টুকুনের অসুখ – আট
ডাক্তারবাবু ভিতরে ঢুকে বললেন, তুমি আজ বাড়ি যাবে টুকুন।
—সত্যি!
—সত্যি।
টুকুন বলল, আমি সত্যি বাড়ি যাব। ওর চারপাশে যা কিছু আছে—এই ভেবে একবার দেখল সব। তেমনি জানালা খোলা। মা—বাবা আসবেন। কখন আসবেন এই ভেবে টুকুন অধীর হয়ে উঠল। নার্সিং হোমের এদিকটায় একটা সবুজ মাঠ। এবং জানলা খুললেই চোখে পড়ে হাজার মানুষের মিছিল—এই কলকাতা শহর এত মানুষ কেন? কোথায় যায়—কী করে এরা, টুকুন ভেবে পায় না। কিন্তু টুকুন যেজন্য জানলায় বসে আছে এবং খোলা রেখেছে, নার্স এলে বলেছে, সুবল এসেছিল সিস্টার? সুবল কি আমার ঘুমের ভিতর ঘুরে গেছে?
সিস্টার বলল না।
—সে কেন এল না। আমি বাড়ি চলে যাব—সে না এলে কী করে আমি বাড়ি যাব?
সিস্টার বলল, তোমার মা—বাবা এসে নিয়ে যাবে।
—মা—বাবা তো সব সময়ই আসছে, ওরা আমাকে যখন খুশি নিয়ে যেতে পারে, কিন্তু সুবলকে যে আমার বলা হয়নি, আজ আমি চলে যাব। সে এখানে এলে আমার ঠিকানা পাবে কী করে?
—আমি দেব। তোমার বাড়ির ঠিকানায় চলে যাবে। তোমাদের কত বড় বাড়ি, চিনতে ওর অসুবিধা হবে না।
—সে তো বলেছে, টুকুনদিদিমণি, আমি কলকাতার পথ—ঘাট চিনি না। তুমি যখন বাড়ি যাবে আমাকে সঙ্গে নিয়ে নিয়ো।
—সে ঠিক চলে যাবে।
—কিন্তু মা কী ওকে নিতে চাইবে?
—নেবে না কেন? এত বড় একটা অসুখ তোমার সে সারিয়ে দিল। আমরা সবাই যা করতে পারিনি, কোথাকার এক পাখিয়ালা এসে সব করে দিল, ভাবা যায় না।
—কোথাকার বলতে নেই সিস্টার। সুবল খুব ভালো ছেলে। সে আমাকে চন্দনের বীচি, কুঁচফল দিয়েছিল।
—খুব ভালো। ঐ যা একটা পাখি রেখেছে বাঁশের চোঙে আর লম্বা আলখাল্লার মতো পোশাক। মনে হয় আমরা তিন চারজন ওর ভিতর ঢুকে যাব।
—সিস্টার আমি একটু জানালার দাঁড়িয়ে থাকতে চাই এখন।
—আমি ধরছি।
—না আমি নিজে হেঁটে যাব। সুবল যে কখন আসবে।
সুবল এলেই যেন টুকুনের সব হয়ে যায়। সে কখনও জানালা পর্যন্ত হেঁটে যেতে পারে না। সে ক’দিন আগে মাত্র উঠে বসতে পেরেছে। গতকাল তাকে ধরে ধরে হাঁটা শেখানো হচ্ছিল। বারবার হাঁটতে গিয়ে টুকুন পড়ে যাচ্ছিল। পারছিল না। নার্স এবং আয়া মিলে দু’পা হাঁটতে সাহায্য করেছে। একে ঠিক হাঁটা বলে না, কিছুটা সান্ত্বনা দেবার মতো ব্যাপারটা ছিল—তুমি হাঁটতে পার টুকুন, আর কী, এবারে তোমাকে আমরা অনেক দূরে নিয়ে যাব। কোনও বড় পাহাড়ে। সেখানে পাইন গাছ থাকবে, শীত থাকবে, বরফের পাহাড় জমবে। তুমি ফারের কোট গায়ে দিয়ে লম্বা সরু দুটো লাঠি হাতে নিয়ে দু’পায়ে স্কেটিং করবে। এ—পাহাড় থেকে সে—পাহাড়। এ—উপত্যকা থেকে সেই অন্য উপত্যকায়—অনেকটা পাখিয়ালা সুবলের মতো ভাষা, সুবল যে জানালায় এসে বলত, টুকুন দিদিমণি, দ্যাখো কেমন পাখি উড়ে যায়, দ্যাখো কেমন ঘোড়া ছোটে, দ্যাখো কেমন নিরিবিলি আকাশে মেঘেরা উড়ে বেড়ায়—তুমি টুকুনদিদিমণি, রাজার মেয়ের মতো ঘোড়ায় চড়ে স্ফটিক জলের নীচে রুপোর কৌটা খুঁজতে যাবে না? আমি তোমায় নিয়ে যাব। তখন টুকুন কেমন ছেলেমানুষের মতো বড় বড় চোখে তাকায়। হাতের ইশারাতে সুবল যা কিছু দেখায়—টুকুনের মনে হয় সব সত্যি। সে সব পারে। সে রাজার মেয়ের মতো রাজ্যের সব দুঃখী রাজপুত্রদের স্বয়ংবর সভা ডাকতে পারে সেই সুবল কেন যে এখনও এল না!
টুকুন বলল, কী সুন্দর দিন!
সিস্টার বলল, ভারী সুন্দর।
—সুবল আমাদের ট্রেনে উঠে এলে পুলিশ এসেছিল সিস্টার।
—পুলিশ।
—হ্যাঁ পুলিশ। ওরা তো জল খাবে বলে মাঝ—রাস্তায় ট্রেন আটকে দিয়েছিল।
—ও মা, কী বলে টুকুন।
—হ্যাঁ সত্যি সিস্টার। ওদের দেশে খুব খরা। জল নেই। লঙ্গরখানা বন্ধ। জলের অভাবে চাষবাস হয় না। গাছপালা পুড়ে গেছে। সারা মাঠ খাঁ খাঁ করছে।
—সত্যি?
—সত্যি সিস্টার। আমাদের ট্রেনটা থামিয়ে দিলে বাবা তো ভয়ে কাঠ। ওদের কী চেহারা! সুবলকে এখন দেখে চেনাই যায় না। ওর শরীরে মাংস ছিল না। লিকলিকে। কাঠির মতো হাত—পা। অথচ কী সুন্দর হাসিমুখ সুবলের, কী সুন্দর সরল চোখ!
সিস্টার বলল, গ্রামের মানুষদের এমনই মুখ চোখ হয় টুকুন।
টুকুন বলল, না দিদিমণি, হয় না। আমাদের কামরায় কেবল তো সুবল ওঠেনি, আরও অনেকে। ওদের দেখলে সিস্টার আপনিও ভয় পেতেন। আমি তো ভয়ে চোখ বুজে ফেলেছিলাম, কিন্তু সুবল এসে শিয়রের কাছে দাঁড়াতেই আমার মনে হয়েছিল সিস্টার, একজন বালক সন্ন্যাসী এসে দাঁড়িয়েছে।
সিস্টার না বলে যেন পারল না, টুকুন তুমি খুব সুন্দর সুন্দর কথা বলতে পারছ দেখছি।
—সিস্টার আমি জানি না, কী করে এমন সুন্দর কথা বলতে শিখে গেছি। আগে মা বলত, আমি একটাও কথা বলতাম না। সব তাতেই আমি বিরক্ত হতাম। শুধু চুপচাপ শুয়ে থাকা ছিল আমার কাজ। আমি এখন কেমন উঠে বসতে পারি, হাঁটতে পারি।
সিস্টার জানেন—টুকুন ঠিক হাঁটতে জানে না। টুকুনের বয়স কত—এই বারো—চোদ্দো হবে, টুকুনের অসুখ কবে থেকে, সেই কবে থেকে যেন, সাল—তারিখ সবাই ভুলে গেছে—এত লম্বা অসুখ মানুষের কী করে হয়—কী যে লম্বা অসুখ, ঠিক ঘোড়দৌড়ের মাঠের মতো, রেসের মাঠে যেমন একটা ঘোড়া অনন্তকাল ছুটেও শেষ করতে পারে না, তেমনি মনে হয় টুকুন এক অনন্তকালের ঘরে অসুখের দরজায় বারবার দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। এমন অনেকবার হয়েছে। সে বেশ ভালো হয়ে গেছে। হেসে খেলে বেড়িয়েছে—আবার কী করে যে একটা অসুখের ভিতর পড়ে যায়—সে জানে না কী করে সে রুগণ হয়ে যায়, ফ্যাকাশে হয়ে যায়, চোখের নীচটা ফুলে যায়। তখন শরীরের যাবতীয় কিছুতে কড়া পাহারা এবং এই করে কতকাল থেকে মা—বাবা বেশ একটা প্রতিযোগিতার ভিতর পড়ে গেল টুকুনের। প্রতিযোগিতা ঈশ্বরের সঙ্গে মানুষের।
টুকুন বলল, এখনও সুবল আসছে না।
—এসে যাবে।
—আমি জানলায় যাচ্ছি। বলে টুকুন নিজেই উঠে বসার চেষ্টা বলল। ওর হাত—পা লম্বা। গায়ে মাংস সামান্য লাগায় মুখটা বেশ ভরা দেখাচ্ছে। সব কিছুর ভিতর আছে কেবল ওর দুটো সুন্দর চোখ। মনে হয় আশ্চর্য নীল চোখ। চোখের মণিতে এখনও ছায়া দেখা যায়। কেউ এসে পাশে দাঁড়ালেই ছায়াটা নড়ে ওঠে। সিস্টার টুকুনকে পাশে দাঁড়িয়ে সাহায্য করতে চাইলে হাতটা ঠেলে দিল।—না সিস্টার, আপনি দেখুন আমি ঠিক ঠিক উঠে যাচ্ছি। আমার এতটুকু কষ্ট হচ্ছে না। বলে সে অনায়াসে উঠে বসে, বলল, কেমন ঠিক আমি উঠতে পেরেছি।
টুকুনকে আজ সকালেই হলুদ রংয়ের একটা ফ্রক পরানো হয়েছে। নরম সিল্কের। রংটা ভারী উজ্জ্বল। লতাপাতা আঁকা ফ্রক। কোথাও দুটো প্রজাপতি মুখোমুখি বসে—এবং নানা রংয়ের ছবি ফ্রকে। ওর সেই খেলনাগুলোর মতো। এই বয়সেও টুকুন খেলার জগতে থাকতে ভালোবাসে। এই খেলনার জগতে সে কখনও রানি হতে ভালোবাসে, অথবা রাজকন্যা। ওর কুদুমাসি বেড়ালটা ভারী বজ্জাত। যখন টুকুন এমন ভাবে, তখন বেড়ালটার গোঁফ নড়ে ওঠে। টুকুনের তখন ইচ্ছে হয় আছাড় মেরে ভেঙে ফেলতে। সে পারে না। কারণ সে উঠতে পারে না, হাঁটতে পারে না। ক’দিন কোনও হুঁশ ছিল না। সুবল এসে খুঁজে পেতে ঠিক জানলায় আবিষ্কার করে ফেলে, আবার ওকে উৎসাহ দিল। বাঁচার উৎসাহ। কী এক জাদুকরের মতো সুবল হাত—পা নেড়ে কেবল নেচে নেচে গ্রাম্য সংগীত সুর করে বলে যেত।
এখনও সুবল আসছে না। সিস্টার অবাক—আজ এমন প্রতীক্ষা একজন মানুষের জন্য টুকুনের, যে এলেই বলবে তুমি যাবে আমাদের বাড়িতে। এই আমাদের ঠিকানা। দেখবে খুব বড় বাড়ি। সামনে বড় জলাশয়। চারপাশে অনেক দিনের পুরনো পাঁচিল। ভিতরে অজস্র গাছপালা। এবং জলাশয়ের পাশে সুন্দর এক অট্টালিকা। অট্টালিকার ছায়া যখন সেই জলাশয়ে ভাসতে থাকে তখন মনে হবে সুন্দর এক রাজকন্যার সন্ধানে কোনও রাজপ্রাসাদে ঢুকে গেছ।
সিস্টার অবাক, ভারী সুন্দর পা ফেলে ঠিক ওর মনে আছে, সে এমন পা ফেলে হেঁটে গেছে—সেই কবে, এখন ভারী স্বপ্নের মতো মনে হয়—সে একজন মানুষের উদ্দেশ্যে এমন পা ফেলে হেঁটে গেছে, বাড়িতে কীসব আলো জ্বালানো হয়েছিল সেদিন, সকাল থেকে শানাই বেজে চলেছে, সে সকাল থেকে হলুদ রংয়ের শাড়ি পরেছিল, এবং পায়ে পায়ে হাঁটা, প্রতীক্ষা, আশ্চর্য প্রতীক্ষা থাকে মানুষের। সে কখনও জানে না কীভাবে সেইসব প্রতীক্ষার দিনগুলি মরে যায়। এখন টুকুন জানলায় যেভাবে হেঁটে যাচ্ছে, ধীরে ধীরে গুণে গুণে পা ফেলে, কেউ যেন দুপাশ থেকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে, যেমন তাকে কেউ ধরে নিয়ে যাচ্ছিল, পীড়িতে বসিয়ে দেবার জন্য, লাল বেনারসি, চুমকি—বসানো ওড়না, মুখে কপালে ঘাম, পা গুণে গুণে হাঁটা, টুকুন ঠিক সেইভাবে জানলায় হেঁটে যাচ্ছে।
টুকুন বলল, সিস্টার আপনি বলেছিলেন আমি হাঁটতে পারি না।
—আমি দেখেছি টুকুন। তুমি ঠিক হাঁটতে পারো।
—আজ মা—বাবাকে বলবেন কিন্তু আমি জানালা পর্যন্ত হেঁটে গেছি।
—বলব।
—কী সুন্দর লাগে।
—আমি তোমাকে ধরে থাকব।
টুকুন জানলার গরাদে হাত রেখে বেশ শক্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে। ওর কষ্ট হচ্ছিল—কষ্ট হোক, পায়ে এভাবে রক্ত সঞ্চালন হচ্ছে, মেয়েটা একদিন ঠিক অশ্বের মতো হয়তো দৌড়ে যাবে। কত জায়গায় না গেছে। এই অসুখ নিরাময়ের জন্য মিঃ মজুমদার হিল্লি—দিল্লি কম করেননি। অথচ মেয়েটা সেই যে কী হয়ে থাকল, চোখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল, আর ভালো হতে চাইল না। তারপর সেই খরার দেশের ওপর দিয়ে ট্রেন এসে গেলে, ট্রেন আটকে দিল মানুষেরা। ট্রেনের জল লুটে—পুটে খেয়ে নিল। খেয়ে নিয়ে কেউ নেমে গেল না। ওরা শহরে—গঞ্জে চলে যাবে বলে ট্রেনে বসে থাকল। তারপর অন্য স্টেশনে, পুলিশ। কড়া পাহারায় সব মানুষগুলোকে ধরে নিয়ে যাওয়া হল। টুকুন শুয়ে শুয়ে আশ্চর্য এক মানুষের গল্প করার সময় এমন বলেছে।
—জানেন সিস্টার, সুবলের একটা বাঁশের চোঙ ছিল। কত যে রাজ্যের কীটপতঙ্গ ওর পকেটে।
—ওসব দিয়ে ও কী করত?
—ওর পাখির জন্য ধরে এনেছিল।
—পাখিটার কী নাম?
—কী যে নাম জানি না।
—ট্রেনে উঠে তোমাদের কামরায় সরাসরি?
—আমি দেখলাম, ওরা এসেই বাথরুমে চলে গেল। জলের কল খুলে দিল। অঞ্জলি পেতে কেবল জল খেতে থাকল।
—তারপর?
—তারপর অবাক আমরা, কী করে সুবলের কোল থেকে সব পোকামাকড় উড়ে গেল। এবং সারাটা কামরা ভরে গেল।
—ও মা, তাই বুঝি?
—বাবা ভীষণ বিরক্ত। কিন্তু যতসব ক্ষুধার্ত লোক একটু জলের জন্য যখন এমন করতে পারে তখন ভয়ে বাবা কিছু বললেন না। পোকাগুলো সারাটা কামরায় ছড়িয়ে পড়েছে। আমরা বসতে পারছি না। আমাদের মুখ—চোখ ঢেকে গেছে।
—সত্যি!
—সত্যি সিস্টার! কিন্তু সুবল নিমেষে সব সাফ করে দিল।
—কী করে?
—কিছু না। সে তার বাঁশের চোঙ থেকে বলল, যা পাখি উড়ে যা! পাখি উড়ে গেল। উড়তে থাকল। সব এক দুই করে খেতে থাকল। বড় বড় পোকামাকড় সব ধরে এনে সুবলের চোঙের ভিতর পুরে দিতে থাকল পাখিটা।
তারপর টুকুন অনেকক্ষণ কোনও কথা বলল না। সে চুপচাপ, চারপাশের মাঠ, রাস্তা, ট্রামগাড়ি, বাসগাড়ি দেখছিল। বেশ চলছে কলকাতা শহর। চলে যাচ্ছে, কেবল চলে যাচ্ছে। কেবল স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দালান কোঠাগুলি আর লাইটপোস্ট, ইলেকট্রিক তার এবং নিরবধি কালের এই আকাশ।
এমন দেখতে দেখতে সে তন্ময় হয়ে যায়। তখন মনেই হয় না, এই শহরের কোথাও সুবল বলে একজন বালকের নিবাস রয়েছে। যে এসেছিল তাদের সঙ্গে, যাকে মা ব্যান্ডেলে নামিয়ে দিল। যার কেউ নেই। মা নেই, বাবা নেই। সংসারে সুবল একা এক মানুষ। অথচ আশ্চর্য, তার কোনও ভয় নেই। মা—বাবা না থাকলে সংসারে কী যে ভয়। টুকুনের ভয়ে চোখ বুজে এল।
সে চোখ বুজেই বলল, জানেন সিস্টার, সুবলের কেউ নেই। মা নেই, বাবা নেই, কেউ না থাকলে কী কষ্ট না।
—খুব কষ্ট। এবার এসো তোমাকে শুইয়ে দিচ্ছি। এতক্ষণ একভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে নেই।
—আমার কিন্তু কোনও কষ্ট হচ্ছে না।
—তা না হোক। তবু তোমার এখন শুয়ে থাকা উচিত।
সিস্টার জানে বেশি সময় দাঁড়িয়ে থাকার ক্ষমতা ওর নেই। এবং যদি দাঁড়াতে গিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে যায় তবে কেলেঙ্কারি। সে বলল, আমি জানলায় আছি, সুবলকে আসতে দেখলেই বলব সুবল আসছে।
—আপনি ঠিক চিনতে পারবেন না।
—আমি এত দেখলাম, কেন চিনতে পারব না!
—না। আমার মনে হয় আপনি ভুলে গেছেন। সে থাকে জানালার বাইরে। আপনি ভিতরে। আপনি তাকে কতটুকু দেখেছেন!
তা ঠিক। সিস্টার খুব একটা বেশি দ্যাখেনি। ছেলেটা এলেই কেমন বিরক্তিকর ঘটনা। সিস্টার দূরে অন্য কাজে মন দিত। কী যে এত কথা এমন একটা সুন্দর বড় ঘরের মেয়ের সঙ্গে—কোথাকার হাভাতে একটা ছোঁড়া, সে এলেই কেমন টুকুন হাতে পায়ে বল পায়। ডাক্তারবাবু বলে গেছেন, সে এলে তাকে যেন টুকুনের সঙ্গে কথা বলতে অ্যালাউ করা হয়—সুতরাং সিস্টার আর কী করে এবং এখন মনে হল, সুবলকে সে খুব একটা ভালো লক্ষ্য করেনি।
টুকুন এবার ধীরে ধীরে বলল, জানেন সিস্টার কেউ একা, এমন ভাবতে আমার কেন জানি ভারী কষ্ট হয়। আমার তখন কিছু ভালো লাগে না।
টুকুন একা—এটা ভাবতে ওর আরও কষ্ট। কখনো কেউ একা থাকলে—কেউ না থাকলে—টুকুনের মনে হয় সে যদি এমন একা হয়ে যায়। কেউ নেই। বাবা নেই, মা নেই। ওর দেখাশোনার মেয়ে শেফালি নেই—কী যে হবে তখন—ওর কী যে কষ্ট, ঠিক সুবলের মতো সে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াবে। কেউ কিন্তু জিজ্ঞাসা করবে না। একটা গাছের নীচে বসে থাকলে তার ভেউ ভেউ করে শুধু কান্না পাবে।
এ—জন্যেই ওর ভিতর সুবলের জন্য কেমন মায়া পড়ে গেছে। সে জানে ওর যা বয়েস—এ বয়সে অনেক কিছু হবার কথা। অথচ কী আশ্চর্য, তার শরীরে কোথাও সে সব লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে না। মা—বাবার কথাবার্তা অথবা ডাক্তারের কথাবার্তা থেকে সে ধরতে পারে—জননী হতে গেলে যা যা লাগে এই বয়সে তার কিছুই তার ভিতর স্পষ্ট হয়ে উঠছে না। সে কেমন দুঃখী গলায় এবার বলল, সিস্টার আমাকে ধরুন। আমি পায়ে হেঁটে আর যেতে পারছি না।
মেয়ের এমনই রোগ। হতাশা বুকে। এখন মনে হয় মেয়ের বয়স ষোলোর মতো। ফ্রক কী খালি গায়ে রাখলেও কোনও ক্ষতি নেই। সে যেন ইচ্ছা করলে একটা সিল্কের গেঞ্জি পরে থাকতে পারে। পুরুষমানুষের মতো হেঁটে বেড়াতে পারে। এবং এ—ভাবেই মেয়ের অসুখ বেড়ে গেল। এখন মনে হয় বয়স আরও বেশি টুকুনের, হিসাব করলে ষোলো—সতেরো। ফ্রক গায়ে কচি বালিকা সেজে বসে আছে—এবং ইহজীবনে বুঝি টুকুন আর এ—বয়স পার হবে না। অথচ আশ্চর্য সুন্দর মুখ টুকুনের। মেয়েদের এমন সুন্দর মুখ হয়! আহা আশ্চর্য চোখের তারায় কী যে মায়া। সে সুবলের জন্য এখন বিছানায় শুয়ে কেমন প্রার্থনা করছে। ঈশ্বর, যাদের কেউ নেই, তুমি তাদের আছো। তুমি তাদের দ্যাখো।
সে শুয়ে আছে। পা দুটো সোজা। একটা সাদা চাদরে ঢাকা। এবং ফের মোমের মতো মুখ হয়ে গেছে। চোখ প্রায় স্থির। কেমন কষ্টদায়ক মুখের ছবি। তাকে কফিনের ভিতর রাজকন্যার মমির মতো লাগছে এবং এ—ভাবেই সিস্টার দেখে অভ্যস্ত। এই যে একটু সময় জানালায় গিয়ে দাঁড়াল সেটাই বড় বিস্ময়ের ব্যাপার। টুকুনকে যারা দেখেছে, তাদের কাছে টুকুনের এমন ভঙ্গিতে শুয়ে থাকার ব্যাপারটাই বরং স্বাভাবিক, টুকুন যে জানালায় হেঁটে গিয়ে সেই সুবল নামক বালকের জন্য প্রতীক্ষা করছিল কে বলবে।
টুকুন বলল, জল খাব সিস্টার।
সিস্টার জল দিলে বলল, সে এলে আমায় কিন্তু ডেকে দিয়ো। আমার এখন খুব ঘুম পাচ্ছে।