ট্রেকার্স (Trekkers) : 15
আরিয়ান, রূপরাজ আর উজ্জ্বল শরৎ বসু রোডের বারিস্তায় বসেছিল আড্ডায়। রূপরাজ তার বন্ধুদের সঙ্গে উজ্জ্বলের পরিচয় করাচ্ছে, ইতিমধ্যেই এই তিনজনের খুব জমে গিয়েছে।
রূপ বলল, “আমি জার্নালিজমটাই টার্গেট করেছিলুম। এখন যত খবর নিচ্ছি, মনে হচ্ছে বড্ড টাফ।”
“তুই কি মনে করেছিলি, তোকে কার্পেট বিছিয়ে ডেকে নেবে সব জায়গায়?”
আরিয়ান জবাবে বলল, “দেয়ার ইজ নো সফ্ট্ জব, ইয়ার। যাই করো, ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং, আই. টি., পলিটিক্স, এমনকী টিচিং পর্যন্ত, বীভৎস রকমের টাফ হয়ে গিয়েছে।”
“আমি কিন্তু সেই টাফনেসের কথা বলছি না। বলছি, জার্নালিজমে ল্যাং মারামারির কথা। তারপর ধরো, এক একটা কাগজের এক একরকম পলিসি। সেই মতো তোকে লিখতে হবে। আমারও তো একটা মতামত থাকতে পারে, সেটাকে চেপে অন্যের বলে দেওয়া কথা আমি কী করে লিখব? কোনও-ই নাকি স্বাধীনতা নেই!” সে হতাশভাবে বলল।
উজ্জ্বল বলল, “তা হলে জার্নালিজমে যাওয়াটা বুদ্ধির কাজ হবে না। ‘মাসকম’-এ বহু লাইন খোলা পাবি।”
“জার্নালিজমে মনটা পড়েছিল রে। যা চাই, তা কেন যে কিছুতেই পাই না।”
“আর কী কী চাইছ গুরু? আরিয়ানের মুখে হাসি। যা চাও, স্ট্রংলি চাও ইয়ার। এ ভাবে হয় না। আমাকে দেখে শেখো।”
“তোকে দেখে কী শিখব, তুই নিজেই তো ডাক্তার হতে চাসনি। নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে যেতে হচ্ছে না? নিজের জেদ বজায় রাখতে পেরেছিস? জেদটাও বড় কথা নয়, ডাক্তারি ইজ ফাইন। ভগবান সেজে মাল কামানো, এমন ডিভাইন শয়তানি আর হয় না। সে-কথা বলছি না, কিন্তু হতে চাস তো নটুয়া! আর কী হল?” রূপ বলল।
“হোয়াট ইজ নটুয়া?”
উজ্জ্বল বলল, “রাইমস উইথ বটুয়া, বুঝলে না?”
“মডেল, ক্রিকেটার, ফিল্মস্টার এইসব যে এঁচে রেখেছিলি?” রূপরাজ বলল।
আরিয়ান একটা চোখ ছোট করে বলল, “কে বলল এগোচ্ছি না? এমনও হতে পারে, ডক্টর-অ্যাক্টর হয়ে গেলাম। ফার্স্ট ইন দা ফিল্ম ওয়ার্ল্ড। কোথাও না কোথাও ফার্স্ট হচ্ছিই।”
“উজ্জ্বলের সঙ্গে পারবি?” রূপ বলল।
উজ্জ্বলকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে আরিয়ান বলল, “হেভি সেক্সি গুরু, কিন্তু তুমি নিশ্চয়ই আমার লাইনে আসবে না?”
উজ্জ্বল কফিতে চুমুক দিয়ে সংক্ষেপে বলল, “না। আচ্ছা শুকতারা, বাবাই, দিয়া ওরা আসছে না কেন এখনও?”
“যা বলেছ, এফএম না থাকলে আড্ডা জমে?” আরিয়ান বলল।
“জমে না এমন কথা বলছি না,” উজ্জ্বল বলল। “কিন্তু ওদের আসবার কথা ছিল।”
আরিয়ান বলল, “দেখো গুরু, তোমাদের কাছে হয়তো এফএম জাস্ট একটা অ্যাডিশন্যাল রিপ্রোডাকটিভ সিস্টেম…”
“কিন্তু আমি তো মেডিক্যাল পড়ি না,” উজ্জ্বল প্রতিবাদ করে উঠল, “পড়ো তুমি। তোমার কাছে তা হতে পারে। আমার যন্ত্রপাতি নিয়ে কারবার। আমি মেয়েদের মেয়ে হিসেবেই দেখি।”
“ইউ আর রাইট,” আরিয়ান স্বীকার করে নিল। “মেয়েদের মেয়ে হিসেবে দেখাই ভাল। ছেলে হিসেবে দেখা ভাল নয়।”
সকলেই একটু হেসে উঠল।
এই সময়ে হাই হিল খটখটিয়ে খোলা চুল মেলে ঢুকল শুকতারা।
“আয়, আয়, এক্ষুনি তোর কথাই হচ্ছিল।”
শুকতারা অন্য একটা টেবিলের কাছ থেকে হিড়হিড় করে একটা চেয়ার টেনে বসে গেল।
“এই তো হিড়িম্বা এসে গিয়েছে,” আরিয়ান বলল। “শূর্পনখা, তাড়কা এরা কত দূর?”
উজ্জ্বল আশ্চর্য হয়ে বলল, “তুমি রামায়ণ-মহাভারতের ক্যারেকটার্স জানো?”
“কবে কমিকস্-এ পড়েছি,” আরিয়ানের গলায় বেশ গর্ব।
“তাই বলো! তা এরা যদি হিড়িম্বা, শূর্পনখা, তাড়কা হয় তা হলে তোমাকেও অলম্বুষ, ঘটোৎকচ, খরদূষণ জাতীয় কিছু হতে হয়।”
শুকতারা বলল, “যেতে দে, যেতে দে। হিড়িম্বা-ফিড়িম্বা বললে আমার কিছুই এসে যায় না। উজ্জ্বল আজকাল ভাল টেনিস খেলছে বুঝলি আরিয়ান। মিক্সড ডাবল্স হল গত শনিবার। একদিকে উজ্জ্বল-দিয়া, অন্যদিকে আমি-বাবাই।”
“তা হলে মিক্সড ডাবল্স হল কোথায়?” আরিয়ান বলল।
“আমি ধর আমাদের গ্রুপে মেল, আর কাউকে না পেলে কী করব?”
“জিতল কে?”
“উজ্জ্বলরা। আসলে ক্রমাগত র্যালি হয়ে যাচ্ছিল। আমরা দু’জনেই ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম। উজ্জ্বলরা সেই সুযোগটা নিল। ওই তো দিয়ারা আসছে।”
আরিয়ান গিয়ে আরও তিনটে কফির অর্ডার দিয়ে এল। আরও কিছু স্ন্যাক্স। দিয়া একটা লক্ষ্ণৌ চিকনের পাঞ্জাবি পরেছে প্যান্টের ওপর। ওকে খুব রোগা এবং ক্ষুরধার দেখাচ্ছিল। বাবাই স্কার্ট, ওকে একেবারেই স্কুল-বালিকা মনে হচ্ছিল। একমাত্র শুকতারাই তার বড় বড় চোখ, লম্বা নাক, মোটা ঠোঁট, অনেক চুল, বিরাট দৈর্ঘ্য আর লো-ওয়েস্ট জিন্স-টপে প্রচন্ড মড আর গ্ল্যামারাস হয়ে বিরাজ করছিল।
“রিনা এল না?” দিয়া রূপকে জিজ্ঞেস করল।
“রিনা এখন কী সব প্রজেক্ট নিয়ে ব্যস্ত,” রূপের জবাবের মধ্যে একটা সাবধান হেলাফেলার ভাব।
উজ্জ্বল বলল, “আমি শুশুনিয়ায় গিয়েছি মাউন্টেনিয়ারিং-এর ট্রেনিং-এ। অযোধ্যা পাহাড় অঞ্চলটাও আমার খুব চেনা। স্কাউটের ক্যাম্পেই গিয়েছি দু’বার। একটু ওয়াইল্ড অথচ বিউটিফুল ল্যান্ডস্কেপের জন্য অযোধ্যা পাহাড়, পুরো ঝাড়খন্ডই একেবারে ঠিক। শুশুনিয়া অঞ্চলটা ড্রাই। তোমরা ন্যাচারালি তোমাদের সাজেসশন বলবে।”
দিয়া বলল, “আমি সিঙ্গাপুর, ব্যাঙ্কক, হংকং গিয়েছি। এখানে কিছু কিছু সি-সাইড আর হিলস্টেশন। নির্জন জায়গা হিসেবে ডালহৌসি বা ল্যান্সডাউন ভাল। তবে ওসব তো যাতায়াতেই অনেকটা সময় যাবে, কী রে আরিয়ান?”
আরিয়ান বলল, “এই রূপ-টুপ আমাকে খুব স্নব-টব ভাববে, কিন্তু ফ্যাক্ট হল আমি অস্ট্রেলিয়া, সুইজারল্যান্ড, লন্ডন গিয়েছি একাধিকবার। বাট আই নো নাথিং অ্যাবাউট ইন্ডিয়া। যাইনি, দেখিনি, সুযোগ হয়নি। তোরা যেখানে ঠিক করবি যাব। আই অ্যাম রেডি। বাবাই কিছু বলো, হিড়িম্বা, তোরই বা কী মত?”
বাবাই বলল, “আমার কোনও আইডিয়াই নেই, দার্জিলিং আর পুরী ছাড়া আমি কোথাও যাইনি।”
রূপ বলল, “যা বলেছিস, টিপিক্যাল মিড্ল ক্লাস হলিডেজ। আমি অবশ্য স্কাউটের সুযোগেই একটু এধার-ওধার গিয়েছি, তবে সে বলবার মতো কিছু নয়।”
“তোরা যা হয় ফিক্স কর, আমার কোনওটাতেই আপত্তি হবে না। খালি অ্যাডভেঞ্চারটা হওয়া চাই। রুকস্যাক, স্পোর্টস শু, নাইক, নাইলন স্ট্রিংস, অ্যান্ড আ’ অ্যাম গেম,” শুকতারা হাত ছড়িয়ে বলল।
“তা হলে উজ্জ্বল অ্যারেঞ্জ কর,” আরিয়ান বলে উঠল। “উই আর আ পার্ফেক্ট সিক্সসাম।”
আরও কিছু গল্পসল্প, হইচই হল। দিয়া আর বাবাই কথা বলছে খুব কম।
আধ ঘন্টা পর বাকিরা উঠে পড়ল। উজ্জ্বল আর রূপরাজ বসল আরও কিছুক্ষণ। যদিও ওদেরই যেতে হবে সবচেয়ে দূর।
রূপ তার সেলফোনটা বার করে একটা নম্বর লাগাল। লাউডস্পিকারটা অন করে দিল।
“হ্যালো, রূপ।”
“এলি না কেন?”
“অড নাম্বার ভাল না।”
“আর কিছু নতুন পেলি?”
“চেষ্টা চালাচ্ছি। একজনের সঙ্গে খুব জমিয়ে নিয়েছি।”
“কে?”
“গেস”
“রণবীর?”
“ও তো হাতের পাঁচ। দি আদার ওয়ান, ভীষণ শেয়ানা।”
“ও কে দেখা হবে।”
ফোনটা বন্ধ করে রূপ বলল, “শুনলি?”
উজ্জ্বলের মুখটা এখন গভীর ভাবনায় আচ্ছন্ন। সে বলল, “শুনলাম, দেখা যাক।”
মিলু উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে। কমলা পাড় সাদা শাড়ি আর কমলা ব্লাউজ। মা-বাবাকে প্রণাম করল। সংযুক্তা কপালে দইয়ের ফোঁটা দিলেন। পরীক্ষার সময়ে গভীর মনোযোগ, বিশ্রাম, নিয়মানুবর্তিতা, ভাল খাবার। আবার সব মিলিয়ে চেহারার মধ্যে একটা ভীষণ ‘পবিত্র শ্রী’ আসে। মিলুকে মনে হচ্ছিল, অপাপবিদ্ধ, শান্তবুদ্ধি, সরস্বতীর মেয়ে। সংযুক্তা সস্নেহে বললেন, “পেপার দেখে একেবারে ঘাবড়াবি না। খুব মন দিয়ে লিখিস। রিসেসে তোর বাবা যাবে’খন।”
ধ্রুবজ্যোতি বললেন, “ক’টা কলম নিয়েছিস?”
“তিনটে,” স্মিত মুখে মিলু বলল।
বাড়ি থেকে সামান্য দূরত্বের মধ্যেই স্কুল। তবু ছাতা নিয়ে ধ্রুব ওকে পৌঁছোতে গেলেন। সিট খুঁজে বসিয়ে দিয়ে, জলের বোতলটি পাশে রেখে, মাথায় একবার হাত রাখলেন। মিলু আবার প্রণাম করছে।
“ইতিহাস মানেই যে একগঙ্গা লিখতে হবে তা কিন্তু নয়।” শেষ উপদেশটা দিলেন।
তারপর চারদিকের কিচমিচ-কিচমিচের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে এলেন। ফিরছেন, পাড়ারই এক ভদ্রলোক তাঁর ছোট মেয়েকে পৌঁছে দিয়ে, তাঁরই সঙ্গে বেরোলেন।
“কেমন তৈরি হল আপনার ক্যানডিডেট?” ভদ্রলোক বিরস সুরে জিজ্ঞেস করলেন।
“ভালই তো মনে হয়, আপনার মেয়ে তো নিশ্চয়ই খুব ভাল।”
“ভগবান জানেন, ধ্রুববাবু। পড়াশোনায় তো মন নেই, সদা-সর্বদা উড়ছে। আর আবদার, বাবা এই দাও, ওই দাও। তার মা-ও তাকে প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছেন, আহা বলছে দাও-ই না। ক্ষণে-ক্ষণে সেলফোনের মডেল পালটাচ্ছে। ওর বন্ধুরা যা ভাল বলবে, যা কিনবে, ওরও তাই চাই। আপনারা আছেন ভাল। ঝিয়ের মেয়ের জন্য যা করছেন, তুলনা হয় না। বরাবর কৃতজ্ঞ থাকবে।”
“ও কিন্তু গৃহস্থ ঘরের মেয়ে, কাজের লোক-টোক বলে আমরা দেখি না।”
“ও-ই হল। কয়লাকে অঙ্গার বললেও সে কয়লাই থাকে।”
ধ্রুবর ভেতরটা চিড়বিড় করতে লাগল। তিনি বললেন, “আপনার বড় ছেলেটি কী করছে?”
“কী আবার করবে? ভ্যারেন্ডা ভাজছে। একটা চাকরিও রাখতে পারে না। ধরছে আর ছাড়ছে। ধরে যখন লাটসাহেবি করে, ছাড়বে তো ভিখিরি। আরে সঞ্চয় কর, আমার সঞ্চয় ছাড়া দাঁড়াতে পারতিস?”
“ধৈর্য ধরুন বিজয়দা। আজকাল চাকরির বাজার অন্য ধরনের হয়ে গিয়েছে। ট্রেন্ড লোকের কাজ পেতে অসুবিধে হয় না। তার উপর আজকাল এই লোন-ইকনমির মধ্যে ছেলেরা মাথার ঠিক রাখতে পারে না। সঞ্চয় এখন বুঝবে না। তবে আমার বড় মেয়েটি কল-সেন্টারে কাজ করতে-করতে কীভাবে যে ফারদার ট্রেনিং নিল, খুব ভাল চাকরি পেয়েছে টিসিএস-এ। মেজটি বিয়ে করেছে। কিন্তু ব্যাবসাদার স্বামী, তাকে কাজে সাহায্য করে। রীতিমতো মাইনে পায়। তার সঞ্চয়ে খুব মন, ফিনান্সে খুব মাথা।”
“আপনার মেয়ে, মানে, ওই ঝিয়ের মেয়ে?” বিজয় সুর থতিয়ে গেলেন।
“অমন কথা মুখেও আনবেন না সুর-দা। পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট। শীলু টিসিএস-এ প্রোগ্রামার, বিলু বিজনেসওম্যান, আন্ত্রপ্রেনিয়র যাকে বলে।”
“আপওয়ার্ডলি মোবাইল লোয়ার ক্লাস,” আলগা-আলগা করে কেমন ভ্যাবলার মতো উচ্চারণ করলেন বিজয় সুর। “কী করে সম্ভব করলেন?” পরে বললেন, আমার মেজটি ভালই করছে। কিন্তু কী বলবো আপনাকে সার, সাঙ্ঘাতিক সেলফিশ। তৃণাকে বরং এই মাধ্যমিকটার পর আপনার কাছে পড়তে পাঠিয়ে দেব।”
ধ্রুবজ্যোতি বললেন, “এটা কিন্ত জাস্ট পড়ানোর ব্যাপার নয় সুর-দা। আপনি ভুল করছেন, জীবনযাপনের ব্যাপার। উই লিভ অ্যান আউটওয়ার্ডলি আনইনটারেস্টিং লাইফ। প্রাইম টাইমে টিভি দেখা নেই, সমস্ত হিন্দি ছবি দেখতেই হবে এইরকম পিআর-প্রেশার ওরা অনুভব করেনি কোনওদিন। খুব যে একটা বন্ধু-বান্ধবের বিরাট দল ছিল, তা তো নয়ই। আমাদের লাইফে একটা অলিখিত ডিসিপ্লিন আছে। আর একটা ইনওয়র্ডলি ইনটারেস্টিং ব্যাপার আছে।”
“সেটা কী?”
“সেটা আমি ঠিক কাউকে বোঝাতে পারব না। ধরুন, মানুষের তো একটা ইনারওয়র্ল্ড আছে। মানে ভাবজগৎ। ধরুন, আমি কী, আমি কেমন, আশপাশে কী হচ্ছে, ভেতরে সেগুলো কী আলোড়ন তুলছে, বই পড়া হচ্ছে, বইগুলো ভিন্ন সমাজে, ভিন্ন মনোভূমিতে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের। এইগুলোতে ভাল লাগা, ইনটারেস্ট তৈরি হয়ে গেলে বাইরের নেশাগুলোর তুচ্ছতা বোঝা যায়।”
“ব্যস, এ তো ফিলজফি সার। এসব আমাদের ছেলেগুলোর কাছে বললে তো হেসে দেবে। ওরা ডিপেন্ডেন্ট, মানে, ঝিয়ের…” কথা শেষ করলেন না বিজয় সুর।
“ওই ডিসঅ্যাডভান্টেজটাই ওদের ক্ষেত্রে অ্যাডভান্টেজ হয়ে দাঁড়িয়েছে ফর্চুনেটলি।”
“তবে কি আপনি বলতে চাইছেন আমরা সবাই মানে, ঝিয়েদের ছেলেপুলেদেরই প্রতিপালন করলে ভাল রেজাল্ট পাব?”
ধ্রুবজ্যোতি হেসে ফেললেন। বললেন, “দূর মশাই, ছাড়ুন তো। কী তখন থেকে ঝিয়ের-ঝিয়ের করে যাচ্ছেন। আপনার ছোট মেয়ে, মানে, ওই তৃণা তো? চমৎকার মেয়ে। কোনও ছেলেমেয়েই আপনার খারাপ নয়। মিথ্যে চিন্তা করছেন।”
কথা বলতে-বলতে তাঁর বাড়ি এসে গিয়েছে। ধ্রুব ঢুকে গেলেন। আপন মনেই হেসে যাচ্ছেন। সংযুক্তার সেকেন্ড হাফ-এ ডিউটি। তিনি চান সেরে হাওয়ায় বসে চুল শুকোচ্ছেন।
“কথাটা ভদ্রলোক খারাপ বলেননি কিন্তু,” ধ্রুবজ্যোতি বলে উঠলেন।
“কী কথা? কোন ভদ্রলোক?”
“পালিত ছেলেমেয়ের ওপর কন্ট্রোলটা নিজের ছেলেমেয়ের থেকে বেশি থাকে। তবে পালিতকে জানতে দিতে হবে সে পালিত, কিন্তু নিজের ছেলেমেয়ের মতোই আমরা দেখি তাদের। বাধ্যতা বেশি পাওয়া যায়। অন্যরা জানে যে, এ পালিত। একজনের দয়ায় রয়েছে, কাজেই বেশি বিরক্ত করে না। ‘ওমা ওই সিনেমাটা দেখিসনি? এমা, এই গানটা কে গেয়েছে। জানিস না? এইসব বলবে না এদের। আমরা দেখো, ডিসকভারি, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক আর অ্যানিম্ল প্ল্যানেটের উপর রেখেছি ওদের। আর কিছু বাছা বাছা প্রোগ্রাম। রেডিয়ো ছাড়া ওদের হাতের কাছে কিছু নেই। হাতখরচ নিতান্তই সামান্য। পোশাক-পরিচ্ছদ ওদের পছন্দের সঙ্গে আমাদের পছন্দে যা মেলে তাই।”
এতক্ষণে সংযুক্তা ধরতে পারলেন বিষয়টা। যদিও কেন উঠল, কোথা থেকে উঠল, বুঝতে পারলেন না। সংক্ষেপে বললেন, “মেয়ে নয়, কিন্তু মেয়ের মতো,” সেই ক্ল্যাসিক উক্তি।
এই মেয়েগুলির প্রত্যেকে অসহনীয় দুর্ভাগ্যের ইতিহাস নিয়ে এই বাড়িতে এসেছে। ওরা জানে বাইরের পৃথিবী কী নিষ্ঠুর, অশ্লীল, ভয়ানক। প্রতি তুলনায় এই বাড়ি কত মমতাময়, নির্ভয়, শালীন। ওইরকম অতীত যদি না হত, সাধারণ দরিদ্র ঘরের মেয়ে হত, তা হলে? তা হলে কি ওরা তাঁদের এই সংযম-শাসন মেনে নিত? যদি মেয়ে না হয়ে ছেলে হত, তা হলেই বা কী হতে পারত?
মিলি মজুমদার আসলে ছিল জাহিরা শেখ। তার ডাক নাম মিলুটাকেই বরাবর রেখে দিয়েছেন তারা। স্কুলে ভর্তির সময়ে তারা জিজ্ঞেস করেছিলেন, “তোর কী নাম দেব?”
ও-ই বলে, “মিলি মজুমদার।”
“কিন্তু তুই যে মুসলিম, তার কোনও চিহ্ন রাখবি না?”
“আমার বাবা তো আমাকে বিক্রি করে দিয়েছিল। তার পদবি, তার নাম আমি নেব কেন? তোমরা যদি ওয়েস্টার্ন ট্রেডিং থেকে একটা ফ্রিজ কেনো, ফ্রিজটা তো তোমাদের হয়ে যায়। আর তো দোকানের থাকে না, কারখানারও থাকে না।”
খুব অদ্ভুত তুলনাটা। কিন্তু একটি সন্তান, এখানে মেয়ে-সন্তান যে আসলে, ঘটিবাটির মতো বিক্রেয় সামগ্রী, সমাজের এই ফ্যালাসিটা মিলি যে ধরে ফেলেছিল তাতে কোনও সন্দেহ নেই। ধর্মের জায়গায় কিছু তো লিখতেই হয়। সংযুক্তা সংক্ষেপে বললেন, “অত ভাবছ কেন? আমাদের মেয়ে আমাদের পদবি, ধর্ম, একটা নাম বসিয়ে দাও। কী মিলি ঠিক আছে?”
তিন বোনের মধ্যে মিলিই সবচেয়ে ফরসা। যত্নে, শরীর চর্চায়, বয়সকালে এখন তাকে আর পাঁচটা ভাল ঘরের মেয়ের থেকে কোনওমতেই আলাদা করা যায় না। অনেক দিন পর্যন্ত একটা ভিতু-ভিতু ভাব ছিল তার মধ্যে। সম্প্রতি সেটা চলে গিয়েছে। চোখ দুটোয় এসেছে প্রশান্তি। গভীরতা। চেহারায় একটা পালিশ। কমপ্লেক্সটা চলে গিয়েছে। জীবনবিজ্ঞান পরীক্ষা দিয়ে সেই মিলি আর বাড়ি ফিরল না। তখনও অ্যাডিশনাল পরীক্ষা বাকি। তার দু’-তিনজন বন্ধুর বাড়ি ফোন করলেন দম্পতি। সকলেই বলল, ওর পরীক্ষা খুব ভাল হয়েছিল। তারপর কখন ও একা-একা বাড়ি ফিরে গিয়েছে কেউ লক্ষ করেনি। ও তো মোটের ওপর একা-একাই যেত।
দু’দিন পর উসকো-খুসকো ধ্রুবজ্যোতি বললেন, “আমি পুলিশে চললুম।”
সংযুক্তা ক্লান্ত গলায় বললেন, “কী দরকার? যে গিয়েছে, সে আপনি গিয়েছে। বিলু কি আপনি যায়নি?”
ধ্রুবজ্যোতি মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলেন।