টুকুনের অসুখ – তেরো
টুকুনকে নিয়ে সুরেশবাবু আবার একটা কষ্টের ভিতর পড়ে গেছেন। শুধু এখন শুয়ে থাকে আবার। মাঝে একটু ভালো হলে সুরেশবাবু টুকুনকে নিয়ে একটা স্পেস অডিসি দেখে এসেছেন। টুকুন স্পেস অডিসি দেখার পর কেমন সত্যি সত্যি বিশ্বাস করে ফেলেছে হাজার লক্ষ কোটি গ্রহ—নক্ষত্রের ভিতর দিয়ে যখন মহাযানটি ছুটছিল, তখন নিশ্চয়ই তার পাশে ছিল ছোট্ট রাজপুত্রের গ্রহাণু। অথবা সেই যে এক বাতিয়ালা ছিল এক ছোট গ্রহাণুতে তার কথাও মনে পড়ছে। তার গ্রহাণুর পাশ দিয়ে যাবার সময় মহাযানটি নিশ্চয়ই উঁকি মেরে দেখেছে, বাতিয়ালা সন্ধ্যা হলেই গ্যাসের একটা বাতি জ্বেলে দিচ্ছে।
সুরেশবাবুও মনে মনে সেই পাখিয়ালাকে খুঁজছেন। তাঁর দৈবে এখনও বিশ্বাস আছে। ডাক্তারবাবু পর্যন্ত মত দিয়েছিলেন। কেবল টুকুনের মার জন্য সিস্টারকে ঠিকানা দেওয়া গেল না। তিনি তিন— চারদিন আগে সিস্টারকে ফোন করেছিলেন পাখিয়ালা এসেছিল কিনা আর? সিস্টার বলে দিয়েছিল—না।
টুকুন এখন আর কিছু বলে না। সে ছোট্ট রাজপুত্রের বইটাই বারবার আজকাল পড়ছে। স্পেস অডিসি দেখার পর এই গ্রহ—নক্ষত্র—সৌরজগৎ অথবা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একটা ধারণা মনের ভিতর গড়ে উঠল—বেঁচে থাকা এই গ্রহে বড় অকিঞ্চিৎকর ঘটনা—অথবা টুকুনের মনে হয় সে কত অপ্রয়োজনীয় এই সৌরমণ্ডলের ভিতর। অন্তত ছোট রাজপুত্রের মতো বাঁচারও একটা মানে ছিল। তার ছিল তিনটে আগ্নেয়গিরি, ছ’টা পাহাড়, দুটো নদী, একটা হ্রদ, একটা সমুদ্র। সে আসার আগে সমুদ্রের ওপরটা বাওবারের পাতায় ঢেকে দিয়েছিল, সে গ্রহাণু থেকে বিদায় নেবার সময় আগ্নেয়গিরির মুখগুলো হাঁড়ি দিয়ে ঢেকে দিয়েছিল। নদীর জল কলাপাতায় ঢাকা। এবং ক’টা বাওবাবের চারা ছিল, সব উপড়ে ফেলেছিল। কিন্তু পরিজ পাখিদের ডানায় ভর করে গ্রহাণু থেকে নেমে আসার সময় তার মনে হয়েছিল বাওবাবের চারা একটা বেঁচে থাকলে, ওর মূল শেকড় এত পাজি যে তার ছোট গ্রহটিকে ঝাঁঝরা করে দেবে।
টুকুন জানলা দিয়ে নানারকম ফুল ফুটতে দেখলেই রাজপুত্রের কথা মনে করতে পারে, সুবলের কথা মনে হয়। সে বিমর্ষ হয়ে যায়। খেতে তার ভালো লাগে না, ইন্দ্রকে আজকাল একেবারেই সহ্য করতে পারছে না। মা এসে ইন্দ্রের সম্পর্কে সব গল্প করে যাচ্ছে। ইন্দ্র কলেজের পড়া শেষ হলেই সরকারি স্কলারশিপ নিয়ে বাইরে চলে যাবে। এসব খবর অর্থহীন টুকুনের কাছে খুবই অর্থহীন। ওর এসব কথা শুনলে ভারী হাসি পায়। সে বলতে পারে, আমার কাছে এমন সব ইতিহাস লেখা আছে, যা তুমি আদৌ জানো না। কত যে অকিঞ্চিৎকর—এই বিদেশ যাওয়া। মা, তুমি ইন্দ্রকে আমার ঘরে আর পাঠাবে না। ওর মুখ পুতুলের মতো। সব সময় মুখটা একরকমের থাকে। সে একটা কথা শুধু জানে,—টুকুন আজ তোমার কেমন লাগছে? শরীর তোমার কেমন?
অন্য কথা জানে না বলে টুকুনের মনে হয় ইন্দ্র এই দুটো কথাই শুধু সারাজীবন ধরে মুখস্থ করেছে। অন্য কথা সে জানে না। তার আত্মীয়স্বজনের ছেলেমেয়েরা কেউ বড় আসে না তার ঘরে। ওর অসুখটা যদি অন্য কারও শরীরে সংক্রামিত হয়—এই অসুখ—কী যে অসুখ—কেউ টের পায় না, একটা মেয়ে সবকিছুর ভিতর কেমন সম্পূর্ণ উদাসীন হয়ে বেঁচে আছে।
সকাল থেকেই আজ এই অঞ্চলে গণ্ডগোল চলেছে। গীতামাসি টুকুনকে এমন বলেছিল। পাঁচিল পার হলে ফুটপাথ। লাইটপোস্টটার নীচে দুটো মানুষের মাথা কারা কেটে রেখে গেছে। সকাল থেকে হইচই। পুলিশ। কোথায় পাশে গুলি চলছে। তিনজন ধরাশায়ী। বিকেলে একটা বড় মিছিল যাচ্ছিল, সেখানে বোমা।
বোমা মিছিল আর নানারকমের অসুখ নিয়ে বেঁচে আছে এতবড় শহরটা। যেমন একটা অসুখ এই শহরের, সব বড় বড় বাড়ি, প্রাসাদের মতো বাড়িগুলো রাতে ফাঁকা থাকে নীচে ফুটপাথে লোক শুয়ে থাকে—শীতে অথবা ঝড়বৃষ্টিতে কষ্ট পায়। টুকুন বুঝতে পারে না এমন কেন হয়। যখন বাড়িগুলো ফাঁকা, লোকজন কম, গরিব সব মানুষদের সেখানে আশ্রয় দিলে কী যে ভালো হয়। কিংবা কেউ খায়, কেউ খেয়ে হজম করতে পারে না, কেউ না—খেয়ে পেটের জ্বালায় ফুটপাথে পড়ে থাকে। অথবা কী যে ধনাঢ্য পরিবার, তার বাবা তাকে নিয়েও বেশ একটা খেলায় মেতে গেছে, কত বেশি সুখ সে টুকুনের জন্য এনে দিতে পারে এমন খেলা। টুকুনের ঘরটা হলঘরের মতো। নানাবর্ণের দেয়াল। ভিতরে চন্দনের মতো গন্ধ। এবং সব সময় কী যেন গীতামাসি স্প্রে করে দিয়ে যায়। বড় বাথরুম। শ্বেতপাথরের দেয়াল। বিখ্যাত সব চিত্রকরদের ছবি। একটা ছবি, বনের ভিতর একটা বাঘ। পিছনে শিকারি হাতির পিঠে। বাঘের সঙ্গে দুটো বাচ্চা।
আবার ওর খাটটা মেহগনি কাঠের। নানারকমের কারুকাজ করা খাটে সে একা শুয়ে থাকে। এতবড় খাট যে, সে একা শুয়ে থাকে, এ—পাশ ও—পাশ করে কতবার যে অন্য প্রান্তে যেতে চায়—কিন্তু পারে না। সে চুপচাপ কাত হয়ে শুয়ে থাকে, তার পায়ে গীতামাসি আলতা পরিয়ে দেয়। চুল বিনুনি করে বেঁধে দেয়। সে সিল্কের লাল—হলুদ ছোপের ফুল—ফল আঁকা কেমন লুঙ্গির মতো একটা পোশাক পরে। ফুল—হাতা সাদা রংয়ের জামা। চোখ কেমন নীল নীল—এবং বুকে সে কোনও ধুকপুক শব্দ শুনতে পাচ্ছে না ভালোবাসার জন্য। কেবল সেই নির্বান্ধব ছেলেটির জন্য ওর মায়া। সে এলে হয়তো উঠে বসতে পারত।
এবং চারপাশে নানারকমের গণ্ডগোল। গণ্ডগোলের শহরে গণ্ডগোল বাদে কী আর থাকবে! এই সন্ধ্যায় যখন একটা গ্রহাণুতে এক বাতিয়ালা গ্যাসের আলো জ্বেলে দিচ্ছে, তখন কিনা এই গ্রহের সব সৌন্দর্য হরণ করে নেবার জন্য মানুষ মানুষকে অকারণ মেরে ফেলছে। টুকুন জানালায় দাঁড়িয়ে তার দোতলার ঘর থেকে দেখতে পেল, রাস্তার দোকানপাট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। প্রাণ বাঁচানোর জন্য মানুষ পাঁচিল টপকে ছুটে আসছে।
দারোয়ানদের ঘরগুলোর পাশে যেখানে লম্বা গ্যারেজ, তার পাশে একটা লোক টপকে এসে কেমন ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেছে। সে যেন রাস্তা থেকে প্রাণ বাঁচাতে এসে অন্য একটা ট্র্যাপে পড়ে গেল। পুলিশের লোকগুলো ছুটছে। যাকে পারছে তাকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। পাঁচিল টপকে একটা লোক এ—বাড়িতে ঢুকে গেছে, পুলিশের নজর এড়ায়নি। পুলিশও বেশ গোঁফে তা মেরে লাফ মেরে পাঁচিলের এ—পাশে এসেই দেখছে ফাঁকা।
টুকুন চুপচাপ শুয়ে দেখছে আর মজা পাচ্ছে। সে দেখতে পাচ্ছে—সেই পালানো লোকটা একটা বনকরবীর ডালে বসে আছে। নানারকমের লতাপাতায় গাছটা ঢাকা। এবং টুকুন একেবারে অবাক, রক্তের ভিতর তার হাজার ঘোড়া সবেগে ছুটছে, ওর মুখ—চোখ লাল হয়ে যাচ্ছে, এবং সে কেমন অধীর হয়ে যাচ্ছে—সে তার ভিতর আশ্চর্য এক তাজা ভাব, অথবা মানুষের যা হয়ে থাকে, সময়ে সংসারের সব নিয়ম—কানুন সহসা পালটে যায়, বোঝানো যায় না এমন কেন হয়, টুকুন কেমন হয়ে যাচ্ছে, টুকুন উঠে বসল খাটে। দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। ঘরে কেউ নেই। সে পিছনের দরজাটা তাড়াতাড়ি বন্ধ করে দিল। ঘোরানো সিঁড়ি বাগানে নেমে গেছে। মালিরা কেউ নেই। এবং সে এ—সময় পাগলের মতো ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে তর তর করে নেমে যাচ্ছে। সে কিছু দেখে ফেলেছে, সে যে নিজের ভিতর এখন নিজে নেই, অথবা তার এটাই নিজের, এতদিন সে একটা মেকি ভয়ে খাটে শুয়ে রয়েছে, এ—মুহূর্তে কোনটা ঠিক ধরা যাচ্ছে না। টুকুন পাগলের মতো ম্যাগনোলিয়া ফুলের গাছটা পার হয়ে গেল।
এখন যদি সুরেশবাবু দেখতে পেতেন—অথবা গীতামাসি কিংবা মা, কেউ এ—ঘটনা বিশ্বাসই করতে পারত না। ওদের চোখে এটা কোনও ভৌতিক ব্যাপার হয়ে যেত।
টুকুন এবার গোলাপের বন পার হয়ে গেল। সে দেখতে পাচ্ছে পুলিশটা চারদিকে তাকাচ্ছে।
টুকুন এবার বনকরবী গাছটার নীচে গিয়ে দাঁড়াল। পুলিশটা তার দিকে আসছে।
এখন সন্ধ্যা। বাগানের নানারকমের ফ্লুরোসেন্ট বাতি। টুকুন পুলিশ আসার আগে ডাকল, সুবল।
সুবল এতক্ষণে লতাপাতার ফাঁকে দেখছে—দিদিমণি। সে প্রায় পাগলের মতো নেমে আসছে এবং লাফ দিয়ে ঝুপ করে টুকুনের পায়ের কাছে পড়ল।
—দিদিমণি তুমি!
—তাড়াতাড়ি এসো। বলে টুকুন আবার সুবলকে নিয়ে বাগানের ভিতর অদৃশ্য হয়ে গেল।
সুবলের হাতে প্লাস্টিকের ব্যাগ। ব্যাগে কিছু রজনিগন্ধা। তার গন্ধ এখন সুবলের গায়ে। সে এখানে যে ভয়ে ছুটে এসেছে বোঝা যাচ্ছে। এভাবে একদিন টুকুনদিদিমণিকে আবিষ্কার করতে পারবে ভাবতে পারেনি। অনেকটা গল্পগাথার মতো। এমন সব মেলানো গল্প শেফালীবউদি তাকে বলত। সে এতটা কখনও আশা করেনি। আশা করেনি বলেই সে কেমন আরও গ্রাম্য সরল বালক হয়ে গেল। নিজের এই আনন্দ সে কিছুতেই হইচই করে প্রকাশ করতে পারছে না।
টুকুন ওকে যেভাবে যেদিকে নিয়ে যাচ্ছে—সে সেভাবে যাচ্ছে।
টুকুনকে দেখে সুবল বিশ্বাসই করতে পারছে না, এই টুকুনদিদিমণি। খুব বেশি একটা হেঁটে এলে জানালা পর্যন্ত আসতে পারত। সে এতটুকুই দেখেছে। এমনভাবে একেবারে স্বাভাবিকভাবে সে কোনওদিন টুকুনকে হাঁটতে দেখেনি। কী সহজ সরল ভাবে ওর হাত ধরে নানারকমের গাছের ভিতর দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। টুকুনের পরনে কী সুন্দর পোশাক। কেমন সকালের গোলাপের মতো তাজা রং পোশাকের রংয়ে। এবং গোলাপের পাপড়ি মতো নরম পোশাক। প্রায় ফ্লুরোসেন্ট আলো যেন পিছলে পিছলে যাচ্ছে।
পুলিশটা এখন পাঁচিলের এদিকটায় একটা মানুষ খুঁজছে। পুলিশটার মনে হয়েছে, যারা বোমা ছুঁড়েছিল রাস্তায় তাদের একজন কেউ হবে কারণ লোকটার হাতে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ। প্লাস্টিকের ব্যাগ থেকে বোমা ছুঁড়ে মারা সহজ। প্লাস্টিকের ব্যাগ আছে বলেই পুলিশটা এখন ওৎ পেতে আছে। সুবল বাগানের ঝোপজঙ্গল থেকে বের হয়ে এলেই ধরবে। প্লাস্টিকের ব্যাগে যে রজনিগন্ধার গুচ্ছ থাকতে পারে—কিছুতেই বিশ্বাস হয় না। পুলিশেরা ফুলের কথা বিশ্বাস করে না।
টুকুন বলল, সুবল তুমি এতদিন আসনি কেন?
সুবল বলল, টুকুনদিদিমণি, এটা রাজবাড়ি?
—যা, রাজবাড়ি হতে যাবে কেন? আমাদের বাড়ি।
—তোমাদের বাড়ি? এতবড় ফুলের বাগান! এত ফুল! টুকুনদিদিমণি, আমি রোজ ফুল তুলে নিয়ে যাব এখান থেকে। তার এসব দেখে এত আনন্দ হচ্ছে সে কী কথা বলবে ঠিক বুঝতে পারছে না। তবু কিছু বলতে হয় বলে যেন বলা, টুকুনদিদিমণি আমি তোমাকে রোজ ফুল বিক্রি করতে করতে খুঁজেছি। শেষদিকে কেমন ভেবেছিলাম তোমাকে আর খুঁজে পাব না। তুমি বাদে আমার তো এ শহরে আর কেউ নেই।
টুকুন বলল, সুবল তাড়াতাড়ি এসো।
সুবল বলল, এটা কী ফুল গাছ?
—তোমাকে পরে চেনাব। ঐ দ্যাখো পুলিশটা বাগানের ভিতর ঢুকে যাচ্ছে।
সুবল দেখল সত্যি। ওকে দেখে ফেলেছে।
টুকুন বুঝতে পারল পুলিশটার চোখে ওরা ধুলো দিতে পারবে না। কিংবা সুবলকে নিয়ে জানাজানি হলে মা আবার সুবলের এখানে আসা বন্ধ করে দেবেন। এটা বাড়ির দক্ষিণ দিক। মা—বাবা থাকেন পুবের মহলাতে। এই মহলে সে থাকে, আর ভিতরের দিকে থাকে গীতামাসি। ও—পাশ দিয়ে কাঠের সিঁড়ি নেমে গেছে। কেউ ওর ঘরে উঠে আসতে হলেই সে টের পায় কেউ আসছে। কারণ কাঠের সিঁড়িতে শব্দ হয়। সেই শব্দ এক দুই করে গুণে গুণে কী যে একটা স্বভাব হয়ে গেছে টুকুনের, কোন শব্দে কে আসে টের পায়। মা উঠে আসছেন, না বাবা, না গীতামাসি, না ডাক্তারবাবু না ইন্দ্র—সে সব টের পায়। পায়ের শব্দ কারও একরকমের হয় না।
সে এবার দাঁড়াল এবং এটা বোধহয় একটা রক্তকরবী গাছ। সে বাতির আলোতে ঠিক বুঝতে পারছে না। গাছটার নীচে দাঁড়িয়ে সে পুলিশের জন্য অপেক্ষা করতে থাকল। এবং পুলিশ হামাগুড়ি দিয়ে কিছু বনঝোপের মতো জায়গা পার হয়ে সামনে দাঁড়াতেই চোখ মেলে তাকাতে পারল না। একটা ফুলপরির মতো মেয়ে। যেন পাখা মেলে দাঁড়িয়ে আছে। সে চোখের পলক ফেলতে পারছে না। কোনও দেবীমহিমা টহিমা হবে। সুবল ওপাশে একটা বড় পাথরের স্ট্যাচুর নীচে বসে রয়েছে। ওকে একেবারেই দেখা যাচ্ছে না।
পুলিশটার মনে হল সে কোথাও কিছু গোলমাল করে ফেলেছে। সে বোধহয় ছুটেই পালাত। কিন্তু সুন্দর গলায় যখন টুকুন বলছে, তুমি এখানে কী চাইছ? কাকে খুঁজছ?
—আমি কিছু খুঁজছি না মেমসাব।
টুকুন এমন কথাবার্তা আরও শুনেছে। সে অবাক হল না। বলল, কেউ নেই এখানে।
—কেউ আমার মনে হয় এই বাগানেই লুকিয়ে আছে।
—সে আমাদের সুবল। সে খুব ভালো ছেলে।
পুলিশ খুব বোকা মুখ করে রেখেছে। টুকুন বলল, সুবলের একটা পাখি আছে। সে এক আশ্চর্য পাখি। এমন পাখি আমি কোনওদিন দেখিনি।
পুলিশ বলল, তাই বুঝি?
টুকুন বলল, সে এসেছে এক খরার দেশ থেকে।
পুলিশ বলল তাই বুঝি?
টুকুন বলল, সে এখন শহরে ফুল বিক্রি করে।
এবং এটুকু বলার পর টুকুন সুবলকে ইশারায় ডাকল। সুবল স্ট্যাচুর ওপাশ থেকে খুব অপরাধী মুখে উঠে আসছে।
টুকুন বলল, এই আমাদের সুবল।
সুবল বলল, আমার নাম সুবল।
টুকুন বলল ওর একটা পাখি আছে। সুবলের দিকে তাকিয়ে বলল, সুবল তুমি পাখিটা আজ এনেছ?
—না দিদিমণি।
—কাল সুবল পাখিটা নিয়ে আসবে।
—আসব।
—আর এই দ্যাখো, বলে সুবলের প্লাস্টিকের ব্যাগটা হাতে তুলে নিল। —দ্যাখো শুধু ফুল আছে। ফুল। সুবল এর ভিতরে ফুল নিয়ে আসে।
—ব্যাগের ভিতর আজকাল কেউ ফুল রাখে জানতাম না মেমসাব।
টুকুন বলল, ব্যাগের ভিতর অনেক কিছু রাখতে পারে। শুধু ফুল থাকবে কেন? সন্দেশ থাকতে পারে, বই থাকতে পারে।
—না, আজকাল মেমসাব শুধু ব্যাগের ভিতরে বোমা থাকে। আর আমাদেরও শালা এমন বজ্জাতি বুদ্ধি, ব্যাগ দেখলেই পিছন ধাওয়া করো, কী আছে না আছে দেখার দরকার।
টুকুন বলল, তবে তুমি যেতে পারো।
পুলিশ একটা সেলাম ঠুকে বলল, খুব বেঁচে গেছিস সুবল। মেমসাব দেবতা। তোকে বাঁচিয়ে দিল!
টুকুন বলল, এসব কেন বলছ?
—মেমসাব আমাকে তো কাউকে ধরে নিয়ে যেতেই হবে। সুবল না হলে সেটা সফল হতে পারে না।
—বিনা দোষে ধরে নিয়ে যাবে?
—আমাদের শুধু ধরার কাজ। বিচারের কাজ সরকারের।
—তার জন্য যাকে তাকে? টুকুনের আর দাঁড়াতে ইচ্ছা করছে না। এখন পুলিশটাকে বিদায় করতে পারলে বাঁচে। কিন্তু কিছুতেই যেন যেতে চাইছে না। সে বলল, বড় আজগুবি ব্যাপার। আমি যাচ্ছি।
পুলিশ আর দাঁড়াল না। সে সুবলের দিকে ভীষণ কটমট করে তাকাল। এটা কী করে আজগুবি হয় সে বুঝতে পারে না। না, এরা একটা আজগুবি দেশে বাস করছে, সংসারে কী ঘটছে ঠিক খবর রাখছে না? পুলিশ যাবার সময় বলল, মেমসাব যাচ্ছি। আমার খুব ভুল হয়ে গেছে।
ভুল হয়ে গেছে বলল, এজন্য যে সে জানে বড়লোকদের মেয়েরা এমন হয়ে থাকে। কোথাকার একটা ফুলয়ালার জন্য প্রাণে হাহাকার। এখন ওর সারা মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। সে কোথায় যে আর একটা লোক পাবে! একজনকে ধরে না নিয়ে গেলে বড়বাবু তাকে আস্ত রাখবে না। সে এখন কী যে করে! রাস্তায় তিনজন গেছে। অ্যাম্বুলেন্স এসে ওদের গাড়িতে তুলে নিয়ে গেছে। যারা গণ্ডগোল করল তাদের পেছনে তাড়া করতে গিয়ে মরার দায়িত্ব নিতে পারছে না। তা ছাড়া এখন রাস্তায় একটাও লোক নেই। শুধু একটা কুষ্ঠরুগি আছে। তাকে নিয়ে যেতে পারত, কিন্তু অসুখটা বড় খারাপ। একটা খারাপ অসুখের লোককে ধরে নিয়ে যাওয়া ঠিক না।
এইসব নানারকম ভেবে যখন পাঁচিল টপকে পুলিশ রাস্তায় নেমে গেল তখন টুকুন কিছুটা যেন হালকা হল। সে বলল, সুবল এসো।
সে সুবলকে নিয়ে এবার নরম ঘাস মাড়িয়ে হাঁটছে। সামনে সেই ঘোরানো সিঁড়ি। টুকুন খুব তর তর করে উঠে যাচ্ছে। সুবল ওর পায়ের দিকে তাকাচ্ছে। কী সুন্দর আর সতেজ মনে হচ্ছে। পায়ে আলতা। সুবলের বারবার কেন জানি মনে হচ্ছে—নীলকমল—লালকমল ঘোড়ায় চড়ে ছুটছে। সেই সব রাজপুত্রেরা বুঝি এমন বাড়িতেই থাকত।
এমন একটা প্রাসাদের মতো বাড়ি এই শহরে আছে, অথবা এখনও থাকতে পারে—সে সব দেখতে দেখতে কেমন অবাক হয়ে যাচ্ছে। সে বলল টুকুন দিদিমণি আমি যাব কী করে?
—তোমাকে যেতে হবে না সুবল। তুমি এতবড় বাড়িতে থেকে গেলে কেউ টের পাবে না।
সুবল সিঁড়ি ধরে ওপরে উঠে এসেই দেখল সাদা রংয়ের কেমন মসৃণ মেঝে। একেবারে সাদা সবটা। দেয়াল, মেঝে, বারান্দা এমনকী পোশাক নানাবর্ণের যে আছে তাও অধিকাংশ সাদা রংয়ের।
সুবল বলল, আমার এ—ফুলগুলো তোমার পছন্দ হয় টুকুনদিদিমণি?
—খুব। বলে সে বুকের কাছে ফুলগুলো তুলে নেবার সময়ই মনে হল, সে তো বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াতে পর্যন্ত পারে না। এখন এমন কী করে হচ্ছে? কী করে সে এটা করে ফেলল। ওর চোখ বুজে আসছে। সে বলল, সুবল, সুবল তুমি আমাকে ধরো। আমি পড়ে যাব।
সুবল দেখল আশ্চর্য মায়া চোখে মেয়ের। ধীরে ধীরে চোখ বুজে ফেলছে দাঁড়াতে পারছে না। বুকের ওপর ফুলগুলো ধরা আছে। বুঝি পড়ে যাচ্ছে। চোখ বুজে বিড় বিড় করে বলছে এবং সুবল শুনতে পাচ্ছে, সেই নিঃশব্দ এক ভাষা থেকে সুবল টের পাচ্ছে—টুকুন তাকে ফেলে আর কোথাও যেতে বারণ করছে। এবং টুকুন দিদিমণি যেন পড়ে যাচ্ছিল। সব মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, নিজের অক্ষমতার কথা মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, হাত—পায়ে আর শক্তি পাচ্ছে না টুকুন। কেমন স্থবির হয়ে যাচ্ছে।
সুবল ধীরে ধীরে টুকুন দিদিমণিকে শুইয়ে দিল। ফুলগুলি পাশে রেখে দিল। সে পায়ের কাছে বসে থাকল। চোখ মেলে না তাকালে সে এখান থেকে চলে যেতে পারে না।