলি হয়ে উঠেছে। সামনে এসে তিনি বললেন,-চললাম এবার পদ্মাপারে। ফিরে এসে আবার ফলার খাব।
মুখে ঝলমলে হাসি। প্রকাণ্ড পুঁটুলি হয়ে ওঠা ঝুলিটি খুব নড়ছিল। মিছিল করে গাঁয়ের লোকেরা ওঁর পেছন-পেছন চলল। গাঁয়ের শেষে মল্লিকদের আমবাগানের ধারে পিচরাস্তা। ফকিরবাবা পিচরাস্তায় উঠলে আমার চোখে পড়ল, ওঁর পিঠের দিকে তাপ্লিমারা ঝুলি ফুঁড়ে কালো কুচকুচে তিনটে আঙুল বেরিয়ে আছে। খুব নড়ছে আঙুল তিনটে। টা-টা বাই বাই করছে কি তিন-আঙুলে দাদা?
দেখে কষ্ট হল। বেশ তো ছিল তিন-আঙুলে। বেচারামকে জব্দ করেছিল। কাতুকুতুকে জব্দ করেছিল। ঠাকুমা কী যে করেন! ভ্যাট!
কিছুদিন পরে এক সকালে ভন্তুমাস্টার আমাকে আঁক কষাচ্ছেন। ঠাকুমা ফুলগাছের সেবাযত্ন করছেন। হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন,–অ্যাই হতচ্ছাড়া! ভালো হবে না বলছি! রেখে যা। রেখে যা।
ভন্তুমাস্টার বললেন,–কী হল মাসিমা?
ঠাকুমা বাগানের বেড়ার দিকে হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। অ্যাই বাঁদর! খুরপি দিয়ে যা। নইলে আবার ফকিরবাবাকে খবর পাঠাব।
ভন্তুমাস্টার আবার বললেন,–কী হল মাসিমা?
ঠাকুমা ঘুরে প্রায় আর্তনাদ করে বললেন,–ও ভন্তু, ও পুঁটে, আমার খুরপি নিয়ে পালাচ্ছে। ধরো, ধরো!
–কে খুরপি নিয়ে পালাচ্ছে মাসিমা?
–তিন-আঙুলে। শিগগির ওকে ধরো।
ভন্ডুমাস্টার দৌড়ে গেলেন। আমিও দৌড়লাম। বাগানের বাইরে খুরপিটা পড়ে থাকতে দেখা গেল। ভন্তুমাস্টার খুরপিটা কুড়োতে গিয়েই উঁহু হু হু করে পিছিয়ে এলেন। তারপর কানে হাত বুলোতে-বুলোতে বললেন, উঁহু হু হু, বড় জ্বালা করছে যে। ও পুঁটু, আমার কানটা আছে না নেই দ্যাখ তো বাবা!
হাসি চেপে বললাম, আছে মাস্টারমশাই!
ভন্তুমাস্টার কানে হাত চাপা দিয়ে বললেন,–কোবরেজমশাইয়ের কাছে মলম লাগিয়ে আনি। উঁহু হু হু! তারপর টাট্টুঘোড়ার মতো উধাও হয়ে গেলেন।
তিন-আঙুলে ফকিরবাবার ঝুলি ফুঁড়ে পালিয়ে এসেছে জেনে আমার খুব আনন্দ হচ্ছিল। বললাম,–তিন-আঙুলে দাদা! ঠাকুমার খুরপিটা আমি কুড়োচ্ছি। আমার কান মুলে দেবে না তো?
না। তিন-আঙুলে আমার কান মলে দিল না। খুরপিটা কুড়িয়ে নিয়ে গিয়ে ঠাকুমাকে দিলাম। ঠাকুমা খুশি হয়ে বললেন, তিন-আঙুলে ফিরে এসেছে যখন, তখন থাক। গা-গেরামে দু-একটা ভূত না থাকলে চলে? তবে নাককাটাটা বড্ড বোকা। সেও পালিয়ে আসতে পারত। তাই না পুঁটু?