টুকুনের অসুখ – তিন
তখন খোলা আকাশের নীচে একটা গাছ, কী গাছ হবে, চড়ুইগাছ অথবা অর্জুন গাছ হতে পারে। গাছে পাতা নেই, রোদ এসে মুখের ওপর পড়ছে, প্রথমে মনে হচ্ছিল কেউ অন্ধকার রাতে ওর সামনে আলো বহন করে এনেছে, সে সচকিত হয়ে চোখ খুলল, মাথার ওপর প্রখর রোদ, সামনে খোলা মাঠ, শুধু ধুধু করছে মাঠের রোদ। ঝিল্লির আঁকাবাঁকা রেখা দিগন্তে পাখির মতো উড়ে উড়ে যাচ্ছে। মরীচিকার মতো মনে হচ্ছিল। বৃদ্ধ পুরোহিত প্রথমে শরীরের আলখাল্লা খুলে ফেললেন। মরীচিকার মতো এই জলের চিহ্ন তিনি দেখতে পাচ্ছেন, মাঠ পার হয়ে হয়তো আকাশের নীচে কোথাও কোনও মেঘের টুকরো উঠে আসছে, তিনি জলের সন্ধানে এই মরুভূমির মতো প্রান্তরে ছুটতে থাকলেন। তাঁর কোনও জ্ঞান ছিল না। তিনি প্রায় পাগলের মতো ছুটে চলেছেন, যদি কোথাও কোনও জলের উৎস খুঁজে পাওয়া যায়।
আর তিনি ঠিক নীচে এসে যেখানে গতকাল মানুষেরা নদীর ঢালুতে জল অনুসন্ধান করে গেছে, সেখানে থমকে দাঁড়ালেন। দক্ষিণ অঞ্চল থেকে একটি ছোট্ট পাহাড়ের শিরা বের হয়ে এসেছে। দু’দিকে পাহাড়ের উপত্যকা গিরিখাতের মতো সৃষ্টি করেছে। তারই নীচে ছোট পাতকোর মতো গর্ত। বালুর পাহাড় চারধারে। একের পর এক এই সব গর্ত গতকাল তাঁর দলের মানুষেরা করে গেছে। কোনও গর্তেই জল নেই তিনি তা জানতেন। শুধু দূরে দেখলেন তিনটি ছোট ছোট প্রাণী একটা গর্তের চারধারে কেবল ঘুরছে। এই খরা অঞ্চলে, জলের অভাবের জন্য যেখানে কোনও পাখপাখালি পর্যন্ত নেই, যেখানে কোনও কুকুর পর্যন্ত ডাকছে না, সেখানে এমন তিনটি প্রাণী দেখে বিস্মিত হলেন।
তিনি যত এগুচ্ছিলেন তত এইসব ছোট ছোট প্রাণীগুলোকে কেমন চঞ্চল দেখাচ্ছিল। কাছে গেলে বুঝতে পারলেন দুটো হরিণ শিশু জলের জন্য পাশের সংরক্ষিত বন থেকে এখানে ছুটে এসেছে। ওঁকে দেখে তারা ছুটে পালাল না! শুধু সামান্য লাফ দিয়ে একটু সরে দাঁড়াল। তিনি গর্তের পাশে দাঁড়ালে আরও বিস্মিত হলেন—একটা বড় হরিণ গর্তের ভিতর পড়ে গেছে, হরিণটার হাঁটু পর্যন্ত জল, সে তার শিশুদের জল দেবার জন্য নীচে লাফিয়ে পড়েছে। আর উঠতে পারছে না। কেবল ভিতরে ঘুরপাক খাচ্ছে। বৃদ্ধকে দেখে কেমন কঁকিয়ে কঁকিয়ে একটু শব্দ করল তারপর বৃদ্ধকে অপলক দেখতে থাকল।
তিনি এবার হরিণ শিশুদের অতিক্রম করে সেই গর্তে নেমে গেলেন। নীচে নেমে হরিণটাকে পাড়ে উঠতে সাহায্য করলেন। তারপর আলখাল্লাটা জলে ভেজালেন। হরিণী একটু দূরে দাঁড়িয়ে বাচ্চাগুলোর জন্য অপেক্ষা করছে। জলের পিপাসা ওদের এত বেশি যে, ওরা জল খাবার জন্য ঝুঁকে পড়ছিল গর্তে। প্রাণের মায়া ছিল না। বৃদ্ধ আলখাল্লা ভিজিয়ে জল তুলে আনলেন। একটু একটু করে তিনি সেই তিনটি শিশুকে আলখাল্লা চিপে জল খেতে দিলেন। ওরা জল খেল, লাফাল, তারপর হরিণীর সঙ্গে সেই বনের দিকে ছুটে যাবার জন্য পাহাড়ের কোলে উঠে গেল।
যতক্ষণ না ওরা তিনজন হারিয়ে গেল ততক্ষণ বৃদ্ধ সেই পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। এখন আর যেন কিছু করণীয় নেই। বালির নীচে চোরা স্রোত, এই স্রোতের সন্ধান যদি তিনি গতকাল পেতেন তবে বুঝি এইসব অঞ্চলের অন্তত কিছু কিছু মানুষকে শস্য এবং সুদিনের আশ্বাস দিয়ে ধরে রাখতে পারতেন। কিন্তু হায়, ওরা এখন সব বিবাগী। ওদের ছোট ছোট কুঁড়েঘর পড়ে আছে। পাহাড়ি উপত্যকাতে এই সময় অন্যান্য বছর যখন বর্ষার জলে মাটি ভিজতে থাকে তখন এক মেলা হয়, উৎসব হয়, উৎসবে তিনি প্রধান মানুষ। এই উৎসব শস্যের জন্য, সম্পদের জন্য, কতকাল থেকে পৈতৃক এই ব্যবসা তাঁর। সকলের বিশ্বাস এখন তিনিই একমাত্র মানুষ যার মন্ত্রের উচ্চারণে আর তেমন শক্তি নেই। হোমে তিনি যে বিল্বপত্র দান করেন এখন তা আর তেমন পবিত্র নয়—নিশ্চয় কোথাও না কোথাও তিনি তাঁর পবিত্র জীবন থেকে বিচ্যুত হয়েছেন। মানুষের বিশ্বাসভঙ্গের দায়ভাগ তাঁর ওপর।
বৃদ্ধ পুরোহিতের নাম জনার্দন চক্রবর্তী। তিনি জলের ভিতর তাঁর মুখ দেখে আঁতকে উঠলেন। চোখে—মুখে অবসাদ, বড় বড় দাড়িতে মুখ ঢেকে গেছে, তিনি ক্রমশ কেমন বন্য জীবের মতো হয়ে যাচ্ছেন। তাঁকে বনমানুষের মতো মনে হচ্ছে। তিনি রোদের জন্য ওপরে দাঁড়াতে পারছিলেন না। তিনি উলঙ্গ হলেন এবং হাঁটুজলে নেমে শরীরে মুখে জল ঢেলে দিলেন। সমস্ত ক্লান্তি এবং অবসাদ শরীরের ক্রমশ কেমন উবে যাচ্ছিল। দীর্ঘদিন পর ঠান্ডা জলের এই স্নান তাঁকে সুখী এবং তাজা যুবকের মতো ফের সেই পুরানো মন্দিরে উঠে যেতে প্রেরণা দিচ্ছে। তাঁর সেই স্বপ্নের কথা মনে হল, জলের জন্য অনুসন্ধান, স্বপ্নে কে যেন বলল—অনুসন্ধান কর, কোথাও না কোথাও নদীর ঢালুতে চোরা স্রোত রয়েছে, তুমি তাই খুঁজে বের কর।
সে আবার চিৎকার করে উঠল, মা সুবচনী, তোর জয় হোক! কিন্তু মা তোর মনে কী এই ছিল? তোর মাটিতে মা ফসল ফলে না, তোর মাটিতে মা আর পালা—পার্বণ নেই, সব খা খা করছে, সব জনহীন প্রাণীহীন মা, আমি এখন এই জলে কী করব মা। তোর জলে তুই ডুবে মর। তুই ডাইনি। সকলের হাড়—মাংস খেয়ে তুই সুবচনি এখন ধেই ধেই করে নাচছিস।
জনার্দন পাড়ে উঠে আলখাল্লা এবং পরনের কাপড়টা কাঁধে ফেলে একবার চারিদিকে তাকালেন। কবে সব মানুষজনদের নিয়ে তিনি জলের সন্ধানে মাঠের পর মাঠ পার হয়ে চলে এসেছিলেন, এখন যেন আর তা মনে পড়ছে না। ভালোবাসার মাটি সকলে ছেড়ে চলে গেলে কী আর থাকল। জনার্দন, এই মাটি ছেড়ে সকলে কোথাও চলে যাবে ভাবতেই জলের জন্যে হতাশ হয়ে মরছিল। পাড়ে উঠে দেখল—তাঁর আবাস অনেক দূর। এত দূর তিনি হেঁটে যেতে পারবেন না, বিশেষ করে এই খরার রোদে। তিনি বালুর ওপর আর পা রাখতে পারছিলেন না, সূর্য যত ওপরে উঠে আসছে তত পায়ের নীচের উত্তাপ প্রখর মনে হচ্ছে। তিনি তাড়াতাড়ি কোনও নিকটবর্তী গ্রামে উঠে যাবার জন্য প্রায় ছুটে চললেন। পরিত্যক্ত কুঁড়েঘরে এখন অন্তত সময়টা কাটিয়ে বেলা পড়ে এলে পর ছোট পাহাড়ে চলে যাবেন।
গ্রামের ভিতর ঢুকতেই জনার্দনের বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। এখন আর এখানে মানুষের কোনও সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। প্রিয় কদমফুল গাছটা মরে গেছে। পুকুরের মাটি ফেটে গেছে। সব কেমন জ্বলেপুড়ে খা খা করছিল। কোথা থেকে পচা দুর্গন্ধ আসছিল। জনার্দন ছোট একটা কুঁড়েঘর দেখে ভিতরে ঢুকে গেলেন। বস্তুত জনার্দন ভয় পাচ্ছিলেন। তিনি দেখলেন দরজার পাশে একটা ছেঁড়া গামছা ঝুলছে এবং বাতাসে গামছাটা নড়ছিল। জনার্দন ভয়ে দরজা বন্ধ করে বসে পড়লেন। মনে মনে বললেন, মা সুবচনি, এত ভয় কেন প্রাণের জন্য। কীসের ভয় মা। আর তো কেউ নেই মা। আমি পুত্র—কন্যাবিহীন। শুধু এক অহঙ্কার ছিল মা। অহঙ্কার আমার এই উপবীতের। তিনি তাঁর উপবীতে হাত রাখলেন। পুরুষানুক্রমিক এই উপবীত, উপবীতের অহঙ্কার, কে যেন হেঁকে গেল মাঠে, ঠাকুরমশাই, মেয়ের বিয়ে কোন মাসে দেব, ঠাকুরমশাই মাথা চুলকে কী দেখলেন, তারপর বইয়ের পাতায় কী পড়লেন, শেষে বলে দিলেন, সাতাশে শ্রাবণ। সন্তানের কী নাম হবে, তিনি নাম বলে দিতেন, পুত্র হবে না কন্যা হবে, তিনি বলে দিতেন, কবে জমিতে ধান চাষ হবে—তিনি বলে দিতেন, কালবৈশাখীর ঝড় থেকে রক্ষার জন্য ভৈরব পূজা দিতেন। বৃষ্টি না হলে হোম করতেন। সময়ে অসময়ে বৃষ্টি ঝড়ে পড়ত। জলে ভেসে যেত মাটি। লাঙল কাঁধে তুলে সুবচনির মন্দিরে চাষি মানুষেরা যেত, তিনি লাঙলের ফলাতে সুবচনির তেল সিঁদুর মেখে দিতেন, গৃহস্থগণ চাষ করে আপন ঘরে সম্বৎসর সোনার ফসল তুলত।
জনার্দন ঘর অন্ধকার করে বসে থাকলেন। ঘরের সব দরজা জানালা বন্ধ, ঘরের ভিতর একটা ছেঁড়া বালিশ—তিনি তার ওপর মাথা রেখে শুয়ে পড়লেন। দিনের বেলাতে আর বের হওয়া যাবে না বোধ হয়, চারিদিকে লু বইছে। মাথায় মুখে কাপড় জড়িয়ে হাঁটতে হচ্ছে। তিনি স্থির করলেন, দিনের বেলাতে সুবচনির মন্দিরে নিদ্রা যাবেন, রাতের বেলাতে উঠে খাদ্য অন্বেষণ এবং অন্যান্য কাজ, কী করে এই মাটিকে উর্বর করা যায়, কী করে ফের মন্ত্রের অমোঘ শক্তিতে বৃষ্টিপাত ঘটানো যায়, সে সবের চেষ্টা।
কারণ জনার্দন ঠাকুরের মন্ত্রের ওপর জনগণের বড় বিশ্বাস ছিল। এই অঞ্চলের দেবী সুবচনি, এই অঞ্চলের রক্ষার দায়িত্ব তাঁর। আর জনার্দন ঠাকুর পুরুষানুক্রমিক দেবীর সেবাইত। পুরুষানুক্রমিক বিশ্বাস, অঞ্চলের মানুষদের বিষয় সম্পর্কে জনার্দন ঠাকুর—প্রায় যেন ঈশ্বরের কাছের মানুষ। অশিক্ষিত গ্রাম্য এবং পূর্ণিয়া অথবা বিহার—বাংলার সীমান্ত অঞ্চলের মানুষ এরা। কিছু পাহাড়ি আদিবাসী। কিছু বাঙালি। ভাষা, বিহার—বাংলার সীমান্ত অঞ্চলের। বড় গরিব মানুষগুলো। যা ফসল ফলত মাঠে, ওরা সোনার ফসল ভেবে নিত। এভাবে ওদের বছরের পর বছর কেটে গেছে। জলের কষ্ট ছিল, কিন্তু জলের অভাবে গোরু—বাছুর মরে যায়নি, অন্নের কষ্ট ছিল মানুষের—কিন্তু কেউ অনাহারে থাকে না। মা সুবচনি, বড় জাগ্রত, বড় লক্ষ্য তাঁর সন্তানের ওপর।
বিস্তীর্ণ পাহাড় আছে, শাল—শিমুলের গাছ আছে, বনে পাখি আছে, হরিণ আছে, আর কত রকমের মূল আছে গাছের যা তুলে ক্ষুধায় খেলে অন্নকষ্ট দূর হয়, শরীরে শক্তি সঞ্চার হয়। গৃহস্থের সোনার ফসল, গরিবের মুনিষ খেটে খাওয়া, কাজ না থাকলে, বনে—পাহাড়ে ঘুরে বেড়াও সকল অন্নকষ্ট দূর হয়ে যাবে। তেমন অঞ্চলে পর পর তিন বছর খরা গেল—সকলে দুঃস্বপ্ন দেখল—বুঝি এই অঞ্চল মরুভূমি গ্রাস করে নিচ্ছে।
সুতরাং মানুষেরা যাদের সহায়—সম্বল আছে তারা শহরে চলে গেল, মড়কে কিছু লোক সাফ হয়ে গেল আর বাকি যারা ছিল এতদিন তাদের জনার্দন ঠাকুর নানারকম আশ্বাস দিয়ে ধরে রেখেছিলেন, কিন্তু হায়, কোথাকার এক ট্রেন এসে তাদেরও নিয়ে চলে গেল। জনার্দন দুঃখে হতাশায় ভেঙে পড়লেন। তবু হায়, জনার্দন ঠাকুরের এই মাটির জন্য আশ্চর্য এক ভালোবাসা। এমন মাটি, ভালোবাসার মাটি, কোথাও যেন তাঁর নেই। তিনি এখানে রাজার মতো ছিলেন, মানুষের কাছে তিনি এখানে পিরের মতো। সেই মানুষেরা চলে গেছে। সেই সব ভালোবাসার মানুষেরা চলে গেছে। তিনি তাদের আর কিছুতেই বুঝি ফেরাতে পারবেন না। তাঁর বাপ—পিতামহের গল্প, দেবীর সব পৌরাণিক ইতিহাস, এবং যা চমকপ্রদ, ঈশ্বরপ্রাপ্তির প্রবাদ এই মাটির সঙ্গে মিশে আছে। কেউ আর স্মরণ করবে না, জনার্দন ঠাকুরের পরিবার দশ পুরুষ আগে পূর্ববাংলার কোনও এক প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে এসে এখানে সুবচনি দেবীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিল। তখন এত লোকালয় ছিল না, দেবীর আশীর্বাদ পাবার লোভে মানুষেরা এই পাহাড়ের নীচে বসতি স্থাপন করেছিল। তারপর থেকে এই জনার্দন এবং তাঁর পরিবার পৌরাণিক ধর্ম বিশ্বাসের মত।
জনার্দন ছেঁড়া মাদুরে শুয়ে ফের উপবীতে হাত রেখে বিড় বিড় করে কী যেন আওড়ালেন, যেন তিনি শপথ করছেন। কীসের শপথ স্পষ্ট বোঝা গেল না। তবু তাঁকে দেখলে মনে হল আমৃত্যু এই মাটির সঙ্গে তাঁর লড়াই। দেবীর সঙ্গে তাঁর লড়াই। ঊষর এই দেশকে উর্বর করে তোলার জন্য তাঁর সংগ্রামকে বড় স্বাস্থ্যকর মনে হবে। কিন্তু তাঁর মুখের ছবি, চোখের দৃঢ়তা এবং উপবীতের অহঙ্কার তাঁকে যেন বড় এক লম্বা দৈত্যের মতো বড় করে ফেলেছে! ভয়ঙ্কর খরা, বাইরের লু আর ঊষর প্রকৃতি তাঁকে নিরস্ত করতে পারল না।
শরীর—মন—প্রাণ শক্ত করার জন্য তিনি বিড়বিড় করে দেবী সুবচনির পাঁচালি পড়তে থাকলেন, সুবচনি মায় বাড়ি বাড়ি যায়, বাড়ি বাড়ি গেলে মায় আমার ধান্য—দূর্বা পায়। আরও কী বলার ইচ্ছা যেন। যেন বলার ইচ্ছা মা, তোর এত ছেলে আছে, আর তুই তোর মাটির ছেলেদের সব একসঙ্গে গ্রাস করে ফেললি! জনার্দন চিৎকার করে উঠলেন, সুবচনি মায়গ আমার বড় দয়াময়, ছেলে কোলে লইয়া ঘোরে পাড়াময়। জনার্দন আবছা অন্ধকারের ভিতর উঠে বসলেন, বললেন, তুই যদি দয়াময়ী হস মা, তবে তোর এই রাক্ষুসী মুখ দেখতে পাচ্ছি কেন?
তখন সারা মাঠ খা খা করছিল। চিতার মতো জ্বলছে গ্রাম—মাঠ গাছগাছালি। জনার্দন পরিত্যক্ত এক কুঁড়েঘরে বসে আছেন। তিনি ভিজা আলখাল্লাটা গায়ের ওপর রেখে দিয়েছিলেন, এখন সেই আলখাল্লা এবং কাপড় দুই—ই শুকিয়ে প্রায় শক্ত কাঠ।
তিনি কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। বিশ—ত্রিশ ক্রোশ হেঁটে শহরের দিকে চলে যাবেন—কিন্তু যা খবর সেখানেও লোক নেই। লোক সব শহর—গঞ্জ ছেড়ে দিচ্ছে। সরকার থেকে যা সামান্য সাহায্য আসছে তাও বন্ধ। সরকার থেকে যে পাতকুয়া গ্রামের মাঠে কাটা হয়েছিল, তাতে জল নেই। সুতরাং জনার্দন ক্রমশ ভেঙে পড়ছেন। ওঁর প্রবল আবেগ, ঊষর জমি উর্বর করে তোলার আবেগ ক্রমশ মরে যাচ্ছিল। কারণ সর্বত্র এই হাহাকারের দৃশ্য—জনার্দন এবার পাগলের মতো দরজা খুলে দিলেন এবং তপ্ত মাঠের ওপর দিয়ে লু—এর ভিতর দিয়ে শ্মশানের মতো এক সাম্রাজ্য শুধু চারিদিকে—জনার্দন চোখ—মুখ বন্ধ করে ঊর্ধ্বশ্বাসে সেই পাহাড়ের উদ্দেশ্যে ছুটছেন।