ডরোথী -11
র থেকে যখন সুছন্দার বাবা পরিমল বাবু চাকরিতে অপশন নিয়ে এপারে চলে আসেন । তখন দাঙ্গার সময় । মাঝ রাতে পরিমল মুখোপাধ্যায়কে সাহায্য করেছিলেন একজন মুসলিম । বাবার কাছে ই শুনেছে সুছন্দা যে মুসলমান হয়ে ও ফজলুল চাচা আর আবদুল চাচার ভালোবাসার কথা । বামুনের ঘরে মুরগি ঢোকা বারণ । বাবার কাছে শুনে সুছন্দার একটা ধারণা হয়েছে । গ্রামের করিম চাচা , হারাণ জ্যাঠা সবাই ওদের ভালো বাসতেন । আবার অন্যায় করলে এই চাচাদের সমান অধিকার ছিল পরিমলদের শাসন করার । ওরা ও বড়োদের ভয় পেতো । আবার সম্মান ও করত । সুছন্দার বাবার ছোট বেলা থেকেই নানা রকম যন্ত্রপাতির দিকে নজর ছিল । মনে নানা প্রশ্ন আসত আবার উত্তর ও পেয়ে যেতেন । ইচ্ছে ছিল একটা ডিপ্লোমা পাবার নিজের একটা মটোর রিপেয়ারিং গ্যারেজ খুলে ওয়র্কশপ করবেন । সূর্য নারায়ন মুখার্জির ছেলে কালিঝুলি মেখে কাজ করবে সেটা সূর্য নারায়ণ মুখার্জির পছন্দ নয় । কারণ তাঁর বড়ো বড়ো জজমানদের কাছে মাথা হেঁট হয়ে যাবে । পরিমল বাবু , বাবা সূর্য নারায়ণের উপর একরকম রাগ করেই যোগ দিলেন ‘রেল কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ারিং
ওয়ার্কশপে । বাড়ি ছেড়ে এসে মন খারাপ লাগত । তখন তাঁর সঙ্গী ছিল বংশ দন্ড মানে বাঁশী । তিনি খুব ভালো বাঁশী বাজাতেন । ঐ বাঁশীই তাঁর মন ভালো করে দিত । রংপুরের পার্বতী পুরে পরিমলের কর্ম স্থল । ব্রিটিশ আমলের কেতাদুরস্ত সাহেবরা কিন্তু পরিমলের ওপরে অতি খুশি ছিলেন । বিশেষ করে ফার্গুসন , মরিসন , ডেভিড সাহেব মাঝে মাঝেই পরিমলকে দুদিনের ছুটি দিয়ে দিতেন । অবশ্য এই পুরস্কারটা তখনই পেতেন যখন অন্য উপরওয়ালা অফিসারেরা কোনো একটা মেসিন অকেজো বলে রিটার্ন করে দিতেন । তখনই যুবক পরিমলের ডাক পড়েছে ঐ মেসিন সাড়াবার জন্য । পরিমল অক্লান্ত পরিশ্রমে যতক্ষণ মেসিন চালু না হতো ছাড়ত না মেসিন টা । ব্রিটিশ সাহেবদের বড়ো অফিসারদের থেকে ও পরিমল এর উপরে গভীর আস্থা ছিল । পরিমলের মেসিন চালু করার চেষ্টার সময় দেখা যেত একে একে সব সাহেবরা পরিমলের সাথে কাজ করতে লেগে গেছেন । হঠাৎ ই মেসিনটা ধোঁয়া তুলে চালু হবার শব্দে সবাই আনন্দে পরিমলের কর মর্দন করতেন । তখনই পুরস্কার দেওয়া হতো দুদিনের ছুটি । সাহেবরা বলতেন- গো , এনজয় । অনেক বড় পুরস্কার মনে হতো পরিমলের কাছে ঐ কেতা- দুরস্ত সাহেবদের কর মর্দন । ওটাই কাজের স্বীকৃতি । আশ্চর্য হতো পরিমল একটা বিষয়ে বাবা যে কাজ হীন বলে ভাবতেন সেই কাজে সাহেব রাও হাত লাগিয়েছে । ঐ দুদিনের ছুটি তে রংপুরের একটা জায়গায় চলে যেতেন । সঙ্গে যেত তাঁর বাঁশি । ঘাঘট নদীর তীরে ছিল একটা সুন্দর জায়গা । এটা নাকি কামরূপ রাজার প্রমোদের জায়গা । আরও সুন্দর একটা জায়গা ছিল । রংপুরের পায়রাবাঁধ নামে একটা পরগনা আছে । ওখানে রাজা ভগদত্তের কন্যার সম্পত্তি বলে কিংবদন্তি আছে । ইংরেজ আমলে রংপুর জেলা বহু অশান্তির কেন্দ্র ছিল । পরিমলবাবু , মানে সুছন্দার বাবা ও দেশের কথা শুরু হলে থামতে চাইতেন না । সুছন্দা মাঝখানে থামিয়ে দিত বাবাকে । – ওহো বাবা । ঐতিহাসিক তথ্য জানতে চাইনা । শুধু তোমার দেশের কথা জানতে চাইছি । সুছন্দার বাবা বললেন- ইতিহাস জানতে চাস না ? তবে যা ভাগ । আর কিছু নেই ।
সুছন্দার মনে পড়ে যায় সেই রেলওয়ে ইনস্টিটিউট এর ফাংশনের কথা । মনিদির থেকে নাচ টা শিখেছিল সুছন্দা । রেলওয়ে ইনস্টিটিউট এ ফাংশন জাজ্ এসেছেন অভয়পুর থেকে বিশেষ অতিথি হয়ে এক মহিলা জাজ্ । এই নাচটা শিখিয়েছে মনিদি । কলকাতায় থাকে মনি দি । এটা একটা বিশেষ ঢংয়ের নাচ । ফাংশন শেষ হয়ে যাবার পর একজন এসে বললেন । – তোমাকে ডাকছেন । – কে ডাকছে ? – আজকের বিশেষ অতিথি যিনি জাজ্ ।
তাঁরই সঙ্গে গেল সুছন্দা । সুন্দর এক মহিলা বসে আছেন । তাঁর পরনে সাদা আসাম সিল্কের সাদা শাড়ি । আভিজাত্যের ছোঁওয়া সারা শরীরে । সুছন্দা দাঁড়াতে তিনি প্রশ্ন করলেন- কোথায় শিখেছ এই নাচ ? খুব সুন্দর নেচেছো ।
সেটা বঙ্গাইগাঁও রেলওয়ে ইনস্টিটিউট এর কথা ।