ট্রেকার্স (Trekkers) : 07
মিলু নাকি জানত, বিলুর ব্যাপারটা। নিয়মিত চিঠিপত্র দিত মিলুকে, সংযুক্তা খবরটা দিলেন ধ্রুবকে। এখন সংযুক্তা অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছেন। মেয়েরা ভেঙেও পড়ে তাড়াতাড়ি, সামলেও নেয় তাড়াতাড়ি। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে ধ্রুব মুষড়ে যাচ্ছেন, প্রজেক্ট ফেল করেছে। ক্লায়েন্ট ছিছিক্কার করছে। কে ক্লায়েন্ট তাঁর? তিনি নিজেই নিজের ক্লায়েন্ট। ব্যর্থতা মেনে নেওয়া খুব শক্ত, বলা সোজা ইগোতে লাগছে। আজকাল এই কতকগুলো কথা হয়েছে। এগুলো মাঝে মাঝে অতি সরলীকরণ হয়ে যায়। তিনি আন্তরিকভাবে নিজের সামর্থ্যের মধ্যে কয়েকজনকে স্বাবলম্বী এবং মানুষ করতে চাইছিলেন। যে-সমাজ তাঁকে এত দিয়েছে, এইভাবে তাকে কিছু ফেরত দেওয়া। অনেক এনজিও যেমন একটা স্পনসর করা বলে ব্যাপার রেখেছে। অনেকেই অনেক বাচ্চাকে স্পনসর করে। তিনিও তাই করেছিলেন। তবে দায়টাও নিয়েছিলেন। ছেলেমানুষদের একটা নিজস্ব গোপন জগৎ থাকে, বোঝা যাচ্ছে। সেটার ঠিকানা তারা কাউকে দেয় না, অভিভাবক শ্রেণিকে তো একেবারেই নয়। আর যৌবন এমনই সময়, যখন ঠিক-ভুলের সংকেতটা ঠিক করে এনডোক্রিন গ্ল্যানডস। ভয় কম, কৌতূহল বেশি, জেদ বেশি। সত্যিকারের বাবা-মা’র প্রতিই দায়বদ্ধতা বা বাধ্যতা যখন থাকে না, এই উজ্জ্বল-আরিয়ান-দিয়াদের যেমন, তখন তাঁদের পালিত মেয়েগুলির তো আরওই থাকবে না। আর সত্যি কথা বলতে তো ওদের পুরোপুরি মেয়ের স্টেটাসও দেননি তাঁরা। ওরা সুখে-সম্মানে থাকা কাজের লোকই ছিল। যদি দু-তিন বছর বয়স থেকে ওদের বড় করার সুযোগ পেতেন, হয়তো মেয়ে করে নিতে পারতেন। কিন্তু ওদের তাঁরা পেয়েছেন কাউকে দশ, কাউকে বারো এমন অবস্থায়। তখন মুখের ভাষা, অভ্যাস, সংস্কার তৈরি হয়ে গিয়েছে। সেখানে কাটাকুটি করার প্রয়োজন ছিল। কোলে-পিঠে করেননি তো কোনওদিন। হয়তো বিশ্বস্ততার ভাগে তাই কম পড়ে গিয়েছে। ধ্রুবজ্যোতির হঠাৎ কেমন রাগ হয়ে গেল। তিনি মিলুকে ডেকে পাঠালেন, “মিলু, মিলু!” বেশ জোরে চেঁচিয়ে ডাকলেন। উত্তাপটা যাতে টের পাওয়া যায়।
“কী বাবা, চা খাবে?” মিলু প্রায় ছুটতে-ছুটতে এল।
“শোন মিলু, আমাদের চা-কফি খাওয়াবার জন্যে তুই বা তোরা এখানে নেই। তোদের আমরা মানুষ, মানে মানুষ করতে চাই বুঝলি? তোরও যদি বিলুর মতো কোনও মতলব থাকে, তা হলে বলে দে। আমরা আর পণ্ডশ্রম করব না।”
মিলু একেবারে হকচকিয়ে গিয়েছে, চোখে ভয়। ঠোঁট দুটো একটু-একটু কাঁপছে। শেষে বলল, “তাড়িয়ে দেবে বাবা?”
সংযুক্তাও হকচকিয়ে গিয়েছিলেন। এখন বললেন, “তাড়িয়ে দেওয়া-টেওয়া আবার কী কথা? ছি, মিলু ওসব আজেবাজে কথা ভাবিসনি। তুই কী করছিলি এখন?”
মিলু আস্তে-আস্তে বলল, “গান শুনছিলুম।”
“তো যা, গান শুনতে যা।”
মিলু চলে গেলে সংযুক্তা ভুরু কুঁচকে বললেন, “কী ব্যাপার, ‘ছি’-টা কিন্তু আমি তোমাকে বললুম। তুমি হঠাৎ এরকম, ও কী ভাবল বলো তো?”
“বিলু ভেবেছিল আমরা কী ভাবব? একবার জানাবার প্রয়োজন পর্যন্ত বোধ করেনি। এদের আমি গদ্দার বলি, গদ্দার।”
“ঠিক আছে। দোষটা করেছে বিলু, তুমি সেটা মিলুর ওপর ঝাড়লে কেন? ও একটা আলাদা মানুষ।”
“খবরটা গোপন রাখার বেলা ওর বিশ্বস্ততাটা তো বিলুর দিকেই গেল। বাবা-মা বলে আমাদের প্রতি ওর কোনও দায় নেই?”
সংযুক্তা একটু চুপ করে রইলেন। তারপরে বললেন, “ক্লাসের একটা ছাত্র দুষ্টুমি করলে অন্য কেউ যদি সেটা মাস্টারমশাইয়ের কাছে বলে দেয়, তা হলে কিন্তু লাগানে ছেলেটাকে সবাই একবাক্যে ছি-ছি করবে, গদ্দার বলবে। ওরা চট করে বন্ধুদের বিরুদ্ধে কিছু বলে না। তুমি কি চাও তোমার মানুষ করা একটি মেয়ে এরকম গদ্দারি শেখে?”
“কনফিউশন অব ভ্যালুজ,” গোঁ গোঁ করে বললেন ধ্রুব।
কিন্তু হঠাৎ মিলুর মুখটা মনে পড়ে গেল তাঁর। ঠোঁট দুটো থরথর করে কাঁপছে, চোখে ভয়, তাঁর মনে পড়ে গেল মিলুকে কোথা থেকে পেয়েছিলেন তাঁরা। কী ভয়ংকর পরিস্থিতি! ও খুব ভয় পেয়েছে। কাজটা তঁর ঠিক হয়নি, একেবারেই না। কিন্তু ছোড়া তির আর বলে ফেলা কথা তো ফিরিয়ে নেওয়া যায় না!
সংযুক্তা উঠে গেলেন। এই ঘর পেরিয়ে খাওয়ার ঘর। তার ওদিকে রান্নাঘর, রান্নাঘরের মুখোমুখি মিলুর ঘর। গান চলছে এফএম-এ, অনেকদিন পর প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় শুনলেন, ‘ধূলির পরে প্রণামখানি দিনু রেখে…’ একটু ইতস্তত করে মুখ বাড়ালেন। মিলু উপুড় হয়ে পড়ে আছে, পিঠটা ফুলে ফুলে উঠছে। চলে আসছিলেন, হঠাৎ তাঁর বুকটা কেমন হুহু করে উঠল। অল্প বয়সে তিনিই কি বকুনি খাননি? এমন বকুনি যাকে অপমান বলে মনে হয়েছে! কিন্তু সে সময়ে দিদি ছিল, বাবা বকলে মা ছিল শক অ্যাবজর্বার। মা বকলে, বাবা। মিলুর কেউ নেই, একেবারে অনাথ। তিনি ভেতরে গিয়ে ওর পাশে বসলেন, সন্তর্পণে পিঠে হাত রাখলেন। হঠাৎ তাঁর মনে হল, ব্রথেল থেকে উদ্ধার হওয়া, এই পাচার হয়ে যাওয়া বাংলাদেশি মেয়েটিকে তিনি কোনওদিন স্পর্শ করেননি। আশ্রয় দিয়েছেন, ভরসা দিয়েছেন, স্নেহও যে না দিয়েছেন তা নয়। কিন্তু কী যেন একটা দেননি, দিলে অনেক আগেই ওকে ছুঁতেন। কেন ছোঁননি, ব্রথেল বলে? পাচার বলে? ছি! কিছুক্ষণ আগে স্বামীকে যেটা বলেছিলেন, এখন দ্বিগুণ ধিক্কারে তিনি সেটা নিজেকে বললেন।
“মিলু ও মিলু! কাঁদিসনি রে। বাবা আসলে বিলুর ব্যাপারে বড় কষ্ট পেয়েছে তো! বকুনিটা আসলে বিলুকেই, তোকে নয়।”
চোখ মুছে মিলু উঠে বসল। ধরা গলায় বলল, “মা, একটু কফি খাবে?”
“দূর পাগল! আবারও বলছি মিলু চা-কফি করে দেওয়ার লোক দরকার হলে একজন কাউকে রেখে দেব। তোর পরীক্ষা, তোকে ডাকাডাকি করব কেন?”
“একটা কথা বলব মা, রাগ করবে না?”
“না না, রাগ করবার প্রশ্নই উঠছে না। একশোবার বলবি, বলিস না কেন সেটাই তো আমার প্রশ্ন।”
“আচ্ছা মা, বিলু যা করেছে ভালই তো করেছে। তোমাদের জানায়নি, বাধা দেবে বলে। কিন্তু খারাপটা কী? একটা আশ্রয় তো দরকার। সেটা যদি জীবনে এমন সকাল-সকাল পাওয়া যায়, স্বীকার করে নিতে ক্ষতি কী?”
“কিন্তু ধর, যদি লোকটি খারাপ হয় বা হয়ে যায়? তা ছাড়া বয়সে কত বড়। বিলুরই কী বা বয়স! কত ভাল মাথা ছিল অঙ্কে, নিজের পায়ে না দাঁড়িয়ে বিয়ে-টিয়ে করা খুব রিস্কি মিলু।”
“মা, বিলু কিন্তু খুব বুদ্ধি ধরে। বেচারামদা এতদিন বিয়ে করেনি কেন বলো তো? দোকানটাকে গুছিয়ে নিচ্ছিল। এখন খুব সলিড। বিলু তো এখনই বেচাদার অ্যাকাউন্টস সব দেখছে। অঙ্কটা যদি নিজের ব্যাবসার কাজে লাগানো যায়, সেটাও কি কাজে লাগা নয় মা?”
সংযুক্তা খুব দুর্বল গলায় বললেন, “আরও অনেক শেখবার সুযোগ ছিল।”
একটু পরে মিলু বলল, “বিলু তোমাদের সঙ্গে দেখা করতে ঠি-ক আসবে মা, ভেবো না।”
বলবেন না বলবেন না করে সংযুক্তা বলেই ফেললেন, “তোরও কি মনের কথা তাই মিলু, সকাল-সকাল আশ্রয়?”
মিলু কেমন শিউরে উঠল, হঠাৎ ভেঙে পড়ে বলল, “মা, আমাকে তাড়িয়ে দিয়ো না। আমি কাউকে বিশ্বাস করতে পারি না। আমি তোমাদের সব কাজ করে দেব, যা বলবে শুনব, দেখো।”
সংযুক্তা ওর মাথায় হাত রেখে অনেকক্ষণ বসে রইলেন। তারপরে বললেন, “তোর-আমার মধ্যে এই কথা হয়ে রইল মিলু। তাড়িয়ে দেওয়ার কথা কোনওদিন মুখে উচ্চারণ করবি না, আমাদের সব কাজ করার কথাও তুলবি না। গৃহস্থ সংসারে মেয়েদের যেটুকু করা উচিত, সেটুকুই তোদের করতে বলি। কিন্তু তোর যদি কোনওদিন অন্য কিছু করতে ইচ্ছে হয়, কোনও বিষয় নিয়ে পড়তে ইচ্ছে হয়, যদি কোনও ট্রেনিং নিতে ইচ্ছে করে অবশ্যই বলবি।”