লী ও নীম নিঃশব্দে হাঁটছিল
হাঁটবার সময় এরা সচরাচর কথা বলে না। লুখগুলি শরীরের ভেতর লুকানো থাকে। নেহায়েত প্রয়োজন ছাড়া বের করে না।
সকালবেলার দিকে তারা ঘরগুলির সামনে এসে দাঁড়াল। ঝড় নেই। শান্ত ভাব চারদিকে। লী বলল,
আজ কোন ঘরটির ভেতর প্রথম ঢুকবে?
নীম জবাব না দিয়ে প্রথম ঘরটির ভেতর ঢুকে পড়ল। এই ঘরটি সবচে উঁচু। প্রায় আকাশছোয়া। লী বেশ অবাক হল। তারা কখনও একাএকা কোথাও যায় না। আজ নীম এরকম করল কেন? লী ডাকল, নীম, নীম।
নীম সাড়াশব্দ করল না। লী খানিকক্ষণ ইতস্তত করে প্রথম ঘরটির ভেতরে ঢুকল। আশ্চর্য, এই প্ৰকাণ্ড হল ঘরের কোথাও নীম নেই। তাহলে সে কি দ্বিতীয় ঘরে চলে গেছে। দ্বিতীয় ঘরেও তাকে পাওয়া গেল না। শুধু তাই নয়, ছটি ঘরের কোনটিতেই নীম নেই।
লী অবশ্য অনায়াসে তাকে খুঁজে বের করতে পারে। লুখগুলি বের করে রাখলেই জানা যাবে কোথায় লুকিয়ে আছে নীম। কিন্তু লীর ইচ্ছা করছে। না। নীম এ রকম করল কেন?
লী ঘরের বাইরে এসে পা ছড়িয়ে বসে থাকল। তার কিছুই ভালো লাগছে না। ক্লান্তি লাগছে। এ রকম কলল কেন নীম? কত দীর্ঘকাল তারা একসঙ্গে আছে। সেই কবেকার কথা, অস্পষ্টভাবে মনে পড়ে। মা ছিলেন বেঁচে। মায়ের চারপাশে তারা ঘুরঘুর করত। মা বলতেন,
আমার লক্ষ্মী সোনারা, তোমরা সবাই একসাথে থাকবে। একা-একা যাবে না কোথাও।
নীম চোখ ঘুরিয়ে বলত, একা-একা গেলে কী হয়?
একা-একা থাকলে অনেক ঝামেলা হতে পারে। যদি একসঙ্গে থাক, তাহলে তোমাদের তিন জনের সুখ একসঙ্গে থাকবে। যদি তারা এক মাত্রায় কাঁপে, তাহলে তোমরা অনেক কিছু করতে পারবে। আমাদের লুখ মহাশক্তিশালী।
কী করে কাঁপবে এক সঙ্গে?
তোমাদের নিজেদেরই তা শিখতে হবে। আমার লুখ নষ্ট হয়ে গেছে। আমি তোমাদের কিছু শেখাতে পারব না।
শুধু লুখ নয়, অনেক কিছু নষ্ট হয়ে গিয়েছিল তাঁর। মা চোখে দেখতেন না, হাঁটতে পারতেন না। তবু যে কত দিন বেঁচে ছিলেন, তাদের কত কিছুই না শেখাতেন। প্রথম শেখাৰ্পেন কী করে সমস্যা নিয়ে চিন্তা করতে হয়।
প্রথমে লুখগুলি শরীরের ভেতর ঢুকিয়ে ফেলবে, তারপর কোনো একটি জায়গায়, যেখানে প্রচুর আলো আছে, সেখানে পা ছড়িয়ে ভাবতে বসবে। একজন কি ভাবছে অন্য জন তা বুঝতে চেষ্টা করবে না।
বুঝতে চেষ্টা করলে কী হয়?
ঠিকমতো ভাবা যায় না।
তাদের প্রথম সমস্যা দিলেন মা। সমস্যাটি অদ্ভুত—আমরা কে? কোত্থেকে এসেছি? দিনের পর দিন এই সমস্যা নিয়ে ভাবতে লাগল। তারা। প্রথম মুখ খুলল আয়ু। সে বলল,
আমরা বুদ্ধিমান একটি প্রাণী।
মা বললেন, প্রাণী কি?
যারা ভাবতে পারে তারাই প্রাণী।
আমরা কোত্থেকে এসেছি?
আমরা কোনো জায়গা থেকে আসি নি। এখানেই ছিলাম।
মা দুঃখিত হয়ে বললেন, তোমরা এখনো ভাবতে শেখ নি। ভাবনাতে যুক্তি নেই তোমাদের।
ক্ৰমে ক্ৰমে তারা ভাবতে শিখল। কত অদ্ভুত অদ্ভুত সমস্যাই না মা দিতেন–(১) আলো আমাদের কাছে এত প্রিয় কেন? কেন আমরা আলো ছাড়া ভাবতে পারি না? (২) কেন ঘরগুলির কাছে আমাদের যেতে মানা?
তখনো তারা ঘরগুলি দেখে নি, শুধু মায়ের কাছে শুনেছে। দুটি ঘর আছে আকাশছোয়। সে ঘরের কাছে যেতে মানা। কেন মানা? মা তা বলবেন না। ভেবে বের করতে হবে।
যেদিন মায়ের শরীর একটু ভালো থাকত, সেদিনই নতুন কিছু বলতেন। একদিন তারা গুনতে শিখল। শেখামাত্রই মা একটি সমস্যা দিয়ে দিলেন পাঁচ সংখ্যার এমন দুটি রাশি বল, যাকে অন্য কোনো রাশি দিয়ে ভাগ দেয়া যায় না।নীম সঙ্গে সঙ্গে বলল,
যে কোনো রাশিকেই এক কিংবা সেই রাশি দিয়ে ভাগ দেয়া যায়।
তা যায়। ঐ দুটি রাশি ছাড়া অন্য কোনো রাশি দিয়ে ভাগ দেয়া যাবে না।
মা মারা যাবার আগে আগে অনেক কিছুই ওরা শিখে ফেলল। আবার অনেক কিছু শিখতে পারল না। মা বলতেন, বেশির ভাগ জিনিসই শিখতে হয় নিজের চেষ্টায়। তোমরা দীর্ঘজীবী! অনেক সময় পাবে শেখার। মৃত্যুর আগে আগে বলে গেলেন,
একটি কথা সব সময় মনে রাখবে, তোমরা থাকবে একসঙ্গে। তোমাদের তিন জনের মিলিত শক্তি হচ্ছে অকল্পনীয় শক্তি। আরেকটি কথা, ঘরগুলির রহস্য বের করতে চেষ্টা করবে।
তাঁর মৃত্যু দেখে ওদের যাতে কষ্ট না হয়, সে জন্যে মা মৃত্যুর ঠিক আগে আগে ওদের একটি সমস্যা নিয়ে ভাবতে বললেন, মৃত্যু কী? তারা সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে থাকল, বুঝতেই পারল না কখন মা মারা গেলেন।
নীম বেরিয়ে আসতে দেরি করল। অনেকখানি দেরি করল। সূর্য তখন প্রায় মাথার উপর। লী কিছুই বলল না। নীম খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, চল ফিরে যাই।
তোমার যা দেখার দেখা হয়েছে?
হয়েছে।
কী দেখলে?
আজকে প্রথম বারের মতো একটা জিনিস লক্ষ করলাম।
বল শুনি।
এই ঘরগুলি আকাশছোঁয়া।
আমার তো মনে হয় এ তথ্যটি আমরা প্রথম থেকেই জানি।
এই ঘরগুলির দেয়াল অসম্ভব মসৃণ।
এইটিও আমরা প্রথম থেকেই জানি।
আমার মনে হয় এ রকম করা হয়েছে, যাতে আমরা দেয়াল বেয়ে উঠতে না পারি।
লী চুপ করে রইল। নীম বলল, আমি ভেতরে গিয়ে আজকে কী করেছি জান?
না। জানতে চেষ্টা করি নি।
এই ঘরের যে কম্পনাঙ্ক, সেই কম্পনাঙ্ক আমি আমার সুখ কাঁপিয়েছি।
লী স্তম্ভিত হয়ে গেল। যদি সত্যি তাই হয়, তাহলে ঘরটির ভেঙে গুঁড়িয়ে পড়ার কথা।
নীম বলল, ঘর ভাঙাই ছিল আমার উদ্দেশ্য। যাতে তুমি আঘাত না পাও, সেজন্যই তোমাকে নিয়ে ঢুকি নি। কিন্তু ঘর ভাঙে নি। কেন ভাঙে নি জান?
না।
ভাঙে নি, কারণ ছটি ঘর আলাদা আলাদা করে এমনভাবে তৈরি করা, যাতে সামগ্রিক কম্পনাঙ্ক অনেক নিচে নেমে গেছে। আমরা এত নিচে নামতে পারি না। তুমি কি কিছু বুঝতে পারছ, লী?
পারছি। যারা এই ঘরগুলি তৈরি করেছে, তারা আমাদের হাত থেকে এদের রক্ষা করবার জন্যেই এরকম করেছে, এই বলতে চাও তুমি?
হ্যাঁ।
তারা তাহলে কোথায়?
সেই সমস্যা নিয়ে আমাদের তিন জনকে একসঙ্গে ভাবতে বসতে হবে।
লী এবং নীম নিঃশব্দে ফিরে চলল। লী ভেবে রেখেছিল নীমকে খুব একচোট গালমন্দ করবে। কিন্তু কিছুই করল না, অত্যন্ত দ্রুতপায়ে ফিরে চলল অয়ুর কাছে। তিন জন মিলে আবার ফিরে আসা দরকার। ঘরগুলির মাথার উপর গিয়ে দেখা দরকার কী আছে সেখানে। অনেক সমস্যা জমে গেছে। ভাবতে বসা প্রয়োজন।
আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, জন্তুটি নিঃশব্দে খাঁচায় ঢুকে পড়ল। জন ফেন্ডার এবং জনি কুলম্যান বড়ই অবাক হল। কোনো জন্তুকে খাঁচায় ঢোকানো অত্যন্ত পরিশ্রমের ব্যাপার। প্রচুর যান্ত্রিক সহায়তা প্রয়োজন। প্রথমে একটি শক্তিশালী বৈদ্যুতিক চক্র তৈরি করা হয়, সেই চক্ৰ ক্ৰমাগত ছোট করে
চার মুখের সামনে আনা হয়। জন্তুটি যত বুদ্ধিমান, তাকে খাঁচায় ঢাকানো ততই মুশকিল। এ ক্ষেত্রে কোনো কিছুরই প্রয়োজন হল না। খাচার মুখ খোলামাত্র জন্তুটি খাচায় ঢুকে পড়ল। বৈদ্যুতিক চক্র তৈরি করার প্রয়োজনও হল না। জনি কুলম্যান চেঁচিয়ে বলল, চার দরজা বন্ধ করে দাও।
কম্পিউটার সিডিসি বলল, যান্ত্রিক গোলযোগ দেখা দিয়েছে। খাচার দরজা বন্ধ হচ্ছে না।
কি জাতীয় গোলোযোগ?
সেকেন্ডারি মেগনেটিক ফিল্ড তৈরি হচ্ছে না।
এরকম হবে কেন?
মনে হচ্ছে কারেন্ট ফ্লো করছে না। ভেরিয়াক দুটি অকেজো। পরীক্ষা করা হচ্ছে।
আমরা এখন কী করব?
অপেক্ষা করবে। আমরা ক্রটি সারাতে না পারলে অন্য আরেকটি খাঁচা পাঠাবে।
জনি কুলম্যানের বিরক্তির সীমা রইল না। কতক্ষণ এরকম অপেক্ষা করতে হবে কে জানে। জন্তুটি মনে হচ্ছে দিব্যি সুখে ঘুমিয়ে পড়েছে। গাছের ডালের মতো যেসব বিচিত্র জিনিস তার মাথার দুপাশ দিয়ে বের হয়েছিল, সেগুলি আর দেখা যাচ্ছে না। শরীরের ভেতর ঢুকিয়ে ফেলেছে। নাকি? জন ফেন্ডার বলল, প্রাণীটি বুদ্ধিমান নয়।
কী দেখে বলছ?
প্রাণীটি ঘুমিয়ে পড়েছে। এ রকম অস্বাভাবিক অবস্থায় কোনো প্রাণী ঘুমিয়ে পড়তে পারে না।
ঘুমুচ্ছে, বুঝলে কী করে?
চোখ বন্ধ। মাথার শুঁড়গুলিও নেই। নড়াচড়া করছে না।
তুমি কি নিঃসন্দেহ যে প্রাণীটি ঘুমুচ্ছে?
না। তা ছাড়া অসংখ্য প্ৰাণী আছে যারা কখনো ঘুমায় না। স্নায়ুবিক বিশ্রামের তাদের প্রয়োজন নেই।
১৮টা পঁচিশ মিনিটে গ্যালাক্সি-ওয়ান থেকে জানানো হল যে চাটির দরজা ঠিক করা সম্ভব হয় নি। বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে অন্য একটি খাঁচা পাঠানো হচ্ছে। জন্তুটিকে নতুন খাঁচায় ঢোকানোর জন্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হোক।
প্রয়োজনীয় কোনো ব্যবস্থা নেয়ার আগেই দেখা গেল ঠিক একই রকম দেখতে আরো দুটি প্রাণী এসে উপস্থিত হয়েছে এবং কিছুমাত্র দ্বিধা না করে ঢুকে পড়েছে খাচায়। ঢোকামাত্রই খাচার দরজা বন্ধ হয়ে গেল। জনি বলল, এসব কী হচ্ছে, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। এই দুটি আবার কোত্থেকে এল?
জন ফেন্ডার বলল, তুমি নিশ্চয়ই আশা কর নি, একটিমাত্র এরকম প্রাণী এই গ্রহে?
লক্ষ লক্ষ এ রকম কুৎসিত প্রাণী এখানে, তাও আশা করি নি। আর ভাব দেখে মনে হচ্ছে সবাই খাচায় ঢুকে পড়বে।
মোটেই অস্বাভাবিক নয়। নিম্নশ্রেণীর প্রাণীরা প্রায়ই দলপতিকে অনুসরণ করে।
জনি গম্ভীর হয়ে বলল,
প্রাণীগুলি মোটেই নিম্নশ্রেণীর নয়। আমার মনে হয় প্রথম প্রাণীটি ইচ্ছা করে দরজা খোলা রেখেছিল, যাতে অন্য দুটি এসে উঠতে পারে এবং সুযোগ বুঝে আমাদের সর্বনাশ করতে পারে।
তুমি শুধু শুধু ভয় পাঞ্ছ জনি। এরা নিরীহ প্রাণী। হিংস্র নয়। হিংস্র হলে আমাদের আক্রমণ করে বসত।
আক্রমণ করে নি, কারণ এরা বুদ্ধিমান। এরা সুযোগের জন্যে অপেক্ষা করবে।
জন ফেন্ডার হেসে উঠল। জনি বলল, তিনটি প্রাণীকে এক সঙ্গে মহাকাশযানে নিয়ে আমরা হয়তো বোকামি করছি।
জান, সে দায়িত্ব তোমার নয়। কেন শুধু শুধু ভাবছ?
জীববিদ্যা গবেষণাগারের একপ্রান্তে প্রাণী তিনটিকে রাখা হল। ঘরটি সিলঝিন সংকরের তৈরি। বায়ুর চাপ ০.৯৫ এটমসফিয়ার। বায়ুমণ্ডলীয় গঠন এমন রাখা হয়েছে যাতে প্রাণীগুলির কিছুমাত্র অস্বস্তি না হয়। খাদ্য এবং পুষ্টি বিভাগের উপর ভার পড়েছে, কী ধরনের খাদ্য প্রাণীটি গ্রহণ করে তা বের করা। সাইকিয়াট্রি বিভাগকে বলা হয়েছে প্রাণীটির বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে একটি প্রাথমিক রিপোর্ট দিতে। রিপোর্টে যদি প্রাণীটিকে বুদ্ধিমান বলা হয়, তবেই তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হবে।
গ্রহটিতে একটি নিরীক্ষা পরীক্ষাগার খোলা হয়েছে। পরীক্ষাগারের দায়িত্ব হচ্ছে, মাকড়সা জাতীয় এই প্রাণীগুলি ছাড়া অন্য কোনো প্রাণের বিকাশ হয়েছে কি না, সে সম্বন্ধে অনুসন্ধান করা। গ্রহটি ১২ টাইপ। এই জাতীয় গ্রহে প্রাণের উদ্ভব হয় না। কিন্তু যেহেতু এক শ্রেণীর প্রাণের সন্ধান পাওয়া গেছে, সেহেতু এই নিরীক্ষা পরীক্ষাগার।
মাকড়সা জাতীয় প্রাণীগুলিকে মহাকাশযানে নিয়ে যাবার পরপরই তাদের ঘুমন্ত ভাব কেটে যায়। তারা মাথার দুপাশের বিচিত্র শিকড়ের মতো জিনিসগুলি বের করে অস্থিরভাবে ছুটোছুটি করতে থাকে। কিন্তু অবস্থাটি সাময়িক। খানিকক্ষণ পর এরা আবার ঘুমিয়ে পড়ে। চুপচাপ নিঝুম। কিন্তু আবার জেগে উঠে আগের মতো ছুটোছুটি করতে থাকে। আবার নিঝ্ঝুম।
তাদের এ পর্যন্ত ছ রকমের খাবার দেয়া হয়েছে। প্রোটিন, ফ্যাট এবং সেলুলোজ জাতীয় খাবার। প্রতি বারই তারা গভীর আগ্রহে খাবারের চারপাশে ভিড় করেছে। কিন্তু খাবার স্পর্শও করে নি। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে আবার সেই আগের মতো ঘুমন্ত অবস্থা।
সাইকিয়াট্রি বিভাগ থেকে বুদ্ধিমত্তা পরীক্ষার জন্যে প্রথম পরীক্ষাটির ব্যবস্থা করা হল। এটি একটি সহজ পরীক্ষা (হলড্রেন ক্রিয়েটিভি টেস্টটাইট হইসি)। যার বুদ্ধিমত্তা পরীক্ষা করা হবে, তাকে চৌষট্টিটি স্কয়ার দেয়া হয় এবং অন্য এক জন প্রাণীটির সামনে ঠিক একই ধরনের চৌষট্টিটি স্কয়ার নিয়ে বসে। নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে সেগুলি নিয়ে একটি ত্রিভুজ, একটি আয়তক্ষেত্র এবং একটি সিলিন্ডার তৈরি করা হয়। এরপর এগুলিকে সমানুপাতিকভাবে বিভিন্ন ভাগ করে প্রাণীটিকে দেখানো হয়। সাধারণত নিম্নশ্রেণীর বুদ্ধিবিশিষ্ট প্রাণীরা বেশ কিছু দূর পর্যন্ত অনুসরণ করতে পারে। মধ্যম শ্রেণীর বুদ্ধিবিশিষ্ট প্রাণীরা সমানুপাতিক ভাগ পর্যন্ত করতে পারে। শেষ দুটি পর্যায় শুধু বুদ্ধিমান প্রাণীরাই করতে পারে।
মাকড়সা শ্রেণীর প্রাণী তিনটি অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে স্কয়ারগুলি নাড়াচাড়া করতে লাগল। কিন্তু তার পরপরই স্কয়ারগুলি এক পাশে সরিয়ে রেখে দিব্যি ঘুমুতে গেল।
হলডেনের দ্বিতীয় টেস্টেও একই ব্যাপার হল। গোলাকার বল পাঁচটিকে নিয়ে তারা খানিকক্ষণ নাড়াচাড়া করে এক পাশে রেখে ঘুমুতে গেল।
সাইকিয়াট্রি বিভাগের প্রাথমিক রিপোর্টে বলা হল–প্রাণীগুলির প্রাথমিক পর্যায়ের বুদ্ধিও নেই বলেই মনে হচ্ছে। সাইমেন্সের টেস্টগুলি না করা পর্যন্ত সঠিকভাবে কিছু বলা যাচ্ছে না।
লীর একটি মাত্র চিন্তা–এসব কি?
বলাই বাহুল্য, এই লম্বাটে দুটিমাত্র পা-বিশিষ্ট প্রাণীগুলি অনেক জানে। যারা এমন একটি অদ্ভুত জিনিসে করে হঠাৎ এসে হাজির হতে পারে, তারা নিশ্চয়ই বুদ্ধিমান। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, বুদ্ধিমান হওয়া সত্ত্বেও এরা সমস্যা নিয়ে চিন্তা করছে না। এদের ভাবভঙ্গি এরকম, যেন কোথাও কোনো সমস্যা নেই। এদের কথার অর্থ বুঝতে পারলে ভালো হত। নীমকে বলা হয়েছে কথার অর্থ বের করতে। সে এখন শুধু একটিমাত্র সমস্যা নিয়েই ভাবছে। এরা প্রতিটি জিনিসকে একটি নাম দিয়ে ডাকে মহাকাশযান, রবট সিডিসি, সাইকিয়াট্রি বিভাগ। একটির সঙ্গে আরেকটির সম্পর্ক কী করে, সেটিই এখন জানতে হবে। ব্যাপারটি জটিল নয়, সময়সাপেক্ষ। নীম এখানকার প্রতিটি জীবের (যাদের এরা মানুষ বলে ভাবছে) কথাবার্তা মন দিয়ে শুনছে এবং বিশ্লেষণ করছে।
এরা চৌষট্টিটি বস্তু দিয়েছে। উদ্দেশ্য কী, তা বোঝা যাচ্ছে না। এক জন অনেক কিছু বানিয়ে বানিয়ে দেখাল। এরা কি চায় তারাও সেরকম কিছু বানিয়ে বানিয়ে দেখাবে? তা কেন চাইবে নাকি তারা চায় এই সব বস্তুর কম্পনাঙ্ক কত তা বের করতে? নীম প্রতিটির কম্পনাঙ্ক কত তা বের করল। তারপর তিন জন মিলে ভাবতে বসল এই কম্পনাঙ্কগুলির অন্য কোনো অর্থ আছে কিনা। সমস্যাটি জটিল। সময় লাগল ভাবতে। কিন্তু উত্তর বের করার আগেই ওরা পাঁচটি গোলাকার বস্তু ঢুকিয়ে দিল। এদের ওজন এক নয়, কিন্তু কম্পনাঙ্ক এক। এটিও কি কোনো সমস্যা? ওরা আবার ভাবতে বসল।
অয়ুর উপর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, ওরা কে কী ভাবছে তা বের করার। এর জন্যে ভাষা জানবার প্রয়োজন হয় না। লুখ দুটিকে সম্পূর্ণ সক্রিয় করতে হয়। অয়ু নিবিষ্ট মনে তাই করে যাচ্ছে। প্রতিটি মানুষের কথা জানবার পরই সে সমস্যা নিয়ে ভাবতে বসবে। কিন্তু ইতিমধ্যে সে একটি অদ্ভুত জিনিস লক্ষ করেছে, মানুষরা একে অন্যের মনের কথা বুঝতে পারছে না। ব্যাপারটি অবিশ্বাস্য হলেও সত্য। জনি নামের মানুষটি জন ফেন্ডারের খুব কাছে পঁড়িয়ে মনে মনে ভাবছে জন ফেভার একটি মহামূৰ্খ–কিন্তু জন ফেন্ডার তা বুঝতে পারছে না।
তাদের সামনে এখন অনেক সমস্যা। সমস্যা মানেই হচ্ছে আনন্দ। কত কিছু ভাববার আছে এখন। আহ্ কি আনন্দ। অয়ুর পায়ে অসম্ভব যন্ত্রণা, কিন্তু তাতে কিছুই আসে যায় না।
কিম দুয়েন নিজের ব্যক্তিগত ঘরে একা-একা বসে ছিল। আজ সরাসরি প্রচুর ঝামেলা গিয়েছে। এখন খানিকটা বিশ্রাম করা যেতে পারে। তার ঘরের বাইরে দুটি ছোট ছোট লাল বাতি জ্বলছে, যার মানে হচ্ছে বিশেষ কোনো জরুরি প্রয়োজন ছাড়া তাকে বিরক্ত করা যাবে না।
কিম দুয়েন একটি সিগারেট ধরিয়ে কম্পিউটার সিডিসির সবুজ বোতাম টিপে দিল। ঘুমুবার আগে সে সাধারণত সমস্ত দিনের ঘটনা নিয়ে কম্পিউটার সিডিসির সঙ্গে কথাবার্তা বলে। হালকা ধরনের কথাবার্তা–জটিল হিসাব-নিকাশ নয়। কোনো কোনো দিন দু-এক দানা দাবা খেলা হয়। প্রায় সময়ই কিম দুয়েনের মনে থাকে না যে, সে কথাবার্তা বলছে একটি কম্পিউটারের সঙ্গে যার মস্তিষ্ক ল্যাববারেটরিতে সিনক্ৰিয়ন কপোট্রন দিয়ে তৈরি। যার লজিক আছে, কিন্তু অনুভূতি নেই। আজ নিম্নলিখিত কথাবার্তা হল।
হ্যালো সিডিসি।
হ্যালো ক্যাপ্টেন। দাবা খেলবে নাকি এক দান?
না। আজ খুবই ক্লান্ত।
বুঝতে পারছি। ক্লান্ত হবারই কথা এবং খুব চিন্তিত হওয়ার কারণ আছে।
কিম দুয়েন ঈষৎ সচকিত হয়ে বলল, চিন্তিত হওয়ার কারণ কী?
যে কোনো অজানা বুদ্ধিমান প্রাণীর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎকারের মধ্যে চিন্তিত হওয়ার কারণ আছে। আলফা সেঞ্চুরির সুসভ্য প্রাণীদের সঙ্গে মানুষের প্রথম সাক্ষাৎকারের কথা মনে আছে তো?
কিম দুয়েন গম্ভীর হয়ে বলল, মনে আছে। কিন্তু সিডিসি, তুমি একটি জিনিস ভুল করছে, এরা বুদ্ধিমান প্রাণী নয়। নীচুস্তরের জীব। খাদ্য যোগাড় করতে গিয়েই এদের সমস্ত বুদ্ধিবৃত্তি ব্যয় হয়।
এখানে তুমি একটি ভুল করছ কিম দুয়েন। প্রাণীগুলি যথেষ্ট বুদ্ধিমান এবং খাদ্যের জন্যে এরা কিছুই করে না।
তার মানে?
এই মুহূর্তে বলতে পারছি না। তুমি জান, আমি অনুমান করে কিছু কখনো বলি না।
সাইকিয়াট্রি বিভাগ কিন্তু আমাকে লিখিত নোট দিয়েছে যে, ওরা হলডেন টেস্ট পাশ করতে পারে নি।
হলডেন টেস্ট বুদ্ধিমত্তা মাপার জন্যে একটি চমৎকার ব্যবস্থা, কিন্তু তোমার মনে থাকা উচিত, হলডেন নিজেই বলেছেন। কোনো প্রাণী যদি অসম্ভব বুদ্ধিমান হয়, তা হলে হলডেন টেস্ট তার কাছে অর্থহীন মনে হবে।
প্রাণীগুলি অসম্ভব বুদ্ধিমান, এ রকম কোনো প্রমাণ কি পেয়েছ?
না, এখননী পাই নি।
এমন কোনো কারণ কি ঘটেছে, যার জন্যে তোমার মনে হয় প্রাণীগুলি বিপজ্জনক হতে পারে?
না ঘটে নি। প্রাণীগুলি শান্ত প্রকৃতির, তবে–
তবে কি?
তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে, আমাদের চার দরজা আটকে গিয়েছিল কিছুক্ষণের জন্যে।
মনে আছে।
তুমি নিশ্চয়ই জান, আজ এক সেকেন্ডের বারো ভাগের এক ভাগ সময়ের জন্যে আমাদের কেন্দ্রীয় ইলেকট্রিসিটি ছিল না।
আমি জানি।
এটি একটি অসম্ভব ব্যাপার নয় কি?
হ্যাঁ, খুবই অস্বাভাবিক।
তুমি হয়তো এখনো খবর পাও নি, আমাদের প্রকৌশলী বিভাগের কাছেও একটা সমস্যা আছে। তারা তা নিয়ে বর্তমানে চিন্তাভাবনা করছে।
কি সমস্যা?
আমাদের পাওয়ার লাইনের ইলেকট্রিসিটিতে এ পর্যন্ত পনের বার সাইকেল বদল হয়েছে। যেন কেউ সাইকেল বদলে কিছু একটা পরীক্ষা করছে।
তুমি বলতে চাও, ঐ প্রাণীগুলি এসব করছে?
আমি কিছু বলতে চাই না। প্রমাণ ছাড়া আমি কখনো কিছু বলি না। আমি শুধু তোমাকে একটি সম্ভাবনার কথা বলছি।
কিম দুয়েন সিডিসির সুইচ অফ করে প্রকৌশলী বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করল।
কিম বলছি, সাইকেল বদলাবার একটি খবর শুনলাম।
তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয় স্যার। সেজন্যেই আপনাকে জানানো হয় নি। জোসেফসান জাংশনের ত্রুটির জন্যে এরকম হতে পারে।
জোসেফসান জাংশানের কোনো ত্ৰুটি কি ধরা পড়েছে?
না স্যার, তা ধরা যায় নি।
তবে?
কিম দুয়েন খানিকক্ষণ উত্তরের জন্যে অপেক্ষা করল। তারপর গম্ভীব মুখে যোগাযোগ করল সিকিউরিটি বিভাগের সঙ্গে।
হ্যালো, সিকিউরিটি?
বলুন স্যার।
যে প্রাণীগুলিকে আমরা পরীক্ষার জন্যে ল্যাবরেটরিতে এনেছি, সেগুলিকে মেরে ফেলার জন্যে নির্দেশ দিচ্ছি।
স্যার, আমি আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না।
বুঝতে না পারার কোনো কারণ তো দেখছি না। আণবিক ব্লাসটার দিয়ে ওদের মেরে ফেলুন।
এই জাতীয় নির্দেশ আপনি একা-একা দিতে পারেন না, স্যার। বিজ্ঞান একাডেমির অনুমোদন লাগবে।
মহাকাশযান যদি কোনো বিপদের মুখে পড়ে, তাহলে সর্বাধিনায়ক হিসাবে একাডেমির অনুমোদন ছাড়াই আয়ি যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারি আইনের এই ধারাটি মনে আছে?
জি স্যার, আছে?
বেশ। এখন যা বলেছি করুন। দায়িত্ব শেষ করবার পর আপনি নিজে এসে আমার সঙ্গে দেখা করবেন।
ঠিক আছে, স্যার।
আরেকটি কথা, আপনার কাছ থেকে আমি একটি লিখিত জবাবদিহি চাই।
স্যার, আমি বুঝতে পারছি না আপনি কী চাচ্ছেন।
আমি জানতে চাই, ঠিক কী কারণে আমার নির্দেশ পাওয়া সত্ত্বেও আপনি তা মানতে দ্বিধাবোধ করলেন, বিজ্ঞান একাডেমির প্রশ্ন তুললেন।
স্যার, আমি ভাবলাম এগুলি দুর্লভ প্রাণী হতে পারে। মেরে ফেলাটা হয়তো ঠিক হবে না।
এগুলি দুর্লভ প্রাণী নয়। আমরা মাত্র দু ঘণ্টার মধ্যে তিনটি প্রাণী ধরেছি।
আমরা ধরি নি স্যার। ওরা নিজ থেকে ধরা দিয়েছে।
হুঁ। আপনার নাম কি?
আমার নাম সুগিহারা স্যার। আমার ক্রমিক নম্বর ফ-২৩৭।
সুগিহারা, প্রাণীগুলিকে কি দেখেছেন?
দেখেছি স্যার।
এ জাতীয় কুৎসিত প্রাণীর জন্যে আপনার এত মমতার কারণ কি?
প্রাণীগুলি দেখতে কেমন, সেটা বড় কথা নয়। আলফা সেঞ্চুরির সুসভ্য প্রাণীরা অত্যন্ত সুদর্শন ছিল।
সুগিহারা।
জি, স্যার।
আপনি প্রাণীগুলিকে মেরে ফেলুন। আর আপনাকে যে কৈফিয়ত দিতে বলেছিলাম, তা দেবার প্রয়োজন নেই।
ঠিক আছে, স্যার।
হঠাৎ প্রচণ্ড শক্তিশালী ওমিক্রন রশির দুটি ধারা প্রাণীদের উপর ফেলা হল। সিলঝিন নির্মিত খাঁচাটি অসহনীয় উত্তাপে দেখতে দেখতে মোমর মতো গলে গেল।
সুগিহারা নিজে গিয়ে কিম দুয়েনের কাছে খবর দিল, আণবিক ব্লাস্টার ব্যবহার করা হয়েছে। সুগিহারার মুখ স্নান চোখ বিষন্ন। ক্যাপ্টেন সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করল। সহজ সুরে বলল, মানুষকে প্রায়ই অনেক হৃদয়হীন কাজ করতে হয়। সুগিহারা কিছু বলল না। কিম দুয়েন খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, কিছু বলতে চান আমাকে।
জ্বি স্যার, চাই।
বলুন। প্রাণীগুলি মারা যায় নি। ওমিক্রন রশ্মি ব্যবহারের পরেও বেঁচে আছে।
মহাকাশযান গ্যালাক্সি-ওয়ানের বিপদ সংকেতসূচক ঘন্টা বাজতে শুরু করল।