Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » টেলিপ্রিন্টার || Atin Bandyopadhyay

টেলিপ্রিন্টার || Atin Bandyopadhyay

সে প্রথমে একটা হাই তুলল। তারপর এক গ্লাস জল চাইল রাখহরির কাছে। এসে বসতে না বসতে তিনটি ফোন—একজন জানতে চেয়েছে রাজীব রাজনীতিতে সত্যি আসছে কি না। একজন কাটোয়ার ট্রেন দুর্ঘটনা—অন্যজন। বিয়েটা কেমন হবে। তিনটি প্রশ্নই একজন মানুষকে পাগল করে দেবার পক্ষে যথেষ্ট। সে, সে-জন্য পাগল হবার হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য তখনই জবাব দিয়েছিল—জানি না। খবরের কাগজে এমন জবাব দিলে চাকরি যাবার কথা। কিন্তু ফোন তো—কোনো সাক্ষ্য নেই। একজন আবার ত্যাঁদড় বেশ—নাম জানতে চায়। সে এড়িয়ে যাবার জন্য বলেছে আমি একজন সাব-এডিটর। তারপর ফোন ছেড়ে দিয়েছে।

এক গাদা বাসি কাটা খবর টেবিলে ডাঁই করা। আগে একটা মর্নিং শিফট ছিল। সকালে একজন এসে যা গাঁথার গেঁথে দিত, যা রাখার ওয়েট চাপা দিয়ে রেখে যেত। নুন শিফটে ডাকের কাগজ বের হয়। লোড শেডিং বলে একটার আগেই পাতা ছাড়ার নির্দেশ। সে ঘড়িতে দেখল সাড়ে দশটা। মর্নিং শিফট উঠে গেছে, লোকজন কম। কম লোজন দিয়ে গুছিয়ে কাজ করানোর জন্য, এর চেয়ে ভালো পন্থা ছিল না। সাড়ে দশটার মধ্যে সবাই চলে আসবে। সবাই বলতে আর একজন। চার জনের শিফট। একজনের অফ একজন দেশে গেছে। বলে গেছে আসতেও পারে নাও পারে। ক্রিডে রেপের খবর—আবার কোথায় রেপ! বাকিজন আসার আগে রেপের খবরটি দেখার তার ভারি উৎসাহ জন্মাল। বিহারে বালিকা ধর্ষণ। পুলিশ ফুসলিয়ে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করেছে। বালিকার বয়স সতেরো। সতেরো বছরের বালিকা কথাটার মধ্যেই সে কেমন ধর্ষণের ঘ্রাণ পেল। সতেরো বছর বয়েস মেয়েদের পক্ষে সবচেয়ে বড়ো সুসময়। সুঠাম শরীর এবং গ্রীবা সহ নারীর জ্যান্ত এক ছবি তখন দুলছিল চোখে। এই বয়েসটাও যে নারীর কামুক গন্ধে গলিত শবের মতো পচে থাকে, নিজের বাপকে দেখে সে টের পেত না। তার নিজের মেয়ের বয়স এগারো। ছেলের বয়স কুড়ি। সে ছেচল্লিশ বছরের। সে যখন বিয়ে করে, বউ-এর বয়স ছিল মোলো। যোলো আর চব্বিশ-বাবা বলেছিল, খুব মানানসই। এখন তার বিশ বছরের ছেলে বাইরে থাকে। মাননসই এই কথাটায় তার চোখের উপর একটি আখাম্বা ষাঁড় এবং পুষ্ট গাভীর অবয়ব ভেসে উঠতেই আবার ফোন’সুকেশ বলছ?

কিছু কিছু গলার স্বর তার ভারি চেনা। ফোন তুললেই বুঝতে পারে কার গলা। শাশুড়ি ঠাকুরুনের ফোন।–বাবলা বাড়ি এসেছে!

না তো!

আসেনি!

না তো। এই তো সেদিন গেল। এখন তো ছুটি নেই।

অঃ। তোমরা ভালো আছো?

হ্যাঁ মা, ভালো আছি।

নন্দিতা?

ভালো।

একদিন তোমরা এসো!

যাব। সুকেশ ভুলেই গেছিল, তিনি ভালো আছেন কি না জানা হয়নি। পৃথিবীর সবাই সে ভালো আছে কি না জানতে চাইবে—আর সে কারও ভালো থাকার কথা জানবে না সে হয় না। খুব গাঢ় গলায় বলল, মা, আপনি ভালো আছেন!

হ্যাঁ বাবা চলে যাচ্ছে।

সুকেশের কিছু খারাপ স্বভাব আছে, সে এটা বুঝতে পারে। নন্দিতার মাকে সে যে গাঢ় গলায় কথাটা বলল, সেটা পেরেই কতটা মেকি বুঝতে মনে অসহিষ্ণুতা কাজ করে। আসলে সে তখন নিজেকে যা খুশি তাই গাল দেয়। সে ফোন ছেড়ে দিয়ে বলল তুমি ভণ্ড না পায়। তারপর চিক করে সরু রগে কেমন একটা ঝিনঝিন শব্দ শুনতে পেল-কেমন আর্ত প্রশ্ন—বাবলা বাড়ি এসেছে? কেন বাবলার দিদিমার বাবলা সম্পর্কে এমন জরুরি প্রশ্ন! বাসি খবরের কাগজে যে কোথায় এক ছোট্ট চিরকুটের মতো সংবাদ—কার্জন পার্কে নিহত দুজন যুবকের একজনের লাশ এখনও শনাক্ত হয়নি। এখনও মানে-কতদিন! শনিবার পুলিশ কার্জন পার্কে গুলি চালিয়েছে। গেল শনিবার তো! সামনের রিপোর্টারটিকে বলল, গেল শনিবারে পুলিশ গুলি চালিয়েছিল কার্জন পার্কে? রিপোর্টারটি—এইমাত্র এসেছে, জরুরি খবর একটা লিখে দিয়ে আবার বের হয়ে যাবে, চিফ-সাহেবের পাখাঁটি ভালো ঘোরে। একটু ঠাণ্ডা হয়ে নেওয়ার জন্য বসেছিল। মুখের ঘাম মুছল রুমালে সে। বলল, নতুন কোনো খবর আছে?

না এমনি। কার্জন পার্কে পুলিশ কবে যেন গুলি চালিয়েছিল?

তা দিয়ে কী হবে?

সুকেশ বলতে পারল না, এইমাত্র বাবলার দিদিমা বাবলার খোঁজ করছিল। সে বাড়ি এসেছে কি না জানতে চেয়েছে, বাড়ি না ফিরলে, মানুষ ভাবতেই পারে, লাশ শনাক্ত করা দরকার। সে শুধু বলল, আপনার খেয়াল নেই।

ফাইল দেখুন না!

অত জরুরি নয়। দেখছি না মতো মুখ করে সে বলল, আমরা সবাই কত সহজে সব ভুলে যাই।

কী ভুলে যাই?

এই খবরগুলি, সবাই আমরা। এই সেদিন, পাঁচ-সাতদিনও হয়নি, কার্জন পার্কের সামনে দুটো যুবকের লাশ। কত রকমের অ্যাঙ্গেল থেকে ছবি! কাগজের প্রথম পাতায় ব্যানার। কলকাতা তপ্ত। যুবকের লাশ তদন্ত কমিশন কত কিছুর দাবি। গতকাল কার্জন পার্ক হয়ে এলাম। মনেই নেই এই সেদিন, রক্তের তাজা গন্ধ, নাক টানলে যার ঘ্রাণ টের পাওয়া যায়-তার বিন্দু বিসর্গ মনে উঁকি মারল না। এতটুকু বলার পরই সুকেশ থেমে গেল। আসলে আকাশবাণী থেকে ফেরার সময় এক সুন্দরী যুবতীর সৌন্দর্য উপভোগ করার তাগিদে কে সি দাস পর্যন্ত সে হেঁটে এসেছিল। মনের এই তপ্ত নিদাঘের আকর্ষণ বাবলার মা জানে না, পৃথিবীর কেউ জানে না। যুবকের লাশ একজন যদি…না না, সে হবে কী করে! যুবতীরা কত সহজে যুবকদের লাগাম টেনে রাখে। সে অন্যমনস্ক হতে চাইল।

সুকেশ বলল, এই রাখহরি।

আজ্ঞে যাই।

কাগজের ফাইলটা দে।

কোন কাগজের ফাইল।

সব, সব কটা।

নীচ থেকে প্রিন্টার উঠে এসে বলল, কপি পাঠান।

পাঠাচ্ছি। বলে দেরাজ থেকে কিছু উত্তরবঙ্গের কপি বের করল। একসেস থেকে পেয়ে গেল দুটো বিহার এবং ওড়িশার খবর। যাক! সে বলল, এতেই মনে হয় পাতা ভরে যাবে।

প্রিন্টার হেসে বলল, ভরে যাওয়া নিয়ে কথা।

সত্যি ভরে যাওয়া নিয়ে কথা। সামনে সেই আখাম্বা ষণ্ডটি দাঁড়িয়ে—পুষ্ট গাভির ছবি এই রকমের। প্রিন্টার চলে গেলে ফাইলগুলির একটা টানতেই খবরটা বের হয়ে এল। গত সোমবার। আজকে শনিবার। সত্যি কলকাতা কী গভীর কল্লোলিনী! সব ভাসিয়ে নেবার জন্য হাঁ করে আছে।

আসলে দুজন যুবকের মৃতদেহ কলকাতার বুকে পুলিশের গুলিতে এত তাড়তাড়ি হাপিজ হয়ে যেতে পারে সুকেশ ভাবতে পারল না। বাবলা কবে বাড়ি থেকে গেছে। রোববার, রোববারই-তো! সে ক্যালেন্ডারের পাতা দেখল মাথার কাছে, তারিখ, দেখল রোববার না সোমবার! মাথাটা যে কীঘিলু দিনকে দিন ভারি হয়ে যাচ্ছে। স্বচ্ছ আয়নার মতো নয়। রোববার না সোমবার বাবলা বাড়ি থেকে গেছে। ধুস যত স্নায়বিক দুর্বলতা! বাবলার দিদিমা কি সকালের কাগজে দেখেছে—পুলিশের খবর—লাশ এখনও শনাক্ত হয়নি! বাবলার দিদিমার কি তখন বাবলার কথা মনে পড়েছে। পুলিশ রিপোর্টে আছে ছিমছাম চেহারা, গায়ে ফুলশার্ট স্যাণ্ডো গেঞ্জি। পায়ে কী আছে! চপ্পল না সু! বাবলা সু পরতে অভ্যস্ত। মাথায় টোকা মেরে মনে করার চেষ্টা করল, স্যু না চপ্পল! বাবলা যাবার সময় সে আর নন্দিতা দরজায় দাঁড়িয়েছিল। যাবার সময় বাবলার সব দেখেছে—অথচ এখন কেমন সব কিছুতেই সংশয়। হাফশার্ট পরে বাবলা, ফুলশার্টও পরে। সেদিন কী পরে গেছে! রাখহরি ফাইলের পাহাড় রেখেছে সামনে। দুজন যুবকের ছবিই বের হয়েছিল কাগজে। একজন চিৎ হয়ে পড়ে আছে, অন্যজন কাত হয়ে। একটা কাগজের ছবি মাথার দিক থেকে ভোলা। সে উপুড় হয়ে দেখার চেষ্টা করল। দুজন যুবকের মধ্যে একজনের মুখ বেশ স্পষ্ট। সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল, না এই মুখ বাবলার নয়। আর একটা ছবিতে কোনো যুবকের মুখই স্পষ্ট নয়। সে একজনকে শনাক্ত করেছে—এটা বাবলা নয়। আর একজনকে শনাক্ত করতে না পারলে বুকের মধ্যে যে দাপাদাপি চলছে এটা কিছুতেই কমবে না। ট্রাংকল করে একবার বাবলার খোঁজ নিলে কেমন হয়, বাড়িতে শুনলে হাসাহাসি করতে পারে, তোমার বাড়াবাড়ি। কার্জন পার্কে বেআইনি মিছিল ঢুকেছিল সোমবার। বাবলা রোববারে বাড়ি থেকে গেছে, সকালের ট্রেনে গেছে, সোমবারে ল্যাব আছে। ল্যাব থাকলে বাবলা কিছুতেই ক্লাস কামাই করতে চায় না। গত তিনটে সেমিস্টারেই বাবলা খুব ভালো নম্বর পেয়েছে। সুকেশ বলে দিয়েছে শুধু ফার্স্টক্লাস ইনজিনিয়ার হলে দাম নেই, অনার্স মার্ক রাখতে না পারলে সঙ্গে সঙ্গে চাকরি পাওয়া কঠিন। বাবলার পক্ষে রোববারে গিয়ে সোমবারে কলকাতায় আসা অবিশ্বাস্য ঘটনা! বাবলা–রোববার গিয়ে সোমবারে কলকাতার লাশ হবার জন্য ফিরতেই পারে না। সে হুংকার দিয়ে ডাকল রাখহরি, কি করছিস? কপি নামা।

রাখহরি টেলিপ্রিন্টার থেকে কপি নামিয়ে কেটে বেশ কায়দা করে ভাঁজ করে রাখল। তিনটে দুর্ঘটনার খবর, ট্রাক উলটে, বাস দুর্ঘটনায়, জলে ডুবে। এর যে কোনো একটা একদিন তার নিজের জীবনেই ঘটে যেতে পারে। বিশ-বাইশ বছর ধরে সে যা কিছু করেছে সবটাই মনে হয় আহাম্মকের কাজ। এই যে ভুতুড়ে ভয়টা মাথার মধ্যে ঢুকে গেল, সেটা বাবলা স্বয়ং হাজির না হলে মিটবে না। চিঠি পেলে বুঝতে পারবে, বাবলার চিঠি। কিন্তু বাবলা যে রোববারে গিয়েই চিঠিটি লিখে রাখেনি কে বলবে। কলকাতায় বাবলার সহসা আসার কী কী কারণ থাকতে পারে? দু-বছর হল বাবলা বাড়ি ছাড়া। বাবলা তাকে না জানিয়ে কলকাতা ঘুরে গেছে মনে পড়ছে না। দু-বার অকারণে ঘুরে গেছিল—কিন্তু তখনও বাড়ি হয়ে গেছে। সে যদি অকারণে বন্ধুবান্ধবের পাল্লায় পড়ে চলে আসে এবং মিছিলের টানে কার্জন পার্কে চলে যায়।–এসব সুকেশ খুব দূরবর্তী ছবির মতো আন্দাজ করার চেষ্টা করল। আসলে মানুষের এত দুর্ভাবনার মূলে সে নিজে।

ঘচাঘচ কপির দুটো একটা রেখে গেঁথে দিল। হরিজন নিগ্রহের খবরটা থাক। পরে আরও খবর আসবে। লিড এলে সাজিয়ে রাখবে। বাইশ বছর আগে বাবলা বলে তার কেউ ছিল না। নন্দিতা ছিল না। লিজি ছিল না। বাইশ বছরে সে যে সংসারে একজন সবচেয়ে বড়ো ক্রীতদাস আজ এটা টের পেল। একটা আস্ত দুর্ভাবনা দুশ্চিন্তার ক্রীতদাস। তার জন্য তাকে আফ্রিকার জঙ্গলে ঢুকতে হয়নি। কেউ তাকে চেন বেঁধে নিয়ে যায়নি—নিজের চেন হাতে গলায় ঝুলিয়ে যোলো আনা সং সাজা গেছে।

আসলে এগুলো তার নিজের সঙ্গে নিজের তর্ক। দু-একটা কাগজ অফসেটে বের হয়। সেই কাগজগুলির ছবি স্পষ্ট দেখা যেতে পারে। অফসেটে ছাপা মুখ সে চিনতেও পারে। কপি সরিয়ে আবার কাগজে হামলে পড়ল। পায়ের দিক থেকে পেল। যুবকের লাশ দুটি ঘুণাক্ষরেও কি ভেবেছিল, খবরের কাগজ থেকে এত রকমের অ্যাঙ্গেলে ছবি নেওয়া যায়। দূরে পুলিশ ব্যাটন হাতে রাইফেল হাতে, মোচে তা দিচ্ছে। কে জানে কার ছেলে, শেষে হয়ত খবরে বের হবে যে বেটা গুলি চালিয়েছিল তারই সবে ধন নীলমণি। একবার কাছে গিয়ে সবারই দেখা দরকার— কার বাপের ছেলে এভাবে মরে পড়ে থাকল। এখনো পর্যন্ত শনাক্ত হল না, তাজ্জব ব্যাপার। বাপ না থাক, দাদা পিসি মাসি দিদিমা কত কেউ থাকতে পারে। একজন যুবক নাড়ি ফেরেনি, অথচ সংসারে সব ঠিকঠাক চলছে ভাবাই যায় না। তার হলে পাগল হয়ে যাবার কথা। থানা পুলিশ, হাসপাতাল ট্রাংকল খোঁজাখুঁজিতে সে তোলপাড় করে দিত সব। সুতরাং যুবকটি এখান থেকে বাড়ি ফিরবে বলে রওনা হয়েছিল, জ্যাম, মিছিল সব মিলে তাকে নিয়তির গ্রাসে ঠেলে দিয়েছে, এ-মুহূর্তে তার কি করা দরকার ভেবে পেল না। বাবলা বাড়ি ফিরেছে। টিটিভ পাখির মতো কেউ ডেকে যাচ্ছে অনবরত। কেমন অস্থির হয়ে পড়ছে ভিতরে ভিতরে। একবার বাবলার কঠিন অসুখ হয়েছিল, তখনো বড়ো অস্থির। বাবলার চিঠি পেতে দেরি হলে অস্থির। রাস্তাঘাটে যে-কোনো জায়গায় দুর্ঘটনা ও পেতে থাকে। বাবলা বাড়ি এলে পকেট সার্চ করে দেখা হয় সঙ্গে আইডেনটিটি কার্ড রেখেছে কি না, প্রায়ই রাখে না, তখন সুকেশের মাথা গরম হয়ে যায়, থম মেরে বসে থাকে কিছুক্ষণ। ছেলে বড়ো হয়েছে মারধোর করা যায় না। শাসনের প্রক্রিয়া নতুন নতুন উদ্ভাবনের দরকার হয়। ইদানীং শরীর ভালো যাচ্ছে না তার, বুকের বাঁ ধারটায় ব্যথা। ডাক্তারের পরামর্শ মতো চলছে। দুশ্চিন্তা দুর্ভাবনা করা বারণ। সেই কথাটাই তুলে শাসনের নতুন প্রক্রিয়া হিসাবে কাজে লাগায়, বাবলা তুই আমাকে আর বেশিদিন দেখছি বাঁচতে দিবি না। দুর্ভাবনায় যত জটিল রোগ জন্মায়, সব সময় উদ্বিগ্ন থাকলে মানুষ বাঁচে! বাবলার এককথা—তুমি অযথা দুর্ভাবনা করলে আমরা কী করব? চিঠি পেতে দু-পাঁচদিন দেরি হলে ছুটে যাবে। সময় মতো চিঠি কে পায়?

সত্যি সময় মতো চিঠি কেউ পায় না। পুলিশের গুলিতে মৃত যুবকেরাও ঠিকমতো চিঠি পায়নি। চিঠি পেলে আগেই সরে পড়ত। যথাসময়ে এই চিঠি পাওয়া নিয়েই মানুষের যত বিড়ম্বনা। সে দেখল এ-সময় এত দুর্ভাবনার মধ্যেও একা শিফট চালিয়ে দিয়েছে। তার এখন ওঠার সময়। বিকেলের শিফটের দু একজন এসে গেছেন! সে একজনকে বলল, দাদা কার্জন পার্কের লাশটাকে পুলিশ কোথায় রাখতে পারে?

বিষয়টা বোধগম্য হয়নি। কার লাশ?

যাকে শনাক্ত করা যায়নি।

মর্গ ছাড়া আর কোথায় রাখবে?

সেই ত মর্গ ছাড়া আর কোথায় রাখবে। বিপদে মানুষের বুদ্ধিভ্রংশ হয়, তার এ সময়ে বুদ্ধিভ্রংশ স্মৃতিভ্রংশ সবই হয়েছে। তা না হলে বাবলা কবে গেছে, রোববার সোমবার, নাকি শনিবার কিছুতেই মনে করতে পারছে না কেন। প্রেসিডেন্সি কলেজের পেছনটাতে একটা মর্গ আছে। তার মনে আছে কে একজন যেন চুপি চুপি পথটা পার হবার সময় বলেছিল, জানেন এখানটাতেই চারু মজুমদারকে রাখা হয়েছিল। সে প্রশ্ন করেছিল, এখানটাতে মানে? লোকটা তার জ্ঞানের বহর দেখে হেসে দিয়েছিল। রোজ রাস্তাটা পার হয়ে যান, জানেনই না এখানে একটা মর্গ আছে। মর্গ কেমন হয়। নীলরতন হাসপাতালে একটা মর্গ আছে। সব হাসপাতালেই বোধ হয় থাকে। পাড়ার জলে ডোবা এক যুবতীর লাশ খুঁজতে গিয়ে কী কী দেখেছিল বিস্তারিত একজন একবার তাকে বলেছিল। বড়ো বড়ো সব দেরাজ। টানলেই কিম্ভুতকিমাকার ফোলা ফাঁপা লাশ বিকৃত মুখে বের হয়ে আসে। বাবলারটাকে বের করবে! পাঁচ সাতদিনে সে তো আর বাবলা নেই। জামা প্যান্ট দেখে চেনা যায়। বাবলা ফিরেছে কি না খবরে এমন বুরবক হয়ে গেছে—এখন তাও মনে করতে পারছে না। বরং বাবলা নিখোঁজ হলে মর্গ খুঁজে দেখবে তার মামারা। তার পক্ষে খুঁজে দেখা সম্ভব হবে না। তার আগেই ভিরমি খাবে। এখন মনের মধ্যে তার ওই খোঁজা নিয়ে তোলপাড় হবার সময় দেখলে সে টু-বি বাস স্ট্যান্ডে এসে হাজির। তাকে রোজ টালিগঞ্জে ফিরতে হয়। এখান থেকে এক বাসে যাওয়া যায় না। যাবার সময় একবার কার্জন পার্কে নেমে গেলে হয়। লালবাজার ঘুরে গেলে হয়। বাড়িতে গিয়ে সে সারাটা সন্ধ্যা অস্বস্তিতে কাটাবে। বাবলা ফুলে ফেপে পড়ে আছে।–সে যে কী করে!

চিন্তা বিষয়টা এমন যে একবার মাথার মধ্যে ঢুকে শত সহস্র ফণা হয়ে ভেসে ওঠে। টেলিপ্রিন্টারের মতো সহস্র খবরের একটা কবরখানা হয়ে যায়—অজস্র প্রেতাত্মার ছড়াছড়ি। এই চিন্তার ভিতর সে দেখল কখনো মর্গে দাঁড়িয়ে আছে কখনো শ্মশানে। তবু শনাক্ত করতে পারছে না এই তার বাবলা। একটি আখাম্বা যণ্ড এবং পুষ্ট গাভির ফসল। বিশ বছর লালন-পালন করার পরও বাবলা তার সঙ্গে মশকরা করছে—বাবা আমাকে তুমি চিনতে পারছ না, আমার আইডেনটিফিকেশানে এত গণ্ডগোল! আত্মীয়স্বজনরাও বলবে এ-কেমন বাবারে— পুত্রের মুখ চিনতে এত বিলম্ব! সে বলল, কী করে জানব মাত্র পাঁচ-সাতদিনে বাবলা আমার ব্লাডারের মতো ফুলে ফেঁপে যাবে। বিশ বছর ধরে প্রোটিনযুক্ত খাবার খাইয়েও যা করতে পারিনি, পুলিশ লাশ বানিয়ে দিয়ে কত সহজে তা করে ফেলেছে।

মাথার মধ্যে অনবরত টেলিপ্রিন্টার—শ্মশান শোকমিছিল মর্গ মেলার ছবি। বাবলা মেলায় গিয়ে নাগরদোলায় চড়তে ভালোবাসত। বনবন করে ঘুরেছে। সে আর নন্দিতা বাবলাকে চেপে ধরে বসে আছে। বাবলা হাত নেড়ে সুখ পাচ্ছিল। বাবলার সমুদ্রতীরে একটা ছবি, সে তার বাবার দিকে ছুটে আসছে। অন্নপ্রাশনে বাবলার হিরের আংটি। বাবলার রুপোর ঝিনুক বাটি কিনতে একবার নন্দিতাকে নিয়ে বউবাজার গিয়েছিল। বাবলার পায়ে মল ঝমঝম করে বাজছে। টেলিপ্রিন্টারের খবর, অজ্ঞাত যুবকের লাশ—বাবলা নামক এক যুবক পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছিল—সে যে বাবলা, শনাক্তকরণ হয়েছে! বাবলার পিতার নাম সুকেশ। ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র। পরীক্ষার ফলাফল দিয়ে বায়োডাটা। শ্মশানেও বায়োডাটা লাগে। টেলিপ্রিন্টারেও লাগে। কাজ পেতে গেলেও লাগে।

এ সময় সুকেশের রাগটা গিয়ে পড়ল ববলার দিদিমার উপর। বাবলা ফিরেছে। একটি মাত্র ‘ফিরেছে’ শব্দে শনাক্তকরণের কাজ আরম্ভ হয়ে গেছে মাথায়। পাঁচ সাতদিনের মধ্যে সে একবারও ভাবেনি বাবলার ফিরে আসা দরকার। অন্তত শনাক্তকরণের জন্য দরকার। পুলিশের গুলিতে সে যে মারা যায়নি তার জন্যও ফিরে আসা দরকার। কাল না হয় ছুটি নিয়ে একবার ঘুরে আসবে। যেমন সে চিঠি ঠিক সময় না পেলে মাঝে মাঝেই চলে যায়। একবার রুনুর দোকানে গেলে হয়। ট্রাংকল করলে হয়। কে ধরবে? অফিস বন্ধ। হোস্টেল বাড়িগুলো দূরে দূরে। কোনো যোগাযোগের বন্দোবস্ত নেই। অন্তত এই নির্বোধ অবন্দোবস্তের জন্য এডিটোরিয়াল পাতায় একটি চিঠি লেখা দরকার। টু-বি বাসটা ভরে গেল। ছাড়ছে। পাশেই সুন্দরী মহিলা। দুশ্চিন্তার হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য মহিলার হাতে ক-টা কাচের চুড়ি আছে গুণতে থাকল। তারপর কানের দুলে কটা পাথর। সহজেই অন্যমনস্ক হওয়ার এগুলি তার নির্দিষ্ট উপায়। ও বাবা, এ দেখছি আবার ফুলে ফেঁপে যাচ্ছে। গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা। পেট চিরলে জরায়ুর কাছাকাছি জায়গায় জল পাওয়া যাবে। কত কাছাকাছি কত আলাদা। দুটোই ত্যাগের ক্ষেত্র। একটি সঙ্গে সঙ্গে সরে যায় অন্যটি আজীবন লেপটে থাকে। বড়ো হয়। ঝিনুক বাটি লাগে। দুঃখে হতাশায় হাহাক্কার হাসি এসে যাচ্ছিল। সে চট করে হাসিটাকে চেপে দিল—এর নাম তবে পাগল হয়ে যাওয়া। বিয়ের জন্য পাগল হয়ে যাওয়া, বাবলার চিঠি না পেলে পাগল হয়ে যাওয়া, ঝিনুক বাটি কেনার জন্য পাগল হয়ে যাওয়া, মস্তিস্কে কত সব মন্ত্র পোরা—টেলিপ্রিন্টারে কত আর খবর আসে! জীবন্ত টেলিপ্রিন্টার মাথার মধ্যে অনবরত খবর পাঠাচ্ছে। সুন্দরী মহিলার যোনির ভাঁজও খবরে ভেসে উঠল। সে চমকে গেল। দুশ্চিন্তার মূলে ওই জোনাকি পোকাটি।

সেদিন সুকেশ বাড়ি ফিরেছিল পর্যদস্ত মানুষ হয়ে। বাড়ি গিয়ে দেখল বাবলা খাবার টেবিলে মনোযোগ দিয়ে খাচ্ছে। নন্দিতা তাকে আর এক টুকরো মাছ দেবে কি না বলছে। সুকেশ কোনো রকমে ভিতরে ঢুকে বলল, তুই! কলেজ ছুটি!

ছুটি!

কীসের ছুটি, কেন ছুটি কিছু বলতে পারল না। কেবল বলল, সঙ্গে আইডেনটিটি কার্ডটা রাখিস তো? ওটা রাখিস। দিনকাল বড়ো খারাপ।

সুকেশ তারপর লম্বা হয়ে গেল বিছানায়। তার ঘুম পাচ্ছে বড়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *