এত্তেলা পেয়ে বটেশ্বর আর বিশ্বেশ্বর
এত্তেলা পেয়ে বটেশ্বর আর বিশ্বেশ্বর হেলেদুলে এসে হাজির। দু’জনেরই বেশ মজবুত চেহারা। একটা কুস্তির আখড়া আছে, তাতে দশটা গাঁয়ের পঞ্চাশ-ষাটটা ছেলে কুস্তি শিখতে আসে। ডলাইমলাইতে বিশ্বেশ্বর আর বটেশ্বরের খুব নাম।
নসিরাম বললেন, “ওরে বিশু, ওরে বটু, দ্যাখ তো বাবা, এই টিঙটিঙে ডাকাতটাকে মানুষ করতে পারবি কিনা।”
ডাকাত শুনে একটু ভড়কে গিয়ে বটেশ্বর বলে উঠল, “ওরে বাবা! ডাকাত তো সর্বনেশে ব্যাপার কর্তা! বাঘা কুকুর পুষুন, দুষ্ট গোরু পুষুন, এমনকী বাঘ-সিংহ পুষুন, তাও ভাল। কিন্তু ডাকাত পোষাটা আপনার ঠিক হচ্ছে না।”
নসিরাম গম্ভীর হয়ে বললেন, “আহা, ওসব তো সবাই পোষে। ওতে মজা নেই। ডাকাত পোষা একটা নতুন ব্যাপার তো!”
বিশ্বেশ্বর নীরবে খাঁদু গড়াইকে ভাল করে দেখে নিয়ে বলল, “কত দর পড়ল কর্তা? তা যাই দর দিয়ে থাকুন, বড় ঠকে গেছেন। এই অচল ডাকাত কে আপনাকে গছিয়ে গেল? এ ডাকাত এ পরগনায় চলবে না।”
নসিরাম অবাক হয়ে বলেন, “বলিস কী রে? এক্কেবারে অচল নাকি?”
“দরকচা মারা চেহারা দেখছেন না? এরকম পাকানো শরীরে কি মাংস লাগে? লাগলেও খরচা মেলা পড়ে যাবে। তারপর ধরুন, এ পরগনার সব ডাকাতই হল রীতিমতো পালোয়ান। প্রহ্লাদ ডাকাত এখনও বেঁচে। লোকে বলে, প্রহ্লাদ না জল্লাদ। ওই নামে একখানা পালাও বেঁধেছিল হরিহর নিয়োগী। সেই পালা বিষ্ণুপুরে সাত দিন ধরে ডবল শো হাউসফুল গিয়েছে। স্বয়ং প্রহ্লাদ সেই পালা দেখে হাপুস নয়নে কেঁদেছিল। আর শুধু প্রহ্লাদই বা কেন, মোটকা মল্লিক, টেকো টগরকুমার, গুঁফো গণেশ, হাড়ভাঙা হারাধন, লেঠেল ললিত, মারকুটে মহেশ, চাকু চপল, সড়কি সতীশ, বাঘা বগলা, কার পাশে একে দাড় করাবেন বলুন তো!”
নসিরাম একটু দমে গিয়ে বলেন, “না রে, যতটা ভাবছিস ততটা নয়। এলেম আছে। এই তো বারোখানা রুটি আর একবাটি ডাল সেঁটে দিল। সঙ্গে এক খাবলা বেগুনপোড়া। তার উপর গায়ে ডাকাতের রক্তও আছে তো! ওর খুড়ো নাকি মস্ত ডাকাত!”
বিশ্বেশ্বর অবাক হয়ে বলে, “নাকি? তা তোমার খুড়োর নাম কী হে?”
খাঁদু বিনয়ের সঙ্গেই বলল, “আজ্ঞে, রাখালহরি গড়াই।” বিশ্বেশ্বর একটু ভেবে মাথা নেড়ে বলল, “না, এ-পরগনার নয়।”
নসিবাবু একটু তোয়াজ করে বললেন, “একটু নেড়েচেড়ে দ্যাখ না বাবা। ডলাইমলাই করলেই দেখবি আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে উঠেছে। আমার তো দেখেই মনে হয়েছিল, এর ভিতরে ডাকাতির জীবাণু একেবারে বিজবিজ করছে।”
“আপনি যখন বলছেন কর্তা, তখন দেখাই যাক। ওহে বাপু, একটু উঠে দাড়াও তো!”
খাঁদু উঠবার আগেই দুই পালোয়ান দু’দিক থেকে এসে তার নড়া ধরে হ্যাঁচকা টানে খাড়া করে দিল। বটু বলল, “প্রথমটায় একটু হাল্কা কাজই দিচ্ছি। দুশো বৈঠক মারো তো বাপু!”
খাঁদুর চোখ কপালে উঠল, “দুশো! বলেন কী মশাই! ইসকুলে অবধি দশবারের বেশি ওঠবস করায় না! এই ভরা পেটে বেশি নড়াচড়া করলে বদহজম হবে যে! অম্বল হয়ে যাবে।”
বিশু নসিবাবুর দিকে চেয়ে বলে, “শুনলেন, কর্তা? ডাকাতের অম্বল হয় কখনও শুনেছেন?”
নসিবাবু হেঁকে বললেন, “ওরে, ঠিকই বৈঠক মারবে। একটু কোঁতকা-টোঁতকা দিয়ে দ্যাখ না? আড় ভাঙতেই যা সময় লাগে।”
বিশু পট করে খাঁদুর বাঁ পাঁজরে দু’আঙুলে একটা খোঁচা মারতেই খাঁদু বাপ রে’ বলে লাফিয়ে উঠল।
বিশু মাথা নেড়ে বলল, “এ, এ যে একেবারে ভুসিমাল গছিয়ে গিয়েছে আপনাকে কর্তা! পাঁজরার হাড় তো প্যাকাটির মতো মুড়মুড় করছে।”
বটুও খুব চিন্তিত মুখে বলল, “দাবনায় তো মাংসই নেই কর্তা!”
নসিবাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, “শোন বাপু, একটা গাট্টাগোট্টা চেহারার লোক পেলে তাকে তৈরি করা তো সোজা কাজ। তাতে কি মজা আছে কিছু? এই তালপাতার সেপাইকে যদি পালোয়ান না বানাতে পারলি তবে কীসের মুরোদ তোদের?”
বিশু লজ্জিত মুখে বলল, “তা কর্তা যখন বলছেন, মেহনত করলে অচল পয়সাও যখন চালানো যায়, তখন আমরাও চেষ্টা করে দেখব। আপনার একটু খরচাপাতি যাবে, এই যা!”
বটু খাঁদুর দিকে চেয়ে বলল, “কী হে বাপু, বৈঠক মারবে, নাকি ফের খোঁচাখুঁচি করতে হবে।”
খাদু পিটপিট করে দু’জনের দিকেই ভয়ে ভয়ে চাইল। তারপর বলল, “যে খোঁচা মেরেছেন মশাই, তাতেই তো শরীর ঝনঝন করছে। বৈঠক যে মারব, হাঁটুতে যে জোর পাচ্ছি না মোটে। তা জোরাজুরি যখন করছেন তখন অগত্যা মারতেই হয়।”
বলে খাদু টপাটপ বৈঠক মারতে শুরু করল। নসিবাবু কড় গুণে হিসেব রাখতে রাখতে মাঝে মাঝে তারিফ করে উঠতে লাগলেন, “বাহবা !… বহোত আচ্ছা!… চালিয়ে যা বাবা!… বাঃ বাঃ, এই তো দিব্যি হচ্ছে।”
তা হলও। বটু আর বিশুও হাঁ করে দেখল, খাদু গড়াই দিব্যি দুশোটা বৈঠক মেরে একটু হাঁদাতে হাদাতে বলল, “হল তো মশাই! এবার খ্যামা দিন।”
দুশো বৈঠক মারা যে চাট্টিখানি কথা নয়, তা বটু আর বিশু ভালই জানে। ছোঁড়া যে অত বৈঠক একবারে মেরে দেবে, তা তারা স্বপ্নেও ভাবেনি।
বিস্ময়টা চেপে রেখে বটু বলল, “মন্দ নয়। তবে এ তো অল্পের উপর দিয়ে গেল। এবার তোমার পাঞ্জার জোরটা যে একটু দেখাতে হচ্ছে বাপ। এই যে আমার ডান হাতের পাঁচ আঙুল ছড়িয়ে দিলুম, তুমিও তোমার পাঁচ আঙুল দিয়ে কষে ধরো। যে যার ডান দিকে মোচড় দিতে হবে। বুঝলে?”
নসিবাবু বিশুকে সাবধান করে দিয়ে বললেন, “ওরে, তুই একটু হিসেব করে মোচড় দিস। তোর তো হাত নয়, বাঘের থাবা, বেচারার কবজিটা আবার মট করে ভেঙে দিস না বাবা!”
“না, কর্তা! হিসেব করেই দিচ্ছি।”
কিন্তু বিশুর হিসেব একটু উলটে গেল। কারণ, খাদু গড়াইয়ের রোগাপানা হাতখানাকে যত দয়াদাক্ষিণ্য দেখানোর কথা, ততটা দেখায়নি বিশু। সে বেশ বাঘা হাতে চেপে ধরে পেল্লায় একটা মোচড় মেরেছে। কিন্তু এ কী! খাদু গড়াইয়ের দুবলা হাতখানা মমাটেই পাক খেয়ে গেল না। বরং তার সরু আঙুলগুলো লোহার আাঁকশির মতো বেশ বাগিয়ে ধরে আছে বিশুর মোটা মোটা আঙুল। কবজি টসকাল না, বরং যেন একটু একটু করে ডান দিকে ঘুরে যেতে লাগল। মিনিটখানেক একভাবে থাকার পর আচমকাই একটা রাম মোচড়ে বিশুর হাতখানা উলটে দিল খাঁদু। বিশু বাপ রে’ বলে হাতটা ঝাড়তে ঝাড়তে অ্যাই বড় বড় চোখ করে খাঁদুর দিকে চেয়ে রইল।
নসিবাবু চেঁচিয়ে উঠলেন, “শাবাশ!” কিন্তু ব্যাপারটা বিশ্বাস্যই নয়। বটু বা বিশু কেউ বিশ্বাস করতেই পারছিল না যে, এই রোগাপটকা লোকটা বিশুকে গোহারান হারিয়ে দিয়েছে।
নসিবাবু বললেন, “বলি ব্যাপারটা কী হল বল তো? ইচ্ছে করে হেরে গেলি নাকি?”
বিশু গম্ভীর হয়ে মাথা নেড়ে বলল, “না, কর্তা, এর মধ্যে অন্য ব্যাপার আছে।”
“কী ব্যাপার ?”
“এ-লোকটা মন্তরতন্তর জানে। বোধহয় পিশাচসিদ্ধ।”
নসিবাবু হাত নেড়ে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গি করে বললেন, “দুর, দুর! মন্তরতন্তর সব কুসংস্কার। মন্তরে কাজ হলে আর লোকে এত কসরত করত না। বোমাবন্দুকও রাখত না। ওসব নয় রে। এই খাঁদু গড়াইয়ের ভিতরে খাঁদু ডাকাত ফুসছে। ও আমি দেখেই চিনেছিলাম। তোরাই কেবল তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছিলি।”
অপমানটা বটুর ঠিক সহ্য হচ্ছিল না। সেও মন্তরতন্তরে বিশ্বাসী নয়, ডাকাবুকো লোক। সে হাতে হাত ঘষে দন্ত কিড়মিড় করে বলল, “কর্তা, যদি অনুমতি দেন আমি এ ব্যাটাকে একটু যাচাই করি।”
খাঁদু ককিয়ে উঠে বলল, “আর না, আর না। আমি হেরে গিয়েছি বলেই ধরে নিন না কেন।”
নসিবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, “ওরে, জীবনে কি পরীক্ষার শেষ আছে? সীতার অগ্নিপরীক্ষার পরও কি বনবাস হয়নি? হারার আগেই হেরে যাবি কেন? তোর রক্তে যে এক ডাকু ডাকহাঁক করছে, শুনতে পাস না আহাম্মক। যা, এটাকেও হারিয়ে দে।”
বটু বলল, “শোনো বাপু, এবার আর পাঞ্জার লড়াই নয়। আমরা দু’জনেই দু’জনকে চেপে ধরব। যে চেপে অন্যের দম বের করে দিতে পারবে তার জিত। বুঝলে?”
খাঁদু কঁদো কাঁদো হয়ে বলে, “বুঝেছি। আজ বুঝি আমার প্রাণরক্ষা হল না। অপঘাতে মরলে কী গতি হবে কে জানে!”
নসিবাবু সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, “ওরে, গতি নিয়ে ভাবিসনি। নিতান্তই যদি মরিস তবে তোর বৃষোৎসর্গ শ্রাদ্ধ করব। দ্বাদশ ব্রাহ্মণ ভোজন করাব। চাস তো গয়ায় গিয়ে পিন্ডিও দিয়ে আসব। সে এমন শ্রাদ্ধ হবে যে, তার ঠেলায় একেবারে স্বর্গের সিংহদরজায় গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়বি। দেখে নিস।”
খাঁদু ঘাড় নেড়ে বলল, “যে আজ্ঞে, তবে আর কথা কী? কিন্তু, দুঃখের কথা কী জানেন, শ্রাদ্ধের ভোজটা যে আমার ফঁক যাচ্ছে। লোকে যখন ভেঁড়েমুশে সাপটে ভোজ খাবে তখন যে আমার কপালে হাওয়া ছাড়া কিছুই জুটবে না।”
নসিবাবু মোলায়েম গলায় বলেন, “তা তুই চাস কী?”
“আজ্ঞে, বলছিলাম, ভোজের আগাম বাবদ যদি কিছু মূল্য ধরে দিতেন তা হলে বুকটা ঠান্ডা হত।”
“সে আর বেশি কথা কী? এই যে, পঞ্চাশটা টাকা রাখ। তুই যে এত ঘোড়েল তা এতক্ষণ বুঝতে পারিনি।”
টাকাটা ট্যাঁকে খুঁজে খাঁদু একগাল হেসে বলল, “আজ্ঞে কর্তাবাবা, ট্যাঁকে টাকাপয়সা থাকলে মানুষের একটু জোর হয়। সত্যি কথা বলতে কী, এখন যেন হাত-পায়ে একটু সাড় ফিরেছে।”
বটু মাথা চুলকোতে চুলকোতে মিনমিন করে বলল, “কর্তা, একটা কথা…”
“তোর আবার কী কথা?”
“আজ্ঞে, বলছিলাম কী, আমাদেরও তো বাঁচা-মরা আছে, শ্রাদ্ধের
ব্যাপার আছে। আমাদেরও তো নিজের শ্রাদ্ধের ভোজ খেতে ইচ্ছে হতে পারে, নাকি? তাই বলছিলাম যে…”
নসিবাবু হাঁ করে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে হুংকার দিয়ে বললেন, “তোর মতো জাম্বুবান যদি এই টিঙটিঙে তালপাতার সেপাইয়ের হাতে মরে, তা হলে এ-গাঁয়ে কেউ আর তোর মুখ দেখবে ভেবেছিস? শ্রাদ্ধ তো দুরের কথা, তোকে শ্মশানে নেওয়ারও লোক জুটবে না। নিজেকেই হেঁটে শ্মশানে গিয়ে নিজের মড়া নিজেকেই পোড়াতে হবে। বুঝেছিস?”
বটু মাথাটাথা চুলকে ঘাড় নেড়ে বলল, “বুঝেছি।”
“আরও ভাল করে বুঝে দ্যাখ। যদি প্রাণের ভয় থাকে তো মানে মানে বিদেয় হ। আমি গাঁয়ে রটিয়ে দেব যে, তুই একটা রোগা-দুবলা লোকের ভয়ে ন্যাজ দেখিয়েছিস। তা হলে কি গাঁয়ে তোর মান থাকবে, নাকি তোর কুস্তির আখড়ায় আর কেউ কোনওদিন যাবে?”
বটু একথায় ফুঁসে উঠে বলল, “এই ছারপোকাটাকে ভয়! হাঃ হাঃ! কর্তা কী যে বলেন! এক্ষুনি এর দম বের করে দিচ্ছি।”
বলেই তেড়ে এসে খাঁদুকে জাপটে ধরল বটু। ঠিক যেমন লৌহ-ভীম চূর্ণ করতে ধৃতরাষ্ট্র জাপটে ধরেছিলেন। খাঁদু সেই ভৈমী চাপে কোঁক করে উঠল। তারপর প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে সেও সাপটে ধরল বটুকে। তারপর বিশালদেহী বটু খ্যাংরাকাঠির মতো খাঁদুকে পিষে ফেলতে লাগল আসুরিক হাতে। প্রথমটায় মনে হচ্ছিল বটে যে, এ বড় অন্যায্য লড়াই হচ্ছে। হেভিওয়েটের সঙ্গে মসকুইটোওয়েট। খাঁদুর হাড়-পাঁজর মড়মড় করে ভেঙে বুকের খাঁচাটাই যাবে গুঁড়িয়ে। ওই চাপে দম বেরিয়ে গেলেই শেষ। কিন্তু দেখা গেল, খাঁদু পেষাই হয়েও দমখানা ঠিক ধরে রেখেছে। মোটেই টসকাচ্ছে না।
মিনিটপাঁচেক গলদঘর্ম হওয়ার পর বটু যখন একটু দম নিয়ে ফের কষন দিতে যাচ্ছে, তখন খাঁদু একটা গা ঝাড়া দিয়ে টুক করে বটুর নাগাল থেকে বেরিয়ে এল।
বটু হাঁ করে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে চোখ কপালে তুলে বলল, “এ কার পাল্লায় পড়েছেন কর্তা? এ তো মনিষ্যিই নয়।”
“বলিস কী? দিব্যি দেখতে পাচ্ছি দুটো হাত, দুটো পা, ধড়ের উপর মুন্ডু, মানুষ বলেই তো মনে হচ্ছে।”
বটু মাথা নেড়ে বলে, “না কর্তা, যে কষন দিয়েছিলাম তাতে যে-কোনও পালোয়ানেরই দম বেরিয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু এ যেন পাঁকাল মাছ। কেমন পিছলে বেরিয়ে গেল দেখলেন না! মনিষ্যি হলে পারত?”
“মানুষ নয়! তা হলে কি ভূত?”
বটু ফের মাথা নাড়া দিয়ে বলে, “তা জানি না কর্তা। বরং একবার পালান ওঝাকে ডেকে একটু যাচাই করে নেবেন। পেন্নাম হই, আমরা তা হলে আসি..”
যেন বেশ একটু তাড়াহুড়ো করেই বটেশ্বর আর বিশ্বেশ্বর চলে গেল।
নসিবাবু আপন মনেই মাথা নেড়ে বললেন, “অপদার্থ! অপদার্থ। ডিসিপ্লিন নেই, ফিটনেস নেই, দিনরাত গোগ্রাসে খেয়ে খেয়ে চর্বির পাহাড় বানিয়েছে, আর বলে কিনা ভূত! ওরে ও খাঁদু, তোরও কি মনে হয় যে তুই ভূত?”
খাঁদু উবু হয়ে মাটিতে বসা। জুলজুল করে চেয়ে বলে, “আজ্ঞে, তাও হয় কর্তাবাবা! যখন বাঁচা-মরার তফাত করতে পারি না, তখন মাঝে মাঝে মনে হয়, মরেই গিয়েছি বুঝি! হাত-পা-দেহ সব যেন বায়ুভূত বলে টের পাই। তখন নিজেকে ভারী ভয়ও হয় আমার।”
“বটে!”
“যে আজ্ঞে! এই যে একটু আগে যখন গরম ডাল আর বেগুনপোড়া দিয়ে রুটি সাঁদ করছি, তখন দিব্যি মানুষ-মানুষ লাগছিল নিজেকে। যেন দিব্যি বেঁচেবর্তে আছি। কিন্তু যখন দানাপানি না জোটে, আর মাইলের পর মাইল ঠ্যাঙাতে হয়, তখনই বোধ হয় একটু একটু ভূত-ভূত ভাবও আসে। তা কর্তাবাবা, এখান থেকে নীলপুরের জঙ্গলটা কদুর হবে?”
ভ্রু কুঁচকে নসিবাবু বলেন, “নীলপুরের জঙ্গল? সে মোটেই ভাল জায়গা নয়। ও জঙ্গলের খুব বদনাম। কেন, নীলপুরের জঙ্গল দিয়ে তোর কী কাজ?”
“আজ্ঞে, একটা পাকা খবর আছে। আমার খুড়োমশাই সেখানেই হালে থানা গেড়েছেন। বয়স হয়েছে, ইদানীং নাকি ‘খাঁদু, খদু’ বলে কান্নাকাটি করেন খুব। কাদারই কথা! তার তো আর আমি ছাড়া তিন কুলে কেউ নেই। লাখো লাখো টাকাপয়সা, গয়নাগাটি বস্তাবন্দি হয়ে পড়ে আছে। সেগুলোর কী গতি হবে বলুন!”
নসিবাবু ভারী চিন্তিত হয়ে বললেন, “হুম! বড্ড মুশকিলে ফেললি। বেশি টাকাপয়সা হাতে পেলে লোকে কুঁড়ে হয়ে যায়, কাজেকর্মে মন দেয় না। আমি যে তোকে একটা চৌকস ডাকাত বানাতে চেয়েছিলুম, যাতে পরগনার সবক’টা ডাকাত ঢিট থাকে।”