টুকুনের অসুখ – দুই
অতর্কিতে এই ট্রেনটার চলে যাওয়া—যেন নিমেষে এক বড় সংসার নিয়ে ট্রেনটা উধাও হয়ে গেল। পুরোহিত মানুষটি কী করবেন ভেবে পেলেন না। তিনি ধীরে ধীরে পাহাড়ের দিকে উঠে যেতে থাকলেন। এত চেষ্টা সত্ত্বেও কোনও মানুষ অথবা পরিবারকে ধরে রাখতে পারলেন না। তিনি ভিন্ন ভিন্ন আশার কথা শোনাতেন, হা অন্নের জন্য, জলের জন্য এবং অনাবৃষ্টির জন্য যখন মন্বন্তর আসে তখন হাজার হাজার লোক মরে যায়, মহামারী দেখা দেয়, গোরু—বাছুর সব বিক্রি করে দিতে হয়, শুধু সামান্য কুঁড়েঘর পড়ে থাকে অবশিষ্ট—কিন্তু তারপর ঈশ্বর মঙ্গলময়, তারপর সব পাপের সংসার আগুনে পুড়ে গেলে ঘনবৃষ্টি। বৃষ্টি হলেই নতুন গাছগাছালি, মাঠে সবুজ ঘাস দেখা দেয়, কোথা থেকে সব পাখি উড়ে আসে তখন। কোথা থেকে সব বন্যপ্রাণী নেমে আসে। এবং ধীরে ধীরে অঞ্চলটা তপোবনের মতো হয়ে যায়। তখন আর পাপ থাকে না, শুধু পুণ্য পড়ে থাকে, এই পুণ্যের জন্য আবার শতবর্ষ ধরে ফসল ফলাও, ঘরে উৎসব, জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ। তারপর ফের পাপ, ফের হা অন্নের সম্মুখীন হওয়া।
বস্তুত এই বৃদ্ধ পুরোহিত ভোর হলেই আকাশ দেখতেন, তিনি প্রায় সব সময় আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। একটু মেঘ দেখলে চিত্ত চঞ্চল হয়ে উঠত। বুঝি আজই বৃষ্টি হবে। কিন্তু তারপর কোথায় বৃষ্টি, সামান্য মেঘটুকু ফুসমন্তরে আকাশের ভিতর অদৃশ্য হয়ে যেত। তিনি তখন ফের অন্য একটুকরো মেঘের সন্ধানে পাহাড়ের টিলাতে উঠে যেতেন। যেন মৃত সব গাছাগাছালি, কুঁড়েঘর অথবা উত্তর—পশ্চিমের পাহাড় যাবতীয় মেঘকে তার দৃষ্টির আড়ালে রেখে দিয়েছে।
তিনি ভেবেছিলেন মানুষের অসীম দুঃখ—কষ্টের দিন শেষ হয়ে আসছে। এবার এ অঞ্চলে ঈশ্বরের করুণাধারা দ্রুত নেমে এসে মাঠ—ঘাট ভাসিয়ে দেবে। তিনি সেই আশায় পাহাড়ের টিলাতে দাঁড়িয়ে দিগন্তে সামান্য মেঘের অনুসন্ধান করতেন।
অথচ এক ট্রেন এসে এ অঞ্চলের সব লোকজন নিয়ে চলে গেল। শহরের দিকে ট্রেন চলে গেছে। জলের জন্য ট্রেন ধরতে আসা, আর সেই ট্রেনে চড়ে মানুষজনেরা সব চলে গেল।
পাহাড়ের উৎরাই ভেঙে উঠতে ভীষণ কষ্ট। পথ, অন্ধকারে স্পষ্ট নয়। চাঁদের ম্লান আলোটুকু নিভে গেছে। ইতস্তত কিছু কুঁড়েঘর ছোট ছোট পাহাড়ি—উপত্যকা—তিনি পাহাড়ি—উপত্যকায় নেমে গেলেন। পথের দুধারে শূন্য সব কুঁড়েঘর। একটা কুকুর পর্যন্ত ডাকছে না। অন্ধকার এবং মৃত অরণ্য কেবল ভয়ের সঞ্চার করছে। তিনি চলতে চলতে কিছু কীটপতঙ্গের আওয়াজ পাচ্ছিলেন। ওরা সামান্য জীব মাত্র, এতবড় লোকালয় এখন একেবারে জনহীন।
তিনি হাঁটতে হাঁটতে কেমন অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন। কে বা কারা সারাক্ষণ পাহাড়ের নীচে দৌড়াচ্ছে মনে হল। যেন কোনও বন্য জন্তুর দল। ক্লপ ক্লপ শব্দ তুলে খুরে, অনবরত সমতল মাঠে ছুটছে। তিনি দ্রুত পাহাড়ের ঢালুতে নেমে এলেন, মনে হল ভোরের হাওয়া বইছে। মনে হল এবার পুবের আকাশ ফর্সা হয়ে গেছে। আর মনে হল শান্ত এক ভাব ধরণীর কোলে। এইসব মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি একটা গাছের গুঁড়িতে পিঠ রেখে বসে পড়লেন। তাঁর ঘুম এসে গেল।
সুবল কীসের শব্দে জেগে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ওর হাত জেবের ভিতর, পাখিটা পোষা এবং ভালোবাসার পাখিটা কী করছে দেখতে থাকল। চারিদিকে কোলাহল। ট্রেন বড় একটা স্টেশনে থেমে আছে। কেবল ফুঁসছে ট্রেনটা, সে জানালাতে মুখ রাখতেই দেখল, দেহাতি মানুষগুলো সারা রাস্তায় ট্রেন আটকে জল শুষে নিয়েছে, সেই মানুষগুলো স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে পাগলের মতো ছোটাছুটি করছে। গোটা স্টেশনে একদল পুলিশ। দেখলে মনে হবে না ওদের এই মানুষগুলো সম্পর্কে কোনও কৌতূহল আছে। নির্বিকারভাবে যেন একদল বন্য মানুষকে ঘেরাও করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সবাই পালাবার চেষ্টা করছে, কিন্তু হাতে বন্দুক, কিছু ফাঁকা আওয়াজ ওদের সন্ত্রস্ত করছিল।
সুবল এবার দ্রুত নেমে যাবার জন্য দরজা টানতেই দেখল দরজা খুলছে না। সে এবার কামরার ভিতরটা দেখল। এত কোলাহলের ভিতরও টুকুন এবং টুকুনের মা—বাবা অঘোরে ঘুমুচ্ছে। সে ভেবে পেল না এখন কী করবে! সে পুলিশের ভয়ে, নিশ্চয়ই ওরা এসে দরজা খুলে ওকে ধরে নিয়ে যাবে, সে কী করবে ভেবে পেল না! নিশ্চয়ই ওরা এসে ওর হাত ধরে হিড় হিড় করে টেনে নামাবে। ওর ভয়ে কান্না পাচ্ছিল প্রায়।
ঠিক তখন টুকুন জেগে গেছে। এই সব শব্দে, টুকুন জেগে দেখল, সুবল দরজা খুলতে পারছে না। টুকুন বাবাকে দেখেছিল দরজা লক করে দিতে। সুতরাং সুবল দরজা খুলতে পারছে না। সে সুবলকে কিছু বলার জন্য উঠে বসতেই জানালায় দেখতে পেল একজন পুলিশ ওদের কামরার দিকে ছুটে আসছে। প্ল্যাটফরমে হইচই। মানুষের ছোটাছুটি, এবং কান্না। যারা জল চুরি করেছিল অথবা লুট করেছিল তাদের এখন ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। টুকুন ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই ডাকল সুবল, সুবল। দরজা খুলবে না। দরজা খুললে ওরা ঢুকে পড়বে ঘরে।
সুবল বলল, আমাকে ওরা ধরে নিয়ে যাবে!
টুকুন বলল, তাড়াতাড়ি এদিকে এসো সুবল। বলে, সে বাংকের নীচে সুবলকে ঢুকিয়ে দিল। তারপর লম্বা চাদর দিয়ে পর্দার মতো একটা আড়াল সৃষ্টি করে সুবলকে অদৃশ্য করে দিল।
সুবল সব পোঁটলাগুলো শিয়রের দিকে রেখে দিল। জেবের ভিতর পাখিটা আছে, সুতরাং সুবল পাখিটাকে একটু আলগা করে রেখে দিল পাশে। পাখিটা এখন প্রায় জড় পদার্থের মতো যেন শীতে ভয়ানক কষ্ট পাচ্ছে অথবা পাখিটার ঘুম পাচ্ছিল বোধহয়—খুব জড়সড়ো হয়ে সুবলের শিয়রে বসে রয়েছে। টুকুন তার বিছানার চাদরটা নীচে ঝুলিয়ে দিয়েছে। টুকুন রুগণ এবং দুর্বল। টুকুন কোনওরকমে উঠে বসল এবং চাদর ঠিক মেঝের সঙ্গে মিলে আছে কিনা, সুবলের হাত পা এবং অন্য কোনও অংশ বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে কিনা দেখবার জন্য উঠে দাঁড়াল। টুকুন বড় দুর্বল, ক্ষীণকায়। সিল্কের দামি ফ্রক গায়ে ঢল ঢল করছে। শুধু সামান্য মুখে সতেজ সুন্দর চোখ কালো জলের মতো গভীর মনে হয়, বেদনার চিহ্ন এই চোখে। দরজায় ঠক ঠক শব্দ হচ্ছে। টুকুন কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না। মা এবং বাবা শেষ রাতের ঠান্ডা বাতাসটুকু পেয়ে অঘোরে ঘুমুচ্ছেন। সুতরাং টুকুন নিজে ধীরে ধীরে উঠে গেল এবং দরজা খুলে দিল—লম্বা এক পুলিশের মুখ, গোটা দরজা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে।
টুকুন খুব আস্তে আস্তে বলল, কেউ নেই।
—কেউ তোমাদের কামরায় ঢুকে লুকিয়ে নেই তো?
—না।
—বড় জালাতন করছে এইসব দেহাতি মানুষগুলো।
টুকুন কোনও জবাব দিল না। কারণ বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। তার শরীর এত দুর্বল যে, মনে হচ্ছিল মাথা ঘুরে নীচে পড়ে যাবে। সে পুলিশের কথা প্রায় শুনতে পাচ্ছিল না। এটা প্রথম শ্রেণী, ওরা প্রথম শ্রেণীর যাত্রী। পুলিশের গার্ড এসেছিল, স্টেশনমাস্টার এসেছিল, ওদের কামরাতে এইসব দেহাতি মানুষগুলো উপদ্রব করে গেছে কিনা, অথবা কোনও দুর্ঘটনার জন্য এই দেহাতি মানুষগুলো দায়ী কিনা অনুসন্ধানের চেষ্টায় আছে।
টুকুন এবার শক্ত গলায় বলল, এ ঘরে কেউ আসেনি গার্ডসাহেব। বলে, সে মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর বাংকে কোনোক্রমে ছুটে গিয়ে শুয়ে পড়ল। আর অবাক টুকুন, কী বিস্ময় টুকুনের, আজ প্রথম কতদিন পর সে নিজে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়তে পেরেছে। সে কতদিন পর নিজের পায়ের উপর ভর করে দাঁড়াতে পেরেছে। সে নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। মা—বাবা ঘুমুচ্ছেন। মা—বাবা দেখতে পেলেন না টুকুন নিজে উঠে বসেছে এবং নিজে গিয়ে দরজা খুলে দিয়েছে। দরজা বন্ধ করেছে।
সে মা—বাবাকে ডাকেনি, কারণ মা—বাবা হয়তো ঘুম থেকে উঠে দরজা খুলে দিয়ে সব বলে দিতেন। হ্যাঁ, এসেছিল, সুবল এক পাখিয়ালা, সে পাখিয়ালা এসেছিল দলবল নিয়ে, সে তার দলবল নিয়ে এই ঘরের শেষ জলটুকু নিঃশেষ করে গেছে। মাকে হয়তো বোঝাতেই পারত না, সুবল এক পাখিয়ালা এসে টুকুন নামে এক রুগণ স্থবির বালিকার পায়ে শক্তি সঞ্চার করতে সাহায্য করেছে। টুকুন মাকে বাবাকে তার এই বিস্ময় দেখানোর জন্য ডাকল, মা, মা!
সে ডাকল, বাবা, বাবা!
ট্রেন চলছে। ভোর হয়ে আসছে। জানালা দিয়ে আবার বড় মাঠ দেখা যাচ্ছে। ট্রেনের তার দেখা যাচ্ছে। পাখিরা ভোরের আলোতে উড়ে যাচ্ছিল। এই মাঠ দেখলে এখন আর কোনও জলকষ্টের কথা মনে পড়ছে না। কিছুটা সবুজ আভা এখন দেখা যাচ্ছে। গ্রামে মানুষের চালাঘর, গোরুবাছুর এবং মাঠে সামান্য শস্য দেখা যাচ্ছিল। টুকুন খুব ধীরে ধীরে তখনও ডাকছে, মা, বাবা, দেখো দেখো। মা, বাবা, ওঠো ওঠো। দেখো তোমরা, তোমরা দেখো, টুকুন শুয়ে নিজের মায়ের ওপর কোমল হাত রাখল।
সুবল বাংকের নীচে চুপ মেরে শুয়ে আছে। এখন বের হলে যে কোনও আর ভয় নেই সে তা বুঝতে পারছে না। ওর ধারণা পুলিশ এখনও এই ট্রেনে দলবল নিয়ে ঘুরছে। সে এতটুকু নড়ছিল না। সে পাখিটাকে পর্যন্ত হাতের ইশারাতে দুষ্টুমি করতে বারণ করে দিল। কারণ ভোর হয়ে গেছে বোধহয় আর খরা অঞ্চলের ওপর দিয়ে ট্রেন যাচ্ছে না। সে ট্রেনে শুয়ে শস্যের গন্ধ পেল। এই শস্যের গন্ধ পেয়ে পাখিটা কেমন শক্তি পাচ্ছে ভিতরে। ওর ফুর ফুর করে উড়তে ইচ্ছা হচ্ছিল। সে এত উত্তেজিত যে বাংকের নীচেই দু’বার ফুর ফুর করে উড়ে মাথায়—মুখে এসে সুবলের পাশে বসে পড়ল।
সুবল এতটুকু নড়ছিল না। সে পাখিটার দুষ্টুমি ধরতে পেরে বাঁশের অন্য একটা চোঙ টেনে আনল সন্তর্পণে। তারপর পাখিটাকে চোঙের ভিতর ঢুকিয়ে দিল। এবং মুখ বন্ধ করে বলল, বড় বজ্জাত পাজি তুই। বড় শহরে না গেলে তোমাকে আর ছেড়ে দিচ্ছি না।
টুকুন নিজের পায়ের ওপর চোখ রেখেছিল বিস্ময়ে! মা—বাবা উঠে গেছেন। টুকুন ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, মা, আমি উঠে দরজা পর্যন্ত গেছি, দরজা খুলে দিয়েছি।
মা এত বিস্মিত যে কথা বলতে পারছিলেন না। বোধহয় টুকুন স্বপ্নের কথা বলছে।
—বাবা, পুলিশ এসেছিল।
বাবা টুকুনকে দেখতে থাকলেন। কথা বলতে পারছিলেন না।
—বাবা, সত্যি আমি উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিয়েছি। ওরা সুবলকে ধরতে এসেছিল। আমি বলেছি এখানে কেউ নেই।
বাবা এবার দরজার দিকে চোখ তুলে দেখলেন, দরজা তেমনি লক করা আছে। তিনি ভাবলেন টুকুন হয়তো কোনও স্বপ্ন দেখেছে। টুকুন স্বপ্ন দেখেছে কোনও মাঠ অথবা ওর প্রিয় লেবুতলায় সে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে। ওর শরীরের সমস্ত শিরা—উপশিরা শুকিয়ে আসছে। পায়ের কোথাও আর শক্তি অবশিষ্ট নেই। কেমন ক্রমশ টুকুন স্থবির হয়ে যাচ্ছিল। কোথাও কোনও জায়গা নেই, বড় ডাক্তার নেই যেখানে তিনি টুকুনকে নিয়ে না গেছেন। হতাশা এখন সম্বল। মেয়েটা ক্রমশ পঙ্গু হয়ে যাবে তারপর সতেজ মুখে আর কোনও বিষণ্ণ ছবি ঝুলে থাকবে না। টুকুন মরে যাবে। বাবা তার এই স্বপ্নটুকু ভেঙে দিতে চাইলেন না।—বাঃ, বেশতো টুকুন, তুমি হেঁটে গিয়েছ, বাঃ, বেশতো। আমি তো বলেছি তুমি আজ হোক কাল হোক হাঁটতে পারবে। তুমি হেঁটে হেঁটে কোথাও না কোথাও চলে যেতে পারবে।
—বাবা, আমি হেঁটে হেঁটে এই বাংকে এসে শুয়ে পড়েছি। আমি সুবলকে পর্দার আড়ালে রেখে দিয়েছি, সব আমি বাবা নিজের হাতে করেছি। আমি পায়ে হেঁটে করেছি। বলে টুকুন ফের উঠে বাবাকে দেখাতে চাইল, আমি হাঁটতে পারি, মাকে দেখাতে চাইল, এই দেখ আমার পায়ে কেমন শক্তি, কিন্তু হায়, টুকুন শত চেষ্টা করেও পায়ের ওপর ভর করে দাঁড়াতে পারল না, অতীব আশার উত্তেজনা ওকে বড় অসহায় করে তুলছে। তবে কী সব ভোজবাজির মতো হয়ে গেল! টুকুন কত চেষ্টা করল। কতভাবে চেষ্টা করল। প্রাণে সকল আবেগ ঢেলে চেষ্টা করল, কিন্তু হায়, টুকুন কিছুতেই আর নিজের চেষ্টায় উঠে বসতে পারল না। টুকুন ভয়ঙ্কর হতাশায় ফের কেঁদে ফেলল, মা, আমার কিছু ভালো লাগে না, তোমরা আমাকে ছেড়ে দাও, কোথাও আমি চলে যাব।
হায়, মেয়েটার দিকে এখন আর তাকানো যাচ্ছে না। সতেজ মুখে চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে। সাদা জামা, চোখের জলে ভিজে গেল। সারাজীবন ধরে কান্না। কী এক দুরারোগ্য ব্যাধি, কী এক অসীম হতাশা এই পরিবারকে ক্রমশ গ্রাস করছে। টুকুন ক্রমশ পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে। হাত—পা অচল হয়ে যাচ্ছে। ভিতরের শিরা—উপশিরা শুকিয়ে যাচ্ছে, রোগের কোনও কারণ নির্ণয় করা যাচ্ছে না।
ট্রেন চলছিল। পাখি উড়ছিল আকাশে। লাইনের তারে কিছু শালিখ পাখি দেখতে পেল ওরা। কত গ্রাম—মাঠ ফেলে ট্রেন ছুটছে। জানালায় ছোট ছোট কুঁড়েঘর, বড় দিঘি, কালো জল, সবুজ মাঠ ভেসে উঠছিল। যত ট্রেন বড় শহরের কাছাকাছি চলে যাচ্ছে তত লোকালয়, ইট—কাঠের বাড়ি, কারখানার চিমনি এবং লোহার পুল। সুবল বাংকের নীচে থেকে উঠে এলে দেখতে পেত সব। বোধহয় সুবল ফের ঘুমিয়ে পড়েছে বাংকের নীচে। সুবলকে ঘুমুতে দেখে পাখিটা চোখের ভিতর কিচমিচ করছিল। ছটফট করছিল ভিতরে। ফুর ফুর করে ওড়বার ইচ্ছা পাখির, পাখি কেন আর এখন চোঙের ভিতর থাকবে। দুষ্টু পাখি সুবলের কানের কাছে চোঙের ভেতর থেকে বের হবার জন্য কিচমিচ করে প্রায় কোলাহল জুড়ে দিল।
বোধহয় সুবল পুলিশের ভয়ে ঘাপটি মেরে আছে। নড়ছে না। পাখিটা চোঙের ভেতর থেকে ভাবছে সুবল ঘুমোচ্ছে। টুকুন ভাবছে সুবল ঘুমুচ্ছে। মা—বাবা এ—ঘরে সুবল আছে বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না। কারণ এঁরা সুবলকে দেখতে পাচ্ছেন না। চাদরটা মেঝেতে গড়াগড়ি যাচ্ছে। সুবলের হাত—পা—মুখ কিছু দেখা যাচ্ছে না। সবটাই স্বপ্ন টুকুনের। সুবল, পাখিয়ালা সুবল চলে গেছে।
আর ঠিক তক্ষুনি সুবল চাদর ফাঁক করে কচ্ছপের মতো মুখ বার করে বলল, মা পুলিশ দরজায় দাঁড়িয়ে নেই তো। মা, আমরা আর কতক্ষণ ট্রেনে? পুলিশ আমাকে ধরবে না তো! টুকুন শুয়ে শুয়ে বলল, তুমি কতদূর যাবে সুবল?
—আমি কলকাতা যাব দিদিমণি।
—সেখানে কে আছে সুবল?
—আপন বলতে কেউ নেই। বলে সুবল হামাগুড়ি দিয়ে চাদরটা সরিয়ে বের হয়ে এল। নোংরা জামাকাপড় বলে সে এক কোণায় মেঝের ওপর জবুথবু হয়ে বসল। সে দু’হাত জোড় করে বলল, মা, পাখিটা আমার বের হতে চাইছে। বের করব? পাখিটা একটু উড়তে চাইছে।
পাখিটা হেগে—মুতে দিতে পারে এই ভয়ে প্রৌঢ় মানুষটি কিঞ্চিৎ সংশয় প্রকাশ করছিলেন। নোংরা সুবলকে সহ্য করতে পারছিলেন না। যেখানে সুবল বসছে ঠিক সেখানেই নোংরা লাগাচ্ছে। কিন্তু টুকুন পাখির নাম শুনেই বলল, সুবল, তুমি এখন পাখি ছেড়ে দিলে মাঠে উড়ে যাবে?
—না দিদিমণি। পাখি আমার পোষা। পাখির মা নেই বাবা নেই, আমার মতো পাখির কেউ নেই। আমাকে ফেলে পাখি আর কোথাও যাবে না দিদিমণি।
—দেখি, কেমন যায় না!
—কেন দিদিমণি, তুমি দ্যাখোনি পাখিটা আমাকে কেমন সব পোকামাকড় ধরে দিয়েছে?
—তা দিয়েছে তোমার পাখি।
—তবে এই দ্যাখো। বলে চোঙের মুখ খুলে দিল সুবল। সেই পাখি সোনার ঠোঁটে কিচমিচ করে উঠল। পেটের দিকে সাদা রঙ, পাখা কালো আর ঘন সবুজ রঙ পাখির পায়ে। পাখিটা প্রায় নেচে নেচে বেড়াল সারা কামরায়। পাখিটা দেয়ালে উড়ে গিয়ে বসল, ওপরের বাংকে বসে উঁকি দিয়ে যেন গাছের ডালে বসে উঁকি দিচ্ছে তেমনি পাখিটা নীচে টুকুনকে দেখল। টুকুন পাখিটাকে দেখল, মাঠের ভিতর খোলা আকাশের নীচে এই পাখি কত সুন্দর দেখাত—সুবল এক পাখিয়ালা কলকাতা যাচ্ছে। যেন বলছে, দেখো দেখো খেলা দেখো, পাখি আমার খেলা দেখাবে, নাচবে, গাইবে, হাওয়ায় উড়বে, ষাঁড় গোরুর মতো, ভালুক অথবা বাঁদর নাচের মতো, সুবল এক পাখিয়ালা কলকাতা নগরীতে অন্নসংস্থানের জন্য যাচ্ছে।
পাখিটা জানালায় বসল, পাখিটা টুকুনের শিয়রে বসে লেজ নাড়ল। আর পাখিটাকে টুকুন সামান্য আপেলের টুকরো দিল খেতে। শিয়রে বসে টুকুনের হাত থেকে পাখিটা ফলের নরম অংশ ঠুকরে ঠুকরে খেল।
তখন সুবল বসেছিল নীচে। ওর পোঁটলার ভিতর লুকনো বটফল, একমুঠো ফল মুখে ফেলে দিয়ে চিবুতে থাকল। প্রায় যখন ফেনা উঠে গেছে মুখে তখন দলাটা কোঁৎ করে গিলে ফেলল সুবল। ফের একমুঠো, ফের ফেনা ওঠা পিষ্টক সে খেয়ে সামান্য পাখিটার জন্য রেখে দিল হাতে।
সুবলের এই নোংরা স্বভাব দেখে টুকুনের মা ঘৃণায় মুখ কোঁচকাল, ঘৃণায় একবার চেকারবাবুকে ডেকে বলবে কিনা ভাবল, এখন তো খরা অঞ্চল নেই, এখন দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষদের ভয় কি! সুতরাং এবার প্রায় টুকুনের মা ধমক দিয়ে বলল, সামনের স্টেশনে তুমি বাপু নেমে যাবে।
সুবল বলল, তাই যাব মা। স্টেশনের কী নাম?
—স্টেশনের নাম ব্যান্ডেল।
—যাব মা। সেখান থেকে কলকাতা কতদূর মা?
অত কথা শুনতে ভালো লাগল না। কোথাকার কোনও এক মানুষ, উটকো মানুষ মা মা বলে একেবারে কামরাটাকে কদাকার করে তুলছে। সে বলল, মা, আমি তো আপনাদের কোনও অনিষ্ট করছি না।
টুকুন শুনছিল সব। সে দেখল সুবল ভয়ে কেমন চুপ মেরে গেছে। সুবল ওর সব সম্বল নিয়ে এসেছে বলে পোঁটলা খুলে দেখল, ছোট ছোট পোঁটলার কোনোটায় চন্দনের বীচি, কোনোটাতে পুঁতির মালা।
তার মা একবার মেলা থেকে একটা পুঁতির মালা কিনে দিয়েছিল আর রঙবেরঙের সব পাথর, সে সেইসব পাথর পাহাড়ের নুড়িপাথর থেকে সংগ্রহ করেছে। সে কিছুই ফেলে না। যা ভালো লাগে, যা কিছু ভালো লাগে—সবই সঞ্চয়ের সামিল এই ভেবে সব সে সঞ্চয়ের ঝুড়িতে জমা রেখে দিত। চন্দনের বীচি, কুঁচফল এবং ভিন্ন ভিন্ন পাথরের উজ্জ্বল রঙ টুকুনকে পুলকিত করছিল। টুকুন মাকে ভয় পায়, মা সুবলকে নেমে যেতে বলেছেন, টুকুনের কষ্ট হচ্ছিল। খুব কষ্ট হচ্ছিল টুকুনের, কারণ সুবলের কেউ নেই—কত আর বয়েস সুবলের, সে সময় পেলে পাখির খেলা দেখায়। অথবা কোনও কোনও সময় ঋষিপুত্রের মতো মনে হয় যেন সুবলকে, সবচেয়ে বড় আশ্চর্য, সুবলের জন্য টুকুন দরজা পর্যন্ত হেঁটে যেতে পেরেছিল। যেন এক দৈবশক্তি ভর করেছিল টুকুনের পায়ে। অথবা সুবল মন্ত্র—টন্ত্র পড়ে টুকুনকে হাঁটতে সাহায্য করেছে। এই সুবল চলে গেলে সে সত্যই পঙ্গু হয়ে যাবে। আর কোনওদিন সে হেঁটে গিয়ে জানালায় দাঁড়াতে পারবে না, কোনওদিন সে খোলা আকাশের নীচে আর দৌড়তে পারবে না।