Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ঠিক ঠিক পিকনিক || Shibram Chakraborty

ঠিক ঠিক পিকনিক || Shibram Chakraborty

ঠিক ঠিক পিকনিক

বিনি আমার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। আর, চিঠিটার ওপরেও—‘কী পড়ছ গো দাদা অমনি করে?’

‘নেমন্তন্নপত্র। আমাদের ইতু লিখেছে। ওদের পিকনিকে যাবার জন্যে সেধেছে…যাবি?’

‘ইতুদের পিকনিক?’

‘হ্যাঁ। ইতু ছাড়াও আরও আছে। ইত্যাদি আছে। এই দ্যাখ-না, কী লিখেছে—জবাদি যাবে, রেবাদি যাবে, মীরাদি যাবে, ইরাদি যাবে, ভুতুদি যাবে, পুতুলদি যাবে—অ্যাঁ, মেয়েটা কি কবি হয়ে গেল না কি রে? ছবিই আঁকত আমি জানতাম।’

‘কবিত্ব পাচ্চ কোথায়?’ বিনি শুধোয়।

‘মিলে। একটা মিল দিতেই আমরা হিমশিম খাই, ও কেমন দিদিতে দিদিতে মিলিয়েছে—দেখেছিস! বাহাদুর মেয়ে! লিখেছে যে, ওদের পিকনিকে একজন প্রধান অতিথি না হলেই নয়। সভায়-টভায় যেমন থাকে আর কী। সেইজন্যেই নাকি আমাকে ওদের দরকার—’

‘যাচ্ছ তুমি?’

‘ভাবছি। প্রধান অতিথি বটে, কিন্তু আতিথ্যের ব্যাপারেই শুধু। ভরসা দিয়েছে যে বক্তৃতা করার কোনো ফ্যাসাদ নেই—মুখ নাড়তে হবে, কিন্তু কথা দিয়ে নয়, খাবার দিয়ে। তাহলে আর ক্ষতি কী গেলে? অতিথির প্রাধান্যে তো খাবার আসবেই, ভোজসভাতে অন্তত? তুই কী বলিস?’ আমি বলি—‘তোকেও নিয়ে যেতে বলেছে। বলেছে যে বিনিদিকে চাই-ই। কেননা—’

‘কেননা?’

‘কেননা, মিনিদিও আসছে যে।’ আমি নিশ্বাস ফেলি—‘আমার ভয় হচ্ছে মেয়েটা নিশ্চয় কবি হয়ে গেছে। ভাবনার কথা।’

‘মিনতিও আসবে বুঝি? তাহলে তো যেতেই হয়।’ বিনি বলল।

‘কিন্তু তুমি যাবে? তোমার মাথা ধরছে না আজকাল? বলছিলে-না যে বেশি খেলেটেলে মাথাধরাটা আরও বেড়ে যায় তোমার?’

‘হ্যাঁ। আমার এই শিরঃপীড়া। এই এক ফ্যাসাদ। সেটা আবার আরও বেড়ে গিয়ে আজ দেখছি আমার পায়ে এসে ধরেছে।’

‘পায়ের মাথাব্যথা?’ অবাক হয় ও।—‘সেআবার কী গো?’

‘তাইতো দেখছি রে! কিন্তু এতে অবাক হবার কিছু নেই—’ আমি প্রকাশ করি—‘অনেক দিন থেকেই আমার সন্দেহ যে আমার মস্তিষ্কের খানিকটা আমার পায়ে গিয়ে জমেছে। কী করে গেল জানিনে। কিন্তু দেখেছি পায়ের আমার ধারণাশক্তি বেশ। পায়চারি করলে আমার মাথা খোলে। যখন গল্পের প্লট আসে না কি খেই পাইনে, তখন দেখেছি দু-এক পাক ঘুরলেই তাদের পাত্তা মেলে। কয়েক চক্কর মারলেই তারা চক্করবরতির খপ্পরে এসে পড়ে।’

‘চক্রে পড়ে বল?’

‘চক্রে এসে খপ্পরে পড়ে। পা খেলালেই আমার মাথা খ্যালে, আমি দেখেছি। এটা তুই কী মনে করিস?’

‘তোমার মুন্ডু।’

‘মুশকিল হয়েছে আজ আবার এই শিরঃপীড়াটা আমার পায়ে নেমেছে। সকাল থেকেই পা-টা টনটন করছে এমন! ঠিক যেন মাথার মতোই। চলতে-ফিরতে পায়ের শির যেন টেনে ধরছে। কী করে ওদের পিকনিকে যাই ভাবছি তাই—’

পিকনিকটা হচ্ছিল আবার বোটানিক্যাল গার্ডেনে। সেখানে ওরা সবাই নৌকা করে যাবে। বোটানিকসে যাবার আমার বাধা ছিল না, কিন্তু বোটে ছিল। আমি মোটেই সাঁতার জানিনে।

বোশেখ মাস। কালবৈশাখী আছেই। ঝড়ঝাপটা লেগেই রয়েছে। কাল হয়ে গেছে, আসছে কালও হবার কথা—আজ যে হবে না, তা কে বললে? আর, কালবৈশাখী মানেই নৌকাডুবি। সাঁতার জানিনে, জলে পড়লেই ডুবে যাব টুপ করে—ঠিক মারবেল গুলির মতোই। কিন্তু আমার নিজের জন্যে না—মেয়েগুলিও যে তলিয়ে যাবে জলের মধ্যে। সাঁতার জানিনে বলে কাউকেই ওদের তুলতে পারব না—বঁাচাতে পারব না কারুক্কেই। ইতুর দিদিরা, দেবীরা নৌকোয় যাচ্ছেন যান—দেবীদের নৌকাযাত্রা শাস্ত্রসম্মত। পাঁজিতেই লিখে থাকে। কিন্তু তাঁদের সহগমন করতে আমার নিতান্ত অনিচ্ছে।

তা ছাড়া, আরও একটা কথা। আমার মতন ভারিক্কি লোক যদি ওদের নৌকোয় ভর করে, তাহলে হয়তো কালবোশেখীরও তর সইবে না। দরকার হবে না আদৌ। এমনিতেই ভরাডুবি হবে। প্রাণের ভয় নেই আমার তা নয়—কিন্তু তা হচ্ছে আসলে ওদের প্রাণের ভয়।

প্রাণের ভয়ে আমরা নৌকো না ধরে ট্রাম ধরলাম। যাচ্ছি তো গাছপালাদের আড়তে, তবু তার জন্যেই বিনির সাজগোজের অন্ত নেই। ভ্যানিটি ব্যাগটাও নিতে ভোলেনি।

আমি আধময়লা কাপড়-জামা বেছে নিয়েছিলাম। ভোজ খেতে বসলে দেখেছি, আমার কাপড়-জামাও আমার সঙ্গে সমান তালে লেগে যায়। সন্দেশের গুঁড়ো, ডাল-ভাতের কিছুটা, মাছের টুকরো, মাংসের ঝোল—অযাচিত আমার গায়ে এসে পড়বেই। লাগবেই আমার কাপড়-জামায়। নিজের পাতে ঝোল টানার অভ্যেস আমার নেই, কিন্তু ঝোলরা যে নাছোড়বান্দা। তারা আমার গায়ের ওপর তাদের হলুদরঙা ছোপ বোলাবেই—ঝোলাবেই নিজেদের বিজ্ঞাপন। তাই সাধ্যমতো সাবধান হতে হয়েছে।

কিন্তু বিনির কোনো কসুর নেই। বেশবাস নিখুঁত। ছোটোদের পিকনিকে নয়—যেন বড়োদের—বড়ো দরের গার্ডেন পার্টিতেই যাচ্ছে সে।

‘যাচ্ছিস তো আহারে, তা এত বাহারের কী দরকার ছিল বাপু?’ না বলে পারিনি—‘তোর এই ভ্যানিটি ব্যাগটাও কি সঙ্গে না নিলে চলত না?’

‘বা রে, ভ্যানিটি ব্যাগ ছাড়া কোথাও যাওয়া যায় না কি?’

‘কেন বল তো?’ ও, বুঝেছি! বুঝেছি এবার। তা, ক-টা সন্দেশ ওর মধ্যে আঁটবে বলে তুই মনে করিস?’ আমারও এবার ব্যাগ্রহ দেখা দেয়।

‘আহা, সন্দেশের জন্যেই বুঝি? চোরের মন শুধু বেঁাচকার দিকে! কত টুকিটাকি রয়েছে এর ভেতর, পাউডার পাফ—!’

‘থাক থাক, হয়েছে। ও শুনলে কি পেট ভরবে আমার? তার চেয়ে বড়ো দেখে একটা থলে নিলে কাজ দিত।’ আমি মুখ বেঁকাই। বাস্তবিক কিছু বাগাবার কাজে যা লাগে না তা নিয়ে এত বাগাড়ম্বরে কাজ কী? এই ব্যাগাড়ম্বরে?

বোটানিকসে গিয়ে আমার শিরঃপীড়াটা নিছক এই পায়েই না, সারা গায়েই যেন ছড়িয়ে পড়ল। পাগলা হাওয়ায় গাছপালাদের সড়সড়ানি! পাতার ঝরঝরানি চারধারে। গা শিরশির করতে লাগল আমার।

ইতু, ভুতুরা একটু আগেই পৌঁছে আয়োজনে লেগেছে। ওরা এসেছে সরাসরি গঙ্গা পেরিয়ে, আমরা এসেছি ট্রামে করে সারা কলকাতা বেড়িয়ে। যাক, খাবার আগে তো বটেই, রাঁধবারও আগে এসে পড়া গেছে। এই বঁাচোয়া!

বিনি তার ব্যাগটা একটা গাছের ফ্যাঁকড়ায় ঝুলিয়ে রাখল। তার কাছাকাছি ইটের উনুন পেতে ধরাবার চেষ্টায় ছিল মেয়েরা। গোড়ায় উনুন আর শেষের নুন—রান্নার এই দুই সমস্যা। এদের সমাধান ঠিকমতো হলে তবেই খাওয়াটা পরিপাটি হতে পারে।

মাংসের কড়া নামবার আগে খাবার বরাত ছিল না। তাই ঘুরে-ফিরে আমি হাওয়া খাচ্ছিলাম। খাদ্য হিসেবে হাওয়ার সুবিধা এই, তা কষ্ট করে হজম করতে হয় না। উপরন্তু জিনিসটাও হজমি। আর নিখরচায় খাওয়া যায় তাই খাচ্ছি। এমন আবহাওয়ায় বিনির দেখা পাওয়া গেল—‘আমার ভ্যানিটি ব্যাগটা দেখেছ দাদা?’

‘না তো।…তখন যে একটা গাছের ফ্যাঁকড়ায় রাখলি দেখলাম।’

‘দেখছি না তো। কোন ফ্যাঁকড়ায় বলো দেখি?’

‘তা কী জানি! আমি কি মার্কা দিয়ে রেখেছি?’ আমি জানাই—‘কোনো ফ্যাঁকড়ার মধ্যে কি যেতে আছে? ব্যাগার খাটনিও আমার পোষায় না।…কী ছিল তোর ব্যাগে? টাকাকড়ি ছিল নাকি কিছু?’

‘ছিল কয়েকটা। কিন্তু সেজন্যে নয়—’

‘তবে এই দ্যাখ’—বলে দু-পকেট উলটে দেখাই—‘আমি নিইনি কিন্তু। তা আমার যতই খিদে পাক-না!’

ভেবে দেখলে, নিয়েই-বা কী করব? টাকা দিয়ে কী হবে এখেনে? এই বিজন বিভুঁয়ে কি কিছু কিনতে মেলে?

‘আমি কি বলেচি তুমি নিয়েছ?’ ও মুখ ভার করে থাকে।

সহানুভূতি ভরে আমিও মুখখানা ভার ভার করতে চেষ্টা করি, কিন্তু বেশিক্ষণ পারা যায় না। খাবার ডাক এসে পড়ে।

ইতু পেল্লায় একখানা মাংস আমার পাতে দিয়ে বলে—‘এই নাও—একটা মাটন চাপ তোমায় দিলাম। এক চাপ মাটন—কত বড়ো একখানা—চেয়ে দ্যাখো! মাংসটা কিন্তু আমার রান্না, বুঝলে বড়দা? জবাদি চাপিয়েছিল বটে, কিন্তু নুন-ঝাল সব আমার দেয়া। তা ছাড়া একটা কাঁচামিঠে আমও দিয়েছি ওর মধ্যে। খেতে বেশ টকমিষ্টি হবে।’

‘আম দিয়েছিস? পেলি কোথায় রে?’ আমি শুধাই।

‘পেতে হয়নি। গাছের ডাল থেকে খসে পড়ল হাঁড়ির ভেতর—আপনার থেকেই।’

‘বলিস কী রে? তা পড়তে পারে, আশ্চর্য কী! মাংসের গন্ধে এসে পড়েছে। আম গাছটা তো কচি আমে ভেঙে পড়বার জোগাড়! ওরই মধ্যে একটা—আমেদের একটা পেটুক চ্যাংড়াই হয়তো…কিন্তু তাই-বা কী করে হবে? আমি তো জানতাম পাকা আমরাই গাছ থেকে টুস করে পড়ে যায়, কিন্তু কাঁচা আম তেমন ঝড় না হলে পড়ে কি?’

‘কেন পড়েছে, বলব বড়দা? এ আমটা আমাদের পাড়ার ছেলেদের মতন এঁচোড়ে পাকা ছিল মনে হয়, তাই—বুঝলে কি না—’

‘কিন্তু ভাই, ভালো ছেলেদেরই তো পড়ার দিকে মন থাকে বলে জানি।’ বলে, ভালো ছেলের মতো পাতের মাংস নিয়ে পড়ি। পাঁঠার যে প্রকান্ড চাপটা ইতু আমার পাতায় ছেড়েছিল তাকে চেপে ধরি। কিন্তু যতই চেপে ধরি-না, কিছুতেই সেটাকে বাগাতে পারছিলাম না। যতই কামড়াই, দাঁত বসাতে পারিনে।

‘ইতু! তোদের পাঁঠার এই মাটন চাপটা—যা তুই আমাকে চাপিয়েছিস! কী রকমের ভ্যাড়াইটি কে জানে!’ দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলি—‘লড়তে লড়তে থকে গেলাম।’

‘জোরসে কামড়াও। আরও জোরসে। দাঁতে তোমার জোর নেই বুঝি?’

‘মনে হচ্ছে এটা পাঁঠাটার পাকস্থলী।’ আমি বলি—‘পাকস্থলী কি খায় মানুষ? খেলে কি হজম করতে পারে?’

‘কেন, পাকস্থলীর সাহায্যেই তো হজম করে সবাই।’ ইরা জানায়।

কিন্তু হজম করব কী, জমাতেই পারছি না আদপে। হাতে আর দাঁতে টাগ অব ওয়ার লাগিয়েও বাগ মানাতে পারছি না। অনেক টানাটানির পর মাংসটার ভেতর থেকে আরেকটা মাংসপিন্ড বেরোয়—‘এই দ্যাখ, কী বেরিয়েছে! পাকস্থলীটার পেট থেকে কী বেরুল দ্যাখ!’ আমি ওদের দেখাই—‘পাঁঠাটা পেটে পুরেছিল কিন্তু হজম করতে পারেনি। তোরা বলছিস পাকস্থলীতে নাকি হজম করে। এই দ্যাখ।’ বলে আমি ভাবতে থাকি—‘অবশ্যি, এমনও হতে পারে যে হজম করার সময়ই পায়নি বেচারা। তার আগেই তোদের কোপ পড়েছে ওর ওপর।’—জিনিসটা আমি মুখে নিয়ে চিবোতে যাই—‘সম্ভবত এটা ওর মেটুলি।…কিন্তু…’ চিবোতে গিয়ে হঠাৎ কেমন কড়াৎ করে ওঠে—‘কিন্তু metal-এর মতো কী যেন একটা মনে হচ্ছে!’

আঁশের মতো কী যেন সব দাঁতের ফাঁকে লাগে—‘না:, পাঁঠাটার রুচি খুব উন্নত ছিল না। সুবোধ বালকের মতো যা পেত তাই খেত হতভাগা। এসব কী? কী এসব আমার মুখে?’ আঁশের মতন জিনিসগুলিকে আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বার করি।

‘আমের আঁশ নয় তো দাদা?’ ইতু শুধোয়। ‘সেই কাঁচা আমটার না তো?’

‘পড়তে না পড়তেই পাঁঠার পেটের মধ্যে গিয়ে সেঁধিয়েছে? বলিস কী রে? কিন্তু যা-ই বল, কাঁচা আমের আঁশ আমি মোটেই পছন্দ করি না। খাবার আশাও করিনি কোনোদিন।’ বিরক্তি মুখে বলি।

‘আরে—আরে—এ কী!… এ কী রে আবার…’ বলতে বলতে আমি চেপে যাই। ভাত চাপা দিই তার ওপর। পাঁঠার পাকস্থলীটার থেকে একটা টাকা বেরিয়েছিল। ঝকঝকে রুপোর টাকা! ইস, টাকা হজম করতেও ওস্তাদ ছিল পাঁঠাটা। ঘাস খেত না খালি, মানুষ ছিল এদিকে। আরে আরে,—আরও টাকা দেখছি যে! নিজেই দেখি—আর কাউকে দেখাইনে—কোনো উচ্চবাচ্য করিনে একদম। কাউকে দেখতেও হয়নি। পাঁঠা হলে কী হবে, ব্যাটা খুব রোজগারে ছিল দেখছি। এই মন্দার বাজারেও মন্দ উপায় করেনি। আর তার যথাসর্বস্ব নিয়ে বেছে বেছে এক নিরুপায় লেখকের পাতে এসে পড়েছে। ভালোই করেছে বলতে হয়। ইতুরা ভোজ দিয়েছে বটে, কিন্তু এর ভোজন-দক্ষিণা দিয়েছে এই পাঁঠাটাই।

পাঁঠাটা মনীষী ছিল মনে হচ্ছে। কোনো বিখ্যাত বংশের কেউ হবে কি না কে জানে! ইতিহাসের দিক দিয়ে তেমন প্রীতিকর না হলেও, যত খাসা বংশেই খাসিরা এসে জন্ম নেয় দেখা গেছে। মাইকেলের সময় থেকে—বাঙালি লেখকের বরাবরের দারিদ্র্যের কথা হতভাগার অগোচর ছিল না মনে হয়। নিজের পাকস্থলী—কিংবা ট্যাঁকস্থলী যা-ই হোক—নিজের প্রাণ দিয়েও এক দরিদ্র লিখিয়েকে উজাড় করে দিয়ে গেছে অকাতরে।

কিন্তু পাকস্থলীটাকে তা বলে আমি ছাড়চিনে। খাবই যে করে হোক। যে আমাকে এত দিল তাকে কি আমি অবহেলায় পাতে ঠেলতে পারি? কৃতজ্ঞতা বলে কি কিছু নেই আমার?

কৃতজ্ঞতা আর দাঁতের জোরে খানিকটা ওর ধসাই। কিন্তু তার বেশি পারা যায় না। অধ্যবসায় হার মানে। কামড় বসাতে পারে না। মাংসটায় যদি একটুখানিও চর্বি থাকত! তাহলেও কিছুটা চর্বিতচর্বণ করা যেত—কিন্তু না, বেবাক নিহাড়—নির্মেদ। টাঁকশালের মতোই রস-কষহীন। অগত্যা, পাঁঠার উদরদেশ ফেলে রেখে বাঙালির ছেলে, সন্দেশের দিকে মন দিই!

কিন্তু সেদিকেই যে জুত করব তার জো কী? সন্দেশই এমন কী মজুত? এক-আধ টুকরো যা পড়েছিল আমার ভাগে, তা-ই মজা করে অনেকক্ষণ ধরে খেলাম। তারিয়ে তারিয়ে—এগাল থেকে ওগালে চালিয়ে—চাড়িয়ে চাড়িয়ে খাওয়া গেল।

‘কেমন খেলে বড়দা?’ পুতুল আমায় শুধায়।—‘মাংসটা লাগল কেমন?’

‘তা—তা এমন মন্দ কী?’ নিশ্বাস ফেলে বলি। ‘আরেক টুকরো পেলে টের পেতাম। এক টুকরোয় আর কী বুঝব?’

‘এক টুকরো পড়েছিল তোমার পাতে? মোটে শুধু এক টুকরো?—অ্যাঁ?’ জবা অবাক হয়ে তাকায়। আমার দিকে আর ইতুর দিকে—একসঙ্গে।

‘কিন্তু কত বড়ো এক টুকরো তাও বলো।’ জবাবদিহি দেয় ইতু।—‘তা ছাড়া, আমার রান্নাটা কেমন হয়েছে তা তো বললে না?’

‘রান্না? টক টক হবে বলছিলি না? কিন্তু কই, তা তো হয়নি, অন্তত তোর মতন এমন টকটকে নয়।’ আমি বলি—‘মোটের ওপর মন্দ হয়নি তা হলেও। সবই ভালো হয়েছে, কেবল একটুখানি যা খুঁত দেখলাম—চোখে নয়—চেখেই দেখেছি খুঁতটা—’ বলে একটু আমি খুঁতখুঁত করি।—‘তবে হ্যাঁ, কেবল যা এই খুঁতটুকুই। তা ছাড়া সবই ভালো। কেবল তোমাদের বিনিদির ভ্যানিটি ব্যাগটা যা একটু আধসেদ্ধ রয়ে গেছে।—এই যা।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *