টুকুনের অসুখ – সাত
জনার্দন বুঝতে পারল, আর রক্ষা নেই। মাটি মরুভূমি হয়ে যাচ্ছে। মরুভূমির মতো উত্তাপে গাছপালা সব নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। কোথাও সামান্য রস সঞ্চিত নেই। এখন এই পাহাড় ঘেরা অঞ্চলে শুধু মৃত্যুর জন্য প্রতীক্ষা করে বসে থাকা। জনার্দন মন্দিরের ভিতর পায়চারি করছিল। হাত—পা শীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। চোখে আর প্রায় দৃষ্টি ছিল না। সে এখন আর পাহাড়ের ওপর উঠে পাথর নিক্ষেপ করতে পারছে না। সমস্ত উদ্যম নিঃশেষ হয়ে গেল।
দাবানলের মতো জ্বলে সূর্য অস্ত চলে গেল। জনার্দন অভ্যাসমতো বের হয়ে পড়ল। চোখের দৃষ্টি কমে আসছে বলে সে ধীরে ধীরে পরিচিত পথ ধরে পাহাড় থেকে নেমে সমতল পথ ধরে হাঁটতে থাকল। আজ প্রায় চারদিন হল জনার্দন শুধু জল খেয়ে আছে। জনার্দন আজও শেষবারের মতো বের হয়ে পড়ল। যদি কোনও আহার্য বস্তু সংগ্রহ করতে না পারে, যদি পাহাড়ময় এবং মাঠময় কোনও মৃত জীবজন্তু অথবা ঘাসপাতা সংগ্রহ করতে না পারে তবে মনে হচ্ছিল মৃত্যু অবধারিত। এই মৃত্যু ওকে গ্রাস করবে ক্রমশ। এখন আর পায়ে শক্তি নেই যে সে দূরের কোনও শহরে অথবা গঞ্জে চলে যাবে। ষাট সত্তর মাইল হেঁটে যাবার শক্তিটুকু জনার্দনের শেষ হয়ে গেছে। সে হাঁটছিল এবং মাঝে মাঝে আবেগে মা মা বলে ডেকে উঠছিল।
জনার্দনের হাঁটতে হাঁটতে মনে হল সংসারে একরকমের তেষ্টা আছে যা কোনওকালে নিবারণ হয় না। একরকমের অভাব আছে যা কখনও দূর হয় না। আর একরকমের অহঙ্কার আছে যা কোনওকালে শেষ হয় না। জনার্দনের সেই অহঙ্কার। শস্যশ্যামলা এই দেশে প্রথম পিতৃপুরুষেরা আসেনি। পাহাড়ি অঞ্চল ছিল। সেখানে লোকালয় বিশেষ ছিল ন। নির্জন এক পাহাড় ঘেরা প্রান্তরে সামান্য ক’ঘর আদিবাসীর ভিতর তার কোনও পিতৃপুরুষ এসেছিল সুবচনি দেবীর ভার কাঁধে নিয়ে। সে এসেছিল বলে, দেবীর প্রতিষ্ঠা করেছিল বলে, এবং দিনমান এই মাঠের ভিতর উপুড় হয়ে পড়ে থেকে সব ঘাসবিচালি তুলে নিয়েছিল বলে বর্ষার শেষে কী ফসল, কী ফসল। এত ফসল হয় মাটিতে মানুষের জানা ছিল না। পাহাড়তলি অঞ্চল থেকে মানুষজন ফসলের লোভে চলে এসেছিল—আর যায়নি। তার পূর্বপুরুষ এক বন্ধ্যা মাটিকে উর্বরা ভূমি করে সংসারে প্রায় পির সেজে গেল। তারপর থেকেই বংশের ভিতর এক নিদারুণ অহঙ্কার। উৎসবে, পালাপার্বণে মানুষের সুখে দুঃখে সব সময় এই দেবীর সেবাইত প্রায় ঈশ্বরের সমতুল্য। জনার্দন হাঁটতে হাঁটতে ফের আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, মা মা—মা সুবচনি তুই নিষ্ঠুর হলে চলবে কেন—আমার অহঙ্কার মুছে দে মা। সামান্য বৃষ্টি দে মা। রাগ করে মা কার ঘরে বসে আছিস। বৃষ্টি দে মা, মাঠে ঘাসবিচালি গজাক। পাখি—পাখালি উড়ে আসুক মা। গাছে গাছে ফুল ফুটুক। ফল হোক মা গাছের শাখা—প্রশাখাতে। তোর লীলা মা আর কতকাল চলবে।
কিন্তু হায় কার কথা কে শোনে। শেয়াল ডাকছে না। কুকুরের আর্তনাদ নেই কোথাও। চারিদিকে বীভৎস জ্যোৎস্না! সাদা আলো মাঠময়। সেই মাঠের ভিতর বসে একসঙ্গে কারা যেন নিত্য কেঁদে চলেছে। জনার্দন একটু থমকে দাঁড়াল। কারা কাঁদছে! ঠিক যেখানে নদী সামান্য বাঁক নিয়েছে, যেখানে ক’ঘর মুন্ডা জাতীয় আদিবাসী ছিল, এবং যেখানে পেটের জ্বালায় ঘরের এক বউ ফাঁসি দিয়েছিল সেইসব মাঠে এবং গাছের ভিতর একদল মেয়ে যেন হাজার হবে, তার বেশিও হতে পারে বসে বসে কাঁদছে। জনার্দনের প্রায় পা চলছিল না। এমন বীভৎস দৃশ্য জনার্দন কোনওকালে যেন দেখেনি। হাজার ঘোড়া ছুটছে। ঘোড়ার পিঠে সব নারী—পুরুষের মুখ ঝুলছে। দেহ নেই। শুধু মুখ। তারপর একটা কালো ঘোড়া যেন ছুটে গেল, সেই ঘোড়ার পিঠে শুধু এক তরবারি। তারপর মনে হল সুবচনি দেবী মাঠের ভিতর ক্রমশ বড় হয়ে উঠছে। ছোট সুবচনি দেবী হাত পা বিশাল করে, স্তনে সন্তান ঝুলিয়ে ঠিক কোনও ভৈরবীর মতো দু হাত ওপরে তুলে জনার্দনের দিকে এগিয়ে আসছে। আর মনে হল হাজার হাজার কঙ্কাল সেই সুবচনি দেবীর চারপাশে আনন্দে নৃত্য করছিল। জনার্দন এবার বলল, মা আমার আর কোনও অহঙ্কার নেই মা। আমি ক্ষুধার জন্য অন্ধ হয়ে যাচ্ছি মা। মা আমার এই পিতৃপুরুষের দেশকে শ্মশান করে দিলি মা। আমি যে মা বড় ঘোরে পড়ে যাচ্ছি। জনার্দন হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকল।
জনার্দন ধীরে ধীরে আরও নীচে নেমে এল। সে একনাগাড়ে হাঁটতে পারছিল না বলে কোথাও সামান্য সময় বসে বিশ্রাম নিচ্ছিল। জলের জন্য সে নেমে যাচ্ছে। খাদ্য অন্বেষণের জন্য সে নেমে যাচ্ছে। যেখানেই সে বসত—চারপাশে শুধু মৃত গাছের ডাল। হাওয়া দিলে মরমর শব্দ করে কিছু গাছপালা ভেঙে পড়ত। জনার্দনের ইচ্ছে যায় তখন, মৃত ডালে, গাছে গাছে এবং সর্বত্র আগুন ধরিয়ে দিলে কেমন হয়। মা সুবচনিকে পুড়িয়ে মারলে কেমন হয়। ভাবতে ভাবতে জনার্দন হা হা করে হেসে উঠল।
আবার জনার্দনের হাঁটা। দক্ষিণের মণি পাহাড়ে উঠে গেলে হয়তো এখন কিছু কাঁটাজাতীয় গাছ মিলতে পারে। কম জল হলে ওরা বেশি গজায়। পাথরের ফাটল থেকে রস চুষে ওরা বড় হয়। কিন্তু শরীর দুর্বল, মণি পাহাড়ে উঠে যাবার সাধ্য যেন একেবারেই নিঃশেষ হয়ে গেছে জনার্দনের। সে হেঁটে হেঁটে শেষ যে পাহাড়ের মাথায় রোজ উঠে পাথর নিক্ষেপ করত তার নীচে কিছুক্ষণ দাঁড়াল। জ্যোৎস্না রাত বলে পাহাড়ের শেষ দিকের অংশটুকু একেবারেই দেখা যাচ্ছে না। সে এবার সেই যোজকের নীচের অংশটুকুতে এসে দাঁড়াল। পাথরে পাথরে জায়গাটা খুব উঁচু হয়ে গেছে। এবার নদীতে জল এলে প্রায় হ্রদের মতো জায়গাটা ঘিরে জল ধরে রাখবে। সে জলের আশায় বৃষ্টির আশায় আকুল হতে থাকল। বৈশাখ চলে গেছে, জ্যৈষ্ঠ যাব যাব করছে। অথচ একবিন্দু বৃষ্টি নেই। এবারেও মা সুবচনি এ—অঞ্চলে আগুন জ্বালিয়ে রাখবে। রাগে দুঃখে জনার্দন পাথরের ওপরই খামচাতে থাকল।
দুঃস্থ মানুষ জনার্দন অহোরাত্র খাদ্য অন্বেষণের পর ক্লান্ত হয়ে নদীর স্রোতের উঁচু অংশটাতে চুপচাপ বসেছিল। ভোর হতে আর দেরি নেই। হরিণী তার দুই শিশু সন্তান নিয়ে এবার নেমে আসবে। ওদের জলপান করানো হলে জনার্দন পেট পুরে জলপান করবে। তারপর, মন্দিরের ভিতর সারাদিন পড়ে থাকা ক্ষুধার ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা সহ্য করতে করতে মাঝে মাঝে দৃষ্টিহীন হয়ে যাওয়া—হায় জনার্দন প্রায় এখন কিছুই ভাবতে পারছিল না। সামনে যেসব গঞ্জ ছিল সেও সুনসান। কোনও কোলাহল নেই, ক্রমশ এক অন্ধকার এই পাহাড়ঘেরা মাঠে নেমে এসে সব অঞ্চলটাকে ভূতপ্রেতের রাজত্ব করে দিল।
জনার্দন মনে মনে খেঁকিয়ে উঠল, না হয় না। তার ইচ্ছে হচ্ছিল যে কোনও মই বেয়ে এবার প্রায় আকাশের কাছাকাছি উঠে যাবে, এবং আকাশটাকে মা সুবচনির খাঁড়া দিয়ে দুভাগ করে দেবে। দু ভাগ করে দিলেই ঝর ঝর করে জল নামবে। সে এই ক্লান্ত শরীরেও মই বেয়ে ওঠার মতো দু হাত তুলে দিল আকাশের দিকে। তারপর চিৎকার করে বলতে চাইল, জল দে। আমি যদি তোর কাছে পাপ করে থাকি, আমার প্রাণের বিনিময়ে জল দে। বলে সে বালিয়াড়ির ওপর সটান শুয়ে পড়ল এবং হাত দুটো পিঠের উপর যেন দুটো হাত বাঁধা অবস্থায় ওকে বলি দেওয়া হচ্ছে এমন ভঙ্গি নিয়ে বালির উপর শুয়ে পড়ল।—এবার দে এক কোপ। ভ্যাঁ। জনার্দন বালির ওপর কাটা পাঁঠার মতো ছটফট করতে থাকল এবং ব্যা ব্যা করে ডাকতে থাকল। যথার্থই যেন ওকে সুবচনি দেবীর মন্দিরে পাঁঠার মতো বলি দেওয়া হচ্ছে এখন।
না এভাবে পড়ে থেকে লাভ নেই—জনার্দন উঠে পড়ল। নিশুতি রাত শেষ হয়ে যাচ্ছে। চারিদিকে মাঠ, গাছ, পাহাড় যেন দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে আছে তাকে হত্যা করবে বলে। জনার্দন উলঙ্গ ছিল বলে উপবীত ডানদিকের কোমরের কাছে ঢলঢল করছিল। মনে হচ্ছিল উপবীত ওর শরীরে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। সে উপবীতে হাত রেখে হাঁকল, কে আসবি আয়, কার কত হিম্মত আছে আয়, কত লড়বি এই ঠাকুরের সঙ্গে আয়—কারণ জনার্দনের মনে হচ্ছিল শুধু সুবচনি নয়, শুধু এই অঞ্চলের মানুষজন নয়, সকলেই যেন, যেন গাছ, ফুল, পাখি, পাহাড় সকলে মিলে ওর সঙ্গে তঞ্চকতা করছে। অথবা রসিকতা করছে—হায় জনার্দন তোদের ফসলের অহঙ্কার ভালোবাসার অহঙ্কার এবারে সব মুছে যাবে।
ঠিক তক্ষনি লাফিয়ে লাফিয়ে নীচে নেমে আসছে হরিণী আর তার দুই শিশু। সোনার হরিণের মতো দেখাচ্ছিল প্রায়। ভোর রাতের জ্যোৎস্নায় ওদের চোখগুলো বড় উজ্জ্বল ছিল। বালিতে পায়ের দাগ পড়েছে। ওদের শরীর এত নরম এবং উজ্জ্বল যে জ্যোৎস্নায় মনে হচ্ছিল শরীর থেকে পিছলে যাচ্ছে। ওরা নেমে আসছিল এবং পিছনের দিকে ফিরে ফিরে তাকাচ্ছিল। জনার্দনের এখন আর মৃত্যুভয় থাকছে না। মাঠ এবং পাহাড়কে এখন দৈত্যের মতো মনে হচ্ছে না। এখন যেন জনার্দন আর একা নয়। সে এবং এই তিন বন্যপ্রাণী মিলে চারজন। সে প্রায় সুবচনি দেবীর মন্দিরে যেমন একা একা কথা বলে দিন কাটায় অর্থাৎ সেই সুবচনির সঙ্গে কথা বলে, এবং সুবচনির হয়ে কথার উত্তর দেয় তেমনি এই নদীর খাতে হরিণদের সঙ্গে প্রায় একা একা কথা বলার স্বভাব।—তা হলে তোরা এলি। তোদের জন্য আমি কখন থেকে বসে রয়েছি। তোরা তো বাপু দ্রুত ছুটতে পারিস, কোথায় কোনও বনে দ্রুত ছুটে যাস কে জানে। আহারের কোনও অসুবিধা হচ্ছে নাত! জনার্দন ওদের সঙ্গে প্রায় সাধু ভাষায় কথা বলতে আরম্ভ করে দিল।
সে ওদের নাম রেখে দিয়েছে এতদিনে।
সে সবচেয়ে ছোটটাকে ডাকল—পলা এই পলা তুইত বাপু ভারী দুষ্টু। শিঙে মুখ ঘসে সুখ খাচ্ছিস। পলা পা দুটো হঠাৎ এবার পিঠের উপর রেখে প্রায় মাথার কাছে মুখ নিয়ে এল। ওর মাথার নীচে এবং গা চেটে দিচ্ছে। বোধহয় ঘাম ছিল শরীরে, এবং ঘাম শুকিয়ে নুনের গন্ধ ছিল শরীরে, পলা মনের সুখে জিভ দিয়ে পিঠ ঘাড় গলা চেটে দিতেই জনার্দন এক ধরনের সুখ পেল—অতীব সুখ, লোভের বশবর্তী সে সুখ আহারের সুখ, এমন সুখ বুঝি কতদিন সে পায়নি—সে ভিতরে আহারের এক সুখ আছে ভাবতেই মনে হল কোথায় যেন আগুন জ্বলছে, কাঠের আগুন, বন্য মানুষেরা সেই কাঠে মাংস পুড়িয়ে চিবুচ্ছে। ওর জিভ স্বাদে গন্ধে অতুলনীয়, জিভে জল এসে গেল। সঙ্গে সঙ্গে সে খপ করে পলাকে ধরে বুকের কাছে টেনে আনল, এবং ওদের জলপান করানোর কথা মনে থাকল না। আহারের লোভে, দীর্ঘদিনের অনাহার জনার্দনকে প্রায় পাগলের মতো করে ফেলছে। সে পলাকে নিয়ে এবার মন্দিরের দিকে দ্রুত ছোটার জন্য মাঠের দিকে উঠে যেতে থাকল।
সুবলের পাখিও দ্রুত আকাশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে উড়ে যাচ্ছে। দ্রুত যেন পাখি সকলকে হারিয়ে দেবে। দেখো হুই আকাশে উড়েছে। জানালার পাশে আর কেউ নেই এখন। সুবল এবং টুকুন।
ভোরবেলা, নার্স এখনও আসেনি ঘরে। সুবলের কেবল গমনের অপেক্ষা। ওর দেবদারু গাছের নীচে থেকে জানালা দিয়ে ঘর স্পষ্ট, নার্স না থাকলেই টুকুনদিদিমণির সঙ্গে কথা, কত কথা, রাজ্যের কথা, রাজারানিদের কথা, রাজা ঘোড়ায় চড়ে শিকারে যাচ্ছেন তার কথা—টগবগ করে ঘোড়া ছুটছে তার কথা—ঘোড়া ছুটছে, দিদিমণি—সেই ঘোড়া, কালো ঘোড়া ছুটছে। সামনে পাহাড়, পথ উঁচু টগবগ করে উঠে যাচ্ছে, থামছে না, ঘোড়ায় চড়ে যেন রাজা যুদ্ধে যাচ্ছেন। সুবল পায়ে ঠিক ঘোড়ার মতো তাল দিতে থাকল। বলল, দেখো আমার পাখি কালো ঘোড়ার মতো, বাজপক্ষী ঘোড়ার মতো রাজার দেশে চলে যেতে পারে। সে যে কত বড় রাজার দেশ! দেশে কোনও দুঃখ নেই, কত গাছ, কত ফুল ফল পাখি—রাজার দেশে মানুষের মুখে হাসি আর আনন্দ। সামনে সমুদ্র, রাজার দেশে হায় কোনও দুঃখ জাগে না। কোটাল পুত্র, রাজার পুত্র মাণিক্যের আলোতে দুখের জন্য জাগে। দিদিমণি দুঃখ না থাকলে কষ্ট না থাকলে প্রাণে, আপনি বাঁশি বাজে না।
টুকুনকে খুশি রাখার জন্য, সামান্য সুবল আবোল তাবোল যা মনে আসে যা মুখে আসে বলতে থাকে। টুকুনের সামান্য হাসি দেখার জন্য সে তার পাখি নিয়ে এসে জানলায় দাঁড়ায়। জানলায় দাঁড়ালে টুকুনের মনে হয় সুবল এসেছে পাখি নিয়ে। এই পাখির জন্য সে ট্রেনে হাততালি দিতে পারছিল, এই পাখির জন্যে সুবলের জন্য সে হেঁটে গিয়েছিল। ওর মনে হয় ওর আর আলস্য থাকার কথা নয়, আর দূরে থাকার কথা নয়। আকাশে পাখি উড়তে থাকলে—অথবা ঘোড়া ছুটছে টগবগ…তখন ঘোড়ার মতো শক্তি যেন পায়ে খেলা করতে থাকে। রাজার হাতে অসি, অসি খেলা হচ্ছে, সুবল দুহাত দিয়ে ছোট্ট একটা তালপাতার মতো বাঁশের বাঁট দিয়ে অসি বানিয়ে রাজার মতো খেলা দেখাচ্ছে। যেন এক রাজা যুদ্ধে যাবার আগে সেনাপতিদের অসির নিয়মকানুন বোঝাচ্ছে।
অথবা ওর হাতে কোনও কোনও দিন লাঠি থাকত। মেলার দিনে সকলে যেমন লাঠি খেলা দেখায়—দূর থেকে ছুটে এসে লাঠিতে মাথায় বাড়ি মারে অথবা এক দুই তিন, এক পা, দু পা, তিন পা সামনে গিয়ে ফের পিছনে—লাঠি ঠিক কোমরের সামনে রেখে ফের এক পা, দু পা এগিয়ে যাওয়া—দেখলে মনে হবে সুবল যেন পায়ের ওপর পাইকদের মতো নাচানাচি করছে। জানলা থেকে টুকুন ওর সব রকমের নাচন—কোঁদন দেখে হাসত। ওর পায়ে কী শক্তি কী শক্তি! পাখির পাখায় কী রাজ্যের স্বপ্ন। মনে হত টুকুনের সমস্ত শরীরে সহসা বিদ্যুৎ খেলে যাচ্ছে।
তারপর সুবল যখন ক্লান্ত হত অথবা নার্স ঘরে ঢুকলে সে ভালোমানুষের বাচ্চার মতো দেবদারুর নীচে গিয়ে বসে বলত, এসে যান বাবু দেখে যান বাবু, জুতো সাফ করে যান—এবং বলত, দু আনা পয়সা দেবেন—সুবল বেশি চায়না, শুধু খেতে পরতে চায়। বলত, আর এই পাখি আছে, পাখির জন্য কিছু সঞ্চয় করে নিচ্ছি। সে মন দিয়ে জুতো সাফ করে। সে পাখিকে টেরিটি বাজার থেকে কিনে আনা কীটপতঙ্গ খাওয়াত। ওর সুখের পাখি শখের পাখির জন্য প্রায় সময় সে স্বপ্ন দেখত। স্বপ্নে টুকুনদিদিমণি খুব সুন্দর এক জরির টুপি মাথায় দিয়ে কনে বউ সেজে বসে আছে। সুবল লাঠি নিয়ে দু’পাশে নাচানাচি করছে। সুবল রাজার পাইক যেন। সুবল লাঠি নিয়ে কনে বউকে খেলা দেখাচ্ছে লাঠির। পরনে জরির কাপড়, মালকোঁচা মেরে সে কাপড় পরেছে। মাথায় পাগড়ি সুবলের। পাগড়িতে পালক আছে। সে রাজার মতো অথবা রাজপুত্রের মতো কোনও কোনও সময়, যেন ঘরে কনে বউ ফেলে হরিণ শিকারে যাচ্ছে আর সেই শিকারের গল্প ভোর হলে অথবা বিকাল হলে বলা চাই।
সে বলত—সে এক হরিণ টুকুনদিদিমণি। হরিণের বনে হরিণ আছে। রাজার সঙ্গে পাইক বরকন্দাজ আছে। বনে ঘন বন আছে। দু’চোখে বনের পথ দেখা যায় না। মাঝে মাঝে সমতল মাঠ আছে, মাঠে ঘাস আছে। রাজার পিঠে তিরধনুক। একটি হরিণ জল খাচ্ছিল। মাঠের ভিতরে এত হরিণ অথচ একটা হরিণ জল খাচ্ছে। ছোট হরিণ—শুধু লাফায়, নাচে আর ঘাস খেতে শখ যায়, কিন্তু নরম ঘাস না হলে, কুয়াশায় ভেজা ঘাস না হলে হরিণ শিশু ঘাস খেতে পারে না।
রাজা ছুটছেন। বুঝলে দিদিমণি বনের ভিতর দিয়ে রাজা ছুটছেন। হরিণ ছুটছে। শিকার ধরার জন্য রাজা ছুটছে। কী বেগে ছুটছে! চারিদিকে পাহাড়, ওপরে মধ্যিখানে হ্রদের পারে হরিণী ছুটছে। কী বেগে কী তালে তালে পায়ের খুরে আগুন জ্বলছে। পাথরে ঘসা লেগে পায়ের খুর জ্বলছে। হরিণীর বাচ্চা একা একা পথে তখন মাঠের ওপাশে হ্রদের জলে মুখ দিয়ে বসে রয়েছে। মা বুঝি আসছেন।
—বুঝলে দিদিমণি বিপদ বুঝতে পেরেছিল হরিণের বাচ্চারা।
—সে মাকে দৌড়তে দেখে সেও দৌড়তে থাকল।
—রাজা ধরতে পারল সুবল?
—না! কী করে পারবে। হ্রদের পারে আসতেই রাজা দেখল পাথরের ঘসা খেয়ে ঘোড়ার পায়ে ফোসকা পড়েছে।
—ঘোড়ার পায়ে ফোসকা।
—বাপরে, আগুন জ্বলছিল পাথরে। হরিণের খুরে আগুন লেগেছিল।
—অঃ। টুকুন যেন আবার যথার্থই সবটা বুঝে ফেলেছে।
আর সঙ্গে সঙ্গে দেখল টুকুন, সুবল চলে যাচ্ছে। বড় জ্বালাচ্ছে। নার্স চিৎকার করতে চাইল। কিন্তু অবাক টুকুন খাটের উপর বসে রয়েছে। মুখে কোনও অবসাদের চিহ্ন নেই। সব কিছু কেমন অলৌকিক মনে হচ্ছে। তাড়াতাড়ি সে ডায়াল করে বলল, সুরেশবাবু, সুরেশবাবু আছেন?
—কে।
—আমি সারদা বলছি।
সহসা এই ফোন সুরেশবাবুকে বিস্মিত করেছে। কোনও অঘটনের আশঙ্কা করলেন তিনি। তার বুক কাঁপছিল। গলা শুকিয়ে আসছে। নার্স সারদার গলা কাঁপছে বলতে—সে ঠিক স্পষ্ট বলতে পারছে না। দুঃসহ খবরের জন্য বুঝি ওর গলা কেঁপে কেঁপে উঠছে। কিন্তু একি বলছে! কী বললে! কী বলল!
—টুকুন খাটের উপর বসে দিব্যি সেই সুবল ছোঁড়াটার সঙ্গে কথা বলছিল।
—ঠিক ঠিক বলছ?
—ঠিক। আমি দরজা দিয়ে ঢুকতেই সুবল পালিয়ে গেল।
—ডাক্তারবাবুকে খবর দিয়েছ?
—না।
—আগে তাকে খবর দেওয়া উচিত ছিল।
—এমন আনন্দের খবর আপনাকে আগে না দিয়ে তাকে দিই কী করে?
—শোন আমরা যাচ্ছি এখুনি। বলে ফোন ছেড়ে দিলেন সুরেশবাবু।
তারপর কিছুক্ষণের ভিতরেই ওরা সকলে এসে গেল। ডাক্তারবাবু এলেন। তিনি টুকুনকে দেখে কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। টুকুন কিছু কুঁচফল এবং চন্দনের বীচি নিয়ে এখন বিছানার ওপর একা একা আপন মনে খেলা করছে, সে ভিড় প্রায় লক্ষ্যই করল না। রাজার গল্প, হরিণের গল্প, রাজপুত্রের গল্প অথবা এই যে এক পাখিয়ালা সুবল যার আপন প্রাণে নিরন্তর বেঁচে থাকার উদ্যম যে—কোনও এক খরা অঞ্চল থেকে চলে এসে এই শহরে ছুটে বেড়াচ্ছে সেই সুবল, বালক সুবল রাজার মতো ওকে কেবল উৎসবের কথা বলে গেল। বেঁচে থাকার কথা বলে গেল। আপন প্রাণের তেজে উড়ে যাবার কথা বলে গেল। সে চন্দনের বীচি কুঁচফল এবং রঙবেরঙের পাথরগুলো দেখতে দেখতে কেমন নিবিষ্ট হয়ে পড়ল।
—টুকুন তোমার শরীর ভালো হয়ে যাচ্ছে! মা মাথায় হাত রেখে বললেন।
—টুকুন একবার মার দিকে তাকাল। কোনও কথা বলল না।
ডাক্তারবাবু বললেন, আমার হাত ধর টুকুন।
টুকুন ডাক্তারবাবুর হাত ধরল।
—এবারে উঠে দাঁড়াও।
—আমি পারব না ডাক্তারবাবু।
—সুবলের একটা পাখি আছে টুকুন।
—ওর পাখিটা ভারী দুষ্টু। ও রাজার মাথায়—বলে হো হো করে হেসে উঠল।
—তুমি দাঁড়াও। সুবল আজ আবার কখন আসবে।
—কখন আসে বলে না। ওদিকে একটা দেবদারু গাছ আছে, তার পাশে কোথায় যেন থাকে।
—তুমি দাঁড়াও। এইত উঠতে পারছ।
—আমি পারব না ডাক্তারবাবু।
—এইত হচ্ছে। আচ্ছা শোন তুমি সুবল এলে থাকতে বলবে, ওর সঙ্গে আমি কথা বলব। আচ্ছা শোন, ঠিক আছে, কাল আবার আমরা হাঁটার চেষ্টা করব।
ডাক্তারবাবু টুকুনকে বিছানায় রেখে উঠে দাঁড়ালেন এবং নার্সকে ইশারা করতেই নার্স বারান্দায় বের হয়ে গেল। ডাক্তারবাবু নার্সের পেছনে পেছনে বের হয়ে ফিস ফিস করে বললেন, সুবল কখন আসে।
—ঠিক থাকে না। আমি না থাকলেই চলে আসে। ও যেন কী করে টের পায় কখন আমি থাকি না।
—ঠিক আছে। ও আসবে। ও টুকুনের সঙ্গে কথা বলবে। তবে যেন একনাগাড়ে বেশিক্ষণ ও না থাকে। তোমার প্রতি সুবলের যে ভয়টা আছে সেটা সব সময় রাখবে।
—আমি ওকে বেশি আসতে দিই না।
—খুব বেশি না দিলেও তোমাকে মাঝে মাঝে কাজের অছিলায় বাইরে বেশি সময় থাকতে হবে। সুবল এসে কথা বললে ও প্রাণের ভেতর এক অশেষ আনন্দ পায়। এক ধরনের উত্তেজনার জন্ম হয়। আমরা সকলে যা পারিনি, সামান্য এক পাখিওয়ালা তাই করে দিয়ে গেল।
—তবে ওকে ভিতরে নিয়ে এলে হয় না?
—না। তা হয় না সারদা। ওর যদি মনে হয় সুবল এখানেই থাকবে, সুবলের আর যাবার জায়গা কোথাও নেই, তবে ওর প্রতি আকর্ষণ কমে যাবে। কারণ এখন সুবল ওর কাছে জাদুকরের মতো। স্রেফ অলৌকিক জাদুকর। আসে যায়, কখনও হারিয়ে যায়। আবার আসে। প্রত্যাশা ওকে বড় এবং ভালো করে তুলবে। বলে ডাক্তারবাবু অন্যমনস্কভাবে কেবল তুড়ি মারতে থাকলেন।
সুরেশবাবু বাইরে এসে বললেন কেমন বিস্ময়ের ব্যাপার লাগছে সব!
সুরেশবাবুর স্ত্রী বললেন, ডাক্তারবাবু টুকুন সত্যি হাঁটতে পারবে?
—সব এখন পাখিয়ালা সুবলের উপর নির্ভর করছে।
—কেন কেন।
সুরেশবাবুর স্ত্রীর মুখ কেমন গম্ভীর হয়ে গেল।
—টুকুনের কাছে সুবল এখন আশ্চর্য এক জাদুকর। ওর পাখি, ওর কুঁচ ফল, চন্দনের বীচি, রঙবেরঙের পাথর আর সারদা যা বলল, কীসব আজগুবি গল্প বলে সে নাচতে থাকে কেবল। তার অর্ধেকটা বোঝা যায়, অধের্কটা বোঝা যায় না। রাজার গল্প, হরিণের গল্প, বন পাহাড়ের গল্প, এবং পাখির গল্প বলে সে কেবল ছোটার অভিনয় করে। তখন টুকুনের সুবলের পা দেখতে দেখতে বুঝি মনে হয়—হরিণের মতো সেও ছুটছে, মনে হয় ঘোড়ার মতো সেও ছুটছে, গল্পের সঙ্গে এই যে ছোটা, ছোটা আর ছোটা—প্রাণের ভিতর এই ছোটা, কেবল আবেগের জন্ম দেয়। রক্তে উত্তেজনা আসে। হাতে পায়ে সেই উত্তেজনায় রক্ত বইতে থাকে। টুকুনকে তখন খুব স্বাভাবিক দেখায়। এই ছোটার ভিতর সেই উদ্যমের কথাই বলা হচ্ছে সুরেশবাবু। আমরা এই উদ্যম হারিয়ে কেমন ক্রমশ টুকুনের মতো স্থবির হয়ে যাচ্ছি। বলে ডাক্তারবাবু কেমন হাঁসফাঁস করতে থাকলেন!—আমাদের জীবনে এখন সুবলের মতো এক পাখিয়ালা চাই। যে প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসা দিয়ে আমাদের এই কঠিন রোগ সারিয়ে তুলবে। বলে তিনি ফের অন্যমনস্কভাবে হাতে তুড়ি মারতে থাকলেন।
হাতে তুড়ি মারতে থাকলেন ডাক্তারবাবু, জনার্দন ছুটতে থাকল মাঠ দিয়ে। বুকে পলা। হরিণ শিশু পলা জনার্দনের বুকের ভিতর চুপটি করে আছে। কোনও ভয়ডর নেই। কান খাড়া করে দেখছে পেছনে ওর মা অপলা, বোন অচলা আসছে। ছুটে ছুটে আসছে না। কারণ জনার্দন ভাবছিল সে খুব দ্রুত ছুটছে, কিন্তু জনার্দনের মনে নেই বোধ হয়—ওর শরীর বড় ক্লিষ্ট, শরীরে কোনও শক্তি আর অবশিষ্ট নেই। চোখ মাঝে মাঝে দৃষ্টিহীন হয়ে পড়ছে। মনে হয় সব কিছু ঝাপসা। আবার কেমন সামান্য জল খেলে চোখের দৃষ্টি ফিরে আসে।
জনার্দন ছুটছিল। কারণ সে অন্য দুই হরিণকে ভয় পাচ্ছিল। শুধু ফাঁকা মাঠ। বালি শুধু মাঠে। এখনও রোদ ওঠেনি বলে বালিতে কোনও উত্তাপ জমছে না। পাহাড়ের নীচটা ক্রমশ সাদা হয়ে উঠছে। অন্য পাশে চাঁদের মরা গোল সোনার বাটি ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে। দু—একটা শকুন উড়ে যাচ্ছিল কোথাও। কোনওদিকে এই শকুনেরা উড়ে যাচ্ছে অন্যদিন হলে জনার্দন একটু অপেক্ষা করে দেখত। কিন্তু আজ এই পলা তার বুকে। এই পলার চোখ ওকে ভয় দেখাচ্ছে—জনার্দন ক্লিষ্ট শরীর নিয়ে ছুটছিল আর মাঝে মাঝে পেছনের দিকে তাকাচ্ছিল। ওরা এখনও জনার্দনকে অনুসরণ করছে। ওরা অর্থাৎ দুই হরিণী। অচলা, অপলা। সে এবার নুয়ে একটা পাথর তুলে ওদের দিকে ছুঁড়ে দিল। পাথরটা বেশি উঁচুতে উঠল না। কিছুদূরে গিয়ে গড়িয়ে পড়ল। হরিণীরা সেই পাথর নিক্ষেপের জন্য অল্প সময় থমকে দাঁড়াল। পাথরটা গড়িয়ে আসছে। জনার্দন ওদের ভয় দেখানোর জন্য থেমে থেমে পাথর ছুঁড়ে যাচ্ছিল। আর হাত তুলে—যা আমার সঙ্গে কেন! যা বলছি! ভয়ে কেমন টেঁসে যাচ্ছিল জনার্দন। জনার্দন পিছন ফিরে তাকালে ওরাও থেমে যেত। জনার্দন ছুটতে থাকলে ওরাও ছুটত। জনার্দন পাথর নিক্ষেপ করলে ওরা দু পা তুলে পাথর রোখার চেষ্টা করত। অথবা যেন পাথরটাকে গুঁতো মারতে আসছে তেমনি শিং বাগিয়ে ধরত।
পাহাড়ের ভিতর দূরে সুবচনির মন্দির দেখা যাচ্ছে। চারপাশে বনের মতো। পাতা নেই কোনও গাছে। ফলে গাছগুলো যেন মৃত। শুকনো এক ভাব—মনে হয় আগুন লাগলে দাবানল জ্বলবে। চারিদিকে তাকানো যাচ্ছে না। চারিদিকে মরুভূমির মতো হাহাকার। মাটি, মরুভূমি বুঝি গ্রাস করছে। জনার্দনের আর পা চলছিল না। সুবচনি দেবী কিছুতেই প্রসন্না হচ্ছেন না। তিনি প্রসন্ন হলে সংসারে আর দুঃখ কীসের! ঠিক তক্ষুনি পলা ওর বুকে ডেকে উঠল। ভয়ে ডেকে উঠল। জনার্দনের চোখে লোভ লালসা ভেসে বেড়াচ্ছে। জনার্দন থর থর করে কাঁপছিল। যত এগিয়ে যাচ্ছে, সুবচনি দেবীর মন্দিরের দিকে উঠে যাচ্ছে, ঠিক তত সে দৃষ্টিহীন হয়ে পড়ছে। এবং মন্দিরের ভিতর ঢুকেই পিছন ফিরে তাকাল। দেখল ঠিক মন্দির সংলগ্ন একটা মৃত অর্জুন গাছের নীচে দুই হরিণী বসে রয়েছে। ওরা ওদের বাচ্চাকে ফিরিয়ে নিতে চায়।
জনার্দন আর অপেক্ষা করতে পারল না। সে ভয়ে ওদের মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিল। কারণ জনার্দনের ভয় ওর ক্ষীণ শরীর সামান্য আঘাতেই ভেঙে পড়বে। যদি হরিণী ওকে আক্রমণ করে তবে ওর পেট ফুঁড়ে যাবে। কিন্তু দরজা বন্ধ করতে মনে হল, ওর কোলের ওপর থেকে হরিণ শিশুটা লাফিয়ে নীচে পড়ে গেল আর মনে হল সে ক্রমশ যে দৃষ্টিহীনতায় ভুগছিল, এখন সেই দৃষ্টিহীনতা ওকে পুরোপুরি গ্রাস করেছে। সে অন্ধকার দেখল চারিদিকে। সে হরিণ শিশুকে ডাকল, পলা পলা। সে লোভের গলায় ডাকল। পলা, মুখে সেই নোনতা স্বাদ, বনে সেই আগুনের ছবি যেন, কোনও আদিম মানুষ বনের ভিতর হরিণের মাংস পুড়িয়ে খাচ্ছে। পলা সুবচনি দেবীর পেছনে চলে গিয়ে ঘাপটি মেরে বসে রয়েছে। জনার্দনের চোখের ছবি দেখে বুঝতে পারছিল যেন মানুষটা ওকে এবার চিবিয়ে খাবে। ভয়ে পলা কোনও শব্দ পর্যন্ত করল না। একবার উঠে গিয়ে দরজার কাছে মাথা ঠুকল। বের হবার চেষ্টা করল।
জনার্দন—অন্ধ জনার্দন দরজায় শব্দ শুনে ছুটে গেল। কিন্তু কোথায়! অন্যদিকে বোধহয়। সে শব্দ শুনে এবার হরিণ শিশুকে ধরার জন্য ওৎ পেতে থাকল। এবং প্রায় অজগর সাপের মতো সে মেঝের ওপর শুয়ে হামাগুড়ি দিয়ে হরিণের পায়ে জাপটে ধরার চেষ্টা করল। কিন্তু হায়! হরিণ শিশু লাফাচ্ছিল, নাচছিল—ওর এখন প্রায় খেলার মতো হয়ে গেল। চারিদিকে পাথরের দেয়াল। ঘুলঘুলি দিয়ে সামান্য বাতাস আসছে। জনার্দন দরজা বন্ধ করে রেখেছে। জনার্দন অন্ধ। সুবচনি দেবীর খাঁড়া মাথার ওপর ঝুলছে। ফুল বেলপাতা শুকনো। যেখানেই পলা গিয়ে দাঁড়াক না কেন, মনে হয় ঐ দিকে। মনে হয় এখন পলা কাসর ঘণ্টার নীচে, মনে হয় পলা এখন ঢাক ঢোলের নীচে, মনে হয় পলা এখন সুবচনি দেবীর মাথার ওপর উঠে বসে আছে। অথবা মনে হয়, পলা ঘরময় হেগে মুতে বেড়াচ্ছে।
জনার্দন সারাদিন ধরে পলাকে ধরার চেষ্টা করল। সে কিছু দেখতে পাচ্ছে না। ওর রাগে দুঃখে চোখ মুখ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। সামান্য এক হরিণ শিশু ওকে নিয়ে রঙ্গ তামাশা করছে। সে হুংকার দিয়ে উঠল। যেখানে খাঁড়াটা ঝুলছিল তার নীচে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর খাঁড়াটা দড়ি থেকে খুলে ছুটে গেল মায়ের পাশে—মা আমার ক্ষুধা পেয়েছে। মা আমি না খেতে পেয়ে অন্ধ হয়ে গেছি। শরীরে শক্তি নেই মা। সে খাঁড়া নিজের মাথায় রেখে কেমন পাগলের মতো শুয়ে পড়ল মেঝের উপর। পলাকে পুড়িয়ে মাংস খাবার ক্ষমতা তার আর থাকল না।
কিন্তু হায়! সব পাগলের কাণ্ড। আত্মহত্যার মতো এই ঘটনা। রক্তে ভেসে যাচ্ছে। জনার্দনের মনে হচ্ছিল সে মরে যাচ্ছে। খাঁড়ার ঘায়ে ঘাড়ের কিছুটা অংশ কেটে গেছে। ভোঁতা খাঁড়ার আঘাত ভালো করে লাগেনি। তবু ঘাড়ের ক্ষতস্থান থেকে রক্ত গড়িয়ে শান ভেসে যাচ্ছিল। এবং মনে হল এবার জনার্দন সত্যি মরে যাবে। কিন্তু পলার কথা মনে হতেই মনে হল ঘরের ভিতর আবদ্ধ থেকে এক অবলা পশু শেষে মরে যাবে! সে কেঁদে উঠল, মা মাগো। আমাকে আর সামান্য শক্তি দে। আমি মা দরজাটা খুলে দি।
শান ভেসে যাচ্ছে রক্তে। ওর জিভে সেই রক্তের স্বাদ নোনতা লাগল, সে তাড়াতাড়ি উপুড় হয়ে সেই রক্ত চাটতে থাকল। আহা আহা খাদ্যবস্তু। এমন খাদ্যবস্তু সে যেন কতকাল আহার করেনি। নিজের রক্ত পানে সে উল্লাসে উঠে দাঁড়াল। উঠে দাঁড়াতে পারল। সে অন্ধ হলেও রক্তটুকু সে চেটে চেটে খেয়ে ফেলল। খেয়ে ফেলতেই ওর মনে হল কতকাল পর আহার করেছে। সে কতকাল পর আহার করে উল্লাসে জয়ঢাক বাজাচ্ছে। জয়ঢাক, ঢাক ঢোল বাজাচ্ছে। সে বাজাচ্ছিল না অন্য কেউ বাজাচ্ছে।—কই রে পলা গেলি কই। সে উঠে দাঁড়াতে পারল, সে হেঁটে যেতে পারল। দরজা পর্যন্ত হেঁটে যেতে পারল। টলতে টলতে সে দরজা পর্যন্ত হেঁটে গেল। খিল খুলে দিয়ে বলল, যা অবলা হরিণ শিশু চলে যা। যদি কোনওকালে বৃষ্টি হয় তবে বলবি—এই সংসারে জনার্দন চক্রবর্তী বলে একটা লোক ছিল, সে তার সব ভালোবাসা দিয়ে, মন্ত্র দিয়ে এই দেশের প্রাণপ্রাচুর্যকে রক্ষা করতে চেয়েছিল—পারেনি।
একি! কীসের এত শব্দ! মনে হয় পৃথিবী দুলে উঠছে। মনে হয় পাহাড় টলছে। মনে হয় আকাশ ভেঙে পড়ছে। মনে হয় ঝড়ে দেবীর মন্দির গাত্রে পাথর ছুটে আসছে। যেন এক প্রলয়। জনার্দন দু’হাত তুলে সেই উলঙ্গ রাত্রির ভিতর ডাকল, পলা, অপলা, অচলা কোথায় গেলি। ঝড়ে মরে যাবি। তোরা মরে গেলে এই অঞ্চলে আমার চেষ্টার সাক্ষী কেউ থাকল না। তোরা মন্দিরের ভিতর চলে আয়। এই ঝড়ে পড়লে তোরা মরে যাবি।
কিন্তু জনার্দন ওদের কোনও সাড়া পেল না। মনে হল অর্জুন গাছটা ঝড়ে ভেঙে পড়েছে। মনে হল ভিতরে যত ফুল বেলপাতা ছিল সব উড়ে যাচ্ছে, মনে হল সেই হরিণ শিশুরা এখন লাফিয়ে চলছে। আর আর আর মনে হল—এটা কী হচ্ছে। বৃষ্টি। বৃষ্টি! মা, মা, বৃষ্টি হচ্ছে। মা মা, মাগো সুবচনি তোর এত কৃপা, তোর এত কৃপা। মা আমি যে আর কিছু ভাবতে পারছি না।
জনার্দন মন্দিরের ভিতর পর্বত প্রমাণ দৈত্যের মতো লুটিয়ে পড়ল।