Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

এটা একটা বড় বাড়ি। খুব বড়। কলকাতার ওপর এতবড় বাড়ি সচরাচর দেখা যায় না। বাড়িটা অনেকটা জায়গা জুড়ে। খুব ছিমছাম, পরিপাটি নরম ঘাসের চাদর বিছানো চারপাশে। সামনে একটা ছোট্ট পাহাড়। দু’দিকে দুটো পথ চলে গেছে। পাঁচিল লম্বা, দু’মানুষ—সমান উঁচু পাঁচিল বাড়িটার চারপাশে। পাঁচিলের পাশে সব ছোট ছোট আউটহাউস। এবং নানা বর্ণের করবীফুলের গাছ। গাছের নীচ দিয়ে হেঁটে গেলে বোঝাই যায় না এ—বাড়িতে কোনও দুঃখ জেগে আছে।

অথচ একটা মেয়ে, ছোট্ট জানলায় বসে রয়েছে। সে এখন জানলা আর বন্ধই করে না। সে আসবে। ঠিক আসবে। কারণ সুবল না এসে পারে না। ওর পাখিটা যখন সম্বল আছে, সে আজ হোক কাল হোক, জানলায় পাখিটাকে পাঠিয়ে দেবে। টুকুন আছে দোতলার দক্ষিণ দিকের বারান্দায়। নীচে মালীরা বড় একটা বাগান করছে। কত সব ফুলের সমারোহ এখন। শেফালীগাছে কত অজস্র ফুল। এবং সকাল হতেই গীতামাসি যখন জানলা খুলে দেয়, সে দেখতে পায় কত সব পাখি এসেছে গাছটায়। সে সুবলের পাখিটাকে তার ভিতর খোঁজার চেষ্টা করে। যদি ওদের সঙ্গে ছদ্মবেশে মিশে থাকে পাখিটা।

আর কী সুন্দর মনে হয় পৃথিবী। ওই যে সকাল হল, কিছুক্ষণ পরই রোদ এসে নামবে, এবং সামান্য শিশিরের টুপটাপ শব্দের মতো পাখিরা এসে বসেছে গাছগাছালির ভিতর—তার যে কী ভালো লাগছে!

এই দক্ষিণের বারান্দায় কাচের জানলা সব। ভিতরে টুকুনের মনোরঞ্জনের জন্য নানারকমের খেলনা। এখন এই ক’মাসেই বোঝা যায় টুকুনের বয়স আর খেলনার জগতে নেই। সে সুবলের সঙ্গে দেখা হবার পর থেকেই শারীরিক কীসব অনুভূতি যেন তাকে ক্রমে গ্রাস করছে। সে এখন সুন্দর সুন্দর বই পড়তে ভালোবাসে। দি প্রিন্স অ্যান্ড দি পপার গল্পটি বড় ভালো লাগে। কখনও সে আতোয়ান দ্য স্যাঁত—একজুপেরির ল্য পতি প্র্যাঁস পড়তে পড়তে মুগ্ধ হয়ে যায়। সেই সাহারা মরুভূমির বুকে নায়ক, সে বিমান বিকল হয়ে যাওয়ায় ওখানে পড়ে গেছে, সাত—আট দিনের মতো মাত্র পানীয় জল আছে—আর আশ্চর্য সেই মানুষটা যখন একাকী, নিঃসঙ্গ মানুষের বসতি থেকে প্রায় হাজার মাইল দূরে এবং শুধু আকাশ সীমাহীন দেখা যাচ্ছে, কিছু নক্ষত্র, আর কাঁটাগাছ মরুভূমির, তখন কিনা সকাল হলে, সুন্দর এক ছোট্ট রাজপুত্রের কণ্ঠ সে শুনতে পায়—আমাকে একটা ভেড়ার বাচ্চার ছবি এঁকে দাও না!

টুকুন যেন সেই ছোট্ট রাজপুত্রের সঙ্গে সুবলের একটা আশ্চর্য মিল খুঁজে পায়। এখন অপেক্ষায় আছে, তার জন্য কেউ একটা সুন্দর ছবি এঁকে দেবে। টুকুন আজকাল বরং ঘর থেকে খেলনাগুলো সরিয়ে দিতে পারলে বাঁচে। পরিবর্তে ওর ঘরে এখন আলমারি—ভর্তি বই। এবং সুন্দর সুন্দর সব ভালোবাসার কথা সেখানে লেখা আছে।

আবার টুকুন আজকাল নানারকম গ্রহ—নক্ষত্রের বই পড়তে ভালোবাসে। বিশাল সৌরমণ্ডলের কথা ভেবে সে কেমন মুহ্যমান হয়ে থাকে। সেখানে সামান্য টুকুন অথবা তার অসুখ, সে বড় হচ্ছে না, তার শরীরের সব লক্ষণগুলো কোথায় যেন আটকে আছে—এসব বড় তুচ্ছ। তখন তার কেন জানি বাবা—মা—র ওপর ভীষণ করুণা হয়। মা—বাবা কেন যে মুখ করুণ করে রাখে! মা কিছুতেই কেন যে সুবল এ—বাড়িতে আসুক চায় না! বাবার সঙ্গে ওই নিয়ে মা—র ভীষণ মন—কষাকষি! বাবা শেষ পর্যন্ত মা—র কথাতেই রাজি—তাই বলে একটা রাস্তার ছেলে কখনও টুকুনের সঙ্গী হতে পারে না। আমি বরং রণবীরকে বলব ওর ছেলে ইন্দ্রকে যেন পাঠিয়ে দেয় এখানে থাকবে। কী সুন্দর সুপুরুষ রণবীর। ওর ছেলে বাপকেও ছাড়িয়ে গেছে। এমন কথার পর বাবা আর সিস্টারকে ঠিকানা দিতে পারেননি! সুবল এলে পাঠিয়ে দিতে বলেননি।

তবু টুকুনের ধারণা, সুবল আসবে। কারণ সে কেন জানি সুবলকে এ—গ্রহের বাসিন্দা বলে ভাবতেই পরে না। সেই ছোট রাজপুত্রের মতো তার বাড়ি অন্য কোনও গ্রহে হবে। সে কোনও অলৌকিক যানে চড়ে এখানে নেমে এসেছে। সুবল নিজের সঠিক ঠিকানা জানে না। তার গ্রহটা খুব ছোট। একটা বাড়ির মতো গ্রহটা। সে সেখানে এতদিন থাকত বোধহয়।

সেই ছোট্ট রাজপুত্রের গল্পের মতো মনে হয় সত্যি এই সৌরজগতে কত তো গ্রহ আছে। সংখ্যায় তারা কত কেউ বলতে পারে না। কত সব ছোট্ট গ্রহ আছে যা দূরবিনে পর্যন্ত ধরা পড়ে না। অথবা কখনও কখনও বিন্দুর মতো ধরা পড়লে জ্যোতির্বিদরা সংখ্যা দিয়ে তার অবস্থান অথবা নাম প্রকাশ করে থাকে। বড়দের তবু নাম আছে একটা—পৃথিবী, বৃহস্পতি, মঙ্গল, শুক্র। কিন্তু ছোটদের জন্য কেউ নাম দেয় না। কোনও জ্যোতির্বিদ কোনও একটা গ্রহ আবিষ্কার করে বসলে একটা সংখ্যা দিয়ে দেন। গ্রহাণু ৩০৪০৮৩, একটা সংখ্যা দিয়ে হয়তো ঠিক নির্ণয় করা যায়। সেই রাজপুত্র তেমন একটা ছোট্ট গ্রহের বাসিন্দা। ছোট্ট রাজপুত্রের কথা ভাবলেই সুবলের আশ্চর্য সুন্দর মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠে।

সুতরাং সকাল হলেই টুকুন বুঝতে পারে—এই পৃথিবী কত সব ভারী মজার ব্যাপার নিয়ে বেঁচে আছে। এই পৃথিবীর মাটিতেই সাহারা মরুভূমিতে এক ছোট্ট রাজপুত্রের সঙ্গে লেখকের দেখা হয়ে গেছিল। বড়রা এ—সব বিশ্বাস করবে না। যেমন বড়রা বিশ্বাস করবে না, ছোটরা যদি ছবি এঁকে দিয়ে বলে, এই ছবিতে একটা বাঘ এঁকেছি, বাঘের মুখে হরিণ—ওরা বলবে, ধ্যৎ, তা হয় নাকি, এটা তো রহমৎ মিঞার গোঁফ হয়ে গেল। তা হয় কী করে! এই নিয়ে কথা কাটাকাটি করেও বড়দের বিশ্বাস করানো যাবে না—কখনও কখনও কোনও ছোট রাজপুত্র অন্য গ্রহাণু থেকে চলে আসতে পারে। টুকুন ভাবল, এসব কথা শুধু একজনকেই বলা যাবে—সে সুবল, সুবল শুনলে বলবে, হ্যাঁ দিদিমণি আমাদের ছিল একটা নদী, বড় নদী শুকিয়ে গেল—সে যেমন বলেছিল, দিদিমণি স্বপ্নে দেখেছি, আমরা চলে আসার পর জনার্দন চক্রবর্তী ফিরে গেছে নদীতে। যেখানে দিনমানে আমরা গর্ত করেছিলাম—সেখানে কী নির্মল জল। জলের ভিতর একটা হরিণ শিশু পড়ে গেছে।

সুবল যখন এমন বলে, তখন মনে হয় সব কিছু সত্যি হতে পারে। সে এলে গল্পটা বলা যাবে। বলা যাবে ছোট্ট রাজপুত্র বারবার একটা কথা কেবল বলেছিল, আমাকে একটা ভেড়ার বাচ্চা এঁকে দাও। মানুষটা কী করে তখন, সে বলেছিল, আমি ছবি আঁকতে জানি না।

ছোট্ট রাজপুত্রের এক কথা, দাও না আমাকে একটা ভেড়ার বাচ্চা এঁকে।

মানুষটা ভাবল ভারী বিড়ম্বনা। এমনিতে উড়োজাহাজটা বিকল হয়ে গেছে। সাত—আট দিনের মাত্র জল আছে এর মধ্যে, কিছু না করতে পারলে মরে যেতে হবে। তখন এমন ছোট্ট রাজপুত্র কী করে যে এখানে! সে বলল, ছোট রাজপুত্র আমি ছেলেবেলাতে একটা ছবি এঁকেছিলাম।

রাজপুত্র বলেছিল, তাই বুঝি?

—কিন্তু কী জান, আমি যা ভেবে আঁকলাম, তা সত্যি হল না।

—মানে?

—আমি একটা অজগরের মুখে হাতির ছবি এঁকেছিলাম।

—বাবা! বেশ তো!

—না, বেশ নয়?

—কেন নয়?

—কেউ বিশ্বাসই করল না ওটা অজগরের হাতি গেলার ছবি।

—ওরা কী বলল?

—ওরা বলল, ওটা একটা টুপি।

ছোট্ট রাজপুত্র হা হা করে হেসে উঠল। —বড়রা খুব অঙ্ক ভালোবাসে। অঙ্কের হিসাবে না মিললে ওরা বিশ্বাস করতে চায় না। যেমন দ্যাখো, বিশ্বাস করতে চায় না কেউ আমার বাড়ি একটা গ্রহাণুতে। কিন্তু লামারতিন নামে এক জ্যোতির্বিদ আবিষ্কার করেছিল—সেটা সতেরোশো বাইশের জানুয়ারির আটাশ তারিখ হবে, আমার গ্রহের নম্বর পর্যন্ত ঠিক করে দিয়েছিল…..

—কত?

ছোট্ট রাজপুত্র বলল, তিন আট সাত পাঁচ…ছোট রাজপুত্র বলতে থাকলে আর শেষ হয় না।

টুকুনের মনে হত সে নিজেই সাহারা মরুভূমিতে একটা ছোট্ট এরোপ্লেন নিয়ে নেমে গেছে এবং যা কিছু কথা সব তার সঙ্গে হচ্ছে।

এমন একটা সকালে যখন সে এসব ভাবছিল, এবং জানালা দিয়ে সুন্দর ফুলের সৌরভ ভেসে আসছিল, তখন ইন্দ্র এসে হাজির।

টুকুন বলল, ইন্দ্র, আজও সুবল এল না।

—আসবে।

—তুমি ওকে আমার ঠিকানাটা দিয়ে আসবে?

—ও কোথায় থাকে?

—তা জানি না। সে একটা দেবদারু গাছের নীচে শুয়ে থাকে জানি।

ইন্দ্র জানে টুকুনের এমনই কথা বলার ধরন। টুকুনকে আজ শাড়ি পরিয়েছে গীতামাসি। টুকুনকে খুব স্নিগ্ধ দেখাচ্ছিল। কিন্তু টুকুনের ভিতর কোনও লজ্জা নেই। সে তার শাড়ির আঁচল বুক থেকে ফেলে দিয়েছে। ইন্দ্র যে পুরুষ সেটা মনেই হয় না টুকুনের চোখ দেখে। ইন্দ্র বেশি সময় সঙ্গ দিতে পারে না। সে সুন্দর করে সেজে আসে। সে যতটা পারে সরু প্যান্ট জামা পরে এবং ওর ভিতর কিছু কৃত্রিমতা থাকে বলে টুকুনের ভারী হাসি পায়। সে কিছুতেই টুকুনকে ছুঁতে চায় না। টুকুন সে এলে ঠিক বান্ধবীর মতো জড়িয়ে ধরতে চায়—আর ইন্দ্র তখন কেমন করে, টুকুন তো এখনও ভালো করে হাঁটতে পারে না। তখন সব কিছু তার কাছে অর্থহীন হয়ে যায়। সে আর নড়তে পারে না খাট থেকে।

টুকুন ডাকল, ইন্দ্র কাছে এসো।

ইন্দ্র কাছে গেলে বলল, তুমি আমার হাত ধরো।

ইন্দ্র হাত ধরতে সঙ্কোচ করলে বলল, তুমি ইন্দ্র এমন কেন, সুবলকে যদি দেখতে, সে আমার জন্য সব করতে পারে। আমি ভালো হলে সুবলকে ঠিক নিয়ে আসব।

ইন্দ্র বলল, মাসিমা বলেছে আমরা আজ ‘চাঁদমামার সংসার’ দেখতে যাব।

—কোথায়?

—ছোটদের নাট্য—সংসদে।

—আমি যাব না।

—তুমি গেলে খুব আনন্দ পাবে টুকুন।

—আমার ভালো লাগে না।

মা এসে বললেন, খুব ভালো লাগবে। ইন্দ্র আর তুমি যাবে।

—আমার ভালো লাগে না মা। আমাকে কেউ ধরে নিয়ে যাবে, আমার এটা ভালো লাগে না।

—ডাক্তার বলেছে, তুমি ভালো হয়ে গেছ। এখন শুধু তোমাকে নিয়ে ইন্দ্র ঘুরে বেড়াবে।

ইন্দ্র বলল, আমি দেখেছি। খুব ভালো।

টুকুন বলল, ওসব বাচ্চাদের বই।

—না, সবাই দেখতে পারে। সবারই ভালো লাগবে।

—আমার এখন রোদ ভালো লাগে। বৃষ্টি অথবা ঝড়। আমার কখনও সূর্য ওঠা দেখতে ভালো লাগে। পাখিরা তখন আশ্চর্যভাবে উড়ে বেড়ায়। আমার কেন জানি মনে হয় সুবল তার দেশে চলে গেছে। সে রোদে বৃষ্টিতে অথবা ঝড়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে। কী সুন্দর যে তাকে লাগছে দেখতে! চোখ বুঝলে আমি সব টের পাই।

তবু ইন্দ্র বারবার চেষ্টা করল। এখন ইন্দ্রের কলেজ বন্ধ। সে এখানেই থাকবে। ইন্দ্রের জন্য নীচে একটা বড় ঘর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ইন্দ্রর সকালে একবার বিকেলে একবার আসার কথা। সবই ডাক্তারের পরামর্শ মতো হচ্ছে। যখন পাখিয়ালা সুবলকে মিসেস মজুমদার মাঝে মাঝে আসতে দিতে একেবারেই রাজি হলেন না, তখন আর কী করা। তবু তাঁর ধারণা, জীবনের ভিতরে এই বয়সে যে উদ্দামতা দেখা যায়, ইন্দ্রের শরীর থেকে মেয়েটা তার গন্ধ পেলে হয়তো বাছবিচার না করা এক আশ্চর্য গন্ধে এই পৃথিবীর কোনও এক সকালে সে বড় হয়ে যাবে। এবং পৃথিবীময় তখন সে মনোরম সংগীত শুনতে পাবে—যা সে কোনওদিন টের পায়নি, এত ভালো, এভাবে পৃথিবী ক্রমে তার কাছে আরও বড় হয়ে যাবে। সে তখন ছুঁতে পাবে চারপাশটা।

ইন্দ্র বলল, তুমি না গেলে আমি যাচ্ছি না।

টুকুন বলল, আমাকে শাড়ি পড়লে বড় দেখায়?

—খুব বড়।

—মা—র মতো লাগে?

—মাসিমার মতো লাগবে কেন?

—বা রে, শাড়ি পরলে মাসিমার মতো না লাগলে তবে শাড়ি পরা কেন?

—তোমাকে টুকুনই লাগছে। যুবতী টুকুন।

—বাঃ, আমি যুবতী হব কী করে, বলেই সে কেমন হতাশ মুখে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকল। ভীষণ অভিমান সুবলের ওপর। কী দরকার ছিল ট্রেনে দেখা হওয়ার! কী দরকার ছিল পায়ে হেঁটে গিয়ে দরজা খুলে দেবার! আমি বেশ তো মরে যাচ্ছিলাম। মরে যেতে আমার ভীষণ ভালো লাগছিল। সবার আগে মানুষের সব দুঃখ বুঝতে না বুঝতে চলে যেতাম তবে। তুমি কেন যে আমার শরীরে আবার প্রাণের সাড়া এনে দিলে! দিলে তো একেবারে ভালো করে দিলে না কেন। কখনও কখনও এত ভালো লাগে সবকিছু—আবার কখনও কেমন হতাশা। আমার কী আছে বল? ইন্দ্র আমার কাছে আসে দায়ে পড়ে। ও তো আমাকে ভালোবাসে না। আমার কিছু নেই। আমি এখনও বাচ্চা মেয়ে হয়ে আছি। ওর কেন আকর্ষণ থাকবে বল?

এভাবে কত সব ভাবনা এসে মাঝে মাঝে টুকুনকে ভীষণ অভিমানী করে রাখে—পাখিটাকে পাঠিয়ে দিতে পারছ না? সে আমার কত খবর নিয়ে যেত। আমার কত গল্পের বই আছে। সেখানে কতরকমভাবে সব মানুষ সমস্ত সৌরজগতের খবর নিয়ে বেড়াচ্ছে, আর তুমি তোমার পাখিটাকে পাঠিয়ে আমার খবরটুকু নিতে পারছ না!

টুকুন এখন দেখল ইন্দ্র আর নেই। এতবড় একটা সম্পত্তির ওপর ইন্দ্রের লোভটা সে কী করে যে টের পায়। ইন্দ্রের বাবা খুব খুশি। আগে এ বাড়িতে ওদের গলা সে কখনও শুনেছে মনে করতে পারে না এখন এ বাড়িতে ইন্দ্রকে নিয়ে আসায়—ওরা খুব আসে। বাবার মুখ দেখলে টের পায় টুকুন তিনি আর কাজে কোনও উৎসাহ পাচ্ছেন না। চারপাশ থেকে বাবাকে কারা যেন অক্টোপাশের মতো গিলে খাচ্ছে। কখনও কখনও এমন হয়ে যায় যে টুকুন ইন্দ্রকে একদম সহ্য করতে পারে না। কিন্তু স্বভাবে টুকুন ভারী মধুর। সে রাগ করে কেন জানি কথা বলতে পারে না। রাগ করে কথা বলতে পারলে সে কবে ইন্দ্রকে তাড়িয়ে দিত।

টুকুন বুঝতে পারে এভাবে একজন তরুণ বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারে না। সে যখন খুব বিনয় করে বলে, আমি আসি টুকুন, আবার পরে আসব—তখন টুকুনের ভারী হাসি পায়। কেন যে মিথ্যা অভিনয় করছে ইন্দ্র! ওর বলতে ইচ্ছা হয়, তোমাকে আর কখনও আসতে হবে না। তুমি আমার কাছে এসে কোনও উৎসাহ পাও না। উৎসাহ না পেলে কিছুই জমে ওঠে না। যদি সুবলকে দ্যাখো, দেখবে সে যে কোথাকার সব রাজ্যের ফুল ফল পাখির খবর নিয়ে আসছে।

সুতরাং ইন্দ্র চলে গেলে ঘর ফাঁকা। মা এসে কিছুক্ষণ পাশে বসে থেকে গেছে। গীতামাসি আসবে নানারকমের খাবার নিয়ে। সে একটা দুটো খাবে, বাকিটা খাবে না। তারপর ওর যা কাজ, জানালায় বসে মালিদের বাগানের কাজ দেখা। প্রতিটি গাছ ওর এত চেনা যে, এখন ইচ্ছা করলে সে যেন বলে দিতে পারে কোথায় ক’টা নূতন কুঁড়ি মেলেছে, কখন ফুল ফুটবে, ক’টা ফুল ক’টা গাছে ফুটে রয়েছে। ম্যাগনোলিয়া গাছে দুটো ফুল ফুটেছিল কাল। সাতটা কুড়ি। তিনটা ফুটবে ফুটবে ভাব। আগামীকাল তিনটা ফুল ফুটবে। আগে এইসব ভালো জাতের ফুল তুলে এনে ওর ঘরে নীল রংয়ের ভাসে সাজিয়ে রাখত গীতামাসি। কিন্তু সে বারণ করেছে, ফুলেরা গাছে থাকলে বেশি ভালো লাগে। ওরা যে কীভাবে ফোটে! কখনও কখনও রাত জেগে দেখতে ইচ্ছা হয়। সে এভাবে আজ পর্যন্ত একটা ফুলের কাছাকাছি যেতে পারল না। ফুল হয়ে ফুটে উঠতে পারল না। কান্নায় ওর গলা বুজে আসে তখন।

সুবল এলে বুঝি সত্যি সত্যি সে এবার ফুল হয়ে ফুটে উঠতে পারত। শরীরে তার নানারকমের ঘ্রাণ, সুন্দর সুন্দর সব ইচ্ছারা খেলা করে বেড়াত। সুবল এলে এইসব ইচ্ছা কেন যে জেগে যায়। এবং সে তখন যেন ইচ্ছা করলে ছুটতে পারে।

সে বলল, গীতামাসি আমাকে ছোট্ট রাজপুত্রের বইটা দাও তো।

টুকুন ‘বৈমানিকের ডায়রি’টা তুলে নিয়ে সেই ছোট্ট রাজপুত্রের গল্পটা পড়তে থাকল।

বৈমানিক লিখেছে, প্রতিদিন আমি তার গ্রহ, সেখান থেকে তার যাত্রা তার ভ্রমণ বিষয়ে খানিকটা করে জেনেছিলাম। এভাবে তৃতীয় দিনে বাওবাব গাছের গল্পটা জেনেছিলাম।

সেটাও আমার সেই ভেড়ার ছবি আঁকার কল্যাণেই জানতে পেরেছি।

কারণ দেখেছিলাম, ওর মুখে ছোট্ট সংশয়ের রেখা। সে যেন কী ভাবছে। কী যে ভাবছে আমি জানি না। চারপাশে বিরাট সাহারা, আমার কাছে আর পাঁচ দিনের মাত্র জল আছে। এর ভিতর উড়োজাহাজটাকে মেরামত করে নিতে না পারলে, আমি আর ফিরতে পারব না। আমার ছোট্ট বন্ধুটির সঙ্গে সারা মাস কাল বোধহয় এই মরুভূমিতেই ঘুরে মরতে হবে। আমি বললাম, কিছু বলবে?

—অনেকক্ষণ থেকে ভাবছি কিছু বলব, কিন্তু—

—কিন্তু কী?

—তুমি যে—ভাবে কাজ করে যাচ্ছ—

—হ্যাঁ কাজ করছি। না হলে দেশে ফেরা যাবে না।

—কিন্তু তুমি ঠিক জানো তো ভেড়ারা গুল্ম খায়?

—হ্যাঁ খায়।

—যাক বাঁচা গেল। কী যে ভাবনা হচ্ছিল!

আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না সে এমন বলছে কেন! আবার ছোট্ট রাজপুত্রের ভারী গলায় প্রশ্ন—ওরা বাওবাব খায়?

আমি হেসেছিলাম। এমন একটা প্রাণ—সংশয়ের ভিতর আছি, আর সে কিনা এমন সব প্রশ্ন করছে—ভেবে অবাক, বললাম—বাওবাব তো গুল্মজাতীয় গাছ নয়। তুমি যদি একপাল হাতি নিয়ে যাও এবং তার ওপর তোমার ভেড়াটাকে চাপাও, তবু বাওবাবের পাতার নাগাল পাবে না।

—আঃ। ছোট্ট রাজপুত্রকে খুব যেন চিন্তিত দেখাল। তারপর খুব জোরে হেসে নিল, তুমি একটা কথা জানো না, সব গাছই বড় হবার আগে ছোট থাকে। ছোট্ট থেকে বড় হয়।

—তাহলে তুমি বাওবাবের চারাগাছের কথা বলছ?

ছোট্ট রাজপুত্র কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে কী দেখল। আর একটা সংশয় যেন দানা বাঁধছে। প্রশ্ন করল, ভেড়া যদি গুল্ম খায় তাহলে বলতে হবে ফুলও খায়।

—ওরা যা পায় তাই খায়। আমাদের দেশে কথাই আছে, ছাগলে কী না খায়, পাগলে কিনা বলে!

—ছাগল ব্যাপারটা কী?

বুঝতে পারলাম ছোট্ট রাজপুত্র ছাগল ব্যাপারটা জানে না। আমি বললাম, সে এক রকমের ভেড়ার মতোই দেখতে জীব। এবং সঙ্গে সঙ্গে ওর চোখে আবার সংশয় ফুটে উঠছে। সে কিছু আবার প্রশ্ন করবে বুঝতে পারলাম।

—আচ্ছা যে ফুলের কাঁটা আছে—

—যে ফুলের কাঁটা আছে ওরা তাও খেয়ে নেবে।

তখন আমি খুব ব্যস্ত ছিলাম বিমানের কাজে। একটা লোহার ডাণ্ডা ভিতরে ঢুকে গেছে! ওটাকে বের করতে না পারলে শান্তি নেই। জলও ক্রমে আমার কমে আসছে। খুব শঙ্কিত ছিলাম এজন্য। পাশে ছোট্ট রাজপুত্রের একের পর এক প্রশ্ন। আর আশ্চর্য, কোনও প্রশ্নের যতক্ষণ পর্যন্ত জবাব না পাবে—একনাগাড়ে সে তা জানতে চাইবে। মনে মনে কিছুটা বিরক্ত। যা মনে আসছে তাই আবোল—তাবোল কিছু বলে সান্ত্বনা দেবার মতো বললাম, কাঁটা দিয়ে কিছু হয় না। ওগুলো আমার মনে হয় ফুলগুলির দুষ্টুমি।

ছোট্ট রাজপুত্র বলল, ও। তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর কেমন ভীষণ রেগে গিয়ে বলল, তোমার কথা মানি না। যা মনে আসছে বলে যাচ্ছ। ফুলেরা দুর্বল আর সরল বলে কাঁটা না থাকলে চলে না। ও—ভাবে কাঁটা আছে বলেই কারও কারও কাছে ওরা ভয়ানক।

কোনও জবাব দিচ্ছিলাম না। এতবড় একটা মরুভূমির মতো জায়গায় ছোট্ট রাজপুত্র আমার সঙ্গী। সে যদি আমাকে ফেলে চলে যায়—ভাবতেই গা—টা ভয়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। আমি তাড়াতাড়ি ডাণ্ডাটা খোলার জন্য খুব জোরে হাতুড়ি মারলাম। একেবারে ওটাকে উপড়ে আনতে চাইছি।

ছোট্ট রাজপুত্র ফের বলল, তুমি কী ভাব ফুলেরা—

—না না, আমি কিছুই ভাবছি না। কেবল আবোল—তাবোল বকে যাচ্ছি। আমার মাথাটা ঠিক নেই। তা ছাড়া দেখছ না দরকারি কাজে ব্যস্ত।

ছোট্ট রাজপুত্র আমার দিকে ভারী বিস্ময়ের চোখে তাকাল। বলল দরকারি কাজ! সে কী জিনিস আবার?

আমি কিছু বললাম না। আমার কিছু ভালো লাগছিল না।

হাতের আঙুলে, হাতুড়িতে তেল—কালি মাখা। বেয়াড়া একটা যন্ত্রের ওপর ঝুঁকে আছি সেই কখন থেকে। ছোট্ট রাজপুত্র আমায় কেবল এখন তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। এবং বুঝতে পারছিলাম ভীষণ রেগে যাচ্ছে। সে ফের বলল, তুমি বড়দের মতো কথা বলছ।

আমি কিছু বলছি না। এমন কী তাকাচ্ছিও না।

সে বলল, তুমি সব ভুলে গেছ, গুলিয়ে ফেলছ।

ছোট্ট রাজপুত্র এভাবে চটে যাচ্ছে। সে কোনও ছোট গ্রহাণু থেকে পাখিদের ডানার মতো একরকম কীসব লাগিয়ে এক গ্রহ থেকে অন্য গ্রহে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এখানে এসে এমন একটা বেরসিক লোকের দেখা পাবে বোধহয় আশাই করতে পারেনি। ওর সোনালি চুলগুলি কী যে মাখনের মতো নরম, ওর চোখ কী যে নীল—সে আর যেন আমার এই অবহেলা মোটেই সহ্য করতে পারছে না।

সে এবার একনাগাড়ে বলে চলল, একটা গ্রহের কথা জানি আমি। সেখানে ঘন লাল রংয়ের একটা লোক থাকে। কখনও একটা ফুল শুঁকে দ্যাখেনি। সে কোনওদিন সাদা জ্যোৎস্নায় হেঁটে বেড়ায়নি, আকাশের তারা দ্যাখেনি, কাউকে সে ভালোবাসেনি। সে একটা যোগ অঙ্ক ছাড়া কিছুই করেনি। সারাদিন তোমার মতো বলত, আমি ভারী ব্যস্ত মানুষ। আর অহঙ্কারে পা পড়ত না। একটু থেমে ছোট্ট রাজপুত্র দুহাতে বালি ছড়িয়ে দিতে দিতে বলল, সে কী একটা মানুষ! সে তো একটা ব্যাঙের ছাতা!

—একটা কী? হাতের সব কাজ ফেলে ওর মুখোমুখি দাঁড়ালাম।

—একটা ব্যাঙের ছাতা। রাগে ছোট্ট রাজপুত্র একেবারে সাদা হয়ে গেছে। ওর সোনালি চুল ছোট পাখির বাসার মতো বাতাসে যে কাঁপছে।

সে ক্রমান্বয়ে রাগে দুঃখে বলে চলল, লাখ লাখ বছর ধরে ফুলেরা কাঁটা তৈরি করছে। আর লাখ লাখ বছর ধরে ভেড়ারাও ফুল খেয়ে যাচ্ছে। যে কাঁটা কারুর কোনও কাজে আসে না, ফুলেরা তাই বানাতে গিয়ে এত কষ্ট করে কেন, সেটা জানা কী দরকারি নয়? এই যে লড়াই ফুলের সঙ্গে ফুলের কাঁটার, ভেড়ার সঙ্গে ফুলের—সেটা একটা যোগ অঙ্কের চেয়ে বেশি দরকার নয় জানার।

আর কথা বলতে পারছিল না ছোট্ট রাজপুত্র। কোনওরকমে ধীরে ধীরে বলছিল—কেউ যদি একটা ফুলকে ভালোবাসে, যে ফুল লক্ষ লক্ষ তারার ভিতর তাদেরই একটি হয়ে ফুটে আছে, এবং তখন যদি একটা ভেড়া ফুল খেয়ে ফেলে—আর যদি আকাশের তারারা সঙ্গে সঙ্গে নিভে যায় ভয়ে, তখন কী সেটা আমাদের জীবনে বড় সমস্যা নয়?

এবং এভাবে ছোট্ট রাজপুত্র আর কথা বলতে পারছিল না। হঠাৎ কেন যে ফুঁপিয়ে ওঠে কান্নায় ভেঙে পড়ল সে। রাত নেমে এসেছিল। যন্ত্রপাতি ফেলে এবার উঠে দাঁড়ালাম। এই মরুভূমির রুক্ষতা, সীমাহীন বালুরাশি, তৃষ্ণা, মৃত্যুভয়—সবই কেমন তুচ্ছ বলে মনে হল। কেন জানি মনে হল আমার গ্রহ এই পৃথিবীতে এক ছোট্ট রাজপুত্র চলে এসেছে—যার নিয়মকানুন সব আলাদা, যাকে আমায় সান্ত্বনা দিতে হবে। ওকে হাত বাড়িয়ে বুকে তুলে নিলাম। একটা ফুলের মালার মতো হাতের ওপর দোলাতে লাগলাম। তাকে সান্ত্বনা দিলাম, যে ফুল ভালোবাস তুমি, তার কোনো বিপদ হয়নি। তোমার ভেড়ার একটা মুখ—ঢাকা এঁকে দেব। আর তোমার ফুলের জন্য একটা বর্ম। আর ভেবে পেলাম না ওর হয়ে আমি আর কী বলব। বুঝতে পারছিলাম না তাকে কীভাবে আর শান্ত করব। কী করে তার মান পাব। চোখের জলের রাজ্যটি সত্যি বড় রহস্যময়।

টুকুন বুঝতে পারল না এভাবে বইটি পড়তে পড়তে সে—ও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে কেন। এ—ধরনের কান্না তার বুক বেয়ে কখনও উঠে আসেনি। সেই নির্বান্ধব ছেলেটি এখানে কোথায়! সে তার কাছে এলে যেন এখন বলতে পারত, আমরা এখানে থাকব না, সেই ছোট গ্রহাণুতে চলে যাব। তুমি আমি ছোট্ট রাজপুত্র একসঙ্গে থাকব। ওর ফুলকে পাহারা দেব।

এবং এভাবে টুকুন কখনও কখনও সন্ধ্যায় অথবা রাতে নিজের বিছানা থেকে বড় জানলা দিয়ে অন্ধকার আকাশ দেখতে থাকে। এবং সব উজ্জ্বল গ্রহ দেখতে দেখতে কোনও বিন্দুর মতো অনুজ্জ্বল কিছু দেখলেই মনে হয় বুঝি সেই গ্রহাণুতে ছোট্ট রাজপুত্র থাকে। সুবলকে নিয়ে সে যদি সেখানটায় যেতে পারত!

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *