টুকুনের অসুখ – চার
তখন ট্রেনটা ব্যান্ডেল স্টেশন থেকে ছাড়ব ছাড়ব করছে। সুবল কামরা থেকে নেমে গিয়েছিল, নেমে গিয়ে দেখল বড় একটা চোঙ দিয়ে আকাশ ফুঁড়ে যেন জল পড়ছে। এত জল! সে অবাক হয়ে তাকাল পশ্চিমের দিকে, সেখানেও বড় একটা চোঙ থেকে জল পড়ছে আকাশ থেকে। এত জল। সুবল দেখল নীচে ছোট ছোট টিপকল, কেবল জল আর জল। সে তাড়াতাড়ি পোঁটলাপুঁটলি রেখে জলে স্নান করে নিল। জল আর জল। চোখ—মুখে জল পড়তেই শরীরের সব অবসাদ কেটে গেল। যেন সমস্ত শরীরে ঈশ্বর তাঁর ঠান্ডা হাতের স্পর্শ দিচ্ছেন। সে কলের নীচে শুয়ে বসে লাফিয়ে স্নান করল। ওঃ, কী ঠান্ডা জল! ওঃ কী আরাম!
কিন্তু একজন নীল উর্দিপরা লোক এসে হেঁকে উঠতেই সে ভয়ে ভয়ে কলের নীচ থেকে বের হয়ে গা—শরীর মুছে যখন প্ল্যাটফর্ম ধরে হাঁটছিল তখনও ট্রেনটা দাঁড়িয়ে আছে। জেবের ভিতর পাখিটা আছে কিনা দেখে নিল সুবল, তারপর ছুটে গিয়ে সেই কামরার জানালায় দাঁড়িয়ে হাঁকল, টুকুন দিদিমণি, আমি স্নানটা সেরে নিলাম।
সুবলের মুখ কী সতেজ, আর কী এক গ্রাম্য সরলতা—আশ্চর্য সরল চোখ সুবলের। স্নান করার জন্য চুল থেকে এখনও টুপটাপ জলের ফোঁটা মুখে শরীরে পড়ছে। সেই লম্বা জামা গায়ে, পোঁটলাপুঁটলি কাঁধের দু’ধারে ঝোলানো—প্রায় তীর্থযাত্রীর মতো দেখতে। একটা শুকনো ডাল হাতে এবং বাঁশের চোঙটা পিঠের ডানদিকে ঝুলছিল।
টুকুন ওর সরল গ্রাম্য চোখের দিকে কিছুক্ষণ অপলক তাকিয়ে থাকল। তারপর বলল, সুবল, তুমি কলকাতায় গেলে আমাদের বাড়ি এসো।
—যাব দিদিমণি।
—তোমার পাখিটা কোথায় সুবল?
—পাখিটা জেবের ভিতর বটফল খাচ্ছে দিদিমণি।
—তোমার পাখিটা আর একবার উড়বে না?
—উড়বে না কেন? বলে সে হাত দিল পকেটে। তারপর পাখিটাকে কাঁধে বসিয়ে দিল। তারপর এই প্ল্যাটফর্মে পাখিটা সুবলের মাথার চারপাশে ঘুরে ঘুরে জেবের ভিতর ঢুকে গেল।
টুকুন বলল, তুমি আমাদের বাড়িতে গেলে আমি আবার পাখির খেলা দেখব। বলতেই ট্রেন—টা ছেড়ে দিল। সুবল গাড়িটার সঙ্গে হেঁটে হেঁটে গেল। সুবল, টুকুন দিদিমণিকে একটা চন্দনের বীচি, একটি পাথর এবং সেই দুর্মূল্য কুঁচফল দেবে ভেবেছিল, এত তাড়াতাড়ি ট্রেন ছেড়ে দেবে তার মনে হয়নি। সে পোঁটলা খুলে দিতে গিয়ে দেখল ট্রেনটা সামান্য চলছে। সে পোঁটলা থেকে চন্দনের বীচি একটি পাথর ও সেই দুর্মূল্য কুঁচফল বের করে গাড়ির সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে টুকুনের হাতে দিল। সে দাঁড়িয়ে থাকল। চারদিকে অপরিচিতি জন, পাখিটা জেবের ভিতর খুঁটে খুঁটে কেবল ছোলা খাচ্ছে, আর একটা ট্রেন এসে এই মাত্র থামল প্ল্যাটফর্মে। সব মানুষেরা গাড়ি থেকে লাফিয়ে নামছে কিন্তু বড় নির্জন মনে হল জায়গাটা। যেন সেই পরিত্যক্ত মাঠ এবং পাহাড়ের মতো এই প্ল্যাটফর্মে শুধু হাহাকারের দৃশ্য। কোথাকার একটা ট্রেন তার প্রিয় দিদিমণিকে নিয়ে চলে গেল।
সুবলের দীর্ঘদিন পর আজ মা’র কথা মনে হল। মেলার কথা মনে হল। সুবচনি দেবীর মন্দিরে ফসল ঘরে এনে যে উৎসব হত তার কথা মনে হল—সে মেলায় বিদেশ থেকে কত লোক আসত, বাজিকর আসত, সাপের পেটে মানুষের মুখ, একটা মানুষের তিনটে মুখ, তিনটে মানুষের একটা মুখ, বড় বড় কাচের বৈয়াম, আর তার ভিতর কিম্ভূতকিমাকার সব মানুষ, অথবা মাঠের শেষ দিকে বড় তাঁবু, সার্কাসের খেলা, হাতি, বাঘ, সিংহ, একটা মেয়ে তারে ঝুলে খেলা দেখাত। একটা ট্রেন গাড়ি তার টুকুন দিদিমণিকে নিয়ে চলে গেল—এসব দৃশ্য চোখের ওপর ভাসতে থাকল সুবলের। আর একটা ট্রেন এসে থেমেছে। ট্রেন চলে যাবে এবার। সুবল ধীরে ধীরে প্ল্যাটফর্মে বসে ওর পোঁটলাগুলো ফের বেঁধে নিল। তারপর যাকে সামনে পেল তাকেই শুধাল, এই ট্রেন কর্তা, কলকাতা যাবে না?
কে যেন বলল, যাবে।
সে সঙ্গে সঙ্গে ট্রেনে উঠে গেল। ট্রেনটা নীল রঙের। বড় হাতল ঝুলছে। সুবল বয়েস অনুযায়ী লম্বা এবং পায়ের পেশী পাহাড়ে ওঠানামার জন্য বড় শক্ত। সে এক পাশে ভিড়ের ভিতর একটা হাতল ধরে দাঁড়িয়ে থাকল। এখন আর মনে কোনও গ্লানি নেই। ট্রেনটা ওকে কলকাতা নিয়ে গেলে সে টুকুন দিদিমণির কাছে চলে যেতে পারবে।
আর এ—সময়ই সুবলের মনে হল ভীষণ ক্ষুধা পেটে। সে তার সঙ্গের শুকনো বটফল থেকে একটা দুটো করে মুখে পুরে দিতে থাকল। সে বটফল চিবুচ্ছে আর দু’পাশের বড় বড় কলকারখানা দেখে কেবল বিস্মিত হচ্ছে। মনে হচ্ছে সে যেন কোনও এক রাজার দেশে চলে এসেছে। যেন এখানে অন্নের অভাব নেই। অন্ন চাইলেই অন্ন। জলের অভাব নেই, জল চাইলেই জল। আর ভালোবাসার অভাব নেই, টুকুন দিদিমণি রাজ্যের সব ভালোবাসা তার জন্য সঞ্চয় করে রেখেছে। তার মনে হল, কলকাতায় পা দিলেই সে রাজা বনে যাবে।
সুবল দেখল তার গাড়ি আশ্চর্য এক নগরীর ভিতর ঢুকে যাচ্ছে। সে চোখ মেলে যত দেখছে তত বিস্মিত হচ্ছে। বড় আশ্চর্য এক নগরী, চারিদিকে বড় বড় প্রাসাদের মতো বাড়ি, সেই সুসনের রাজবাড়ির মতো, কবে একবার বাবা তাকে রাজবাড়ি দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল, কবে একবার সে ছোট বেলায় গল্পের বইয়ে রাজবাড়ির গল্প পড়েছিল, চারিদিকে বড় বড় অট্টালিকা, চারিদিকে বাঁধানো রাস্তা। বড় বড় দেবদারু গাছ, গাছে গাছে রুপোর পাতা, সোনার ফল, নীচে বনের ভিতর সোনার হরিণ—এ যেন সেই রাজার দেশ, লাইনের ওপর তার, আর আশ্চর্য এক লম্বা ঘরের ভিতর তার গাড়ি ঢুকে গেছে, নানারকমের নীল লাল রঙের বাতি, বেগুনি রঙের বাতি, কত হাজার হাজার লোক, সব রাজবাড়ির রাজপুত্রদের মতো ফিটফাট, কোথাও কোনও অপরিচ্ছন্নতা নেই, ঝক ঝক করছে সবকিছু।
অথচ কেউ দাঁড়িয়ে একমুহূর্ত গল্প করছে না, সকলে নিজের মতো হেঁটে যাচ্ছে। সকলে ব্যস্ত। সকলে যেন কোথাও কোনও নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যাচ্ছে। অথবা কোথাও বড় এক রাজবাড়ি আছে, সকলে সেই রাজবাড়ির উদ্দেশে ছুটছে।
সুবল ভিড়ের ভিতর দেখল ডান পাশের লোহার গেটে চেকারবাবু কার সঙ্গে পয়সার হিসাব করছেন গোপনে, মনে হল, চেকারবাবুর হাতে কে পয়সা গুঁজে দিল। সুবল দাঁড়িয়ে থাকল। ওর কাছে পয়সা নেই, টিকিট নেই। এখন টুকুন দিদিমণি নেই যে ওকে গেট পার করে দেবে। এই লোহার দরজাটার কাছে এসেই সুবলের ভয়ে পা সরছিল না। সে একপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল, ভিড় কমলে চেকারবাবুকে বলবে, বাবু আমার পয়সা নেই, আমার কিছু বটফল আছে, কিছু পাথর আছে আর আছে এক পাখি। আমি বাবু আমার পাখির খেলা দেখাতে পারি। বাবু পাখির খেলা দেখলে আপনি খুশি হবেন। খুশি হলে বাবু ওকে ছেড়ে দেবে এই ভেবে সুবল একটু পিছনের দিকে সরে তাকাতেই দেখল—ট্রেন, মেলা ট্রেন, কেবল ভোঁস ভোঁস করছে ট্রেন। মানুষ আর লটবহর চারিদিকে। লোহার রেলিং পার হলে ফলের দোকান। চারিদিকে এত প্রাচুর্য, এত সম্পদ, এত মানুষ, এত জল—সুবল ক্রমশ কেমন বিহ্বল হয়ে পড়ছে।
তখন চেকারবাবু ডাকলেন, এই ছোকরা, ওখানে কী হচ্ছে। টিকিট কোথায়?
—বাবু টিকিট নেই।
চেকারবাবু দেখলেন সুবলকে এবং চেহারা দেখে না হেসে পারলেন না। ভিখারির মতো জামাকাপড় গায়ে কতরকমের পোঁটলা ঝুলছে কাঁধে, হাতে লাঠি এবং পিঠে বাঁশের চোঙ। একেবারে বহুরূপী।
অন্য চেকারবাবু বললেন, ঠিক শালা খরা অঞ্চলের লোক। উপদ্রব বাড়ছে।
—কী করে হবে! ওরা তো দল বেঁধে আসছে। এ তো একা।
—দল ছুট। দেখে বুঝতে পারছ না?
সুবল দেখল বাবু দু’জন ওকে দেখে খুব হাসাহাসি করছে। সুবল যেন সাহস পেল এবার। কাছে গিয়ে বলল, বাবু আমাকে ছেড়ে দিন। আমার পয়সা নেই। এই দেখুন বলে সে তার জেব উলটে দেখাতে গেলে পাখিটা উড়ে এসে ওর মাথার ওপর বসল। আর সঙ্গে সঙ্গে চেকারবাবু দু’জন বলল, শালা ভোজবাজি জানে। জেব উলটে পয়সা নেই দেখাতে গেল আর শালার জেব থেকে পাখি উড়ে এসে মাথায় বসল। পয়সার বদলে পাখি!
চেকারবাবু বললেন, খুব তো ভোজবাজি শিখেছ।
—না কর্তা। কোনও ভোজবাজি নেই। পাখি আমার পোষা। ও জেবের ভিতর থাকে। খুব নাছোড়বান্দা না হলে চোঙের ভিতর ভরে রাখি না। বলে সে পিঠ থেকে বাঁশের চোঙা এনে উলটে দেখাল। তারপর একটু হেসে খুব বিনীতভাবে বলল, যাব কর্তা? শুকনো বটফল ছিল পোঁটলাতে, কথা বলতে বলতে দুটো একটা বটফল মুখে পুরে দিচ্ছিল।
এখন যথার্থই যেন সুবলের কোনও ভয় ছিল না। কোনও ডর ছিল না। চেকারবাবুরা ওকে কোনও আর ভয়ও দেখাচ্ছে না, কেমন আলগা করে পথ ছেড়ে দিলেন। সুবল পাখির খেলা দেখানোর জন্য চেকারবাবু দু’জন বোধহয় খুশি। সে প্রায় চুপি চুপি বের হয়ে সোজা স্টেশনের কাউন্টার পর্যন্ত হেঁটে এল। প্রায় মুক্ত এখন সুবল। সে ঘুরে ফিরে এতবড় স্টেশন দেখতে থাকল। চারদিকের এই প্রাচুর্য ওকে জীবনযাপন সম্পর্কে আর কোনও ভয়ের উদ্রেক করতে পারল না। যখন এত প্রাচুর্য, এত জল আর এত সুখী মানুষের ভিড় তখন সামান্য এক সুবলের আহারের জন্য ভাবনা কী। সে প্রায় লাফিয়ে হাঁটতে থাকল, ঘুরতে থাকল এবং ছবির মতো, রাজারানির মতো আর নদীর জলের মতো পরিচ্ছন্ন এই স্টেশনের চারদিকটা দেখতে পেয়ে সে আনন্দে প্রায় শিস দিয়ে উঠল।
কোনও গ্রাম্য সংগীত ও শিসে বাজাচ্ছিল। আর ওর মুখের শিস শুনে পাখি পর্যন্ত আত্মহারা। পাখি এবং সুবল এমন একটা দেশে চলে এসেছে—এমন প্রাচুর্যের দেশ, ভাবল সে। বাইরে বের হতেই দেখল বড় বড় দোতলা সব বাসগাড়ি, ট্রামগাড়ি দৈত্যের মতো—সেই যেন আলাদীনের প্রদীপ, যা চাওয়া তাই পাওয়া যায়। আলাদীনের পোষা দৈত্যের মতো সব ট্রামগাড়ি, বাসগাড়ি সুবলের জন্য এবং ওর পাখির জন্য প্রতীক্ষা করছে। সুবল বলল, রোস। আমরা আসছি। কারণ ডানদিকে কিছুদূর হেঁটে গেলে জল, টিপকল থেকে কেবল জল পড়ছে।
সে জলের নীচে ফের ছুটে গিয়ে দাঁড়াল। পাখিকে জল খাওয়াল, স্নান করাল। এবং শান্তশিষ্ট বালকের মতো সে তার ভিজা নেংটি কাপড়, জামা সব রেলিঙ—এ শুকোতে দিলে।
এখন নদীর জলের ওপর সব বড় জাহাজ ভাসছে, কোথাও আকাশের নীচে লম্বা ম্যাচ বাক্সের মতো বাড়ি, ডানদিকে বড় একটা পুল, মাথায় সারি সারি সব পাখি বসে রয়েছে আর সব ঠেলাগাড়িতে আলু, ফুলকপি, শাকসবজি হরেক রকমের কত তরমুজ এবং ফল যাচ্ছে। সে অপলক দেখতে দেখতে সেই বৃদ্ধ পুরোহিতের কথা ভাবল। তিনি সামান্য জলের জন্য কী না করেছেন। পাগলের মতো পাহাড়ের নীচে, সমতলভূমিতে, নদীর ঢালু অঞ্চলে এবং পাহাড়ের গিরিপথে জলের জন্যে হন্যে হয়ে ঘুরেছেন। হায়, যদি মানুষরা কলকাতার এত প্রাচুর্যের কথা জানতে পারত। তা হলে বুঝি তিনি সব ফেলে, তাঁর সুবচনি মন্দিরে তেলসিঁদুর ধান—দূর্বা ফেলে এখানে চলে আসতেন।
ঠিক তক্ষুনি এক বৃদ্ধ যেন সেই জনার্দন চক্রবর্তী, সে কাছে গিয়ে ভালো করে দেখার চেষ্টা করল—না, জনার্দন ঠাকুর নয়, অন্য মানুষ, তেমনি লম্বা জোয়ান মানুষ, মাথায় সাদা চুল, চোখ বড় বড়, পায়ে হরেক রকমের রঙবেরঙের কানি বাঁধা, হাতে পায়ে গলায়! ঠিক ফকির দরবেশের মতো মুখ—কেবল হেঁকে যাচ্ছে। কী হাঁকছিল বোঝা যাচ্ছে না—খুব সন্তর্পণে কান পাতলে ওর অস্পষ্ট কথা ধরা যাচ্ছে। সে দু’হাত ওপরে তুলে নাচছিল, গাইছিল এবং মাঝে মাঝে কলকাতা শহরকে যেন সে জরিপ করছে—একটা ফিতা ছিল হাতে, সে ফিতা দিয়ে কী যেন কেবল মাপছে মাঝে মাঝে। সুবল বুঝল মানুষটা তবে জনার্দন চক্রবর্তী নয়। সুবল রেলিং থেকে ওর জামাকাপড় তুলে নিল। তারপর এক অনির্দিষ্ট যাত্রা। এই শহর এতবড় শহর ঘুরে ঘুরে দেখা। কিছু আহারের ব্যবস্থা করতে হয়। সুবল আহার সংস্থানের নিমিত্ত চারিদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে হাঁটতে থাকল।
তখন টুকুন হাসপাতালের এক ঘরে শুয়ে ছিল। জানালার পাশে টুকুনের বিছানা। স্প্রিং—এর খাট। মাথার দিকটা একটু ওপরের দিকে তোলা। টুকুন সামনের জানালা দিয়ে মাঠ দেখতে পাচ্ছিল। জানালার নীচে পথ, পথের ওপর এক ফুচকাওয়ালা ফুচকা বিক্রি করছে। বড় গরম চারিদিকে। বৃষ্টি নেই, টুকুন গরমে হাঁসফাঁস করছিল দুপুর থেকে।
এখন বিকেল সুতরাং এখন ফুচকাওয়ালা ফুচকা নিয়ে বের হয়েছে। এখন বিকেল সুতরাং মাঠে মাঠে খেলার দৃশ্য আর পার্কের ভিতরে ছোট বড় ছেলেমেয়ে সব খেলতে এসেছে। ওরা ঘাসের ওপর ছুটাছুটি করছিল।
টুকুন জানালা থেকে সব দেখতে পাচ্ছে। একটা গাছে কিছু ফুল ফুটে আছে—কী ফুল হবে, বোধহয় নাগেশ্বর ফুল, ফুলের সৌরভ সব পার্কটা কেমন আমোদিত এবং বোধ হয় এই সব ফুলের সৌরভের জন্য নানারকমের পাখি উড়ে এসেছে, পাখিগুলো উড়ছিল, পাতা উড়ছিল, পাখিগুলো উড়ে উড়ে ডালে বসছে, ঠিক যেন সুবলের পাখি! সুবল, এক পাখিওয়ালা সুবল এই শহরে এসে নানা জাতের সব পাখি ছেড়ে দিয়েছে আকাশে।
কিন্তু রাস্তার অন্য দৃশ্য। রাস্তার ওপর বড় মিছিল। মিছিলের আগে একটা মানুষ লাঠি হাতে হেঁটে যাচ্ছে। পেছনে একদল মানুষ, ওদের হাতে নানা রঙের ফেস্টুন, ভিন্ন ভিন্ন লেখা, বাঁচার মতো খাদ্য দিতে হবে, চোরাকারবারি বন্ধ করতে হবে, অথবা যেন বলার ইচ্ছা সকলের, আমাদের দাবি মানতে হবে, না মানলে সংসারে সব আগুন লাগিয়ে দেব।
অথবা টুকুন মাঝে মাঝে এমন সব দৃশ্য দেখতে পায় যা মনকে ব্যথিত করে। সামনে একটা—বোধ হয় ওটা শাল—শিমুল জাতীয় গাছ, গাছের নীচে প্রায় উলঙ্গ সব কাচ্চাবাচ্চা, প্রায় নগ্ন সব যুবক— যুবতী রাতে শুয়ে থাকে। ভোর হলেই ওরা কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে যায়। আর টুকুনের চোখে ঘুম নেই বলে, শেষ রাতের দিকে কেবল মনে হয় ঘোড়ার গাড়িতে অথবা গোরুর গাড়িতে কারা যেন শহরে কেবল কীসব ভোজ্যদ্রব্য নিয়ে আসছে চুরি করে। অথবা মাঝে মাঝে রাত গভীরে শহরের সব অলিগলিতে কীসের যেন ফিসফিস শব্দ, ওরা যেন এক ষড়যন্ত্র করছে।
ভোর হলেই টুকুন দেখতে পায় এক ছোট্ট বালক কাঁধে মই নিয়ে দেয়ালে দেয়ালে কেবল পোস্টার মেরে যাচ্ছে। ওর একদিন বলতে ইচ্ছা—এই পোস্টারয়ালা, তোমার পোস্টারে কী লেখা আছে?
হয়তো সেই পোস্টারয়ালা জবাব দেবে—কী করে বাঁচতে হয় তার কথা লেখা আছে।
আমার পায়ে শক্তি নেই, আমার শরীর ক্ষীণ হয়ে আসছে, আমি আর বাঁচব না বুঝি। পোস্টারয়ালা, তোমার পোস্টারে আমার বাঁচার কথা লেখা নেই? টুকুনের আরও যেন কীসব প্রশ্ন করার ইচ্ছা। শাল—শিমুলের নীচে যুবক—যুবতীরা কেন রাতে শুয়ে থাকে, অন্ধগলিতে রাতে কারা ফিসফিস করে কথা বলে, কত রকমের ভোজ্যদ্রব্য চুরি যাচ্ছে শহরে, গ্রামে, কেবল মানুষেরা আপন স্বার্থের জন্য সঞ্চয় করে যাচ্ছে, অন্যের জন্য ভাবনা নেই, এমন কেন হয়, টুকুনের ঘুম আসে না রাতে, কেবল দুঃস্বপ্ন।
মা—বাবা বিকালে আসেন, ওঁদের মুখ বড় করুণ, বাবা সারাদিন অফিস করেন, কত হাজার টাকা বাবা রোজগার করেন, বাবা টুকুনের কাছে বীরপুরুষের মতো, মা বাবাকে আদৌ সমীহ করেন না, মা কেমন গোমড়ামুখো অথবা টুকুনকে এই যে নানারকমের খেলনা কিনে দিয়ে যাচ্ছে—গোটা ঘর ভর্তি খেলনা, রাতে ওরা টুকুনের সঙ্গে কেবল কথা বলতে চায়, কিন্তু টুকুন সামান্য তাজা মুখ নিয়ে যখন কথা বলতে থাকে তখন বড় বেড়ালটা মিউ মিউ করে কাঁদে। টুকুনের রাগ হয়। তুমি কাঁদবে না, কাঁদলে তোমাকে বাছা জলে ফেলে দেব।
গোটা ঘর ভর্তি খেলনা। টুকুনের মাঝে মাঝে মনে হয় খেলনাগুলো সব নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে। হাসি—মশকরা করছে। যেন টুকুনই এখন ওদের খেলনা হয়ে গেছে। কারণ টুকুন বিছানা ছেড়ে ওদের কাছে যেতে পারে না, হাঁটতে পারে না। দিনের বেলায় শুধু জানালা দিয়ে সামনের মাঠ দেখে, এবং মাঠ, গাছ, পাখি আর পথের বিচিত্র সব মানুষদের দেখতে দেখতে তন্ময় হয়ে যায়। ওর তখন সব ছেড়েছুড়ে ছুটতে ইচ্ছা হয়। কিন্তু হায়, পায়ে একেবারে শক্তি পাচ্ছে না। হায়, সেই পাখিয়ালা যে টুকুনকে হাসিয়েছিল, যার জন্য টুকুন তালি বাজিয়েছিল এবং যে মানুষের জন্য টুকুন দরজা পর্যন্ত হেঁটে যেতে পেরেছিল, সেই মানুষের আর দেখা নেই।
টুকুনের বাঁ—দিকে বড় একটা পুতুল ছিল, টুকুন দেখল পুতুলটা যেন ওর দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসছে। সামান্য গোঁফের রেখা আছে পুতুলটার মুখে, পুতুলটার নামও আছে একটা, টুকুন চিৎকার করে উঠল, রাজা, এক থাপপর মারব। খুব হাসা হচ্ছে! সব খেলনাগুলো ভয়ে যেন কাঠ হয়ে গেল।
টুকুন সকলের দিকে চোখ বুলিয়ে নিল। তারপর বালিশের নীচ থেকে চন্দনের বিচি, পাথর এবং কুঁচ ফল বের করে দেখাল রাজাকে এবং অন্যান্য পুতুলগুলিও ওর দিকে যেন চন্দনের বিচি, লাল—নীল পাথর, কুঁচ ফল দেখার জন্য এগিয়ে এল। টুকুন এবার বলল, বুঝলি রাজা আমি মিথ্যা বলি না। এই দেখ, সুবল আমাকে কত কিছু দিয়েছে। সুবলকে পুলিশ ধরতে এসেছিল, আমি নিজে পায়ে হেঁটে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছি। সঙ্গে সঙ্গে রাজা এবং কুদুমাসি বিড়াল সকলের হয়ে আদাব দিল টুকুনকে। তারপর টুকুন তাচ্ছিল্যভরে ওদের শোনাল, দেখিস সুবল এলে আমি তোদের হেঁটে দেখাব। সুবল জাদুকর, সে জাদুর পাখি রেখেছে কাঁধে। সে পাখি উড়িয়ে দিলেই আমি তোদের কাছে হেঁটে চলে যেতে পারব।