টি ভিং মনোরমাং
ঘরেতে ভ্রমর এলে কী হয়? গুনগুনিয়ে ওঠে।
ঘরে টেলিভিশন এলে কী হয়? প্রথমে ছাদের মাথার ওপর ফাঁক ফাঁক চিরুনির মতো একটা বস্তু শূন্যাকাশে গৃহস্বামীর অহংকারকে বারোমাস চিতিয়ে রাখে। ইদানীং শহরে টিভির সংখ্যা বেড়েছে। বছরে বছরে বাড়ছে। একটা সময় ছিল যখন মহল্লার দুটি-একটি বাড়ির ছাদেই। অ্যান্টেনা শোভা পেত। সেই সময় জনৈক ভদ্রলোক তাঁর বাড়ির নিশানা আমাকে এইভাবে দিয়েছিলেন, বাস থেকে নামলেন। নেমেই নাকের সোজা দু-কদম হাঁটলেন। বাঁ-দিকে ঘুরলেন। সোজা রাস্তা ধরে এগোচ্ছেন, প্রথম ডান দিকের রাস্তায় ঢুকে আকাশের দিকে তাকালেন। ব্যস, আমার বাড়ি দেখতে পেয়ে গেলেন। কাউকে জিগ্যেস করার কোনও প্রয়োজন নেই। অ্যান্টেনা লক্ষ করে চলে আসুন, চলে আসুন। আসছেন, আসছেন। এসে, এসে গেলেন। এরিয়েলের ফিতে কার্নিশ ঘেঁষে, ঝুলবারান্দা টাচ করে নীচে নেমে এসেছে। কলিংবেল টিপলেন। কুকুরের ঘেউ ঘেউ শুনলেন। অ্যালসেশিয়ান। ডাক শুনলেই বুঝবেন। কয়েক সেকেন্ডে অপেক্ষা করলেন। ম্যাজিক আই দিয়ে চট করে একঝলক দেখে নিয়েই দরজা খুললুম। আমি আপনার সামনে। নো প্রবলেম। রোববার সন্ধের মুখে তাহলে চলে আসুন। টিভিতে সিনেমা-টিনেমা দেখে রাতের আহার করে চলে যাবেন। নো প্রবলেম। ও তল্লাটে আর কোনও বাড়িতে টিভি নেই। দ্যাট ইজ দি ওনলি হাউস।
সেই ওনলি হাউসে গিয়ে আমি শুধু অ্যান্টেনাই দেখিনি, সেই বায়ুপক্ষে একটি ঘুড়িকেও আটকে থাকতে দেখেছিলুম। অহংকারে যেন ন্যাজ বেরিয়েছে। তা হলে টিভি এলে প্রথমে কী হয়? ছাদে পাইপের পাঁচটা আঙুল জানান দিতে থাকে আমার আছে। আমি অর্ডিনারি ক্লাস নই, টিভিক্লাস। ঘুড়ির সিজনে একটি ঘুড়ির মৃতদেহ সেই আঙুলে ধরা পড়ে লাট খেতে থাকে। দিনের বেলায় কাক বসে গলা সাধে। মাঝেমধ্যে গোলাপায়রা সপরিবারে বসে সাংসারিক কথাবার্তা বলে। বিশ্রম্ভালাপ করে। বাসা বাঁধার ঋতুতে কাক প্রাণপণ চেষ্টা করে ঠোঁটে করে এরিয়েলের তারের খানিকটা কেটে নিয়ে উড়ে যেতে।
এরপর কী হয়! ঘরের শোভা বাড়ে। চারটে ঠ্যাঙের ওপর লম্বাটে একটি বাক্স। যে মডেলই হোক। ঝকঝকে সুন্দর। সামনে তালশাঁস রঙের ছলছলে কাচের পরদা। সন্ধ্যায় যার ওপর ভেসে ওঠে চাঁদপানা সব মুখ, আলোর অবয়বে। ভালো করে তাকালে স্পষ্ট হয়ে ওঠে পশ্চাৎপটে আলোর। রেণু ঝরে ঝরে পড়ছে। আলোকের ওই ঝরনা ধারায় ঘণ্টা তিনেক কত কিছুর বিচিত্র অবগাহন। বিরাটকায় ফড়িং-এর মতো ওই যন্ত্র-বিস্ময় একটি কোণ জুড়ে মহামান্য অতিথির মতো সারা দিবস নিদ্রার পর সন্ধ্যায় আঁখি মেলেন। চিচিং ফাঁক। মহতের সঙ্গে থাকলে অন্যেও মহৎ হয়। ঘরের অন্যান্য আসবাবপত্রের অঙ্গরাগেও সামঞ্জস্য আনতে হয়। গ্রিলে রং। জানলা-দরজার। চেহারা ফেরানোর প্রয়োজন দেখা দেয়। ভাঙা টেবিল, ত্রিভঙ্গ চেয়ার বিদায় নেয়। ডিভান আসে সেজেগুঁজে। শেড লাগানো সারস-বাতি! দেয়ালের পরিচয্যা হয়। পর্দার চাকচিক্য বাড়ে। তেনার কল্যাণে ঘর হেসে ওঠে। বাড়ির টিভিরুম। তা হলে কী হয়? কিছু খরচা হয়। কিছু খরচ লেগেই থাকে। সরকারি দপ্তর হলে বলা হত—ডেভেলাপমেন্ট এক্সপেনডিচার।
আর কী হয়? নিজের ভেতর থেকে একটা চৌকিদার বেরিয়ে এসে অন্যের শান্তি নষ্ট করে দেয়। মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী বয়স্ক মানুষ বলেছিলেন, ওটা তুমি রিটায়ার করার পর কিনলেই পারতে মধু। বাড়িতে সব পড়ুয়া ছেলে-মেয়েরা রয়েছে। সামলাতে পারবে? খুব পারব জ্যাঠামশাই। এখন তাই সন্ধেবেলা গৃহাঙ্গনে খেটে লাঠি হাতে মেজর রুডলফ রেডফোর্ডের মতো পাহারাদি করতে হয়। হাই কম্যান্ডের হুকুম ছাড়া ভোলা চলবে না। রাশন করে আমোদ ছাড়তে হবে। আজ একটু খেলা আছে। বেশ একটু হোক। সামান্য সংগীত। আচ্ছা সামান্য সংগীত হোক। একটা ইন্টারভিউ, শিক্ষামূলক। শিক্ষামূলক? বেশ হয়ে যাক। আজ মধ্যরাতে একটু বাংলাদেশ ধরার সাধনা? হয়ে যাক সাধনা। এসো হোল ফ্যামিলি লেগে যাই। অতঃপর কী হয়? শনিবার বাড়ি ঢোকা বন্ধ হয় আর রবিবার সন্ধেটা বাইরে কোথাও কাটিয়ে আসতে হয়। শনিবার বাংলা। সিনেমা। মেঝেতে পুরু জাজিম। প্রথম সারিতে বৃদ্ধাদের আসন। চোখে চালসে। পর্দার একটু কাছাকাছি না থাকলে মুখপোড়াদের মুখ দেখা যায় না, ঢংয়ের কথাও শোনা যায় না। যদি বলা হয়, ও ঠাকুমা চোখের বারোটা বেজে যাবে যে, সঙ্গে সঙ্গে কড়া উত্তর, চোখ থাকলে তো বারোটা বাজবে বাবা। চোখের মাথা খেয়ে বসে আছি। দ্বিতীয় সারিতে গ্যাঁট্টা-গোঁট্টা বউমারা। আশেপাশে তাঁদেরই কুঁচোকাঁচারা। থইথই অবস্থা। বাড়ির আসল বাসিন্দারা ভয়ে ভয়ে সব কোণের ঘরে ঢুকে বসে আছে। বাড়ি হাতছাড়া। কিছু বলার উপায় নেই। বললেই সমালোচনা হবে। ওঃ, ব্যাটার খুব অংহকার হয়েছে। ধরাকে সরা জ্ঞান করছে। দেখব অহংকার কতদিন থাকে। অত বড় বলী রাজারও অহংকার টেকেনি! অতি দর্পে হত লঙ্কা। উলটে তাঁরাই বলেন। পাশেই রান্নাঘরে হয়তো কাপ-ডিশের শব্দ হল অমনি তাঁরা বলে উঠলেন, আস্তে আস্তে। তোমার হাত পা বড় চঞ্চল বউমা। ঠিক আমার মেজো বউটির মতো। বাথরুমে সামান্য জল পড়ার ছরছর শব্দ হয়েছে অমনি ধমক শোনা গেল, কলটা আবার এ সময় কে খুললে গা? ঠাকুমা, বাথরুমে। আপনার ছেলে অফিস থেকে ফিরে হাত-পা ধুচ্ছে। একটু পরে ধুলেই তো হয় মা। সব কিছুর একটা হিসেব থাকা চাই। মুখপোড়ারা যখন হড়ং বড়ং করে খবর পড়ে তখন হাত-পা ধুলেই হয়। আমরা যখন সংসার করেছি তখন কত হিসেবে চলতুম। কী বলো সরো! ওই হিসেবের জন্যে আমার কম নাম ছিল? কত্তা যখন খাবি খাচ্ছে তখন অন্য কেউ হলে চিল্লে বাড়ি মাথায় করত। আমি জানতুম কারুর মরার সময় চেঁচাতে নেই। কত্তো হিসেব। দাঁতে দাঁত চেপে রইনু। আর সহ্য করতে না পেরে বউদের মধ্যে থেকে একজন বলে উঠলেন, ঠাকুমা, চুপ করবেন? ঠাকুমা ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, আ মর। আমি চুপ করব কী কথা বলব, তুমি বলার কে? আমি চুপ করব না। তোমার বাড়ি? যার ধন তার ধন নয় নেপোয় মারে দই। ব্যস, লেগে গেল দক্ষযজ্ঞ!
শনিবার সন্ধের সময় এক কাপ চা চাইলে পাওয়া যাবে না। চা তৈরি করে রান্নাঘর থেকে বেরোনো যাবে না। সকলের চোখে পড়ে যেতে হবে। চক্ষুলজ্জা। সেটা কি ভালো দেখায়! সকলের সামনে তুমি একা চা খাবে? চারখানা ফুলকো লুচি, সঙ্গে আলুভাজা। সর্বনাশ! গন্ধ বেরোবে না। একে মা মনসা তায় ধুনোর গন্ধ! গ্রহণ লাগার আগে বা পরে যেমন খেয়ে নিতে হয়, প্রাকৃতিক কর্ম সেরে নিতে হয়, সেইরকম শনি আর রবিবার এই দুটো দিন বাড়িতে গেরোন। লেগেছে ভেবে সময়ে সব সেরে নিয়ো। আর হ্যাঁ, একটা পানিপাঁড়ে এই দুদিনের জন্যে ব্যবস্থা করতে পারলে ভালো হয়। ছবি মিইয়ে এলেই ভীষণ জলতেষ্টা সব। ঘন ঘন জল সাপ্লাই দিতে গিয়ে গেরস্থ কাত। কত্তা ভুল করে ওপাশের টেবিলে চশমা রেখে এসেছেন। এখন প্রয়োজনে। আর আনতে পারা যাবে না। কে যাবে টপকে টপকে! চোখ বুজিয়ে অন্ধকার বারান্দায় বসে ধ্যান করো। চশমা মিলবে রাত সাড়ে নটার পর।
তারপর কী হয়? অবিশ্বাসীও অদৃষ্ট বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। স্ত্রী আর টিভি—দুটি বস্তুই বরাতে লেগে গেল তো গেল, নইলে বংশদণ্ড। এর চেয়ে বড় বাঁশ আর কিছু নেই। গোমড়ামুখো পত্নী আর অবাধ্য টিভি সমান ক্লেদায়ক। মনমেজাজ খারাপ করে দেয়। গৃহিণী গৃহমুচ্যতে, টিভি টুপি উচ্যতে। হয় মাথা উঁচু করিয়ে দেবে, নয়তো নত করে দেবে। সেই কারণে ডিলার দেখা হলেই ভয়ে ভয়ে জানতে চান, কেমন চলছে? নো ট্রাবল? ক্রেতা যেই উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, ও ফাইন। কী রিসেপশান! অভিজ্ঞ ডিলার অমনি ভয়ে ভয়ে বললেন, আস্তে মশাই, আস্তে। বলবেন না বলবেন না। যেন টিভি আর অদৃষ্ট এখুনি শুনে ফেলে বিগড়ে বসে থাকবে। পাগলা সাঁকো নাড়াসনি গোছের অবস্থা।
তপনবাবুর টিভি। আর সূর্যবাবুর ছেলে। এর চেয়ে ভালো উদাহরণ পাড়ায় আর কী আছে। এ বলে আমায় দেখ, ও বলে আমায় দেখ। দুটোই ডেলিকোয়েন্ট। তপনবাবুর টিভির প্রথম থেকেই নানা ব্যামো। তিনি প্রথম দিনেই একবার চোখ খুলেই সেই যে ধ্যান-নেত্র হলেন, হাজার খোঁচাখুঁচি করেও সে ধ্যান ভাঙানো গেল না। পর্দার ওপর দিকে দুটো ঠ্যাং, টেবিলের পায়া, সুন্দরীর চিবুক এইসব দেখা যেতে লাগল। যেন ত্রিশঙ্কু কা খেল। এক্সপার্ট এসে বললেন, ভোলটেজের ভোজবাজি। স্টেবিলাইজার পালটাও। টিভি তখন পুরো চোখ খুললেন। শুরু হল নতুন খেলা। ছবি পেছলাতে লাগল। মনে হল রেলগাড়ির জানালায় বসে শোন ব্রিজের ওপর দিয়ে যেতে যেতে দৃশ্য দেখছি। চোখের সামনে দিয়ে যেন ভেনিশিয়ান ব্লাইন্ড নেমে যাচ্ছে। কার ক্ষমতা থামায় সেই চলচঞ্চল অধোগতি। ভার্টিক্যাল হোল্ড করতে করতে ভার্টিগো হয়ে গেল। চোখে এমন ধাঁধা লেগে গেল তপনবাবু রাস্তায় বেরিয়েও ধরো বলে চিৎকার করে ওঠেন। সমগ্র বিশ্বসংসার যেন হড়কে হড়কে নীচের দিকে নেমে যাচ্ছে। সে রোগ সারল তো এল আর এক রোগ। টিভি একই সঙ্গে ধমকাতে এবং চমকাতে লাগল। তপনবাবু এখন ফ্যালফ্যাল চোখে রাস্তায় হাঁটেন, বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকেন ছুটির দিনে। পরিচিতজন পাশ দিয়ে গেলে চিনতে পারেন না। কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছেন! পরশপাথর না কি! অনেকটাই তাই। ভিড়ের মধ্যে। মেকানিক খুঁজছেন। দোতলা থেকে জমিতে দৃষ্টি ফেলে রেখেছেন। যদি তিনি দর্শন দেন, ক্যাঁক করে ধরবেন! কোম্পানি হাত তুলে দিয়েছে। ভরসা এখন সেই বন্ধু। টিভি বিশেষজ্ঞ। দেখা হলে কথা দেন কিন্তু ধরা দেন না।
তারপর কী হয়?
তার আর পর নেই। রক্তের চাপ বেড়ে যায়। অভিজ্ঞ ব্যক্তি বলেন, টিভি কিনবেন সার্ভিস দেখে, যেমন হোটেলে ওঠেন অ্যাটাচড বাথ দেখে। যন্ত্র সব এক। সেই পিকচার টিউব, পর্দা, স্পিকার। খোলের বাহারে বিজ্ঞাপনের আশ্বাসে মাথানা মুড়িয়ে, ভালো বংশের মেয়ে আনবেন। ব্যবহার ভালো পাবেন। বিলিতি মেজাজ স্বদেশি ঘরে বিগড়াবেই। ধন্বন্তরি যেন ডাকলেই আসেন। যে প্রতিষ্ঠানের সার্ভিস এক ডাকে সাড়া দেবে সেই প্রতিষ্ঠান থেকেই টিভি কিনুন তাহলে আপনার ওই তপনবাবুর মতো আধপাগলা অবস্থা হবে না। এমন প্রতিষ্ঠান আছে নাকি? যাঁরা কথায় না বড় হয়ে কাজে বড়।