এখনও বুকে ব্যথা
কিন্তু পাওয়া গেল। টেলিফোন ধরল নাগেশ্বর, হ্যালো।
আমি ঘটকমশাই বলছি, আপনি কে বলছেন?
আমি নাগেশ্বর। খুব চিন্তায় ছিলাম। ওরা দুর্ব্যবহার করেনি তো?
না না। আপনি সবাইকে নিয়ে বরযাত্রী হিসেবে চলে আসুন।
অ্যাঁ। সেকি! বরয়াত্রী যাব, তার মানে বিয়ে হচ্ছে?
হচ্ছে। দেরি করবেন না।
লাইন কেটে গেল। রিসিভার হাতে ধরে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে চিৎকার করে উঠল নাগশ্বের, ও গোরক্ষ, বরযাত্রীদের খবর দাও, যেতে হবে।
যেতে হবে? গোরক্ষ ঝিমোচ্ছিল। আজ সন্ধ্যায় আহ্নিক হবে না ঠিকই ছিল। তবু। লাফিয়ে উঠল সে, বিয়ে হচ্ছে?
হ্যাঁ। হচ্ছে। হাসতে হাসতে মাথা দোলাল গোরক্ষ।
তার মানে!
বুঝতেই পারছ।
ওরাই বোধহয় ধরে বেঁধে, ঘটকমশাই-এর সেই গল্পের মতো!
আমাদের প্রস্তাব মেনে নিয়েছেন বড়বাবু।
এইজন্যেই বলে, ভাগ্যবানের বউ মরে–।
আমরা অভাগাই থেকে যাব হে। চল, চল।
ছড়িয়ে পড়ল খবরটা। সবাই সাজগোজ করতে লাগল। যারা চলে গিয়েছিল তারা ফেরত এল। হরিপদ ছুটে গিয়েছিল অন্দরমহলে, ও মতির মা, বড়বাবু বিয়েতে বসেছেন।
হঠাৎ মতির মা পালটে গেল, ঠিক করেছেন। একটা আইবুড়ো মেয়েকে রক্ষা করেছেন। বলে কেঁদে উঠল সে।
এলোকেশী কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর নিচু গলায় বলল, আমি বিশ্বাস করি না।
ফোন এসেছিল আর তুমি অবিশ্বাস করলেই হবে। হরিপদ ধমক দিল।
বড়বাবুর মতো মানুষ এই কাজ করতেই পারেন না। এলোকেশীর কথা শেষ হতে না হতে বরযাত্রীদের গাড়ি চোঁ চোঁ দৌড়াল বিয়েবাড়ির উদ্দেশ্যে।
টেলিফোন বাজছে। এলোকেশী দৌড়াল। রিসিভার তুলে সাড়া দিতে ঘটকমশাই-এর গলা শুনতে পেল, ডুডুয়ার সতীশ রায়ের বাড়ি?
এলোকেশী বলল, হ্যাঁ।
বরযাত্রীরা রওনা হয়ে গেছে?
এলোকেশী টোক গিলল। ঘটকমশাই আবার প্রশ্নটা করলেন।
হ্যাঁ। কে বলছেন?
আমি ঘটকমশাই।
ও। বিয়ে আরম্ভ হয়ে গিয়েছে?
হ্যাঁ। সানাই শুনতে পাচ্ছ না? রাখছি।
শুনুন, হ্যালো।
হ্যাঁ, বলো।
বড়বাবু।
খুব ক্ষেপে গেছেন। আমাকে ওঁর পাশে থাকতে হচ্ছে।
মানে–?
মানে আবার কি? ছেলের ওপর রেগে চণ্ডাল হয়ে আছেন!
ছেলে, মানে, খোকাবাবু–!
সে ভিজে বেড়ালের মতো বিয়ের পিঁড়িতে বসে মন্ত্র পড়ছে। রাখছি।
হঠাৎ কান্না এল এলোকেশীর। কেন এই কান্না তা তার অজানা। খুব দ্রুত সেটাকে সামলে নিয়ে সে চিৎকার করল, ও মতির মা, ও হরিপদদা।
ওরা ছুটে এল অবাক হয়ে। হেসে ফেলল এলোকেশী, খোকাকে পাওয়া গিয়েছে গো।
মতির মা আঁচলে ঠোঁট চাপা দিল, কোথায়?
বিয়ের পিঁড়িতে বসে মন্ত্র পড়ছে।
অ্যাঁ। হাঁ হয়ে গেল হরিপদ।
ঝকমকিয়ে হেসে উঠল মতির মা, সত্যি?
আরও বেশি হাসল এলোকেশী, সত্যি, সত্যি।
বিয়ে হয়ে গেল। বরবউকে বাসর ঘরে নিয়ে যাওয়া হল। সতীশ রায় উঠলেন। ঘটকমশাই জিজ্ঞাসা করলেন, কোথায় যাবেন বড়বাবু?
ওই হারামজাদার ভূত ভাগাব আমি।
দয়া করে এখন এই কাজ করবেন না বড়বাবু। হাতজোড় করল ঘটকমশাই।
তার মানে? আমার ছেলেকে আমি শাসন করব না?
নিশ্চয়ই করবেন। কিন্তু এখানে নয়। এখানে সে বর, তার সম্মান আছে।
রাখো। তার সম্মানবোধ থাকলে এরকম করত?
তা করত না, হয়তো ভাবেনি এসব। তাছাড়া–।
চটপট বলে ফেলো।
এখন তো সে শুধু আপনার ছেলে নয়, এ বাড়ির জামাইও।
জামাই? থমকে গেলেন সতীশ রায়।
এঁদের সামনে জামাইকে অপমান করা কি ঠিক কাজ হবে?
হুম্। সতীশ রায়কে দেখে মনে হল অনেক কষ্টে নিজেকে সামলালেন।
কালীপদবাবু এবং সরমা এগিয়ে এলেন। কালীপদবাবু বললেন, এবার আপনারা এ-বাড়ির অনুগ্রহণ করতে চলুন।
সতীশ রায় বললেন, যাও ঘটকবাবু, তুমি খেয়ে নাও। এতরাত্রে খাওয়ার অভ্যেস নেই আমার।
তা বললে শুনছি না। মেয়ে দেখতে এসে আপনি বলেছিলেন বিয়ের দিন পেট ভরে মিষ্টি খাবেন। সরমা বললেন।
কালীপদবাবু বললেন, নিয়ম না ভাঙলে সেটা আছে কিনা বোঝা যায়। রায়মশাই। কথায় বলে যার শেষ ভালো তার সব ভালো। আপনাকে অ্যান্টাসিড দিচ্ছি। সেটা খেয়ে নিয়ে খেতে বসুন, হজমের কোনও অসুবিধে হবে না।
ঘটকমশাই বললেন, বড়বাবু আপনি যবনের হাতে পড়েছেন। নিস্তার নেই।
বেশ। বরযাত্রীরা আসছে। ওঁরা আসুক। সতীশ রায় মাথা নাড়লেন।
ঘটকমশাই কালীপদবাবুর সঙ্গে কথা বলতে খাওয়ার জায়গা যেদিকে সেদিকে চলে গেলেন। সম্ভবত এই সুযোগে মেনু যাচাই করা তার ইচ্ছে। মাথার ওপর শ্রীকৃষ্ণ আছেন। একটা বড় দাও প্রায় হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছিল, এবার ঘটকবিদায় নিশ্চয়ই খুব ঘটা করে দেবেন বড়বাবু। আনন্দ হচ্ছে খুব।
সতীশ রায় বললেন, একটা কথা বলি, আপনাদের মন খুব বড়। নইলে ওই ছোকরার ন্যাকামি শুনেও বিয়ে দিতেন না।
হেসে ফেললেন সরমা, আশ্চর্য। যে মেয়ের সঙ্গে ও কথা বলেনি, দূর থেকে দেখেছে, সেই মেয়েও ওকে ভালো করে চেনে না তার জন্যে বেচারা ভাবছে মনের কৌমার্য নষ্ট করে বসেছে বলে আর বিয়ে করবে না। আজকের দিনে কোনও ছেলে এরকম ভাবছে কেউ বিশ্বাস করবে?
তবে বুঝুন। কী ছেলে নিয়ে আমি বাস করছি। আজকের দিনে কেন, কোনও কালেও কেউ বিশ্বাস করবে না। সতীশ রায় বললেন।
ঠিক বলেছেন। সেই যে আমি ডুডুয়ায় গিয়েছিলাম মায়ের সঙ্গে, আপনি তখন তো বাইশ তেইশ বছরের, আমার দিকে একটু বেশি তাকাতেন দূর থেকে। মা সাততাড়াতাড়ি আমাকে নিয়ে ফিরে এল মালবাজারে। তা তখন কি আপনার মনে হয়েছিল যে আপনি মনের কৌমার্য হারিয়েছেন?
আমার ঠিক মনে পড়ছে না–।
ছেলেদের মনে থাকে না, মেয়েরা ভুলতে পারে না।
নভেল আর কবিতা পড়ে পড়ে ওর মাথাটা শেষ হয়ে গেছে।
মেয়েটি কে?
কোন্ মেয়ে?
যার জন্যে ওর মনের কৌমার্য গেছে। হাসলেন সরমা।
ও নাম বলেনি?
না।
ডুডুয়ার পোস্টমাস্টারের মেয়ে। রাস্তায় ঘোরাঘুরি করতে কেউ দ্যাখেনি। পোস্টমাস্টার কলকাতায় নিয়ে গিয়ে তার বিয়ে দিল। কিন্তু এমনই কপাল কয়েকদিনের মধ্যেই বিধবা হয়ে ফিরে এল মেয়েটা।
ইস!
এইসময় মহাদেববাবুর স্ত্রী এসে বললেন, তুই সারাদিন উপোস করে আছিস। এখন একটু মিষ্টি আর শরবত খেয়ে নিবি চল।
দাঁড়াও। আগে বেয়াইমশাই খেতে বসুন, তারপর।
না না। আপনি উপোস করে আছেন। তারপরেই মনে আসতে সতীশ রায় জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা, উপোস করার কী খুব দরকার ছিল?
সরমা মাথা নাড়লেন, সন্তানের মঙ্গলের জন্যে উপোস করে প্রার্থনা করতে মনে তৃপ্তি আসে। এটুকু তো কম প্রাপ্তি নয়?
বরযাত্রীরা এসে গেল। নাগেশ্বর এবং গোরক্ষ ঘটকমশাইকে দেখতে পেয়ে উৎফুল্ল হয়ে জিজ্ঞাসা করল, বড়বাবু কি এখন বাসরঘরে?
অ্যাঁ? একথা জিজ্ঞাসা করছেন কেন? ঘটকমশাই অবাক।
বাঃ। আপনি ফোনে বললেন বিয়ে হচ্ছে। নাগেশ্বর সন্দেহের চোখে তাকাল।
হ্যাঁ। কিন্তু বড়বাবু বিয়ে করছেন একথা বলিনি।
তাহলে?
যার বিয়ে করার কথা ছিল সে-ই করছে।
সেকি?
কালীপদবাবুরা বরযাত্রীদের আপ্যায়ন শুরু করায় ঘটকমশাই হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। বরযাত্রীদের খেতে বসিয়ে দেওয়া হল। সতীশ রায় বসলেন না। তিনি একবার খাওয়ার জায়গায় এলেন, নাগেশ্বর, গোরক্ষ, বেশ রাত হয়ে গেছে, গলা পর্যন্ত খেয়ো না।
তা খাবো না। নাগেশ্বর বলল, কিন্তু বড়বাবু, খোকাকে কোথায় পেলেন?
আমি পাইনি। সতীশ রায় দাঁড়ালেন না।
নাগেশ্বর অবাক হয়ে পাশে বসা গোরক্ষর দিকে তাকাল। খাওয়া বন্ধ করে হতভম্ব গোরক্ষ তখন বড়বাবুর চলে যাওয়া দেখছে।
সরমার অনুরোধে সতীশ রায় গোটা দুয়েক মিষ্টি খেলেন আলাদা বসে। তারপর বললেন, আমার বাড়িতে বউভাতে আপনারা পায়ের ধুলো দিলে খুব খুশি হব। সবাই যেন আসেন।
সরমা বললেন, নিশ্চয়ই যাব। কিন্তু আমি দুটো মিষ্টি ছাড়া আর কিছু খাব না। জোর করবেন না বলে রাখলাম।
কেন?
ছেলের বাপ যা আচরণ করছেন মেয়ের মায়ের তাই করা উচিত।
হেসে ফেললেন সতীশ রায়, বিশ্বাস করুন, দীর্ঘকালের অভ্যেস। রাত নটায় খেতে বসি। দশটা বেজে গেলে খাই না। কষ্ট হয়। এবার উঠি।
মহাদেব সেন বললেন, বিরকনের সঙ্গে দেখা করে যাবেন না?
বাসরঘরে সবাই আনন্দ করছে, কী দরকার বিরক্ত করার। হা, কাল কখন ওরা রওনা হচ্ছে?
বাসি বিয়ে হয়ে গেলেই। ধরুন, সকাল দশটায়। কালীপদবাবু বললেন।
তাহালে বারোটায় পৌঁছাবে। ভরদুপুরে। তার চেয়ে খেয়েদেয়ে যদি তিনটে নাগাদ রওনা হয়। অবশ্য বারবেলা যদি পড়ে না যায়!
ঠিক হল, পুরোহিতের সঙ্গে কথা বলে ওঁরা আগেভাগে জানিয়ে দেবেন। বরযাত্রীদের খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। নাগেশ্বর গোরক্ষ তাদের সঙ্গে বরকনেকে দেখে এসেছে বাসরঘরে গিয়ে। কনে তার বান্ধবীদের কথায় খুব হাসছিল। বেশ সুন্দরী দেখাচ্ছিল তাকে। পাশে বসা বরকে বরং বেশ বিমর্ষ বলে মনে হল। মাথা নিচু করে বসে আছে। যেন তার ওসব ভালো লাগছে না।
বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলেন সতীশ রায়। সঙ্গে সঙ্গে মানিকজোড় ঘটকমশাইকে অন্য গাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে ড্রাইভারের পাশে উঠে বসল। সতীশ রায় কিছু বললেন না।
গাড়ি চলতে শুরু করলে গোরক্ষ বলল, দেখে দু-চোখ জুড়িয়ে গেল। বড়বাবু।
কী দেখে? পেছনের আসনে হেলান দিয়ে বসা সতীশ রায় প্রশ্ন করলেন।
নতুন বউকে।
ও।
আপনার বাড়ি আলোয় ভরে যাবে।
এখন অন্ধকারে ডুবে আছে বলছ?
না-না মানে–!
ঠিক আছে।
গোরক্ষ আর কথা খুঁজে পেল না। নাগেশ্বর বলল, খোকা তাহলে আজ শিলিগুড়িতে যায়নি। নিশ্চয়ই ভেবেছিল বিয়ে বাড়িতে না এলে আপনার অসম্মান হবে।
সতীশ রায়ের ইচ্ছে করছিল না কথা বলতে। কিন্তু এই দুজনের কৌতূহল মেটানো পর্যন্ত এরা কথা বলেই যাবে। তাই সংক্ষেপে ঘটনাটা বললেন।
কেউ চিনতে পারেনি? গোরক্ষ অবাক।
চিনলে তো বেঁধে রাখতো না। যাঁরা চিনতেন তাঁরা ওর আসার কথা জানতেন না। অবশ্য শুধু বেঁধে রাখা নয় ওকে যদি মারধোর করতো খুশি হতাম।
দেখবেন, বিয়ের পর বদলে যাবে। গোরক্ষ বলল।
সতীশ রায় কিছু বললেন না।
বিকেল সাড়ে চারটের সময় সত্যচরণ তার নতুন বউকে নিয়ে বাড়ি ফিরল। নাগেশ্বর এবং গোরক্ষর বউ নতুন বউকে বরণ করে ভেতরে নিয়ে এল। সতীশ রায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁকে দেখতে পেয়ে প্রতিমা দাঁড়াল। তারপর কাছে গিয়ে নিচু হয়ে পায়ের ধুলো নিল। মাথায় হাত রাখলেন সতীশ রায়, তোমার ওপর খুব ভরসা করে আছি মা।
ছোট্ট শব্দটি ঘোমটার আড়াল থেকে ভেসে এল, জানি।
মতির মা বা এলোকেশী তো বটেই, নাগেশ্বররাও অনুরোধ করেছিল সত্যচরণকে বউভাতের আগে বকাঝকা না করতে। ছেলেকে দেখে তাই মুখ সরিয়ে নিলেন সতীশ রায়। সত্যচরণ ভেতরে চলে গেল।
আজ কালরাত্রি। সত্যচরণের ঘরটিকে সকাল থেকে সাজিয়েছে এলোকেশীরা। সেখানেই প্রতিমাকে নিয়ে যাওয়া হল। এলোকেশী বলল, কাল অবধি এটা তোমার বরের ঘর ছিল। আজ থেকে তোমার।
প্রতিমা অবাক হল, তা হয় নাকি? ওর ঘর আমার হবে কেন? এ বাড়িতে আর কোনও খালি ঘর নেই?
তা থাকবে না কেন? কিন্তু তোমরা দুজন তো এই ঘরেই থাকবে!
আমরা তো সেই ঘরেই থাকতে পারি! হাসল প্রতিমা।
অতএব আর একটি খালি ঘরে খাট পাতা হল। সেখানে গিয়ে প্রতিমা বলল, বাঃ। চমৎকার। আমার জিনিসপত্র এখানে এনে দাও, আমি জামাকাপড় পালটাবো।
এলোকেশীর সঙ্গে বেশ ভাব হয়ে গেল প্রতিমার। তার মুখেই বিবাহবৃত্তান্ত শুনল এলোকেশী। অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, এসব শুনেও তুমি বিয়ে করতে রাজি হলে?
আমাকে তো কেউ এসব আগে বলেনি। শুভদৃষ্টির সময় দেখতে পেলাম। তখন কি করে ছাঁদনাতলা ছেড়ে বেরিয়ে আসি বল। প্রতিমা ঠোঁট ফোলাল।
তা ঠিক। পরে, মানে বাসরে ওকে কিছু জিজ্ঞাসা করোনি?
চান্সই পাইনি। ফাঁসির আসামির মতো মুখ করে বসেছিল। রাত্রের খাওয়া শেষ করেই এমনভাবে ঘুমিয়ে পড়ল যে মা বলল, আহা বেচারা। ঘুমাচ্ছে ঘুমাতে দে। প্রতিমা বলল, কী যে করি!
তার মানে?
সত্যি বলতে এলোদি, কেউ যদি মনে মনে কাউকে ভালোবাসে তাহলে তার মন থেকে কি ভালোবাসা উড়িয়ে দেওয়া যায় না দেওয়া উচিত?
তুমি ওর মনে ওই ভালোবাসা থাকতে দেবে? চোখ বড় করল এলোকেশী।
তাই তো দেওয়া উচিত! মাথা ঝাঁকাল প্রতিমা।
অ্যাঁ! তুমিও কি পাগল?
আমি কেন পাগল হব? প্রতিবাদ করল প্রতিমা।
সেই মেয়ের বিয়ে হয়েছিল, বিয়ের পর বিধবা হয়ে বাপের বাড়িতে ফিরে এসেছে। খোকাকে সে ভালো করে চেনেই না, কথাও হয়নি কোনদিন।
হু!
হুঁ কী?
একেবারে মীরার মতো ব্যাপার, না?
মীরা? কে মীরা?
ওঃ। তুমি মীরার নাম শোননি? কৃষ্ণের মূর্তির সামনে বসে ভজন গাইতেন। কৃষ্ণ ওঁকে কোনদিন দ্যাখেননি, কথাও বলা দূরের কথা, তবু মীরা প্রেমিক বা স্বামী ছাড়া কিছুই ভাবতে পারতেন না।
দশ মিনিট পরে মতির মাকে নির্জনে পেয়ে এলোকেশী বলল, কী হবে গো! এ দেখছি, যেমন দেবা তেমনি দেবী।
মতির মা মাথা নাড়ল, না না। মেয়েটা খুব ভালো। নইলে খোকাবাবুকে তার ঘর ছেড়ে দেয়?
এলোকেশী মতির মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল।
মতির মা জিজ্ঞাসা করল, কী হল?
কী মিল তোমাদের মধ্যে। এলোকেশী হাসল।
নিজের ঘরটাকে অন্যরকম দেখে বেশ রেগে গেল সত্যচরণ। তার টেবিলের কাগজপত্র উধাও। ছড়ানো ছেটানো বইগুলো একপাশে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। আলনাটা খালি। তার মানে জামাকাপড় আলমারিতে ঢুকিয়ে রেখেছে। আর এসব কীর্তি যে এলোকেশীর তাতে তার কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু রাগ গিলতে হল। গতকালের ঘটনার পর বাবা তাকে একটাও কুবাক্য বলেননি। ওরা তাকে শুধু বেঁধে রেখেছিল, বাবা হাতে পেলে জুতো ছিঁড়তেন মারতে মারতে। অথচ একটা সরল সত্য সে কাউকে বোঝাতে পারছে না। টিয়া যাই বলুক, তার হৃদয়ে শুধু ওরই মুখ। তাহলে তার মনের কৌমার্য নেই। সেক্ষেত্রে এই মন অন্য কাউকে দেওয়া মানে অসৎ হওয়া। যতদিন না তার হৃদয় থেকে টিয়ার মুখ মুছে না যায় ততদিন সে কাউকে হৃদয়ে গ্রহণ করতে পারবে না। তার আবেগকে কেড়ে নিতে সে কিছুতেই দেবে না। হঠাৎই কবিতার লাইন মাথায় এসে গেল সত্যচরণের। কাগজ খুঁজল সে। চোখের সামনে কোন কাগজ নেই। না থাক। মনে মনে লাইন ভাবল সত্যচরণ, তুমি ডানা মেলতেই এই বুক সবুজে ছেয়ে যায়। পরের লাইনটা মাথায় আসছিল না।
সন্ধেবেলায় নাগেশ্বররা এল। কাল বউভাত। ম্যারাপ বাঁধা হয়ে গেছে বাড়ির সামনে। ঠাকুররা রান্নার আয়োজন করছে। যদিও মূল রান্না শুরু হবে কাল সকাল থেকে। ডুডুয়ায় বউভাত মানে দুপুরের খাওয়া। বেলা সাড়ে এগারোটা থেকেই অতিথিরা এসে যাবেন। গোরক্ষ রান্নার তদারকিতে ছিল। নাগেশ্বর আপ্যায়নে।
একটু হালকা হলে ওরা সতীশ রায়ের সঙ্গে দেখা করতে এসে দেখল ডুডুয়ার কয়েকজন বয়স্ক মানুষ ওঁর সঙ্গে কথা বলছেন।
সতীশ রায় জিজ্ঞাসা করলেন, কিছু বলবে?
নাগেশ্বর জিজ্ঞাসা করল, আজ কি সন্ধের পরে বেরুবেন?
কোথায়? সতীশ রায় বুঝতে পারলেন না।
গাড়ি নিয়ে। গোরক্ষ বাক্য শেষ করল না।
নাঃ।
ঠিক আছে। গোরক্ষরা সরে এল।
নাগেশ্বর বলল, আজ কালরাত্রি, কাল ফুলশয্যা। গতকাল বিয়ে গেল। পরপর তিন রাত্রি উপোস।
বড়বাবুরও কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু লোকলজ্জা বলে একটা কথা তো আছে।
হুঁ। তাহলে ধরে নিই এটা আমাদের পরীক্ষা।
তাছাড়া উপায় নেই।
লোকজন চলে এলে নিজের ঘরে এসে হরিপদকে ডাকলেন সতীশ রায়। হরিপদ এলে জিজ্ঞাসা করলেন, বউমা কী করেছে এখন?
আজ্ঞে, বসে আছে। হরিপদ বলল।
একা?
হ্যাঁ।
সে কোথায়? তার ঘরে।
বউমাকে এখানে আসতে বল।
হরিপদ চলে গেল। একটু পরেই প্রতিমা ঘরে এল। এখন তার আটপৌরে সাজ। বলল, আমাকে ডেকেছেন?
হ্যাঁ। বসো।
প্রতিমা বসল।
খুব মন খারাপ করছে নিশ্চয়ই!
প্রতিমা মুখ নামাল।
মেয়েদের এটা সইতেই হয়। তবে কদিন বাদেই তো মায়ের কাছে যাবে। আগামিকালও তাঁদের সঙ্গে দেখা হবে তোমার। বেশিদূরের পথ তো নয়। গাড়ি আছে, যখন দেখতে ইচ্ছে করবে চলে যাবে। সতীশ রায় বলল।
ঠিক আছে।
তোমার সঙ্গে খোকার কথা হয়েছে?
কী কথা?
মানে, এমনি কথাবার্তা?
না।
কী লজ্জায় ফেলে দিয়েছিল বল তো। শুধু আমাকে নয়, তোমাকেও। অতএব.একটা ছেলে যে এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন হবে ভাবতে পারিনি।
প্রতিমা বলল, আপনি এ নিয়ে আর ভাববেন না।
সতীশ রায় বউমার দিকে তাকালেন। এই মেয়ে বুদ্ধিমতী। জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাকে দেখতে গিয়ে শুধু একটি প্রশ্ন করেছিলাম, পাঁচটা গালাগালি শুনতে চেয়েছিলাম। তোমার মনে হয়নি কেন এরকম উদ্ভট প্রশ্ন করেছিলাম?
আপনি বোধহয় আমাকে যাচাই করতে চেয়েছিলেন। বিশ্বাস করুন, বিয়ের পিঁড়িতে বসা ইস্তক ওই পাঁচটা, না না, ছটা গালাগালি কেবলই মনে আসছিল।
কতক্ষণ?
এই বাড়িতে ঢোকা পর্যন্ত।
তারপর?
তারপর আর আসছে না।
তোমার সঙ্গে সে কথা বলেছে তো?
একটাও না। এই যে এতক্ষণ গাড়িতে পাশে বসে এল, যেন কোনও সাড় ছিল না। আমিও তাই একটাও কথা বলিনি। প্রতিমা মাথা নড়ল।
না মা। তুমি কথা না বললে ও খুশি হবে। নিজের মতো থাকতে পারবে। তুমি তাই কথা বলবে। মাটির কলসির ঘষা লেগে পাথরও ক্ষয়ে যায়, ও তো মানুষ। তুমি ঠিক পারবে ওকে সচল করতে। সতীশ রায় বললেন, যাও, বিশ্রাম নাও। এ বাড়িতে কোনও অসুবিধে হলেই আমাকে নিঃসংকোচে জানাবে।
প্রতিমা উঠে দাঁড়াল। এক পা দরজার দিকে এগিয়ে থেমে গেল। তারপর সবিনয়ে বলল, শ্বশুরবাবা!
শ্বশুরবাবা? সতীশ রায় অবাক।
আমার তো বাবা ছিল। বাবা বললেই তার কথা মনে পড়ে। তাই—
ঠিক আছে। শ্বশুরবাবাই বলবে। হ্যাঁ, বলো।
আমি এ বাড়িতে আসায় আপনি–। আবার চুপ করে গেল প্রতিমা।
আচ্ছা বল, নিঃসংকোচে বল।
না, হরিপদদা বলছিলেন আপনি রোজ বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ম করে আহ্নিক করেন এই সময়, আমি আসায় সেটা বন্ধ করেছেন?
ওঃ। হরিপদ একথা তোমাকে বলেছে! দেখেছ, হতভাগা ঠিক নালিশের জায়গা পেয়ে গেছে। আসলে সারাদিনের পরে একটু গল্পগুজব, সেই সঙ্গে দুপাত্র খেলে রাতের ঘুমটা ভালো আসে। আমি কখনই সীমা অতিক্রম করি না। হরিপদ নিশ্চয়ই বলেছে আমি কখন রাতের খাওয়া খাই!
ঘা। আপনি যেমন ছিলেন তেমন থাকলে আমার ভালো লাগবে।
বেশ তো। আজ আমার খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। ক্ষিদেও পেয়েছে। বউভাত চুকে যাক, তারপর দেখা যাবে। হাসতে হাসতে বললেন সতীশ রায়।
সকাল থেকে খুব ধকল গেল। প্রথমে বউকে দিয়ে আত্মীয়স্বজন, ঘনিষ্ঠদের ভাত পরিবেশন করানো হল। সত্যচরণকেও সেই পঙক্তিতে বসতে হল। এলোকেশী লক্ষ করল সত্যচরণের পাতে প্রতিমা বেশ বেশি বেশি ভাত তরকারি ঢেলে দিল। তারপরেই সতীশ রায় বললেন, এবার ওকে রেহাই দাও। আর কষ্ট করতে হবে না। সত্যচরণের পক্ষে ওই পরিমাণ ভাত খাওয়া অসম্ভব। তাই খাওয়া শেষ হলে সবাই যখন উঠে যাচ্ছে তখন সতীশ রায়ের নজর গেল ছেলের পাতের দিকে, ওকি! তুমি অত ভাত ফেলে রেখেছ? না খেতে পারলে দেওয়ার সময়ে আপত্তি করোনি কেন? অদ্ভুত।
এলোকেশীই সাজিয়ে দিল। বেনারসী, চন্দন এবং ফুলের মালায় প্রতিমাকে জীবন্ত মনে হচ্ছিল। ফুলশয্যার ঘর ফুল দিয়ে ভরিয়ে রাখা হয়েছে সন্ধে থেকেই। সাধারণত কনে আগে ঘরে ঢোকে, বর তার পরে। কিন্তু খাওয়াদাওয়ার পরে সত্যচরণ আগেই ঘরে ঢুকে বসে আছে। প্রতিমাকে নিয়ে সেই ঘরে গিয়ে এলোকেশী বলল, তোমার বউকে দিয়ে গেলাম সারাজীবন যত্নে রাখবে। বলে হেসে বেরিয়ে গিয়ে দরজা ভেজাতে ভেজাতে বলল, ভেতরের ছিটকিনি তুলে দাও।
চেয়ারে বসেছিল সত্যচরণ। মুখ নিচু করে। প্রতিমা তার দিকে তাকাল। তারপর ধীরে ধীরে খাটের একপ্রান্তে গিয়ে বসল।
সত্যচরণ তার দিকে তাকাচ্ছে না। মিনিট তিনেক পরে প্রতিমা জিজ্ঞাসা করল, তুমি কি রাগ করেছ?
সত্যচরণ নীরবে মাথা নেড়ে না বলল।
কাকা চিনতে না পেরে ভয় পেয়ে তোমাকে শাস্তি দিয়েছিল।
সত্যচরণ কথা বলল না।
তুমি কি আমার সঙ্গে কথা বলবে না?
সত্যচরণ কথা বলল। প্রতিমার দিকে না তাকিয়ে বলল, কথা বলতেই তো গিয়েছিলাম। সুযোগই পেলাম না।
এখন বল। আমি মন দিয়ে শুনব। প্রতিমা হাসল শব্দ করে।
হাসির কথা নয়। মুখ না ফিরিয়ে বলল সত্যচরণ।
বেশ। তাহলে হাসব না।
তুমি কীভাবে নেবে জানি না। সবাই আমাকে ভুল বোঝে। তুমিও নিশ্চয়ই তাই বুঝবে। কিন্তু এই অন্যায় আমি করতে চাইনি। আমাকে জোর করে করানো হয়েছে। প্রতিমুহূর্তে আমি তাই জ্বলে পুড়ে মরছি। শ্বাস ফেলল সত্যচরণ।
কী অন্যায়?
আমি অসৎ হয়ে গেলাম।
কীরকম?
আমার এই মনের কৌমার্য অনেকদিন আগে চলে গেছে। এই অবস্থায়। তোমাকে বিয়ে করা মানে অসৎ হওয়া। সত্যচরণ বলল।
মনের কৌমার্য! তার মানে?
মানে, আমার মন আর আমার নেই। বিমর্ষমুখে বলল সত্যচরণ।
কোথায় গেছে?
সত্যচরণ এবার ঘুরে বসল। তার চোখ ছলছল করছে, একজন আমার মন জয় করে নিয়েছে। আমার কিছু করার ছিল না।
সে কোথায় থাকে?
এখানেই। এই ডুডুয়ায়।
ও। তাকে বিয়ে করলে না কেন?
কী করে করব? তার আগেই তো ওর বিয়ে হয়ে গেল।
বিয়ে হয়ে গেল? তোমরা মেনে নিলে? অবাক হল প্রতিমা।
না মেনে কী করব? ওর সঙ্গে তো কথাই হয়নি আমার।
কথা হয়নি? তোমাদের আলাপ ছিল না? হাঁ হয়ে গেল প্রতিমা।
না। আমি ওকে দেখেছি। দেখে মন দিয়ে দিয়েছি। ও আমাকে তোত দ্যাখেনি। কথা বলাও হয়নি। এতদিন পরে ও যখন বিধবা হয়ে বাপের বাড়িতে ফিরে এল তখন কথা বললাম।
বিয়ে হল, বিধবাও হয়ে গেল।
হুঁ। একেই বলে দুর্ভাগ্য।
অ। কী কথা হল?
সান্ত্বনা দিতে গিয়েছিলাম। তা আমার সঙ্গে ভালো ভাবে কথাই বলল না। বলুক, কিন্তু, আমি যে কী করি!
প্রতিমা হাসল, তোমার সমস্যা নিয়ে এখন থেকে তুমি একা ভাববে না। আমিও ভাবব।
তুমিও ভাববে? অবাক হল সত্যচরণ।
নিশ্চয়ই। আমি তোমার সহধর্মিণী, তোমার পাশে দাঁড়ানো যে আমার ধর্ম। কটা দিন যাক। আমি গিয়ে ওর সঙ্গে দেখা করব।
তুমি?
হ্যাঁ। আচ্ছা, ওর নাম কী?
পাখি?
কী মিষ্টি নাম!
তোমার রাগ হচ্ছে না?
ওমা। রাগ হবে কেন?
আমার মনের কৌমার্য নেই শুনেও রাগ হচ্ছে না?
যা গেছে তা নিয়ে ভেবে কী লাভ। আমার দিদিমা তো শিবপুজো করে, নারায়ণ পুজো করে, কালীপুজো করে, লক্ষ্মীপুজো করে। এক এক পুজোর সময় এক এক মন্ত্র পড়ে। একটা মনে অতগুলো দেবদেবীর জায়গা দেওয়া কি অসৎ ব্যাপার নয়? ভালো করে বিছানায় বসল প্রতিমা।
ফ্যালফ্যাল করে তাকাল:সত্যচরণ। তার মাথায় কিছু ঢুকছিল না।
প্রতিমা বলল, তা পাখিকে দেখার আগে আর কাউকে দেখে মন দিতে ইচ্ছে করেনি?
না। এখানকার অন্য মেয়েরা কেমন যেন। বোন বোন দেখতে।
শব্দ করে হেসে ফেলে মুখে হাত চাপল প্রতিমা, ওমা! এ কী কথা! বোন বোন মানে কী রকম?
মানে, দেখলে মনে আবেগ আসে না!
ও। প্রতিমা চোখ ঘোরাল?, আমাকে দেখে কী মনে হয়?
তাকাল সত্যচরণ। তারপর মুখ নিচু করে বলল, ভালো।
হুম। শান, আমার ঘুম পেয়েছে। প্রতিমা বলল।
ও।
ও মানে? আমি শুয়ে পড়ছি। তুমি ঘুমোবে না? প্রতিমা বলল, এসো শুয়ে পড়। দ্বিতীয় বালিশটাকে বেশ কিছুটা দূরে সরিয়ে দিয়ে বলল, ওইখানে ঘুমোবে। ঘুমের ঘোরে আমি পা ছুঁড়ি, কাছে থাকলে তোমাকে লাথি মেরে বসব। এসো।
সত্যচরণ উঠল। জামা খুলতে গিয়েও খুলল না। সন্তর্পণে অনেকটা দূরত্ব রেখে শুয়ে পড়ল সে। ওদের দুজনের মাঝখানে একটা লম্বা পাশবালিশ।
প্রতিমা বালিশে মাথা রেখে বলল, তুমি চিন্তা কোরো না। আমি পাখির সঙ্গে দেখা করে সব বুঝিয়ে বলব।
তুমি পাখির সঙ্গে দেখা করবে? ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞাসা করল সত্যচরণ।
যাকে দেখে তোমার মনের কৌমার্য চলে গেছে তাকে দেখতে যে খুব ইচ্ছে করছে। নিশ্চয়ই আমার চেয়ে খুব সুন্দরী। এখন বুঝতে পারছি।
কী বুঝতে পারছ?
ওই যে কথা আছে না, অতিবড় সুন্দরী না পায় বর, তাই বেচারা বিধবা হল। ভাগ্যিস তোমার সঙ্গে ওর আগে কথাবার্তা হয়নি।
তার মানে?
উঠে বসল প্রতিমা।
তার মানে বুঝতে পারছ না। তোমার সঙ্গে ওর বিয়ে হলেও তো ওকে বিধবা হতে হত। একমাত্র ছেলে মরে গেলে শ্বশুরবাবা তো পাগল হয়ে যেতেন! মতির মা-ও আত্মহত্যা করত। এই বাড়িটা পোড়ো বাড়ি হয়ে যেত। ভেবে দ্যাখো, তুমি এখন পৃথিবীতে নেই, তোমার কেমন লাগছে?
সত্যচরণ কোনও কথা বলতে পারল না। ব্যাপারটা ভাবতেই বুকের ভেতর শিরশির করে উঠল। কথা বলার চেষ্টা করতে মুখ থেকে মিনমিনে আওয়াজ বেরুল।
প্রতিমা বিরক্ত হল, আঃ। তুমি এত মেনিমুখো কেন? কথা বল।
সত্যচরণ কোনওমতে উচ্চারণ করল, তাহলে অন্তত মনের কৌমার্য হারিয়ে বাবার আদেশে এই বিয়েটা তত করতে হত না। পবিত্র থাকতাম।
একেই বলে মাকাল।
মানে?
মাকাল ফল দ্যাখোনি? বাইরে টুকটুকে লাল, কী সুন্দর। ভেতরটা জঘন্য। পবিত্র থাকার সাধ হয়েছে, মরে গেলে সেটা বুঝতে কী করে?
তা অবশ্য–।
প্রতিমা আবার শুয়ে পড়ল। পাশবালিশের ওপাশে সত্যচরণ বেশ শব্দ। করে শ্বাস ফেলল।
ঘুম আসছে না তোমার? জিজ্ঞাসা করল প্রতিমা।
না। জবাব এল সত্যচরণের।
আলো নিভিয়ে দেব?
আমি ঘুমিয়ে পড়লে দিয়ে।
কখন তুমি ঘুমাবে তার জন্যে আমি জেগে থাকব?
তাহলে দাও।
বেড সুইচ টিপে আলো নিভিয়ে দিল প্রতিমা। তারপর খেয়াল হতে অন্ধকারেই বিছানা থেকে নেমে দরজার ছিটকিনি তুলে দিয়ে এল। বিছানায় শোওয়ার পর আবার সত্যচরণের শ্বাস ফেলার শব্দ কানে এল তার।
কী হল? বুকে কষ্ট হচ্ছে?
হুঁ।
ঘরে মুভ মলম আছে?
আছে। টেবিলের ড্রয়ারে।
ওটা বের করে বুকে মালিশ করো, ব্যথা কমে যাবে।
না থাক।
থাকবে কেন? ব্যথা হচ্ছে বলছ।
এ ব্যথা সে-ব্যথা নয়।
কী ব্যথা?
মরে গেছি ভাবলেই বুকের ভেতরটা টাটিয়ে উঠছে।
এদিকে এসো।
অ্যাঁ?
আমি মেয়েমানুষ হয়ে বলছি এদিকে এসো, আর তুমি বলছ, অ্যাঁ?
অন্ধকারে সত্যচরণ শরীরটাকে নাড়াচাড়া করতেই পাশবালিশে বাধা পেল।
সে বলল, পাশবালিশ আছে যে, এটা কোথায় রাখব?
অন্ধকারে শব্দটা বুলেটের মতো ছুটে এল, ঢ্যামনা।
ফুটো হওয়া বেলুনের বাতাসের মতো গলা হয়ে গেল সত্যচরণের, সেকি!
ঠিক বলেছি। শ্বশুরবাবা কেন আমাকে মাত্র একটা প্রশ্ন করেছিলেন তা এখন হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছি। চাদর আর বালিশ নিয়ে নিচে নেমে মেঝের ওপর শুয়ে পড়। আমাকে আর জ্বালিয়ো না। এবার সত্যি ঘুম পাচ্ছে। পাশবালিশ জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করল প্রতিমা।
মেঝেতে শুলে মাটি থেকে চুঁইয়ে উঠে আসা ঠাণ্ডা বুকে বসে যাবে। নিমোনিয়া হবে। নিমোনিয়া হওয়ায় তাদের স্কুলের একটা ছেলে মারা গিয়েছিল। সেও মরে যেতে পারে। মরে গেলে তো প্রতিমা বিধবা হবে। তখন ওর অবস্থা হবে পাখির মতো। জেনেশুনে কাউকে বিধবা করা তো মহাপাপ।
চুপচাপ বসে থাকল সত্যচরণ। একটু পরে মৃদু ঢুলুনি এল। ততক্ষণে প্রতিমা গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে। একসময় পাশবালিশটাকে নিয়ে উলটোদিকে মুখ ফিরিয়ে শুলো।
আর বসে থাকতে পারছিল না সত্যচরণ। প্রতিমা যখন ওইরকম গভীর ঘুমে তলিয়ে গিয়েছে তখন নিশ্চয়ই টের পাবে না সে নিচে নেমে শুয়েছে কিনা! পায়ের দিকে বালিশ রেখে পা গুটিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল সে। শোওয়া মাত্র ঘুম জাঁকিয়ে বসল তার ওপর।
কতক্ষণ পরে জানা নেই। চাপা আর্তনাদ করে সত্যচরণ হুড়মুড়িয়ে উঠে বসল। তার বুকের ওপর আঘাতটা লেগেছে। প্রতিমার পা পেনাল্টি কিক করেছে তার বুকের ওপর। টাটিয়ে যাচ্ছে পাঁজরা। সেই চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল প্রতিমার, কী হল?
তু-তুমি, তুমি আমার বুকে লাথি মেরেছ! করুণ গলা সত্যচরণের।
অ্যাঁ! তুমি নিচে নেমে শোওনি?
না। নিমোনিয়ার ভয়ে এদিকে গুটিয়ে শুয়েছিলাম।
উঠে বসল প্রতিমা, তোমাকে তখন বলেছিলাম ঘুমের ঘোরে আমি পা ছুঁড়ি, সেটা তোমার কানে ঢোকেনি?
মনে ছিল না।
ওঠো। উঠে দাঁড়াও। ধমকাল প্রতিমা।
হ্যাঁ। সোজা হয়ে দাঁড়াও।
অতএব বুকে হাত চেপে সত্যচরণ উঠে সোজা হয়ে দাঁড়াল। প্রতিমা নিল ডাউন হয়ে বসে তার দুই পায়ে হাত ছোঁয়াল, স্বামীর গায়ে পা লাগলে পাপ হয়। তারপর সেই হাত বুকে মাথায় ছোঁয়াল।
থরথর করে কাঁপছিল সত্যচরণ। জীবনে এই প্রথম কেউ তাকে প্রণাম করল। প্রতিমা জিজ্ঞাসা করল, কী হল? এখনও বুকে ব্যথা লাগছে?
না না। ব্যথা একটুও নেই। আর মনে হচ্ছে আমি অপবিত্র নই, মনের কৌমার্য চলে যায়নি।
প্রতিমা বলল, তাহলে এই খাটে আমার পাশেই শুয়ে পড়। বালিশে মাথা রেখে নিঃশব্দে হেসে উঠল সে, মনে মনে বলল, ঢ্যামনা।