টুকুনের অসুখ – বারো
সুবল সেদিন শেফালীবউদির কাছে ফিরে আসবে ভেবেছিল। সে গিয়ে যখন দেখল টুকুন দিদিমণি হাসপাতাল ছেড়ে চলে গেছে, তখন ওর আর কিছু ভালো লাগছিল না। কেউ তাকে আর কোনও খবরও দিল না। সে দুবার চেষ্টা করেছে সেই সিস্টারের সঙ্গে দেখা করতে। কিছুতেই সুবলের সঙ্গে সিস্টার দেখা করতে চায়নি।
তবু যা হয়ে থাকে, মনের ভিতর এক অসীম বিষণ্ণতা। সে যখন তার গ্রাম মাঠ ফেলে চলে আসছিল, তখন কী ভীষণ মায়া তার গ্রাম মাঠের জন্য। সে বারবার বলেছে, আমি আবার ফিরে আসব মা সুবচনি। সুবচনি দেবী ওদের খুব জাগ্রত দেবতা। তার যতদূর মনে আছে, বাবা—মা ওর কী একটা অসুখে একবার সেই দেবতার মন্দিরে পূজা দিয়েছিল। সে সেই পূজা দেখেছিল, না অন্য মানুষের মুখে শুনে শুনে সে তার বাবা—মার সম্পর্কে একটা ধারণা গড়ে রেখেছে, এখন আর মনে করতে পারে না।
সুবল জানত না এই শহরে এসে সে এক আশ্চর্য মায়ায় জড়িয়ে পড়বে। এতবড় শহরে কী করে যে টুকুনদিদিমণি তার খুব কাছের মানুষ হয়ে গেল! এখন নিজের ওপরেই তার রাগ হচ্ছে। সে যদি দেবদারু গাছটার নীচেই আস্তানা গেড়ে নিত! কিন্তু ওর কী যে হয়ে গেল, বেশি পয়সার লোভে সে অন্য ব্যবসা করতে গিয়েই মরেছে। সে সময় কম পেত। আগের মতো খুশিমতো দুজোড়া জুতো পালিশ করে গাছের নীচে ঘুমিয়ে যেতে পারত না। এখন কেন জানি ঘুমিয়ে পড়লেই মনে হয় কেউ তার সবকিছু চুরি করে নিয়ে যাবে। তার এমন কিছু হয়েছে, যা চুরি যাবার ভয়। তার আর আগের মতো কোনও স্বাধীনতা নেই। সে বুঝতে পারে, এইসব শহরে এলেই মানুষের স্বাধীনতা চুরি যায়।
সে যখন শেফালীবউদির ওখানে ফিরল তখন বেশ রাত হয়ে গেছে। সে ইচ্ছা করলে ফুটপাথে রাত কাটিয়ে দিতে পারত। কিন্তু কেন জানি সে আজ খুব পরিষ্কার হয়ে গেছিল, এমনকি সঙ্গে সে পাখিটাকে নিয়ে যায়নি। তার হাঁটতে হাঁটতে মনে হয়েছিল, পাখিটাকে খাওয়ানো হয়নি। নানা কারণেই সে ফিরে না এসে পারেনি। আর এমন পরিচ্ছন্ন পোশাকে ফুটপাথে রাত কাটাতেও কেমন খারাপ লাগছিল।
শেফালী সুবলের মুখ দেখেই বুঝল, টুকুনের সঙ্গে সুবলের কিছু একটা হয়েছে।
সে বলল, মুখ গোমড়া কেন রাজা?
—তোমার কাছে থাকব বউদি আজ। দাদা এখনও ফেরেনি?
—না। একটু থেমে বলল, সিস্টার আবার বুঝি ধমক দিয়েছে?
সে জবাব দিল না কিছু। গলায় সুবলের মাফলার জড়ানো স্বভাব। সে তার গ্রামে দেখেছে, কেউ বাবুবনে গেলে গলায় একটা কমফর্টার জড়িয়ে রাখে। সে—ও আজ গলায় একটা কমফর্টার জড়িয়ে গিয়েছিল। সে সেটা একটা দড়িতে ঝুলিয়ে ঝুড়ির ভিতর থেকে পাখিটাকে বের করল। সে পাখিটার জন্য ইচ্ছা করলে একটা খাঁচা কিনতে পারে। কিন্তু খাঁচায় পাখি রাখার ইচ্ছা সুবলের হয় না। পাখি সেই যে কবে বাঁশের চোঙে আশ্রয় নিয়েছিল, আর সে অন্য আশ্রয়ে যেতে চায়নি। সে বলল, পাখি তোর টুকুনদিদিমণি চলে গেছে।
পাখি পাখা নাড়ল। যেন বলতে চাইল, কোথায়?
—জানি না।
শেফালীর ঘুম পাচ্ছিল। সুবল কিছু খাবে হয়তো। ওকে জল—নুন দিতে হবে। বাকিটা সুবল নিজের কাছে রাখে। ছোলার ছাতু, লংকা একটু চাটনি। সে একটা থালায় এসব রেখে শেফালীবউদিকে হয়তো বলবে এক গেলাস জল দাও তো বউদি, খেয়েনি।
কিন্তু আজ সে—সব কিছুই করল না সুবল। বরং পাখিটাকে খাওয়াল। তারপর পাখিটার সঙ্গে কী যেন ফিস ফিস করে বলল, এবং এক সময় মনে হল, ওর টুকুনদিদিমণিকে খুঁজতে যাওয়া দরকার। সে শেফালীবউদিকে বলল, একটু কষ্ট করতে হবে। আমার যা কিছু—এই যেমন কড়াই, চিনেবাদাম, ছোলা—মটর সব এখানে কিছুদিনের জন্য থাকল। কবে ফিরব ঠিক নেই। পাখিটা সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি।
—দেশে যাচ্ছ নাকি? অবাক চোখে তাকাল শেফালী।
—দেশে আমার কেউ নেই। আমাদের কেউ নেই। তবে স্বপ্ন দেখেছি একদিন জনার্দন চক্রবর্তী দেবীর মন্দিরের বাইরে একটা হরিণকে ধরার জন্য ছুটছে। কী যে স্বপ্ন! স্বপ্নটার কোনও মানে হয় না।
—কিন্তু এত রাতে? কিছু খেলে না। তুমি কী পাগল!
সুবল হাসল। সুবলের লম্বা পাজামা, লম্বা পাঞ্জাবি গেরুয়া রংয়ের এবং সন্ন্যাসীর মতো মুখ শেফালীকে কেমন কাতর করছে। সে বলল, খেলে না। টুকুনের কাছে গেলে—দেখা হল কিনা বললে না। সিস্টার কী বলল বললে না। কী হয়েছে তোমার?
—টুকুনদিদিমণি হাসপাতাল থেকে চলে গেছে।
—তাহলে দেখা হয়নি?
—না।
এক আশ্চর্য বিষণ্ণতা ধরা পড়ছে সুবলের চোখে মুখে। অথবা দেখলে মনে হয় সুবল মনে মনে কিছু স্থির করে ফেলেছে। তাকে এখন শেফালী কিছুতেই আটকে রাখতে পারবে না। শেফালী তবু বলল, কিছু খেলে না!
—কিছু খেতে ইচ্ছা হচ্ছে না।
—তুমি তো দেখছি শহরের মানুষের মতো হয়ে যাচ্ছ।
সুবল চোখ তুলে তাকাল।
—তোমার তো এমন হওয়া উচিত না রাজা।
সুবল কিছু বলল না। সুবলের যেমন স্বভাব কথার ঠিক জবাব দিতে না পারলে একটু হেসে ফেলা, তেমনি সে হেসে দিল।
এই হাসিটুকু ভারী সুন্দর। এমনভাবে হাসলে বড় বেশি সরল মনে হয়। তখন ওকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা হয়। আদর করতে ইচ্ছা হয়। এত যে মনের ভিতর তার অশান্তি—কেমন নিমেষে উড়ে যায়। তার মানুষ ঘরে থাকে না। মানুষটা সংসার চালাবার নামে কোথায় থাকে, কোথায় যায় সে বলতে পারে না। এবং মদ্যপানে মানুষটা কখনও অমানুষ হয়ে গেলে শহরের সব দুঃখ একসঙ্গে ধরা যায়। তখন সুবলের মতো একজন সরল গ্রাম্য বালকের সঙ্গ পেতে বড় ভালো লাগে।
শেফালী বলল, তুমি রাজা আজ কোথাও যেতে পারবে না।
সুবল দেখল শেফালীবউদির চোখে ভীষণ মায়া। ভীষণ এক টান। এবং এই শহর, নির্বান্ধব শহরে সে কেন জানি আর না করতে পারে না।
শেফালী বলল, আমি কটা গরম রুটি সেঁকে দিচ্ছি। একটু আলুর তরকারি। বেশ খেতে ভালো লাগবে।
সুবল বলল, তুমি আমার জন্য এত রাতে এসব করবে?
—বাঃ করব না! তোমার দাদা এসে যদি জানতে পারে রাজা রাতে না খেয়ে বের হয়ে গেছে, তবে আমাকে আস্ত রাখবে!
সুবল বুঝতে পারে এই শহরের কোথাও নানা ভাবে নানা বর্ণের দুঃখ জেগে আছে। এই সংসারে এমন এক দুঃখ। অভাব—অনটনের সংসারে একটা মানুষ সবসময় কোথায় কী করে বেড়াচ্ছে! কেমন একটা পালিয়ে বেড়ানোর স্বভাব অজিতদার। কোথায় যে এই মানুষের আস্তানা সে সঠিক জানে না। খুব কম সময় সে অজিতদাকে এখানে দেখেছে। এবং শেফালীবউদির চোখ দেখে মনে হয়েছে সে—ও সঠিক ঠিকানা অজিতদার জানে না। ওর মনে হল টুকুনদিদিমণির সঙ্গে অজিতদার সঠিক ঠিকানাটাও সে খুঁজে বের করবে। সে বলল, দাও তবে। আজ আর বের হচ্ছি না। যখন বললে, তখন আজ রাতটা এখানেই কাটানো যাক।
সুবল কেমন স্মার্ট গলায় এখন কথাবার্তা বলছে। সে দেখল বারান্দায় উনুনে বউদি আঁচ দিচ্ছে। এবং বউদিকে দেখে মনে হচ্ছিল কিছুদিন থেকে দাদার সঙ্গে একটা বোঝাপড়ার অভাব হচ্ছে। অথবা বউদির এমন একটা জায়গা ভালো লাগছে না। কারণ বউদি খুব পরিপাটি এবং সেজেগুজে থাকতে ভালোবাসে।
অজিতদার খুব ইচ্ছা বউদির জন্য সে যাবতীয় কিছু করবে। এতসব অট্টালিকা এই শহরে, বউদির জন্য এমন একটা অট্টালিকা চাই। এবং যখন সে নানাভাবে চেষ্টা করেও কোনওরকমে একটু সুন্দরভাবে বাঁচবার মতো ব্যবস্থা করতে পারে না, তখন কেমন হীনমন্যতায় ভোগে। এবং এভাবে সংসারে অশান্তি নেমে এলে মনে হয় শেফালীবউদিকে অজিতদা কোথা থেকে যেন চুরি করে নিয়ে এসেছে। অনেক কিছুর প্রলোভনে শেফালীবউদি সবকিছু পিছনে ফেলে চলে এসেছিল। বউদি কতদিন কতভাবে তাকে নানারকম সব গল্প শুনিয়েছে। এবং আজকের এই রাতে খাওয়া একটা বেখাপ্পা ঘটনা। ওর সঙ্কোচ হচ্ছিল।
শেফালী বলল, বেশ গরম পড়েছে। চান করে নাও।
কলতলা খোলা। সেখানে সে পাজামা খুলে চান করতে পারে না। এবং শরীরে সব অস্পষ্ট জলের রেখা চারপাশে ভেসে উঠেছে। সে ছুঁলেই বুঝতে পারে নরম, খুব নরম ত্বকে বাবুইয়ের বাসার মতো গুচ্ছ গুচ্ছ কীসব ভেসে উঠেছে। এবং এভাবে ওর এক লজ্জা নিবারণের কথা মনে হয়। সে বলল, বউদি আমি বরং রাস্তার কল থেকে স্নান করে আসি।
শেফালী বলল, এত রাতে রাস্তার কলে চান করলে পুলিশে ধরে নিয়ে যাবে।
পুলিশকে বড় ভয় সুবলের। সে বলল, আমি বরং হাত—মুখ ধুয়েনি।
শেফালী বলল, রাস্তায় গাছের নীচে শুয়ে থাকলে এত গরম লাগে না রাজা।
ঘরে শুলে ভীষণ গরম। চান না করে নিলে ঘুমোতে পারবে না।
—তাহলে আমি যখন চান করব, তুমি কিন্তু তাকাবে না।
—তাকালে কী হবে? শেফালী হেসে দিল।
সুবল বলল, আমি বড় হয়ে গেছি বউদি। বলেই সে কেমন ছেলেমানুষের মতো লজ্জায় মাথা নিচু করে রাখল।
—আমার বড় তোয়ালে—ওটা পরে নাও।
—তোমাদের অসুবিধা হবে না? অজিতদা খারাপ ভাবতে পারে।
সুবল আর কিছু না বলে বেশ বড় একটা তোয়ালে নিয়ে নিল। সংসারে অজিতদার যা কিছু রোজগার সব শৌখিনতার জন্য। সুবল এতসব সুন্দরভাবে ভাবতে পারে না। তবু যখন তোয়ালেতে এক মনোরম গন্ধ, সে তোয়ালেটা মুখে নিয়ে কেমন ঘ্রাণ নিতে থাকল। এমন রঙবেরঙের তোয়ালে নিশ্চয়ই বউদির। সে ঠিক টুকুনদিদিমণির মতো এক আশ্চর্য সুবাস পায় বউদির শরীরে। আর কেন জানি সুবলের মনে হয় এই শহরে, সে যতবার যতভাবে যুবতী মেয়েদের অথবা ফ্রকপরা মেয়েদের সান্নিধ্যে এসেছে, কেমন এক ফুলের সুবাস সবার গায়ে। সে ভাবল, সে যখন ফুল বিক্রি করবে তার শরীরেও এমন একটা মিষ্টি গন্ধ থাকবে।
শেফালীবউদির চটপট সব হয়ে যায়। সুবল গড়িমসি করছিল খুব। ওর তো এমনভাবে বাঁচার স্বভাব নয়। এ যেন আলাদা ব্যাপার। সে একটা আলাদা স্বাদ পাচ্ছে। খুব নিরিবিলি একটা ঘরে, বউদি, বউদির রান্না, ঝালের গন্ধ, এবং আলোর ভিতর বউদির কপালে ঘামের চিহ্ন কেমন এক আকর্ষণ তৈরি করছে। সে সুবল, সংসারের নিয়ম—কানুন সঠিক তার জানা নেই, সে জানে না, এভাবে কোনও যুবতী বালককে রেঁধে—বেড়ে খাওয়াতে পারে, সে ভারী এক রহস্যের স্বাদ পেয়ে যাচ্ছে, সে বলল, বউদি এখানে এলে আমার আর যেতে ইচ্ছা হয় না। অজিতদা যে কী করে তোমাকে ফেলে এতদিন নিরুদ্দেশ হয়ে থাকে বুঝতে পারি না।
শেফালী বলল, তুমি থেকে যাও না রাজা।
—আমার যে বউদি টুকুনদিদিমণির কাছে যেতে হবে।
—কে যে এক টুকুনদিদিমণি তোমার।
—না, খুব ভালো। আমাকে দেখলেই দিদিমণির প্রাণে যেন জল আসে।
—তুমি ঐ ভেবেই সুখে থাক।
সুবল বলল, আমি যখন ফুল বিক্রি করব তখন একটা করে ফুলের গুচ্ছ দিদিমণিকে দিয়ে আসব।
—তুমি ওকে কোথায় পাবে?
—কেন, এই শহরে।
—সে কী খুব ছোট ব্যাপার?
—আমি যখন ফুল নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় বিক্রি করব তখন আমার ডাক শুনলে ঠিক দিদিমণি টের পাবে। জানালা খুলে দিলে আমাকে চিনতে পারবে।
আমি বলব, দিদিমণি তোমার ফুল।
শেফালী এই সরলতার জন্য কেমন মুগ্ধ হয়ে যায়। সে বলল, তুমি দাঁড়াও রাজা। ঝোলটা হয়ে গেলে তোমাকে জল পাম্প করে দেব।
শেফালী জল পাম্প করে কেমন ছেলেমানুষের মতো বলল, রাজা তুমি সাবান মাখ না কেন?
—সাবান কোথায় পাব?
—আমি তোমাকে সাবান মাখিয়ে দিচ্ছি। আমাকে তোমার দাদা পামঅলিভ কিনে দেয়।
—আমার গায়ে মেখে দিলে তোমার শরীরের মতো গন্ধটা হবে?
—হ্যাঁ। ঠিক আমার শরীরে তুমি স্নান করে এলে, যেমন গন্ধ পাও ঠিক তেমনি।
—তবে দাও। খুব সুন্দর গন্ধ শরীরে থাকলে আমার রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে ভালো লাগে।
—শেফালী ছুটে ছুটে কাজ করছিল। ওর যেন এটা একটা খেলা হয়ে গেছে। সুবলকে নিয়ে খেলা। সুবল কলের নীচে বসে আছে। সুবলের পিঠে শেফালী সাবান মাখিয়ে দিচ্ছে। বড় নরম শরীর সুবলের। ওর ঘন চুল কী কালো। কপাল প্রায় যেন ঢাকা। লম্বা ভুরু। চোখ ভাসা, এবং পদ্মফুলের মতো জলের ওপর যেন গাছের ছায়া ভেসে বেড়াচ্ছে।
কী যে ভালো লাগছিল শেফালীর—এমনভাবে সাবান মাখিয়ে দিতে! ওর শরীরের ভিতর এক আশ্চর্য অহঙ্কার আছে, শেফালী কেমন পাগলের মতো ওর শরীর নিয়ে, ঠিক একটা ছোট্ট পাখির মতো ওর অহঙ্কার ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। সুবল বলছে, বউদি ঠিক আছে, এবার বাকিটা আমি ঠিক পারব।
—না, তুমি পারবে না রাজা। তুমি কিছু জানো না।
—জানি, ঠিক জানি। দাও, দ্যাখো কী করে মাখতে হয় দেখিয়ে দিচ্ছি। তুমি এমন করছ, আমার ভীষণ খারাপ লাগছে।
কিন্তু শেফালী আজও আশা করেছিল, অজিত ফিরে আসবে, কিন্তু যা খবর পাঠিয়েছে ওর মানুষ দিয়ে, অজিত কবে আসবে ঠিক নেই, কবে আসতে পারবে সে বলতে পারবে না। কিছু টাকা পাঠিয়েছে। ভীষণ হতাশা ছিল মুখে। এই সুবল এখন সব আকাঙ্ক্ষার রাজ্যে নতুন বাতির মতো। —তোমার শরীরে রাজা কী ময়লা, বলেই সে বগল তুলে ঘষে দিতে দেখল, কালো মসৃণ ছোট সুন্দর সব চুলের গুচ্ছ—ঠিক কলমি ফুলের মতো রং। ঠিক কালো নয়, কিছুটা তামাটে রং। সুবলের কেমন কাতুকুতু লাগছিল। সে হো হো করে হাসতে থাকল।
শেফালী বলল, তুমি এমন বড় হয়ে গেছ আগে বলোনি কেন রাজা?
সুবল কোনও জবাব দিতে পারল না। একেবারে চুপ মেরে গেল। সত্যি ওর ভীষণ খারাপ লাগছিল। এবং ভয়ে ক্রমে গুটিয়ে যাচ্ছিল।
এভাবে হৃদয়ের কাছাকাছি থাকার যে বাসনা মানুষের, মানুষ যার টানে বড় রকমের কঠিন কিছু করতে পারে না, এবং এভাবে সুবলের ব্যথিত মুখ দেখে শেফালী কেমন থমকে গেল। বলল, তুমি এমন দুঃখ পাবে জানতাম না।
সুবলের ভিতর এক পাপবোধ এভাবে জন্ম নিলে—এই শহরের গ্লানিকর সব ছবি তাকে তাড়া করে বেড়াতে থাকে। ওর মনে হল, সকাল হলেই সে ফুলের সন্ধানে চলে যাবে।
সঙ্গে থাকবে পাখিটা। যা সামান্য সম্বল আছে এই দিয়ে সে এই শহরের বড় রকমের পাপখণ্ডনের নিমিত্ত আবার রাস্তায় নেমে গেল। সেই যে এক দেশ, যে দেশে সে জন্মেছে, কী যে পাপ ছিল, টুকুনদিদিমণির এমন অসুখ!
সে নানাভাবে ফুলের সন্ধান করে বেড়াল। বই—পাড়ার কাছে খুব বড় ফুলের দোকান আছে। সেখানে সন্ধান নিয়ে সে জেনেছে, কিছুদূর ট্রেনে গেলে, একজন মানুষ আছে। মাঠে তার কেবল ফুলের চাষ। সে রজনিগন্ধার চাষ করতেই বেশি পছন্দ করে। ওর কেন জানি মনে হল, এই পৃথিবীতে একমাত্র সেই লোকটির সঙ্গেই তার এখন বন্ধুত্ব হতে পারে।
সুবল লোকটার সন্ধানে চলে গেল।
একটা নীল রঙের ট্রেনে চড়ে একটা সাদা রংয়ের স্টেশনে সে নেমে পড়ল। যে লোকটা নীলবাতি নিয়ে স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকে তার কাছেই খবর পেল—লোকটি একটা ভাঙা কুটিরে থাকে। ওর সম্বল একটা লণ্ঠন। সে তার দুই বিঘা জমিতে নানারকমের ফুলের চাষ করে থাকে। বেলফুলের জন্য আছে কাঠা চারেক ভুঁই। রজনিগন্ধার জন্য আছে কাঠা দশেক। গাঁদাফুল এবং অন্য মরশুমি ফুলের চাষের জন্য সে রেখেছে বাকি জমিটা।
তার বাড়ি যেতে হলে পায়ে হেঁটে যেতে হয়। সে গেলেই একটা ফুলের গুচ্ছ এনে তুলে দেবে। সেখান থেকে তোমার খুশিমতো ফুল পছন্দ করে কিনে আনবে। গুচ্ছের ভিতর সে সব সময় তাজা এবং ভালো ফুলগুলো রাখে। ওর মুখে লম্বা সাদা দাড়ি। ভীষণ কালো রং মানুষটার। সে একটা লুঙ্গি পরে। মাথায় তার একটা ফেজ টুপি। মানুষটা ধার্মিক। পাঁচ বেলা নামাজ। আর ফুল ফোটানো তার কাজ। পৃথিবীতে অন্য কাজ আছে বলে সে জানে না।
মানুষটার আবার ভীষণ বাতিক। সে যে জমি থেকে মৃতের জন্য ফুলের তোড়া তৈরি করে, সেই জমি থেকে কখনও ফুলশয্যার মালা গাঁথে না। সুবল লোকটির পরিচয় পেয়ে খুব খুশি। সুবল বলল, আমার খুব ইচ্ছা ফুলের চাষ করি তোমার মতো।
—ফুলের চাষ কোর না। দুঃখ পাবে।
সুবল বলল, দুঃখ মানুষের জন্য। মানুষটার কাছে এসে সুবল তার মতো ধার্মিক কথাবার্তা বলতে পেরে আনন্দ পাচ্ছে।
—তা হলে এই বয়সে সুখ—দুঃখ নিয়ে তোমার ভাবনা আছে?
—ভাবনা কী নিয়ে ঠিক জানি না বুড়োকর্তা। তবে এটুকু মনে হয়েছে, তুমি খুব আনন্দে আছো। তুমি শহরে যাও না?
—শহরে কোনওদিন যাইনি। আগে ফুলের চাষ করতাম নেশার জন্য। এখন এটা পেশা হয়ে গিয়ে ভালোই হয়েছে। শুনেছি আমার ফুলের খুব সুনাম বাজারে। মানুষেরা মরে গেলে শুনেছি আমার ফুল তাদের চারপাশে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। ব্যাপারটা ভাবতে খুব আনন্দ পাই।
—সুন্দর সুন্দর বউরা শুনেছি বিকেলে ছাদে ঘুরে বেড়ায়। তাদের খোঁপায় আমার এই সব বেলফুলের মালা জড়ানো থাকে! বুড়ো মানুষটি সুবলকে এমনও বলল।
সুবল বলল, তুমি আনন্দেই আছো। ফুল বিক্রি করাও খুব আনন্দের। আমার তো তেমন পয়সা নেই।
বুড়ো লোকটি বলল, আমার কাছে একদিনের ধারে পেতে পারো। তার বেশি নয়।
—কিন্তু আমার ঠিকানা নেই।
—ঠিকানা! মানুষটা ঠিকানার কথা বলতেই কেমন চোখ বড় বড় করে ফেলল। মানুষের কোনও আবার ঠিকানা থাকে নাকি?
—থাকে না? এই যে তোমার ঠিকানা, ফুলের মাঠ, একটা সবুজ কুটির এবং নদীর ধারে বড় রাস্তা।
লোকটি বলল, অঃ। এই ঠিকানার কোনও দাম নেই। আমি তোমার ঠিকানা চাই না। তুমি তো একদিনের জন্য ধার নেবে। বাকিটা তো আমার ওপর।
যাই হোক, সুবল লোকটির কাছে অনেক বেলফুল চাইল।
লোকটি বলল, এসো।
সুবল লোকটির সঙ্গে হাঁটতে থাকল।
বেলফুলের জমিতে এসে বলল, তুমি এই এই গাছ, বুড়ো এক দুই করে গাছের নম্বর বলে গেল, এগুলো তোমার। তুমি এসব গাছ থেকে ফুল নেবে। বলেই সে সুবলের মুখে কী দেখল। বলল, দাম অর্ধেক হয়ে যাবে। গাছের সেবা—যত্নের ভার নিলে, ফুলের দাম কমে যায়।
সুবল অর্ধেক দামেই ফুলের বন্দোবস্ত নিল।
সুবল খুব সকালে আসত। গাছে জল দিত। গাছগুলোর গোড়া খুঁচিয়ে দিত নিড়িকাচি দিয়ে। নদীতে স্নান করত। জোয়ারে জল থাকত খুব নদীতে। সে জল বয়ে আনত নদী থেকে। মাটিগুলো টেনে গেলে অথবা গোড়া শক্ত হয়ে গেলে, সুবলকে খুব চিন্তিত দেখাত। অথবা পোকা লাগলে সে কী করবে ভেবে পেত না। বুড়ো মানুষটা তখন নানারকমের শুকনো পাতা সংগ্রহ করত বন থেকে। শুকনো নিমপাতা অথবা কচুরিপানা। সব সে আগুন জ্বেলে একরকমের ছাই সংগ্রহ করত। ছাই ছড়িয়ে দিত গাছে গাছে পাতায় পাতায়।
আর সকাল হলেই সুবল দেখতে পেত ঝোড়ো হাওয়ায় পাতা থেকে সব ছাই উড়ে গেছে। পোকামাকড় সব মরে গাছের নীচে পড়ে গেছে। পাতাগুলো গাছের কেমন সবুজ হয়ে গেছে। আর কী আশ্চর্য সাদা রংয়ের ফুল—চারপাশে গন্ধে ভীষণ আকুল করছে। এমন একটা ফুলের মাঠে দাঁড়ালে কোথাও দুঃখ আছে বোঝা যায় না।
এই কুটিরের পাশেই সুবল আর একটা কুটিরে বানিয়ে নিয়েছে। সে নদী থেকে মাটি কেটে এনেছে। বুড়ো মানুষটা তাকে সাহায্য করেছে নানাভাবে। এতদিন একা থেকে বুড়ো মানুষটার একরকমের স্বভাব হয়ে গিয়েছিল—মানুষ কিছুতেই সহ্য করতে পারত না। আর যেসব ফুলের দালালরা আসত, ভারী খারাপ লোক। নানাভাবে তাকে ঠকাত। একমাত্র সুবল এক মানুষ, কেমন সরল, এবং ঠকানো কাকে বলে জানে না। সে আসার পর তার চাষ দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। এবং সময়মতো আজকাল বর্ষা আসে। ভালো ভালো ফুল হয়। গোলাপগুলো কী যে বড় হয়ে ফুটছে। গোলাপ চাষের ভার এখন সুবলের উপর। ছেলেটা ভারী পয়া। যেন সুবল বললে সব তার নামেই লিখে দেবে।
এই লোকটিকে দেখে সুবলের কখনও কখনও জনার্দন চক্রবর্তীর কথা মনে হয়। খুব দাম্ভিক, কিছুতেই হার মানবে না প্রকৃতির কাছে। এই মানুষেরও একটা তেমন অহঙ্কার আছে। তার মতো ফুলের চাষ এ—তল্লাটে কেউ জানে না। সে ফুলের চাষ করে যা উদ্বৃত্ত হয়েছে, একটা মসজিদ বানিয়েছে। সে সেখানে মাঝে মাঝে গরিব মানুষের জন্য শিরনি দেয়। তার স্বভাব উলটো। একটা ইঁদারা করে দিয়েছে। সে এসবের ভিতরেই ধর্মকে খুঁজে বেড়ায়। এবং সুবল এখানে আসার পর সে একটু যেন হাতে সময় পেয়েছে। মাঝে মাঝে চারপাশে যখন তার অজস্র গোলাপ, তখন সে একটা বড় লম্বা মানুষ হয়ে যায়। ওকে একটা ফুলের বনে ফেরেস্তার মতো মনে হয়।
একদিন সকালে উঠে বুড়ো মানুষটা দেখল, সুবল ঘরের দাওয়ায় চুপচাপ বসে আছে। পাখিটা খুব ওকে জ্বালাচ্ছে। সে মাত্র নামাজ পড়ে এদিকে এসেছে সুবলকে বলতে, যেন সুবল গোলাপের দালালি করার লোকটা এলে ভাগিয়ে দেয়। এবার থেকে সব ফুল সে সুবলকে দিয়ে দেবে। গোরুর গাড়িতে সুন্দর করে স্তবকে স্তবকে কলাপাতায় মোড়া ফুলের গুচ্ছ। শেষ—রাত থেকে উঠে তুলে ফেলতে হয়। সকাল সকাল স্টেশনে ওগুলো চালান দিতে হয়। রোজ ফুল যায় না। একদিন অন্তর একদিন। কিন্তু সে এসে সুবলকে এমনভাবে বসে থাকতে দেখবে ভাবতে পারেনি।
বুড়ো লোকটা কাছে গিয়ে বলল, তোর আজকাল ফিরতে এত রাত হয় কেন রে?
সুবল তাকাল। খুব বিষণ্ণ দেখাচ্ছে।
বুড়ো মানুষটা এমন একটা মুখ মাঝে মাঝেই সুবলের দেখেছে। চুপচাপ কাজ করে যাচ্ছে, ফুলের কুঁড়ি বেছে নিচ্ছে সুবল, সাতটা কথা বললে একটা কথার জবাব দিচ্ছে। বুড়ো লোকটা এবার কেমন খেপে গেল, বলল, সুবল ফুলের মাঠে কেউ দুঃখ নিয়ে বাঁচলে আমার ভালো লাগে না।
—দুঃখটা তুমি কর্তা কোথায় দেখলে?
—সকালে এমন মুখে বসে আছিস কেন?
—তুমি জানো না কর্তা, আমি কতদিন থেকে তাকে খুঁজছি।
বুড়ো লোকটা বুঝতে না পেরে বলল, সে সবাই খোঁজে, কেউ পায় না। আমিও তো তাকে খুঁজছি। পাচ্ছি কোথায়?
সুবল বলল, তুমি বুড়োকর্তা এমন কোনও মেয়ে দেখেছ, কেবল যার অসুখ? অসুখ ছাড়ে না। দাঁড়াতে পারে না, হাঁটতে পারে না। কেবল শুয়ে থাকে। মুখটা তার বেলফুলের মতো সাদা।
বুড়োকর্তা হা হা করে হেসে উঠল। বলল, মেয়েই দেখিনি জীবনে। তার আবার অসুখ, তার আবার ভালো থাকা! আর তাই নিয়ে তুই মুখ গোমড়া করে রেখেছিস!
সুবল বুড়োকর্তার দুঃখটা কোথায় ধরতে পারে। এমন একজন কুৎসিত মানুষকে, কেউ হয়তো ভালোবাসেনি। যখন ঘরে বিবি আনার বয়স ছিল, তার পয়সা ছিল না, তার মুখের চেহারাতে আছে নৃশংস এক ছবি। নিষ্ঠুর মুখচোখ দেখলে কেউ কাছে আসতে সাহস পায় না।
কেবল সুবল জানে—কী কোমল ধর্মপ্রাণ মানুষটি। সে বলল, আমি ভেবেছিলাম, তাকে খুঁজে ঠিক বের করব। তার খুব অসুখ। আমাকে দেখলে ও খুব খুশি হয়।
অথবা তার যেমন ধারণা। সে গেলেই টুকুনদিদিমণি ভালো হয়ে যাবে। এমন এক সরল বিশ্বাস টুকুনের চোখ—মুখ দেখে তার গড়ে উঠেছে বুঝি। সে তো কখনও টেরই পায় না টুকুনদিদিমণি অসুস্থ। সে গেলে জানলা পর্যন্ত হেঁটে আসতে পারে। কত কথা। টুকুনকে নিয়ে সে কত কথা। টুকুনকে নিয়ে সে সারা বিকেলে শুধু গল্প আর গল্প। এবং এভাবেই মানুষের মনে অজান্তে এক অহঙ্কার গড়ে ওঠে। সে জনার্দন চক্রবর্তীর মতো রুক্ষ মাঠে বান ডাকাবার চেষ্টা করছে।
বুড়োকর্তা বলল, তুমি পাবে। তাঁকে ঠিক খুঁজে পাবে। ভালো মানুষেরা তাঁকে একদিন খুঁজে পায়।
সুবল বুঝতে পারল বুড়োকর্তা ঈশ্বরের কথা বলছেন। সে আর বুড়োকর্তাকে ঘাঁটাল না! ঈশ্বর—বিশ্বাসেরই মতোই ওর ধারণা, সে একদিন না একদিন টুকুনদিদিমণিকে ঠিক জানালায় আবিষ্কার করে ফেলবে।