ডরোথী -12
মলি দের বাড়িতে শনি ঠাকুর ছিল তা শিশুকালে জানা ছিল না সুছন্দার । শনিবার সুছন্দার মা উপোস করতেন । বাড়ির আঙিনায় শনি ঠাকুরের পুজো হয় । একবার শনি পুজো দিতে মলিদের বাড়িতে সুছন্দার বাবা মা সুছন্দাকে নিয়ে মলিদের বাড়িতে গিয়েছিল । তখন রাস্তায় বৃষ্টিতে ভিজে গিয়েছিল ছোট্ট সুছন্দা । মলির মা সুছন্দাকে মলির জামা পড়িয়ে দিয়েছিলেন । সেই প্রথম আলাপ ওদের সাথে । স্কুলে ও ওরা একই ক্লাসে পড়তো । যখন স্কুলে প্রথম গেল তখন বুঝতে পারতো না মা কেন ওখানে থাকেনা । মাস্টার মশায় এর তখন সে পাঠ পড়া হয়নি । যে পাঠে শিশুদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে আপন করে নেওয়া যায় । তখন মাস মাইনে নিয়েই ব্যাপারটা ছিল । ভাবা হয়নি তাদের অন্তরের কথা । শাসনে জেরবার সুছন্দা বুঝতে পারতো না কেন তাকে বেঞ্চ এর ওপরে দাঁড়াতে বলে । কি করে বেঞ্চে উঠতে হয় তাও জানা নেই । তাও এক পায়ে দাঁড়ানো । সাহায্য কারি ক্লাস এর এএকজন বড়ো মেয়ে । সে জুতো খুলে ধরে ধরে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে সুছন্দাকে । এটা কি ওর কাজ? মাস্টার মশায় যা করতে বলতেন সে টা ভয়াবহ ব্যাপার । কারণ শিশু পড়ে গেলে দায়টা কার?এ যেন যতো বড়ো শাসক ততো বড়ো মাস্টার । শিশুর দোষ কি? সে হাতের লেখায় নিজের নামের পাশে ঘেরাটোপ করেছে । নাম লেখা মাস্টারের নির্দেশ । কিন্তু ঘেরাটোপে দোষ । লঘু পাপে গুরূদন্ড ।
আবার আরও একজন শিক্ষক ছিলেন তিনি প্রশ্নের সাথে সাথে গলা টিপে ধরতেন । এটাই ছিল সে যুগের শিশু শিক্ষা । এই ভাবেই বেড়ে উঠেছে সুছন্দা । স্বাস্থ্য পড়াতেন যিনি তিনি শিশুকে ডেকে নিয়ে প্রথমেই শিশুর পেটে হাত দিয়ে ধরে থাকতেন । তার মানে তিনি চিমটি কাটার জন্য তৈরি হয়ে থাকতেন । অপেক্ষা শিশুর ভুল হবার । এতে শিশু তার তৈরি করা পড়াও মাস্টার মশায়ের বড়ো বড়ো নখ দেখে ভয়ে সব ভুলে গেছে । ঐ মাস্টারই স্বাস্থ্য বইয়ের নখ পড়াতেন । নখ কাটার কথা বলতেন কিন্তু নিজে নখ কাটতেন না । সুছন্দা ঐ বই এতো পড়তো যে সুছন্দার বাবা বলতেন- কইরে তোর নখের পাতা তো পড়ে আছে । সুছন্দারা রেলওয়ে কোয়ার্টারে থাকত । পেছনে অনেক টা জায়গা । সেখানে লাল তুলসীর ঝোপ । বাঁয়ে একটা টিলা আছে । তার ওপরে শিমুল গাছ । আর একটা কাপাস তুলোর গাছ । হাওয়া হলে তুলো ছড়িয়ে পড়তো । টিলার পাশে বুড়াইদের আস্তানা । রেলের জমিতে টিনের ছাউনি দেওয়া ঘর । ওরা জাতে কাছারি না কুকি তা জানা ছিল না । সুছন্দা র বয়সেই হবে । ভাষার হেরফের ওদের খেলায় পাঁচিল তুলতে পারে নি । ওদের খেলার মাঝেই ওর দিদিমা চেঁচিয়ে বলতো- থাংবোই লাংবোই ঐ ঐ ঐ । কাকে যে ডাকে তা জানা হয়নি । বুড়াই মা , দিদিমা পরিবৃত হয়ে বাস করতো । সুছন্দার মা বুড়াই এর সাথে মেয়ের খেলা চাইতেন না কারণ ওর মামার টি বি হয়ে মারা যায় ।
টিলার চলতি পথের দুধারে লতিয়ে উঠেছে ঝিঙে , কাঁকরোল , আরো কতো কি । সুছন্দার দিদিমা কলকাতা থেকে বঙ্গাইগাঁও এলে ঐ লতানে ডগা ছিঁড়ে আনতেন । মায়ের পছন্দ ছিল না তা । বলতেন- মা লোকে দেখলে কি বলবে বলোতো?
- ক্যান , বাজারে র মাইয়ারা কোথা থিকা আনে জানস না?পয়সা দিয়া আনলে সেই টা ভালো হইয়া গেল? সত্যি কথা । সুছন্দার মা ভাবতেন ।
কোয়ার্টারে ঠাকুর ঘরে বোখনায় দিদিমার ভাতের মধ্যে সেই ডোগা সিদ্ধ হয় । আট বছরের সুছন্দা আনচান করছে কখন সেই দিদিমার তুলে আনা ডোগা সিদ্ধ খাবে । হাতের ইশারায় চট করে ঢুকে পড়ে ঠাকুর ঘরে । মায়ের সতর্ক চোখ এড়িয়ে । তাহলে পিঠে পড়বে গুম গুম কিল । পাথরের থালায় ডোগা সিদ্ধ কোন দিন খায়নি সুছন্দা । মায়ের নজর সব দিকে । তাই বলেন- ওকে দাও কেন কম পড়ে যাবে তোমার । দিদিমা বলেন- ঐ টুকু মেয়ে একটা দলা খাইলে কম পড়ে?
একটু বড়ো হবার পর বুঝতে পারতো ঠাকুমা আর দিদিমা আসার পার্থক্যটা । ঠাকুমা এলে রকমারি রান্না হতো । ভালো রান্না করত ঠাকুমা । সুছন্দার লম্বা চুল বেঁধে দিত ঠাকুমা । একদিন ঝোলা ঝুলি করে ঠাকুমার দেশের গল্প শুনেছে সুছন্দা । পরে হবে সে কথা ।
যে কথা হচ্ছিল সেই ছোট্ট বেলায় রানী কাকিমার কাছে ডাক পড়েছে নাচের জন্য । রানী কাকিমা খুব মিষ্টি ছিল । ভালো গান গাইতো । সুছন্দার ভালো লাগত রানী কাকিমাকে । রানী কাকিমার স্বামী কাকিমার গানে তাল কেটে গেলে স্কেল দিয়ে কাকিমার হাতে বারি মারত । সুছন্দার রাগ হতো কাকুর ওপরে । সেই সুছন্দার প্রথম নাচ ।
তার পর শুরু হলো মলি আর ডরোথীর সাথে । সবই নৃত্য নাট্য । প্রথম নৃত্য নাট্য অভিসার রবিঠাকুরের । সুছন্দা নর্তকী আর মলি সন্ন্যাসী । এটা ওরা ক্লাস থ্রি তে প্রথম করেছে । তার পর আরো অনেক বার করেছে ।
সুছন্দার নাচের সঙ্গে নাটকের রিহার্সাল চলেছে । সুছন্দার বাবার অফিসের কাকুরা ছোট বেলা থেকেই ওকে দিয়ে নাটক করাতো । মহারাজ নন্দকুমার এ মিস্ ক্লেভারিং এর রোল ও একই সঙ্গে উম্মত জহরত এর রোল । দারুণ করে ছিল সে । তখন বড়ো জোর দশ বয়স হবে । মনে পড়ে সুছন্দার , একবার আলিপুর দুয়ার থেকে একটা মেয়ে স্কুলে ভর্তি হলো ওদের স্কুলে । দারুণ নাচে মেয়েটা । ফাংশনের রিহার্সাল চলেছে । মেয়েটার নাচ দেখে ঘাবড়ে গেছে সুছন্দা । এবার বুঝি আর প্রথম হওয়া হলো না । দুরু দুরু বুকে নেচেছে সুছন্দা । নাচ হওয়ার পর অপেক্ষা করেনি । বাড়ি চলে গেছে । বিছানায় লেপ মুড়ি দিয়ে মাথা ঢেকে শুয়ে আছে । যাতে এনাউন্সমেন্ট না শুনতে পায় । কিন্তু আশ্চর্য জনক ভাবে দু’ দুটো প্রাইজে সুছন্দার নাম ডেকেছে । পরের দিন জেনেছে ওখান কার অফিসার ডি জে চাটার্জী সুছন্দার নাচে খুশি হয়ে বিশেষ পুরস্কার দিয়েছিলেন ।
সুছন্দা মলি কে কাছে টানত । মলি কতদূর ওকে টানত তা নিয়ে ওর চিন্তা ছিল না । সুছন্দা ধরেই নিয়েছিল মলি ওকে ভালোবাসে । কারণ মাস্টার মশায় পড়া ধরার সময় মলির আগের জনকে পড়া ধরার আগেই মলি সুছন্দাকে জিজ্ঞাসা করে নিতো এর পরের ট্রানশ্লেসন টা কি হবে ? এটা ছিল রোজ এর কথা । কারণ মাস্টার মশায় বই দেখে পর পর জিজ্ঞাসা করতেন ।
আবার সেই পুরনো কথায় ফেরা যাক । স্কুলে মলির রাগের নমুনা টা দেখেছে একবার । কথা ছিল সবাই গ্রীষ্মের বন্ধ হবার দিন শাড়ি পড়ে আসবে । কিন্তু সুছন্দার মা কিছুতেই শাড়ি দেবেন না ।
যা হোক , সুছন্দা কান্না কাটি করার পর মা একটা সাদা শাড়ি দিলেন । ওদের ছোট বেলা থেকেই সুছন্দার মা সাদা শাড়ি পড়তেন । মা দেখতে লম্বা ও সুন্দরী ছিলেন । বড়ো হয়ে মনে হয়েছে লোকের নজরে মা না পড়ে যান তাই বুঝি তাই সাদার বেড়াজালে বাবা মা কে আবদ্ধ করে রেখে ছিলেন । সেটার ও একটা কারণ ছিল মনে হয় । মায়ের তখন কতই বা বয়স বড়ো জোর বাইশ কি তেইশ । সেই সময়ে বাবাকে মাসের কুড়ি দিনের মতো বঙ্গাইগাঁও এর বাইরে অফিস ডিউটিতে থাকতে হতো । তা ছাড়া রেলওয়ে কোয়ার্টারে উঠোন পেরিয়ে রাতে বাইরে যাওয়া । মা কে একা তিন টে বাচ্চা নিয়ে থাকতে হয় । তাই মায়ের সাদা শাড়ি পড়ার অভ্যাস তখন থেকেই । যাতে কারো কু নজরে মাকে পড়তে না হয় । যে কথা হচ্ছিল সেই স্কুলে শাড়ি পড়ে যাওয়ার কথা । মায়ের দেওয়া শাড়ি সুছন্দা পড়তে চাইল না । অভিমান করেই শাড়ি না পড়ে সুছন্দা স্কুলে ঢুকেছে । বেঞ্চ এ বই রাখার সঙ্গে সঙ্গে মলি সুছন্দার বইগুলো হাতের ধাক্কায় নিচে ফেলে দিলো । ছত্রাকারে মাটিতে পড়লো সব বই । ছেলে মেয়ে দের স্কুল । সবাই চেয়ে দেখছে কান্ডটা । মলি চিৎকার করে বলছে- তোর এখানে জায়গা হবে না । ছোট থেকেই প্রথম বেঞ্চ এ বসে আসছে । লজ্জায় কান ঝাঁ ঝাঁ করছে । মলি বলে চলেছে সুছন্দার শাড়ি না পড়ার কারণ । পেছনের সারি থেকে ছুটে এসেছে গায়ত্রী চক্রবর্তী । আর সামনের ছেলেদের বেঞ্চ থেকে পুলক রঞ্জন সরকার । দুজনে সব বই তুলে দিয়েছে । গায়ত্রী চক্রবর্তী সুছন্দাকে সাদরে নিয়ে গেছে শেষ বেঞ্চে । বলেছে- চল তো আমাদের সঙ্গে বসবি ।
তাই করেছে সুছন্দা । গায়ত্রী চক্রবর্তী ওদের থেকে একটু বড়ো ছিল । তাই সে সময় ওকে দিদি মনে হয়েছে । যেন কতো আপন । অন্য দিনের তুলনায় ক্লাসটা অনেক বড়ো লেগেছে । প্রথম সারিতে বসে পুরো ক্লাস টা দেখা যায় না । আজ পুরো ক্লাস টা দেখা যাচ্ছে । তাই অনেক বড়ো লাগছে । ভালো লেগেছে গায়ত্রীদি কে । আপসোস হয়েছে এতোদিন এই ভালো লাগা কেন হয়নি গায়ত্রীদির ওপরে ।
সুছন্দার এতো ভালোবাসার বন্ধু ছিটকে পড়লো মন থেকে । সেদিন মনে হলো সুছন্দা মলিকে যতো – ই ভালোবেসে থাকুক না কেন মলি সুছন্দাকে কোন দিন ভালোবাসে নি । সুছন্দার বয়ঃসন্ধির সময় মুখে খুবই কথা । আর কথা বলার কেউ ছিল না । মনে পড়ে তখন ক্লাস নাইন । স্কুলের টয়লেটকে তখন বাথরুম ই বলা হয় । সেই বাথরুমে অবশ্য সুছন্দা কে যেতে হতো না । কারণ টিফিনের সময় সুছন্দা বাড়ি চলে যেত । মলি আর ডরোথীকে যেতে হতো সেই মায়াবিনী বাথরুমে । সেখানে দরজায় , দেওয়ালে নানা কথা লেখা থাকতো । মলি বলেছে- শক্তি দা আর মালতী দির নাম ও লেখা আছে । আমাদের নাম ও লেখা আছে । আরো সব নোংরা কথা ।
সুছন্দা শান্ত স্বভাবের বলে কারো সাথে কখনো ঝগড়া হয় নি । মলি আর ডরোথী তখন সুছন্দার দুপাশে বসতো । তাই বুঝি ওদের পাকা পাকা কথা ওকে শুনে সুছন্দার কান গরম হয়ে যেত । মলির পাকা কথার কারণ ওর দিদি জামাইবাবু , ওর দাদা বৌদিরা ওর অভিজ্ঞতায় শান দিয়েছে । ওসব কথা শুনে সুছন্দা টিফিন বেলায় বাড়ি গেলে ওর মা কপালের তাপ মেপেছেন জ্বর হয়েছে কিনা ভেবে ।
ডরোথীর মতে স্ত্রী পুরুষের বিজ্ঞান সম্মত জ্ঞানটা উঠতি বয়সের ছেলে মেয়েদের জানা উচিত । বয়ঃসন্ধির সময় ইন্ডিয়ান মায়েরা ছেলে মেয়েদের বুঝিয়ে দেন না । ডরোথীর মা পামেলা এগারো বছর বয়সেই ডরোথীকে বুঝিয়ে দিয়েছেন । তাতে মেয়েদের বোকার মতো ঠকতে হয়না । অনেক সময় ঘরের পুরুষদের কামুকতার শিকার হতে হয়েছে সরল মেয়েদের । ঐ বাথরুমের কথা রোজই শুনতে হয় সুছন্দাকে । সুছন্দার কাছে ওটা রহস্যময় । বাথরুম নোংরা হতে পারে । কিন্তু লেখা গুলো কি করে নোংরা হয়? সে ধারণা নেই সুছন্দার । দুটো মাত্র পারমিটেড গাল সুছন্দাদের বাড়িতে ওরা দিতে পারত । তা হলো অসভ্য আর পাজি । এর বাইরে কোন গাল দেয়া চলবে না । তাই ভাবে কি এমন নোংরা যে মলির মুখ লাল হয়ে যায়? ঐনোংরা কথাগুলো জানবার দুর্নিবার আকর্ষণ বোধ করে সুছন্দা । একদিন সাহসে ভর করেই চলে গেছে মায়াবিনী বাথরুমে । সে ঘরের যে অবস্থা তাতে নাক চাপা দিয়ে সাবধানে পা ফেলতে হয় । দৃষ্টি সজাগ না থাকলে অজায়গায় কু জায়গায় পা পড়ে যাবে । মলির প্রখর দৃষ্টির কথা ভেবে আশ্চর্য হয় । ডরোথীরা দেওয়ালে চোখ রাখলো কি করে?দেওয়ালের কোথাও তো ফাঁকা নেই অজস্র আঁকিবুকি কাটা । এক লেখার পড়ে আর এক লেখা । আগ্রহ থাকলে ও ক্ষমতায় কুলায়নি । কোন রকমে নাক চেপে পালিয়ে এসেছে । মনে ভেবেছে , এ কি এমন খারাপ? একটা ঘরে আটকে রয়েছে । এর থেকে বেশি অশ্লীল লেগেছে পন্ডিত মশাই এর শকুন্তলার রুপ বর্ণনা । ক্লাস ভর্তি ছেলেদের মধ্যে মাত্র দুজন সংস্কৃত নিয়েছে , সুছন্দা আর সুপর্ণা । আর বাকি সব হাইজিন পড়তে অন্য ক্লাসে চলে গেছে । পন্ডিত নিজের বুকে হাত দিয়ে শকুন্তলার স্তনের বর্ণনা করতেন । ছেলেরা উচ্ছ্বসিত হয়ে হৈচৈ করে উঠছে । প্রতিদিন ছেলেদের একই বায়না । বৃদ্ধ পাঁচ সন্তানের বাপ পন্ডিত মশায় উৎফুল্লিত সেই একই পাঠে ও বিশেষ জায়গায় কালাতিপাতে । ছেলেদের থেকে ও বেশি উৎফুল্লিত পন্ডিত মশায় । সুছন্দা আর সুপর্ণা অধোবদনে । পন্ডিত কি ভুলে যেতেন যে , এক দঙ্গল ছেলেদের মধ্যে বয়ঃসন্ধির দুই কিশোরী নির্যাতিতা ? এ তো কথা দিয়ে কিশোরীর বস্ত্র হরণের আনন্দ । ঐ পাঠে মরণ যন্ত্রণা দুই কিশোরীর । পড়া না থাকলে ঐ বিশেষ পাঠের অনুরোধ এলেই পন্ডিতের ঢুলুনিটা চলে গেছে । টয়লেট থেকেও পন্ডিতের ভাব টা আরো নোংরা মনে হয়েছে সুছন্দার ।
দেখতে দেখতে স্কুলের পড়া শেষ হলো । এবার বিরঝোড়া হাই স্কুলের সান্ধ্য কলেজে ভর্তি হলো সুছন্দা আর সুপর্ণা । মেয়েদের ওল্ড কলোনী থেকে আনার জন্য রেলওয়ে হাইস্কুলের দফতরী চৌধুরীকে ঠিক করা হলো । আট দশজনের মেয়েদের একটা দল যায় বঙ্গাইগাঁও সান্ধ্য কলেজে । তখন ওখানে রিক্সার চল ছিল না । হেঁটেই সবাই যাতায়াত করে । কলেজে অহমীয়া ভাষায় কথা না বলতে পারার জন্য স্যার দের কাছে কথা শুনতে হতো । যে সুছন্দা অহমিয়া মাস্টার মশায়ের কাছে প্রশংসা শুনেছে । “তয় বঙালী ন হয় ” সেই সুছন্দা কে এখন অহমিয়া ভাষায় কথা বলতে না পারার জন্য কথা শুনতে হচ্ছে । কারণ সুছন্দারা যেখানে থাকে সেখানে সবাই বাঙ্গালীএবং বাঙ্গলা ভাষায় কথা বলে । তাছাড়া ওরা যে স্কুলে পড়াশোনা করেছে সেখানে ও পুরোপুরি বাঙ্গালী প্রধান জায়গা । অহমিয়া ভাষায় কথা বলার লোক নেই । অতএব সুছন্দারা অহমিয়া বলতে পারে না । কলেজে বাঙ্গলা বলার অপরাধে ধমক খাচ্ছে ।
সুছন্দার মনে হয় যারা ভাষা নিয়ে এতো ঝামেলা করে তারা কিন্তু অন্য রাজ্যে গেলে সে ভাষা বুঝতে বা বোঝাতে সহনশীলতার পরিচয় দিয়ে থাকেন । তবে ওদের রাজ্যে ওদের সহনশীলতার এত অভাব কেন?
বিরঝোড়া সান্ধ্য কলেজে কম্পিটিশন শুরু হলো । গান , মিউজিক্যাল চেয়ার , ব্যালান্স রেস , ক্যারাম বোর্ড , সব মিলিয়ে সুছন্দা নয়টা পুরস্কার পেলো । ব্যালান্স রেস এ মাথায় জল ভরা মাটির কলস নিতে হয়েছিল সুছন্দাদের । বিনা দি , সুকৃতি ওদের বাড়ি কাছেই তাই ঘরের থেকে গামছা এনে বিড়া বানিয়ে নিয়েছিল । সুছন্দা কে বিনাদি একটা গামছা দিয়েছিল । এই ব্যালান্স রেস এ দুটো দল তৈরি হয়েছে । অলকা দির প্রেমিক কাবুল দা ওরা অলকা দির দলে । আর স্যারেরা বলেছেন সুছন্দা প্রথম হয়েছে ব্যালান্স রেস এ । প্রথম বার হলো , দ্বিতীয় বারও একই ফল হলো । কাবুল দা রা বললো আবার ও করতে হবে । তাই হলো , তৃতীয় বার অলকা দির মাথা থেকে কলসি মাঝ পথে পড়ে গেল । সুছন্দাই প্রথম হলো । সব মিলিয়ে নয়টা পুরস্কার পেয়েছে সুছন্দা কিন্তু কাবুল দা সুছন্দা কে পুরস্কার নিতে দেয়নি । ফাংশনের দিন সুছন্দাকে গার্ড দিয়ে বসে বলেছে- একদম যাবি না । ওরা পার্শয়ালিটি করেছে । কাবুলদা স্কুলে সুছন্দার ছোরদির ক্লাস মেট ছিল । তাই সুছন্দা ওর কথায় অবাধ্য হতে পারে নি । তখন ঐছোট জায়গায় বড়দের কথা শোনাটাই রেওয়াজ ছিল । কাবুল দার প্রহরায় সুছন্দা এক বিন্দু ও নড়তে পারে নি ।
সুছন্দা সাবলীল হতে পারে না কলেজে । কারণ ঐ একদল বয়স্ক লোক ও ঐ কলেজে পড়ে । ডরোথীকে সেই কথা বলায় ডরোথী বলে- ডোন্ট অ্যাভএড দেম । দে আর অলসো কামিং ফ্রম আ ফ্যামিলি । দে আর হ্যাভিং দেয়ার সিস্টার অলসো । সো মিক্স উইথ দেম । ইউ উইল বি ফ্রী ফ্রম দিজ অবসেশন । সুছন্দা বলে- ওরা এমন ভাবে তাকিয়ে থাকে ! ডরোথী আবার বলে- আফটার অল ইউ আর বিউটিফুল গার্ল । গোলাপের দিকে যেমন তোমার তাকাতে ভালো লাগে । ওদের ও তোমাকে দেখতে ভালো লাগে । এর মধ্যে খারাপ কিছু নেই । তুমি ওদের দিকে তাকাও । উইশ করো ওদের । বি ফ্রি সুছন্দা । তুমি যা ভাবছ তা নাও হতে পারে । আবার ওঁরা হয়তো তোমাকে দেখছেই না ।
ক্লাস এর ঘন্টা বাজতেই প্রফেসর কল্যাণ চক্রবর্তী এসে ঢুকলেন বাংলার ক্লাস এ । ডরোথী চুপ করে গেল ।
স্যার বললেন- আজ রবিঠাকুরের কবিতা পড়বো ।
গম গমে গলায় আবৃত্তি করছেন ।
ইচ্ছে , ইচ্ছে সেই তো ভাঙ্গছে সেই তো গড়ছে , সেই তো দিচ্ছে নিচ্ছে । । সেই তো আঘাত করছে তালায় , সেই তো বাঁধন ছিঁড়ে পালায়- বাঁধন পড়তে সেই তো আবার ফিরছে । গম গমে গলায় কল্যাণ স্যার এতো সুন্দর বোঝালেন যে সুছন্দার মনে গেঁথে গেল একেবারে । কলেজের পাঠ শেষ হয়ে গেছে । যে যার মতো ছড়িয়ে পড়লো । সুছন্দার বাবার চাকরির ক্ষেত্রের বদল হলো । ওরা চলে গেছে শিলিগুড়ি । মিলিটারি ব্যারাকের পাশ দিয়েই ঘরে ফিরতে হতো । বঙ্গাইগাঁও থাকতে শুনেছিল কোন এক নেপালি মেয়েকে ওরা তুলে নিয়ে গিয়েছিল । মিলিটারি দেখলেই সে কথা মনে পড়ে যায় । আস্তে আস্তে শক্ত হয়ে গেল সুছন্দা । কলেজে ভর্তি হতে দেরি হয়ে গেল তাই সিট পাওয়া গেল না । অতএব একটা স্কুলে চাকরি তে ঢুকে গেল সুছন্দা ।
স্কুল থেকে ফেরার পথে একটা ঘটনা ঘটলো । ঘরে ফিরেই ডরোথীকে একটা চিঠি লিখতে বসলো সুছন্দা ।
ডিয়ার ডরোথী , তোরা কেমন আছিস? আমি এখানে এসে বি এ তে ভর্তি হতে পারিনি । পরের বছর ভর্তি হবো । বসে না থেকে একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে বাচ্চাদের পড়াই । তুই তো আমার সেই ভয় পাওয়া রোগটা জানিস । এখানে মাঝে মাঝে আর্মির স্রোত দেখা যায় । রাস্তায় অসংখ্য মিলিটারি চলেছে । প্রথম দিকে ওদের ভয় পেতাম । কিন্তু স্কুলে কাজ নেবার পর রোজই আমার ছুটির সময় টায় ওদের ও মার্চ করার সময় মিলে যায় । নিঝুম দুপুরে চারদিক নিস্তব্ধ তার মধ্যে আমি মহানন্দা ব্রিজ পার হই । আমার বাড়ি ডান দিকে তাই আমি ডান দিকের রং সাইড ই ধরি । দূর থেকে নজরে পড়লো ওরা নিয়ম অনুযায়ী মার্চ করতে করতে আসছে মহানন্দা ব্রিজ এর দিকে । মহানন্দায় নীলচে সাদা ফেননিভ ঢেউ । দূরের কাঞ্চনজঙ্ঘার বরফের রূপোর ঝলক । তার সাথে পাহাড়ের কালচে গাঢ়ো নীল আর মেঘের হালকা নীলের সমাহার । বুঝলাম ঠিকই দেখেছি , ওরা মহানন্দা ব্রিজ এ আমার ফুটপাতই ধরেছে । বিশাল বাহিনী আসছে । মনে হলো ফুটপাত বদল করি । মেরুদণ্ড শিরশির করে উঠল । ভাবলাম যদি ওরা বুঝতে পারে যে আমি ভয় পেয়েছি তাহলে তো ওরা আমার পিছু ধাওয়া করবে ।
মুহূর্তে কল্যাণ স্যারের গলা ভেসে এল । রবিঠাকুরের “ইচ্ছে ইচ্ছে “মনে পড়ল । অমনি আমার ইচ্ছা শক্তি দৃঢ় হয়ে গেল । মনে করলাম , আমি তো কোনো অন্যায় কাজ করি না । শিশুদের আন্তরিক ভালোবেসে পড়াই । ছাত্র ও ছাত্রীদের উন্নতির চেষ্টা করি । তবে আমার কিসের ভয়? ওরা যেমন দেশের সেবক । আমি ও তো দেশের সেবিকা । আমার দেশ সেবায় তো কোন ফাঁক নেই । এই মনোভাবটা আমায় আমার নিজের চলার পথে সাবলীল ভাবে চলতে দিলো । আশ্চর্য হলাম এই দেখে যে , যে হেতু আমি আমার চলার পথে অটল থেকেছি । তাই ওরা আমার ঠিক দু’হাত দূরে এসেই প্রথম জন রাস্তায় নেমেছে আবার আমার পেছনে গিয়ে ফুটপাথ এ উঠেছে । ঠিক “ডায়না মোর “এর মতো । একেএকে রাস্তায় নেমে আবার ফুট পাথ এ উঠেছে । সে এক অদ্ভুত দৃশ্য । আমি আমার দৃষ্টি ওদের দিকে না দিয়ে একেবারে সাবলীল থেকেছি নিজের চলার পথে । আমার দৃষ্টি তখন দূরে , কাঞ্চন জংঙ্ঘায় । ভাবলেশহীন চাহনি । এই চলা এমন ছিল যে কারো জন্য কারো চলা থেমে থাকেনি । ওদের প্রতি শ্রদ্ধায় আমার মাথা নত হয়েছে । এমন মানুষদের না ভালোবেসে পারা যায়? ওদের কথা আমরা ভাবি না । ওরা আমাদের দেশ রক্ষা করে । আমাদের ভাব এমন যে এটা ওদের চাকরি তাই করে । এ যেন বাবা মায়ের সন্তানেরা যা মনে করে ঠিক তেমনি । বাবা মা সন্তান মানুষ করতে এতো করে কিন্তু সন্তান ভাবে ওটা তো ওদের কর্তব্য । দেশের জন্য প্রাণ বলিদান দিতেই ওরা যায় ।
আমার কি মনে হয় জানিস? জেলখানায় কয়েদী দের জেলখানায় না রেখে ফৌজএ ভর্তি করে দিলে ভালো হয় । ভালো কাজের সুযোগ পেলে ওরা ও ভালো হয়ে যাবে । একটা চাকরি পেলে ওদের অপরাধ প্রবণতা কমে যাবে । তোর কি মনে হয় জানাস আমাকে ।
ইতি- সুছন্দা ।
পোস্ট বক্সে চিঠি ফেলতে হাতে ঠেকলো আর একটা চিঠি । খুলে ফেলল চিঠি খানা । রমলার লেখা চিঠি । ছাতে উঠে গেল আরাম করে পড়বে বলে । মনে পড়ছে সেই ছোট্ট বেলার কথা ।
বঙ্গাইগাঁও থাকতে আরতি দির দাদা রমলার বাবার ঠিকানা দিয়েছেন । রমলা ক্লাস থ্রিতে উঠে চলে যায় বঙ্গাইগাঁও ছেড়ে । ওর বাবা বঙ্গাইগাঁও থেকে বদলি হয়ে যান মালদায় । কিন্তু ঐ ছোট্ট বেলায় সুছন্দার জানা ছিল না ওরা কোথায় গেল বদলি হয়ে । সুছন্দা ভাবতো রমলা হারিয়ে গেছে । ঠাকুর কে বলতো- ঠাকুর রমলা কে ফিরিয়ে দাও । আরতি দি বুদ্ধি দিয়েছিল । – মাটিতে গর্ত করে থুতু ফেল সেই গর্তে তার পর লাফ দিয়ে গর্ত টা ডিঙ্গিয়ে যা দেখবি রমলা এসে গেছে । এই ভাবে বড়ো হয়ে গেছে ওরা ভুলে ও গেছে সেই হারিয়ে যাওয়া রমলাকে । হঠাৎ একদিন আরতিদির দাদা বললো ওদের অফিসে কাটিহারে কাজ করে রমলার বাবা । তখন সুছন্দার ক্লাস টেন । সঙ্গে সঙ্গে চিঠি লেখা হলো রমলাকে । ছোটবেলার মনের কথা ঢালা ঢালি শুরু হলো । সুছন্দার বাবা শিলিগুড়ি আসার পর চিঠি বন্ধ হয়ে গেল । এরপর সুছন্দার বিয়ে হয়ে গেল । সুছন্দার স্বামীর অফিসের কাজে আবার খোঁজ পড়ে রমলার ।
রমলার বাপের বাড়িতে গিয়েই জানা গেল সে বাবার কাছে থাকে না । ওর ভাই রমলার ঠিকানায় পৌঁছে দিয়ে গেল সুছন্দা আর ওর স্বামীকে । দরজা যিনি খুললেন , তাঁর গলায় কন্ঠী । পরনে গেঞ্জি ও লুঙ্গি । বছর পঁয়তাল্লিশ হবে । বাড়ান্দায় দাঁড়িয়ে নীলাম্বরী শাড়ি পড়নে অল্প বয়সী এক মহিলা । বয়স বড়ো জোর পঁচিশ । দুই বিনুনি বুকের পরে ঝুলছে । সুন্দরী বলা যায় তাকে ।
সুছন্দা জিজ্ঞাসা করলো ভদ্রলোক কে- রমলা কি আছে ? উত্তরে ভদ্রলোক ঐ মহিলা কে বললেন- কে এসেছে দেখো । সুছন্দা ও তার স্বামী এগিয়ে গেলেন ঐ মহিলার দিকে । সুছন্দার হাসি দেখে সেই মহিলা বললেন- তুই সুছন্দা না?
সুছন্দা তাজ্জব তবুও বলে- তুই কি রমলা?আমাকে চিনতে পারলি কি করে? রমলা বলে- তোর হাসিটা দেখেই চিনেছি । হাসিটা একই আছে ।
সুছন্দা কে ভেতরে নিয়ে গেল রমলা । দুই বন্ধুর গল্প শুরু হলো । সুছন্দা বলে- ঐ ভদ্রলোক কে? রমলা বলে- আমার স্বামী ।
হাঁ করে চেয়ে আছে সুছন্দা । বলে কি? এর বয়স তো রমলার দ্বিগুণ । সুছন্দা বললো- কি করে এমন হলো?
রমলা যা বললো তার সারমর্ম হলো এই যে , যে কলেজে রমলা পড়ত সে কলেজের প্রফেসর ছিলেন ইনি । ওঁর স্ত্রীর সঙ্গে বিবাদ চলছিল । সেই সময় ভদ্রলোকের দুঃখের কথা শুনে রমলা স্যারের কষ্টে সহানুভূতি জানাতে গিয়ে জড়িয়ে পড়ে । এমন জড়িয়ে পড়ে যে বিয়ে করতে বাড়ির থেকে পালিয়ে গেছে । সেই থেকে মা বাবার সাথে সম্পর্ক নেই । খুবই খারাপ লেগেছে সুছন্দার । এ কেমন প্রেম? মাথায় ঢোকে নি সুছন্দার । তবে প্রফেসর লোকটি খুবই চতুরের চূড়ামনি তা বুঝেছে । ফাঁদ পেতে সরল মেয়েটির সর্বনাশ করেছে । এমন লোকের শায়েস্তা পাড়ার লোকেরই করা উচিত ছিল বলে মনে হয়েছে সুছন্দার । বেশ কয়েক বার সুছন্দা চিঠি দিয়েছে । তারপর বন্ধ হয়ে গেছে । হাতের চিঠিতে নজর দিল সুছন্দা । খুলে ফেলল চিঠি খানা । শান্তিনিকেতন থেকে লিখেছে ।
সুছন্দা
অনেক দিন খবরাখবর নেই তোর । আমার স্বামী এক বছর হলো মারা গেছেন । আমি মালদা থেকে শান্তিনিকেতন এ চলে এসেছি । এতো দিন একসাথে থেকে ও তার ভালোবাসা পাইনি । সে আমার দেহটা ব্যবহার করেছে এতো বছর ধরে । যাইহোক আমার পুরোনো দিন ভুলে একজন আমাকে আপন করতে চেয়েছিল । কিন্তু আমি আর ঐ খেলায় যেতে চাইনি । তুই তো জানিস গানে ডিপ্লোমা করেছিলাম । গানের টিচার এর কাজ নিয়ে শান্তিনিকেতন এ যাচ্ছি । পারলে একবার আসিস ।
ইতি তোর – রমলা ।
চিঠি টা ভাঁজ করে নিল । কে যেন বেল বাজাচ্ছে ।