সান্ধ্য আসরে একদিন
সান্ধ্য আসরে একদিন তারানাথকে বললাম, আপনার ছোটবেলার গল্প বলুন। শুনতে ইচ্ছে করছে।
তারানাথ হেসে বলল, তোমাদের কথায় অনেকদিন বাদে মনে পড়ল আমারও একটা ছোটবেলা ছিল বটে। মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হয়েই বাউণ্ডুলে নই। কি গল্প শুনতে চাও?
দেখলাম তারানাথের চোখ কেমন স্বপ্রিল আর ভাসা-ভাসা হয়ে এসেছে। শৈশবের স্মৃতি সব মানুষকেই উদাস করে দেয়। কিশোর বলল—যা ইচ্ছে বলুন। তুচ্ছ ঘটনাও আপনার বলার গুণে ভাল লাগে। আচ্ছা, আপনার পরবর্তী জীবন যে এইরকম হবে, ছোটবেলায় তার কোনো আভাস পাননি?
উত্তরে তারানাথ কিশোরীর দিকে তাকিয়ে বলল, আমার সিগারেট ফুরিয়ে গিয়েছে।
তৎক্ষণাৎ কিশোর বেরিয়ে গিয়ে মোড়ের দোকান থেকে একবাক্স সিগারেট এনে তারানাথের সামনে নামিয়ে রাখল। একটা সিগারেট ধরিয়ে চোখ বুজে তৃপ্ত মুখে ধোঁয়া ছেড়ে তারানাথ বলল, সত্যি কথা বলতে কি, আজ দুদিন একটা পয়সাও আমদানি হয়নি। না হাত দেখা না স্বস্ত্যয়ন, না কিছু সংসারের নৌকো একেবারে বালির চড়ায় ঠেকে গিয়েছে। তাই আর লজ্জ করলাম না, সিগারেটটা চেয়েই নিলাম–
কিশোর বলল, পৃথিবীতে কিছু না দিলে কিছু পাওয়া যায় না। গল্প শোনারও একটা দক্ষিণা আছে বইকি৷ আপনি রোজ রোজ গল্প বলবেন, আর পরিবর্তে আমরা কিছুই দেব না?
তারানাথ হেসে বলল, ভাল। তোমার দেওয়াটা তুমি সুন্দর কথা দিয়ে ঢেকে দিলে। ফকিটা ধরতে পারলাম বটে, তবুও আমার নেওয়ার লজ্জাটা ঢাকা পড়ল। বেশ, কথকের দক্ষিণ বলেই নিলাম না হয়।
বাইরে শেষ বিকেলের আলো গাঢ় হয়ে এসেছে। বৈঠকখানার জানালা দিয়ে কিছুক্ষণ বাইরে তাকিয়ে থাকল তারানাথ, তারপর একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ছোটবেলার কথা মনে পড়লে বুকের ভেতরটা কেমন করে। কোথায় গেল সেইসব সবুজ মাঠ, মুক্ত হওয়া, আমতলায় ছুটোছুটি করে বেড়াবার দিন? আর এই এখন কোথায় পড়ে আছি দেখ-নোংরা পরিবেশ, ঘরের মধ্যে দিনের বেলা অন্ধকার, নর্দমা থেকে পাকের গন্ধ ভেসে আসে সারাদিন। নাঃ, সে-সব দিন আর ফিরবে না, ফেরে না।
তারপর সবকিছু ঝেড়ে ফেলবার ভঙ্গিতে হাত নেড়ে তারানাথ বলল—যাক্, যা গিয়েছে তা তো আর ফিরবে না। বরং আমার স্মৃতিতেই সমস্ত উজ্জ্বল হয়ে থাক।
সিগারেট শেষ করে ছাইদানী হিসেবে ব্যবহৃত একটা নারকেলের মালার মধ্যে গুজে দিয়ে তারানাথ বলল, একটা ঘটনা বলি শোন। বহুদিন আগেকার কথা, আমার আট-নয় বছর বয়সের। একে ঠিক অলৌকিক বা অপ্রকৃত ঘটনা বলা যায় কিনা জানি না, কারণ বাহ্যত তেমন কোন কাণ্ড ঘটেনি। তবে শ্রেণীবিভাগ না করতে পারলেও গল্পটা তোমাদের ভালই লাগবে।
তোমরা তো জানো আমি গ্রামের ছেলে। বিরাট ধনী না হলেও আমাদের অবস্থা নিতান্ত খারাপ ছিল না। ঠাকুর্দার তো ছোটখাটো একটা তালুকই ছিল। আমি সংসারী। হওয়ায় আমার দুই ভাই বাবার মৃত্যুর পর সব নষ্ট করে ফেলে।
ঠাকুর্দা ছিলেন ভয়ানক রাশভারী মানুষ। সমস্ত বৈষয়িক ব্যাপার তিনিই দেখতেন। তিনি বেঁচে থাকতে বাবা কেবল মাছ ধরে বেড়াতেন, আর কিছু করবার ছিল না বলে। ঠাকুর্দা যে কেবল পয়সা চিনতেন বা মামলা করে বেড়াতেন তা নয়। তার ঘরে অনেকগুলো সেকেলে ধরনের আলমারিতে ঠাসা ছিল নানা ধরনের বই। হাতে-লেখা পুথিও ছিল কত তখন বোঝবার বয়স হয়নি, এখন আন্দাজ করতে পারি কি অমূল্য সম্পদ ছিল সেই সব বই। কিন্তু সে সমস্তও আমার ভাইয়েরা নষ্ট করেছে। কে কোথা দিয়ে নিয়ে গিয়েছে তা আর বলা সম্ভব নয়। রোজ রাত্তিরে ঠাকুর্দা লণ্ঠনের আলোয় বসে পড়াশুনো করতেন। কথা বলতেন কম, কিন্তু যখন বলতেন বোঝা যেত যে বিষয়ে বলছেন তাতে তার গভীর জ্ঞান রয়েছে। নিদারুণ ব্যক্তিত্ব ছিল। কারো সঙ্গে মতবিরোধ হলে তিনি ঝগড়াও করতেন না, যুক্তিও দেখাতেন না—কেবল মুখ থেকে ফরসীর নলটা নামিয়ে তার দিকে ঠাণ্ডা চোখে স্তাকিয়ে থাকতেন। তাতেই কাজ হত।
আমি ছিলাম সবার আদরের ছেলে। কাকারা তখনো বিয়ে করেননি—আমার ভাইয়েরাও জন্মায়নি। কোনো কিছু ভাগ করে নেবার অভ্যেস হয়নি তখনো। এই সময় আমাকে নিয়ে বাড়ির সবাই খুব বিব্রত হয়ে পড়ল।
বললাম, কেন?
তারানাথ বলল, সেইটেই গল্প। মনোযোগ দিয়ে শোন। আট বছর বয়েস থেকে আমার হঠাৎ এক অদ্ভুত জ্বর আরম্ভ হল। খেলাধুলো করে এসে রাত্তিরে ঠাকুমার পাশে শুয়ে রূপকথা শুনছি, হঠাৎ ঠাকুমা বললেন—দেখি, তোর গা যেন গরম-গরম লাগছে—
হাতের উল্টোদিক দিয়ে কপাল আর গলা দেখে বললেন, হ্যাঁ, তোর বেশ জ্বর হয়েছে। কি করে হল? চুরি করে আচার খেয়েছিলি?
বললাম, না তো!
—তাহলে জ্বর হল কেন? যা গে, আজ রাত্তিরে তোর ভাত খেয়ে কাজ নেই। দুধসাৰু করে দিচ্ছি, খেয়ে শুয়ে থাক। কাল দুপুরে রুটি খাবি। শরীর একটু টেনে গেলে জ্বর কমে যাবে এখন–
তাই করা হল। কিন্তু পর পর তিন দিন রোগীর পথ করার ফলেও জ্বর কমল। তখনকার যুগে লোকে কথায় কথায় ডাক্তার দেখাত না, আর গ্রামে-গঞ্জে অত ডাক্তারই বা কোথায়? বাবা কেবল একবার বললেন, ছেলেটা বড় দুষ্ট হয়েছে। টো টো করে ঘুরে অসুখটা বাধাল। ওকে একটু শিউলিপাতার রস খাইয়ে দিয়ো তো–
মোটের ওপর কেউ আমার অসুখটাকে বিশেষ অমিল দিল না। দেবার কথাও নয়। জ্বরজারি বাচ্চাদের হয়েই থাকে, আবার সেরেও যায়।
কিন্তু দিনদশেক বাদেও যখন আমার জ্বর কমল না, তখন সবার টনক নড়ল। ঠাকুর্দার কানে সহসা সংসারের কোনো খবর পৌঁছয় না, নিজের ঘরে বইপত্র আর দলিল-দস্তাবেজ নিয়ে মগ্ন থাকেন। আমার জ্বরের দশম দিনে ঠাকুর্দা এসে খাটের পাশে দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে গায়ের উত্তাপ দেখলেন। ঠাকুমা লম্বা ঘোমটা দিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, তাকে বললেন, আগে আমাকে খবর দাওনি কেন? তারপর বাবার দিকে ফিরে বললেন, কাল সকালে উঠে মহকুমা শহর থেকে জীবন ডাক্তারকে ডেকে আনবে–
বাবা ক্ষীণস্বরে বললেন, আজ্ঞে, জীবন ডাক্তার?
—হ্যাঁ। ঘোড়ার গাড়ি করে নিয়ে আসবে। আরো আগে আনা উচিত ছিল। টাইফয়েডে দাঁড়ালে কি হবে ভেবে দেখেছ?
বাবার মুখ শুকিয়ে গেল। তখন টাইফয়েড একটা কালান্তক রোগ বলে গণ্য হত। ব্যাকটিরিও ফাজ আবিষ্কার হয়নি। শুধু জলচিকিৎসা হত। বাবা পরের দিনই দুপুরের মধ্যে শহর থেকে বড় ডাক্তার নিয়ে এলেন। ডাক্তারবাবু বুকে নল বসিয়ে, পেট টিপে, জিভ দেখে এবং মা আর ঠাকুমাকে অনেক প্রশ্ন করে তারপর বললেন, টাইফয়েড বলে মনে হচ্ছে না।
বাবা জিজ্ঞাসা করলেন, ম্যালেরিয়া?
—উঁহু। কাঁপুনি নেই, লিভার-টিভার নয়—জুরও তো একই ভাবে চলছে ছাড়ছে না। ম্যালেরিয়াও নয়—
-তাহলে?
–বলতে পারছি না। আরো ক’দিন দেখতে হবে। একটা থার্মোমিটার কিনে রাখুন, রোজ তিন-চারবার জ্বর দেখে লিখে রাখবেন। আপাতত একটা ওষুধ লিখে দিয়ে যাচ্ছি, সেটা খেয়ে কেমন থাকে জানালে তারপর দেখা যাবে।
অর্থাৎ আন্দাজে চিকিৎসা শুরু হল। এই সবে আরম্ভ, এর পরে কত যে ডাক্তার এল আর কত যে ওষুধ খেলাম তার ইয়ত্তা নেই। পেটের মধ্যে ডাক্তারখানা খোলবার যোগাড় করে ফেললাম। কিন্তু বিচিত্র জ্বর কিছুতেই কমল না। প্রায় দু’মাস হয়ে গেল। আমি তখন হাড়সার রোগ হয়ে গিয়েছি, মুখের ভেতর একটা তেতো স্বাদ সব সময় থাকে। জানালার ধারে শুয়ে দেখি গ্রামের হরেন, রামু, শিবেন—এরা সবাই গুলতি হাতে পাখি মারতে যাচ্ছে কিংবা ছিপ হাতে চৌধুরীদের পুকুরের দিকে চলেছে। আমাকে দেখে ওরা জিজ্ঞাসা করে, কিরে, জ্বর কমল?
আমি মাথা নাড়ি। ওরা চলে যায়।
মা আর ঠাকুমা প্রায় খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। বাবার থমথমে মুখ দেখলে আমার বুকের মধ্যে কেমন করে। এর ভেতর একদিন তিনি কোলকাতা থেকেও বড় ডাক্তার ধরে আনলেন। সবই হল, কিন্তু আমার অসুখ সারল না। জ্বর খুব একটা বাড়ে না, কিন্তু গায়ে থেকেই যায়—ছেড়ে যায় না একেবারে। ওঃ, সে বড় ভয়ানক সময় গিয়েছে। একদম কাহিল হয়ে পড়েছিলাম। বিছানা থেকে উঠে দাঁড়া বার ক্ষমতা ছিল না। প্রথম দিকে ঠাকুমা কোলে করে বাথরুমে নিয়ে যেতেন, তারপর থেকে ওগুলো বিছানাতেই সারতে হত। আমার কোনো মৃত্যুভয় হয়নি, কারণ ওই বয়েসে শিশু মৃত্যুকে চেনে না। কেবল খেলতে যেতে পারি না বলে, বাড়ি থেকে বেরুতে পারি না বলে মন খারাপ লাগত।
একদিন কেবল ভয় পেয়েছিলাম। বিকেলের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছি—তখন আমার ঘুমোবার সময়ের কোনো ঠিক ছিল না, সব কেমন উলটোপালটা হয়ে গিয়েছিল। সারাদিনই শুয়ে থাকা তো—যখন-তখন ঘুমিয়ে পড়তাম। একদিন বিকেলে জেগে উঠে দেখি আধো অন্ধকার ঘরে মা রয়েছেন। ভয় পেয়ে বলে উঠলাম, মা, কি হয়েছে?
মা প্রথমে উত্তর দিতে পারলেন না—এখন বুঝতে পারি কান্নায় তার গলা বুজে গিয়েছিল। উত্তর না পেয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম, কি হয়েছে? তোমরা আমন করে তাকিয়ে রয়েছে কেন?
ঠাকুমা এগিয়ে এসে আমাকে বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরে বললেন, কিছু হয়নি, চিৎকার করছিস কেন? থাম, শরীর অস্থির করবে
-–মা কথা বলছে না কেন?
—পুজো করতে যাবে কিনা, তাই এই তো চান করে এল, আজ যে বৃহস্পতিবার। পুজো না করে কথা বলতে নেই–-
তখনকার মত চুপ করে গেলাম বটে, কিন্তু আমার বালকমনে ঘটনাটা গভীর ছাপ ফেলল। জুরের ঘোরে ঘুম থেকে উঠলে এমনিতেই মস্তিষ্ক যথাযথ কাজ করে না, তার ওপর অন্ধকার ঘর—মায়ের আমনভাবে তাকিয়ে থাকা—এই প্রথম আবছাভাবে অনুধাবন করতে পারলাম আমার জটিল কিছু একটা হয়েছে, এবং সেজন্য বাড়ির সবাই খুব চিন্তিত।
দু-মাস হয়ে যাবার পর ঠাকুর্দা বাবাকে আবার কোলকাতা পাঠালেন। যে বড় ডাক্তার আমাকে একবার দেখে গিয়েছিলেন তাকে আবার নিয়ে আসা হল। ডাক্তারবাবু অনেকক্ষণ ধরে আমাকে দেখলেন, নানারকম জিজ্ঞাসাবাদ করলেন, তারপর চুপ করে বসে রইলেন।
খাটের এধারে ঠাকুমা দাঁড়িয়েছিলেন, তিনি বললেন, কেমন বুঝলেন ডাক্তারবাবু?
ডাক্তার হাত জোড় করে বলেন, আমাকে আর লজ্জা দেবেন না। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। সব রকম পরীক্ষা হয়ে গিয়েছে, জ্বর ছাড়া অন্য কোনো উপসর্গও নেই। এ অবস্থায় কি চিকিৎসা করব? অন্য ডাক্তার হলে লজ্জা বাঁচানোর জন্য যাহোক কিছু প্রেসক্রিপশন করে দিয়ে যেত। কিন্তু তা করতে আমার বিবেকে বাধে।
অনেক অনুরোধেও তিনি ফী নিলেন না। বললেন, না মশাই, টাকা নিতে পারব। না। এখনও পুরোপুরি চশমখোর হতে পারিনি। যদি একান্তই না ছাড়েন, তবে আমার ফেরবার ভাড়াটা বরং দিন।
গ্রাম্য বাঙালী পরিবারের যা বৈশিষ্ট্য, এরপর সবাই দৈব ওষুধের সন্ধানে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। নারাণপুরে কে নাকি ঠাকুর পেয়েছে, সেখানে গিয়ে ধর্না দিলে ওষুধ পাওয়া যায়। নারাণপুর আমাদের গ্রাম থেকে প্রায় কুড়ি-পঁচিশ মাইল দূরে। অন্য কেউ গেলে হবে না, রোগীকেও অবশ্যই যেতে হবে। তা অম্লশূলের বা মৃগীর রোগী হলে না হয় গেল, কিন্তু দু মাস ভুগে আমি তখন বিছানা ছেড়ে উঠতে পারি না, আমি অত পথ যাব কি ভাবে?
বাবা ভেবে ভেবে উপায় বের করলেন। ঘোড়ার গাড়িতে যেতে পারব না, কারণ ঝাঁকুনিতেই মরে যাব তাহলে। বাবা বললেন, ওকে পালকিতে করে নিয়ে যাব। দাঁড়াও পালকির ব্যবস্থা করি।
পালকিতে আমাকে নিয়ে ঠাকুমা চললেন, বাবা-ঠাকুর্দা পেছন পেছন এলেন গরুর গাড়িতে। মন্দিরের ভেতর ঠাকুমার কোলে সারারাত শুয়ে রইলাম। সেসময় অতিরিক্ত ভুগে আমার যেন মাথার মধ্যে কেমন গোলমাল হয়ে গিয়েছিল। প্রায়ই রাত্তিরবেলা আবোলতাবোল স্বপ্ন দেখতাম। এখানেও শেষরাত্তিরে কি একটা হিজিবিজি স্বপ্ন দেখলাম, তার কোনো মাথামুণ্ডু নেই—এমন কি সকালে মনেও করতে পারলাম না। সেবায়েৎ সকালে জিজ্ঞাসা করল, কিছু আদেশ-টাদেশ পেয়েছ খোকা?
আদেশ কাকে বলে? ঘাবড়ে গিয়ে বললাম, আজ্ঞে না তো, তবে একটা স্বপ্ন দেখেছি—
—কি স্বপ্ন?
–তা এখন আর মনে পড়ছে না।
সেবায়েৎ বলল, তা যাক গে, ওই দেখলেই হবে।
কি সব পুজো দেওয়া হল, একটা মাদুলি ঝুলিয়ে দেওয়া হল আমার হাতে। সেবায়েৎ কোশায় করে অনেকখানি চরণামৃত এনে আমাকে হাঁ করিয়ে খাইয়ে দিল। তাতে বহুদিনের ফুলবেলপাতার গন্ধ।
আবার পালকি করে বাড়ি। মাদুলিতে কি ফল হল তা বুঝতে পারা গেল না, কিন্তু চরণামৃত খেয়ে জ্বরের ওপর আমার হল ভয়ানক পেটখারাপ। অসুখ চলতেই লাগল। দিনদশেক বাদে বাবা একদিন টান দিয়ে মাদুলিটা ছিড়ে বাইরে ফেলে দিলেন।
একদিন—সময় সন্ধ্যেবেলা—পরিষ্কার মনে পড়ছে দৃশ্যটা, ঠাকুর্দা এসে আমার বিছানার পাশে দাঁড়ালেন। বাবা বাইরের কাজকর্ম সেরে আগে থেকেই এসে বসেছিলেন। ঠাকুর্দা কিছুক্ষণ চুপ করে আমাকে দেখে বললেন, কেমন আছিস আজ?
ভুগে ভুগে কেমন আছি বোঝবার ক্ষমতা লুপ্ত হয়েছিল। তাই বললাম, ভাল আছি।
ঠাকুর্দা বললেন, হু। তোর জন্য একটা পুজো করা হবে, বুঝলি? তাহলেই তোর অসুখ সেরে যাবে।
বাবা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, পুজো? কি পুজো?
ঠাকুরদা আমার পায়ের কাছে বিছানায় বসলেন, বললেন, কাল রাত্তিরে পড়তে পড়তে একটা জিনিস পেলাম—ভগবানই পাইয়ে দিলেন বলতে পার। আমার ঠাকুর্দা নরনাথ ঘোর তান্ত্রিক ছিলেন, তা তো তোমরা জানোই। তন্ত্রসাধনার ওপর অনেক বই ছিল তার। তার মধ্যে বেশির ভাগই হাতে লেখা পুথি। কিছু কিছু নষ্ট হয়েছে, কিছু চুরি গিয়েছে—আবার কিছু রয়েও গিয়েছে। তারই একটা বই পড়তে গিয়ে কাল রাত্তিরে একটা ঘটনা পড়লাম, বুঝলে?
ঠাকুমা বললেন, কি?
—লেখক বলছেন, যদি কারও দীর্ঘদিন ধরে কালান্তক জ্বর চলতে থাকে, এবং কিছুতেই সে জ্বর না সারে তাহলে বুঝতে হবে তাকে জ্বরাসুরে আক্রমণ করেছে।
–জ্বরাসুর আবার কে?
ঠাকুর্দা বিব্রত হয়ে বললেন, সে তোমাকে বোঝানো কঠিন হবে। জ্বরাসুরকে দেবতাও বলতে পার, আবার উপদেবতাও বলতে পার। এরা শুধু অনিষ্টই করতে পারে। পুঁথিতে লিখছে জ্বরাসুরের বিধিমত পুজো করলে জ্বর কমে যায়।
ঠাকুমা শঙ্কিত গলায় বললেন, না, ও পুজো তোমায় করতে হবে না।
ঠাকুর্দা বললেন, কেন?
—না, ওসব ঠাকুরের নামই শুনিনি কখনো। আর কিবা নামের ছিরি, শুনলেই শরীর হিম হয়ে আসে। দরকার হলে চেনাজানা ভাল ঠাকুরের পুজো করো—ও তোমায় করতে হবে না।
ঠাকুর্দা বাধা পেয়ে রেগে গেলেন। তিনি কারো পরামর্শে মত বদলাবার পাত্র ছিলেন না, নিজে যা ভাল বুঝতেন তাই করতেন। বললেন, ব’কো না, আমি কি আমার নাতির খারাপ চাই। আমি ঠিকই করছি। আমার ঠাকুর্দার পুঁথি, বহুদিন আগেকার মস্ত এক সাধকের লেখা। তা কি কখনো ভুল হতে পারে? ভগবান পাইয়ে দিয়েছেন।
—তা এ পুজো করবে কি করে? মন্তর-তত্তর পাবে কোথায়?
ঠাকুর্দা খুশি হয়ে বললেন, ওইটেই তো মজা! জ্বরাসুরের পুজোর সমস্ত বিধি ওই বইতেই সংস্কৃতে লেখা রয়েছে। দেখবে? দাঁড়া ও, দেখাই–
একটু বাদেই ঠাকুর্দা তার পুথি নিয়ে ফিরে এলেন। পুরনো দিনের হাতে তৈরি কাগজের পুথি, তাতে মোটা খাগের কলমে কালো কালিতে লেখা অক্ষর। বলা বাহুল্য, মা বা ঠাকুমা কেউই বিন্দুবিসর্গ বুঝলেন না—কিন্তু ঠাকুর্দা মহা উৎসাহে গড়গড় করে দুর্বোধ্য সংস্কৃত পড়ে গেলেন অনেকখানি। তারপর এক জায়গায় থেমে গিয়ে বললেন—এই হল পুজোর নিয়ম আর মন্ত্র, বুঝতে পারলে তো?
দেবভাষার মোহ বড় সাংঘাতিক। ঠাকুমা মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানালেন। ঠাকুর্দা বললেন, আমার ভাগ্যও খুব ভাল। ঠিক এর পরেই পুঁথির এই পাতাটা কিছুটা পুড়ে গিয়েছে। এই দেখ—
দেখলাম সত্যিই পাতার অর্ধেকটা কিভাবে যেন পুড়ে গিয়েছে বটে।
ঠাকুর্দা বললেন, তাতে অবশ্য কোনো ক্ষতি হবে না। পোড়া জায়গায় আগেই পূজাবিধি সম্বন্ধে লেখাটা শেষ হয়ে গিয়েছে। আর বারোদিন বাদে অমাবস্যা, ওদিনই পুজো দেব।
বাবাকে বললেন, হরিশ কুমোরকে খবর দিস তো কাল আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য—ঠাকুর গড়াতে দিতে হবে।
বাবা বললেন, ঠাকুরও গড়ানো হবে নাকি?
–তা হবে বইকি! নইলে পুজো হবে কি করে?
–কেমন ঠাকুর?
ঠাকুর্দা একটু কেশে বললেন—ইয়ে, পুঁথিতে যা বর্ণনা রয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে। জ্বরাসুরের চেহারা-মানে, খুব একটা সুন্দর নয় আর কি। তা সে আর কি করা যাবে—
পরের দিন হরিশ কুমোর এসে হাজির হল। ঠাকুর্দা আদৌ ভূমিকা না করে তাকে। বললেন, তোমাকে একটা নতুন ধরনের মূর্তি বানিয়ে দিতে হবে পুজোর জন্য। পারবে তো?
—আজ্ঞে, কিসের মূর্তি?
–জ্বরাসুরের।
–জ্বরাসুর? সে কি জিনিস?
ঠাকুর্দা তাকে ব্যাপারটা আদ্যোপান্ত বুঝিয়ে দিলেন। সময় নেই মোটে। এগারো দিনের মধ্যে শেষ করতে হবে। বারোদিন পরে পুজো।
-–কর্তামশাই, মূর্তি দেখতে কেমন হবে?
ঠাকুর্দা একটু ইতস্তত করে বললেন, তিনটে মাথা হবে, বুঝলে? ছটা পা, ছটা হাত—পেছনে একটা মোটা ল্যাজও থাকবে।
—আজ্ঞে–ল্যাজ?
—হ্যাঁ। ল্যাজে আর গায়ে বড় বড় কাটা। গায়ের রঙ ঘোর কালো। তিনটে লালরঙের বড় বড় চোখ হবে, তার ভেতর একটা চোখ থাকবে কপালে। লাল জিভ বের করে দাঁড়িয়ে আছেন জুরাসুর। কি, পারবে তো?
একটা নিঃশ্বাস ফেলে হরিশ বলল, আজ্ঞে পারব। তবে কথা হচ্ছে কি, এ পুজো কি না করলে হত না? কেমন কেমন ঠেকছে যেন
—আরে রাখ তো, তুমিও দেখি মেয়েদের মত আরম্ভ করলে। যে রোগের যে ওষুধ, বুঝলে না? যাও, কাজ করো গে—
জ্বরাসুরের পুজো নাকি বসতবাড়ির ভেতরে করতে নেই। তাই আমাদের বাড়ির বাইরে যে করে দিল হরিশ কুমোর। ইতিমধ্যে গ্রামে এবং গ্রামের বাইরে রটে গিয়েছে ঠাকুর্দা নাতির অসুখের জন্য কি এক বিকট মূর্তি বানিয়ে পুজো করছেন। রোজ সকাল থেকে সামিয়ানার তলায় ব্যাপারটা চাক্ষ দেখবার জন্য ভিড় লেগে থাকত। হরিশ কুমোরও ওস্তাদ লোক। এখন বুঝি মানুষটা খাটি শিল্পী ছিল। কেবলমাত্র বর্ণনা শুনে অভূতপূর্ব কিছু সৃষ্টি করা চাট্টিখানি কথা নয়। সুন্দরকে যে সৃষ্টি করে সে যেমন বড় শিল্পী, আবার ভয়ানক বীভৎস রস যে সৃষ্টি করতে পারে সেও বড় শিল্পী বইকি। হরিশ মাথা ঘামিয়ে এমন এক বিকট মূর্তি তৈরি করল, যা দেখে পুজোর দিন আমার হৃৎকম্প উপস্থিত হয়েছিল।
এদিকে সব আয়োজন মোটামুটি হয়ে গেল। শুধু পুরুত ঠিক করা বাকি। ঠাকুর্দা নিজেই পুজো করবেন ঠিক করেছিলেন কিন্তু এবার ঠাকুমা স্বমূর্তি ধরে ঝাঝালো গলায় জানিয়ে দিলেন যে ঠাকুর্দা বিপত্নীক হবার পর যা খুশি তাই করতে পারেনতার আগে নয়। ঠাকুর্দা—সামান্য হলেও—ঠাকুমাকে ভয় করতেন। ফলে তিনি গ্রামের তিন-চারজন পুরুত বামুনের থেকে বেছে বেছে সবচেয়ে দরিদ্র রামজীবন চক্রবর্তীকে পাকড়াও করলেন। তখন জ্বরাসুরের মূর্তি প্রায় তৈরি হয়ে এসেছে। সে বেচারি ঠাকুরের চেহারা দেখে ঘাবড়ে গিয়ে বলল—আজ্ঞে, এ আমার সাধ্যে কুলোবে না—
ঠাকুর্দা কার্যোদ্ধারের নানা বাস্তব উপায় জানতেন। তার মধ্যে সবচেয়ে ফলদায়ী উপায়টি প্রয়োগ করলেন। ঠাণ্ডা গলায় বললেন, ও, তোমার অসুবিধে হবে বলছ? থাক তাহলে। জোর করে কাউকে দিয়ে কোন কাজ করানো উচিৎ নয়—বিশেষত পুজো-আচ্চা। সাঁতরাগাছি থেকেই তাহলে পুরুত আনাতে হবে দেখছি। আসলে অনেকগুলো কাপড়, থালা-বাসন, ফলফলাদি—তাছাড়া এক মুঠো টাকা দক্ষিণা-এসব বাইরের গ্রাম থেকে এসে কেউ নিয়ে যাবে— এটা চাই না বলেই তোমাকে বলছিলাম। বরং দক্ষিণা কিছু বেশি লাগলেও গ্রামের পুরুত করলেই ভাল হত। তা তোমার যখন অসুবিধে–
রামজীবনের দুই বয়স্ক মেয়ে তখনও অবিবাহিতা। একমাত্র ছেলে পড়াশুনা এবং পৈতৃক ব্যবসা ছেড়ে গ্রামে গ্রামে সখের যাত্রা করে বেড়ায়। কাজেই রামজীবন ইতস্তত করে বললেন—আজ্ঞে না, অসুবিধে আর কি! তবে নিয়মকানুন জানিনে, তাই—এ পুজো তো বড় একটা হয় না।
—নিয়ম আমি তোমাকে বলে দেব।
তিনদিন ঠাকুর্দা পুঁথি নিয়ে বসে সকাল-সন্ধা রামজীবনকে বোঝালেন। শেষদিন বললেন—এবার একটা দরকারী কথা বলি, শোন। এ ঠাকুরের মূর্তি কিন্তু বিসর্জন হবে না।
রামজীবন বললেন—বিসর্জন হবে না? তবে কি থাকবে?
—না, থাকবেও না।
—তবে?
ঠাকুর্দা কিছুক্ষণ চুপ করে বোধ হয় ভাবলেন কিভাবে ব্যাপারটা বললে ভাল হয়। তারপর বললেন, রামজীবন, পূজো হয়ে গেলে জুরাসুরের মূর্তিটা গলিয়ে ফেলতে হবে।
গলিয়ে ফেলতে হবে! মানে, ওপর থেকে জল ঢেলে মাটি গলিয়ে—
বাধা দিয়ে ঠাকুর্দা বললেন, জল দিয়ে নয়, রক্ত দিয়ে।
—রক্ত!
-হ্যাঁ। বলির পশু আগে থেকেই এনে রাখতে হবে। পুজো হয়ে গেলে একের পর এক বলি পড়বে, আর সেই রক্ত দিয়ে স্নান করানো হবে ঠাকুরকে। বলি চলবে যতক্ষণ না সমস্ত মাটি গলে কাঠামো বেরিয়ে পড়ছে। যত পশু লাগে লাগুক।
রামজীবন নির্বাক হয়ে বসে রইলেন। ঠাকুর্দা বোধ হয় তার মনের ভাব বুঝতে পেরেছিলেন, হাত দুটাতে জড়িয়ে ধরে বললেন, রামজীবন, আপত্তি করো না ভাই। আর তোমাকে টাকার লোভ দেখাব না। আমার নাতির অসুখ—তার কথা ভাবো। আমার বিশ্বাস এ পুজো না করলে সে বাচবে না। রাজী হও ভাই—
মাথা নিচু করে রামজীবন বললেন, ভয় পাবেন না। কথা যখন একবার দিয়েছি, কোনো কারণেই আর ফেরত নেব না। আপনার নাতিকে আমি আশীর্বাদ করছি—
এইভাবে অমাবস্যা এল। ভোর থেকে বাইরে পুজোর জায়গায় জোড়া ঢাক বাজছে। আগের রাত থেকে বাড়ির কেউ আর ঘুমোয় নি। মা এবং ঠাকুমা সারারাত জেগে পুজোর সাজ করে দিয়েছেন। সাধারণত সে সময়ে কারও বাড়ি কোনো কাজ উপস্থিত হলে পাড়ার সবাই সাহায্য করতে আসত। কিন্তু জ্বরাসুরের মূর্তি দেখে কারও সে সদিচ্ছা জাগেনি। তবে আগে না এলেও পূজোর দিন সকাল থেকেই আশেপাশের চার-পাঁচখন গ্রাম থেকে লোকজন এসে ভিড় করল। তাদের মধ্যে মূর্তির সামনে কুশাসনের ওপর স্নান করে গরদের কাপড় পরে বসে আছেন রামজীবন চক্রবর্তী। তার হাতে কোষ্ঠীর মত গোল করে পাকানো কাগজ—তাতে তিনি ঠাকুর্দার।
পুথি থেকে পুজোর মন্ত্র নকল করে নিয়েছেন।
বেলা নটা নাগাদ ঠাকুর্দা আমার বিছানার পাশে এসে কপালে হাত দিয়ে জ্বর দেখলেন। তারপর নরম গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, খুব কি কষ্ট হচ্ছে দাদু?
বললাম, হ্যাঁ।
মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ঠাকুর্দা বললেন, আর ভয় নেই। এইবার সেরে যাবে। নে, ওঠ দেখি—আমার সঙ্গে চল—
ঠাকুমা বললেন, না না, ওকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? ও এখানেই থাক—
ঠাকুর্দা মৃদু গলায় বললেন, কিন্তু পুজোর জায়গায় ওকে থাকতে হবে যে।
—না, ও যাবে না—
ঠাকুর্দা আমার মায়ের দিকে ফিরে বললেন, বৌমা, ওঁকে বঝাও তো বলে যে আমার নাতিকে আমি কারও চেয়ে কম ভালবাসি না।
মা চুপ করে রইলেন।
আমি বিছানা থেকে কোনোমতে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, চল, আমি তোমার সঙ্গে যাব। বাড়ির পেছনদিকে খিড়কির পুকুর। তার পাড়ে এনে ঠাকুর্দা বাবাকে বললেন, যাও, ওকে ধরে চান করিয়ে দাও। হাত ধরে নামাও পৈঠা দিয়ে–
পরিবারের সবাই আপত্তি করার ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলেন। আমার গায়ে তখন কম করে একশ তিন জ্বর। বাবা বিনা বাক্যব্যয়ে আমাকে পুকুরে ডুব দিইয়ে আনলেন। ঠাকুর্দার হাতে গামছা আর নতুন কাপড় ছিল। সেই কাপড় পরে পূজোর জায়গায় গেলাম।
সব লোক যেন কেমন ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ঠাকুরের মূর্তির সামনে বসে ওপরদিকে তাকালাম।
এই প্রথম জ্বরাসুরের মূর্তির সঙ্গে চোখাচোখি হল।
ওঃ, কি ভয়ানক মূর্তিই না বানিয়েছে হরিশ কুমার। ঘোর কৃষ্ণবর্ণ শরীরে বড় বড় তিনটে ভাটার মত লাল চোখ। গায়ে পেরেকের মত খোঁচা খোঁচা কাঁটা। তিনটে মাথা, ছটা পা। পৃথিবীর সব কুশ্রীতাকে একত্র করে এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের জন্ম দিয়েছে এর স্রষ্টা।
বাবা-ঠাকুর্দা আগেই স্নান সেরে নিয়েছিলেন। তারা দুজনে আমার দু’পাশে বসলেন। পুজো শুরু।
চারদিকে বেদম ঢাকের আওয়াজ। ধুনোর ধোঁয়ায় চারদিক অন্ধকার। রামজীবন চক্রবর্তি দৃপ্তম্বরে মন্ত্রপাঠ করে চলেছেন। আমি দুর্বল শরীরে কোনোমতে আসনে বসে আছি মাত্র। ঠাকুর্দা একহাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে রয়েছেন।
ঘণ্টাখানেক বাদে পুজো শেষ হল। রামজীবন হেঁকে বললেন, সরে যাও সব এবার বলি
ঠাকুর্দা কত করেছিলেন আমার জন্যে। অত বড় মূর্তি গলাতে কত ছাগল বলি দিতে হবে তার ঠিক কি? কাজেই নিখুঁত দেখে বহু ছাগল যোগাড় করে রাখা ছিল। ঠাকুর্দার ইঙ্গিতে নিবারণ কামার রামদা হাতে এগিয়ে এসে কাজ শুরু করল।
সমবেত সবাই নির্বক আতঙ্কে তাকিয়ে দেখছে। অত মানুষ জড়ো হয়েছে সেখানে, কিন্তু এতটুকু শব্দ নেই কোথাও। জ্বরাসুরের শরীর বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে টাটকা রক্তের ধারা। সেই লাল রক্তে স্নান করে বিকট মূর্তিকে যেন বিকটতর লাগছে। একটু একটু করে ধুয়ে যাচ্ছে রঙ, গলে যাচ্ছে চোখ-মুখ-বিকৃত অর্ধগলিতাঙ্গে কি বীভৎস হাসি হাসছে দুঃস্বপ্নের দেবতা! বেশিক্ষণ তাকাতে পারলাম না, চোখ সরিয়ে নিলাম। পেছনে তাকিয়ে দেখি অনেকেই এ দৃশ্য সহ্য করতে পারেনি। কখন নিঃশব্দে পূজামণ্ডপ শূন্য হয়ে এসেছে। সেই শূন্যতার মধ্যে কেবল একটু বাদে বাদে উঠছে নামছে নিবারণ কামারের রামদা। তারও চোখ জুরাসুরের মত লাল হয়ে উঠেছে, সর্বাঙ্গে চকচকে ঘাম।
একসময় চারদিকের রঙিন থকথকে কাদার মধ্যে জুরাসুরের মূর্তির অবয়বহীন কাঠামোটা দাঁড়িয়ে রইল কেবল। আর সব নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। আমি এলিয়ে পড়েছি ঠাকুর্দার কোলের ভেতর। ঠাকুর্দা বুকের মধ্যে ধরে আমাকে বাড়িতে নিয়ে এলেন। আবার আমাকে বিছানায় শুইয়ে দেওয়া হল। অবস্থা দেখে ঠাকুমা আমার মাথা কোলে নিয়ে বসলেন, বাবা নিজে বাতাস করতে লাগলেন পাখা দিয়ে। মা চোখে আঁচল দিয়ে কাঁদছেন। কেবল ঠাকুর্দা অবিচলিত, তিনি তখনই আবার বেরিয়ে গেলেন। জ্বরাসুরের কাঠামোটা নদীর ধারে নিয়ে গিয়ে দাহ করে ফেলতে হবে। তাই নাকি নিয়ম।
কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার কি জানো—জ্বরাসুর জাগ্রত দেবতা বলেই হোক, বা ঠাকুর্দার দৃঢ় ইচ্ছাশক্তির ফল হিসেবেই হোক—সবাইকে অবাক করে পরদিন আমার জ্বর ছেড়ে গেল। গেল এবং আর এল না। তারপরও কিছুদিন বাড়ির সবাই ভয়ে ভয়ে থাকত, একটু বাদে বাদে আমার কপালে হাত দিয়ে দেখা হত। কিন্তু সত্যিই জ্বর আর এল না।
ঠাকুর্দার সম্মান দারুণ বেড়ে গেল। শুধু পরিবারের ভেতরে নয়, আশেপাশের বহু গায়ের লোক তাকে একজন বিচক্ষণ মহাপুরুষ বলে মনে করতে লাগল। সারাদিন। ধরে বিস্তর লোক নানান পরামর্শ নিতে আসত। ফুর্তির চোটে ঠাকুর্দা অর্ডার দিয়ে কাশী থেকে উৎকৃষ্ট অম্বুরী তামাক আনালেন। অবশ্য এ সম্মান বেশিদিন ভোগ করতে পারেননি তিনি। আমার জ্বর সারার ঠিক ছ’মাসের মাথায় ঠাকুর্দা মারা যান। যন্ত্রণাহীন মৃত্যু, কাউকে কষ্ট দিলেন না, বিছানাতেও পড়ে রইলেন না। একদিন সকালে তাকে ডাকতে গিয়ে দেখা গেল বিছানায় তার প্রাণহীন দেহ পড়ে। রাত্তিরে ঘুমের মধ্যে কখন প্রাণ বেরিয়ে গিয়েছে। বোধ হয় মৃত্যু আসন্ন অনুভব করে ইষ্টমন্ত্র জপ করছিলেন, কারণ ডানহাতের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দিয়ে কর ধরা ছিল। সবাই বলল—সন্ন্যাস রোগ। এইভাবে ঠাকুর্দা চলে গেলেন।
ঘটনাটা এইখানেই শেষ হতে পারত, কিন্তু হল না। বিধাতাপুরুষ বড় রসিক। আমি জানতাম না যে এই ঘটনার একটা বৃহত্তর উপসংহার রয়েছে। জানলাম প্রায় পচিশবছর পরে। তখন আমার অনেক সাধুসঙ্গ করা হয়ে গিয়েছে। পাকা ভবঘুরে তান্ত্রিক তখন। একদিন ঘুরতে ঘুরতে এক গ্রামের প্রান্তে একজন সাধুর মঠে আশ্রয় নিয়েছি সন্ধ্যেবেলা। বেশ সৌম্যদর্শন সাধু। ভারী ভাল ব্যবহার করলেন আমার সঙ্গে। তার আদেশে তার শিষ্যরা আমাকে যত্ন করে খাওয়াল রাত্তিতে। সুন্দর শোবার জায়গা করে দিল। পরদিন সকালেই আমি চলে যাব। তাই রাত্তিরে খাওয়ার পরে সাধুর কাছে তার আতিথেয়তার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিতে গেলাম। প্রাথমিক আলাপের পর নানা বিষয়ে কথাবার্তা আরম্ভ হল। অনেক রাত অবধি গল্প চলল, কথায় কথায় সাধুকে জ্বরাসুরের পুজোর ব্যাপারটা বললাম।
শুনে সাধু চমকে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, সে কি! তোমার ঠাকুর্দা জ্বরাসুরের পুজো করেছিলেন। সে যে বড় সাংঘাতিক দেবতা। তার কথা তোমার ঠাকুর্দা জানলেন কি করে?
বললাম, ঠাকুর্দার অনেক পুরনো পুঁথি ছিল। আমাদের পারিবারিক সম্পত্তি, তাতেই পেয়েছিলেন।
সাধু বললেন, কিন্তু সমস্ত বিবরণ পড়েও তিনি পুজোয় নেমেছিলেন? পুজোর সংকল্প কার নামে হয়েছিল? বললাম—ঠাকুর্দার নামেই। বাবা নিজের নামে করতে চেয়েছিলেন, ঠাকুর্দা রাজী
হননি—
—পুঁথিটা আস্ত ছিল?
এবার আমার মনে পড়ে গেল। বললাম, না, শেষের পাতার অর্ধেকটা কিভাবে যেন পুড়ে গিয়েছিল। অবশ্য তাতে কোনো ক্ষতি হয়নি—
সাধু বললেন, হয়েছে। ক্ষতি হয়েছে।
অবাক হয়ে বললাম, কি রকম?
সাধু উঠে গিয়ে ভেতর থেকে একটা পুথি নিয়ে এলেন। আমাকে বললেন, এই দেখ। আমার কাছেও একখণ্ড আছে। শেষ পাতা পুড়ে না গেলে ঠাকুর্দা দেখতে পেতেন, জ্বরাসুরের পুজোর নিয়মের শেষে সাবধান করে দিয়ে লেখা আছে—যার নামে সংকল্প হবে, ছ’মাসের মধ্যে তার মৃত্যু হবেই। ছ’মাস পরেই তো তোমার ঠাকুর্দা মারা গিয়েছিলেন বলছ?
আমি নির্বাক হরে বসে রইলাম। আজ কোথায় বা স্নেহময় ঠাকুর্দা, কোথায় বা ঠাকুমা—মা-বাবা? সব স্বপ্নের মত মিলিয়ে গিয়েছে।
একটু পরে বললাম, সাধুজী আপনার বোধ হয় একটু ভুল হচ্ছে—
উনি বিস্মিত হয়ে বললেন, ভুল?
–হ্যাঁ। ও পাতাটা আস্ত থাকলেও ঠাকুর্দা পুজো করতেন। আমি ঠাকুর্দার নয়নের মণি ছিলাম।
সাধু চুপ করে রইলেন।
আমিও আর কিছু বললাম না। কিন্তু আর একটা কথা আমার মনে ঘোরাফেরা করছিল। এখন তা আমার দৃঢ় বিশ্বাস। তা হচ্ছে এই যে, ঠাকুর্দা নিজেই ও পাতার শেষটা পুড়িয়ে ফেলেছিলেন। পাছে কেউ পড়ে ফেলে তাকে বাধা দেয়—তাই। আমাকে ঠাকুর্দা বড়ই ভালবাসতেন।
তারানাথ গল্প থামিয়ে চুপ করে রইল। জল চকচক করছে নাকি তার চোখে? এই প্রথম আমি আর কিশোর তারানাথের গল্পের শেষে বিশ্বাস-অবিশ্বাস নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠাতে পারলাম না।