নবীন খেতে ভালবাসে
নবীন নিজে যেমন খেতে ভালবাসে, তেমনই লোকজনকে ডেকে খাওয়াতেও ভালবাসে। কিন্তু তার এখন যা অবস্থা, তাতে নিজেদেরই ভাল করে জোটে না, লোককে ডেকে খাওয়ানোর প্রশ্নই ওঠে না।
তবে বুড়ি পিসি কী একটা ব্রত করেছে, তাতে নাকি দ্বাদশ ব্রাহ্মণ ভোজন না করালেই নয়। ক’ দিন ধরেই পিসি ঘ্যানঘ্যান করছে, নবীন কথাটা তেমন কানে তোলেনি।
কিন্তু আজ এসে পিসি ধরে পড়ল, “ও বাবা নবীন, তুই কি শেষে আমাকে চিরটা কাল নরক ভোগ করতে বলিস? নরক যে সাঙ্ঘাতিক জায়গা বাবা, যমদূতেরা বড়-বড় সাঁড়াশি লাল টকটকে। করে গরম করে নিয়ে, তার পর তাই দিয়ে নাক কান হাত-পা সব টেনে-টেনে হেঁড়ে। তার পর হাঁড়ির মধ্যে গরম জলে ফেলে সেদ্ধ করতে থাকে। সেও শুনি হাজার হাজার বছর ধরে সেদ্ধ করতেই থাকে। মাঝে-মাঝে হাতা দিয়ে তুলে দেখে নেয়, ঠিক মতো সেদ্ধ হয়েছে কি না, আর তাতেই কি রেহাই আছে বাপ? সেদ্ধ হলে পর নাকি সর্বাঙ্গে নুন মাখিয়ে রোদে শুকোয়, তার পর হেঁটমুণ্ডু করে-করে ঝুলিয়ে রাখে, তার পর কাঁটার বিছানায় শুইয়ে রাখে, তার পর…”
নবীন মাথা নেড়ে-নেড়ে শুনছিল; বলল, “তার পর আর বাকি থাকে কী পিসি? এত কিছুর পর কি আর কেউ বেঁচে থাকে?”
পিসি মুখখানা তোম্বা করে বলল, “বাছা রে, একবার মরলে পরে আর যে মরণ নেই। নরকের ব্যবস্থাই তো ও রকম। যতই যা করুক না কেন, আর মরণ হবে না যে! তার পর সেখানে এঁটোকাঁটার বিচার নেই, চার দিকে নোংরা আবর্জনা আঁস্তাকুড়। একটু ভেবে দ্যাখ বাপ, মাত্র বারোটা বামুন খাওয়ালে যদি ফাঁড়াটা কাটে, তবে হাঁফ ছেড়ে বাঁচি।”
নবীন ম্লান মুখে বলল, “আচ্ছা পিসি, দেখছি কী করা যায়।”
পিসি নিশ্চিন্ত হয়ে চলে গেল। জানে, নবীনের মনটা বড় ভাল। ঠিকই ব্যবস্থা করবে।
নবীন দুপুরবেলা একতলায় নেমে এল। নাচঘরের দক্ষিণ-কোণে দেওয়ালের মধ্যে একটা ছোট্ট ছিদ্র। তার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে একটা হাতল ঘোরালেই মেঝেতে একটা সিঁড়ির মুখ খুলে যায়। সরু সিঁড়ি, অন্ধকারও বটে।
সিঁড়ি দিয়ে টর্চ হাতে নবীন নেমে এল মাটির নীচে। চার দিকে একটা টানা গলি, মাঝখানে নিরেট পাতালঘর। পাথরের দেওয়াল, লোহার দরজা, নবীন অন্তত হাজারবার এই পাতালঘরে হানা দিয়েছে। দেওয়ালে বা দরজায় শাবল বা হাতুড়ি মারলে ফাঁপা শব্দও হয় না। এতই নিরেট।
নবীনের হাতে এখন একেবারেই টাকাপয়সা নেই। কারও কাছে হাত পেতেও লাভ নেই। কেউ দেবে না। সকলেই জানে যে, নবীনের অবস্থা খারাপ, তার বিষয়-সম্পত্তি মহাজনের কাছে বাঁধা। ধার নিলে নবীন শোধ করতে পারবে না।
নবীন পাতালঘরের দরজার সামনে বসে আকাশ-পাতাল ভাবতে লাগল। কী করা যায়?
নবীন বসে-বসে ভাবতে লাগল। ভাবতে-ভাবতে তার একটু ঢুলুনিও এসে গেল। ঢুলতে-দুলতে তার মাথার মধ্যে নানা চিন্তা হিজিবিজি ঘুরে বেড়াতে লাগল। মহাজন টের পাওয়ার আগেই গোপনে লোক লাগিয়ে পাতালঘরের দেওয়াল যদি ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া যায়। অবশ্য তা হলে বাড়িটাও ধসে পড়তে পারে। যদি সুড়ঙ্গ কেটে ঢোকা যায়? যদি…
হঠাৎ তার কানে কে যেন মৃদু স্বরে বলে উঠল, “দূর বোকা! ওভাবে নয়।”
নবীন চমকে সোজা হয়ে বসে বলল, “কে?”
না, কেউ কোথাও নেই।
নবীন চার ধারটা খুব ভাল করে খুঁজে দেখল। কারও দেখা পেল না। পাতালে নামবার দরজাটা যেমন বন্ধ ছিল, তেমনই আছে।
খুবই চিন্তিতভাবে ওপরে উঠে এল। তার পর মহাদেবকে ডেকে বলল, “দ্যাখো মহাদেবদা, তুমি বহু পুরনো আমলের লোক। আজ যে ঘটনাটা ঘটল, তার মানেটা কী আমাকে বুঝিয়ে দেবে?”
মহাদেব খুব গম্ভীর মুখ করে ঘটনাটা শুনল, পাকা মাথাটি নেড়ে মাঝে-মাঝে ‘হু’ দিল। তার পর অনেকক্ষণ ভেবে নিয়ে বলল, “না গো নবীনভায়া, ঠিক বুঝতে পারছি না।”
নবীন খুব আগ্রহের সঙ্গে বলল, “কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, পাতালঘরে ঢোকার একটা সহজ পথ আছে।”
মহাদেব গম্ভীর মুখে বলল, “সেটা আমারও মনে হয়, তোমার ঠাকুরদাও সারাটা জীবন ওই পাতালঘরে সেঁধোবার চেষ্টা করেছেন। শাবল-গাঁইতিও কিছু কম চালানো হয়নি। শেষে একেবারে শেষ জীবনে তিনি চুপচাপ পাতালঘরের সামনে বসে থাকতেন। তার পর যখন মৃত্যুশয্যায় পড়ে আছেন, তখন আমি তাঁর কাছেই দিন রাত মোতায়েন থাকতাম। এক ঝড়বৃষ্টির রাতে হঠাৎ তোমার ঠাকুদা চোখ মেলে চাইলেন। মুখখানা ভারী উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। আমার দিকে চেয়ে বললেন, “পেয়েছি রে, পেয়েছি।”
নবীন সাগ্রহে বলল, “তার পর?” মহাদেব মাথাটা হতাশায় নেড়ে বলল, “কী পেয়েছেন, সেইটে আর বলতে পারলেন না। জিজ্ঞেস করলাম, উনি শুধু বললেন, “পাতালঘর। তার পরই নেতিয়ে পড়লেন, চোখ উল্টে গেল, জিভ বেরিয়ে পড়ল। মরে গেলেন।”
“ইশ, অল্পের জন্য হল না তা হলে?”
“খুবই অল্পের জন্য। আমার মনে সেই থেকে বিশ্বাস, তুমি যে-রকম ভাবে দেওয়াল বা দরজা ভাঙাভাঙির চেষ্টা করে যাচ্ছ, সেভাবে হবে না।”
“তবে কীভাবে হবে? মহাজনের হাতে বাড়ি চলে যেতে তো আর দেরি নেই, মহাদেবদা।”
“সবই তো বুঝি নবীনভায়া, কিন্তু আমার বুড়ো মাথায় তো কোনও কিছুই খেলছে না, আমিও কি কিছু কম ভেবেছি!”
নবীন চিন্তান্বিত হয়ে বলল, “পাতালঘরে ঢোকা ছাড়া যে আর পথ দেখছি না মহাদেবদা। পিসি বারোজন বামুন খাওয়াবে, তা তারও পয়সা হাতে নেই। এ রকম করে চললে যে আমাকে আত্মহত্যা করতে হবে।”
মহাদেব ভ্রূ কুঁচকে বলল, “দ্যাখো নবীনভায়া, ওটা পুরুষ-মানুষের মতো কথা নয়। তোমার বংশ ডাকাতের বংশ। তার একটা খারাপ দিক আছে বটে, আবার একটা ভাল দিকও আছে। তোমার বংশের লোকের বুকের পাটা ছিল। তারা ফুলের ঘায়ে মূর্ছা যেত না। তোমাকেও সেই রকম হতে হবে। সাহসী হও, দুনিয়াটা দুর্বলদের জায়গা নয়।”
নবীন মুখখানা হাঁড়ি করে বসে রইল।
আংটি ছিল, মায়ের গয়না ছিল, পুরনো কিছু মোহর ছিল। সবই গেছে। এখন এই বসত-বাড়িটা ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট নেই। দিন আর চলে না। কোনও বন্দোবস্ত না হলে বুড়ি পিসি আর বুড়ো মহাদেবদাকে নিয়ে গিয়ে গাছতলায় দাঁড়াতে হবে।
বিকেলের দিকে নবীন গিয়ে গোপীনাথ মহাজনের কাছে হাজির হল।
গোপীনাথের কারবার অনেক। নানা রকমের ব্যবসা তার। তার মধ্যে একটা হল, চড়া সুদে টাকা ধার দেওয়া আর বন্ধক রাখা। কেটেরহাটে তার মতো ধনী আর প্রতাপশালী লোক কমই আছে এখন। তার হাতে মেলা লোকজন। হাতে মাথা কাটতে পারে।
গোপীনাথের চেহারাখানাও পেল্লায়। থলথলে ভুড়িদার
চেহারা নয়, রীতিমতো পালোয়নের স্বাস্থ্য। চোখ দু’ খানা সাঙ্ঘাতিক কুটিল। চোখের দিকে তাকালে যে-কোনও লোকেরই বুকটা গুড়গুড় করে উঠবে।
নবীন যখন তার সামনে গিয়ে হাজির হল, তখন গোপীনাথ তার বৈঠকখানায় বসে বাদামের শরবত খাচ্ছে আর নিজের পোষা ব্লাডহাউণ্ড কুকুরের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করছে।
নবীনকে দেখে গোপীনাথ একটু বিরক্তির গলায় বলল, “কী খবর নবীনবাবু?”
নবীন কাঁচুমাচু মুখ করে বলল, “আপনার কাছে আজ আমার একটা প্রার্থনা আছে। এই শেষবার।”
গোপীনাথ বোধহয় এই সব বনেদি পড়তি বড়লোকের ছেলেদের বিশেষ পছন্দ করে না। শরবতের গেলাসটা ধীরেসুস্থে শেষ করে পাশের টেবিলে রেখে বলল, “পুরনো বাড়ি বাঁধা রেখে আপনাকে যা টাকা দিয়েছি, তাও আমার উশুল হবে না। যদি আর টাকা চান, তা হলে আগেই বলি, এক পয়সাও দিতে পারব না।”
নবীন মৃদুস্বরে বলল, “কিন্তু আমার পিসিকে যমদূতেরা নাকি গরম সাঁড়াশি দিয়ে ছিড়বে, কয়েক হাজার বছর ধরে সেদ্ধ করবে, রোদে শুকিয়ে হেঁটমুণ্ড করে রাখবে। তার পর আবার কাঁটার বিছানায় শোওয়াবে…ওফ…সে ভাবা যায় না…”
গোপীনাথ চোখ গোল করে এ সব শুনল, তার পর বলল, “বটে? তা পিসিকে এত সব খবর কে দিল?”
নবীন অম্লান বদনে বানিয়ে বলল, “আজ্ঞে কয়েক দিন আগে এক মস্ত তান্ত্রিক এসেছিলেন বাড়িতে। যদুপুরের অঘোরবাবা, নাম নিশ্চয়ই শুনেছেন, সাক্ষাৎ পিশাচসিদ্ধ। স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালে অনবরত যাতায়াত করেন। তিনি নরকের একেবারে হালের খবর এনে দিয়েছেন।”
গোপীনাথের মুখটা কেমন যেন পাঁশুটে মেরে গেল। চাকরকে ডেকে কুকুরটাকে নিয়ে যেতে বলে কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে রইল গোপীনাথ। তার পর বলল, “যদিও আমি ও সব গাঁজাখুরিতে বিশ্বাস করি না, ‘অঘোরবাবা’ বলে কারও নামও আমি শুনিনি, তবে নরকের ব্যাপারটা যেন কে আমাকে বলেছিল বটে।”
“আজ্ঞে, কী বলেছিল?”
“আরও খারাপ। দু পায়ে দুই তেজী ঘোড়াকে বেঁধে দু ধারে ছুটিয়ে দেওয়া হয়। ফলে একেবারে মাঝখান দিয়ে চিরে দু ফালা হয়ে যায় লোকে।”
“আজ্ঞে, নতুন নতুন গ্যাজেট তো নরকেও বেরোচ্ছে। হয়তো গায়ে জোঁক ছেড়ে দেয়, শুয়োপোকা ছেড়ে দেয়…”
“ও বাবা!”
গোপীনাথ নিমীলিত নয়নে কিছুক্ষণ নরকের দৃশ্যটাই বোধহয় কল্পনার চোখে প্রত্যক্ষ করে নিল। তার পর হঠাৎ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রবল কণ্ঠে বলে উঠল, “তারা ব্রহ্মময়ী, তুমিই ভরসা। সব সামাল দিও মা…”
নবীন মৃদু হেসে বলল, “আজ্ঞে শুনেছি, গরিব ব্রাহ্মণকে সাহায্য করলে নাকি যমদূতেরা আর ততটা অত্যাচার করে না। ধরুন, সাঁড়াশিটা হয়তো তেমন গরম করল না, সেদ্ধটা ভাল রকম হওয়ার আগেই তুলে ফেলল, কিংবা নুন মাখানোর বদলে পাউডার মাখাল…”
গোপীনাথ কটমট করে নবীনের দিকে চেয়ে বলল, “কত চান বলুন তো?”
মাথা চুলকে নবীন একটু ভাবল। লোককে খাওয়াতে সে খুবই ভালবাসে। দ্বাদশ ব্রাহ্মণের সঙ্গে যদি আরও কয়েকজন বন্ধুবান্ধব এবং পাড়া-প্রতিবেশীকে খাইয়ে দেওয়া যায়, তা হলে মন্দ কী!
“আজ্ঞে, দ্বাদশ ব্রাহ্মণের জন্য দ্বাদশ শত অর্থাৎ কিনা বারোশো টাকা হলেই চলবে।”
গোপীনাথ এত অবাক হল যে, প্রথমটায়, মুখে বাক্য সরল না। তার পর বলল, “আপনি জানেন যে, আমার নিজের এক দিনের খোরাকি মাত্র বারো টাকা?”
“বড়লোকদের একটু কমই লাগে। তাদের খিদেও কম, খাওয়াও কম। কিন্তু গরিবদের তো তা নয়। তারা কষি খুলে, প্রাণ হাতে নিয়ে খায়। একেবারে হাঘরের মতো। একটু বেশি তো লাগবেই।”
গোপীনাথ বিজ্ঞের মতো বলল, “আপনাকে যে টাকা দিতে রাজি হয়েছি, এই ঢের জানবেন। কুল্যে পঞ্চাশটা টাকা দিচ্ছি, ওইতেই বামুনদের চিড়ে-দই ফলার করান তো।”
নবীন ভারী বিনয়ের সঙ্গে বলল, “তার চেয়ে পিসি বরং নরকেই যাক গোপীবাবু। বামুন না-খাওয়ালে মেয়াদ কিছু কম হতে পারে। পিসির পাপ-টাপও বেশি নেই, সহজে উদ্ধার হয়ে যাবে। আর ফলার খাওয়ালে? বারোটা বামুনের অভিশাপ ঘাড়ের ওপর গদাম গদাম করে এসে পড়লে, নরকের যমদূতেরা পিসির গায়ে কাঁকড়া বিছেও ছেড়ে দেবে।”
গোপীনাথ একটু শিউরে উঠল, “তারা ব্রহ্মময়ী! দেখো মা। যাক গে, বারোশো টাকার সুদ গুনতে পারবেন তো? বড় কম হবে না।”
“যে আজ্ঞে।”
“আর শুনুন, ফের সাবধান করে দিচ্ছি, ওই পাতালঘরের ধারেকাছে কিন্তু আর যাবেন না। বাড়ি, বলতে গেলে, এখন আমারই। কোনও রকম ভাঙচুর হলে কিন্তু মুশকিলে পড়বেন। মনে থাকে যেন।”
“যে আজ্ঞে।”
খাজাঞ্চিকে ডাকিয়ে হ্যান্ডনোট লেখানোর পর নবীনকে টাকা দিয়ে দিল গোপীনাথ। আচ্ছা চশমখোর লোক। বারোশো টাকার এক মাসের সুদও ধরা হয়েছে বারোশো টাকাই। শোধ দিতে না পারলে চক্রবৃদ্ধি হারে ঋণ বেড়ে যাবে।
তবে নবীন বড় একটা ভবিষ্যতের ভাবনা ভাবে না। তার চিন্তা বর্তমানকে নিয়ে। সে টাকা নিয়ে বাড়ি এসে সোল্লাসে বলে উঠল, “পিসি, আর ভয় নেই। যমদূতেরা আর তোমাকে ছুঁতেও পারবে না। বারোটা বামুনের খাওয়ার জোগাড় করো।”
পিসি আহ্লাদে চোখের জল ফেলতে লাগল। বলল, “আমি যদি স্বর্গে যাই, তোকেও টেনে নেব বাপ, দেখিস। সেখানে ভারী ভাল ব্যবস্থা।”
“সেখানে কী রকম ব্যবস্থা গো পিসি?”
“সকালে উঠলেই দুধের সর দিয়ে খইয়ের মোয়া। বুঝলি? তার পর দুপুরে পোলোয়া তো রোজই হয়। অ্যাই বড় বড় চিতল মাছের পেটি খাবি। তার পর বিকেলে গাওয়া ঘিয়ের লুচি। রাতে মাংস, পায়েস, কত কী!”
“আর কী?”
“ও রে, স্বর্গে কি কিছুর অভাব! সেখানে শীতকালে ল্যাংড়া আম, গ্রিষ্মিকালে কমলালেবু। চালে কাঁকর নেই। আরও একটা ভাল জিনিস হল, স্বর্গে নাকি একাদশী করতে হয় না।”
“তা হলে তো দারুণ জায়গা পিসি।”
পিসি ফোকলা মুখে হেসে বলল, “তবে?”
পিসির বামুন আর নবীনের বন্ধু-বান্ধব মিলে বড় কম হবে না। বিরাট আয়োজন করতে হবে। বহু দিন বাদে নবীনের মনে বড় স্ফুর্তি এল। সে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে বাগানে বেড়াতে গেল।
নবীনের বাগানটারও কোনও ছিরিছাঁদ নেই। দেখাশোনা করা হয় না বলে আগাছায় ভরে গেছে। তারই মধ্যে স্থলপদ্ম বা গোলাপও যে ফোটে না এমন নয়। তবে বাগানের চেয়ে জঙ্গল বললেই ঠিক বলা হয়।
বাগানে এক সময়ে পাথরের পরী, ফোয়ারা এসব ছিল। পরী বহু কাল আগে মুখ থুবড়ে পড়ে গেছে, তাকে আর তোলা হয়নি। ফোয়ারা বহু কাল বন্ধ।
ফোয়ারার ধারটা এক সময়ে চমৎকার বাঁধানো ছিল। বাড়ির লোকেরা তার ধারে বসে বিকেল কাটাত। এখনও নবীন এসে ফোয়ারার ধারেই বসে।
আজও নবীন ফোয়ারার ধারে বসে আকাশ-পাতাল ভাবছিল। কত কী যে সে ভাবে। ভোজটা হয়ে গেলে হাতে যা টাকা থাকবে, তাই দিয়ে সে একবার হরিদ্বার ঘুরে আসবে। সে বার হৃষিকেশের এক সাধু তাকে একটা স্ফটিকের মালা দেবে বলেছিল। বেজায় সস্তা। মাত্র দেড়শো টাকা দাম। সাধুকে খুঁজে পেলে মালাটা কিনে ফেলবে। আরও কত কী করবে সে… শুধু পাতালঘরটা যদি একবার খুলতে পারত!
দাদু কি সত্যিই পাতালঘর খোলার হদিস পেয়েছিল? কীভাবে পেয়েছিল?
কাছেই কে যেন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নবীন চমকে উঠে চেয়ে দেখল, কেউ কোথাও নেই।
একটু নড়েচড়ে বসল সে। হঠাৎ ফটকের ও পাশ থেকে কে যেন হাঁক দিয়ে তাকে ডাকল, “নবীন! বলি ও নবীন! বাড়ি আছ নাকি?”
নবীন গিয়ে দ্যাখে, সদাশিববাবু।
“আজ্ঞে আসুন। গরিবের বাড়ি অনেক দিন পায়ের ধুলো দেননি।”
সদাশিববাবু নবীনের দিকে চেয়ে বললেন, “কী সব শুনছি বলো তো?”
“আজ্ঞে?”
“তুমি নাকি ফের টাকা ধার করেছ?”
নবীন লজ্জিতভাবে মাথা চুলকোতে লাগল। এই সদাশিববাবুর পূর্বপুরুষদের সঙ্গে নবীনের পূর্বপুরুষদের সাঙ্ঘাতিক শত্রুতা ছিল এক সময়ে। এ-ওকে পেলে ছিঁড়ে ফেলে আর কি। দু’ পক্ষের লোকজনের হাতে পারস্পরিক খুন-জখম লেগেই থাকত। বড় ঝিলে যে কত লাশ ফেলা হত, তার হিসেব নেই। নবীনের ঠাকুরদার আমলেও সেই রেষারেষি ছিল। এই আমলে আর নেই। নবীনের অবস্থা খুবই পড়ে গেছে, সদাশিববাবুর অবস্থা সেই তুলনায় যথেষ্ট ভাল। রেষারেষি হয় সমানে-সমানে।
নবীন বলল, “আজ্ঞে, পিসি কী একটা ব্রত করেছে। দ্বাদশ ব্রাহ্মণ না খাওয়ালেই নয়।”“।
সদাশিব নবীনকে ভালই চেনেন। বললেন, “সে তো ভাল কথা। কিন্তু তুমি যে শুনছি গোপীনাথের কাছ থেকে বারোশো টাকা ধার নিয়েছ। এত টাকা শুধবে কী করে ভেবে দেখেছ?”
“আজ্ঞে না।”
সদাশিববাবু বাগানে ঢুকে চার দিকটা চেয়ে দেখলেন। তার পর দুঃখের সঙ্গে মাথা নেড়ে বললেন, “কী বাড়ি ছিল, কী হাল হয়েছে! এ যে চোখে দেখা যায় না হে নবীন।”
“যে আজ্ঞে।”
“পাতালঘরটা খুলবারও তো কোনও ব্যবস্থা হল না। হলে, কে জানে, হয়তো কিছু পেয়েও যেতে পারতে। তোমার ঊর্ধ্বতন ষষ্ঠ পুরুষ তো হৃদয়পুর কাছারি লুঠ করে মেলা টাকা এনেছিল। অথচ সেটা লুঠ করার কথা আমার ঊর্ধ্বতন পঞ্চম পুরুষ জয়শিবের।”
নবীনের একটু আঁতে লাগল। সে বলল, “আজ্ঞে, ব্যাপারটা মোটেই তা নয়। জয়শিব হৃদয়পুরের লেঠেলদের ভয়ে কাছারি লুঠ করার পরিকল্পনা ত্যাগ করেন। আমার ঊর্ধ্বতন ষষ্ঠ পুরুষ কালীচরণ সাহসী পুরুষ ছিলেন। তিনি একাই উনিশজন লেঠেলকে ঘায়েল করেন। এ কথা সবাই জানে।”
সদাশিব ভ্রূ কুঁচকে বললেন, “তুমি কিছুই জানো না। জয়শিব আর কালীচরণ, দুজনের নিবিড় বন্ধুত্ব ছিল। বলতে গেলে কালীচরণ ছিলেন জয়শিবের অনুগত। ডান হাত। দু’জনের একসঙ্গেই কাছারি লুঠ করতে যাওয়ার কথা। অথচ জয়শিবের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে কালীচরণ আলাদা লোকজন নিয়ে গিয়ে আগেভাগেই কাছারি লুঠ করে সব টাকাপয়সা লুকিয়ে ফেলেন।”
“আজ্ঞে, কথাটা মোটেই ঠিক নয়। কালীচরণ কোনও দিনই কারও তাঁবেদারি করেননি। জয়শিবের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব ছিল ঠিকই, কিন্তু তিনি তাঁর অনুচর ছিলেন না। তাঁর বরাই আলাদা দল ছিল।”
“ইতিহাস তা বলে না রে, বাপু।”
“আজ্ঞে, তা-ই বলে। জয়শিব ভিতু ছিলেন।”
“কালীচরণ ছিলেন বিশ্বাসঘাতক।”
দু’জনের মধ্যে একটা বচসা বেধে উঠেছিল প্রায়। কিন্তু ঠিক এই সময়ে ঝোঁপের আড়াল থেকে কে যেন বলে উঠল, “দুজনেই খুব খারাপ ছিল।”
সঙ্গে-সঙ্গে সদাশিব বলে উঠলেন, “জয়শিব খারাপ ছিলেন। তাঁর অনেক দানধ্যান ছিল।”
নবীনও বলে উঠল, “কালীচরণের মতো সাধু লোক কমই ছিল। ধ্যানে বসে তিন হাত ওপরে উঠে যেতে পারতেন।”
তার পর দু’জনেরই খেয়াল হল, কথাটা বলল কে আড়াল থেকে?
“নবীন, কথাটা কে বলল দ্যাখো তো! কোন বেয়াদব?”
ঝোপের আড়াল থেকে সাহেবি পোশাক পরা একটা লোক বেরিয়ে এসে বলল, “আমি বলেছিলাম।”
সদাশিব লোকটার দিকে বিরক্তির চোখে তাকিয়ে বললেন, “তুমি! তা তুমি এখানে উদয় হলে কী করে?”
অভিজিৎ মৃদু হেসে বলল, “চারদিকটা ঘুরে-ঘুরে দেখছিলাম। এখানে তো পোকামাকড়ের অভাব নেই। এই জঙ্গলটা দেখে আর লোভ সামলাতে পারিনি।”
“আড়াল থেকে অন্যের কথা শোনাটা ভাল কাজ নয়।”
অভিজিৎ জিভ কেটে বলল, “ইচ্ছে করে শুনিনি। একটা ক্যাটারপিলার দেখতে পেয়ে সেটাকে একটু অবজার্ভ করছিলাম। কানে আপনাদের কথা আসছিল। শুনে মনে হল, আপনাদের দু’জনেরই পূর্বপুরুষরা ডাকাত ছিলেন।”
“ছিলেন তো কী! সে-আমলে ডাকাতদেরও ইজ্জত ছিল। জয়শিবকে ব্রিটিশ সরকার ‘রায়সাহেব’ উপাধি দিতে চেয়েছিল তা জানো?”
নবীনও বলে উঠল, “আর কালীচরণকে সোনার মেডেল।”
অভিজিৎ হাত তুলে বলল, “ঘাট হয়েছে। আপনাদের দু’জন পাছে ঝগড়া পাকিয়ে তোলেন, তাই আড়াল থেকে কথাটা বলে ফেলেছি। কিছু মনে করবেন না। আচ্ছা, আপনিই তো নবীনবাবু?”
নবীন বলল, “আজ্ঞে হ্যাঁ।”
“আপনার এই বাড়িটা ভারী অদ্ভুত। বাগানে পোকা-মাকড় খুঁজতে-খুঁজতে আমি জঙ্গলটায় কয়েকটা জিনিস আবিষ্কার করে ফেলেছি।”
“কী বলুন তো?”
“ওই দক্ষিণের দিকে ঘাস-জঙ্গলের মধ্যে একটা ঢাকনা দেওয়া কুয়ো আছে। ওটা কিসের বলুন তো?”
নবীন বেজার মুখে বলল, “কুয়ো আর কিসের হবে। জলের।”
সদাশিব অট্টহাসি হেসে বললেন, “জলের না হাতি! ওর ঠ্যাঙাড়ে পূর্বপুরুষেরা মানুষ মেরে ওই কুয়োয় লাশ ফেলত। খুঁজলে ওর মধ্যে বিস্তর কঙ্কাল পাওয়া যাবে।”
সদাশিব উঠে পড়লেন, “চলল হে অভিজিৎ।”
নবীন বেজার মুখ করে ফোয়ারার ধারে বসে রইল। বসে পূর্বপুরুষদের কথা ভাবতে লাগল।