Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ট্রেকার্স || Bani Basu » Page 11

ট্রেকার্স || Bani Basu

গরম ক্রমে বাড়ছে। সইয়ে-সইয়ে বাড়ছে। গোড়ায় দুম করে হাওয়াটা পড়ে গেল। আকাশে সাদাটে মেঘের আস্তর। তবে কি আবার বৃষ্টি, জলো শীত না একটা চাপা ভাব আবহাওয়ায়! তারপর মেঘ সরে গেল। উজ্জ্বল রোদ। বাইরে তাপ, ভেতরে এখনও আরামদায়ক। তারপর বাইরে তাপ, ভেতরে গুমোট। এখনও রাধাচূড়ায় কাগজকুসুম, সন্ধে হলে ঝিরঝিরে হাওয়া, কালবৈশাখীর তোড়জোড়। হঠাৎ সব শুনশান। আকাশের লাল চোখ সাদা। মেঘ সরে যাচ্ছে, ঝড়ো হাওয়ার ঠিকানা নেই, আবারও বসন্ত।

ধ্রুবজ্যোতি হাফ-হাতা পাঞ্জাবি ধরেছেন। বেশি হাঁটতে পারছেন না। এক পাক ঘুরতেই জামা ভিজে চুপচুপে। গাছের ছায়ায় বসে জিরোচ্ছেন। হঠাৎ খেয়াল হল, স্নিকার্স, শর্টস এবং গোলগলা হাতকাটা এক ধরনের টি-শার্ট পরে যে ছেলেটি দৌড়চ্ছে, তাকে তিনি চেনেন। চিনতে তো অনেককেই পারেন। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু একে তিনি একটু বিশেষরকম চেনেন। কারণ এর নাম আরিয়ান। ছেলেটি ফরসা, বেশ সুগঠিত। ডান হাতে একটা চোখে পড়ার মতো উল্কি, নীল রঙের ড্র্যাগন। ছেলেটার চেহারায়ও একটা ড্র্যাগন-ড্র্যাগন ভাব আছে কি? একটা লিকলিকে অথচ পেশি-কঠিন, নমনীয় শরীর। কত লম্বা হবে। পাঁচ দশ, কি এগারো। খোলা জায়গায় দৈর্ঘ্য ঠিক আন্দাজ করা যায় না। মাথায় এখন খুব ঝাঁকড়া চুল, মুখটাও বেশ বড়সড়। ছেলেটিকে কি হ্যান্ডসাম বলা চলে? তা হয়তো চলে। কিন্তু আকর্ষক বলা যাবে না। সব থাকা সত্ত্বেও, এক মাথা চুল, ফরসা রং, সুন্দর বডি, পুরুষালি ভুরু, লম্বা নাক, সবই রয়েছে। কী যেন একটা নেই বা আছে, যার জন্য শুধু অনাকর্ষক নয়, একটু যেন বিতৃষ্ণাকর। ছেলেটি সেকেন্ড রাউন্ডে যখন কাছাকাছি এল, তিনি ভাল করে লক্ষ করে দেখলেন। ওর চিবুক ছোট, ঠোঁটদুটো একেবারে একটি সরলরেখা, চোখ দুটো আবার বড়-বড় যেন ফেটে বেরোতে চায়। তাঁর খুব আনপ্লেজেন্ট লাগছে। কে জানে এই সবের ভিতরেই হয়তো ‘টপ সেক্সিনেস’ লুকিয়ে আছে। তিনি দেখতে পাচ্ছেন না, রমণীরা দেখতে পায়। বিজ্ঞাপকরাও দেখতে পায়।

ওকে একটু তাতিয়ে দেবার জন্য তিনি মুখিয়ে উঠলেন। তৃতীয় রাউন্ডে ও দৌড়োচ্ছে আস্তে আস্তে, তাঁর কাছাকাছি এসে মন্থর হতে-হতে থমকে গেল একেবারে। হয়তো তার প্রবল ইচ্ছাশক্তির জোরেই তাঁর কাছাকাছি এসে বসল, একটু শিথিল হয়ে হাঁটুর উপর হাত লম্বা করে বসেছে।

“স্পোর্টসম্যান না কি?” তিনি সন্তর্পণে জিজ্ঞেস করেন।

“আই লাভ স্পোর্টস,” উত্তর এল।

“তোমার বডিটি তো বেশ, কোন স্ট্রিমে আছ?” অতি সন্তর্পণে তিনি জিজ্ঞেস করেন।

“মেডিক্যাল।”

“ইউ ক্যান বি অ্যান এগজাম্পল টু ইয়োর পেশেন্টস।”

“হু ওয়ান্টস পেশেন্টস? বো…রিং। বাবা মা’র জোরাজুরিতে। কিছু মনে করবেন না, আপনাদের জেনারেশন হেভি জুলুমবাজ।”

“শুনলে কেন?”

বুড়ো আঙুল দিয়ে তর্জনীতে টোকা দিয়ে আরিয়ান বলল, “এই জিনিসটা তো ওদেরই কাছে।”

“তুমি মডেলিং করে রোজগার করতে পারো কিন্তু।”

হঠাৎ আরিয়ান ঘুরে বসল, “ইউ থিঙ্ক সো, অ্যান্ড সে সো?”

“বলছি।”

“আপনার কাছ থেকে আশা করিনি। আপনি, ডোন্ট মাইন্ড, আমার মা-বাবার জেনারেশনের চেয়েও সিনিয়র।”

ধ্রুবজ্যোতি মৃদু হাসলেন। আরিয়ান একটু চেয়ে রইল। হাসিটার মানে যে সে অনুধাবন করতে পারছে না এবং তা না পেরে একটু বোকা বনেছে, এটা বুঝতে তাঁর অসুবিধে হল না।

সিনিয়র সিটিজেন বলে একটা কথা হয়েছে আজকাল, ষাটোর্ধ্বদের বোঝার। সোজাসুজি বুড়ো বা বৃদ্ধ না বলে সিনিয়র সিটিজেন। এখন ষাট বছরেও অনেকেই বুড়ো হন না। সিনিয়র সিটিজেন বলে দিলে আর কোনও গোল থাকে না। ৬১-ও সিনিয়র সিটিজেন, ৯১-ও তাই। কিন্তু আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে তাঁর মনে হল, জুনিয়র সিটিজেন বলে শব্দগুচ্ছটাও তৈরি হওয়া উচিত। অল্পবয়স, ছেলেমানুষ, যুবক, তরুণ এইভাবে ভাগাভাগি না করে গড়পড়তা জুনিয়র সিটিজেন। ১৫ থেকে শুরু করে ৩০ পর্যন্ত। ৩০ থেকে ৬০ পর্যন্ত এদের কী বলা হবে, এন এস এন জে? নিদার সিনিয়র নর জুনিয়র।

তিনি বললেন, “তোমার মনের কথাটা আন্দাজ করতে পেরেছি বলে অবাক হচ্ছ? সিনিয়র সিটিজেন হয়ে গেলে একটা উঁচু টিলায় উঠে দাঁড়ানোর মতো অনুভূতি হয়। বহুদূর পর্যন্ত সব কিছু, তাদের খুঁটিনাটি, তাদের পশ্চাৎপট নিয়ে দেখা যায়। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, তুমি সন্তুষ্ট নও। ভিতরে একটা বিটারনেস কাজ করছে, কেমন?”

“সর্ট অফ,” আরিয়ান পুরোপুরি ধরা দিতে চাইল না।

তিনি বললেন, “দেখো, তুমি মেডিক্যাল পড়ার চান্স পেয়েছ, মানে কিন্তু তুমি এলেমদার ছেলে। জয়েন্টটা তো পার করতে হয়েছে। তার উপর তোমার বাবা-মা উভয়েই ডাক্তার…”

“কী করে জানলেন?” ভারী আশ্চর্য হল জুনিয়র সিটিজেনটি।

আবার সেই রহস্যময় হাসিটা হাসলেন তিনি, “আন্দাজ করলাম, মিলে গেল।”

“আপনি নিশ্চয়ই অ্যাস্ট্রলজার। কপাল-টপাল দেখে অনেক কিছু বলে দিতে পারেন।” খুব ব্যগ্রভাবে বলল সে।

“দূর, সিম্পলি আন্দাজটা মিলে গিয়েছে। ডাক্তারি সংস্কারটা তাই তোমার রক্তেই থাকার কথা বুঝলে? আজ বুঝতে পারছ না কিন্তু ভবিষ্যতে খুব সফল ডাক্তার হওয়ার সম্ভাবনা তোমার রয়েছে।”

“কে চায় সফল ডাক্তার হতে? নো ফান ইন লাইফ। কতকগুলো নেগেটিভ জিনিস নিয়ে জীবন কাটানো?”

“বলছ কী, জীবন বাঁচানোটা নেগেটিভ? এর চেয়ে পজিটিভ আর কী হতে পারে মাই ফ্রেন্ড? এই যে ফান কথাটা ইউজ করলে, এটা তো এনিওয়ে এখন পুরোপুরিই করে নিচ্ছ। আড্ডা, ডিসকো, নাইট ক্লাব, ডেটিং সবই তো হচ্ছে। খুব শিগ্‌গিরিই এগুলো আর ভাল লাগবে না, তখন?”

“জীবনটাকে প্রচণ্ডভাবে উপভোগ করে নিতে চাই আমি, প্রচণ্ডভাবে। যতদিন পারি, এই সময় তো চিরকাল থাকবে না।”

“ও সেটা তুমি জেনে গিয়েছ? সময়টা চিরকাল থাকবে না। কী জানো আরিয়ান, ভগবান বা প্রকৃতি যা-ই বলো, মানুষের জীবনের স্টেজগুলো উলটে দিলে ভাল করতেন। ধর, প্রৌঢ় বয়সটা প্রথমে এল, লেখাপড়া ট্রেনিং সব চমৎকারভাবে হয়ে গেল, তারপর তোমার যাকে বলে এনজয়মেন্টের কাল।”

“হোয়াট ননসেন্স!”

“আহা আমি একটা হাইপথেটিক্যাল কথা বলছি। কিন্তু একই সঙ্গে ট্রেনিংয়ের সময় আর যৌবনচাঞ্চল্য দিয়ে ভদ্রলোক আমাদের খুব মুশকিল করে দিয়েছেন। দুটোর ব্যালান্স করা সোজা কথা নয়।” তিনি দুঃখে মাথা নাড়তে থাকলেন।

আরিয়ান বলল, “একবার বললেন মডেলিং করে টাকা উপার্জন করে তারপরে বলছেন ডাক্তারি করতে…”

“না, না, না, না। আমি কোনওটাই করতে বলিনি হে জেসি, স্যরি জুনিয়র সিটিজেন। তোমার সামনে এই দুটো পথ প্রবলভাবে খোলা আছে, সেটাই ডিসকাস করছিলাম।”

“আমিও প্রবলভাবে বলছি, আমি শো-ম্যান হতে চাই। আপনার যদি জ্যোতিষ-টোতিষ জানা থাকে কাইন্ডলি বলুন না, মডেলিংয়ে চান্স কেমন?”

“তুমি আজকালকার ছেলে, জ্যোতিষ বিশ্বাস করো?”

“বিশ্বাস না করার কী আছে? আমাদের বন্ধুরা কতগুলো আংটি তাবিজ পরে তা জানেন?”

“তোমার হাতটা দেখি একবার।”

সাগ্রহে হাত বাড়িয়ে দিল আরিয়ান। হাতের তেলোর উপর দিয়ে আঙুল বুলোতে লাগলেন ধ্রুবজ্যোতি। এর ব্রেনলাইন আর হার্টলাইন এক, খুব বিরল কেস। ভেতরে কোনও দ্বন্দ্ব নেই। হার্ট আর ব্রেন এক পথে এক মতে চলে। তিনি বিশেষ কিছুই জানেন না। তবু ভাব দেখাতে হল যেন অনেক জানেন। আয়ুরেখাটা শেষ পর্যন্ত পৌঁছোয়নি তবে একটা হেল্পলাইন রয়েছে। ভাগ্যরেখা মোটামুটি। সানলাইন বলে কিছু নেই।

“তুমি মডেলিং-এ চেষ্টা করেছ?” আস্তে আস্তে বললেন।

“নিজের অ্যালবাম করেছি, সিভি আপ টু ডেট রাখি। বন্ধু-বান্ধবের চেনাজানাতে দু’-একটা করেছি। কই আর তো ডাকে না?” গলায় সামান্য হতাশার সুর।

“তুমি একটা ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি আর সরু গোঁফ রাখো, তারপরে দেখো কী হয়। নাচ শেখো নাকি?”

“শিওর, না হলে শো-ম্যান হব কী করে?”

“দেখো, আমি কিন্তু হাত দেখে বলছি তোমার খুব যশস্বী হওয়ার ভাগ্য নয়। তা হলে শো-ম্যানটা হবে কী করে? অথচ দেখছি টাকাপয়সা, কর্মস্থান সব ভালই।”

“মানে বস্ টাকা রেখে যাবে আর আমি হসপিটালের আরএমও হয়ে ঘষটাব এই আর কী! আচ্ছা বাই,” জুনিয়র একটু লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল।

তিনি বললেন, “হাত সব নয়। হাত তৈরি করা যায় সংকল্প দিয়ে, সব রেখা পাল্টে যায়।”

“কনসোলেশন প্রাইজ?” বলে একবার হাসল আরিয়ান। তারপর বড়-বড় পা ফেলে চলে গেল।

লোকটা কিছু জানে। কিছু ঠিকঠাক বলল, কিছু চেপে গেল। চাপলটা কী? এনি ওয়ে, কপুরদের ফ্যামিলি অ্যাস্ট্রলজার আছে, তার কাছে যাওয়া যাবে একদিন। আংটি-ফাংটি যা বলবে পরে নেওয়া যাবে। সে বাড়ির দিকে চলল। হাঁটা পথ পাঁচ-মিনিটের। মেঘনাদ সাহার স্ট্যাচু পেরিয়ে চলে গেল। রাস্তা পেরিয়ে শরৎ বোস রোড, লম্বা লম্বা পায়ে হেঁটে পার হয়ে গেল। দেশপ্রিয় পার্কে তার বাড়ি। বাইরের ধাপগুলো একলাফে পেরিয়ে পকেট থেকে চাবি বার করে দরজা খুলল সে। সামনেই একটা আয়না। ওপরে ঢাকনা পরানো আলো। দরজা বন্ধ করে আয়নার সামনে দাঁড়াল সে। ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি আর সরু গোঁফ, মন্দ বলেনি লোকটা।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress