ট্রেকার্স (Trekkers) : 03
আমি রাসবিহারী মোড়ে টুক করে নেমে যাই। এখান থেকে ট্রাম নিয়ে নিই। ঘড়ঘড় ঘড়ঘড় করতে-করতে ট্রাম চলল। জ্যাঠামশাইয়েরই মতো, স্পিড নেই, বাক্য আছে। ওখার্ডের কাছটা কী নোংরা, বাপ রে! কাগজকুড়ুনিদের বস্তি মনে হচ্ছে। বস্তা বস্তা আবর্জনা জড়ো করে রেখেছে একদিকে। তার থেকে কিছু খুঁজে চলেছে তিন-চারটে বাচ্চা। দু’জন মেয়েলোক। একটা লোক বিড়ি ধরাল। ও বাবা, আবার তোলা উনুনে রান্না বসেছে। দেখতে-দেখতে ট্রাম-জ্যাঠা খুরখুর করে এগিয়ে গিয়েছে। এ দৃশ্য আমাদের নর্থে নেই, বুঝলি আরিয়ান! কোটি টাকার হাসপাতাল, ঠাকুরদেবতার মঠ, দু’পাশে বড় বড় দোকান, বড়লোকের বিবিরা সিল্ক-ব্রোকেড কিনছে, তার মাঝমধ্যিখানে কাগজ কুড়ানির বস্তি ইন ফুল সুইং। এরই কাছাকাছি কোথায় যেন থাকিস? দেশপ্রিয় পার্কের কাছেই বলেছিলি তো! রাস্তার নামটা ঠিকঠাক মনে পড়ছে না। তবু এ কথা সত্যি, রাসবিহারী ধরে একটু এগোলেই মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে যায়। সামহাউ প্রবলেমগুলো কেমন বাষ্পীয় হয়ে যায়। যেন চাকরি-বাকরির ভাবনা আবার কী জিনিস? ও তো হবেই, জাস্ট আ ম্যাটার অব টাইম। মিছিল নেই, চাক্কা জ্যাম নেই, রাস্তায় পড়ে থাকা লাশ নেই, দু’ধারে কালোয়ারদের দোকান নেই, ইচ্ছে হলেই কিছুমিছু খেয়ে নেওয়া যায়। এটুকু স্বীকার করতেই হবে।
গড়িয়াহাটে নেমে পড়ি। রোল-ফোল কিছু খেয়ে নিতে হবে। দু’পাশে হাজার রকম পসরা সাজানো। চিকমিক- ঝিকমিক করছে। ভিড় ঠেলে এইসব চিকিরমিকিরের মধ্যে দিয়ে যেতে বেশ লাগে। মনে হয়, চারপাশে একটা উৎসব চলেছে। যে-যার মতো করে এই উৎসবে অংশ নিয়েছে। কেউ রোল ভেজে যাচ্ছে, দ্যাখ-না-দ্যাখ এক ঢিপি পেঁয়াজ কেটে ফেলছে, কেউ-কেউ ‘আসুন দিদি, আসল পপলিনের পেটিকোট’ হাঁকছে, ‘কী রে ঠকাবি না তো?’ একজন জিজ্ঞেস করল। যেন ও বলেকয়ে ঠকাবে। ফুল কিনছে একজন, ‘উঁহু, নীলে চোবানো রজনীগন্ধা নেব না। গ্ল্যাডিওলি কত করে?’ একজন আমার পা মাড়িয়ে গেল, ‘সরি দাদা, লেগে গেল।’ দুটো রোল বেশ ফুর্তির মাথায় পেট্টায় করলুম। তারপর হন্টন।
বালিগঞ্জ স্টেশন রোড, এই আর এক মাল। কী ঘিঞ্জি, কী ঘিঞ্জি! তেলিপাড়াকে হার মানায়। এখানে একটা গেস্ট হাউজ আছে। নামে গেস্ট হাউজ, আসলে ভাড়াবাড়ি। একখানা ঘর নিয়ে তুমি থেকে যেতে পারো। এখানে নাকি নামী লেখকরা থেকেছেন, উঠতি অভিনেতারাও। রীতিমতো পশ গেস্ট হাউস।
নীচে একজন থ্যাপাস-থ্যাপাস করে কাপড় কাচছে। আমি পাশের সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলাম। ডান দিকে হিতেন সারের ঘর। হিতেন দেশাই গুজরাতি। শুনেছি সুদ্দু এই কোচিং করেই কলকাতায় বাড়ি-গাড়ি বানিয়ে ফেলেছেন। এই খাস্তা-গজা জায়গাটায় বোধহয় শুধু কোচিং করেন। দশ-বারোজন ছেলেমেয়ে অলরেডি বসে আছে। রিনাকে চিনলুম। বলল, “হাই!” ওদিকে ও ছেলেটা কে, ফ্যান্টাস্টিক চেহারা তো! বিজ্ঞাপনের পাতাটাতা থেকে উঠে এসেছে মনে হচ্ছে। এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে যেন ও-ই হিরো, হিতেন দেশাই ইজ নো বডি। আরিয়ান, তোর বাজার গেল রে!
দিয়ার পাশে গিয়ে বসি। ওর ভাল নাম প্রজ্ঞাপারমিতা। কিন্তু আমরা ডাক নাম ধরেই ডাকি। মুখখানা প্রতিদিনের মতো দুঃখু-দুঃখু করে রেখেছে। কীসের যে অত দুঃখ বুঝি না বাবা। দামি-দামি জামাকাপড় পরিস, গাড়ি সব সময়ে তোর তাঁবে, মা ঘ্যাম কাজ করে, হাতখরচা দেয় বাবা, ঝমঝম করছে ব্যাগ। মা-বাবা একসঙ্গে নেই তো কী? থাকলেই তো ঝগড়া। রাত্তিরে কেন মুড়ো ঘন্ট করেছ? জানো না, আমার কাঁটা লাগে? লাগ ধুমাধুম লেগে গেল। দিদির নাতির অন্নপ্রাশন, রুপোর সেটটা আনতে সে-ই ভুলে গেলে? নারদ-নারদ। এর গলা ‘নি’-তে চড়েছে তো ও গলা চড়ায় ‘সা’। কত অ্যাডভান্টেজ তোর, চেহারাখানাও পেয়েছিস জব্বর। ভগা না দিলে কে দেয় বল! এক ঘড়া তোর গঙ্গাজল, এক আধ ফোঁটা চোনা থাকবে না? ওতে কিস্যু হয় না।
“মলাটটা পালটা,” আমি নিচু গলায় বলি।
“শাট-আপ!” জবাব আসে।
হিতেন সার সাদা চুলের কেশরের উপর দিয়ে সাদা হাতটা চালিয়ে বললেন, “রূপরাজ, তোমার খাতাটা এসে নিয়ে যাও। মেন্ড দ্য ক্রস্ড ওয়ানস।” খাতাটা নিয়ে আমি পাশের ঘরে চলে যাই। এখানে ক’টা টেবিল আর মোল্ডেড প্লাস্টিকের চেয়ার আছে। মার্জিনাল নোটস রয়েছে, পয়েন্টস দিয়ে দিয়েছেন, আধঘণ্টাটাক লেগে গেল। উনি খাতাটা নিয়ে চোখ বুলিয়ে নিলেন, বড় বড় রাইট চিহ্ন দিলেন। তারপর একগোছা জেরক্স বাড়িয়ে ধরলেন। ব্যাস, আমার কাজ শেষ। উঠে পড়লুম। বাই দিয়া, বাই রিনা। বেরিয়ে দেখি, সেই মডেলও নামছে।
আমি বললুম, “আমি রূপ, মাসকম। তুমি?”
“উজ্জ্বল, এবার বেঙ্গল এঞ্জিনিয়ারিং-এ ঢুকলাম।”
“এঞ্জিনিয়ারিং-এ যাচ্ছ কেন? মডেলিং-এ যাও। বস্তা বস্তা টাকা কামাবে, তারপর ফিল্ম।”
“বডিটার কথা বলছ? ফালতু কাজের জন্যে বানাইনি। সো ইউ বিলিভ ইন বস্তা-বস্তা টাকা কামানো? আমার বডিটা তোমায় দিয়ে দিচ্ছি, যাও কামাও। তোমার কলমটা আমায় দিয়ো, অ্যান্ড ইয়োর ইম্যাজিনেশন।”
“সে-সব মাল আবার কোথায় পাব?”
“হিতেন সার বলছিলেন, আছে। মানে তোমার।”
আমি হেসে ফেলি। মনটা হঠাৎ খুব হালকা হয়ে যায়। বলি, “টাকা কামানো তো অবশ্যই, কিন্তু আসল হচ্ছে মিনিংফুল কিছু করা।”
“দাগ রেখে যাওয়া বলছ, বিবেকানন্দ বলেছিলেন না?”
“ওরে বাবা, দাগ রেখে যাওয়া-টাওয়া আমার কম্মো নয়। ভাল লাগে, এমন কিছু করতে ইচ্ছে করে।”
“আমি আবার যা ভাল লাগে না, জেদ করে তাই করছি।”
“কেন?”
“তাড়াতাড়ি ইন্ডিপেন্ডেন্ট হয়ে যাব।”
ভাল লেগে যায় ছেলেটাকে। একটা কফিখানায় গিয়ে বসি।