টুকুনের অসুখ – দশ
সিস্টারের ভয়ে সুবল ক’দিন হল নার্সিংহোমের দিকে পা বাড়ায়নি। এই শহরে একমাত্র টুকুন দিদিমণিই ওর জন্য প্রতীক্ষায় বসে থাকে। তাকে দেখালে খুব খুশি হয়। এবং কেন জানি এ—ভাবে সুবলের কাছে টুকুন খুব আপনজন হয়ে গেল।
অথচ ভয়, সিস্টার তাকে নানাভাবে ভর্ৎসনা করেছে। সেদিন সিস্টারের চোখে কী এক কঠিন বিরক্তি দেখে সে আর যেতে সাহস পায়নি। তা ছাড়া অজিতদা ওকে অন্য একটা সুন্দর ব্যবসার কথা শিখিয়ে দিয়েছে। সে বড়বাজার থেকে চিনাবাদাম কিনে আনছে। এবং ফুটপাথে সে উনুন জ্বালিয়ে বেশ ভাজাভুজি রেখে বিক্রি করছে। সে এখানে এসে একটা ব্যাপার দেখে খুশি। দেশে থাকতে কী না ওরা অসহায় ছিল। এমন একটা সুন্দর দেশ পর পর ছ’বছর খরাতে শস্যবিহীন দেশ হয়ে গেল। তবু অন্যান্য বছর সামান্য বৃষ্টিপাতের দরুন কিছু ফসল হয়েছিল—এবার যে কী হল! দেশ ছেড়ে মানুষ পালাল। সে আর থাকে কী করে! ওর ইচ্ছা ছিল টুকুনদিদিমণিদের সঙ্গেই চলে যাবে। দিদিমণির মা—টা যেন কেমন। ঠিক সিস্টার যেমন মুখ করে রেখেছিল, দিদিমণির মা—টার তেমনি রাগী রাগী ভাব। সে ভয়ে ব্যান্ডেলে নেমে গেল। তারপর এক আশ্চর্য বিকালে এতবড় জানালায় দিদিমণিকে আবিষ্কার করে অবাক।
কিন্তু এখন সে এমন একটা কাজ নিয়ে ফেলেছে যে সে যেতে পারছে না। ওর জুতো—পালিসের সব কিছু অজিতদার বাড়িতে আছে। অজিতদার বউয়ের খুব সিনেমা দেখার স্বভাব। সে সুবলকে নিয়ে যেতে চায়। অথচ তার এসব ভালো লাগে না। সে সময় পেলে বরং টুকুনদিদিমণির কাছে চলে যাবে।
টুকুনদিদিমণির কাছে গেলেই তাকে নানারকম গল্প বলতে হয়। সে আজ যাবে ঠিক করেছে। চার—পাঁচদিন হয়ে গেল দিদিমণিকে না দেখে কেমন সে কিছুটা দুঃখী সুবল বনে গেছে। সকাল সকাল কলের জল থেকে স্নান করেই মনে হয়েছে, দিদিমণির সঙ্গে দেখা না হলে কাজে উৎসাহ পাবে না। সে তাড়াতাড়ি কিছুটা ভাজাভুজি বিক্রি করে নেবে, তারপর বিকেলে হাতে সে কোনো কাজ রাখবে না। আগে ওর খুব একটা ঝামেলা ছিল না। যখন খুশি চলে যেতে পারত। এখন পারে না। সে আগে হাতে তার জুতোর বাক্সটা রেখে দিত। এখন তার সম্বল একটা উনুন, একটা চট, একটা চালুনি, একটা কাঠের ট্রে, একটা ভাঙা কড়াই, কিছু বালি, এতগুলো দিয়ে যে যখন তখন যেখানে সেখানে যেতে পারে না।
সে আজ ভাবল, সব রেখে দেবে শেফালী বউদির কাছে। শেফালী বউদির রং কালো। কেবল গুন গুন করে হিন্দি গান গায়। সব সিনেমার গল্প এসে কাউকে না কাউকে বলা চাই। রাতের বেলায় সুবল গেলে তাকে বসিয়ে গল্প। এক কাপ চা খেতে দেয় তখন। কালো রংয়ের শেফালী বউদির খুব তাজা চোখ মুখ। এবং সবসময় পান খাবার স্বভাব। ছোট দুটো ঘর। তাই যতটা সম্ভব সুন্দরভাবে সাজিয়ে রাখে। কাগজের ফুল তৈরি করে নানা রংয়ে সাজিয়ে রাখার স্বভাব। এবং কারুকার্য করা ডিমের খোলা—কোনটা লাল রংয়ের, কোনটা হলুদ রংয়ের। পাশে একটা বড় পুকুর। জানালা খুললে পুকুরের জলে অনেককে নাইতে দেখা যায়। অজিতদা না থাকলে জানলা খুলে শেফালী বউদি কার জন্য মনে হয় জানলায় অপেক্ষা করে। সুবলের এটা কেন জানি ভালো লাগে না।
সুতরাং সুবল সব টুকিটাকি কাজ সেরে ফেলার সময় শেফালী বউদির কথা ভেবে কেমন সামান্য কষ্ট পেল। এই শহরে বড় একটা কষ্ট আছে সবার। যেমন অজিতদার, বউদির। ওদের কাছে যেন কিছু জিনিস খুব দুর্লভ। সেই দুর্লভ কিছু পাবার জন্য ওরা এমন করছে। ওর কাছে দুর্লভ বলতে টুকুনদিদিমণি। দিদিমণিকে দেখলেই ভিতরে সুবল প্রাণ পায়। সুবল দিদিমণির জন্য কী যে সুন্দর একটা খেলা শিখে ফেলেছে, আজ গেলে সেই খেলাটা দেখাতে পারলে খুব আনন্দ পাবে।
সে তার টুকিটাকি মালপত্র সব মাথায় করে এক সময় শেফালী বউদির ঘরের দিকে রওনা হল। সে যাবার সময় একটা সুন্দর সাজানো পান কিনে নিল। নিজে সে পান—টান কিছু খায় না। অজিতদা ওকে একদিন একটা বিড়ি দিয়েছিল খেতে। সে খেতে গিয়ে খক খক করে কেশেছে ভীষণ। সেই থেকে বিড়ি ব্যাপারটাকে ভীষণ ভয় পায় সে।
সে হাঁটছিল। তাকে খুব একটা দূরে হেঁটে যেতে হয় না। বড় রাস্তা থেকে কিছুদূর হেঁটে গেলেই গোলবাগান বস্তি। দুপাশে ছোট ছোট সব খুপড়ি ঘর, টিনের চাল। একটা হোমিওপ্যাথ ডাক্তারের ডিসপেন্সারি। তারপর একটা লোক দুটো লেদ মেসিনের দোকান নিয়ে সারাদিন কাজ চালিয়ে যায় এবং রোয়াকে চায়ের দোকান। একটা ছোট মুদি—দোকান, কলের জল পড়ছে এবং কলের পাড়ে ভীষণ ভিড়। সে এখানে এলেই সবাই ঝুঁকে পড়ে। সুবল তোর পাখিটা দেখি। দেখা না রে পাখিটা। কেউ কেউ একটা মাকড় ধরে এনে বলে, নে, এটা খাওয়া। সে জানে কোথায় কী বলতে হয়। সে মানুষকে আঘাত করতে জানে না। সে মিথ্যা কথাও বলতে জানে না, সে ইচ্ছা করলে বলতে পারে না, পাখিটা এখন আমার জেবে নেই। বললেই ওরা সরে যায়। কিন্তু বললে মিথ্যা কথা বলা হবে। সে কোনোরকমে তাড়াতাড়ি রাস্তাটা পার হয়ে যায় তখন। চৌকাঠে ঢুকে গেলে কেউ তখন আর বিরক্ত করতে আসে না।
শেফালী অসময়ে সুবলকে দেখে বলল, সুবল, এ—সব নিয়ে অসময়ে?
—একটু কাজ আছে বউদি।
শেফালী ওর মাথা থেকে এক এক করে টুকিটাকি জিনিস নামাতে নামাতে বলল, কোথায় যে রাখি!
—আজ রাখো, কাল সকালে নিয়ে যাব। তোমার জন্য একটা পান নিয়ে এসেছি।
—সুবল, তুমি আমাকে ভালোবাসো?
সুবল অবাক। বউদি তাকে ঠাট্টা করে কথাটা বলেছে। তবু কেমন যেন গা—টা শির শির করে উঠল। এই শহরে এলে মানুষ বুঝি সব কিছু একটু তাড়াতাড়ি শিখে ফেলে। সে বলল, তুমি পান খেতে ভালোবাসো। অজিতদা কোথায়?
শেফালী ঠোঁট উলটে বলল, জানি না।
—আজ আসেনি?
—না।
—কেন আসে না?
—একবার জিজ্ঞাসা কর না!
—না, খুব খারাপ বউদি। আমি ঠিক জিজ্ঞাসা করব। বলেই সুবল হেসে দিল।—তুমি ঠাট্টা করছ বউদি। দাদা ঠিক এসেছে।
—না রে! তোর সঙ্গে আমি মিথ্যা বলি না।
সুবলের মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। সে বলল, কোনও খবর নিয়েছ?
—ঠিক চলে আসবে। কোথায় খোঁজ করব বল? কোথায় যায় আমাকে বলে যায় না।
সুবল বুঝতে পারল, বউদি সত্যি কিছু জানে না। সে নিজেই একটা জলঢৌকি টেনে দিল। বসতে বসতে বলল একটু জল খাব।
শেফালী জল এনে দিলে বলল, কাল ক’টায় বের হয়েছে?
—রাতে।
—রাতে ক’টায়?
—বেশ রাত। যেন শেফালী ইচ্ছা করেই আর বেশি বলতে চাইছে না,—শেফালী সুবলকে মাঝে মাঝে রাজা বলে ডাকে। যদিও জানে রাজা খুব ভালো ছেলে। রাজার নতুন গোঁফ উঠছে বলে, খুব ভালো লাগে দেখতে। এই নতুন গোঁফ—ওঠা ছেলেদের খুব ভালো লাগে। রাজা আগে খুব নোংরা জামাকাপড় পরে থাকত। শেফালী ওকে কিছু কিছু ট্রেনিং দিয়ে বেশ এখন সাফসোফ রাখার ব্যবস্থা করেছে। আগে চুল ছিল বড় বড়। চুল কাটত না। ইদানীং চুল কাটছে। এবং বড় একটা শিখা ছিল মাথায়, সেটাও ছোট করে ফেলেছে। খুব খেয়াল না করলে বোঝা যায় না শিখাটা আছে মাথায়।
শেফালী বলল, সব ফেলে কোথায় যাচ্ছ?
—টুকুনদিদিমণির কাছে।
—তুমি যে বলেছিলে আর যাবে না? সিস্টার পছন্দ করে না।
সুবল বলল, আমার বউদি, আপনজন বলতে টুকুনদিদিমণি। ভেবেছিলাম যাব না। কিন্তু কাল থেকে মনটা টুকুনদিদিমণির জন্য কেমন করছে।
—কবে যেন গেছিলে?
—গত বুধবার।
—আর মাঝে যাওনি?
—না।
—টুকুন ঠিক জানলায় রোজ দাঁড়িয়ে থাকবে?
—জানি না বউদি। ওর মা আমাকে দেখতে পারে না। ওদের অসুবিধা হবে বলে একটা বড় স্টেশনে আমাকে নামিয়ে দিয়েছিল।
—ভীষণ খারাপ। বড়লোক হলে মানুষ ভালো হয় না। বড়লোকেরা খুব স্বার্থপর।
সুবল সে—সব কথায় গেল না। সে বলল, আসতে আসতে দেখলাম, একটা বড় গির্জার সামনে দুটো ছেলে ফুল বিক্রি করছে। বেশ ভালো কাজ।
—কেন, তুমি ফুল বিক্রি করবে নাকি?
—দাদা এলে জিজ্ঞাসা করব, কোথায় ফুল কিনতে পাওয়া যায়।
—এ কাজটা খুব ভালো হবে। তোমার খুব সুন্দর মুখ রাজা। তুমি যদি ফুল বিক্রি করো তবে লোকে অনেক ফুল কিনবে।
—সত্যি কিনবে?
—সত্যি। প্রথম দিনের একজন খদ্দের তুমি আমাকে পাবে।
—আমি তোমাকে এমনি দেব।
—তবে তোমার ব্যবসা হবে কী করে রাজা?
—একটা ফুল দিলে ব্যবসা নষ্ট হয় না। যখন চিনাবাদাম ভেজে বিক্রি করি, কেউ কেউ দুটো একটা এমনি খায়। খেয়ে পছন্দ হলে নেয়। তুমিও আমার তেমন।
—আমার একটা ফুলে কিছু হবে না রাজা। একটা ফুল দিয়ে মালা গাঁথা হয় না।
—কত ফুল লাগবে?
—একগুচ্ছ।
—তাই নেবে!
—না রাজা, এমনি নেব না।
—তাহলে কী করতে হবে?
—সে পরে বলব। বলেই শেফালী বলল, যাও, আপনজনের কাছে যাও।
সুবল এতক্ষণে মনে করতে পারল সে টুকুনদিদিমণিকে একমাত্র আপনজন বলেছে। সে বউদির ঠাট্টাটা ধরতে পেরে বলল, তোমার নিজের লোক। অজিতদা কত ভালো লোক।
—ভালো লোক না ছাই!
—তুমি কেবল বউদি অজিতদার নিন্দা কর। দাদা এলে বলে দেব।
—বলে দ্যাখ না যদি একটু রাগ করে। লোকটার রাগ অভিমান বলতেও কিছু নেই। যা খুশি করবে। মান—সম্মান বুঝবে না। অপমান বলতে কিছু নেই।
সুবল দেখল কথা অন্যদিকে যাচ্ছে। সে উঠে পড়ল। সে একটা বল নিয়েছে হাতে। শেফালীর ইচ্ছা সুবল আর একটু বসুক। এখন এই বিকেলটা শেফালীকে বড় একা একা কাটাতে হবে। এখানে এ ঘরের কেউ দেখতে পাচ্ছে না সুবলকে সামনে নিয়ে বসে রয়েছে। সুবল এলেই মনের ভিতর একটা অদ্ভুত রহস্য খেলা করে বেড়ায়। ওর নরম চুল এবং চোখ দেখলে যেন কোনও আর দুঃখ থাকে না। বেশ জড়িয়ে ধরে ছেলেটাকে চুমু খেতে ইচ্ছা হয়। এবং সুন্দর করে সাজানো পুতুলের মতো অথবা সে যে—সব সিনেমায় নানারকমের কল্প—কাহিনী দেখে তেমনি সব কল্প—কাহিনীর বাসিন্দা হতে ইচ্ছা হয়। সুবলকে না দেখলে তার এমন বুঝি হত না।
শেফালী বলল, পাখিটার খেলা আজ দেখালে না?
সুবল বুঝতে পারছিল, কিছু না কিছু বলে তাকে আটকে রাখছে। সে বলল, আজ আমার একটু তাড়া আছে। বলে সে বারান্দা থেকে নেমে চৌকাঠ পার হয়ে রাস্তায় নামল।
সুবলের বেশ ভালো লাগছিল হাঁটতে। সে সাফসোফ হয়ে যাচ্ছে। জামা পাজামা সব ধবধব করছে। সে কলের পাড়ে এসব গতকাল কেচে নিয়েছিল। পয়সা হলে সে আরও দুটো ঢোলা পাজামা পাঞ্জাবি করে নেবে। একটা টিনের স্যুটকেস কেনার খুব বাসনা। একটা টিনের স্যুটকেস কিনে ফেলতে পারলেই সে সব কিছু অতি প্রয়োজনীয় যা আছে স্যুটকেসের ভিতর রেখে দেবে। আর কেন জানি মাঝে মাঝে টুকুনদিদিমণিকে চিঠি লিখতে ইচ্ছে হচ্ছে।
আর মাঝে মাঝে আর একজন মানুষকে তার চিঠি লিখতে ইচ্ছা হয়। সেই যে কাপালিকের মতো মানুষ জনার্দন চক্রবর্তী। যিনি তাদের নিয়ে শেষ চেষ্টা করেছিলেন জল আবিষ্কারের। এবং তিনি পাহাড়ের ওপর কোনও ঋষি পুরুষের মতো দাঁড়িয়েছিলেন। হাতে একটা লাঠি। নদী পাহাড় খাত ভেঙে উপত্যকার ওপর দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে। যদি নদীগর্ভে চোরা স্রোত থাকে, সেজন্য তিনি সব মানুষদের, যারা আর অবশিষ্ট ছিল, শেষ পর্যন্ত মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে চেয়েছিল, তাদের নিয়ে শেষ চেষ্টা। দূরে দূরে সব এক একজন করে মানুষ ক্রমান্বয়ে দিনমান বালি খুঁড়ে চলছিল—জলের আশায় মানুষের এমন মুখ—চোখ হয় সুবল এখন চিন্তা করতেই পারে না।
সারাদিন কেটে গিয়েছিল, রাত নেমে এসেছিল, না, কোথাও জল নেই। মানুষটিই তাদের অনেকদূর হাঁটিয়ে, প্রায় ক্রোশ—দশেক হাঁটিয়ে নিয়ে গিয়েছিল—এবং ট্রেন আটকে দিতে বলেছিল। জল লুটেপুটে খেতে বলেছিল। এখন মানুষটা কেমন কে জানে! চিঠি দিলে সেখানে আর কে যাবে। কে আর পৌঁছে দেবে।
মনের ভিতর মানুষটার মুখ—চোখ, আলখাল্লার মতো পোশাক, এবং দিনমানে সে হয়তো অন্নহীন হয়ে সুবচনি দেবীর মন্দিরে পড়ে আছে। এমন মানুষ সে কোথাও দেখেনি। এই একমাত্র মানুষ যার বিশ্বাস ছিল দেবী কখনও না কখনও সুপ্রসন্না হবেন। এবং কোনও পাপ মানুষকে এভাবে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। সেই পাপের খণ্ডন কী কোনও এক অলৌকিক উপায়ে করতে চেয়েছিলেন। এবং মানুষেরও তেমন একটা বিশ্বাস ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত চোখের ওপর দেখেছেন দেবীর মহিমা কী ভাবে বার বার মিথ্যা প্রতিপন্ন হচ্ছে। সংসার আর সুজলা—সুফলা হচ্ছে না। সুবলের সেই মানুষটার জন্য মাঝে মাঝে দুঃখ হয়। ওকে ফেলে চলে এসে সে যেন ঠিক কাজ করেনি। খুব স্বার্থপরের মতো ব্যাপারটা হয়ে গেছে।
সুবল দেখল সে ভাবছে বলে খুব একটা এগোতে পারছে না। অন্যমনস্ক হয়ে গেলে সে কেমন ঝিমিয়ে হাঁটে। সেই গির্জাটা পার হয়ে যাচ্ছে সে। গির্জায় বাঁশ বেঁধে রং করছে। গেটে একজন লোক বসে রয়েছে। ভিতরে বড় কারখানা। কাচের বাক্স করে নিয়েছে একটা লোক। তার ভিতরে বসে ফুল বিক্রি করছে। লোকটার কাজই সবচেয়ে ভালো। মানুষের শেষদিনে মানুষকে ফুল দিয়ে সাজিয়ে দিচ্ছে।
অথবা সুবলের ইচ্ছা হয় মাঝে মাঝে এমন সব গির্জায় কেবল রং করে বেড়ায়। অথবা মন্দিরে। মসজিদে, মসজিদে কারুকাজ করা যেসব পাথর আছে তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছা হয়। মানুষের সুখদুঃখ ব্যাপারটা সুবলকে খুব ভাবায়!
অথচ এর ভিতর টুকুনদিদিমণির মুখ উজ্জ্বল হয়ে আছে। সে খুব দ্রুত হেঁটে যাচ্ছে। গাছের মাথায় সূর্যের আলো। এবং সব সুন্দর সুন্দর ছেলেমেয়েরা পার্কে খেলা করে বেড়াচ্ছে। দোকানগুলোতে মানুষের ভিড়। কী পোশাক, কী সুন্দর সব মানুষ! কোনও অভাব—অনটন নেই। শেফালীবউদি খুব সুন্দর পোশাক পরে যখন সিনেমায় যায়, তখন ওর তাকিয়ে থাকতে খুব ভালো লাগে। সব মানুষগুলোই সেজে—গুজে কেমন সুন্দর সুসজ্জিত হয়ে থাকে। এমন পরিপাটি পোশাক, মুখ—চোখ, সে তার গ্রামে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। মানুষ এ—ভাবে সুখে পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে পারে সে কল্পনাও করতে পারেনি। খুশিমতো আলো জ্বেলে নেয়। জল তুলে নেয়, রাস্তা পার হয়ে যায়, হুস—হাস গাড়ি চলে যায়, বাজারে বাজারে প্রচুর শাকসবজি মাছ মাংস! ওর একবার মনে আছে গ্রামে মাংস হবে। গোবিন্দ বণিক একটা পাঁঠা কিনে এনেছিল। বাবা কী করে পাঁচসিকা পয়সা সংসার খরচ থেকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন দুর্দিন এলে খরচ করবেন। কিন্তু বণিক সেই পাঁঠাটা কাটলে বাঁশতলায় কী ভিড়! বাবাও লোভে পড়ে পাঁচসিকার মাংস কলাপাতায় কিনে এসেছিলেন। সেবারই শেষ মাংস খাওয়া। তবে বাবা মাঝে মাঝে পাখি ধরে আনতেন। ওরা পাখির মাংস খেত। মা খুব পাখির মাংস খেতে ভালোবাসত বলে বাবা অনেকদিন খুব রাত থাকতে পাহাড়ে চলে যেতেন। বালিহাঁসের ডিম, ডিম না হয় হাঁস ধরে আনতেন।
সুবলের ধারণা ছিল পাখি ধরা খুব সহজ কাজ। কিন্তু বাবা প্রায়ই কিছু আনতে পারতেন না। মা রাগ করে কিছুই না খেয়ে থাকত। এমনিতে না খাওয়া ছিল তাদের অভ্যাস, আর একটু চাল— ডাল হলেই মা মাংস দিয়ে ভাত খেতে চাইত। বাবার ওপর রাগ করে মা—টা তার মরে গেল।
সুবলের এখন ধারণা হয় বাবা উদ্যমশীল ছিল না। যেমন সে—ও খুব নয়। কোনওরকমে দিন চলে গেলেই হল। কিন্তু এখানে এসে সে নানাভাবে দেখছে খুব সহজে দিন চলে গেলে জীবনের কোনও মানে থাকে না। চারপাশে এত প্রাচুর্যের ভিতর সে কতদিন আর ফুটপাথে দিন কাটাবে। ওর একটা ঘর না হলে চলছে না। সে ভাবল, বলবে টুকুনদিদিমণিকে, আমি আর গাছতলায় থাকব না। আমাকে একটা ঘর বানিয়ে নিতেই হবে।
সুবল রাস্তায় কত কিছু ভাবতে ভাবতে হাঁটছে। শহর ধরে হাঁটলেই যেন এমন হয়। অথচ খারাপ দিনগুলোতে সে একটা ভাবনাই ভাবত, জল কোথায় পাবে? জল পেলে কখনও পাহাড়ে যা সব লতা মূল ছিল, যেমন পেস্তা আলোর গাছ, এবং তার মূল অথবা ফল কিছু সিদ্ধ করে খেলে কোনওরকমে তাদের দিন চলে যেত। জল যে কী দুর্লভ ছিল! এখন এই শহরে এটা ভাবতে পর্যন্ত হাসি পায়। জলের জন্য তারা প্রাচীনকালের মানুষদের মতো নদীগর্ভে এক এক করে মাইলের পর মাইল বালি তুলে মানুষ—সমান গর্ত করেও যখন দেখল নদীর চোরাস্রোতে পর্যন্ত জল নেই, তখন যার যেদিকে চোখ যায় সেদিকে চলে যাওয়া যেন।
অথচ এখানে এসে আর জলের কথা মনে হয় না। সে চারপাশে দেখে নানা আকর্ষণ। সকাল হলে গাছে তেমন পাখি ডাকে না, অথচ আকাশ নীল, ট্রামলাইনের তার নীল সুতোর মতো অজানা রহস্য হয়ে যায়। কত দূরে এই সব ট্রামলাইন চলে গেছে সে জানে না। পয়সা হলে সে একদিন সারাদিন ট্রামে চড়ে ঘুরবে। শহরে বড় রাস্তায় কখনও কখনও গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলে সে হেঁটে যেত। আশ্চর্য নিস্তব্ধতা। এবং দুটো একটা গাড়ি গেলে মনে হত এক বড় মাঠের ভিতর দিয়ে একা একা সে হেঁটে যাচ্ছে। কেউ তার পাশে নেই। তাকে ঠিক পথ চিনে মাঠ পার হয়ে যেতে হবে।
এত সব ভাবতে ভাবতে সে দেখল এক সময় দূর থেকে টুকুনদিদিমণির জানলাটা দেখা যাচ্ছে। সে এবার প্রায় রাস্তা ধরে ছুটতে চাইল। কারণ সে দেখতে পাচ্ছে, ঠিক স্পষ্ট নয়, এখনও স্পষ্ট নয়, তবু মনে হচ্ছে জানলাটা বন্ধ। এখন শরৎকাল। আকাশে নানা বর্ণের মেঘের খেলা। কখনও বৃষ্টি, কখনও নির্মল আকাশ। অথচ এ—সময় জানালা বন্ধ। টুকুনদিদিমণি কখনও জানালা বন্ধ করে না। ওর মনে হল হয়তো ক’দিন ওকে আসতে না দেখে হতাশায় জানলা বন্ধ করে দিয়েছে।
ওর খুব খারাপ লাগছিল। সে কেন যে এল না, কেন যে সিস্টারের ওপর অভিমান করে এল না! যদি অন্য কিছু হয়, যদি টুকুনদিদিমণির ছোট পাখির মতো আত্মাটা উড়ে চলে যায়! এসব মনে হতেই কেমন ওর বালকের মতো বুকভরে কান্না উঠে আসতে চাইল। সে বলল, দিদিমণি, এবার থেকে ফের আগের মতো রোজ আসব। আমি এসেছি।
কিন্তু সে গিয়ে যা দেখল—সত্যি অবাক, জানলা বন্ধ। সেখানে কেউ আছে বলেও মনে হয় না।
সুবল পাগলের মতো জানলায় শব্দ করতে থাকল।
সহসা জানলা খুলে, প্রায় পাঁচ সাতটা মানুষ ওকে তেড়ে এল। সে ওদের কাউকে চেনে না। ওরা সবাই একসঙ্গে মুখ খিঁচিয়ে আছে।
তবু এরই ভিতর সে যা দেখল, একজন খুব মোটামতো মানুষ বিছানায় বসে আছে। ওর পাশে একটা নলের মতো কী যেন। মাঝে মাঝে দুটো সরু হলুদ রংয়ের নল সে টেনে নিয়ে দরকার হলে নাকে দিচ্ছে আবার খুলে রাখছে। মোটা গোঁফ লোকটার। সুবল ওদের তবু বলল, আমার টুকুন দিদিমণি এ—ঘরে ছিল। আমি ওকে দেখতে এসেছি।
লোকগুলো কোনও কথা বলল না। মুখের ওপর জানলা বন্ধ করে দিল।