টুকুনের অসুখ – একুশ
সকালবেলা যখন এমন অবস্থা, যখন টুকুন বাবার পাশে বসে আছে এবং টুকুনের মা ভীষণ বিশ্বস্ত মুখে কাজকর্ম করে যাচ্ছে, তখন মনেই হল না, সংসারে স্বামী স্ত্রীতে এতটুকু অবিশ্বাস আছে। বরং অসুখটা যেন দুজনকে সহসা বারমুখী থেকে ঘরমুখী করে দিল। এবং এমন একটা অসুখ নিয়ে মজুমদার সাবকে চিরদিন বিছানায় শুয়ে থাকতে হবে, টুকুনের মা চিরদিন এবার নীরবে মানুষটাকে সেবাশুশ্রূষার সুযোগ পাবে। এত বছর গেছে, এমন একটা সুযোগ যেন তার এই প্রথম। ফলে সে খুব যত্ন নিয়ে দেখাশোনা করে যাচ্ছে। যদিও ইতিমধ্যে দুজন নার্সের কথা উঠেছে, এবং ওদের নিয়োগের ব্যাপারে বাইরের ঘরে কথাবার্তা চলছে তখন টুকুনের মা ভাবছে—এসব নার্স—টার্স কী দরকার, সে নিজেই যখন আছে তখন অনর্থক, নিজের মানুষটাকে পরের হাতে ছেড়ে দেওয়া কেন! তারপরই মনে হল হাতের কাছে কাজের লোক থাকলে মন্দ হয় না। সুতরাং সকালবেলাতে যে একটা জরুরি কথা ছিল টুকুনকে বলার, সেটা বুঝি আর বলা হল না। ইন্দ্রের বাবাকেও যে বলার ছিল কিছু, এখন এই অসময়ে আর কী হবে বলে, বরং তিনি ভালো হয়ে উঠুন, তারপর সব করা যাবে।
কিন্তু মজুমদার সাব কথাটা ভোলেননি। তিনি দেখলেন খুব বিষণ্ণ মুখে বসে আছে টুকুন। সকালবেলাতে এলোমেলো চুল হাওয়ায় উড়ছে। নাকে মুখে এসে চুল উড়ে পড়ছে। এবং রাতে একেবারে মেয়েটার ঘুম হয়নি বোঝা যাচ্ছে। চোখ ভীষণ ভিতরে ঢুকে গেছে। হয়তো টুকুন ওর মার চেঁচামেচি থেকে টের পেয়েছে, এবাড়ি থেকে তাকে আর একা বের হতে দেওয়া হবে না। এমনকি, গাড়িতে ড্রাইভার থাকবে। সে আর একা ইচ্ছামতো ঘুরতে পারবে না। মেয়েটার জন্য ভীষণ কষ্ট হয় মজুমদার সাবের। অথচ কেন যে মেয়েটা এভাবে একটা ফুলের উপত্যকায় হেঁটে যাবার আকর্ষণে পড়ে গেল। চারপাশে টুকুনের কত সুন্দর সুন্দর ছেলেরা আছে, কত বড় বড় পার্টিতে তিনি মেয়েকে নিয়ে গেছেন অথচ, একেবারে উদাসীন টুকুন। কিছুতেই টুকুন তার বন্য স্বভাব ছাড়তে পারছে না।
মজুমদার সাব বললেন, তুমি এত চুপচাপ কেন টুকুন?
টুকুন বোকার মতো একগাল হেসে দিল। অর্থাৎ বাবাকে সে অভয় দিতে চাইল যেন, কোথায়? আমি তো বেশ হইচই করে আছি বাবা।
মজুমদার সাব এবার হেসে বললেন, আমি খুব তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে উঠব টুকুন।
—তোমার কিছু হয়নি বাবা। ডাক্তারবাবু অনর্থক তোমাকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছে।
ওমা, একি কথা! এ যে দেখছি টুকুন একেবারে সুবলের মতো কথা বলছে।
টুকুন ফের বলল, তুমি বাজে দুশ্চিন্তা ছেড়ে দাও, দেখবে ভালো হয়ে যাবে!
এখানে যেন টুকুন কোথায় প্রায় ডাক্তারসুলভ কথা বলে ফেলল। সেতো এ—বাড়ির মেয়ে। সে টের পায় সংসারের জন্য বাবাকে অনেক পাপ কাজ করতে হয়। এমন একটি স্ট্যাটাসের ভিতর বাবা উঠে এসেছেন যে তার জন্য তিনি সারাটা দিন কী না করছেন। বাবা কোথায় কীভাবে কী করছেন সে জানে না, কিন্তু বাবার মুখ দেখে সে টের পায়, উদ্বিগ্ন চোখেমুখে বাবার এক অতীব ভয়। সব সময় যেন তিনি জীবনে নিরাপত্তার অভাব বোধ করছেন। সবকিছু ঠিকঠাক রেখে যাবার জন্য বাবার এই সব পাপ কাজ, বাবাকে খুব সহসা প্রাণহীন করে দিল।
টুকুন বলল, বাবা তুমি একটু ভালো হয়ে ওঠো। ভালো হলে তোমাকে রোজ বিকেলে এক জায়গায় নিয়ে যাব। সেখানে গেলে তুমি নিরাময় হয়ে যাবে।
টুকুন ‘ভালো হয়ে উঠবে’ না বলে ‘নিরাময়’ কথাটা ব্যবহার করল। নিরাময় কথাটা বলতে তার কেন জানি এ—সময় ভালো লাগল।
অর্থাৎ একদিনেই টুকুনের আশ্চর্য বিশ্বাস জন্মে গেছে, মানুষ নিজেই পারে এই আশ্চর্য সুন্দর জগৎ তৈরি করতে—যেখানে মানুষ এতটুকু নিরাপত্তার অভাব বোধ করবে না। সেখানে সবাই সবার জন্য ভাববে। এবং এমন একটা জগৎ এভাবে তৈরি হয়ে যাবে একদিন। অহেতুক ভয় থাকবে না। ভয় থেকে কোনও অসুখ জন্মাবে না। বাবার অসুখটা সে বুঝতে পেরেছে ভয় থেকে হয়েছে। সব সময় এক ভয়, যা কিছু আছে মানুষেরা লুটেপুটে নিয়ে যাবে।
আবার সে বলল, বাবা ওখানে গেলে সত্যি তুমি ভালো হয়ে যাবে।
টুকুনের মার যেন এতক্ষণে মনে পড়ল কথাটা। সে বলল, টুকুন তুমি বড় হয়েছ। এখন আর একা কোথাও যাবে না! বাড়ি থেকে বের হবে না।
টুকুন বুঝতে পারল মা তাকে সেই ফুলের উপত্যকায় যেতে বারণ করছে। কিন্তু সেই ফুলের উপত্যকার কথা মনে হলেই কেমন তার চোখ বুজে আসে। সে যদি যায়, মা ভীষণ অশান্তি করবে। এবং এই অশান্তি বাবার পক্ষে আরও ক্ষতিকারক। সে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা না বললে আমি আর কোথাও যাব না।
সে বাবার জন্য এই সংসারে কোনও অশান্তি সৃষ্টি করতে চায় না।
এবার টুকুন উঠে ওপরে চলে গেল। সকালে মুখ ধুয়ে সে এক গেলাস ফলের রস খায়। ঘরে গিয়ে দেখল, গীতামাসি সব ঠিক করে রেখেছে। ফলের রস খেতে তার ভীষণ বিস্বাদ লাগল। সে এখন এ বাড়িতে প্রায় বন্দি জীবনযাপন করবে, কোথাও গেলেই মার ধারণা হবে, সেই ফুলের উপত্যকায় সে চলে গেছে!
এভাবে বাড়িতে সে কিছুদিন আটকা পড়ে গেল। হেমন্তের শেষাশেষি বাবা একটু সুস্থ হয়ে উঠলেন। কারখানা ক্লোজারের পর খুব বাড়াবাড়ি গেছিল ক’দিন, এখন বোধ হয় ওটা সামলে উঠেছেন। ইউনিয়নের তরফের লোক এসে দেখা করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু ডাক্তারের দোহাই পেড়ে ওঁর সেক্রেটারি তা ঠেকিয়ে রেখেছেন।
যেমন টুকুনকে নিয়ে বাবা—মা একদিন সব পাহাড়ি জায়গায় শরীর ভালো করবার জন্য ঘুরে বেড়িয়েছেন, তেমন টুকুন তার বাবাকে নিয়ে নানা জায়গায় ক’মাস থেকে এল। যেমন কিছুদিন ওরা ছিল নৈনিতালে। দেরাদুনেও গেছে। অর্থাৎ এভাবে যাবতীয় পাহাড়ি জায়গায় আশ্রয় নিয়েও যখন দেখেছে বাবার শরীরে সম্পূর্ণ নিরাময়ের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না তখন ফের ফিরে আসা।
মাঝে মাঝে টুকুন বাবার পায়ের কাছে বসে থাকত। বাবা বুঝতে পারতেন, টুকুন কেমন বিষণ্ণ হয়ে যাচ্ছে ফের। বাবার রুগণ মুখে টুকুন তা ধরতে পারলেই হেসে দিত। বলত, বাবা আমি কত যে চেষ্টা করছি, চুপচাপ আগের মতো শুয়ে থাকলে কেমন হয়, সেই আগের মতো নিঃসাড় পড়ে থাকতে গিয়ে দেখেছি একেবারেই ভালো লাগে না শুয়ে থাকতে। তোমাকে বলিনি বাবা, বললে কষ্ট পাবে, ভেবেছি, কম খেয়ে না খেয়ে শরীর দুর্বল করে ফেললেই আগের অসুখটা ফের আমাকে আশ্রয় করবে। কিন্তু বাবা তোমাকে কী বলব, একবেলা না খেলেই চোখে অন্ধকার দেখছি। তখন গীতামাসিই হেসে বাঁচে না।
একটু হেসে টুকুন আবার বলল, আমার আর অসুখের ভিতর ফিরে যাওয়া হবে না। এভাবে সারা মাস ঘরে চুপচাপ বসে থাকার চেয়ে আমার অসুখের ভিতর ফিরে যাওয়া ভালো ছিল বাবা। তোমরা আমাকে আর সেখানে যেতে দাও না।
মজুমদার সাব বুঝতে পারেন টুকুন মায়ের উপর অভিমান করে এমন একটা অসুখের ভিতর ফের ফিরে যেতে চাইছে। তিনি বললেন, তুমি ভারী বোকা মেয়ে। বিয়ে হলে দেখবি, এসব অভিমান আর থাকবে না।
টুকুন বলল, বাবা আমার বিয়ের জন্য তোমরা এত ভাবছ কেন। যাকে আমার পছন্দ নয়, তার সঙ্গে কেন তোমরা আমাকে জুড়ে দিতে চাইছ?
কেমন মনটা খারাপ হয়ে যায় এমন কথা শুনলে। কিন্তু মেয়ের জেদ। মজুমদার সাব চুপ করে থাকেন।
টুকুন বুঝতে পারে বাবার খুব কষ্ট হচ্ছে। সে বলল, ঠিক আছে তোমাদের যা ইচ্ছা তাই হবে।
মজুমদার সাব সেই বিকেলেই বললেন, তুই যে বলেছিলি আমাকে কোথায় নিয়ে যাবি। সেখানে গেলে আমি ভালো হয়ে যাব।
—তুমি যাবে বাবা?
—যাব। কিন্তু তোর মা যদি জানে!
—তবে তুমি জানো কোথায় নিয়ে যাব তোমাকে?
—জানব না!
—কী করে বুঝলে আমি তোমাকে আমাদের সেই ফুলের উপত্যকায় নিয়ে যাব?
—পৃথিবীতে মা তুই তো একটা জায়গার কথাই ঠিক জানিস। টুকুন কেমন মাথা নীচু করে রাখল।
—একটু যা মিথ্যে কথা বলতে হবে।
—কী মিথ্যে!
—বলবি, আমাকে নিয়ে তুই হাওয়া খেতে যাচ্ছিস মাঠে।
—বলব।
—বলবি আমরা গ্রাম মাঠ দেখে বেড়াচ্ছি।
—বলব।
—বলবি গ্রাম মাঠের ভিতর দিয়ে গেলে নির্মল বাতাস বুক ভরে নেওয়া যায়।
—বলব বাবা।
—আর বলবি ডাক্তারের পরামর্শমতো সব হচ্ছে।
—বলব।
ডাক্তার এলে মজুমদার সাব ফিস ফিস করে বললেন, একভাবে শুয়ে বসে থাকতে ভালো লাগছে না হে ডাক্তার। সকালে বিকেলে গাড়িতে ঘুরে বেড়ালে কেমন হয়। এই যেমন ধরো, বেহালার ভিতর দিয়ে গিয়ে যদি ডায়মন্ড হারবার রোডে পড়ি। অথবা ফুলবাগান হয়ে কাঁকুড়গাছি পার হয়ে সোজা সলট লেক, লেক টাউন পিছনে ফেলে এরোড্রাম পার হয়ে বারাসাতের রাস্তায় চলে যাই।
—খুব ভালো। ঘুরে বেড়ান না। এতে যদি মন ভালো থাকে ক্ষতির তো কিছু দেখছি না।
—তুমি একবার তোমার বউদিকে বুঝিয়ে বলো। ও তো বিছানা থেকে উঠতেই দিতে চায় না। ডাক্তার হেসে বলল, বলব।
—আমার টুকুন মা আছে, ভারী সুন্দর গাড়ি চালায়। কাজেই বুঝতে পারছ, আজে বাজে ড্রাইভিং হবে না।
ডাক্তার বলল, ঠিক আছে। আপনার এখন খিধে কেমন?
—কিছু না। এখন মনে হয় হাওয়া খেয়ে পেট যে ভরে প্রবাদটা একেবারে মিথ্যা না।
ডাক্তার কিছু ওষুধ পালটে দিল। টুকুনের মা এলে বলল, বউদি, দাদার একটু বেড়ানো দরকার। বাড়িতে বসে থাকলে মন মেজাজ দুই—ই খারাপ হবার কথা। টুকুন ওঁকে নিয়ে সকাল—বিকেল গ্রাম মাঠ দেখে এলে মনটা প্রফুল্ল থাকবে। দেখা গেছে অসুখ অনেক সময় এভাবে সেরে যায়।
টুকুনের মা বলল, আমার সঙ্গে থাকা দরকার। ঝি—চাকর দিয়ে কী সব হয়! টুকুন কী সব বোঝে!
মজুমদার সাব হেসে ফেললেন, তুমি সেই সেকেলে আছো। এখনকার মেয়েরা অনেক কম বয়সেই সব শিখে ফেলে। কী বলো হে ডাক্তার? টুকুন তো আমার লক্ষ্মী মেয়ে। সে না পারলে আর কে পারবে।
এভাবেই ঠিক হয়ে যায় টুকুন যাবে। আর যাবে মজুমদার সাব। সঙ্গে থাকবে পুরানো চাকর রামনাথ। ইন্দ্র ঘ্যান ঘ্যান করছিল—সেও যাবে। কিন্তু মজুমদার সাব সব জানেন বলে বললেন, ইন্দ্র তোমাদের ক্লাব এবার সেমিফাইনালে উঠেছে। সবটা তোমার কৃতিত্ব। ফাইনালে ওঠা চাই। আমাদের সঙ্গে বিকেলে কাটিয়ে দিলে দেখবে—ওই পর্যন্ত। এবার যে শিল্ড ঘরে তোলা চাই।
মজুমদার সাব এভাবে বেশ ম্যানেজ করে এক বিকেলে বের হয়ে পড়লেন।
ধীরে ধীরে লাঠিতে ভর করে তিনি গাড়ি—বারান্দায় এলেন। টুকুন এবং রামনাথ দুপাশে দাঁড়ালে তিনি ওদের কাঁধে ভর করে সিঁড়ি ভাঙলেন! দুপাশে সব বাড়ির এবং অফিসের কিছু আমলা কর্মচারী, ফরাসের লোক খাস খানসাম রামনাথ সবাই মিলে বড়কর্তা বিকেলে যে বের হচ্ছেন এবং মানুষটি অসুখে ভুগলে কী যেন একটা ভয়—এতবড় বাড়ির বৈভব আর থাকবে না, সামনে কৃত্রিম পাহাড়ের পাশে ছোট্ট হ্রদ, হ্রদে কিছু পাখপাখালি এমন শৌখিন বাড়ি এ—তল্লাটে হয় না অথচ এখন এমন বাড়িটা ধীরে ধীরে শ্রীহীন হয়ে যাচ্ছে। দুবছরের ওপর কারখানা ক্লোজার, দুবছরের ওপর এভাবে সাব বাড়িতে শুয়ে আছেন, দুবছরের ওপর, কারখানার শ্রমিকেরা স্টেশনে স্টেশনে কৌটো ফুটো করে পয়সা মাগছে—এসব দৃশ্য সবার মনে পড়ে গেলে ভারী খারাপ লাগে।
গাড়িতে মজুমদার সাব সামনে বসেছেন। পাশে টুকুন। টুকুনের চুল শ্যাম্পু করা। ঘাড় পর্যন্ত চুল পরিপাটি বিছানো। মনে হয় দেবদেবীর চুলের মতো—কী কোমল আর মিহি, হাত দিলে যেন ছোঁয়া যায় অথবা চুল শ্যাম্পু করা থাকলে আকাশের মতো ভারী দেখায় মুখ। চুলের ভিতর আছে আশ্চর্য এক গন্ধ। টুকুন পরেছে হালকা চাঁপা রঙের শাড়ি। শাড়িতে লতাপাতা আঁকা এবং নানা রকমের বর্ণাঢ্য শোভা—এমন একটা শাড়ির সৌন্দর্যে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। এবং মজুমদার সাব বেশ লক্ষ্য করে বুঝেছেন, মেয়ের খুব পছন্দ আছে—কী রঙ ওকে মানায় সে যেন জানে। আশ্চর্য স্নিগ্ধ স্বভাবের মনে হচ্ছে টুকুনকে। এবং শাড়ির এমন রঙের সঙ্গে ও শরীরের কোমল আভা অথবা বলা যায় লাবণ্য একেবারে মিলেমিশে গেছে। হালকা প্রসাধন পর্যন্ত। ঠোঁটে যে সামান্য রঙ তাও এত স্বাভাবিক যে মানেই হয় না টুকুন ঠোঁটে রঙ লাগিয়েছে। বরং এটুকু না লাগালেই ওকে যেন এই পোশাকের ভিতর সামান্য শ্রীহীন করে রাখত।
আর এভাবে এক মেয়ে—বোধ হয় এটা হেমন্তকাল—বেশ গাড়ি ছুটিয়ে যাচ্ছে। সে দোকান থেকে ফুল আনার সময় সুবলের কিছু খোঁজখবর রেখেছে। কারণ শহরের সব ফুলের দোকানগুলো বলে দিতে পারে সুবলের কথা, সুবলের ফুল একদিন এই শহরে না এলে সব অন্ধকার দ্যাখে, সেই সুবলের খোঁজখবর সব তার কাছে থাকবে সে আর বেশি কী—এবং এভাবে সেও তার খোঁজখবর সুবলকে দিয়ে গেছে। সুবলের ওইটুকুই লাভ। সে টুকুনদিদিমণির চিঠি অতি যত্নে রেখে দিয়েছে। সে তার জন্য তপোবনের মতো আলাদা একটা আশ্রম করে দিয়েছে। বুড়ো মানুষটা মারা গেছে গত শীতে।
কাঞ্চন ফুলের চারপাশে সবুজ ঘাসের কাঠা চারেকের মাঠ। সেখানে ঘাসের ছায়ায় কাঞ্চন সৌরভে বুড়ো মানুষটা আছে। তার কবর শান বাঁধানো। কাঞ্চন ফুল দিন—রাত পাঁপড়ি ফেলছে সেখানে। বিকেলে যখন হাতে কোনও কাজ থাকে না, সুবল সেই ঘাসের ভিতর কাঞ্চন গাছটার নীচে চুপচাপ বসে থাকে। এসব খবর টুকুনদিদিমণিকে সে তার লোক মারফত জানিয়েছে। সে চিঠি লিখতে আজকাল পারে। কিন্তু হাতের লেখা এত খারাপ যে দিদিমণিকে চিঠি লিখতে লজ্জা পায়। টুকুনদিদিমণির সঙ্গে কতদিন দেখা নেই—বাড়ি থেকে বের হতে দেওয়া হচ্ছে না, সে যেন বুঝতে পারে টুকুনদিদিমণি বারান্দায় অথবা রেলিং—এ কীভাবে দাঁড়িয়ে আছে, বুঝতে পারলেই ওর ভীষণ কষ্ট হয়—সব ফেলে চলে যেতে ইচ্ছা হয়—কী এক আকর্ষণ শরীরে তার—কিন্তু টুকুনদিদিমণির অপমান ওর কাছে আরও কষ্টকর। এখন তো সে আর আগের মতো পাঁচিল টপকে যেতে পারে না। সে কেমন যেন ক্রমে স্বভাবে শহরের মানুষ হয়ে যাচ্ছে। গাড়িগুলো শহরে ফুল নিয়ে যাচ্ছে—তাদের টংলিং টংলিং শব্দ কানে এলে চোখ বুঝে পৃথিবীর যাবতীয় সুষমা সে শুষে নিতে পারে। এবং টুকুনদিদিমণির আশ্চর্য ভালোবাসা সে তখন ভিতরে ভিতরে বড় বেশি অনুভব করতে পারে।
মজুমদার সাব বললেন, তোর সুবল বাওবাব গাছ দিয়ে কী করবে রে টুকুন?
টুকুন এমন কথায় ভীষণ লজ্জা পেল। বলল, বাওবাব গাছের কথা তুমি কী করে জানলে?
—সে জেনেছি।
—ওটাতো বাবা একটা গল্পের গাছ।
—মানে!
—মানে ছোট্ট রাজপুত্রের একটা দেশ আছে। সেটা একটা ছোটো গ্রহাণু। শিশুদের জন্য লেখা গল্প। সেখানে বাওবাব গাছের কথা আছে।
—তুই জানিস না, বাওবাব বলে সত্যিকারের গাছ আছে। জায়গায় জায়গায় নামটা পালটে যায়।
এখানে রাস্তাটা একটা বড় পুকুরের পাশ দিয়ে ঘুরে গেছে বলে টুকুনকে খুব ধীরে ধীরে টার্ন নিতে হল। এখন হেমন্তকাল বলে বেশ শীত শীত ভাব। চারপাশে ধানের জমি। কাঁচা পাকা ধানের মাঠ। চাষিরা মাঠের আলে আলে দাঁড়িয়ে গল্পগুজব করছে। কারণ বোঝাই যায়—ধান তোলার সময় হয়ে আসছে। খুব খুশি ওরা, ফসল ভালো, এবং এভাবে এই মাঠের সব জমি, চাষিদের মুখে আকাশের নীলিমা এবং কিছু পাখির কলরব টুকুনকে ভীষণভাবে আপ্লুত করছে। সে বাবার শেষ কথাটা ঠিক মন দিয়ে শুনতে পায়নি।
মজুমদার সাব ফের বলে যাচ্ছেন—আমি একটা বইয়ে পড়েছি, কেনিয়াতে কাণ্ডুরার জঙ্গলে এই গাছ আছে। ছবিতে যা দেখেছি, তাতে মনে হচ্ছে ঠিক আমাদের দেশে বাবলা গাছের মতো। আমার মনে হয় সুবল সেজন্য বাওবাব খুঁজে বেড়াচ্ছে।
—আমি ঠিক জানি না বাবা। সুবলকে জিজ্ঞাসা করে দেখব।
—তোর মনে আছে যখন প্রথম সুবল গাড়িতে উঠে এসেছিল?
—মনে আছে বাবা।
—খুব হাসি পেত দেখলে! ওর পাখিটার খবর কীরে?
—সে ওটা ছেড়ে দিয়েছে বাবা।
তারপর ওরা সেই ফুলের উপত্যকাতে ধীরে ধীরে গাড়ি এগিয়ে নিল। বড় রাস্তা। তারপরই উঁচুনীচু মাঠ, চন্দনের গাছ, এবং নানারকম লতাগুল্মের বন। বনের ভিতর দিয়ে রাস্তা নেমে গেছে, একটু বন থেকে বের হলেই সামনে এক বিস্ময়কর দেশ। নানা জায়গায় নানা ফুল। ওরা দূর থেকেই ফুলের গন্ধ পাচ্ছে। এতসব ফুলের গন্ধ মিলে, যেমন গোলাপ, রজনিগন্ধা, গন্ধরাজ, চামেলি, চাঁপা, বেল ফুল এবং টগর, জুঁই—কত যে সব ফুল এবং ফুলের বাস।
মজুমদার সাব বললেন, টুকুন সুবল এখন একটা দেশের রাজা।
টুকুন বলল, না বাবা, সে রাজা নয়। সে বলে, সে এর কিছু নয়। যারা কাজ করে তারাই সব। এবং সে দেখেশুনে বেড়ায় বলে তার একটু থাকবার জায়গা ওরা দিয়েছে। ওই যে দূরে দেখছ, উঁচু জায়গায় আশ্রমের মতো ঘর, ওখানে সুবল থাকে। তুমি শুনতে পাচ্ছ না, টংলিং টংলিং শব্দ, দেখতে পাচ্ছ না, তুমি দেখতে পাবে না, ওপাশের রাস্তা দিয়ে একটা ফুলের গাড়ি চলে যাচ্ছে। তোমার কষ্ট হচ্ছে নাতো হাঁটতে? আমি তোমাকে ধরব?
মজুমদার সাবের এই প্রথম মনে হল তাঁর শরীর ভালো নেই। এভাবে হেঁটে যাওয়া ঠিক না, কিন্তু আশ্চর্য তার কষ্ট হচ্ছে না, তিনি বেশ হেঁটে যেতে পারছেন।
মজুমদার সাব বললেন, টুকুন আমি বেশ হেঁটে যেতে পারছি রে।
—আমি তোমাকে ধরব!
—কী বললি!
—তুমি যদি পড়ে টড়ে যাও?
—সুবলটা কোথায়?
—এখন সূর্য অস্ত যাবার সময়। সে হয়তো যারা খাটে তাদের এখন আগামী কাজকর্ম বুঝিয়ে দিচ্ছে। ওদের টাকাপয়সা, সে এখানে নতুন দেশ গড়েছে বাবা। মানুষের জন্য একটা ভালো আবাস তৈরি করেছে।
মজুমদার সাব হেঁটে যাচ্ছিলেন। যেন ভিতরে থাকে মানুষের এক দুর্জ্ঞেয় ইচ্ছা, সেই শৈশব থেকে স্বপ্ন, বড় হওয়ার স্বপ্ন। মানুষের মাথা উঁচু করে হেঁটে যাবার স্বপ্ন, সব তাঁর হয়েছে, অথচ কোথায় যেন তিনি মানুষের চিরটা কাল অনিষ্ট করে বেড়িয়েছেন। সুবলের মতো তার জীবনেও ছিল অসীম দুঃখদারিদ্র্য—তিনি তা জয় করতে গিয়ে এটা কী করে ফেলেছেন! বড় হতে যাওয়ার মানে কেমন বদলে যাচ্ছে ক্রমশ। সুবলকে দেখে, সুবলের উপত্যকা দেখে তাঁর মনে হল, পৃথিবীতে এভাবে বড় হলে অনেক পাপ থেকে মানুষ বেঁচে যায়। তিনি কেমন এবার দ্রুত হাঁটতে থাকলেন। সেই কুটিরে ওঁর যাওয়া চাই। সেখানে গেলেই বুঝি তিনি আশ্চর্যভাবে ঠিক ঠিক নিরাময় হয়ে যাবেন।