ট্রেকার্স (Trekkers) : 12
বসন্তকাল বলতে ঠিক যা বোঝায় তা এ শহরে বেশিদিন থাকে না। কিন্তু আসে, সামান্য তপ্ত আবহাওয়া কিন্তু হাওয়ার ক্লান্তি নেই। কেমন একটা সুগন্ধ ধোঁয়া ওঠে ভূতল থেকে। পুষ্প, তৃণ, নবোদ্গত পত্ররাজির গন্ধ কি? হঠাৎ-হঠাৎ কীসের স্পর্শে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে। উত্তর ষাটেও এই বাসন্তী হরখিলা মুগ্ধতায়, প্রসন্নতায় মাখিয়ে দিয়ে যায় তাঁকে। ভাল লাগতে থাকে জীবন। শুধু বারান্দায় বসে বাঁচতে, শুধু কুসুম-বিছানো পথে হেঁটে হেঁটে বাঁচতে। সংযুক্তাও কেমন নতুন হয়ে ওঠেন। ত্বকের ওপর একটা নতুন আভা, ঘরে ফেরা ক্লান্তির ওপর লাবণ্য মাখানো। গা ধুয়ে, ভাল করে ট্যালকম পাউডার মেখে একটা আকাশি রঙের শাড়ি পরে বারান্দার চায়ের আসরে যোগ দেন সংযুক্তা। মিলু এবার পটে করে চা নিয়ে আসে, নানারকম বিস্কুট ওঁদের দু’জনেরই একটা বিলাস।
“আচ্ছা সংযুক্তা, তুমি কি টের পাও বসন্ত বদলেছে?”
“আমাদের কথা বলছ তো?”
“ন্যাচার্যালি।”
“তা হলে ভাবতে হয়। আমার তো আবার প্রত্যেক ঋতু পরিবর্তনকেই একটা করে বসন্ত মনে হয়। আগেও হত, এখনও হয়। কেমন একটা রোমাঞ্চ,” ভেবে-ভেবে বললেন সংযুক্তা। “তবে কী জানো এখন সেটাকে ট্যাক্ল করতে পারি, আগে পারতাম না। কেঁদে, মন কেমন করে, বিষাদে, আহ্লাদে আকুল হয়ে যেতাম।”
“ভালবাসতে না?”
সংযুক্তা হেসে বললেন, “আমি অন্তত সবচেয়ে ভালবাসতুম নিজেকে। নিজেই নিজেকে নির্জনে প্রেমনিবেদন করতুম, একটা পছন্দসই চরিত্র খাড়া করে নিতুম। সে আমাকে খুব ভাল-ভাল কথা বলত।”
“প্রেম নিবেদন কতটা পর্যন্ত, ফিজিক্যালি যেত?”
“একদম অসভ্যতা করবে না,” সংযুক্তা একটু লাল হয়ে বললেন।
“তবে হ্যাঁ যৌবনে, মানে প্রথম যৌবনে সারা বছরই বসন্ত,” চায়ে চুমুক দিয়ে ধ্রুব বললেন।
“তোমাদের আর কী! আমাদের বর্ষায় কাপড় শুকোবার, চুল শুকোবার মুশকিল। গ্রীষ্মে ঘামতে ঘামতে রান্না করা।”
“তুমি করতে নাকি?” ধ্রুব হেসে জিজ্ঞেস করলেন।
“আমি না হলেও, আমার মাকে তো করতে হত।”
“তাঁর তো তখন নবযৌবন না, সেটা তোমার।”
“আজ্ঞে না, আমাদেরও করতে হত। চা, টোস্ট, কফি এসব করতে হত।”
“আচ্ছা সংযুক্তা একটু ভেবে বল তো,” ধ্রুবজ্যোতি বললেন, “বসন্তটা কি শুধু প্রেমের, সেক্সের সুড়সুড়ি?”
“আমাদের ক্ষেত্রে অন্তত না।”
“আবার বহুবচন করছ কেন? বহুর কথা তুমি জানো না, তোমার কথা বলো।”
“আমার মন কোথায় উধাও হয়ে যেত। কার জন্য, কীসের জন্য যেন মন কেমন করে উঠত থেকে থেকে। ফুটন্ত ফুলে-ভরা গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে পথে চলতে-চলতে কেমন একটা উচ্ছ্বাস, একটা পুলক হত। সেটা এখনও হয়। হয়তো অতটা না, কিন্তু হয়। তোমার?”
ধ্রুবজ্যোতি বললেন, “সেই জন্যেই তো তোমায় জিজ্ঞেস করছিলুম। আমরা মেয়েদের দেখে পুলকিত হতুম ঠিকই, আমার কিন্তু বেশ ভাল মন্দ বিচার ছিল। তবে বেশির ভাগ বসন্তই গিয়েছে কবিতা লিখতে। আকাশে-বাতাসে কবিতা ভাসত। খুব পড়তুম তখন, রবীন্দ্রনাথ নিয়ে বুঁদ হয়ে থাকতুম। যত না প্রেম, তার চেয়ে বেশি প্রেমের কথা ভাল লাগত,
সে ভোলে ভুলুক কোটি মন্বন্তরে
আমি ভুলিব না আমি কভু ভুলিব না।
সুধীন দত্ত পড়তে পড়তে ফিদা হয়ে যেতুম। রবীন্দ্রনাথের ‘অসম্ভব’ আবৃত্তি করতুম মনে-মনে,
দূর হতে শুনি বারুণী নদীর তরল রব
মন শুধু বলে অসম্ভব, এ অসম্ভব।
আর সেই যে…
বোলো তারে, বোলো,
এতদিনে তারে দেখা হল।
তখন বর্ষণশেষে।
ছুঁয়েছিল রৌদ্র এসে
উন্মীলিত গুল্মোরের থোলো।
সেই সব বৈদেহী কল্পনা, নীল কুয়াশার মতো আচ্ছন্নতা, রোম্যান্টিক বিরহবেদনা, ব্যক্তিনির্ভর নয় একেবারেই। এসব কি ঘটে না এখনকার তারুণ্যে? তারুণ্য তা হলে জানকারি পেল অনেক, কিন্তু হারাল এমন এক ভরাট ব্যঞ্জনাময় প্রতীক্ষা, যার হিসেব অঙ্কে হয় না।
দুটি তরুণ-তরুণী বসেছিল তাঁর সঙ্গে একই বেঞ্চে। তিনিই প্রথমে বসেছিলেন। ওরা এল পরে। সুতরাং তাঁর উঠে যাওয়ার প্রশ্ন নেই। কিন্তু তিনি কিছুক্ষণ পর সবিস্ময়ে শুনলেন, ছেলেটি মেয়েটিকে বলছে, ‘অফ কোর্স শোব। কিন্তু বিয়ে-টিয়ে করতে পারব না।’
এই ভাষা এবং এই বক্তব্য। একজন তৃতীয় ব্যক্তি ধারে-কাছে থাকলেও কিচ্ছু এসে যায় না। মিলনের যে রোমাঞ্চ বহু বহু যুগ ধরে মানুষ গড়ে তুলেছে, একটা কথায় তা ভূমিসাৎ হয়ে গেল। এরা সব জেনে গিয়েছে, মিলন এদের ভেতর কোনও প্রতীক্ষা, কোনও দায়, কোনও রেশ রাখে না। দে জাস্ট হ্যাভ ফান। আর কোনও আড়ালও রইল না। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো দেখা যাবে, মানুষ-মানুষী কুকুরের মতো রাস্তায়-ঘাটে সঙ্গম করছে। যে-কোনও পার্কময় অসংখ্য উলঙ্গ, সঙ্গমরত যুগল। কখনও কখনও তৃতীয় একজন এসে কামড়াকামড়ি করছে, এদের পাশ দিয়ে সিনিয়র সিটিজেন কুকুরের চেন হাতে ধরে কিংবা নাতি-নাতনির হাত ধরে বেড়াচ্ছেন। কারওই হয়তো কোনও বৈলক্ষ্যণ্যও নেই। না বৃদ্ধের, না শিশুর, না কুকুরের। তার মানে, সেই আদিমতায় প্রত্যাবর্তন। যখনকার অবস্থান থেকে মানুষ ধীরে ধীরে অন্তরাল, আচ্ছাদন এসব সৃষ্টির সূক্ষ্মতা অর্জন করেছিল। মানুষ আর পশুর পার্থক্য তৈরি হয়েছিল।
তিনি ভাবতে লাগলেন, সেই অদূর অ-সভ্য দুনিয়ায় ললিতকলা বলে কিছু থাকবে কী? ক্র্যাফ্ট হয়তো বেঁচে থাকবে, কিন্তু ফাইন আর্টস নয়। সূক্ষ্মবোধ ছাড়া সূক্ষ্মতার শিল্প কী করে থাকবে? যন্ত্র তৈরি হবে, আরও উন্নত যন্ত্র সব। কিন্তু শিল্প হবেও না, তার অভাবও কেউ বোধ করবে না। ভালবাসা থাকবে না, প্রত্যেকটা সম্পর্কই কেজো। ভালবাসা না থাকলে শিশুরা কী করবে? শিশুরা শুধু বেড়ে উঠবে, তাদের কাছেও সব কিছু খোলাখুলি থাকবে। তারা বুঝতে পারবে না। শিশুরা থাকবে, কিন্তু তারা শিশু থাকবে না। তা হলে তাদেরও একটা নতুন নামকরণ দরকার। কী নাম, কী নাম! আই সি? ইম্যাচিওর সিটিজেন?
ভাবতে-ভাবতে কেমন হাত-পা ভেতরে ঢুকে যেতে লাগল তাঁর। ‘স্মারং স্মারং স্বগৃহ চরিতং দারুভূতো মুরারি।’ তিনি জগন্নাথ হয়ে যাচ্ছেন। তাঁর মতো জগন্নাথ অনেকেই হচ্ছে, হবে। মনু দীক্ষিত তো বটেই। সংযুক্তা খুব প্র্যাকটিক্যাল, মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা খুব। তবু বোধহয় ও জগন্নাথ না হয়ে পারবে না। সারি সারি জগন্নাথ দেখতে-দেখতে তিনি বিন্দুবৎ হয়ে যাচ্ছিলেন, যদি না তাঁকে চৈতন্যে ফিরিয়ে আনত অন্য মানুষের উপস্থিতি। একলা একলা ভাবা খুব বিপজ্জনক তা হলে। অথচ একলা না হলে ভাবনাও আসে না। গভীর, ভরাট, বিস্তৃত হতে পারে না। না ভেবেই বা কী করে বাঁচবেন তিনি, ভাবনা ছাড়া বাঁচা যায়?