Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » তটিনী ও আকাতরু || Buddhadeb Guha » Page 2

তটিনী ও আকাতরু || Buddhadeb Guha

এই একটা জায়গা, যেখানে প্রত্যেক মানুষ-ই, কী স্ত্রী, কী পুরুষ, স্বচ্ছন্দ, সৎ অশুভ এবং ঢিলেঢালা। এই চানঘর। এখানে কারোরই কোনো মুখোশ থাকে না। যে-মুখোনি মাকে দেখানো যায়, মুখোশহীন মুখ, আর দেখানো যায় শুধুমাত্র চানঘরের আয়নাকেই।

একে একে জামা-কাপড় সব খুলে ফেলল তটিনী। তারপর দাঁড়াল আয়নার সামনে। তার প্রিয় শরীরের ছায়া ফেলে। ও কালো হলে কী হয়, ওর ফিগারটা যে, এত সুন্দর তা শুধু নিজেকে পুরোপুরি নিরাবরণ করলেই ও বুঝতে পারে। আর বুঝতে পারে পুরুষমানুষের চোখের আয়নাতে। কিন্তু পুরুষদের চোখের আয়নাতে যে, শুধুই ‘স্তুতি’ থাকে না, এই মুশকিল!

নিরাবরণ কিন্তু ও নিরাভরণ নয়। দু-কানে দু-টি রুবির দুল। মস্ত বড়োজুয়েলার গেদু সেন দিয়েছে ওকে। ম্যাচ করা রুবির হারও আছে। দু-হাতে রুবির বালা। শুধু দুলজোড়াই নিয়ে এসেছে। অভিনয়ের সময়ে তো ইমিটেশন জুয়েলারিই পরতে হয়। সবসুদ্ধ লাখ তিনেক টাকা দাম হবে কম করে পুরো সেটটির।

গেদুবাবু বলেন, আহা! তোমার ফিঙের মতো কালো শরীরে এই রুবির বেদানাদানার গয়নাগুলোযে, কী জেল্লাই দিয়েছে! যেন, পলাশ ফুটেছে কালো গাছ আলো করে।

কিন্তু মুখে কাব্যি করলে কী হয়! মানুষটা বড়োই জংলি। কোন পুরুষ যে, আসলে কোন ‘প্রজাতি’র তা বোঝা যায় যখন সে, নগ্ন হয়ে বিছানাতে ওঠে শুধুমাত্র তখন। কচুবনের শুয়োরের মতন ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে গেঁদুবাবু তার শরীরে। নরম, নিভৃত, আদ্র শরীরী মাটি ছিটকোয় শক্ত খুরের আঘাতে আঘাতে। শুয়োরের-ই মতন গেদু তার দাঁত দিয়ে তটিনীর নবনী-শরীর যেন, চিরে চিরে দেয়।

শরীরী আদরও একটা মস্ত বড়োআর্ট। পনেরো বছর বয়স থেকে অনেক পুরুষকে আদর করে আর অনেক পুরুষের আদর খেয়ে এই ভর তিরিশে পৌঁছে এসবের পুঙ্খানুপুঙ্খ জেনেছে তটিনী।

চালকলের মালিক, সেই মোটা, বেঁটে, কালো, মুখে বসন্তের দাগঅলা পানখাওয়া বাবুটি, যিনি তার বাবার চেয়েও বড়ো ছিলেন বয়েসে, ধুতি আর পাঞ্জাবি পরতেন, সেই মানুষটিই কিন্তু তাকে যা-কিছু শেখাবার সব শিখিয়েছিলেন। সব শরীরী ইতিবৃত্ত। মনের-ই মতন, শরীরের মধ্যেও কম জটিলতা নেই। নারী-বিলাসী ছিলেন কিন্তু ভেতরে বড়োনরম, বুঝদার। কী সুন্দর করে কথা কইতেন তিনি, হাতে ধরে শিখিয়েছিলেন কী করলে ওঁর নিজের ভালোলাগা বাড়বে আর কী করলে তটিনীরও। পুরুষের আর নারীর শরীরের আলোছায়ার অলিগলিতে, খানা-করে, পাহাড়চুড়োয়, উপত্যকায় যে, কত অগণ্য সুইচ আছে, যেখানে আঙুল ছোঁয়ালেই এক একটি পাঁচশো পাওয়ারের বালব দপ দপ করে জ্বলে ওঠে, কত কঠিন হিমবাহ অবলীলায় গলে যেতে থাকে নারী শরীরের অভ্যন্তরে, তা উনি না শেখালে, তটিনী কি কখনো জানত? মাস্টার রেখে গান ও নাচও তো প্রথমে উনিই শেখান তাকে। উনিই নামও রাখেন ‘তটিনী। ওর আসল নাম তো ছিল মান্তুই। ডাকনাম যদিও। ভালো নাম ছিল ফুল্ললোচনী। ওই নামের-ই জন্যে পোস্ট অফিসে ফাইফরমাশ খাটা মাকে দেখেই ফ্ল্যাশব্যাকে ওর পুরোনো দিনে ফিরে গেছিল তটিনী। কিন্তু সে-নামে পরবর্তী জীবনে কেউই ডাকেনি ওকে। মা-মরা, মাতাল বাবার পরম অবহেলার মেয়েকে বাবা এবং অন্য সকলেও যে, মা বলেই ডাকত।

ওই প্রাণ খাঁ-ই মান্তুর, থুড়ি, তটিনীর প্রকৃত শিক্ষাদাতা বাবা ছিলেন। যদিও সেই মানুষটার সঙ্গে তার শরীরী সম্পর্কও ছিল। সে তাঁর রাখস্তি ছিল কিন্তু একটি দিনও জোর করেননি তার ওপরে প্রাণবাবু। না শরীরের ওপরে, না মনের ওপরে।

তটিনীর শোয়ার ঘরে ছাগলের দুধ খেয়ে এবং চরকা কেটে অথবা অক্সোনিয়ান ইংরেজিতে বক্তৃতা করে ভারত স্বাধীন করা গান্ধিজির বা জওহরলাল নেহরুর কোনো ফটো নেই। একটি মা-কালীর আর অন্যটি প্রাণ খাঁর। গিলে করা আদ্দির পাঞ্জাবি আর চুনোট ধুতি পরা। পাঞ্জাবিতে হিরের বোতাম। রিমলেস চশমা। তাতে হালকা গোলাপি আভা। হাতের কবজিতে রোলেক্স ঘড়ি, সোনার। বুকভরা কাঁচা পাকা চুল। পাকানো দুচোলো গোঁফ। মাথাতে ব্যাকব্রাশ-করা চুল। ব্রাইলক্রিমে চকচকে।

সেই এক বহিরঙ্গ মূর্তি। আর তার কুৎসিত নিরাবরণ মুর্তিটার কথা ভাবলে আজও গা ঘিন ঘিন করে। অধিকাংশ সময়েই চোখ দুটি বন্ধই করে রাখত তটিনী। প্রাণ খাঁ বলতেন, থাক থাক। চোখ বন্ধই থাক। শরীরের ও চোখ ছাড়াও অন্য হাজারো চোখ আছে। তোর সব চোখ আমি একে একে খুলতে শেখাব দেখিস। সব মেয়েই অক্টোপাস।

শিখিয়েছিলেন।

পরে পরে চোখ দুটো খুলে থাকলেও কুরূপ মানুষটাকে দেখতেই পেত না। সেই অপার অন্ধকারেই মানুষটার শরীর অগণ্য ফুল ফোঁটাত ওর শরীরে। কখনো কিছু হুলও ফোঁটাত। গান গাইত তটিনীর শরীরে।

বুঁ-উ-উ-উ-উ’ শব্দ করে একটা বোলতা নগ্না তটিনীকে চমকে দিয়ে উড়ে এল। মনে হল, যেন, ওর বুকেই কামড়াবে।

চিৎকার করে উঠেছিল ও একটু হলেই। করলে, সিন ক্রিয়েটেড হত। বাইরের দরজাতে ধাক্কা পড়ত। ওর শান্তি বিঘ্নিত হত।

বোলতাটা পরমুহূর্তেই ঘুরে অন্য দিকে চলে গেল। ভাগ্যিস!

তটিনী নজর করে দেখল, কমোডটা যেদিকে তার পাশের-ই কাঠের দেওয়ালে একটা ফুটো। জানলার পর্দার ওপর দিয়ে দেখল, একটি মস্ত কাঁঠাল গাছ, অসংখ্য এঁচড় এসেছে, সে-গাছে আর সেই গাছেই একটি মস্ত মধুর চাক। এই গাছ থেকেই বোধ হয় আকাতরুবাবু আঁচড়ের বন্দোবস্ত করবেন। চানঘরের মধ্যে ওই ফুটো দিয়ে তারা ঢোকে আর বেরোয়। সকালে লক্ষ করেনি যে, পেছনের দেওয়ালে লাইন দিয়ে বোলতা পিল পিল করছে।

ও সাবধানে ডান দিকের জানলাটা খুলে দিল হাঁটু গেড়ে বসে। মেয়েদের এই অসুবিধে। ছেলেদের ঊধ্বাঙ্গে কোনো লজ্জাস্থান নেই। সে পুরুষ হলে দাঁড়িয়েই জানলাটা খুলতে পারত। জানলার পর্দার আড়ালে তার নিম্নাঙ্গ।

জানলাটা খুলতেই দেখল, পাশ দিয়ে একটি পাহাড়ি ঝোরা বয়ে গেছে পাথরে পাথরে লাফিয়ে লাফিয়ে। আর অন্য পারে, রাজাভাতখাওয়ার ডরমেটরিটা যেদিকে, তার পেছন দিকে একটি দোতলাবাংলো। অনেকগুলি নেপালি পরিবার অথবা একটি যৌথ পরিবার সেখানে থাকে। ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা খেলছে। তাদের চিকন চিৎকারে এই নির্জনের বিলম্বিত সকাল চমকে চমকে উঠছে। লাল-নীল-হলুদ নানা রঙের ব্লাউজ আর শাড়ি পরা নেপালি মেয়েরা কেউ চুল আঁচড়াচ্ছে। কেউ চুল আঁচড়ে দিচ্ছে কারো। কেউ-বা রঙিন উলের লাছি নিয়ে বসে সোয়েটার বা গরম ব্লাউজ বুনছে আর সকলেই নীচুস্বরে নিজেদের মধ্যে গল্প করছে।

বাংলোটার পেছনে একটা মস্তবড়ো গাছ। কী গাছ, কে জানে? আকাতরু কি?

আকাতরু! গাছের নাম আকাতরু। আশ্চর্য মানুষের নাম আকাতরু। গাছটা কী গাছ, আকাবাবু এখানে থাকলে হয়তো বলতে পারতেন। ভাবনাটা ভেবেই ওর শরীর শিউরে উঠল। ভয়ে কি?

না, ঠিক ভয়ে নয়, এক মিশ্র অনুভূতিতে।

ওই জানলা দিয়ে বাইরে চেয়ে তটিনীর মন বড়োউদাস হয়ে গেল। উদাস হয়ে গেল নানা মিশ্র কারণে। প্রাণবাবুর একটা কটেজ ছিল কালিম্পং-এ। গরমের সময়ে তটিনীকে নিয়ে প্রতিবছরই তিনি দিন পনেরোর জন্য যেতেন সেখানে। সেই কটেজটিতে প্রাণবাবুর শোয়ার ঘরের লাগোয়া যে-চানঘরটি ছিল সেই চানঘরের জানলা দিয়ে এইরকম একটি জোরা নেপালিদের বাড়ি দেখা যেত।

প্রাণবাবু প্রতিদিন ওকে, নিজে হাতে রান্না করে খাওয়াতেন। রান্না শেখাতেন। কালিম্পং এর সেই কটেজে সময় পেতেন তো অনেকেই। কলকাতাতে তো বড়োজোর ঘণ্টাখানেক থাকতে পারতেন। খাওয়াদাওয়া, গান শোনা, বই পড়া, তারপর বিকেলে তটিনীকে নিজে হাতে সাজিয়ে-গুজিয়ে নিয়ে কালিম্পং-এর হেলিপ্যাডের দিকে হাঁটতে বেরোতেন প্রত্যেক দিন।

যদি কেউ দেখে ফেলে?

ভয়ে ভয়ে, তটিনী বলত, প্রথম প্রথম।

দেখলেই-বা। আমি তো কারো মেয়ে-বউ ভাগিয়ে আনিনি। তোকে তো আমি ফুটিয়েছি কুঁড়ির-ই মতন। প্রাণ খাঁ বাঘ। তাকে পেছন থেকে, আড়াল থেকে অনেকেই ‘ফেউ’ অনেক কিছু বলবে হয়তো কিন্তু সামনে এসে দাঁড়াবার সাহস কারোর-ই নেই।

কলকাতায় পুরোদস্তুর বাঙালি প্রাণবাবু কালিম্পং-এ গেলেই সাহেব হয়ে যেতেন। থ্রি-পিস স্যুট পরতেন, বাড়িতে গরম ড্রেসিং গাউন, মুখে পাইপ, গর্ডনস জিন আর রাতে হালকা সবুজ চারকোণা বোতলের Ancestor স্কচ হুইস্কি খেতেন। তটিনীকে ভদকা আর টোম্যাটো জুস দিয়ে “ব্লাডি মেরি” বানিয়ে দিতেন যত্ন করে নিজে হাতে। ডিনারের পরে যখন দু-জনে শীতের মধ্যে লেপের তলায় যেতেন তখন, স্বর্গ নামত পৃথিবীতে। মানুষটা জীবনকে কী করে ভালোবাসতে হয়, টাকা কী করে খরচা করতে হয়, তা জানতেন।

খেতে এবং খাওয়াতে খুব ভালোবাসতেন মানুষটা। খাদ্য, পানীয়, শরীর এবং মন এই চার নিয়েই ছিল তাঁর জীবন। জীবন যে, ভোগ করার-ই জিনিস, হা-হুঁতাশ করে বেদনা বিলাস নিয়ে কাটিয়ে, হামাগুড়ি দিয়ে চিতাতে গিয়ে ওঠার জন্য নয়, তা প্রাণবাবু বিশ্বাস করতেন এবং সকলকে বিশ্বাস করতে বলতেনও।

নামহীন, যশহীন ছোট্টপরিধির মধ্যে তৃপ্ত সদা হাসিখুশি মানুষটি মারাও গেলেন অমনি হঠাৎ-ই। যেমনটি চেয়েছিলেন। কাজ করতে করতেই।

তাঁর চালকলের বিরাট বিরাট বয়লারগুলো আর চাল সেদ্ধ করার ভ্যাটগুলোর সামনেই একদিন সকালে জলখাবার খাওয়ার পরে হার্ট ফেল করে পড়ে মারা গেলেন। তটিনী, কলের একজন কর্মচারীর মুখেই শুনেছিল।

প্রাণবাবু ওকে বলেছিলেন, দেখ তটিনী, তোর আমার সম্পর্ক কিন্তু শুধুমাত্র জীবনের-ই। মরণের পরে আমার আর কোনোই দাবি রইবে না তোর ওপরে। আমি মরে গেলে তুই আমার কেউ নোস। তুই তখন যা-খুশি করিস। পাছে তোকে কেউ অপমান করে বা বঞ্চিত করে তাই আমার জীবদ্দশাতেই তো তোকে সবকিছু করে দিয়ে গেলাম। মরে গেলে তোর জীবনে আমি শুধু একটা ফটোই হয়ে যাব। তাই এই ফটোটা তোকে দিয়ে গেলাম। তোকে নাচ-গান, অভিনয়, পড়াশোনা শিখিয়ে দিয়ে গেলাম তটিনী। সুখেই তোর দিন চলে যাবে। তোর ঘরের জোড়াখাটে শুয়ে যখন, তুই অন্য পুরুষের সঙ্গে সোহাগ করবি, তাকে ভালোবাসবি, তখন আমার এই ফটোটা ড্রয়ারে ঢুকিয়ে রাখিস। নইলে তোর আনন্দে হয়তো কাঁটা বিঁধবে। আমারও হয়তো খারাপ লাগবে। মরার পরে কি সে বোধ বেঁচে থাকবে? কে জানে!

গায়ে সাবান মাখতে মাখতে ভাবছিল তটিনী, কত গভীরভাবে ভাবতেন প্রাণবাবু ওর কথা, ওর ভবিষ্যতের কথা। অমন করে বোধ হয়, খুব কম স্বামীও ভাবেন তাঁদের স্ত্রীদের জন্যে।

তাকে প্রাণবাবু তাঁর বিবাহিত স্ত্রীর সমান মর্যাদাই দিয়েছিলেন।

তটিনীর খুব-ই ঔৎসুক্য ছিল, প্রাণবাবুর স্ত্রী কেমন তা জানতে। একদিন প্রাণবাবু নিজেই স্বগতোক্তির মতন বলেছিলেন, জানিস তটিনী, আমার গিন্নী ভারি ভালো মানুষ। রূপও তার অঢেল। গুণের শেষ নেই। আমাকে খুব ভালোবাসে।

তবে? আপনি আমাকে…।

ওসব তুই বুঝবি না। এক এক জন মেয়ে, এক এক রকম। ভগবান পুরুষকে অমনি অতৃপ্ত করেই গড়েছেন। ক্ষতিই বা কী? আমি তো তাকে কোনোদিক দিয়েই ঠকাইনি। সত্যিই তো ভালোবাসি। তোকেও ঠকাইনি।

তবু…

তটিনী বলেছিল।

ও তুই বুঝবি না। তোর নিজের যখন একের বেশি নাগর হবে, সেদিন হয়তো বুঝবি। হয়তো নাও বুঝতে পারিস। মেয়েরা অন্যরকম। এসব-ই ভগবানের ‘লীলাখেলা। আমাদের বোঝাবুঝির বাইরে।

তটিনীও অবশ্য কোনোদিনও অসতী হয়নি। যতদিন প্রাণবাবু তাকে রেখেছিলেন ততদিনে শত প্রলোভনেও সে, নিজেকে উড়িয়ে দেয়নি অন্য দিকে।

একবার প্রাণবাবুর বড়োজামাই ওর কাছে এসেছিল, এক বর্ষার দুপুরে, প্রচুর মদ গিলে, বেহেড মাতাল হয়ে। একটি চকোলেট-রঙা ব্যুইক গাড়ি চড়ে। শুনেছিল, সেটা প্রাণবাবুর-ই দেওয়া। নাদুসনুদুস। নানারকম বীজ-এর মস্তবড়ো ব্যবসাদার জামাই।

ফ্রিজ থেকে রসগোল্লা বের করে আর লেমন স্কোয়াশ দিয়ে শরবত করে খাইয়ে তটিনী বলেছিল, শুনুন জামাইবাবু, বাড়ির উলটোদিকের রক-এ কিন্তু একজন গুণ্ডা সবসময়েই বসে থাকে। তার কোমরে রিভলবার বাঁধা। আপনার শ্বশুরমশায়ের নির্দেশে। চোখের ইশারা করলেই আপনাকে খতম করে দেবে। কখনো আর এমুখো হবেন না। আপনার শ্বশুরমশাই এর চরিত্রর নরম দিকটা দেখেছেন আপনি, কঠিন দিক দেখেননি। আপনার ভালোর জন্যই একথা বলছি। মানুষটার মধ্যে অনেকগুলো মানুষ আছে।

কতক্ষণ যে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে এমন, আবোল-তাবোল ভাবছিল তা বলার নয়।

অটোম্যাটিক গিজারে গরম জল ছিলই। অনেকক্ষণ ধরে ভালো করে চান করে তোয়ালে দিয়ে সারাশরীর মুছতে মুছতে আবার ও ওর শরীরের দিকে তাকাল।

শরীর, সব শরীর-ই ভারি সুন্দর। এবং ভারি নোংরাও। গাছের পাতারা এলোমেলো হাওয়াতে যখন আন্দোলিত হয়, যখন উলটে যায়, যখন তাদের পেটের দিকটা দেখা যায়, তখন পিঠের রং যাইহোক-না কেন। মানুষের শরীরেও যেখানে রোদ পড়ে না, তলপেট, ঊরু, জঘন, বুক, মেয়েদের নাভির ওপর থেকে বুকের নীচ অবধি পেটের অনাবৃত অংশটুকু ছাড়া আর ফিঙের মতন কালো শরীরকেও পাতিকাকের গলার-ই মতন মসৃণ, ছাই-রঙা দেখায়। সে রূপ, ফর্সা যারা, তাদের চেয়েও ভালো। যারা দেখেছে তারাই জানে।

পাতাদের ভেতরদিকের রং যে, অন্যরকম হয় তা কি জানে আকাতরুও?

এই লম্বা-চওড়া, পেটা, রোদ-জলে তামাটে হওয়া শরীরে, শিশুর মতন মনের এই যুবক, তটিনীর মনে ভারি একটি শিহরন তুলেছে। খরগোশ বা ছাগলছানাকে নিয়ে খেলতে যেমন ভালো লাগে, আকাতরুর সঙ্গও যেন, তার মনকে তেমন-ই নিষ্পাপ, স্বর্গীয় ভালোলাগায় ভরিয়ে দিয়েছে। দিচ্ছে।

শরীরও যেন, মেঘলা আকাশ হয়ে গেছে। পরতের পর পরত মেঘের আড়ালে যেন, গুরুগুরু’ধ্বনি শুনতে পাচ্ছে। হয়তো বৃষ্টি নামবে। তবে কখন? কোথায়? কবে? তা ও জানে না। নাও নামতে পারে। কিন্তু নামতে যে, পারে, এই ভাবনাটুকুর মধ্যেও ভারি শিহরন আছে। একটি।

আকাতরুর দৃষ্টিতে কোনো পাপ নেই। কিন্তু মৃদুলের দৃষ্টিতে আছে। অবনীর দৃষ্টিতে পাপও নেই, পুণ্যও নেই।

মৃদুলের চোখ তো নয়, যেন এক্স-রে মেশিন। ওর সামনে গেলেই তটিনীর মনে হয় যে, ও বিবস্ত্র হয়ে গেল। অধিকাংশ পুরুষ-ই ওইরকম। তারা মেয়েদের শরীর ছাড়া অন্য কিছুই দেখে না। মেয়েরাও যে, সমান সমান মানুষ, বুদ্ধিতে, শিক্ষাতে, রুচিতে, তাদের মনও পুরুষের মনের চেয়ে কোনোদিক দিয়ে, কোনো অংশেই যে, কম নয়, এই সরল সত্যটি অধিকাংশ পুরুষ-ই বোঝে না। পুরুষেরা প্রেম বোঝে না, কাম বোঝে। এমনকী, আশ্চর্য, তারা মোহ পর্যন্ত বোঝে না।

সেই কারণেই, এই সোজা, সরল, উদার, ভালো, কাঠ-বাঙাল আকাতরুকে এভালো লেগেছে তটিনীর। আর আকাতরুও প্রাণে বাঁচলে হয়! তার যে, কী অবস্থা তা, তটিনী ভালো করেই বুঝতে পারছে এবং পারছে বলেই, তার কষ্টটাকে আরও গভীর করে তুলে নিজের আনন্দকে দীপ্যমান করছে।

এও কি এক ধরনের স্যাডিজম?

কে জানে! মনস্তাত্ত্বিকেরাই বলতে পারবেন।

ভাবল, তটিনী।

মৃদুলের মতন শিক্ষিত পুরুষেরা আপাদমস্তক ভন্ড, মিথ্যাচারী, পাজি। মৃদুল বিয়ে করেছে। প্রমাকে। লিটন থিয়েটারের একটি দলে অভিনয় করে প্রমা। যেমন দেখতে মিষ্টি, তেমন-ই ভালো মেয়ে। তটিনীর মতন নয়। ভালো ঘরের। সচ্চরিত্র। মৃদুলের চেয়ে বয়সে অনেক-ই ছোটো। প্রায় শিশুবধ-ই করেছে বলতে গেলে। প্রমা, মৃদুলের কণ্ঠস্বর, তার বুদ্ধি, তার ইংরেজি উচ্চারণ নিয়ে দারুণ গর্বিত। আবৃত্তিও ভালো করে মৃদুল। আজকাল যেমন, অনেক আবৃত্তিকারেরাই জুটি বেঁধে নানা জায়গাতে আবৃত্তি, পাঠ, শ্রুতি-নাটক, এসবে প্রায় রোজই অংশ নেন এবং কিছু উপরি রোজগারও করেন, ওরা দু-জনেও তা করতে শুরু করেছে। নাটক করে মিডিয়ার নজর যেটুকু কাড়া যায়, এইসব করে কাড়া যায়, তার চেয়ে অনেক-ই বেশি, পৌনঃপুনিক প্রচারও হয়, এইসব যদি মিডিয়ার সুনজরে থাকে।

কিন্তু প্রমা জানে না যে, মৃদুলের শিক্ষা আর সব গুণ সত্ত্বেও সে, একজন বাজে স্বামী। অসৎ। নীতিহীন। সে প্রমাকে ভালোবাসে না। এক পার্টির একজন মাঝারি শ্রেণির নেতা প্রমার মামা হন, বলেই হয়তো প্রমাকে বিয়ে করেছে ও। সেই নেতা এবারের নির্বাচনে হেরে গেলেই প্রমাকে ছেড়ে দিতে পারে মৃদুল। তার নিজের কেরিয়ারের জন্যে সে, সবকিছুই করতে পারে।

কাব্য-সাহিত্য-সংগীত-আবৃত্তির জগতের এইসব মানুষের চেহারার ভন্ড বদমাশদের তটিনীর মতন ভালো কেউই চেনেনি হয়তো। এই প্রেক্ষিতে তার প্রথম “বাবু” চালকলের মালিক প্রাণবাবু আর আকাতরু তার চোখে দুই আলাদা মেরুর মানুষ হয়েও অনেক-ই শ্রেয়, এইসব এঁটো-কুড়োনো, পা-চাটা, শুধুমাত্র পচাগলা বাতিল মাংস ছিঁড়ে-খাওয়া শকুনদের চেয়ে। এদের কণ্ঠস্বর কৃত্রিম, উচ্চারণ বিকৃত, এরা চরম অসৎ।

‘সৎ’ শব্দটায় শুধু অর্থনৈতিক সততাই বোঝায় না। যদিও এই হা-ভাতেদের দেশে অর্থনীতিই সবচেয়ে মান্য বিষয়। শুধু অর্থনৈতিক সততাই নয়, কোনোরকমের সততাই নেই এদের। অথচ এদের সঙ্গেই তটিনীর ওঠা-বসা। এইসব আঁতেলদের চেয়ে প্রাণবাবু, গেদুবাবুরা অনেক-ই ভালো। তাঁরা ভন্ড নন অন্তত। অনেক দিয়ে, সোজাসুজি বদলে কিছু চান। তাঁরা ব্যবসাদার। তাঁদের বাণিজ্যের রকমটা তবু বোঝা যায়। এরা সত্যিই চিজ এক একটি। অথচ পেশাদার যাত্রা করার বা নাটক করার কারণে, মৃদুলের মতন মানুষদের সঙ্গেই তটিনীর দিনরাতের অধিকাংশ সময় কাটাতে হয়। যাত্রাতে যে আজকাল অনেক-ই পয়সা। এই বছরে ওর চুক্তি পাঁচ লাখের। পঁচিশ চেক-এ দেবে প্রডিউসার। আর চার লাখ পঁচাত্তর ক্যাশ-এ। প্রডিউসার সরকারি ঠিকাদার। যাদের বানানো রাজপথ প্রথম বর্ষাতেই ধুয়ে যায় তাদের পক্ষে চেক-এ বেশি দেওয়া মুশকিল তো। তটিনীদেরও সুবিধে। মিথ্যে বলবে না।

সরকারকে ট্যাক্স দেবেই বা কেন? কী দেয় সরকার বদলে? চোখরাঙানি ছাড়া?

.

০৪.

খেতে করতে সেই তিনটেই হয়েছিল। তবে খাওয়াদাওয়ার পরে বিশ্রাম আর নেওয়া হয়নি। রাজভাতখাওয়া থেকে জয়ন্তীর পথ অবশ্য খুব একটা বেশি নয়। কল্যাণ দাস, অ্যাডিশনাল ডি. এফ. ও. ওয়্যারলেস টেলিফোনে খবর পাঠিয়েছিলেন যেন, ওয়াচটাওয়ারটা ঘুরিয়ে নিয়ে যায় ওদের। কল্যাণ দাস-এর হেডকোয়ার্টার্স আলিপুরদুয়ারে। জিপ নিয়ে প্রায় রোজ-ই তাঁকে আসতে হয় নানা জায়গাতে। সান্ত্রাবাড়ি, ভুটানঘাট, কোনোদিন সাংহাই রোডের মধ্যে দিয়ে বন দেখতে যেতে হয় কলকাতা থেকে ওপরওয়ালারা এলে অথবা ফিল্ড-ডিরেক্টর নিজে এলে। কখনো বা হাতির দলের গতিবিধির ওপর নজর রাখার জন্যে তাদের দলের কোনো হাতিকে রেডিয়ো-অ্যাকটিভ কলার পরানোর জন্যে ঘুমপাড়ানি গুলি ছুঁড়ে বেহুশ করে তারপর সেই কলার পরানো হয়। তখন অবশ্য কলকাতা থেকে সুব্রত পালচৌধুরী আসেন। টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট। তা ছাড়া, অবনী বলেছিলেন, কল্যাণ দাসের ওপরওয়ালাও তো কম নয়। এখন কনসার্ভেটরের তো ছড়াছড়ি। ওয়াইল্ড লাইভ-এর কনসার্ভেটর শ্রী অতনু রাহা। সিলভিকালচারের কনসার্ভেটর সুব্রত পালিত। তাঁদের ওপরে আছেন চিফ কনসার্ভেটর। তবে ওঁদের নাকি খুবই দুঃখ যে, ফরেস্ট সেক্রেটারি কল্যাণ বিশ্বাস একবারও বক্সা টাইগার প্রোজেক্টে আসেননি। এলে, এখানের সকলেই খুব খুশি হতেন, নিজেদের অভাব অভিযোগের কথা বলতে পারতেন।

তটিনী গাড়ির সামনে বসেছে একা ড্রাইভারের পাশে। মারুতি ভ্যান একটি, লাল রঙা। পেছনে ওরা তিনজন। আকাতরু, অবনী আর মৃদুল। মৃদুল ঘন ঘন সিগারেট খায় বলে, জানলার পাশে বসেছে।

এখন ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলেছে গাড়িটা। আলোছায়ার শতরঞ্জি বিছানো আছে পথে। দু-পাশে মাথা উঁচু সব প্রাচীন মহিরুহ।

অবনী বলল, কি রে আকা! ঘুমিয়ে পড়লি নাকি? তোকে বললাম, অত খাস না! তুই ঘুমিয়ে পড়লে তটিনী দেবী আর মৃদুলবাবুকে এইসব গাছগাছালি চেনাবে কে? তুই মানুষ নোস, বনমানুষ। সেইজন্যেই তো তাকে সঙ্গে আনা।

তটিনী বাঁ-হাতটা খোলা জানলার ওপরে রেখে বসেছিল। মাথায় পনিটেইল করেছে। লো কাট একটা হালকা বাদামি রঙা ব্লাউজ। ঘাড়ের কাছে সাদা লেস-এর কাজ। তাতে যেন, তটিনীর গ্রীবাকে মরালীর গ্রীবার মতন দেখাচ্ছিল।

তটিনী মুখটা পেছনে ঘুরিয়ে অবনীর কথার প্রতিবাদ করে বলল, উনি ‘ভালোমানুষ’ বলে আপনার ওর পেছনে, অমন করে লাগাটা উচিত নয় অবনীবাবু।

অবনী বলল, বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে। বনে এসেছি বলেই তো বনমানুষকে এত ইম্পর্ট্যান্স দিচ্ছি। কিছুদিন আগে আমার চেয়েও বড়ো বনমানুষ এখানে এসেছিলেন। সব ঘুরে ফিরে দেখে গেলেন। বলেছেন ফিরে গিয়ে এখানকার কথা লিখবেন।

কে?

লেখকদের মধ্যে তো লেজবিশিষ্ট একজন-ই আছেন। বনমানুষ।

ও। বুঝেছি।

তটিনী বলল।

তাঁকে আমিও দেখেছি। নন্দাদেবী ফাউণ্ডেশন’-এ এসেছিলেন। চেহারা দেখলে মনে হয় না, কোনোদিন বনে-জঙ্গলে ঘুরেছিলেন বলে।

তটিনী বলল, বয়স হলে তারপর শহরে দিনের পর দিন থাকলে মানুষের চেহারা তো বদলে যেতেই পারে। তা বলে তাঁর অতীতটা তো আর মুছে ফেলা যায় না। বাহ্যিক চেহারাটা কিছুর-ই পরিচায়ক নয় মানুষের। না বিদ্যা-বুদ্ধির, না অভিজ্ঞতার, না মানসিকতার।

সেটা ঠিক।

মৃদুল বলল। তোমাকে দেখলেও কি বোঝা যায় যে, তুমি কাছিম?

কেন? কাছিম কেন?

দেখলে মনে হয় গন্ধরাজ ফুল। শিশুও যেন, সে ফুলের পাপড়ি ছিঁড়তে পারে। কিন্তু তোমার ভেতরটা কাছিমের পিঠের মতো শক্ত।

তা হবে। আপনার চোখ তো নয়, এক্স-রে মেশিন। আপনি বলেই যা, অন্যে দেখতে পায় না, তা আপনি পারেন সহজেই।

এই ফ্যাকল্টিটা ডেভলাপ করতে হয়েছে অনেক যত্ন করে তটিনী। কোনো কিছুই ‘সহজ’-এ পাওয়া যায় না। চাওয়া যতই তীব্র হোক-না কেন?

যাক। সারকথাটা বুঝেছেন যে, এইটাই আনন্দের। এই সরল সত্যটাই বোঝে না অধিকাংশ মানুষ।

সামনে ওটা কী?

আকা বলল, ওইটারেই ত টাওয়ার কয়।

কীসের টাওয়ার?

ওয়াচ টাওয়ার। ওর-ই উপরে বইস্যা ত মান্যিগণ্যিরা জানোয়ার দেখে। মানে, যারে কয় ‘ওয়াচ’ করে। তাই তো নাম, ওয়াচটাওয়ার।

তাই?

আউজ্ঞা।

সামনে ওই ন্যাড়া জায়গাটা কী? ডান দিকে? এখানে কি মান্যিগণ্যি মানুষেরা কুস্তি লড়েন? দেখতে কুস্তির আখড়ার মতন।

আকাতরু হেসে উঠল।

তটিনী লক্ষ করল যে, আকাতরুর হাসির মধ্যেও সত্যিই একটা বন্য-ব্যাপার আছে। তার হাসিতেও যেন, ডিমা নোনাই জয়ন্তী রায়ডাক এইসব নদীর আর চিকরাসি আর গামারি আর লালি গাছের আর বোরোলি আর তেকাটা মাছের গন্ধ লেগে আছে। আকাতরু এই আকাতরু–বনে না জন্মালে যেন, ওর জীবন বৃথা হত। কলকাতার মেকি আর ভন্ড আর তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের প্রেক্ষিতে ও যেন, সত্যিই এক প্রতিবাদ। আকাতরু সঙ্গে না থাকলে এই বক্সার বনে তটিনীর আসাই বৃথা হত।

আকাতরু বলল, এরে কয় নুনী।

‘নুনী’! মানে?

অবনী বলল, ইংরেজিতে একেই বলে SALT LICK.

সেটা কী বস্তু?

মৃদুল বলল।

ন্যাচারাল সল্ট-লিক থাকে, সব বনের-ই ভেতরে। মাটিতে বা পাথরে নুন থাকে। সেই নুন চাটতে আসে তৃণভোজী সব জানোয়ার। আর তাদের পেছনে পেছনে আসে মাংসাশীরা। তবে এটি ন্যাচারাল নয়। বন-বিভাগ বস্তা বস্তা নুন ফেলে রাখেন। নইলে মান্যিগণ্যিরা জানোয়ার দেখবেন কী করে?

অবনী বলল।

আই সি।

মৃদুল বলল।

আমার কিন্তু ভালো লাগে না। এই নুনীতে যেসব জানোয়ার নুন চাটতে আসে নির্ভয়ে, এই টাওয়ার ওখানে আছে জেনেও তাদের মধ্যে বন্যতা থাকে না। তার চেয়ে আমি মানুষটা বেশি বন্য।

তা ঠিক। কাজিরাঙার গন্ডার, বান্ধবগড়ের বাঘ যেমন, দেখতে লাগে আর কী। এমনকী আফ্রিকার সেরেঙ্গেটি বা গেরোংগোরোর সিংহ বা চিতা। মনে হয় চিড়িয়াখানার জানোয়ার দেখছি।

মৃদুল বলল।

আপনি কি আফ্রিকাতে গেছেন নাকি?

মৃদুল বলল, আজকাল পৃথিবী দেখতে বেরোয় গাধারা। সমস্ত পৃথিবীটাই তো স্যাটেলাইট আর টিভির নানা চ্যানেলের দৌলতে মানুষের বসার বা শোয়ার ঘরের মধ্যে ঢুকে এসেছে। আমি যাব কোন দুঃখে? পাশে হুইস্কির বোতল, বরফ আর সিগারেট নিয়ে সোফাতে বসে মোড়ার ওপরে পা তুলে দিয়ে সারাপৃথিবী ঘুরে বেড়াই।

আর প্রমা? প্রমা তখন কী করে?

তটিনী বলল।

মেয়েদের যা করা উচিত। আমার জন্যে ভালোমন্দ রান্না করে।

বাঃ।

বাঃ। কেন? এতে ‘বাঃ-এর কী আছে? আমি একজন নাট্যকার, অভিনেতা, যাত্রা করলেও ওয়ান অফ দ্য লিডিং স্টেজ অ্যাক্টর, আমিই রোজগারটা করি। আমি আমার কর্তব্য করলে সে, তার কর্তব্য করবে না?

প্রমাও তো অভিনয় করে। ভালো গান গায়। আবৃত্তিও করে।

তটিনী বলল।

ছাড়ো তো। সেসব তো আমার-ই কালেকশানস-এর জন্যে।

তটিনী আহত হল। মৃদুলের এই স্বার্থপর-আত্মম্ভরী রূপের সঙ্গে পরিচয় ছিল না তটিনীর। হেসে ও যেন, নিজেই লজ্জিত হল। ভারি কষ্ট হল প্রমার জন্যে।

মৃদুল বলল, আসলে প্রমা খুব হোমলি। স্বামীকে নিজে হাতে ভালো-মন্দ রান্না করে খাওয়াতে খুব ভালোবাসে।

সময় পায় কী করে? বেশিরভাগ দিন-ই তো আপনারা দুজনে একইসঙ্গে বাড়ি ফেরেন!

সময় করে নেয় প্রমা। আমার জন্যে সময় করে। সব পুরুষের ক্যারিশমা তো সমান নয়। কিছু পুরুষ থাকে তারা প্রত্যেক মেয়ের কাছেই জাস্ট ইরেজিষ্টিবল।

তটিনী মুখে কিছু বলল না। মনে মনে বলল, ভাবছ তাই! ক-জন মেয়েকে দেখেছ? কী যে, ভাবে নিজেকে! আর–

তারপর-ই বলল, ও মা! কী লাল লাল বলের মতন? ওই মানুষেরা ওগুলো কুড়িয়ে জড়ো করছে কেন? নিয়ে যাব ক-টা ঘর সাজাবার জন্যে?

টাওয়ারের সামনে থেমে-থাকা গাড়ির দরজা খুলে আকাতরু নামতে নামতে বলল, ঘর তো সাজায় মানুষে এ-দিয়ে। তারপর বনবিভাগও জমিয়ে রাখে বীজের জন্যে।

দেখে মনে হয়, যেন মাকাল ফল। তাই-না? ছোটো মাকাল ফল।

মৃদুল বলল।

মাকাল ফল দেখেছেন আপনি?

তটিনী বলল।

দেখব না?

আপনি তো গ্রামে থাকতেন না। আমি না-হয় গ্রামের মেয়ে।

চিনি। চিনি। আমি সব চিনি।

সর্বজ্ঞর মতন বলল মৃদুল।

তটিনী মনে মনে বলল, মাকাল তো মাকাল চিনবেই। গায়ের রং একগাদা ফর্সা হলেই এদেশে মানুষ ‘সুন্দর’ বলে গণ্য হয়। এই পদ্ধতিতে মিত্তির সাহেবের পিগরিতে সুইজারল্যাণ্ড থেকে ইমপোর্ট করা সাদা শুয়োরগুলোও সুন্দর।

তারপর, আকাতরুকে প্রশ্ন করল, ওগুলো কোন গাছের ফল?

দুধে লালি। লইবেন তো কয়টা, নাকি?

নেব।

সোৎসাহে বলল তটিনী।

দুধে লালির ফল সংগ্রহ করার পরে তটিনী বলল, যেখানে যাচ্ছি সেখানে গিয়ে একটু ধুয়ে নিতে হবে। কোথায় যেন, যাচ্ছি আমরা?

জয়ন্তী। অবনী বলল।

তারপর বলল, আকা তুই কিন্তু ফাঁকি মারছিস। ওইসব গাছগাছালি তো অন্য বেশি জমিতে হয় না, সব গাছগুলো চেনা মৃদুলবাবু আর তটিনী দেবীকে। চুপ করেই যদি বসে থাকবি তো এলি কেন?

উত্তরে আকাতরু চুপ করেই রইল। কী আর বলবে। কেন যে, এল সে, ওই জানে। আকাতরুর সেই গানটি মনে পড়ে গেল। ইন্দ্রনীল সেন সেদিন গেয়ে গেলেন আলিপুরদুয়ারে–

কী সুর বাজে আমার প্রাণে
আমিই জানি, মনই জানে।
কীসের লাগি সদাই জাগি,
কাহার কাছে কী ধন মাগি
তাকাই কেন পথের পানে।।
আমি জানি, মনই জানে।

এটা কার গান কে জানে! অতুলপ্রসাদের কি? নাঃ। ওর গলাতে যদি ভগবান একটু সুর দিতেন তবে ও অবশ্যই গান শিখত। তটিনী যে, কী সুন্দর গান গায়। যখন স্টেজে উঠে ও সেজেগুজেগান গায় তখন মনে হয় আকাতরুর যে, ওর গলাতে চুমু খায়! একটা গান আছে। ‘হলুদ গোলাপ’-এ। কার লেখা গান অতশত ও জানে না আকা, কিন্তু গানের কথা আর তটিনীর গলা মিলে যেন, ওর প্রাণে রাভাদের ছোঁড়া বর্শার-ই মতন গেঁথে গেছে সেই গানটি।

প্রাণ তুমি প্রেম সিন্ধু হয়ে, বিন্দুদানে কৃপণ হলে
ওগো পিপাসিত জনে, উপায় কী দেহ বলে…।

দানাদার টপ্পার দানাগুলি যেন, একটি হিরের মতন ঝকঝক করে।

গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে। ওরা চলেছে জয়ন্তীর দিকে।

এটা কী গাছ?

এবারে মৃদুল বলল।

কোনটা?

লম্বা আকা ঘাড় হেঁট করে মুখ বাড়িয়ে দেখবার চেষ্টা করে বলল, কোন গাছটা?

ওই যে। ওই সামনের ওই মোড়ের বাঁ-দিকে, যে-গাছটি আছে, সেটি।

ও ওইটারে ইখানে আমরা কই মেড়া গাছ।

কী গাছ?

তটিনী জিজ্ঞেস করল।

কইলাম-না। মেড়া গাছ।

কী নাম রে বাবাঃ। এ কোন লিঙ্গ? পুরুষ তো?

অবনী বলল, মেড়া’ যখন, তখন নিশ্চয়ই পুরুষ। “দুর্বলে সবলা নারী সসাঃ প্রাণঘাতিকাঃ”।

মৃদুল আর তটিনী খুব জোরে হেসে উঠল।

তটিনী বলল, আপনি খুব রসিক আছেন মশাই। যাই বলুন আর তাই বলুন।

অবনী বলল, আকা আমার চেয়েও বেশি রসিক। তবে ওর জার্মান ভাষাটা বোধ হয়, আপনাদের বিশেষ রপ্ত হচ্ছে না। ল্যাঙ্গোয়েজ ব্যারিয়ারে আটকে যাচ্ছেন।

তটিনী বলল, এইজন্যেই আমার মনে হয়, পৃথিবীর সব মানুষদের-ই বোধগম্য হয়, এমন একটা Instrumental ভাষা উদ্ভাবন করা উচিত। ভাষার বাধা না থাকলে, মানুষে কতসহজে সারাপৃথিবীর কাছে পৌঁছোত পারত। পন্ডিত রবিশঙ্কর, আলি আকবর খাঁ সাহেব, আমজাদ আলি খাঁ সাহেব বা নিখিল ব্যানার্জি বা বুধাদিত্য মুখার্জি যতসহজে সারাপৃথিবীর মানুষের কাছে পৌঁছেছেন, তত সহজে কি আবদুল করিম খাঁ সাহেব বা ওস্তাদ বড়ে গুলাম আলি খাঁ সাহেব, সিদ্ধেশ্বরী দেবী অথবা কিশোরী আমনকার কখনো পৌঁছোতে পারবেন?

অবনী বলল, পারবেন অবশ্যই তবে হৃদয়ের সঙ্গে বোধ ও অনুভূতির মাধ্যমে যতখানি পৌঁছোনো যায় ততখানিই পৌঁছোবেন। তার বেশি নয়।

আকা বলল, ওই দেখেন। ওইটা হইল গিয়া সিঁদুরে গাছ। বড়োগাছ তা ত দেখতাই আছেন। ওই গাছের ডাল পুড়াইয়া যে, কাঠকয়লা হয় তা গুঁড়া কইর‍্যা গান-পাউডার হয়। গারো রাভা মেচিয়া নেপালি ডুবকা হক্কলেই, যাদের কাছে বে-পাশী গাদা বন্দুক আছে, তারা বারুদ বানায়।

গাদা বন্দুক কী জিনিস?

তটিনী বলল।

হেইডাই ত অরিজিনাল বন্দুক। গান পাউডারের নলের মধ্যে টুইস্যা দিয়া সামনে সিসা বা লোহার বল বা খুচড়া টুকরা-টাকরা ভইরা দিয়া BALL’ আর ‘SHOTS’ হয়। তারপরে না, সব একে একে অন্য বন্দুক রাইফেল সব আইছে। কর্ডাইট, হ্যাঁমারলেস, চোক, ইজেক্টর, রিপিটর। আর বন্দুক-ই বা কত, সিংহল-ব্যারেল, ডাবল-ব্যারেল, ওভার-আণ্ডার, প্যারাডক্স, লেখা জোকা আছে নাকি?

আপনি এত জানলেন কী করে?

ওর বড়োমামা ছিলেন খুব নামকরা শিকারি জলপাইগুড়ির। চা-বাগানের সব সাহেবরাই বন্ধু ছিলেন। চা-বাগান ছিল মামার। তার-ই শাগরেদি করে শিখেছে আর কী। আমাদের আকা কিন্তু গোটা চারেক চিতা মেরেছে। হরিণ, কুমির, ঘড়িয়াল, পাখি, এসবের তো গোনাগুনতি নেই।

ছিঃ। কী নিষ্ঠুর আপনি! কী করে মারেন অমন সব, প্রাণী আর পাখিদের।

আকা বলল, যখন মারছি, তখন মেলাই ছিল। আর শিকারি হিসাবেই মারছি। Butcher হিসাবে নয়। আমাগো ছুটোবেলায় আইনকানুন ছিল দ্যাশে। এমন পূর্ণস্বাধীনতা তো ছিল না তখন।

বলেই, মনে মনে বলল, হায়রে সুন্দরী। বন্দুকে আওয়াজ হয় বইল্যা বন্দুকের মার বোঝন যায় আর তুমি যে, আমারে এক এক চাউনি দিয়াই প্রতিক্ষণে মারতাছ তার বেলা? শালার ভগবানের কুননাই বিচার নাই।

ওইগুলো কী গাছ?

মৃদুলবাবু একটা সিগারেট ধরিয়ে বললেন।

ও তো আমলকী।

অবনী বলল, এ গাছ আমিও চিনি। একেবারে বন হয়ে রয়েছে যে।

আকাতরু বলল, চিতল হরিণে আমলকী খাইতে খুব ভালোবাসে। আর কোটরা বা বার্কিং ডিয়ারে খুবই ভালো বাইস্যা খায় শিমুলের ফুল।

ওই সিঁদুরে গাছের বটানিক্যাল নাম জানিস?

অবনী শুধোল আকাতরুকে।

জানি।

কী?

MALLOTUS PHILPINENSIS. মুয়্যের সাহেব নাম দিছিল।

তিনি আবার কিনি?

তা আমিই কী ছাই জানি?

এটি কি ফিলিপাইনস-এর গাছ?

সম্ভবত তাই। নাম শুইন্যা তো তাই মনে হয়।

আপনি এত জানলেন কী করে? আকাতরুবাবু?

মৃদুল বিস্ময়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করল।

জানবার ইচ্ছা হইল তাই। আমাগোর মধ্যে অধিকাংশরই কুনো ইনকুইজিটিভনেসই নাই? আপনে যদি ফরেস্ট ডিপার্টের সাহেবদেরও জিগান, ইটা কী গাছ মশয়? তয় উত্তর পাইবেনঃ ‘গাছ’। যদি জিগান, ইটা কী পাখি মশয়? তবেও উত্তর পাইবেনঃ ‘পাখি’। তবে এই অঞ্চলে ময়নাবাড়ি বিট-এর বিট অফিসার আছেন সুভাষ রায়। সেই ভদ্রলোক জঙ্গল এক্কেরে গুইল্যা খাইছেন। অত বটানিক্যাল নাম টাম জানেন না, ইংরাজ বা ল্যাটিন, কিন্তু দিশি নাম জানেন হক্কলের।

অবনী বলল, ময়নাবাড়ি বিট কোন ফরেস্ট রেঞ্জ-এর আণ্ডারে?

নর্থ রায়ডাক রেঞ্জ। ওই রেঞ্জের রেঞ্জার সুধীর বিশ্বাসও ভালো মানুষ। নতুন আইছেন। তবে জঙ্গলের ‘পুকা’ হইলেন গিয়া সুভাষবাবু।

মৃদুল বলল, পুকা-ফুকা দিয়ে আমি কী করব যখন জয়ন্তী থেকে ভুটানঘাটে যাব তখন আপনার ওই সুভাষবাবু বা রেঞ্জার সাহেব কি ভুটানি হুইস্কি খাওয়াতে পারবেন? “ভুটান মিস্ট” বলে একটা হুইস্কির নাম শুনেছিলাম আলিপুরদুয়ারে।

অবনী বলল, সর্বনাশ। সে তো স্মাগলড জিনিস।

হ্যাঁ।

মৃদুল বলল।

তারপর বলল, ভুটান থেকে সস্তা এক বোতল “ভুটান মিস্ট” জোগাড় করলেই জেলে যেতে হবে হয়তো আমাকে। কিন্তু ভারতে স্মাগলড জিনিস তো কিছুই আসে না। কলকাতার খিদিরপুর, মেট্রো সিনেমার পাশের গলি, পুরো চৌরঙ্গি এলাকা, শিলিগুড়ির বাজার, নকশালবাড়ির কাছে ধুলাবাড়ি বাজার, এ-সমস্ত জায়গাতেও কোনো স্মাগলড জিনিস বিক্রি হয় না। কলকাতার নিউমার্কেট, এয়ারকণ্ডিশানড় মার্কেট, নিউ দিল্লির পালিকা বাজার, বম্বের ‘হিরা-পান্না’, স্মাগলড জিনিস কি কোথাওই পাওয়া যায়? আমাদের দেশের পুলিশ আর কাস্টমস ডিপার্টমেন্ট যখন, সতোর গল্প ফাঁদে তখন, তাদের বলতে ইচ্ছে হয় যে, আর কোনো গুণ যদি নাই থাকে তো ‘চক্ষুলজ্জা’টা তাদের অন্তত থাকা উচিত। বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো।

আপনি বেশি সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছেন মৃদুলবাবু।

মৃদুল, দুশ্চরিত্র হলেও, ভন্ড হলেও মনে হয়, মানুষটা অসৎ নয়।

সে বলল, সিরিয়াস’ একটা ইংরেজি শব্দ। তাতে কোনো ম্যাগনেচুয়ড নেই। তাই, আমি সিরিয়াস হতে পারি কিন্তু বেশি বা কম সিরিয়াস হওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।

যাকগে।

অবনী বলল।

অবনী ভাবছিল, মৃদুলবাবুর গলার স্বরটি ভারি ভালো। কলকাতার এফ-এম-এ প্রোগ্রাম যাঁরা কনডাক্ট করেন তাঁদের গলার স্বরের মতন। কিন্তু গলার স্বরের ভালোত্ব আর বক্তব্যের ভালোত্ব বোধ হয় সমার্থক নয়।

তটিনী বলল, আমাকেও কলকাতাতে একজন বলেছিল, ভুটান মিস্ট’ বলে একটা হুইস্কি ভুটান থেকে আসে। সেটা নাকি চমৎকার।

তুমি কি আজকাল হুইস্কির সমঝদার হয়েছ নাকি তটিনী?

যে-পরিবেশে থাকি তাতে এতদিনে যে, পাঁড় মাতাল হয়ে যাইনি তাই তো যথেষ্ট। আমি মাঝে মাঝে একটু-আধটু খাই না যে, তা নয়, তবে শুধুই সাধুসঙ্গে খাই।

আমি কি সাধু নই?

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, সে-প্রশ্ন নিজেকেই করবেন। আমি তো জজসাহেব নই, আপনার আয়নাও নই। আমার মতামতের দাম-ই বা কী?

মৃদুল বলল, যাইহোক অবনীবাবু, তটিনী যখন খোঁজ দিলই তখন, ভুটানি কুয়াশা’ একটু জোগাড় করুন। আপনাকে দিয়ে হবে না মনে হচ্ছে। পারলে ওই আকাতরুবাবুই পারবেন। দাম আমি দিয়ে দেব।

আকাতরু চুপ করে থাকল। সে মদ খায়ও না, কেউ খাক তা, পছন্দও করে না। তটিনী যে মাঝে মাঝে খায়– এইকথাটা তাকে ব্যথিত করেছে।

সুভাষচন্দ্র রায়, ময়নাবাড়ি বিট-এর বিট অফিসারের কথা যখন, উঠলই তখন বলি প্রমীলার কথাও।

আকাতরু বলল।

প্রমীলাটি কে? তার রক্ষিতা নাকি? নাকি অনূঢ়া কন্যা?

মৃদুল বলল।

ছিঃ ছিঃ।

বলল অবনী।

‘যাদৃশী ভাবনা যস্য’! কী করা যাবে? মৃদুলবাবুর ভাবনার জগৎটা হয়তো ছোটো।

তটিনী বলল।

হয়তো তাই। রক্ষিতাদের বৃহৎ জগৎ সম্বন্ধে তোমার যতখানি জ্ঞান আমার তো ততখানি নয়।

মৃদুল বলল।

আকাতরু বলল, ভদ্রলোক সংসারী। ওখানে একা থাকেন। ফ্যামিলি অন্যত্র থাকেন। তারপর একটু উত্তেজিত হয়ে বলল, এইরকম বাজে ইয়ার্কি ভালো নয়।

যাক সে-কথা। এখন বলুন, প্রমীলা কে?

প্রমীলা বনবিভাগের পোষা হাতি। ময়নাবাড়ি বিটেই থাকে। নানা কাজে লাগে। মাদি হাতি।

প্রমীলা যে, মরদও হয় তা তো আগে জানতাম না। তবে প্রমীলাদের মধ্যেও মরদের স্বভাব থাকে যদিও অনেকের-ই।

মৃদুল বলল।

খোঁচাটা যে, তটিনীর-ই প্রতি তা, তটিনী যেমন বুঝল, অন্যরাও বুঝল।

তটিনী বলল, তা ঠিক। আবার উলটোটাও দেখা যায় অনেক সময়ে।

কী বললে?

মৃদুল বলল।

খ্যাতিতে পুরুষসিংহ, আসলে নখদন্তহীন, ম্যাদামারা।

মৃদুল চুপ করে গেল।

আকাতরু শুনছিল সব আর তার কপালের শিরা দু-টি দপদপ করছিল। ওর বন্ধু ডাক্তার মৃগেন বলে যে, ওর ব্লাড-প্রেশার হাই হয়ে গেছে। ওষুধ খাওয়া দরকার। সবরকম উত্তেজনা বর্জন করাও উচিত। কিন্তু কী করবে। তার-ই সামনে কেউ তটিনীকে ঠুকবে আর তার ব্লাড প্রেশার ঠিক থাকবে তা তো হবার কথা নয়।

এটা কী গাছ?

তটিনী বলল, আকাতরুকে।

ওইটা হলুদ। সফট উড। কাঠের রংও হয়। কাঁঠাল কাঠ দেখেছেন কখনো?

হ্যাঁ। গ্রামের কাঁঠাল কাঠের পিঁড়ি দেখেছি। আমাদের বাড়িতেও ছিল। সস্তার কাঠ।

ঠিকই কইছেন! হলুদও তাই।

এবারে আপনি পর পর গাছগুলো চিনিয়ে দিন তো আমাকে। এই হলুদ গোলাপ’ যাত্রা নিয়ে এসে তো অনেককিছুই ভুলতে বসলাম। কিছু শিখেও যাই এখান থেকে।

বেশ। কইতাছি। শোনেন আপনে।

মৃদুল বলল, মনেই ছিল না। আমাদের সঙ্গে ফ্লাস্কে তো কফি আছে। এই নিবিড় নিচ্ছিদ্র জঙ্গলে একটু কফি খেয়ে অ্যাডভেঞ্চার করলে হত নাকি? নাকি রাতের বেলা হবে।

রাতের বেলা হাতির লাথি খেতে কে আসবে এখানে? উত্তরবঙ্গের হাতিরা ডেঞ্জারাস এবং আনপ্রেডিক্টেবল। হ্যাঁবিট্যাট নষ্ট হয়ে গেছে।

অবনী বলল।

হাতির হ্যাবিট্যাট নষ্ট হয়েছে বলে প্রায়-ই নানা কাগজে বন্যপ্রাণী দরদি আর পন্ডিতদের আর্টিকেল দেখি। অথচ মানুষের ‘হ্যাবিট্যাট’ যে, কবেই পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে সে-কথা আর কে বলে? মানুষের নিজের প্রতিই তার কোনো দরদ নেই। ভারি আশ্চর্যের কথা।

মৃদুল বলল।

তা যা বলেছেন। মানুষ-ই এখন সবচেয়ে ইম্পর্ট্যান্ট প্রাণী পন্ডিতদের কাছে।

অবনী বলল।

আকাতরু বলল, রবিঠাকুরে ঠিকোই কইছিলেন– যারা সবকিছুই পন্ড করে তারাই হইল গিয়া পন্ডিত।

মানুষের মধ্যে আবার পুরুষ মানুষ-ই হচ্ছে সবচেয়ে বেশি নেগলেগটেড। কবে যে, এই প্রজাতির পুংলিঙ্গ পুরোপুরি extinct হয়ে যাবে, তা কে বলতে পারে? তাদের জন্যে কাঁদবার কেউই নেই। আর তাদের জন্যে কেঁদে, পুরুষের দু-চোখ দিয়ে ধারা বইছে অবিরত।

দ্যাখেন ম্যাডাম, ওইটা কী গাছ কন দেহি?

আমাকে ‘ম্যাডাম’ বলবেন না।

তা! কী কম? মানে, কী বইল্যা ডাকুম?

নাম ধরেই ডাকবেন। আমি কি আপনার পিসিমা, না শাশুড়ি?

নাম ধইর‍্যা ডাকুম?

হ্যাঁ।

আকাতরুর সারাশরীরে যেন, বিদ্যুত্তরঙ্গ বয়ে গেল। ভালো করেই বুঝতে পারল যে, এক একবার ‘তটিনী’ বলবে আর তার শরীর মনের ব্যাটারি একটু একটু করে ডিসচার্জ হতে থাকবে। ডায়নামোটা যে, চারদিন আগে তটিনীর সঙ্গে প্রথমবার দর্শনেই গেছে। আকাতরুর রবিঠাকুরের সেই গানটা মনে পড়ে গেল।

বিনা প্রয়োজনের ডাকে ডাকব তোমার নাম,
সেই ডাকে মোর শুধু শুধুই পুরবে মনস্কাম।
শিশু যেমন মাকে নামের নেশায় ডাকে,
বলতে পারে এই সুখেতেই মায়ের নাম সে বলে
তোমারি নাম বলব নানা ছলে।

মনে মনে বলল, তটিনী! তটিনী!

অন্যমনস্ক হয়ে গেছিল আকাতরু।

কী হল আকাতরু, গাছ চেনাচ্ছেন না যে? জয়ন্তীতে পৌঁছে গেলে কি আর এতগাছ পাব? সে জায়গাটা কেমন?

দারুণ জায়গা।

অবনী বলল। কত গাছ চাই? সব গাছ-ই পাবেন।

তারপর বলল, মনে হবে, যেন, নদীর মধ্যেই রয়েছেন। চানঘরে যখন চান করবেন, যদি জানালা খুলে রাখেন, তা রাখতে কোনো বাধাও নেই, কারণ বাংলোটা অনেক-ই উঁচু আর দিনের বেলাতে তো বাইরে থেকে কিছু দেখা যাবে না, তাহলে মনে হবে যেন, নদীতেই চান করছেন। নদীর ওপারে ভুটানের দিকে পাহাড়। আকাশ প্রায় ঢেকে দিয়েছে। বাঁ-দিকে দূরে বাঁক নিয়ে একটি দ্বীপের সৃষ্টি করে হারিয়ে গেছে।

আহা! আর বলবেন না। নিজের চোখে দেখব।

নদী যেখানে বাঁক নিয়ে চোখের আড়ালে চলে যায়, মনে হয় নাকি যে, নদীর সব রহস্য সেখানেই আছে? সব ফুল, সব পাখি, তার গায়ের গন্ধ…

তটিনী বলল।

আকাতরু বলল, আপনের কথাগুলানও য্যান যাত্রার ডায়ালগেরই মতন মিষ্টি। কী কইর‍্যা যে, অমন কথা কন আপনে, আপনেই জানেন।

তটিনী হেসে উঠল।

তটিনী হাসলে আকাতরুর বুকটা ভালোলাগায় কেঁদে ওঠে। ভালোবাসা যে, ঠিক এইরকম বেদনাদায়ক কোনো হাড়ি পিলপিলানো অসুখ, সে-সম্বন্ধে তার কোনো ধারণাই ছিল না! বড়ো কষ্ট। এ কেমন আনন্দ, যারমধ্যে এমন কষ্ট থাকে?

ভাবছিল আকাতরু।

ওই গাছটার নাম আকাশপ্রদীপ।

বাঃ। কী সুন্দর গাছ। আর আরও সুন্দর নাম।

হ্যাঁ। গাছটা অস্ট্রেলিয়ান।

তাই?

হ্যাঁ।

বটানিকাল নাম কি জানেন নাকি?

বটানিকাল নাম অ্যাকাসিয়া মানগিয়াম।

তটিনী বলল, রাঁচিতে একবার নাটক নিয়ে গেছিলাম। ওঁরা বেতলাতে নিয়ে গেছিলেন, পালামৌ ন্যাশনাল পার্ক-এ। বেতলার সবচেয়ে পুরোনো বনবাংলোর কম্পাউণ্ডে একটি অস্ট্রেলিয়ান ফুল গাছ দেখেছিলাম। দেখিয়েছিলেন, ডি.এফ.ও কাজমি সাহেব আর গেম ওয়ার্ডেন সংগম লাহিড়ী। ভারি সুন্দর তবে গাছটা আকাশমণির মতন বড়ো নয়। মানে, আমি যখন দেখেছিলাম তখন বড়ো রাধাচূড়ার অথবা স্থলপদ্মর মতন ছিল। ফুলগুলো কাগজের ফুলের মতন দেখতে।

নাম কী? মনে আছে?

অবনী বলল।

দাঁড়ান। দাঁড়ান। মনে করি। নামটাও ভারি সুন্দর। ফুল হয় মার্চ-এপ্রিলে। কাগজের ফুলের মতন। সাদা ফুল! হ্যাঁ মনে পড়েছে। গ্লিনিসিডিয়া সুপার্বা।

বাবাঃ। এ কোথায় এসে পড়লাম রে বাবা! কখন যে, আমার পিতৃদেবের বটানিকাল নাম জিজ্ঞেস করে বসবেন আপনারা মশাই, সেই ভয়ে আছি এখন। জঙ্গলে বেড়াতে এসে এমন বিপদে পড়ব আগে জানলে আসতাম না। কোথায় একটু নির্জনে তাস খেলব, মাল খাব শান্তিতে, তা নয় এ কী বিপদ রে বাবা!

অবনী ও আকাতরু এমনকী ভাড়াগাড়ির ড্রাইভার মদন পর্যন্ত হেসে উঠল মৃদুলের কথাতে। কিন্তু তটিনী হাসল না।

সে বলল, আশ্চর্য। অথচ আমাদের মধ্যে আপনিই সবচেয়ে বেশি শিক্ষিত। ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির এম.এ.।

বাংলায় এম.এ. পাশের সঙ্গে বাঁশ অথবা ঘেটুফুল চেনার কী সম্পর্ক?

আমরা কেউই তো এম.এ. পাশ নই। আমি তো কলেজেই যাইনি। অবনীবাবু ও আকাবাবুর কথা জানি না। কিন্তু জানার ইচ্ছের সঙ্গে ডিগ্রির তো কিছুমাত্র সম্পর্ক আছে বলে বুঝতে পারি না। যদিও থাকা উচিত ছিল কথাতেই বলে “The purpose of a University is to bring the horse near the water and to make it thirsty’. Eetcard $10 tot com বিশ্ববিদ্যালয়ের পাকানো কাগজটি হাতে পাওয়ার পরেই জাগবার কথা। তাই নয় কি? সব মানুষের সব ডিগ্রিই তো পাকানো কাগজমাত্র। “শিক্ষা’ তো মানুষ তার কথাবার্তা, তার ব্যবহারেই, তার চলায়-বলায়, তার জ্ঞান-পিপাসার মধ্যেই বয়ে বেড়ায়। প্রকৃত শিক্ষাতে আর ডিগ্রিতে কোনোদিনই কোনো মিল ছিল না।

তুমি বলতে চাইছ সাযুজ্য? শব্দটা ‘সাযুজ্য’ই কি?

হ্যাঁ। আমি তো ভালো বাংলা জানি না।

তটিনী বলল।

ইংরেজি আর ফ্রেঞ্চটা বুঝি, বাংলার চেয়েও ভালো জান?

মৃদুল বলল।

তটিনী অপমানিত হয়ে বলল, আমি যাত্রাদলের অশিক্ষিতা নায়িকা-বাংলাটাই ভালো করে জানি না আর ওসব তো! তা ছাড়া আমি তো মৃদুলবাবু আপনার এবং অনেক বড় তাবড় বুদ্ধিজীবীদের মতন হেলিকপ্টার থেকে গড়িয়াহাটের মোড়ে পড়িনি। মেদিনীপুরের গ্রাম থেকে অতিসাধারণ প্রায় লজ্জাকর অতীত থেকে এতখানি ধুলো-ময়লা মাড়িয়ে হেঁটে এসেছি অনেক কষ্ট করে।

জানি। ধুলো-ময়লা মাড়ায় অনেকেই কিন্তু মন্দিরে ঢোকার আগে যে-জুতো পরে তা মাড়িয়ে এল, তা খুলে রাখে বাইরে। শোয়ার ঘরে বা মন্দিরে জুতো পায়ে ঢোকার দরকার-ই বা কী? আমি তো তোমার অতীত সম্বন্ধে কিছু জানি। একেবারেই জানি না, তা তো নয়।

মৃদুল বলল।

কী জানেন?

তোমার অতীতের সব কথা জানি না। কিছু অবশ্যই জানি। তোমার বর্তমানটাও কি খুব একটা গৌরবের?

তটিনী দাঁত চেপে বলল, তাই-বা বলি কী করে? আপনি যখন, স্টেজে আমার নায়ক, বর্তমানটাও যে, গর্ব করার মতন কিছু, তাই-বা বলি কী করে? আমার মতন অনেকেই আছেন যাঁরা সমস্ত জীবনেই গর্বিত হওয়ার মতন কিছু করতে পারেন না। কী করা যাবে? তাদের সবকিছুকেই মানিয়ে নিতে হয়।

আকাতরু মনে মনে খুব রেগে গেল মৃদুলের ওপরে। মানুষটা একটা বাজে মানুষ। এবং শ্রদ্ধা বাড়ল তটিনীর ওপরে।

তটিনী বলল, এই সমাজে যে-মেয়ে একা থাকে, একা কাজ করে, যার সংসার নেই সে, সবসময়েই খারাপ, সমালোচনার পাত্রী। আর পুরুষমাত্রই দেবতা, সে একাই থাকুক কী সংসারীই হোক।

তুমি কি ধোওয়া-তুলসী পাতার কথা বলছ? তুমি…

আমি তুলসী পাতার ‘পবিত্রতা কোথায় পাব? তুলসীই নই! তার ধোওয়া আর অধোওয়া! অবনী প্রসঙ্গান্তরে গিয়ে বলল, কী রে আকা, গাছ চেনবার কী হল? গাছ চিনাইতে যাইয়াই ত এমন বিপত্তি। দেখতাছি যে, মানুষ চিনোনের চাইয়া গাছ চিনোন অনেক-ই সোজা।

মৃদুল বুঝল কথাটা আকাতরু তাকে উদ্দেশ্য করেই বলেছে। কিন্তু এই ষাঁড়ের মতন মানুষটাকে না ঘাঁটানোই মনস্থ করল। মৃদুলকে সে, জঙ্গলে ছুঁড়েও ফেলে দিতে পারে। আর বাঙালের রাগ বলে কথা!

ওটা কী পাখি?

তটিনী হঠাৎ বলল, বাঁ-দিকের জঙ্গলের মধ্যে ঝুঁটিঅলা একটা বাদামি আর সাদা পাখিকে দেখিয়ে।

অবনী বলল, ওটা হুপী।

আর ওইগুলো?

ওগুলো ছাতারে। ইংরেজি নাম BABBLER। সবসময় মানুষের মতন-ই কলকলিয়ে কথা বলে।

অবনী বলল।

BABBLER? না ThRASHER?

আকাতরু বলল।

THRASHER বুঝি? তা হবে।

মানুষই কি সবচেয়ে বেশি কথা বলে? সব প্রাণীদের মধ্যে?

তটিনী শুধোল।

নট আনলাইকলি।

অবনী বলল।

Pages: 1 2 3 4

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress