টুকুনের অসুখ – ষোলো
একটা বাওবাব গাছের বড় দরকার সুবলের, এমন মনে হলে—চারপাশে যা কিছু, যেমন একটা নদী আছে, নদীর পারে বন আছে আর এ পারে আছে ফুলের উপত্যকা, এর ভিতর বাওবাবের চারা লাগিয়ে দিলে বেশ একটা সুন্দর পৃথিবী সে গড়ে তুলতে পারত, এবং এমন উপত্যকায় একদিন ওর ভারী ইচ্ছা টুকুনকে নিয়ে আসবে। সে আর টুকুন। বুড়ো মানুষটা আজকাল আর ঘর থেকে বের হতে পারে না। সুবল তার জন্য সুন্দর টালির ঘর করে দিয়েছে। লাল টালি, মাটির দেয়াল, দেয়ালে নানারকমের কারুকাজ, ফুলফল, লতাপাতা সব ছবিতে আঁকা।
বুড়ো মানুষটা চলাফেরা তেমন আজকাল করতে পারে না বলে, সে তার জন্য আর বুড়ো মানুষটার জন্য রান্না করে। নামাজের সময় হলে সে মনে করিয়ে দেয়—এখন তোমার কর্তা জহোরের নামাজ। বুড়ো মানুষটা চোখে আজকাল ভালো দেখতে পায় না। কোথাকার কে সুবল এসে এখন এই ফুলের উপত্যকায় রাজা হয়ে গেল প্রায়। সে সুবলকে সব দিয়ে যাচ্ছে। কারণ বুড়ো মানুষটার তো কেউ নেই। সে সুবলকে সব দিয়ে যেতে পেরেছে বলে ভীষণ খুশি। এমনভাবে সে হালকা হতে পারবে কখনও ভাবতেই পারেনি। বড় চিন্তা ছিল তার, এমন সুন্দর একটা ফুলের উপত্যকা কাকে দিয়ে যাবে, ওর তো কেউ নেই। যারা আছে তারা সব ফুলের দালাল। কী লোভ বেটাদের। এসেই একটা বড় রকমের দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলত—তা মিঞা, তুমি এমন একটা কাজ করলে কী করে!
—কী করে আবার, পরিশ্রম করে?
—শুধু পরিশ্রমে হয়?
—কেন হবে না?
—হয় না মিঞা।
তারপর সে থেমে একটু কী ভাবত, তারপর বলত, হ্যাঁ আর আছে অহঙ্কার। আমার হাতের অহঙ্কার। আল্লা আমার সঙ্গে আমার অহঙ্কারের জন্ম দিয়েছেন।
সে ঠিক ঠিক বুঝতে না পারলে বুড়ো মানুষটা বলত, আমি চাই আমার মতো এমন ফুলের চাষ কেউ আর করতে পারবে না। দিনমান খেটে, রাতে নদী থেকে জল এনে, রাতে কখনও বনে পাহাড়ের সব পাতা পুড়িয়ে এমন সব সার তৈরি করতাম—ভেবে অবাক হবে, সে সার না দিলে—ফুল কখনও এমন বড় হয় না। একটু থেমে সে ফুলের গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকত। তারপর বলত, আমি চাই না দুনিয়ায় আমার চেয়ে কেউ বেশি ফুলের চাষ ভালো জানুক।
সুবলের সঙ্গে সুখে দুঃখে ইমানদার মানুষটা এমন বলত।—আমার একটা লোভই আছে সুবল, কেবল জমি কিনে ফুলের চাষ বাড়িয়ে যাওয়া।
বুড়ো লোকটা আরও সব গল্প করত ওর সঙ্গে। সে ফিরে যখন বন থেকে শুকনো কাঠ সংগ্রহ করে রাতের আহার তৈরি করত—তখন বুড়ো মানুষটার গল্প আরম্ভ হত। কারণ সে চোখে দেখতে পায় না বলে, রাজ্যের সব গল্প মনে করতে পারে। সুবলকে সে সব দিয়ে দেবার পরই কেমন আরও বেশি বুড়ো হয়ে গেল। সুবল যাদের নিয়ে চাষবাস বাড়াচ্ছে তাদের সন্ধ্যা হলেই ছুটি দিয়ে দেয় বলে, জায়গাটা কেমন আরও বেশি নির্জন হয়ে যায়। নদীতে কখনও নৌকার লগির শব্দ কানে আসে। বৈঠা মেরে কেউ হয়তো গান গেয়ে চলে যায়। আর সূর্যাস্ত হলে যখন হাত—পা ধোবার জল এনে দেয় টিউকল থেকে, বুড়ো মানুষটা কেমন আন্দাজে গল্প আরম্ভ করে দেয়। নীচে যেসব ঘাসের চটান আছে তার একপাশে সুবল রান্না আরম্ভ করে দেয়। সোজা রান্না। নদী থেকে মাছ আসে। বুড়ো মানুষটা চাপিলা মাছ খেতে খুব ভালোবাসে। বিকেলে সেই মানুষটা এসে বেশ কয়েকটা বড় মাছ রেখে দিলে আন্দাজে হাত দিয়ে টের পায় মাছগুলো খেতে খুব ভালো লাগবে।
বুড়ো মানুষটার সামনে একটা হ্যারিকেন জ্বালা থাকে। মাদুরে সে বসে থাকে। পা দুটো তার ভাঁজ করা। মাথায় সাদা কাপড়ের টুপি। নানারকমের কারুকাজ টুপিতে। খুব সূক্ষ্ম সুতোর কাজ। সুবল ওর লুঙ্গি, পাঞ্জাবি, টুপি রোজ ধুয়ে রাখে। খুব সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার শখ এই মানুষটার, যেমন সে ভাবে এই সরল পৃথিবীতে আল্লা অথবা ভগবান যেই হোক না সব কিছু রেখে দিয়েছেন মানুষের জন্য। মানুষ সেটা পরিশ্রম করে পাবে। ওর খুব ভাবতে কষ্ট হয়, সে কিছু এখন আর করতে পারে না। কাজ না করলে ঈশ্বর চিন্তা হয়। মাঝে মাঝে সে যখন এমন ভাবে তখন তার হাই ওঠে। সুবলের মাছের ঝোল টগবগ করে ফুটছে। সে সুন্দর কালোজিরে সম্ভারে বেগুন দিয়ে জিরে লংকার কেমন সব সুস্বাদু খাবার করে। অথবা সে যখন মাছ সাতলায় তার ঝাঁঝ নাকে লাগলে বেশ খিদেটা বেড়ে যায়। তখন আর বুড়ো মানুষটা বসে থাকতে পারে না। সে বারান্দা থেকে নেমে সুবলের কাছে চলে গেলে, মনে হয় বেশ একটা নির্জন পৃথিবীতে তারা বেঁচে আছে। অনেক দূরান্তে বন থেকে কিছু জীবজন্তুর ডাক, অথবা পাখপাখালির আওয়াজ এবং সে চুপ করে থাকলে পৃথিবীর যাবতীয় কীটপতঙ্গের আওয়াজ টের পায়। সে তখন চুপচাপ বসে থাকতে পারে না। কিছুটা যেন গল্প করে সময় পার করে দেওয়া অথবা গল্প করে খিদের কথা ভুলে থাকা। তাই ওর গল্পে এমন সব কথা থাকে—বুঝলি, আল্লা আমাদের খুব সরল।
সুবলের স্বভাব অন্য রকমের।—তুমি আবার কেন চাচা বাইরে এলে। ঠান্ডা না লাগালে বুঝি চলে না। সুবলের মাঝে মাঝে শখ হলে বুড়ো মানুষটাকে চাচা বলে ডাকে। এমন একটা ডাক খোঁজ সে চায়! সে ভালোবাসে সুবল তাকে চাচা বলে ডাকুক।
সে উনুনের পারে বসে কেমন কিছুটা তাপ নেবার মতো হাত বাড়িয়ে বলল, তোর উনুনের আঁচটা ভালো লাগছে। তারপর কেমন যেন সরল মানুষের মতো বলা, আমার খুব খিদে লেগেছে সুবল। তুই আমাকে খেতে দে। তোর কেবল কাজ আর কাজ।
—তুমি না বললে চাচা, আল্লা মানুষের জন্য পৃথিবীতে সব কিছু রেখে দিয়েছেন। পরিশ্রম করে তাকে সেটা পেতে হবে।
—খিদে লাগলে সব ভুলে যাই।
—আমি তো তোমার জন্য তাড়াতাড়ি করছি। সারাদিন পর দুটো খাবে—
—আমি কাঠ ঠেলে দিচ্ছি। তুই যা! কলাপাতা কেটে আন।
—রাতে কেউ গাছ থেকে পাতা কাটে!
—ওরা যে বলল, তুই কেটে রাখিসনি।
ওরা মানে যারা কাজ করে। কাজের শেষে ফিরে যাবার সময় বুড়ো মানুষটার কাছে এসে ওরা দাঁড়ায়। বলে, চাচা যাচ্ছি।
—যা। একটু থেমে বলে সুবল তোদের টাকাপয়সা দিয়েছে?
—দিয়েছে চাচা।
—আমাদের জন্য দু জোড়া কলাপাতা কেটে রেখে যাস। নিত্য এটা কেমন বলার স্বভাব মানুষটার।
ওরা বলল, সুবল বলেছে কেটে রাখবে। আমাদের কাজ সারতে সারতে একটু দেরি হয়ে গেল চাচা।
—ও কী করছে?
—আসছে। নলচিতা গাছের দুটো বেড়া কার গোরু ভেঙে দিয়ে গেছে। আজ সারাদিন আমরা ওটাই করলাম। ও ঘুরে ঘুরে দেখছে আরও কোথাও এমন হয়েছে কী না!
—আমাকে ও আজকাল কিছু বলে না।
—বললে তুমি কষ্ট পাবে।
—আমি কষ্ট পাব কেন?
—তোমার এমন সুন্দর বাগান কেউ নষ্ট করলে কষ্ট পাবে না?
—সে তো শুনছি খুব চাষবাস বাড়াচ্ছে।
—ওর জন্য আমাদের এখন আর শহরে যেতে হয় না চাচা। সুবল আমাদের শহরের চেয়ে বেশি পয়সা দিচ্ছি।
এমন বললেই বুড়ো মানুষের যা হয়—সেই ঈশ্বরপ্রীতির কথা, অর্থাৎ আল্লা আমাদের খুব সরল। তিনি পৃথিবীতে চান সরল এবং ভালো মানুষেরা বাঁচুক। তারপরই তিনি সেই মহামহিমের জন্য কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে রাখেন, যেন বুঝতে পারেন, আছেন, চারপাশেই আছেন তিনি। সব লতাপাতার ভিতর ফুলফলের ভিতর, এবং সব গ্রহনক্ষত্র আর সৌরলোক, যা কিছু আছে চারপাশে—তিনি আছেন। কোনও উপাস্য নেই তিনি ভিন্ন। তিনি রাজার রাজা। তিনি সবচেয়ে প্রাজ্ঞ। যা কিছু আছে আকাশে, আর যা কিছু আছে পৃথিবীতে সব তাঁর। তিনি জানেন সব কিছু—সৃষ্টি স্থিতি প্রলয় তাঁর অন্তর্লোকের রহস্য। তিনিই জানেন একমাত্র কী আছে সামনে আর কী আছে পিছনে। তাঁর আসন আকাশ আর পৃথিবীর ওপরে বিস্তৃত আর এই দুইয়ের তিনি নিশিদিন রক্ষাকারী। তিনি তার জন্য এতটুকু ক্লান্ত বোধ করেন না। আর সেজন্য তিনি মহীয়ান, মহামহিম।
সুবল তখন এসে বলল, চাচা তুমি খাবে।
মানুষটার চোখমুখ কেমন উদাসীন দেখায় তখন। চুপচাপ বসে থাকে। খাবার কথা সে ভুলে যায়। তাকে যে খেয়ে নামাজ পড়তে হবে সে যেন তা আর মনে রাখতে পারে না। সেই থেকে, অর্থাৎ সেই যখন পরিশ্রমী মানুষেরা চলে গেল, এবং সে বসে থাকল একা মাদুরে—তারপর সুবলের ফুলের চাষবাস দেখে ফেরা, এবং এসব কেমন যেন তার উদাসীনতার ভিতর পার হয়ে গেছে। সে যে উত্তাপ নেবার জন্য উনুনের পাশে বসেছিল, সেও কিছুটা বোধহয় সেই অন্তর্যামীর ইচ্ছা, সে যে খিদে লেগেছে বলেছে, সেও বোধহয় তাঁর ইচ্ছা। এবং এই বুড়ো মানুষের যা স্বভাব খেতে খেতে কেমন আনমনে হয়ে বসে থাকা তাও।
সুবলেরও স্বভাব হয়ে গেছে, খাও চাচা। তোমার মাছ বেছে দিচ্ছি। এই বলে সে বেশ ডেলার উপর মাছ রেখে দিলে হাত টিপে টের পায় মানুষটা—সুবল বড় যত্নে সব কিছু করে যাচ্ছে।
সে তখন বলবে, সুবল তুই তোর ধর্ম মানিস?
—ঠিক বুঝি না চাচা। ধর্মের কথা মনে হলেই সেই জনার্দন চক্রবর্তীর কথা মনে হত। আর আমাদের ছিল সুবচনি দেবীর মন্দির। ওর ভীষণ বিশ্বাস ছিল, দেবীর ক্রোধে আমাদের দেশটায় খরা এসে গেল।
বুড়ো মানুষটা বলল, তোরা সবাই চলে এলি, সে থেকে গেল।
—ওর ছিল প্রচণ্ড অহঙ্কার। ও ছিল ঠিক তোমাদের মুসার মতো।
রাতে যখন ওরা শোয়, ঘরের দু—পাশে দুটো বাঁশের মাচান, মাচানে নকশি কাঁথার বিছানা, তার পাশে ফুল, বেলফুল, রজনিগন্ধা অথবা গন্ধরাজ ফুল এবং কখনও সব নীল অপরাজিতা, জবা ফুল, চামেলি, চাঁপা কত যে ফুল নিয়ে বেঁচে আছে এই উপত্যকা আর তার ভিতর আছে একটা লাল টালির ঘর, সেখানে সুবল আর চাচা শুয়ে যতক্ষণ ঘুম না আসে কেবল নানারকম গল্প করে যাওয়া। বুড়ো মানুষটা খুব বেশি মুসার গল্প বলতে ভালোবাসত। সেই থেকে সুবল একটা মানুষের সঙ্গে কেবল জনার্দন চক্রবর্তীর মিল পায়, তার নাম মুসা। মুসার মতো আত্মবিশ্বাস ছিল মানুষটার। কেবল লাঠিটা ছিল না হাতে। অথবা যে লাঠি ছিল, সেটা বুঝি ঈশ্বরপ্রদত্ত ছিল না। না হলে মুসা সেই যে তাঁর লোকদের জন্য জল চাইলেন, আর তখনই দৈববাণী, তোমার আসা (লাঠি) দিয়ে পাথরে মারো। সেই মুসা তার লাঠি দিয়ে পাথরের পর পাথর ছুঁয়ে গেল, আশ্চর্য, নীল পর্বতমালার নীচে, শুকনো মরুভূমিতে বারোটি জলের প্রস্রবণ। জল পান করো মনুষ্যগণ। আল্লাহ যে জীবিকা দিয়েছেন তা থেকে খাও আর পান করো! অন্যায়কারী হয়ে দেশে অপবিত্র আচরণ করো না।
যখন সেই উপত্যকায় সাদা জ্যোৎস্না ছড়িয়ে থাকত, আর ফুলেরা ফুটতে থাকত, এবং সব ফুলেদের ফোটার ভিতর আশ্চর্য উল্লাস থাকত, বুড়ো মানুষটা শুয়ে শুয়ে তা টের পেত। সে বলত, সুবল আমাকে নিয়ে একটু ঘুরে বেড়াবি। আমাকে একটু গোলাপের বাগানে নিয়ে যাবি। অথবা চামেলি গাছটার নীচে তুই আর আমি কিছুক্ষণ বসে থাকব।
ছেলেমানুষ সুবল। সারাদিন খাটাখাটনি করে তার ঘুম পায়। সে এখন সপ্তাহান্তে যায় বড় শহরে। টুকুন এখন কত বড় আর লম্বা হয়েছে। সে যায় সদর দরজা দিয়ে। টুকুন আরও সুন্দর করে সাজে তখন। এবং যে দিনটাতে সে শুনেছে ইন্দ্র আসে না। টুকুনের ভয় কেন যে ইন্দ্রকে নিয়ে। সেতো কোনও পাপ কাজ করেনি। টুকুনদিদিমণির মুখ চোখ, এবং যখন সেই পিয়ানোতে একটা সিল্কের পাঞ্জাবি আর পাজামা পরে চোখ বুজে গান গায়, ওর ববকরা চুল ঘাড়ে রেশমের মতো উড়তে থাকে তখন সে কেমন এক আশ্চর্য সুষমা টের পায় টুকুনের শরীরে। ঈশ্বর টুকুনকে যেন এতদিন অপবিত্র করে রেখেছিল। টুকুনের শরীর দেখে অর্থাৎ টুকুনের সব কিছু মা হবার জন্য যখন উন্মুখ, টুকুনকে কী করে আর ঈশ্বর অপবিত্র রাখেন। পবিত্র মুখে সুবলের জন্য ভীষণ মায়া। সুবলও যখন আসে বেশ সুন্দর পোশাকে আসে। সে তার ঘাড়ে একটা রঙবেরঙের ব্যাগ রাখে। ব্যাগে থাকে যাবতীয় সব কেয়াফুল। সুবল এলেই সব মানুষেরা টের পায় সুন্দর সুগন্ধে গোটা বাড়িটা ম ম করছে। অথচ কেউ টের পায় না, একজন মানুষ গ্রাম থেকে চলে আসছে, সদর দিয়ে ঢুকে যাচ্ছে, ঘোরানো সিঁড়ি ধরে উঠে যাচ্ছে, এবং এ সময় টুকুন ঠিক থাকবে। অন্য দিকের দরজা ঠিক বন্ধ থাকবে—কিন্তু রোজ এখন এটা করতে পারে না। টুকুন ভালো হয়ে গেছে বলে তাকে ইন্দ্রের কাছে গাড়ি চালানো শিখতে হয়। ভালো হয়ে গেছে বলে আত্মীয়স্বজনেরা, বন্ধুবান্ধবেরা তাকে ঘিরে থাকতে ভালোবাসে। অথচ সুবল টের পায়—বড় অস্বস্তি টুকুনের। সে যখন যা ভাবছে, একটা বাওবাব গাছের চারা পেলেই টুকুনদিদিমণিকে এখানে নিয়ে আসতে পারবে। এবং এতসব ভাবনায় সে রাতে বড় ক্লান্ত থাকে। ওর ঘুম থেকে উঠতে ইচ্ছা হয় না। কিন্তু বুড়ো মানুষটা টের পেয়েছে ফুলেরা ফুটছে। সে সাদা জ্যোৎস্নায় বসে চুপি চুপি ফুলেদের ফুটতে দেখবে। এবং মনে হয় যে তখন মহামহিম আলাহর করুণা সব ফুলে ফুলে আশ্চর্যভাবে টের পায়। বুড়ো মানুষটা চুপচাপ তখন, কেবল গাছের নীচে বসে থাকতে ভালোবাসে।
সেও বসে থাকে চাচার সঙ্গে। সামনের জমিটা বেলফুলের। হেমন্তের শেষাশেষি এটা। শীতকাল আবার আসবে। এখন সাদা জ্যোৎস্নায় শীতটা ওদের বেশ লাগছিল। একটা পাতলা কাঁথা বুড়োর গায়ে দিয়েছে সুবল। এমন জবুথবু হয়ে বুড়ো মানুষটা এখন ফুলের সৌরভ নিচ্ছে।
এমন দেখলেই সুবলের বলতে ইচ্ছা হয়, চাচা তুমিতো অনেক জানো, এখানে কোথায় বাওবাব গাছ পাওয়া যায় বলতে পার?
অনেকক্ষণ পর বুড়ো মানুষটা সুবলের দিকে তাকায়।—কীরে আমাকে কিছু বলছিস!
—একটা বাওবাবের চারা না হলে যে চলছে না।
—এটা এখানে পাবি কোথায়? সেতো ছোট্ট রাজপুত্রের দেশের গাছ।
এমনি হয়, কারণ ওদের কথা কিছুই সংগোপনে থাকে না। সুবল যেসব গল্প টুকুনের কাছে শুনে আসত, সব এসে হুবহু বুড়ো মানুষটাকে বলত। ইদানীং তো সুবলের সন্ধ্যার পর কথা বলার আর কেউ থাকে না। কেবল বুড়ো মানুষটার সঙ্গে যত কথা। সে উনুনে মাটির হাঁড়িতে ভাত সেদ্ধর সময় অথবা যখন ডাল সেদ্ধ হয় উনুনে এবং আগুনের তাপে চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে যায়—তখন নিবিষ্ট মনে যত রাজ্যের গল্প সে চাচার সঙ্গে জুড়ে দেয়।
—ছোট্ট রাজপুত্রের দেশে যদি আগ্নেয়গিরি থাকে, যদি নদী থাকে, এবং সমুদ্র থাকে তবে আমাদের পৃথিবীতে একটা বাওবাব থাকবে না।
—তা বটে। বলে কেমন একটা হাই তুলল।
—তোমার ঘুম পাচ্ছে চাচা। এবারে ওঠো।
—তোর ঘরে শুয়ে থাকতে এখন ভালো লাগবে।
—খুব।
—তুই তবে মানুষ না।
—তা যা খুশি বলতে পারো।
কেমন আসমান, তারা, চাঁদ, আর দ্যাখ যেদিকে চোখ যায় তোর মনে হবে একটা ফুলের জগতে বসে আছিস। দূরের জ্যোৎস্নায় কেমন ফুলের সৌরভ ভেসে যাচ্ছে দ্যাখ।
বুড়োরা এমন ধরনের কথা বলেই থাকে। সুবল সেজন্য মনে কিছু করে না। কেবল মাঝে মাঝে কথায় সায় দিয়ে যায়। এবং কথা না থাকলে টুকুনের কথা ঘুরে ফিরে আসে।
—জানো চাচা, টুকুন দিদিমণি এখন গাড়ি চালাতে শিখছে।
—টুকুনের জন্য তোর খুব কষ্ট সুবল। কারও জন্য কোনও কষ্ট মনে মনে পুষে রাখবি না। তবে দুঃখ পাবি।
—তুমি বুড়ো হয়ে গেছ বলে এমন কথা বলছ।
বুড়ো হলে মানুষ অনেক কিছু বুঝতে পারে সুবল।
সুবল এবার বলল আমার কোনও কষ্ট নেই। আমি গাঁ থেকে এসেছি। জলের জন্যে এসেছিলাম। এখন ফুল বেচে খাই! তুমি আছো, এমন একটা ফুলের উপত্যকা আছে আর কিছুদূর গেলে নদী, তার পাড়ে বন আছে, আমার দুঃখ কী চাচা।
—তোর কথা শুনলে আমি সব বুঝি। তোর কতটা কষ্ট আমি ধরতে পারি।
ওরা এভাবে কখনও সকাল করে দেয়। এবং যখন ফুলের দালালেরা আসে, সুবল ফুল তুলে দেয় তাদের। তারপর খুব তাড়াতাড়ি বুড়ো মানুষকে খাইয়ে এবং নামাজের ব্যবস্থা করে দিয়ে সুবল চলে যায় নদীতে। সে নদীর পাড়ে সব ছেড়ে জলে নেমে যায়। তার এভাবে নদীর জলে সাঁতার কাটতে ভীষণ ভালো লাগে। ও—পাশে বন, বনে নানারকম গাছ, সে সব গাছের নাম জানে না, বুড়ো মানুষটা জানে। সে আগে মাঝে মাঝে বুড়ো মানুষটাকে নিয়ে বনে আগুন জ্বালতে গেলে কখনও কখনও সে কিছু গাছের নাম জেনে নিয়েছে। বাকিগুলো জানা যায়নি। জানতে জানতে কখন বুড়ো মানুষটা চোখে কম দেখতে থাকল। তাকে আর রোজ নিয়ে সে নদীর ওপারে যেতে পারত না। তাকে একা একা বনের শুকনো পাতা ঘাস কুড়িয়ে আনতে হত সারের জন্য। এবং এই সার তৈরি করা সে বুড়োর কাছেই জেনেছে। তিনি বলেছেন, তোমায় এই দুনিয়াতে আল্লা সব দিয়ে দিয়েছেন, তুমি বাপু করে কম্মে খাও। এমন কিছু নেই যা সংসারে অবহেলার। গাছ তার অতিরিক্ত সব কিছু অর্থাৎ পাতা ডাল, সময় হলে পরিত্যাগ করে, তুমি তা থেকেই অমূল্য সব বস্তু নির্মাণ করে নিতে পারো। বুড়ো মানুষটা আল্লার কথায় এলেই কেমন সাধুভাষায় কথা বলতে চেষ্টা করে।
সুতরাং সাঁতার কাটতে কাটতে সে কখনও নদীর ওপারে ওঠে, বনে ঢুকে যায়। বনে কোনও মানুষের ছায়া থাকে না। বড় শহর থেকে ঘণ্টাখানেকের পর ট্রেনে এলে, এবং একটা বড় মাঠ পার হয়ে গেলে এমন একটা নদী, এমন একটা ফুলের উপত্যকা, এমন একটা ছোট্ট বন, সবুজ লতাপাতা ঘাস নিয়ে ক্রমে ঈশ্বরের পৃথিবীতে বড় হচ্ছে টের পাওয়া যায় না।
সুবল বেশ হেঁটে যাচ্ছিল। একা এই বনের ভিতর একজন আদিম মানুষের মতো তার হেঁটে যেতে ভালো লাগছিল। সেই যে সে মুসার গল্প শুনেছে, সেই যে সে আদম ইভের গল্প শুনেছে, অর্থাৎ প্রাচীনকালে মানুষ বনে পাহাড়ে থাকত অথবা প্রথম মানুষ আদম—ইভের জ্ঞানবৃক্ষের ফল চুরি করে খাওয়া সব তার একসঙ্গে মনে পড়ছে। এবং মনে হয় সে বেশ ছিল, ভালো ছিল, যেন সে ট্রেনে চড়ে শহরে চলে এসেই জ্ঞানবৃক্ষের ফল খেয়ে ফেলেছে। কেমন তার উচ্চাশা, এবং আকাঙ্ক্ষা তাকে নিরন্তর ভিতরে ভিতরে খুব ছোট করে দিচ্ছে। এমন মনে হলেই চুপচাপ একটা গাছের কাণ্ডে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। টুকুনদিদিমণির কথা মনে হয়। দিদিমণির সেই রুগণ মুখ, বিবর্ণ ছবি চোখে ভেসে ওঠে—তারপর সে কী করে যে আশ্চর্য এক পাখির খেলা দেখিয়ে দিদিমণিকে নিরাময় করে তোলার সময় তার জানা ছিল না, এক আশ্চর্য জাদুকরের খেলায় সে দিদিমণির ভিতরে ভালোবাসা সঞ্চার করেছে। পৃথিবীতে বুড়ো মানুষটাই কেবলমাত্র তার কষ্টটা বুঝতে পারে। সে যে নিশিদিন ফুল ফুটিয়ে বেড়ায় কেউ জানে না দুঃখটা কোথায়। টুকুন দিদিমণির সঙ্গে এখন সে একা একা কথা বলতে পারে। সে সেজন্য এখন বনে ঢুকে গেলে দেখতে পায় যেন সে ছোট্ট রাজপুত্র হয়ে গেছে। একটা বাওবাবের নীচে সে আর টুকুনদিদিমণি দাঁড়িয়ে। বুড়ো মানুষটা যাচ্ছে হেঁটে! ফুলের সৌরভ তখন কেবল ভেসে আসছিল। বুড়ো মানুষটা তখন লাঠি তুলে যেন বলছে, সুবল তোর ঈশ্বর তোকে অহঙ্কার দিক, তুই ভালোভাবে বেঁচে থাকতে শেখ। ঈশ্বরের পৃথিবীতে ভালোবাসার দাম সবচেয়ে বেশি। তাকে হেলা ফেলা করতে নেই।