Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

তারপর একটা খেলা হয়ে গেল। সংসারে এমন খেলা কে কবে খেলেছে জানা নেই। সুবলকে নিয়ে টুকুন নূতন এক জগৎ সৃষ্টি করে ফেলেছে।

সুবল, টুকুন চোখ মেলে তাকালে বলেছিল, টুকুন তুমি ভালো হয়ে গেছ। টুকুনকে খুব অবুঝ বালিকার মতো দেখাচ্ছে। সুবলের টুকুনকে আর দিদিমণি বলতে ইচ্ছা হয় না। কারণ টুকুনকে অসহায় এবং কাতর দেখাচ্ছিল। সে যা করেছে এতক্ষণ, সিঁড়ি ধরে যে নীচে নেমে গেছে, গোলাপ গাছগুলোর পাশ দিয়ে যে হেঁটে গেছে, সে কিছুতেই তা বিশ্বাস করতে পারছে না। বিশ্বাস না করতে পারলে যা হয়, ভিতরের উদ্যম নষ্ট হয়ে যায়।

সে বলল, টুকুন তোমার কোনও অসুখ নেই। তুমি ভালো হয়ে গেছ।

—তুমি সুবল সত্যি বলছ?

—সত্যি টুকুন। তুমি উঠে বোস। আমি নেমে গেলে দরজা বন্ধ করে দেবে। সুবল এই বলে উঠে এসে রাস্তায় গণ্ডগোল কমেছে কি না, না আবার কারফিউ দিয়ে দিল—এসব জানার জন্য উদগ্রীব হলে টুকুন বলল, সুবল তুমি কোথায় থাকছ?

—অশ্বিনীনগর স্টেশনে নেমে যেতে হয়।

—এত দূরে চলে গেলে কেন?

—খুব দূর না তো। শিয়ালদা থেকে বিশ মিনিট লাগে।

—তবে তো খুব কাছে।

—খুব কাছে। শুয়ে শুয়ে তোমার কথা বলতে ভালো লাগে টুকুন?

—না।

—তবে উঠে বসছ না কেন? এই দ্যাখো বলে সে বলল, তুমি রেডিয়োটা চালিয়ে দাও না।

—কী হবে?

—কারফিউ দিলে বলে দেবে।

—কারফিউ হলে যাবে কী করে?

—কিন্তু যাওয়া দরকার। আমি না গেলে বুড়ো মানুষটা ভয়ানক ভাববে।

—বুড়ো মানুষটা তোমাকে বুঝি খুব ভালোবাসে?

—ভালোবাসে না ছাই! কেবল কাজ। কাজ করো। কাজ করলে লোকটা সবাইকে ভালোবাসে। কাল আমাদের বনে যাবার কথা আছে।

—কী করবে গিয়ে?

—সব শুকনো পাতা জড়ো করব। তারপর যখন সন্ধ্যা হবে, সেইসব শুকনো পাতায় আগুন দেব।

—কী মজা।

—খুব মজা! শীতের সময় আগুন দিলে বুড়ো লোকটা বলেছে জীবজন্তুরা পর্যন্ত সব চলে আসে।

—ওরা আসে কেন?

—আগুন পোহাতে। একটু থেমে সুবল বলল, তুমি রেডিয়োটা খুলে দাও, আচ্ছা টুকুন, কেউ আবার চলে আসবে না তো? কত বড় ঘর তোমার। কেউ চলে এলে কী হবে?

—কেউ এলে কী হবে সুবল?

—আমাকে আসতে দেবে না। তোমার মা আমাকে যদি পুলিশে দেয়!

টুকুনের মুখটা সত্যি শুকিয়ে গেল। সে এটা ভাবেনি। না বলে না কয়ে পাঁচিল টপকে সে চলে এসেছে, পুলিশে দিয়ে দিলে যা হোক ওদের একটা কাজ মিলে যাবে।

সুবল বলল, আমি আর আসব না। আমি এতটা ভাবিনি।

টুকুন বলল, আমার পাশের ঘরটায় গীতামাসি থাকে। বিকেলের খাবার দিয়ে সে নীচে নেমে যায়। উঠে এলে টের পাব সুবল। কাঠের সিঁড়িতে শব্দ হবে।

—গীতামাসি তোমার দেখাশোনা করে?

—হ্যাঁ। ওকে, দ্যাখো, ঠিক হাত করে নিতে পারব।

—কিন্তু তোমার মাকে টুকুন?

টুকুন উঠে বসল। যেন একটা পরামর্শ না করলেই নয়। সে বলল, এদিকে এসো। সুবলকে নিয়ে ওর বাথরুমের দিকে চলে গেল। ওর দু—পাশে দুটো জলের কল। বড় বড় দুটো থাম। এবং কিছু জালালি কবুতর একসময় কার্নিশে ছাদের অলিন্দে বসবাস করত, তারা এখন কেউ নেই। টুকুনের অসুখ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওরা নাকি উড়ে গেছে। সুবলকে এসব দেখাল টুকুন, বলল সুবল, মা এলে আমরা টের পাব। তোমার কোনও ভয় নেই। পায়ের শব্দ আমি টের পাই। কোনটা গীতামাসির, কোনটা ডাক্তারবাবুর। সব আমি জানি। ওরা এলে তোমাকে আমি ঠিক লুকিয়ে ফেলব। সে দোতলার অলিন্দে নিয়ে গেল। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাল। সুবলের কাছে এটা প্রায় রাজার দেশ। টুকুন এক রাজকন্যার মতো। সে যেন এক রাখাল বালক। তার কাছে আছে মৃতসঞ্জীবনী সুধা। সুধা রসে মেয়েটা এখন নির্ভাবনায় হাঁটছে। সুবলের আছে এক ভালোবাসার জাদুমন্ত্র, অথবা সুবলকে নিয়ে হেঁটে এই যে ঘরের পর ঘর, নানাবর্ণের ছবি, এবং সব বিচিত্রবর্ণের কারুকাজ করা খাট—পালঙ্ক পার হয়ে যাচ্ছে—এ যেন তার কাছে ভারী মজার। যেন হাজার হাজার দৈত্য আসবে সুবলকে তুলে নিতে। টুকুনের কাছে আছে দৈত্যের প্রাণ। কোথায় ওরা দাঁড়িয়ে পাখিটার পাখা পা এবং গলা ছিঁড়বে তার যেন একটা পরামর্শ চলেছে।

এসব হলেই মেয়ের মনে হয় না তার কোনও অসুখ আছে। এসব হলেই মনে হয় পৃথিবীতে বেঁচে অনেক সুখ। এক অপার অভাববোধ এই বালকের জন্য। সংসারে ছেলেটি যত অপাঙক্তেয়, তত টুকুনের কাছে সে মহার্ঘ। টুকুন আনন্দে, কারণ যখন প্রায় সব ঠিক হয়ে গেল তখন আনন্দে প্রায় ছুটে ছুটে যাচ্ছিল। বলল সুবল তোমাকে এখানে আসার একটা সুন্দর রাস্তা দেখিয়ে দেব। তুমি ফুল বিক্রি করে রোজ এখানে আসবে। আমি কী সুন্দর ছোট্ট রাজপুত্রের গল্প পড়ে রেখেছি। তুমি আসবে বলে বসেছিলাম। তুমি না এলে কাকে আর আমার গল্প শোনাব।

কাঠের সিঁড়ির মুখের দরজাটা টুকুন বন্ধ করে দিল। কী বড় বড় শার্সির নীল রংয়ের দরজা। টুকুন অনায়াসে টেনে টেনে বন্ধ করে দিচ্ছে। সুবল ওকে দরজাটা বন্ধ করে দিতে সাহায্য করলে সে বলল, আমি পারব সুবল। বলে হাসল।

সুবল যেতে যেতে বলল, এটা কী?

—এটা পিয়ানো। বলেই টুকুন দুহাতে ঝম ঝম করে বাজাতে থাকল। কতদিন থেকে পিয়ানোটা কেউ বাজায় না। না, ইন্দ্র মাঝে দু’একদিন বাজিয়েছে। যখন টুকুন শুয়ে থাকে মা কখনও বাজান। লম্বা একটা খাতা পিয়ানোর ওপর। সুবল দেখল কেমন গোটা ঘরটা ঝম ঝম করে উঠছে। এবং ক’টা চড়াইপাখি ঝাড়—লণ্ঠনে বসেছিল, পিয়ানো বাজালে পাখিগুলো উড়ে উড়ে বাগানের ভিতর চলে গেল।

সুবল দেখছে—কী সুন্দর বাজাচ্ছে টুকুন। এমন একটা সুন্দর বাজনা পৃথিবীতে আছে তার যেন জানা ছিল না। চুলগুলো বব করা টুকুনের। বিনুনি বাঁধা নয়। হাতের আঙুলগুলো চাঁপা ফুলের মতো। পায়ে আলতা আছে বলে খুব সুন্দর লাগছে। এবং সে পাজামার মতো কোমল পোশাক পরে আছে, আর লম্বা, টুকুন প্রায় তার মতো লম্বা। সে বয়সানুপাতে লম্বা হয়ে যাচ্ছে। সে আয়নায় নিজের মুখ দেখতে পেল। কারণ বড় বড় দুটো আয়না, পৃথিবীতে এতবড় আয়না দিয়ে কী হয় সে জানে না। গোটা ঘরের প্রতিবিম্ব এখন এই আয়নার ভিতর। সে তন্ময় হয়ে টুকুনদিদিমণির পিয়ানো বাজনা শুনছে।

আর তখন কাঠের সিঁড়ির মুখে কারা উঠে আসছে যেন। ওরা দুজনে এত বেশি গভীরে ডুবে আছে যে কেউ টের পায়নি, অথবা শুনতে পাচ্ছে না সিঁড়ি দিয়ে বাড়ির সবাই ছুটে আসছে এদিকে। কারণ অসময়ে পিয়ানো বাজাচ্ছে কেউ, সে কে।

আশ্চর্য এক মেলডি ভেসে বেড়াচ্ছে বাড়িময়।

সুবলেরই প্রথম মনে হল দরজায় কারা আঘাত করছে। সে টুকুনকে ঠেলে দিয়ে বলল, টুকুন কারা দরজায় ধাক্কা মারছে। এবং সঙ্গে সঙ্গে ভোজবাজির মতো ব্যাপারটা হয়ে গেল। টুকুন বাজানো বন্ধ করে দিল। সুবল লুকিয়ে পড়ল টুকুনের খাটের নীচে। তারপর খুব সহাস্যে দরজা খুলে দিলে দেখল সবাই, টুকুন দরজা খুলে দিচ্ছে। ওরা হাসবে না কাঁদবে স্থির করতে পারছে না। মা বললে, টুকুন তুমি পিয়ানো বাজাচ্ছিলে?

—হ্যাঁ মা।

—সত্যি?

—হ্যাঁ মা।

টুকুনের মা টুকুনকে বুকে জড়িয়ে ধরল। যেন বিশ্বাস হচ্ছে না কথাটা। সে বলল, তুমি আর একবার বাজাবে?

—এক্ষুনি?

—তোমার বাবা এলে তাকে বাজিয়ে শোনাও না। তিনি খুব আনন্দ পাবেন।

—বাবা আসুক।

—আমি জানি টুকুন ঠিক একদিন সুস্থ হয়ে যাবে।

গীতামাসি বলল, কোথাকার একটা রাস্তার ছেলেকে ধরে আনতে যাচ্ছিলেন বড়বাবু।

মা বলল, আজকালকার ডাক্তারও হয়েছে তেমন। তারপর কী ভেবে বলল, একবার ইন্দ্রকে ডাকো না?

—সে তো নেই দিদিমণি?

—কোথায় গেল?

—সে তো এসময়ে ক্লাবে রোয়িং করতে যায়। ইন্দ্রকে খুশি রাখার জন্য মা—র যে কী করার ইচ্ছা। কারণ এখানে বসে থাকতে চায় না ইন্দ্র। আজ ইন্দ্র এলে খুব খুশি হবে।

টুকুন এখন চাইছে সবাই চলে যাক। কিন্তু সে যে কেন পিয়ানো বাজাতে গেল। সবাই এখন এটা গল্পগাথার মতো ব্যবহার করবে। ছুটে আসবে। এখন যেভাবে হোক সুবলকে বের করে দিতে হবে। ওর ভিতরে সুবলের জন্য একটা দুশ্চিন্তা দেখা দিচ্ছে। এবং নানাভাবে সে চিন্তা করছে। কী করলে যে এদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।

সবাই এসে টুকুনকে দেখে যাচ্ছে। ওর খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। সে এখন আবার সাদা চাদর গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়বে ভাবল। কেবল সুবলের জন্য সে শুয়ে পড়তে পারছে না। খাটের নীচে একবার উঁকি দিতে ইচ্ছা হচ্ছিল। ওদিকে কেউ গেলে পা দেখে ফেলবে। এবং এমন একটা ভয়াবহ সমস্যার মোকাবেলা সে জীবনে করেনি। এবং এইসব সমস্যা অথবা তাড়না তাকে এখন বড় বেশি স্বাভাবিক করে রেখেছে। সে বলল, মা আমার আবার ভালো লাগছে না কেন জানি। আমার ঘুম পাচ্ছে।

গীতামাসি, যারা সবাই চাকর এবং অন্যান্য সব পরিজন এসেছিল তাদের চলে যেতে বলল। গীতামাসির কাজ এখন কত বেড়ে গেছে এমন ভাব। সে বলল, দিদিমণি, টুকুন এবার ঠিক বড় হয়ে যাবে।

এ—ছাড়া টুকুনের মার কত সব দুশ্চিন্তা এবং মনের ভিতর সংশয় থেকেই যাচ্ছে। টুকুন এভাবে আরও দু’একবার খুব স্বাভাবিক হয়ে গেছিল। অবশ্য প্রতিবারই পাখিয়ালা সুবল ছিল কাছে। এবার সে নেই। কিন্তু এমন ম্যাজিকের মতো ব্যাপারটা ঘটবে আশা করতে পারেনি।

মা বলল, টুকুন আমি তোমার জন্য একজন পিয়ানোর শিক্ষক দেব।

টুকুন বলল, আমি শোব মা। আর বসে থাকতে পারছি না।

গীতামাসি টুকুনকে ধীরে ধীরে শুইয়ে দিচ্ছেন।

মা বলল, এটা কী করছ গীতা?

গীতামাসি বলল, টুকুন আবার আগের টুকুন হয়ে যাচ্ছে।

খাটের নীচে যেই না শুনতে পেল সুবল, টুকুন আবার আগের টুকুন হয়ে যাচ্ছে, সে বোধহয় জোরজার করে উঠেই আসত—কেবল টুকুন চাদরটা একটু ফেলে দিয়ে ওকে একদিকে ভালো করে আড়াল করে দিচ্ছে।

টুকুন শুয়ে পড়লে মা বলল, তুমি যে বলেছিলে, বাবা এলে বাজাবে?

—কাল বাজাব মা। খুব দুর্বল লাগছে।

—তা ঠিক। একদিনে বেশি ভালো না। তুমি বরং একটু শুয়ে থাক। বাবা এলে আমরা আসব।

মা চলে গেলে গীতামাসি বলল, টুকুন এখন তোমার দুধ, আপেল, সন্দেশ খাবার সময়! বের করে দিচ্ছি।

—কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না। তুমি মাসি দরজাটা ভেজিয়ে দাও না।

দরজা ভেজানোর কথা উঠলেই মাসি উঠে পড়বে। কারণ বারবার এক কথা শুনতে ভালোও লাগে না। নিজের ঘরে গিয়ে বেশ পান—দোক্তা খেয়ে উত্তরের বারান্দায় চলে গেলে, নীচ থেকে যারা উঠে আসে তাদের সঙ্গে গল্পগুজব করা যায়।

গীতামাসি বলল, কিন্তু এখন তো তোমার এসব খাবার সময়।

টুকুন বুঝতে পারল, না—খাইয়ে ছাড়াবে না। সে বলল, তুমি রেখে যাও, আমি ঠিক খেয়ে নেব।

—অন্যদিন আমার সামনে তুমি খাও। আজ কেন এমন বলছ?

—আজ তোমার সামনে খাব না। কিছুতেই খাব না।

টুকুনের জিদ উঠলে একেবারে কেলেঙ্কারি কাণ্ড। সেজন্য ভয়ে ভয়ে গীতামাসি বাইরে বের হয়ে এলে সে নিজে উঠে গেল। দরজা বন্ধ করে দিল। ডাকল, সুবল বাইরে এসো। ওরা সবাই চলে গেছে।

সুবল বের হয়ে এলে টুকুন বলল, তুমি আমার সঙ্গে এসো।

সুবল বলল, আমার ফুলের থলেটা দেখছি না।

—ওটা আমি ঠিক জায়গায় রেখে দিয়েছি। তুমি যে কী বোকা না! ওটা দেখলেই ওরা বলত না, এই থলেটা কার, কী করে এমন একটা বিশ্রী থলে এখানে আসতে পারে। দরকার পড়লে ডিটেকটিভ লাগিয়ে দিত।

সুবল শহরের অনেক ব্যাপার যেমন ঠিক বোঝে না, তেমনি ডিটেকটিভ কথাটাও বুঝতে পারলে না। সে বলল, ডিটেকটিভ কী টুকুন?

—ওরা চোর গুণ্ডা বদমাশ ধরে বেড়ায়। কেউ যদি খুন হয়, কে খুনটা করেছে তাকে খুঁজে বের করে।

—আমার সামান্য থলেটার জন্য এতবড় একটা ব্যাপার তবে ঘটে যেতে পারে?

—সুবল তুমি জানো না, এটা যে কী অসামান্য অপরাধ! আমার মা—র চোখ দেখতে সব টের পাই সুবল।

ওরা বাথরুমে ঢুকলেই সুবল বলল, জল দেখলেই চান করতে ইচ্ছা হয় টুকুন। বাঃ কী মজা! পাতাল থেকে ফোয়ারার মতো জল উঠে আসে, কী মজা প্রথম প্রথম ভাবতাম। খরা অঞ্চল থেকে আসার পর, দিনে কতবার যে রাস্তার কলে চান করতাম।

—তুমি চান করে নেবে?

—তোমার চানের ঘরটায় কী সুন্দর গন্ধ। মারবেল পাথরে কারুকাজ করা সব পাথরের দেয়াল—কী মসৃণ! সুবল দেয়ালের গায়ে হাত দিয়ে কী যেন দেখছে। ভীষণ মসৃণ। হাত পিছলে পিছলে যাচ্ছে। নানারকম গন্ধ সাবান। তেল। শ্যামপু সব। এসব সে ঠিক চেনে না, কী দিয়ে কী হয়, এবং মনে হয় সুবলের শরীরে ঘামের গন্ধ। টুকুন সুবলকে হাত ধোয়ার জন্য বাথরুমে নিয়ে এসেছিল। যা খাবার আছে সে সুবলকে খেতে দেবে। কিন্তু এখানে এসে সুবলের যে কী হয়ে গেল—সে চান না করে খাচ্ছে না। সে খুব পরিশ্রম করে—তার চোখে—মুখে আশ্চর্য দৃঢ়তা। টুকুন এসব দেখে ভাবল, চান করে নিলে তাকে আরও বেশি তাজা দেখাবে।

টুকুন বলল, সুবল তুমি চান করবে?

—মন্দ হয় না, টুকুন।

টুকুন শাওয়ার ছেড়ে দিয়ে বলল, এটা দিয়ে এভাবে জল পড়বে। বাথরুমের সব বুঝিয়ে দিয়ে বলল, তুমি চান করে নাও। আমি দাঁড়াচ্ছি। সুবল বলল, টুকুন, আমি দরজা বন্ধ করে দেব।

টুকুন দরজা বন্ধ করার কারণ খুঁজে পেল না। সুবল তো তার কাছে ছোট্ট এক বালক বাদে আর কিছু না। সে তো সেই যেন দুই শিশু নদীর পারে দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে কোনও জামাকাপড় নেই। কেবল ওরা ছুটছে।

টুকুন বলল, আমাকে তোমার লজ্জা কী?

সুবল বুঝতে পারল টুকুনদিদিমণি এখনও স্বাভাবিক নয়। সে বাথরুমের দরজাটা খোলাই রাখল। সে একটা তোয়ালে পরে নিয়ে জামা পাজামা পাশের ব্রাকেটে ঝুলিয়ে রাখল।

টুকুন বেশ মনোরম চোখে দেখছে। সুবলের কী সুন্দর হাত। পুষ্ট বাহু। এবং পিঠের শক্ত কাঁধ খুব মজবুত। সে শাওয়ারের নীচে বসে গায়ে মাথায় সাবান মাখছে। বস্তুত সুবলেরও একটা অসুখ হয়ে গিয়েছিল—সে খরা অঞ্চল থেকে চলে এসে যখন কলকাতা নগরীতে এত প্রাচুর্য বিশেষ করে জলের—ভাবা যায় না—সে এখনও ফাঁক পেলে যেখানে সেখানে চান করে নেয়। শরীরে ওর কী যে গরম বেঁধেছে কিছুতেই ঠান্ডা হচ্ছে না। সে এখানে এসেও এই লোভ সামলাতে পারেনি।

টুকুন বলল, আমি তোমাকে সাবান মাখিয়ে দিচ্ছি।

সুবল জানে, টুকুনের কোনও ইচ্ছাকে অবহেলা করতে নেই। টুকুন কত বড়, কত বড় বাড়ির মেয়ে, টুকুন যা বলবে তাকে এখন তাই করতে হবে। সে এভাবেই বুঝে ফেলেছে, এর ভিতর এক নতুন প্রাণের সাড়া দেখা দিচ্ছে। এখন কিছুতেই সেখানে ভাঁটার টান আনলে চলবে না। সে বলল, তুমি টুকুন পারবে?

—বা রে পারব না কেন?

—আমার বিশ্বাস হয় না টুকুন—সেই রাজার ঘোড়ায় চড়ে যাবার কথা মনে আছে? হরিণ ধরতে যাচ্ছে রাজা। হরিণ প্রাণের ভয়ে ছুটছে। রাজা, ঘোড়া পাহাড়ের ওপর দৌড় দিচ্ছে। পাথরে পাথরে ঘসা লেগে ঘোড়ার খুরে আগুন লেগে গেছে।

—সত্যি কী সুন্দর হরিণ না। টুকুন সুবলের চারপাশে ঘুরে বেড়াতে লাগল। কী সুন্দর মজবুত সুবল। টুকুন বলল, আমিও চান করব। সে বলল, আমাকে সাবানটা দাও। সে একেবারে শিশুর মতো জলের নীচে খেলা করতে থাকল। সুবলও কখন এমন হয়ে গেছে। ওরা দুজনে গল্প করছিল—পাশের ওদিকটার যে দরজা বন্ধ আছে এবং কেউ আর একদিকটায় আসতে পারবে না ওরা জানে।

এবং এভাবে কী হয়ে যায়। সুবল স্নানের সময় শরীর থেকে সব জল শুষে নিতে গিয়ে দেখল, তোয়ালেটা কী করে কখন শরীর থেকে খসে পড়ে গেছে। সে তোয়ালে ব্যবহারের নিয়মকানুন ঠিক জানে না। আর টুকুন ওকে অপলক দেখছে। স্থির। চোখে বিস্ময়। সে টুকুনের এমন চেহারা দেখে একেবারে ফ্রিজ হয়ে গেছে। দুজনেই দুদিকে, একটা ফ্রিজ শটের মতো। সুবলের যেন মুহূর্তের জন্য কাণ্ডজ্ঞান লোপ পেয়েছিল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *