ট্রেকার্স (Trekkers) : 04
বারান্দায় কাগজ ছোড়ার বম্বেটে আওয়াজটা পাওয়া গেল। চোখটা একবার খুলেই আবার বুজে ফেললেন ধ্রুবজ্যোতি। সংযুক্তা বললেন, “ওঠো না, একদিন না হয় চা-টা দিলে।”
“দেব বলছ?” ধ্রুব আড়মোড়া ভেঙে উঠে পড়লেন। বিলুটা দেশে গিয়ে হয়েছে মুশকিল। মিলুর পরীক্ষা এসে গিয়েছে, সে ছাতে গিয়ে ঘুরে ঘুরে পড়া তৈরি করে। দরজাটা খুলতে না খুলতেই দেখলেন, মিলু তিরের মতো সাঁ করে রান্নাঘরে ঢুকে গেল। তিনি নিশ্চিন্তে মুখ-টুখ ধুয়ে, গরম চা হাতে বারান্দায় এসে কাগজের পাকানো লাঠিটি খুলে ধরলেন। ধরেই একটু ঝুঁকে পড়লেন তিনি। চা-টা চলকে পড়ল ডিশে। শুকতারা বলে একটি মেয়েকে কনট্যাক্ট করেছে পুলিশ। সে নাকি আরিয়ানের প্রেমিকা।
মেয়েটি পুলিশকে বলেছে, “প্রেমিক? বশ্ অ্যান্ড ননসেন্স? ডেট বলতে প্রেমিকা বোঝায় না ফর ইয়োর কাইন্ড ইনফরমেশন। ডেটিং একটা খেলা। এর মধ্যে কোনও সিরিয়াস ব্যাপারই নেই। আজ যদি আরিয়ান নামে কারও সঙ্গে বেরোই, পরশু হয়তো বেরোব জগদীশের সঙ্গে। তার দু’দিন পরে জাস্ট মিতালি। একে কি ওয়েস্টার্ন সেন্সে ডেটিং বলে? এখানে পড়াশোনা করতে হলে রীতিমতো খাটাখাটনি করতে হয়। অত শস্তা নয়। ডেট হুঁঃ! হ্যাঁ, নিশ্চয় আরিয়ানকে আমি চিনতাম। তো কী? বলুন কী বলব?”
আরিয়ান অ্যাকাডেমিক্যালি মধ্যমানের ছেলে ছিল শুকতারার কথা অনুযায়ী। ভীষণ আমেরিকা-হ্যাংলা। ও খুব হাল্কা ধরনের ছেলে ছিল, কোনও কিছুকেই সিরিয়াসলি নিতে শেখেনি। মতিস্থিরও ছিল না। স্পোর্টসম্যান ছিল ভাল। কিন্তু সেটাকে নিয়েও কিছু ভাবেনি। কেন যে নিরুদ্দেশ হল, দেখুন হয়তো মুম্বই গিয়ে ‘খান-টান’ কিছু হওয়ার চেষ্টা করছে। শুকতারা আরও বলেছে, সে সিরিয়াসলি ডাক্তারি পড়ছে। থানায় গিয়ে নষ্ট করার মতো সময় তার নেই। যখনই প্রয়োজন হবে, তাকে পাওয়া যাবে। অসুবিধে কী? প্রেসের ধারণা, মেয়েটি আরও কিছু জানে। পুলিশ কী ভাবছে, বলছে না।
আরিয়ান, রূপরাজ, বাবাই, দিয়া/প্রজ্ঞাপারমিতা, উজ্জ্বল পাঁচটি ছেলেমেয়ে উইক-এন্ডে দিঘা বেড়াতে যাচ্ছে বলে বেরিয়ে গিয়েছিল ২৫ ফেব্রুয়ারি। কেউ ফেরেনি। কোনও মুক্তিপণের ফোনটোন আসেনি। দিঘায় এদের ট্রেস করা যায়নি। পাঁচজনের ছবি দিয়ে খবর বেরিয়েছে কাগজে, দূরদর্শনের চ্যানেলে-চ্যানেলে। সেখানে আবার একাধিক ছবি নানা অ্যাঙ্গল থেকে। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা, এরা কেউই কাদের সঙ্গে যাচ্ছে তা নিয়ে বাড়িতে সত্যি কথা বলেনি।
“শুকতারা, তুমিও কিছু সত্য গোপন করে গিয়েছ। আরিয়ান ছাড়াও অন্যদের তুমি চিনতে, চিনতে না?”
শুকতারা দাঁতে নখ কাটতে-কাটতে উদ্ধত গলায় বলল, “সো হোয়াট?”
“বললে না তো সে কথা?”
“পুলিশ আর প্রেস এই দুই পি’র খপ্পরে সাধ করে পড়তে যাব কেন? বুদ্ধু পেয়েছেন নাকি আমাকে?”
“দিয়াকে চিনতে? ও তো তোমার খুব বন্ধু ছিল।”
“খুব কি না জানি না, বন্ধু ছিল।”
“রূপরাজ?”
“চিনতুম।”
“তুমি উজ্জ্বল, বাবাই এদেরও চিনতে?”
“চিনতুম।”
“বিভিন্ন কলেজের, বিভিন্ন ব্যাকগ্রাউন্ডের ছেলে-মেয়েগুলোকে চিনলে কোথায়?”
“কী আশ্চর্য! আমাদের কোনও কমন ফ্রেন্ডের বাড়িতে দেখা হতে পারে না?”
“শোনো, ঠিক করে বলো তো, কোনও জয়েন্ট ছিল? ক্লাবটাব গোছের?”
শুকতারা বলল, “আপনি বড্ড বাজে বকছেন। ন্যাচারালি থাকবেই, সো হোয়াট?”
মেয়েটি হাই হিলের খটাখট শব্দ তুলে চলে গেল। পরনে গোল-গলা টি শার্ট, ব্লু জিনস, কোমরে কেমন একটা শেকল মতো, আধুনিক যুগের চন্দ্রহার বোধহয়। গলাতেও লম্বা একটা শেকলে একটি রুদ্রাক্ষ, তার তলায় স্টিলের ওঁ। খুব ঝাঁকড়াচুল মেয়েটির। মাঝে মাঝেই তার সাদা পালিশ করা লম্বা-লম্বা আঙুলগুলো চুলের মধ্যে ঢুকে যায়। ওটাই তার মুদ্রাদোষ। কিংবা চুলটাকে বশে রাখবার কায়দা।
শুকতারা নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল, জামাকাপড় বদলে নিল। মুখে চোখে জলের ঝাপটা। হাউজকোটের মধ্যে ঢুকে পড়ল। কী করছে ওরা? এবার ফিরে এলেই তো পারে! সব জিনিসের একটা সীমা আছে। ফোন করতে পারবে না, টাওয়ারই নেই। থাকলেও বিপজ্জনক। অথচ নিজের মধ্যে একটা দুশ্চিন্তার গুড়গুড় টের পাচ্ছে সে। তারও থাকার কথা ছিল, ঘটনাচক্রে অন্যরকম হল।
দরজায় টোকা পড়ল। হয় বাপি, নয় মা। আর কে হবে? দরজা খুলে শুকতারা দেখল, দু’জনেই দাঁড়িয়ে আছে।
“কী ব্যাপার, তোকে থানায় ডেকে পাঠিয়েছিল কেন?” মা বলল।
“বুঝতেই তো পারছ, বন্ধুদের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতে।”
“এতদিন ডাকেনি, এখন ডাকল কেন?” বাপি।
“সব কমন ফ্রেন্ডদের নক করছে আর কী!”
“তুমি সত্যি কিছু জানো না?” মা।
“কী আশ্চর্য! কী করে জানব, আই অ্যাম ভেরি মাচ ওয়ারিড লাইক এভরিবডি এলস।”
বাপি খুব সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “আমার কিন্তু তোকে একটুও ওয়ারিড মনে হচ্ছে না টুসি। দিব্যি খাচ্ছ-দাচ্ছ, সাজগোজ করে বেরিয়ে যাচ্ছ।”
“ঠিক আছে, এবার থেকে আর দিব্যি খাব-দাব না। তা হলে খুশি হবে তো?”
মা বলল, “টুসি তুমি অ্যাডাল্ট, তোমার কাছ থেকে দায়িত্বশীল ব্যবহার কি আশা করতে পারি না আমরা?”
“মা, আমি দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো কিছু করিনি। করেছে দিয়া, আরিয়ান, উজ্জ্বল ওরা। আমাকে ব্লেম করছ কেন? বেশ তো।”
“ঠিক আছে, দরজা বন্ধ কোরো না,” মা চলে গেল।
বাপি কিন্তু ঢুকে এল।
“ওহ্ টুসি, তোর মা না প্যারানয়েড হয়ে যাচ্ছে তোকে নিয়ে।”
শুকতারা ঠান্ডা গলায় বলল, “স্বাভাবিক।”
“আচ্ছা, দিয়া মেয়েটা কেমন রে?”
“কেন, তুমি অ্যাডপ্ট করবে?” শুকতারা মুচকি হাসল।
“না, যেটুকু দেখেছি ওকে খুব শান্ত, নিরীহ, ঘরোয়া মেয়ে বলেই তো মনে হয়। হঠাৎ এরকম একটা নিরুদ্দেশের ঘটনায় ওর জড়িয়ে পড়াটা খুব অস্বাভাবিক লাগছে। আর ওই আরিয়ান? ওর সঙ্গেও তো তোর খুব ভাব ছিল।”
“একসঙ্গে পড়ি, ভাব তো থাকবেই। দেখো বাবা, তুমি পুলিশগিরি কোরো না। খুব হাস্যকর হচ্ছে ব্যাপারটা। বন্ধু মানেই তার সমস্ত হিডন লেয়ার জানব, এমন কোনও কথা আছে?”
“হিডন লেয়ার?”
“হ্যা, মানুষের পার্সোনালিটির মধ্যে কতগুলো স্তর আছে আমরা জানি?”
বাপি বলল, “এনিওয়ে আমরা তোমাকে স্বাধীনতা দিয়েছি, তুমি তার যোগ্য বলে নিজেকে প্রমাণ করো। এমন কিছু কোরো না, যাতে তুমি বা আমরা বিপদে পড়ি। কিছু গোপন করা যদি বন্ধুত্বের শর্ত হয়, তা হলে টুসি, সে-শর্ত ভাঙবার সময় এসেছে। দশ দিন বোধহয় হয়ে গেল, তোমার বন্ধুরা নিরুদ্দেশ। যদি কিছু জানো, যদি কোনও পয়েন্ট, কোনও ক্লু দিতে পারো, দিয়ে দাও পুলিশকে। ওদের বাবা-মায়েদের কথা চিন্তা করো।” বাপি তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। বলল, “কিছুই তো বলছ না।”
শুকতারা বলল, “কিছু বলবার নেই বাপি। ওদের মধ্যে কেউ-কেউ আমার পরিচিত হতে পারে। কিন্তু ওদের সব কিছু আমি জানি না। আমার সত্যিই ভাবনা হচ্ছে।”