টুকুনের অসুখ – উনিশ
তখন শহরে মিছিল যাচ্ছে। মিছিলের স্লোগান—ঘেরাও চলছে, চলবে। স্লোগান, আমাদের দাবি মানতে হবে।
বড় বড় লাল শালুতে দাবির ঘোষণা। বেশ বড় বড় করে লেখা—বেতনের একটা নিম্নতম হার।
পথের ধারে দাঁড়িয়ে মিছিলের দিকে চেয়ে এক ভিখারিনি, পাগলিনি—প্রায় ভীষণ হাসছিল। আর হেঁকে হেঁকে বলে যাচ্ছিল—দু ঘরের মাঝে অথৈ সমুদ্দুর।
মজুমদার সাহেবের ড্রাইভার বলল—স্যার, আর এগুনো ঠিক উচিত হবে না।
মজুমদার সাহেবের ড্রাইভার খুব পুরানো লোক। এবং কী হবে না হবে সেটা তার মনে করিয়ে দেবার স্বভাব। সে বলল—মিছিল শেষ হলেই গাড়ি জ্যামে পড়ে যাবে।
মজুমদার সাহেব টুবাকো টানেন। পাইপে ধোঁয়া উঠছে না। তিনি বুড়ো আঙুলে টিপে টিপে ফের কটা টান দিয়েও যখন দেখলেন ধোঁয়া উঠছে না, তখন কেমন ক্লান্ত দেখাচ্ছিল তাঁকে। ক্লাবে আজ একটা বড় রকমের লাইসেন্সের লেনদেনের ব্যাপার আছে। ট্যান্ডন সাব আসবেন। তাঁকে খুশি করার ব্যাপারও একটা আছে। মিস ললিতাকে সেজন্য তিনি ফোনে বলে রেখেছিলেন, আর রাস্তায় নেমে এমন একটা বিশ্রী ব্যাপারের ভিতর আটকে যাওয়া। তিনি কেমন বিরক্ত মুখে বললেন—দিন দিন এসব কী হচ্ছে বুঝি না।
ড্রাইভার বলল—স্যার বরং গাড়ি বাড়িতে নিয়ে যাই।
কোনো উপায় নেই বুঝতে পারলেন। কেবল তারা যাচ্ছে। আর চারপাশে গাড়ির হর্ন। এভাবে ক্রমে এই রাস্তা একটা গাড়ির পিঁজরাপোল হয়ে যাবে কিছুক্ষণের ভিতর। তিনি যে এখন কী করেন। তাঁর হাত—পা কামড়াতে ইচ্ছা হচ্ছে। অথবা এই সব মিছিলের মানুষদের ধরে শহরের বাইরে বের করে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। তিনি বললেন—দ্যাখো ব্যাক করতে পারো কিনা।
এবং তখনই পাগলিনি হেঁকে হেঁকে যাচ্ছে—দু—ঘরের মাঝে অথৈ সমুদ্দুর। হাতে তার লাঠি। লাঠির মাথায় পালক। পাগলিনিকে ভীষণ দাম্ভিক মনে হচ্ছে। মজুমদার সাহেব বললেন—দ্যাখো পাশ কাটাতে পারো কিনা।
তারপর ফিরে এসে ফোন। প্রোগ্রাম ক্যানসেল। ভিতর বাড়িতে এ—সময় কারও থাকার কথা না। টুকুনের যাবার কথা আছে একাডেমিতে। ইন্দ্রকে নিয়ে যাবে। এখন টুকুন ভীষণ ভালো গাড়ি চালাতে পারে। ওঁর ইচ্ছা হাতের সব কাজ হয়ে গেলে একবার গাড়িতে স্বামী স্ত্রী টুকুন সবাই কাশ্মীর যাবেন। খুব জমবে। টুকুনের মা নিশ্চয়ই দরিদ্র—বান্ধব ভাণ্ডারে চাঁদা আদায়ের জন্য মিঃ তরফদারের কাছে গেছে। সেখান থেকে ফিরতে ওর রাত হবার কথা।
অথচ এমন একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট ক্যানসেল করে মনটা খচ খচ করছিল। তবে তিনি ট্যান্ডন সাবকে জানেন ভীষণ লোভী মানুষ। আশ্চর্য সৎ টাকাপয়সার ব্যাপারে। এক পয়সা ঘুষ তিনি নেন না কথিত আছে। তবে যে দেবতা যাতে খুশি। ললিতা সম্পর্কে এমন একটা ছবি তৈরি করে রেখেছেন ট্যান্ডন সাবের মনে যে তাঁর আর সূর্যাস্ত না দেখে উপায় নেই। নদীর পারে খোলামেলা বাতাসের ভিতর একটা নিরিবিলি গাছের ছায়ায় ট্যান্ডন—সাব আর ললিতা। সব ব্যবস্থা মজুমদার সাহেব নিপুণভাবে করে রেখেছেন। অথচ এই সময়টায় কিনা মিছিলের লোকগুলি—কাজ না করে ফাঁকি দিয়ে দিয়ে পয়সা কামাতে চায়! কী যে স্বভাব মানুষের এবং এটা বাঙালিদের ভিতর খুব বেশি এমন মনে হলে তাঁর কেন জানি মনে হয় আর এ বাঙালি জাতিটাকে বাঁচানো গেল না।
রামনাথ ব্যক্তিগত খানসামার কাজও করে, এ সময়ে সাহেবের ফাইফরমাশ খাটার সে মানুষ, মুখ লম্বা করে দাঁড়িয়েছিল—কী যে আদেশ করবেন তিনি।
এবং রামনাথ ভাবতেই পারেনি, এমন অসময়ে সাহেব তার কুটিরে ফিরে আসতে পারেন! তার পোশাক—আসাক ভারী বিশ্রী—সে তাড়াতাড়ি প্যান্টের বোতাম আঁটতে ভুলে গেছে। সে দাঁড়িয়ে ছিল অ্যাটেনশান হয়ে। পাগড়ি তার ঠিক ছিল না। স্ট্যান্ড অ্যাট ইজ হতেই তার মনে হল কী যেন দেখছেন মজুমদার সাব।
সে একটু হকচকিয়ে কেমন বোকার মতো হেসে দিল।
তারপর যা হয়, তাঁর অঙ্গুলি সংকেতই যথেষ্ট। রামনাথ দেখল ওর প্যান্টের বোতাম আলগা। নীচে কিছু পরার স্বভাব নেই বলে এমনটা হয়। সে জানে আরও ক—বার তার এমন হয়েছে। এবং মজুমদার সাবের লাস্ট ওয়ার্নিং ছিল। রামনাথ এখন ভীষণ কুপোকাত। সে বলল—সাব আর হবে না।
মজুমদার সাহেব মনটা ভালো না। তিনি তাঁর এটাচড বাথরুমে এখন ঢুকে বেশ ঠান্ডা জলে স্নান করবেন। তাঁর বাঁধানো দাঁত এখন টেবিলে একটা মোমের বাটিতে ভেজানো থাকবে। এবং তখন কিনা রামনাথ হাতজোড় করে দাঁড়াল। সাহেব কেমন অবাক চোখে তাকালেন। এ—ব্যাপারে যে তিনি একটা লাস্ট ওয়ার্নিং ওকে দিয়ে রেখেছিলেন, বেমালুম ভুলে গেছেন। টুকুনের মা—র ফিরতে অনেক রাত হবে। মিছিল—টিছিলের ব্যাপার দেখিয়ে একটা বেশ অজুহাত তৈরির সুবিধা পেয়ে যাবে।
কারণ এই শহরে মিছিলের পরই জ্যাম আরম্ভ হয়। এবং জ্যাম ভাঙতে ভাঙতে রাত যে কত হয় কত হতে পারে কেউ যেন জানে না। এবং এভাবে টুকুনের মা যত রাত করেই ফিরুক মজুমদার সাহেব কিছু বলতে পারেন না। রাত তাঁরও হয়। তবে তিনি একটা ব্যাপারে খুবই ভালো মানুষ, টুকুনের মাকে খুব ভালোবাসেন। ললিতার মতো মেয়েরা ট্যান্ডন সাবদের মতো মানুষের ভোগে লাগে—মজুমদার সাব সেখানে সামান্য কৌশলী ব্যান্ড—মাস্টার মাত্র।
এবং এভাবে আজকের ব্যান্ড—মাস্টার মজুমদার সাহেব নিজে হয়ে যাচ্ছেন। বাথরুমে স্নান করার সময় তাঁর কথাটা মনে পড়ল। মাথায় শাওয়ারের জল। হাতে নানা রঙের পাথর সব—দামি, ভাগ্য ফেরানোর ব্যাপারে সেই যৌবনকাল থেকে পরে আসছেন। এখন দু—আঙুলে দশটা—ক্রমে বয়েস বাড়লে বিশটা হয়ে যাবে। বাথরুমের আলোটা সাদা মতো দেখাচ্ছে। পেটে চর্বি, এবং লোমশ শরীর থেকে টুপটাপ জল পড়ছে। আয়নায় নিজের চেহারা দেখে টুকুনের মা—র কাছে নিজেকে কেমন একটা বনমানুষ মনে হল। ভাবল, টুকুনের মা—র আসতে দেরি হওয়া স্বাভাবিক। মুখে চোখের ভয়ঙ্কর ঈর্ষা কেমন এক উদাসীন সন্ন্যাসীর মতো হয়ে গেলে আয়না থেকে চোখ তুলে নেন তিনি। খুব সুগন্ধযুক্ত সাবানের ফেনার ভিতর লম্বা টবে শুয়ে শুয়ে ঠান্ডা জলে কী যে ভালো লাগে পাইপ টানতে। এবং অনেক টুকিটাকি কাজ তিনি এভাবে শুয়ে ঠান্ডা জলের ভিতর সেরে ফেলতে পারেন। রামনাথ তখন তাঁর অনেক কাছের মানুষ হয়ে যায়। দরজায় পাহারা—আভি কোই মাত ঢোকনা। সাব নাহানে মে গিয়া।
—রামনাথ।
রামনাথ বুঝল, বাবুর নকল দাঁত এবার তাকে দিয়ে আসতে হবে। অথচ কী যে বয়স। এমন সামান্য বয়সে দাঁত কেন পড়ে যায় সব সে ভাবতে পারে না। সব না এক পাটির কিছু অংশ সে জানে না। এমন একটা মোমের পাত্রে তা ঢাকা থাকে, এবং সে যখন ভিতরে দিয়ে আসে তখন সাহেবের মুখে এমন একটা ফুলো ভাব থাকে যে দেখলে মনে হবে তাঁর একটা দাঁতও পড়েনি এবং রামনাথ জানে না, মেমসাব আজও জানে কিনা, দাঁত নকল না আসল। কনফিডেনসিয়াল সব। সে এ—ঘরের টুঁ শব্দটি দরজার বাইরে বের হতে দেয় না। এখানে এই স্নানের সময়টুকু স্নানের ঘরে ঢুকলেই তাঁর বের হতে হতে দু—ঘণ্টা—রামনাথের মনে হয় ঠান্ডা জলে কীসব গন্ধদ্রব্য একটার পর একটা ঢেলে, তিনি আশ্চর্য এক নীল সমুদ্রের বাসিন্দা হয়ে যেতে চান। সে তখন যেই খোঁজ করুক না—সাব নাহানে মে হ্যায়। ব্যাস তার এক কথা। এমনকি তখন মেমসাব কেমন সন্তর্পণে চলাফেরা করেন। তিনি পর্যন্ত ঢুকে বলতে সাহস পান না, আমি দেখব, দাঁত আসল না নকল।
তারপর যা হয়ে থাকে…নকল দাঁতের শৌখিনতা মানুষের মনে সেই কবে থেকে যেন। সে জানে বোঝে নকল দাঁতেরা খুব উজ্জ্বল হয়। পুরানো দাঁত পরে থাকতে বুঝি ভালো লাগে না মানুষের। উজ্জ্বল দাঁত পরে, হাসিটুকু উজ্জ্বল রেখে, সব সময় মানুষ তার নিজের গোড়ালি উঁচু রাখতে চায়। এবং এর ভিতরই থেকে যায় অসুখটা। টুকুনের ছিল—কিন্তু মজুমদার সাব অথবা মেমসাহেবের কোনও অসুখ নেই কে বলবে। প্রাচুর্য অনায়াস হলে মানুষের নকল দাঁতের দরকার হয়। মজুমদার সাব এটা যে বোঝেন না তা নয়, খুব বোঝেন। উদ্যম বিহনে কিবা পূরে মনোরথ—উদ্যমই সব। অথচ কোথায় যে মানুষেরা উদ্যম বিহনে ভুগে ভুগে অনায়াস প্রাচুর্যের লোভে কখনও মিছিলের ভিতর, কখনও কারখানার ভিতর, আবার কখনও বড় বাড়ির সদরের এক কঠিন অসুখ—আর, এভাবে একটা ঐতিহাসিক তত্ত্বের মতো ঘটনাটা আবিষ্কার করে কেমন তিনি উৎফুল্ল হলে, দরজার ও—পাশে ক্রিং ক্রিং করে ফোন বেজে উঠল।
তিনি রামনাথের গলা পাবেন আশা করে বসে আছেন—কে রে? তিনি রামনাথকে উদ্দেশ করে বাথরুম থেকে বললেন।
—সাব ইন্দ্র দাদাবাবু।
—ইন্দ্র দাদাবাবু।
—হ্যাঁ সাব।
—ছোঁড়াটা জ্যামে পড়ে গেল বুঝি!
—তা কিছু বলছে না।
—তবে কী বলছে?
—মেমসাবকে চাইছে।
—ধরো। আসছি।
তিনি একটা নীল রঙের তোয়ালে কোমরে জড়িয়ে বেশ ছুটে এসে ফোনটা ধরলেন—হ্যালো কে?
—আমি ইন্দ্র বলছি মেসোমশাই!
—কী ব্যাপার!
—ব্যাপার খুব ভীষণ।
—রাস্তায় আটকা পড়েছ?
—রাস্তায় না, একাডেমিতে। পাশের একটা দোকান থেকে ফোন করছি।
—আটকা পড়েছ মানে?
—টুকুন আমাকে না বলে না কয়ে কখন বের হয়ে গেছে গাড়ি নিয়ে।
—কোথায় গেছে?
—জানি না।
—কখন গেছে?
—অনেকক্ষণ।
—গেছে যখন, ঠিক ফিরে আসবে। মজুমদার সাব এইটুকু বলে ফোন ছেড়ে দেবেন ভেবেছিলেন। কিন্তু মনে হচ্ছে ইন্দ্র আরও কিছু বলবে। কারণ তিনি বুঝতে পারছিলেন সে কিছু বলতে ইতস্তত করছে।
—টুকুন আমাকে বলল, একটু বোসো। আমি আসছি।
—আসছি যখন বলেছে, ঠিক চলে আসবে।
—সে বাড়ি ফিরে যায়নি তো?
—তোমাকে না নিয়ে বাড়ি ফিরবে কী করে!
—কী জানি, ওর যা মেজাজ।
—কতক্ষণ হল গেছে?
—ঘণ্টা দুইয়ের ওপর হবে।
মজুমদার সাবের মুখ সামান্য সময়ের জন্য খুব উদ্বিগ্ন দেখাল তারপর ভাবলেন কোনও জ্যামে পড়ে গেছে। তিনি বললেন—আজ তোমাদের বের হওয়া উচিত হয়নি। কী করে যে ফিরবে ঠিক বুঝতে পারছি না। আমার তো যাবার কথা ছিল ওদিকে, কিন্তু কিছুতেই যেতে পারলাম না। রাত দশটার আগে জ্যাম ছাড়বে বলে মনে হয় না।
—এদিকে তো শুনছি মাঠে ভীষণ গণ্ডগোল। পুলিশ আর জনতার খুব মারধর হচ্ছে। যে যেদিকে পারছে পালাচ্ছে।
—তোমার তো দোকানে থাকা উচিত হবে না এ—সময়। টুকুন ফিরে এসে তোমাকে না পেলে ভাববে।
—কিন্তু এমন হওয়া তো উচিত না। কেমন বেপরোয়া। হুঁশ করে গাড়ি নিয়ে চলে গেল। সোজা রবীন্দ্রসদন পার হয়ে বাঁদিকে ঘুরে গেল।
—কোথায় যেতে পারে তোমার মনে হয়।
—কী করে বলব। তবে কদিন থেকে বলছিল ওর বাওবাব গাছের খুব একটা দরকার।
—বাওবাব গাছ! সে আবার কী!
—সে আমিও জানি না। সুবল একটা বাওবাবের চারা খুঁজছে।
—কত রকমের যে গাছ আছে পৃথিবীতে!
ইন্দ্র মনে মনে হাসল। মেয়ের মতো বাপেরও বুঝি একটা রোগ আছে। মেয়েটা কোথায় গেল, এতটুকু চিন্তা করছে না। সে এবার বলল—মাসিমা কোথায়?
—এ সময় তো তুমি জানো ও বাড়ি থাকে না। আমিই কেবল অসময়ে বাড়িতে। একটু থেমে বললেন—শোন, তুমি দেরি কোরো না। ও এসে তোমাকে জায়গামতো না দেখলে খুব চিন্তায় পড়ে যাবে।
ইন্দ্র এবার হাসবে না কাঁদবে ভেবে পেল না। সে বলল—ঠিক আছে, যাচ্ছি। সে মজুমদার সাবকে কিছু বলে চটাতে ভয় পায়। টুকুনের সায় নেই, মেসোমশাইরও সায় না থাকলে ওর হিসাব উলটে যাবে। সে ভয়ে বলতে পারল না টুকুন আমাকে এসে না দেখলে খুব খুশি হবে, সে এতটুকু ঘাবড়ে যাবে না। বললেই যেন সে ধরা পড়ে যাবে—সে খুব অক্ষম, টুকুনকে সে এতদিনেও হাত করতে পারেনি। এবং অন্য যুবকেরা তো বেশ গোড়ালি উঁচু করে দাঁড়িয়েই আছে—এক ফাঁকে এই সাম্রাজ্যের ভিতর কী করে লাফিয়ে পড়া যায়। টুকুনের এক মাস্টারমশাই পর্যন্ত—ছোঁড়া খুব দামি গাড়িতে আসে পড়াতে। মেসোমশাইর কাছে ওর খুব সুনাম! আশ্চর্য যে একজন পেটি শিক্ষক কীভাবেই বা আশা করে টুকুনের মতো মেয়েকে পাবার—তবে যে টুকুনের অসুখ। অসুখ না থাকলে এমনভাবে সে একটা পাখিয়ালার জন্য বাওবাবের চারা খুঁজে বেড়াচ্ছে!
হঠাৎ ইন্দ্রের খেয়াল হল, যা, মেসোমশাই ফোন ছেড়ে দিয়েছে! সে হঠাৎ কী ভাবতে গিয়ে বলতে গিয়ে বলতে পারল না, আমি ঠিক জানি ও কোথায় গেছে! কিন্তু ওটা যে আর বলা হল না! মেসোমশাই ফোন ছেড়ে দিয়েছে। সে আবার ভাবল ডায়াল ঘুরিয়ে বলবে—কিন্তু তক্ষুনি মনে হল টুকুন যদি চলে আসে। সে সত্যি যদি ওকে না দেখে ভীষণ ঘাবড়ে যায়! এমন ভাবতে ইন্দ্রের ভীষণ ভালো লাগে এবং ভালো লাগাটা সে কখনও সত্যি সত্যি মনে মনে মেনে নেয়। কী হবে সব জানিয়ে—মেয়েটার অসুখ বড় কঠিন অসুখ এক—যা সে নিত্যদিন দেখে দেখে কেমন বিষণ্ণ হয়ে যায়। কোথাকার এক পাখিয়ালা, কোথাকার এক পেটি শিক্ষক—যারা সহবত জানে না তারা পর্যন্ত টুকুনের কাছে খুব দামি মানুষ।
ইন্দ্র সুতরাং রাস্তা পার হয়ে যায়। সেই গাছটার নিচে গিয়ে বসে থাকে। এবং গাড়িগুলোর যাওয়া—আসার পথে সে কেবল ভাবে—এই বুঝি টুকুন এল। ক্রমে রাত বাড়ে এভাবে। ওর ভালো লাগে না। মাকে ফোন করে গাড়ি পাঠিয়ে দিতে বলবে ভাবল। মা জিজ্ঞাসা করবে—কী হল, তোকে তো টুকুন পৌঁছে দিয়ে যায়। আজ তোর এমন কথা কেন! সে কেন জানি তার মাকেও বলতে ভয় পায়—মা, টুকুনের অসুখে আমাকে জড়াচ্ছ কেন। মেয়েটা আমাকে পাত্তা দিচ্ছে না। তারপরই মনে মনে ভীষণ রাগ, এবং এক কঠিন মুখ, এ—মুখ যে তার নিজের সে ঠিক তখন বুঝতে পারে না। কেমন নৃশংস মুখ হয়ে যায়। পেটি শিক্ষকের কথা সে ছেড়ে দিতে পারে, তার ওপর সে ভরসা রাখতে পারে; কিন্তু মনে হয় বারবার সে হেরে যাবে একজনের কাছে—তার নাম সুবল—এক পাখিয়ালা। ফুলের রাজ্য তৈরি করে সে এক স্বপ্নের দেশের মানুষ হয়ে গেছে টুকুনের কাছে। তার মাঝে মাঝে ইচ্ছা হয়, টুকুনের স্বপ্নটাকে সে যে ভাবে পারে ভেঙে দেবে। এবং তার আজই ইচ্ছা হল, একবার গোপনে সে সুবলের দেশটা দেখে আসবে—কীসের আকর্ষণ, এমনভাবে তাকে ফেলে পালিয়ে যাবার কী এমন আকর্ষণ! তারপরই কেন জানি সে জোর করে হেসে ফেলে—কীযে সব আজেবাজে সে ভাবছে! টুকুন না বলে গাড়ি নিয়ে গেছে বলে অভিমানে যত সব বাজে সন্দেহ। হয়তো এক্ষুনি এসে পড়বে। কোথাও জ্যাম—ট্যামে আটকে গেছে। তা ছাড়া যদি…..যদি….একটা অ্যাকসিডেন্ট! ওর কেমন ভয় ধরে গেল। এভাবে বসে থাকা ঠিক হচ্ছে না। সব খুলে বলা দরকার। একটা ট্যাকসি—এই ট্যাকসি। এভাবে দুবার তিনবার ট্যাকসি ডেকে শেষবার পেয়ে গেলে—সোজা টুকুনদের বাড়িতে। সে এসেই বলল—টুকুন ফেরেনি মাসিমা?
মাসিমার মুখ ভীষণ ভার। জ্যামে তিনিও আটকে গিয়ে অসময়ে বাড়ি ফিরে এসেছেন। হাতের এতটা সময় কী কে করেন! মিঃ তরফদারের সঙ্গে তাঁর দেখা না হওয়ায় তাঁর খুব খারাপ লাগছে। এবং তখন যেন হাসতে হাসতে বলা—শুনছ, টুকুন ইন্দ্রকে গাছতলায় বসিয়ে গাড়ি নিয়ে হাওয়া খেতে গেছে।
—ভালো করেছে।
মেজাজ ভালো না থাকার ব্যাপারটা মজুমদার সাব বেশ ধরতে পেরে মনে মনে হাসছিলেন।
এবং ঠিক পরে পরেই ইন্দ্র এসে যখন বলল—মাসিমা টুকুন ফেরেনি! কেমন হুঁশ ফেরার মতো তিনি ঘড়ি দেখলেন—মেয়েটার জন্য কেমন প্রাণ কেঁদে উঠল। আর সঙ্গে সঙ্গে হুঙ্কার—তুমি কী। মজুমদার সাবকে ভীষণ গালাগাল—তুমি এতবড় নিষ্ঠুর। আমার একটা মাত্র মেয়ে তাও তুমি এমনভাবে চুপচাপ আছো।
—আরে ঠিক চলে আসবে। মনে হয় সুবলের কাছে গেছে।
—সেই পাখিয়ালাটা! ছিঃ ছিঃ। তুমি এখনও চুপচাপ বসে আছ? ইন্দ্র, তুমি পরিমলকে ধরো তো।
—আরে করছ কী! পুলিশ কমিশনার—টমিশনার আবার ডাকছ কেন? আমি তো আন্দাজে বললাম।
টুকুনের মা ঘড়ি দেখছে কেবল। নটা বেজে গেছে। সুবলের কাছে গেছে কী, যায়নি, কেউ তো ঠিক জানে না, হয়তো মীনাদের বাড়ি গেছে, মীনার কথা মনে হতেই জোনার কথাও মনে হল। যা খামখেয়ালি মেয়ে। টুকুনের মা সব ওর বান্ধবীদের এক এক করে যখন ফোন শেষ করে উঠবে তখন সবার চোখে অন্ধকার। এবার বোধ হয় পুলিশ কমিশনার—টমিশনার দরকার আছে। কিন্তু এতবড় বাড়ির একটা ব্যাপার, স্ক্যান্ডাল হতে কতক্ষণ—আরও কিছু সময় দেখা দরকার। হয়তো কিছুই হয়নি। পুলিশে ছুঁলেই আঠারো ঘা। সুতরাং ইন্দ্র, মজুমদার সাব, টুকুনের মা এবং মজুমদার সাবের পার্সোনেল সেক্রেটারি চুপচাপ কী করা যায় ভাবছিলেন—তখন মনে হল কেউ বলতে বলতে আসছে—টুকুনদিদিমণি আসছে।
ওরাও দেখল টুকুনদিদিমণি আসছে। ভীষণ সজীব। পেছনে ধীর পায়ে আসছে সুবল। কত লম্বা দেখাচ্ছে ওকে। খুব হাসিখুশি। বাড়ির ভিতর যে একটা ব্যাপার ঘটবে সুবল যেন বুঝতে পেরেছে। তবু সে এতটুকু আমল না দিয়ে বলল—টুকুনদিদিমণি একাই ফিরতে চেয়েছিল, এতটা রাস্তা একা আসবে—ঠিক সাহস পেলাম না।
মজুমদার সাব খুব সংযত গলায় বললেন—এভাবে টুকুন তোমার যাওয়া উচিত হয়নি। আমরা খুব ভাবছিলাম।
ইন্দ্র বলল—আর একটু হলেই পরিমল মামাকে ফোন করব ভেবেছিলাম।
টুকুনের মা বলল—তুমি আর বাড়ি থেকে কোথাও বের হবে না।
সুবল বলল—আমি যাচ্ছি টুকুনদিদিমণি।
মজুমদার সাব বললেন—না, বোস।
টুকুনের মা বলল—না, তুমি যাও সুবল। অনেক রাত হয়েছে।
সুবল বলল—সেই ভালো।
টুকুন বলল—একটু দেরি করে গেলে কিছু হবে না। এগারোটার লাস্ট ট্রেন পেয়ে যাবে। একটু কফি করে দাও মা।
মা যে কী জবাব দেবে ভেবে পেল না। মেয়েটা এত বেহায়া। ইন্দ্র বলল—এটাও একটা অসুখ।
টুকুন বলল—কী অসুখ!
—এই অসুখ!
মজুমদার সাব খুব বিব্রত বোধ করছেন। তিনি বললেন—তুমি আর এসো না সুবল। তোমাকে নিয়ে সংসারে খুব অশান্তি।
টুকুন ভাবল, সবাই তবে তোমরা শান্তিতে আছো! সুবল এলেই যত অশান্তি। ঠিক আছে। সে বলল—সুবল, আমি কাল যাব।
টুকুনের মা থ, মেয়ের এত সাহস! ছেলেটা তুকতাক করে একেবারে মাথাটা খেয়েছে। এবং সুবল যখন চলে গেল, তখন টুকুনের মা—র ভীষণ মাথা ধরেছে। কী যে হবে!
কবে একবার ওর বাবা একটা বেয়াড়া চাকরকে গুলি করে হত্যা করেছিলেন, এবং কুয়োতে ফেলে দিয়ে মাটি বুজিয়ে দিয়েছিলেন, কেন যে বাবা এমন করেছিলেন, সে জানত না। কেবল সে দেখেছে ঐ চাকরটার মৃত্যুর পর মা কেমন বিষণ্ণ হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি সব সময় জানলার ধারে দাঁড়িয়ে থাকতেন। এবং চোখ উদাস। এখন সে ব্যাপারটা বুঝতে পারে।
বুঝতে পারে বাবা বেশি বয়সে দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন। সে শেষ পক্ষের মেয়ে। বাবার সঙ্গে মা—র বয়সের তফাত কত যে বেশি ছিল, সে যেন সেটা এখনও অনুমান করতে পারে না। মা—র চোখ মুখ কী পবিত্র ছিল, মা বড় করে সিঁদুরের টিপ কপালে দিতেন। খুব মোটা করে আলতা পরতে ভালোবাসতেন, মা—র চোখে মুখে ছিল অসীম লাবণ্য। মা কখনও কঠিন কথা বলতে জানতেন না। ঝি—চাকরদের কাছে মা ছিলেন দেবীর মতো, অথচ বাবার সংশয় ভীষণ এবং এই সংশয় থেকে সংসারে ঝড় উঠেছিল।
এসব কথা মনে হলে মাথা ধরাটাও আরও বেড়ে যায়। টুকুনের জন্য তার এমন একটা কিছু মনে হয়েছে। এবং সে যেতে যেতে দেখল বড় বড় আয়নায় ওর প্রতিবিম্ব পড়ছে। সে নিজের মুখের দিকে নিজেই তাকাতে পারছে না। ভীষণ কুৎসিত দেখাচ্ছে মুখ। সমাজে সে মুখ দেখাবে কী করে! মিঃ তরফদার এ—নিয়ে বেশ রসিকতা করবেন। কান গরম হয়ে যাবে। পায়ের রক্ত মাথায় উঠে আসবে। সে তার শোবার ঘরের দিকে যেতে যেতে দেখতে পেল—দেয়ালের সব বড় বড় ছবি ওর দিকে তাকিয়ে যেন হাসছে। অথবা সব ছবিগুলো জীবন্ত হয়ে যাচ্ছে। এবং ওর পিছনে ছুটে আসছে। আর ঘড়িতে তখন সাড়ে দশ। রেল স্টেশনে গাড়ি ছাড়ার শব্দ। কেমন বেহুঁশের মতো সে তার ঘরের দিকে ছুটে গিয়ে আলোটা নিভিয়ে দিল। আর একটু বাদে এ—ঘরে সেই কাপুরুষ মানুষটা ঢুকবে। মুখে লাগানো তার নকল দাঁত। ওকে চেটেপুটে খাবার জন্য আসবে। সে এসে যাতে চেটেপুটে না খেতে পারে সেজন্য দরজা বন্ধ করে দিল।
দরজা বন্ধ দেখলে মানুষটা ফিরে যাবে এবং সারা রাত ছটফট করবে বিছানায়। ওর ঘুম আসবে না। সকাল হলে সে মানুষটার কাছে যা চাইবে ঠিক পেয়ে যাবে। সে জানে সারা দিন পর শরীর চেটেপুটে খেতে না দিলে মানুষটার কামনা—বাসনা মরে না। সে তার মেয়ে টুকুনকে সুস্থ করে তোলার জন্য আবার কী করা যায় ভেবে যা স্থির করল সে বড় নৃশংস। ভাবতেও ভয় হয়।