টুকুনের অসুখ – পাঁচ
সেই এক জাদুকরের জন্য জনার্দন চক্রবর্তীও ঘুরছে। একা নিঃসঙ্গ মাঠে জনার্দন চক্রবর্তী রাতের অন্ধকারে অথবা ভোররাতের দিকে ঘুরছে। খরা থেকে এই মাটিকে রক্ষা করার জন্য ঘুরছে। এক প্রচণ্ড অহমিকা জনার্দনের। সুবচনি দেবীর মন্দিরে মাথা কুটছে, মা জল দাও। জল দাও। মা, জলে তুমি মাটি ভাসিয়ে দাও। মা, তোমার সন্তানেরা সব দেশ ছেড়ে চলে গেল। কেউ আর ফিরে এল না, আমি মরে গেলে তোকে কে আর ফুল জল দেবে। কিন্তু নিষ্ঠুর সুবচনি দেবী, করালবদনি ডাইনি মুখ ব্যাদান করে আছে। লম্বা জিভে যেন জনার্দনকে ভেংচি কাটছে। শ্মশানের মতো মন্দিরের চারপাশে শুধু আগুনের মতো রোদ।
জনার্দন মাঝে মাঝে দেবীর কপালে হাত রাখত, কপাল ঘামছে কিনা দেখত, কপাল ঘামলে দেবী প্রসন্না হবেন।
সে দেবীকে প্রসন্ন করার জন্য এক রাতে হাজার বিল্বপত্র সংগ্রহের জন্য বের হয়ে দেখল, গাছে কোনও বিল্বপত্র নেই। সে দেবীকে প্রসন্ন করার জন্য জল তুলে আনল নদীর গর্ত থেকে কিন্তু এমন মরুভূমির মতো স্থান যা জলের রঙ ক্রমশ গাঢ় হয়ে রক্তবর্ণ ধারণ করল। দেবী হা হা করে হেসে উঠে যেন ভয় দেখালেন জনার্দনকে। জনার্দন খেপে গিয়ে বলল, বল—মাগি, কবে বৃষ্টি হবে, তোর কোনও মরদকে ধরে আনতে হবে বল, বলে সেই নগ্ন সন্ন্যাসী অথবা কাপালিকের মতো চেহারা যে জনার্দন মুখে বড় দাড়ি, নাসিকা লম্বা, আর কোটরাগত চোখ থেকে আগুন ঝরছে, সেই জনার্দন হা হা করে লাঠি তুলে তেড়ে গেল দেবীর কাছে এবং চিৎকার করে উঠল, জল, জল চাই, জল না হলে শালি তোর একদিন কী আমার একদিন। এই দ্যাখ, বলে সে বড় শক্ত বাঁশের লাঠি ঘরের কোণে তুলে রাখল, জল না হলে তোর মাথা দু’ভাগ করে দেব। তোর ছেইলা কোলে নিয়া বেড়ানোর শখ ভেঙে দেব।
মন্দিরের দরজা বন্ধ। সুতরাং ভিতরে উত্তাপ কম। প্রায় সারাটা দিন এই মন্দিরে জনার্দন পড়ে থাকে। প্রায় সারাটা দিন জনার্দন দেবীর সঙ্গে বচসা করে, কথা বলে, মার্জনা ভিক্ষা করে, অথবা উপবীতের অহঙ্কার দেখায়। পাথরের দেয়াল বলে এবং জায়গাটা পাহাড়ের গুহার ভিতর বলে ওর চিৎকার অথবা মার্জনা ভিক্ষা কোনও কাকপক্ষী পর্যন্ত টের পায় না। কোনও লোক চলাচল আর নেই এ অঞ্চলে।
সে মাঝে মাঝে পাহাড়ের ওপরে উঠে দূরে ট্রেনের শব্দ শোনার চেষ্টা করে অথবা কখনও দেবীর গায়ের কাছে পড়ে থেকে মা মা বলে কাঁদতে থাকে—মা, সোনার দেশে ফসল ফলাবি না মা? কোন পাপে মাগো তোর মাটিতে আর ফসল ফলাবি না মা? কোন পাপে মাগো তোর মাটিতে আর ফসল ফলে না, বৃষ্টি হয় না।
দেবীর মুখ তেমনি নির্বিকার। ছেলের মুখ দেবীর স্তনের কাছে। কালো পাথরের মূর্তি। এক ফুটের মতো লম্বা। পায়ে কপালে এত সিঁদুর যে এখন আর মুখ এবং স্তনের প্রভেদ খুঁজে পাওয়া যায় না। নীচে বেদি। বেদিমূলে কিছু ধান—দূর্বা, শুকনো ধান—দূর্বা, শঙ্ক কোষাকুষি, ঢোল ঢাক, বড় কাসি আর বাঘের কী হরিণের চামড়া, ব্যবহারে সব লোম উঠে গেছে, সুতরাং বাঘ অথবা হরিণ না অন্য জীবজন্তুর চামড়ায় তৈরি এই আসন বোঝা যায় না। তেল—সিঁদুরের জন্য দেবীর মুখ সব সময়ই চক চক করছে।
জনার্দন তিক্ত হয়ে দেবীর মুখে দুটো বুড়ো আঙুল ঠেসে ধরল। বলল, খা, কাঁচকলা খা। বস্তুত জনার্দন পেটে খিধে থাকলে এমন করতে থাকে। কোনও খাদ্যদ্রব্য নেই। সে গত রাত্রে বনের ভিতর বন—আলুর মতো লতার সন্ধানে ছিল। সে কিছু খুঁজে পায়নি। লতার সন্ধান পেলে সে মাটি খুঁড়ে অনেক নীচ থেকে বড় থামের মতো আলু তুলে আনতে পারত।
সে সুতরাং সারাদিন উপোসী থেকে দেবীর ওপর তিক্ত হয়ে পড়েছে। নিজের উপবাসই দেবীর উপবাস। নিজের দুঃখই দেবীর দুঃখ।—কি আর খাবি মা। হয়তো কিছু বটফল সংগ্রহ করেছে জনার্দন, তাই মুখে ফেলে বলল খা মাগো, খা, এই খেয়ে পেট ভরে ফেল। কেমন লাগে মা খেতে! সে নিজে বটফল চিবিয়ে বলত, কেমন লাগে! ভালো লাগে! খা, ভালো লাগলে অমৃত বলে খেয়ে নে। সে কোৎ করে একটা ঢোঁক গিলত তারপর। তারপরে দেবীর মুখের দিকে ফ্যাকাসে চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকত কতক্ষণ, একসময়ে হা হা করে হেসে উঠত ফের।—কেমন লাগে, অন্ন নেই, জল নেই, মানুষ নেই, ফুল বেলপাতা, দূর্বা—ধান কিছু নেই, কেমন লাগে! ছেইলা কোলে লৈয়া বৈসা থাকতে কেমন লাগে। চেষ্টা নেই, সাধনার ধন মা না দিলে ফসল ফলে না। বলে জনার্দন দরজাটা ফাঁক করে দেখল, বেলা পড়ে গেছে। সূর্য পাহাড়ের অন্যমাথায় নেমে গেছে।
এবার তার ফের বের হবার পালা। এখন বের হলে সব ঘুরে, পাহাড়ময় ঘুরে মাঠময় ছুটে নদীর গর্ত থেকে ভোরের দিকে সামান্য জল নিয়ে ফের সুবচনির মন্দিরে উঠে আসা যাবে। জল তোলার আগে তেমনি সেই হরিণী তার দুই শিশু নিয়ে এসে বসে থাকতে পারে। জলের জন্য পারে সে বসে থাকত। জনার্দন উঠে আসার মুখে ওদের জল দেবে খেতে। জীবের জন্য মায়া। যেন জীব বলতে সামান্য এই হরিণ, তার দুই শিশু, ক্বচিৎ দুটো একটা পাখি উড়ে যেতে দেখা যায়।
জনার্দন আকাশের দিকে চোখ তুলে অনেকক্ষণ পাখির আকাশে ওড়া দেখে, কোথায় কোনও টুকরো মেঘ আকাশের কোলে ভেসে আসছে কিনা দেখে, আর হা—অন্নের জন্য দু’হাত তুলে যেন হারাধনের দশটি ছেলে ঘোরে পাড়াময়, একটি ম’ল জলে ডুবে রইল বাকি নয়, জনার্দন ডুবে যাওয়া, হারিয়ে যাওয়া ছেলের মতো মাঠময় পাহাড়ময় শুধু নদীর কোথায় জলসঞ্চয় করে রাখলে সম্বৎসর এই অঞ্চলে জলে ভরে থাকবে, তাই অন্বেষণ করে বেড়াচ্ছে।
সুতরাং রাতের বেলায় জনার্দনকে চেনা যায় না। মানুষ বলে চেনা যায় না। এক দৈত্য আলখাল্লা পরে অথবা এক কাপালিক মাথায় পাগড়ি বেঁধে পাহাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। জল, মাগো জল চাই। এমন এক অঞ্চল মা, জলের ব্যবস্থা থাকলে আর কোনোকালে এখানে দুর্ভিক্ষ হবে না, সময়ে জল চাই ফসলের গোড়ায়।
নদীর নীচে জমি, বাঁধ দিলে জল থাকে, এমন এক জায়গার সন্ধানে ছিল জনার্দন যেখানে অল্প আয়াসে বাঁধ দিলে সব জল বর্ষায় নেমে যাবে না, কিঞ্চিৎ জল থেকে গেলেই অঞ্চলের খরা নিভে যাবে। সেজন্য জনার্দন প্রায় পাগলের মতো পাহাড়ের ঢালুতে, এবং নদী উৎরাইয়ে রাতের অন্ধকারে অথবা যখন জ্যোৎস্না থাকত, চাঁদের মরা আলোতে জনহীন প্রান্তর ভীষণ মনে হত তখন জনার্দন দাগ কেটে আপন উদ্যম, সফল উদ্যম মিলিয়ে নদীর তটে বড় বড় পাথর গড়িয়ে দিত। বটফল, বন—আলু এবং ক্বচিৎ কোথাও মৃত পাখি অথবা জীব মিলে গেলে তার মাংস জনার্দনের খাদ্যবস্তু ছিল।
জনার্দন মাঠময় ঘুরে পাহাড়ময় ঘুরে সেই স্থান সেই সংযোগস্থলের সন্ধান খুঁজে পেয়েছিল। সে রাত হলে বড় বড় পাথর গড়িয়ে দিত, নদী এখানে বড় সরু পথ কেটে নেমে গেছে। দু’ধারে পাহাড়, উঁচু মতো পাহাড়, জল নেমে গেলে পাহাড়ের ভিতর হ্রদের মতো জল ধরে রাখবে, শুধু খাদে বড় কিছু পাথর ফেলে দিতে হবে, হাজার পাথর, লক্ষ পাথর। জনার্দন শিশু বয়সের কবিতা আওড়াত—উদ্যমবিহনে কিবা পুরে মনোরথ। শুধু উদ্যম চাই, সফল উদ্যম।
সে একটা পাথর টেনে আনত আর বলত উদ্যম চাই, উদ্যম। মা, মাগো, শক্তি দে। সে আবার পাহাড়ের মাথায় পাথর দোলাত, তারপর পাথরটা নীচে ফেলে দিত, মাগো উদ্যম চাই, উদ্যম। সে সারারাত এক করে ভোরের দিকে হরিণ শিশুদের জলের ব্যবস্থা করে, নিজের জন্য সামান্য জল তুলে সুবচনির মন্দিরে উঠে যেত। ওঠার সময় শুনত, মা—ও যেন বলছেন, উদ্যম চাই জনার্দন, আমরা বড় উদ্যমবিহীন হয়ে পড়েছি।
টুকুনের ঘরেও সেই এক কথা। ডাক্তারবাবু, নার্স, টুকুনের বাবা এবং মা বসেছিলেন। টুকুন এই সময়টাতে একটু হাত—পা মেলে বসার চেষ্টা করে। মা—বাবাকে দেখলে কেমন যেন মনটা নরম হয়। ডাক্তারবাবু ভালোবাসার হাত রাখেন টুকুনের মাথায়।
নার্স টুকুনের বেণী বেঁধে দেবার সময়ে নানারকমের পাখির গল্প করে থাকে। ফুলপরি, জলপরি, স্থলপরি, দেবস্থানে এক রকমের পরি থাকে, ভগবানের কছে অন্যরকমের পরি, আর ডাক্তারবাবু বলছিলেন, সব পাখির এক কথা টুকুন, উদ্যম চাই, বাঁচার উদ্যম। ডাক্তারবাবু টুকুনের বাবাকে বলেছিলেন, মেয়েটার সব উদ্যম শেষ হয়ে গেছে যেন। বেঁচে থাকার স্পৃহা জন্মানো দরকার ওর ভেতরে। নতুবা একদিন শুকিয়ে মেয়েটা কাঠ হয়ে যাবে। কিছুতেই বাঁচানো যাবে না।
সুতরাং এক বাঁচার উদ্যম এই সংসারকে নিয়ত গতিশীল করে রেখেছে। টুকুনের বাবা বললেন, মা, তোমার জন্য আমরা আর কী কী করতে পারি!
টুকুন বলল, বাবা, আমার জন্যে একটা ফুলপরি কিনে আনবে।
বাবা টুকুনকে ফুলপরি এনে দিয়েছিলেন।
টুকুন বলল, বাবা, আমাকে একটা খরগোস কিনে দেবে।
বাবা তাই কিনে দিলেন। আর এভাবেই টুকুনের ঘরটা খেলনায় ভরে গেল। কী নেই এখন টুকুনের ঘরে, জলপরি আছে, ফুলপরি আছে, রাজা আর কুদুমাসি বিড়াল এবং সেই এক বন্দুকধারী সিপাই। টুকুনের বাবা টুকুনের জন্য কোনও অভাব রাখেনি। যা চেয়েছে টুকুন, বাবা সব এনে দিয়েছেন। যেন এখন শুধু টুকুনের জন্য এক রাজপুত্র ধরে আনা বাকি। এনে দিলেই টুকুন এই ঘরের ভিতর স্বর্গরাজ্য তৈরি করে ফেলবে। কারণ টুকুন যেন কী করে জেনে ফেলেছিল—সে মরে যাবে। মরে গেলে মানুষ কী হয়। টুকুনের কী হবে অথবা মৃত্যুর পর টুকুন নিশ্চয় এমন এক স্বর্গীয়রাজ্যের ভিতর প্রবেশ করবে যেখানে তার এই জগৎ থাকবে আর কে থাকবে! সেই সুবল নিশ্চয়ই থাকবে, পাখিয়ালা সুবল, কাঁধে পাখি নিয়ে। বড় পাঁচিল থাকবে একটা, কারণ যারা নরকে যায় তাদের জন্য পাঁচিলের ওপাশে যমপুরী। যমপুরীতে ভূতপ্রেত থাকে। সুবল পাঁচিলের ধারে এসে উঁকি মারলে সে হাত ধরে তাকে তুলে নেবে। তখন বাবা—মা কিছু বলতে পারবে না। সুবল এলেই প্রায় যেন সবকিছু ওর হয়ে যায়। সে হেঁটে চলতে ফিরতে পারবে। সুবলের জন্য তার ভিতরে ভিতরে কষ্ট হচ্ছিল।
টুকুন বলল, বাবা, সুবল বলেছিল কলকাতায় আসবে?
বাবা বললেন, কে সুবল?
—বা, তুমি দ্যাখোনি, ট্রেনে যখন ফিরছিলাম, সেই সুবল, পাখিয়ালা সুবল, আমাদের সঙ্গে আসছিল। মা ওকে স্টেশনে নামিয়ে দিলেন!
টুকুনের বাবা এতক্ষণে মনে করতে পারল!
ডাক্তারবাবু বললেন, কী ব্যাপার সুরেশবাবু?
—আর বলবেন না। আমরা ফিরছিলাম সিমলা থেকে। ট্রেনটা যখন বাংলায় ঢুকছে, রাতের বেলা, কোথাকার সব কতগুলি লোক, কংকালসার চেহারা, আমাদের ট্রেনটাকে আটকে দিল। বলল, জল চাই, জল চাই। বোধহয় খবরটা পত্রিকায়ও পড়ে থাকবেন।
—হ্যাঁ, সেই খরার খবর! জল নেই নাকি দেশটাতে।
—ওরা ট্রেনে উঠে কল খুলে সব জল খেয়ে নিচ্ছিল।
—তারপর!
—তারপর আর কী! ড্রাইভার ভীষণ চালাক। লোকগুলো সব জল যখন চেটে চেটে খাচ্ছিল, সে মশাই জল খাওয়া দেখলে আপনি ভয় পেয়ে যেতেন, জল এভাবে খায় আমার জানা ছিল না, যেন অমৃত পান করছে অসুরেরা। জলের অপর নাম জীবন, সেদিন ট্রেনে প্রথম বুঝেছিলাম। ড্রাইভার দেখল জলের নেশায় পাগল, ড্রাইভার বুদ্ধি করে ট্রেন সহসা ছেড়ে দিল। ব্যস।
—সব নিয়ে রওনা হলেন?
—হ্যাঁ, প্রায় তাই। দলের মধ্যে সুবল ছিল। সুবল আমাদের কামরায় ছিল! ওর একটা পাখি ছিল সঙ্গে, কিছু কীটপতঙ্গ ছিল, শুকনো বটফল ছিল পুঁটলিতে, সে তার পোষমানা পাখি উড়িয়ে দিয়েছিল, পাখিটা উড়লে টুকুনকে আমরা হাততালি দিতে দেখেছিলাম।
ডাক্তারবাবু বললেন, সে এখন কোথায়?
—জানি না। ব্যান্ডেল স্টেশনে দেখি সে নেই।
টুকুন বলল, মা ওকে নামিয়ে দিয়েছে।
ডাক্তারবাবু বললেন, আপনারা দেখেছেন টুকুন হাততালি দিয়েছে।
—হ্যাঁ, আমাদের চোখের সামনে।
—তুমি সে কথাটা বলো। টুকুনের মা টুকুন যে স্বপ্ন দেখেছিল তার কথা মনে করিয়ে দিলেন।
—হ্যাঁ, আর একটা কথা ডাক্তারবাবু, ট্রেনে আমরা ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, সুবল দরজার এককোণায় পোঁটলাপুঁটলি নিয়ে বসেছিল। অন্য স্টেশনে ট্রেন এলে পুলিশ তাড়া করেছিল লোকগুলিকে। সুবল আমাদের কামরায় আছে, টুকুন বলছিল সে হেঁটে গিয়ে দরজা খুলে দিয়েছে। এটা স্বপ্নের মতো ঘটনা, হয়তো টুকুন স্বপ্ন দেখছে।
ডাক্তারবাবু বললেন, ওর সে সময় বাসনা, তীব্র বাসনা, বাঁচার তীব্র বাসনা, জীবনের সুখ—সম্পদে কী কোথায় জীবনের তৃষ্ণা রয়েছে সামান্য সময়ের জন্য বোধহয় ভিতরে ওর সেই তৃষ্ণা জেগেছিল। এই তৃষ্ণা কী করে ফের জাগানো যায়। বেঁচে থাকার তৃষ্ণা, রক্তের ভিতরে তুফান, বুঝলেন সুরেশবাবু, সেই তুফানের কথাই বলছি, রক্তের ভিতরে তুফান তুলে দিতে হবে, ঢেউ, যাকে আমরা তরঙ্গ বলি, বেঁচে থাকার জন্য এই তরঙ্গ তুলে দিতে পারলে আবার টুকুনকে বাঁচাতে পারব। সুবল সেই পাখিয়ালা হয়তো সেই রক্তে সামান্য দোলা দিতে পেরেছিল। ডাক্তারবাবু প্রায় সব কথাই বিশেষ করে রুগি সম্পর্কে কথা বলে ইংরেজিতে বলেছিলেন। সুতরাং টুকুন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়েছিল, সে স্পষ্ট কিছু বুঝতে পারছে না। সে শুধু বলল, মা, আমি জল খাব।
—সেই এক উদ্যমের কথাই বলছি ডাক্তারবাবু। কথাটা বলে ফের কেমন অন্যমনস্ক হলেন। এবং নিজেকেই নিজে বললেন, আমরা বড় উদ্যমবিহীন হয়ে পড়েছি, সুরেশবাবু।
বিকাল মরে যাচ্ছে। ডাক্তারবাবু ওপরে উঠে গেলেন। সুরেশবাবু এবং টুকুনের মা চলে গেল। নার্স সামান্য দুধ গরম করার জন্য কিচেনের দিকে গেছে। বাইরে আলো জ্বলে উঠল। ঘরে হলুদ রঙের আলো, এখন। এই ঘরের চারপাশে সব পুতুল, জলপরি, স্থলপরি। আর কেউ থাকবে না এখন। সুতরাং পুতুল এবং এইসব পরিরা সন্ধ্যার পর টুকুনের সঙ্গে ঘর—সংসার আরম্ভ করে দেয়। টুকুন আপন মনে কথা বলে চলে, এই রাজ্যে তখন টুকুন রানি অথবা রাজকন্যার মতো। সব পরিদেব, সে জলপরি অথবা স্থলপরি হোক, সে রাজা অথবা কুদুমাসি বিড়ালই হোক টুকুনের কথায় উঠতে বসতে হবে। এদিক ওদিক হলে রক্ষা থাকবে না। পরদিন ভোরে নার্সকে বলবে, মাসি বেড়ালটাকে ঘরের বার করে দাও। সারারাত ওটা আমাকে ঘুমুতে দেয়নি, কেবল জ্বালাতন করেছে।
সুবল গাছের নীচে দাঁড়িয়ে বলল, পাখি তুমি বড় জ্বালাতন করছ। উড়ে গেলে আসতে চাও না।
পাখিটা সুবলের মাথায় মুখে ঘুরতে থাকল। যেন পাখিটা সুবলের অভিমান ধরতে পেরেছে। অভিমান ভাঙানোর জন্য নানাভাবে সুবলকে খুশি করার চেষ্টা করছিল উড়ে উড়ে।
সুবলকে এখন দেখলে প্রায় চেনা যায় না। সে কী করে ইতিমধ্যে কিছু অর্থ সংগ্রহ করে ফেলেছে। ওর বাঁ হাতে ছোট কাঠের বাক্স, বাক্সের ভিতর জুতোর ভিন্ন ভিন্ন রংয়ের কালি, ব্রাস, ক্রিম এবং ছোট একটা তোয়ালে। ওর চুল আর বড় নেই, টিকি এখন আরও ছোট করে ছাঁটা। বড় লম্বা জামা আর শরীরে ঢল ঢল করছে না, সুবল প্যান্ট পরেছে একটা, গেঞ্জি গায়ে দিয়ে সমস্ত সকাল জুতা পালিশ করে এখন বিশ্রাম নিচ্ছে। সে গাছের নীচে শুয়েছিল। পাখিটা ঘাসের ওপর লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। সে কিছু চানা কিনে নিজে খেয়েছে, পাখিটাকে খাইয়েছে।
পথের ওপাশে বড় বড় প্রাসাদের মতো বাড়ি। সে ঘাসের উপর শুয়ে বড় সব বাড়ি দেখছিল। জানালায় কত সুন্দর মুখ, সুন্দর মুখ দেখলেই টুকুন দিদিমণির কথা মনে হয়। সে প্রথম ভেবেছিল। কলকাতা গেলেই টুকুনদিদিকে পাওয়া যাবে, সে সেই ডাবয়ালাকে অর্থাৎ সুবল কতদিন সেই ডাবয়ালার ডাব নৌকা থেকে তুলে এনেছে পারে, ডাবয়ালা খুশি হয়ে পয়সা দিয়েছে, তাকে একবার বলেছিল, তুমি জান ডাবয়ালা টুকুনদিদিমণি কোথায় থাকে? লোকটা রাস্তার নাম এবং নম্বর চাইতেই বুঝেছিল সুবল, টুকুনদিদিমণিকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না, এতবড় শহরে টুকুনদিদিমণি হারিয়ে গেল।
এতবড় শহর দেখে সুবলের বিস্ময়ের আর সীমা ছিল না। মাঝে মাঝে মনে হয় যেন জনার্দন চক্রবর্তী ওদের প্রিয় পুরোহিত, গ্রামের এবং অঞ্চলের বাঞ্ছিত পুরুষ যিনি প্রায় সব ধর্মের নিয়ামক তেমন কোনও অসীম এবং অপরিমেয় শক্তিশালী মানুষ, অথবা সে জাদুকর হতে পারে, পির পয়গম্বর হতে পারে যিনি এই শহরকে চালাচ্ছেন। মোড়ে মোড়ে পুলিশ, প্রাসাদে—প্রাসাদে উর্দিপরা দারোয়ান, হাওয়াই গাড়ি, ট্রাম এবং স্রোতের মতো মানুষের মিছিল। সন্ধ্যা হলে রাস্তার সব আলো জ্বলে উঠছে। গাড়িগুলো মোড়ে এসে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। আবার চলতে শুরু করেছে। এতটুকু ফাঁকা জায়গা পড়ে নেই। কেবল বড় বড় অট্টালিকা আর গম্বুজের মতো রহস্যজনক মিনার সুবলকে বড় বেশি আবেগধর্মী করে তুলেছে।
আর মনে হত এই শহরে টুকুনদিদিমণি আছে। এই শহরের কোথাও না কোথাও টুকুনদিদিমণি আছে। সুতরাং সুবল যখনই সময় পেত, পথ ধরে হেঁটে যেত, গাড়ি দেখলে এবং ফ্রক পরা মেয়ে দেখলে চোখ তুলে তাকাত যদি টুকুনদিদিমণি হয়, যদি টুকুন তার জন্য কোনও জানালায় মুখ বার করে রাখে। সে ভোরের দিকে কাজ করত, সুবল একা মানুষ। কোনও আত্মীয় নেই, বন্ধু—বান্ধবহীন সুবলের আয় থেকে কিছু কিছু সঞ্চয় হলে সে বাসে উঠতে পারছে, সে ঘুরে ঘুরে কাজ করছে।
সে কখনও এক জায়গায় বসছে না, প্রায় শহরটাই যখন মেলার মতো, প্রায় শহরটাই যখন উৎসবের মতো সেজে আছে এবং যেখানে বসা যায় সেখানেই দু’পয়সা সংগ্রহ হচ্ছে তখন এক জায়গায় বসে কী লাভ। এই ঘোরা, কাজের জন্য ঘোরা এবং টুকুনদিদিমণির জন্য ঘোরা সুবলের একটা বাই হয়ে গেল। শুধু দুপুর হলে সে গড়ের মাঠে চলে আসত। এসময় সুবলের প্রিয় পাখি আকাশে উড়তে চায়। পাখিটা না উড়লে ওর পা স্থবির হয়ে যাবে, পাখি স্থবির হয়ে যাবে ভেবেই সুবল ঠিক দুপুরে, যখন রোদে খা খা করছে সারা মাঠ, যখন দুর্গের উপর কবুতর ওড়ে এবং যখন প্রায় পাখিরা দুপুরের অবসাদে গাছের ডালে অথবা অন্য কোনও ছায়ায় চুপটি মেরে ঠোঁট পালকে গুঁজে পড়ে থাকে তখন সুবল আকাশে পাখিটাকে উড়িয়ে দেয়। পাখিটা উড়তে উড়তে কোথায় যেন চলে যায়। আর দেখা যায় না।
রোদের জন্য আকাশের দিকে বেশিক্ষণ চোখ তুলে তাকাতে পারে না সুবল। সে পাখিটার জন্য দাঁড়িয়ে থাকে। ওর এক হাতে বাক্সটা তখন খোলা, অন্য হাতের মুঠোয় সে রোদের ভিতর অনেকটা ঠিক আকবর বাদশার মতো হাতের মুঠোয় পাখি রাখার জন্য গর্বে আত্মহারা। অথবা পাখি উড়ে উড়ে যখন ক্লান্ত হয়, পাখি যখন সুবলের কাছে ফের ফিরে আসে এবং মুঠোয় বসে চারদিক তাকায় তখন সুবলের এক প্রশ্ন, টুকুনদিদিমণিকে পেলি?
পাখি পাখা ঝাপটাল, ফের উড়তে চাইল। সুবল বুঝল, না টুকুন দিদিমণিকে পাখিটা খুঁজে পায়নি। সুতরাং সে বলত, বেশ হয়েছে বাপু, এবার চলো চুপটি করে আমার কাঁধে বসে থাকবে। এখন আর রোদে রোদে তোমায় ঘুরতে হবে না।
এই পাখি যেন সব বোঝে। সুবলের দুঃখের দিনে এ পাখি ছিল, সুখের দিনেও এই পাখি। সে বলল, টুকুনদিদিমণি কোথায় যে গেল।
পাখি বলল, কিচ কিচ। পাখি সুবলের সঙ্গে কথা বলতে চাইল।
সুতরাং সুবলের এখন এক কাজ। টুকুনকে খুঁজে বের করতে হবে। কোনও ঠিকানা নেই টুকুনের। এতবড় শহর তবু সুবল হার মানল না। সকালের দিকে দুজনের মতো রোজগার হয়ে গেলেই সুবল পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়ায়। জানালায় জানালায় উঁকি দিয়ে দেখে, পার্কের ভিতর ফ্রক পরা মেয়ে দেখলে টুকুনদিদিমণি যদি হয়, সে প্রায় পাগলের মতো এই শহরে টুকুনকে অনুসন্ধান করে বেড়াচ্ছে, পার্কে, বড় রাজপথ, গঙ্গার ধারে, এবং বড় বড় বাড়িতে উঠে যেত কাজ নিয়ে। সে কাজের ফাঁকে শুধু কীসের প্রত্যাশা করত যেন।
সুবল ওর পাখিকে পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছিল অনুসন্ধানের জন্য। যখন ওর শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়ত, যখন অবসাদে শরীর চলতে চাইত না, সুবল ওর পাখি ছেড়ে দিত, দেখ যদি তুই কোথাও টুকুনকে খুঁজে পাস। সুবল এক সরল বালক, পাখি এক অবলা জীব, শহরের মানুষেরা সুবলকে দেখলে এবং ওর পাখি দেখলে কৌতুক বোধ করত। সুতরাং সুবল পাখিটার জন্য একটা দাঁড় কিনে নিয়েছে। পাখিটা দাঁড়ে বসে থাকত। সুবল মাঝে মাঝে যখন হাতে কাজ থাকত না আর ঘুরে ঘুরে আর শরীরও যখন দিচ্ছে না, তখন বলত, পাখি তুই আগে ছিলি কার?
পাখি বলত, কী বলত—সরল না হলে বোঝা যায় না, পাখি বলত বুঝি রাজার!
সুবল, মনে মনে এবার বলত, এখন কার?
—এখন তোমার।
—হ্যাঁ তবে দেখ উড়ে, সেই দিদিমণি আমাদের কোথায়! তারপর পাখি উড়তে থাকত। দেওয়ালের পাশে, জানালায়, অথবা সদর পথে এক সোনার পাখি উড়ে যেত। পাখির সরল চোখ জানালায়, ঘরের ভেতর এবং রুগণ যুবক—যুবতী অথবা ছোট মেয়ে দেখলে শিয়রে বসে দেখত সেই টুকুন কিনা। সুবলের পাখি, ভালোবাসার পাখি হয়ে শহরময় উড়ে বেড়াচ্ছে। পাখি উড়ে উড়ে কত দৃশ্য দেখতে পেল, শহরে বড় লাল বাড়িতে কারা যেন জড়ো হয়েছে, রাস্তায় মানুষের কী ভিড়, আর পুলের উপরে সম্রাট সিজার যেন মিশর দেশ জয় করে ফিরছেন, এক অলৌকিক ঘটনার মতো, পাখি এসে দাঁড়ে বসে গেল এবং কিচ কিচ করে উঠল।
সুবল বলল, পেলি না।
পাখি কিচ কিচ করে উঠল।
—না পেলে আর কী করবি।
সুবল বলল, টেরিটিবাজার থেকে তোর জন্য কীটপতঙ্গ কিনে এনেছি। খা। বলে সুবল দাঁড়ের উপর ছোট পেতলের বাটিতে কীটপতঙ্গগুলো রেখে দিল।
আর তখনই মনে হল শহরের উপর দিয়ে দলে দলে লোক ছুটছে, ওদের কণ্ঠে চিৎকার, অন্ন চাই, বস্ত্র চাই। সুবলের মনে হচ্ছিল ওরা সব বলছে সকলে, শুধু বলছে না, উদ্যম চাই। আমরা কেমন যেন উদ্যমবিহীন হয়ে পড়েছি, একথা কেউ বলছে না।
সুবলের ইচ্ছা হল চিৎকার করতে, বলুন আপনারা উদ্যম চাই। উদ্যম। উদ্যম বিহনে কিবা পূরে মনোরথ। পাঠশালায় জনার্দন ঠাকুর ওদের পড়াত, উদ্যম বিহনে কিবা পূরে মনোরথ।
সুবলের এই করে শহরটা প্রায় ঘোরা হয়ে গেল ক্রমশ। শহরের সর্বত্র সে এক উদ্যমবিহীন জীবন দেখতে পেল যেন। অফিসে, কাছারিতে, মাঠে ময়দানে এবং সব নেতা গোছের মানুষদের মুখেও সব কথার উল্লেখ আছে, শুধু উদ্যমবিহীন হয়ে পড়েছি, এ—কথা কেউ বলছে না। অফিসে কাছারিতে এবং বড় পার্কের ভিতর মানুষের কথাবার্তা থেকে এসব ধরতে পারত।
সকলের কথায় কী এক আক্রোশ যেন, কেউ সুখী নয়, এত বড় কলকাতা শহর দেখে সে যা ভেবেছিল, সুখের নগরী, দুঃখ নেই, অভাব নেই, জল, অন্ন—বস্ত্র সব কিছু আছে যখন, যখন আলোময় এই শহর, যখন বড় বড় হলঘরের মতো হোটেল ঘর, দেব—দেবীর মন্দির রয়েছে, মানুষের দুঃখ তখন থাকার কথা নয়।
কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এখানে শুধু দুঃখই আছে, ফুটপাতে মানুষের দৈন্য, পাগলের প্রাদুর্ভাব বড় বেশি শহরে। এই দুঃখের নগরীতে সুবলের যেন আজকাল আর ভালো লাগছে না। ওর মনে হল সেই সব বরিষের দিন, মাঠে মাঠে ধান, গোয়ালে গোরু, সে গোরু নিয়ে মোষ নিয়ে বের হয়ে গেছে মাঠে, মাঠে মাঠে ফসলের দিনগুলি অথবা আদিগন্ত সবুজ মাঠ শুধু, সে দৌড়ে বেড়াত, মাঠের ভিতর কেবল কী যেন এক রহস্য। গ্রামের অন্য রাখাল বালকের সঙ্গে গুলি খেলা, কোনও বড় অর্জুন গাছের নীচে বসে থাকা, অথবা বুনো মানুষ হরিপদর মুখে—অঞ্চলের ভিন্ন ভিন্ন ভৌতিক গল্প শুনতে শুনতে তন্ময় হয়ে যাওয়া—হায় সেই দেশে কী করে এমন খরা এসে মরুভূমির মতো হয়ে গেল, সুবল চোখ বুজে বলল, মা সুবচনি জল দে। যদি জল হয়, যদি খাদ্য হয়, যদি মাঠে মাঠে ফের গোরু মোষ নিয়ে বের হওয়া যায়, কিন্তু কে খবর দেবে, কে বলবে দেশটাতে ফের বর্ষা নেমেছে, দেশটাতে আবার সোনার ফসল ফলবে—কার এমন উদ্যম আছে—ফের মাঠে সোনার ফসল ফলার, বরিষের দিনে জল কোথাও ধরে রাখে, অজন্মা অথবা খরা এলে সেই জলে মানুষ স্নানাহার করবে।