Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ঝিকরগাছায় ঝাট || Shirshendu Mukhopadhyay » Page 8

ঝিকরগাছায় ঝাট || Shirshendu Mukhopadhyay

রাজবাড়ির ফটকের উলটোদিকে

রাজবাড়ির ফটকের উলটোদিকে বটগাছটার তলায় দিনতিনেক হল একজন সাধু এসে থানা গেড়েছে। তা সাধুসজ্জন মাঝে মাঝে আসে বটে, অভিনব কিছু নয়। রাজা মহেন্দ্র চোখে ভাল ঠাহর পান। দূর থেকে দেখে যা মনে হয়, সাধুর বয়স খুব কম। কালো দাড়ি গোঁফ, কালো জটা। ছিপছিপে গৌরবর্ণ তেজি চেহারা। একজন চেলাও ঘুরঘুর করছে কাছাকাছি।

রানি বিন্ধেশ্বরীও সাধুটিকে জানলা দিয়ে দেখলেন। দেখে বললেন, “আহা, কী কচি বয়সেই ছেলেটা সাধু হয়ে গেছে দেখো। দেখলে মায়া হয়। কোন মায়ের বুক খালি করে বিবাগী হয়েছে কে জানে।” বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, তারপর বুড়ি দাসী সুবালাকে ডেকে বললেন, “ওরে, ওই সাধুকে একটা সিধে দিয়ে আয় তো। আমার নবেন ফিরে এসেছে, বাছার মঙ্গলের জন্য একটু সাধুসেবা করা ভাল।”

সুবালা বলল, “ও বাবা, ও সাধু বড্ড রগচটা। কারও কাছ থেকে কিছু নেয় না। দিতে গেলে তেড়ে আসে।”

“না নিলে না নেবে। তুই তবু নিয়ে গিয়ে দিয়ে দ্যাখ।”

সুবালা সিধে নিয়ে গেল। ফিরে এসে একগাল হেসে বলল, “তোমার কপাল ভাল গো রানিমা। প্রথমটায় চোখ পাকিয়ে উঠেছিল বটে, কিন্তু যেই বললুম রানিমা পাঠিয়েছে অমনি একগাল হেসে হাত বাড়িয়ে নিয়ে নিল।”

রানিমার চোখ ছলছল করে উঠল, “আহা রে, বোধ হয় মায়ের কথা মনে পড়েছে।”

মহেন্দ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “পড়ারই কথা কিনা।”

রানিমাও একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “এই শীতে খালি গায়ে বসে থাকে, দেখলে বড় কষ্ট হয়। খুব ইচ্ছে করে একখানা কম্বল দিয়ে আসি।”

মহেন্দ্র বললেন, “তা দিলেই তো হয়।”

রানিমা বললেন “আমাদের আগের অবস্থা থাকলে কি আর দিতাম না! বাড়তি কম্বলই বা কোথায় বলো! একখানা পুরনো বিলিতি কম্বল আছে বটে, তা সেখানা খুব দামি জিনিস। সেটা তো আর দানধ্যানে দেওয়া যায় না! নবেন আবার রাগ করবে। দেওয়া থোওয়া সে বেশি পছন্দ করে না। বলে, দান ধ্যান করে করেই রাজবাড়ির এই দুর্দশা হয়েছে। তা কথাটা মিথ্যে নয় বাপু।”

মহেন্দ্র মাথা নেড়ে বললেন, “তা বটে! নবেনের বেশ বিষয়বুদ্ধি আছে।”

রানিমা পানের বাটা নিয়ে বসে পান সাজতে সাজতে বললেন, “খুব আছে। বাছার আমার চারদিকে চোখ। কুটোগাছটা এদিক-ওদিক হলেও ঠিক টের পায়। তা এরকমই তো হওয়া ভাল, কী বল?”

“খুব ভাল, খুব ভাল।”

রানিমা পান মুখে দিয়ে বললেন, “বাছার আমার তেজও আছে খুব। তার দাপটে গঙ্গাধরপুরে এখন বাঘে গোরুতে এক ঘাটে জল খায়। বজ্জাত লোকগুলো সব ঢিট হয়ে গেছে। শুনলুম খাজনাপত্রও আদায় হচ্ছে ভালই।”

মহেন্দ্র সভয়ে বললেন, “সবাই খাজনা দিচ্ছে বুঝি?”

“তা না দেবে কেন? আমাদেরই রাজত্বে বাস করবে আর আমাদের খাজনা দেবে না তা কি হয়? নবেন তো আর মেনিমুখো নয় তোমার মতো। ন্যায্য খাজনা আদায় করে ছাড়ছে। বলেছে রাজবাড়ির ভোল পালটে দেবে।”

“বাঃ বাঃ, শুনে বড় খুশি হলাম।”

রানিমা পিকদানিতে পানের পিক ফেলে বললেন, “হ্যাঁ গো এই এতদিন বাদে আমাদের নবেন ফিরে এল তাতে তোমার আনন্দ নেই কেন বলো তো! মুখটা সবসময়ে অমন আঁশটে করে রাখ কেন? বলি তুমি এখনও সেই জডুলটা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছ নাকি?”

“আরে রামোঃ, জডুল আবার একটা মাথা ঘামানোর মতো জিনিস হল!”

রানি খুশি হয়ে বললেন, “তাই বলো। খবরদার, ওই চোরটাকে আর আশকারা দিয়ো না। ভারী বেয়াদপ লোক। নবেন জানতে পারলে খুব রাগ করবে।”

.

আজ সকালে রাজকুমার নবেন্দ্র তার দলবল নিয়ে ঝিকরগাছার হাটে গেছে। বাড়ি পাহারা দেওয়ার জন্য রয়ে গেছে মাত্র দু’জন ষণ্ডা। তবে তারা পদসেবা করতে তেমন আগ্রহী নয় দেখে রাজা মহেন্দ্র ভারী স্বস্তি বোধ করলেন এবং দরবার ঘরে সিংহাসনে বসে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে লাগলেন।

“পেন্নাম হই রাজামশাই।”

মহেন্দ্র চোখ চেয়ে শ্রীদামকে দেখে একটু লজ্জা পেয়ে বললেন, “বুড়ো বয়সের কী দোষ জান! যখন-তখন ঘুম পেয়ে যায়।”

“যে আজ্ঞে! তা বয়সেরও তো গাছপাথর নেই আপনার। এই মাঘে আপনার বয়স গিয়ে দাঁড়াচ্ছে আটান্ন বছর তিন মাস।”

“আটান্ন! বলো কী হে! আমার তো মনে হয় একানব্বই পেরিয়ে এবার বিরানব্বইতে পা দেব।”

“আপনি যদি হুকুম করেন তো তাই। তবে আমার কাছে পাকা হিসেব আছে মহারাজ।”

মহেন্দ্র একটু ভাবিত হলেন। তারপর মাথা নেড়ে বললেন, “দু-চার বছর কমাতে পার, কিছু মনে করব না। কিন্তু আটান্নটা যে বেজায় কম হে!”

শ্রীদাম হাত কচলে বলে, “তা আটান্ন বয়সটা আপনার পছন্দ না হলে পছন্দমতো একটা বয়স বেছে নিতে বাধা কী মহারাজ! বয়সের ঘাড়ে ক’টা মাথা!”

মহেন্দ্র গভীর চিন্তা করতে করতে বললেন, “বেজায় মুশকিলে ফেলে দিলে হে! দিব্যি বিরানব্বই বছরে এসে ঘাপটি মেরে বসে আছি, তুমি এসে এক ঝটকায় আটান্নয় নামিয়ে দিলে! এত টানাহ্যাঁচড়া আমার সইবে না বাপু! তোমার দোষ কী জান?”

“আজ্ঞে, দোষঘাটের অভাব কী? আমার শত্রুও বলতে পারবে না যে, শ্রীদামের এই দোষটা নেই।”

“তোমার দোষ হল, এক একবার উদয় হয়ে তুমি আমার মাথায় নতুন নতুন সমস্যা ঢুকিয়ে দিয়ে যাও। আটান্ন যে আমার হাঁটুর বয়স! আমি কি আমার চেয়ে এতটাই ছোট! এই হারে যদি বয়স কমিয়ে ফেলতে থাক বাপু, তা হলে তো একদিন দেখব আমি আমাকেই কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি।”

জিভ কেটে নিজের দু’কান ছুঁয়ে শ্রীদাম বলল, “আস্পদ্ধা মাফ করে দেবেন মহারাজ। তা হলে হাঁটু প্রতি আটান্ন করে ধরে দুই হাঁটু যোগ করলে একুনে আপনি যে বয়সটা চাইছেন তাই গিয়ে দাঁড়ায় বোধ হয়।”

“তুমি বড়ই অর্বাচীন।”

“যে আজ্ঞে।”

রাজা মহেন্দ্র একটু হাসলেন।

শ্রীদাম একটু গলাখাঁকারি দিয়ে বলে, “মহারাজ!”

“বলে ফেলো বাপু।”

“বলি কাজটা কি উচিত হচ্ছে?”

“কোন কাজটা হে বাপু?”

“একটু আগে আসার পথে দেখলুম, মহারানিমা একখানা বিলিতি কম্বল নিয়ে গিয়ে বটতলার সাধুটাকে দিয়ে এলেন। এতে কি রাজকুমার নবেন্দ্র কুপিত হবেন না?”

“অ্যাঁ!” বলে রাজা মহেন্দ্র সোজা হয়ে বসলেন, “দিয়ে এসেছে?”

“শুধু কি তাই মহারাজ! সঙ্গে একথালা মিষ্টিও।”

“বল কী হে! ঠিক শুনছি তো!”

“যে আজ্ঞে মহারাজ। বলছিলাম কাজটা কি ঠিক হচ্ছে!”

“তা ইয়ে, শ্রীদাম।”

“আজ্ঞা করুন মহারাজ।”

“ইয়ে, ওই জডুলটা এখনও স্বস্থানেই আছে তো!”

“আজ্ঞে মহারাজ, জড়ল একচুলও নড়েনি, নড়ার লক্ষণও নেই।”

স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে মহেন্দ্র বললেন, “ওই জডুলটা নিয়েই চিন্তা, বুঝলে শ্রীদাম।”

“বুঝেছি মহারাজ।”

.

রাজকুমার নবেন্দ্র দরবার ঘরে সন্ধেবেলা ম্যাজিক শোর আয়োজন করেছেন। তাঁর হুকুমে বাড়ির সবাই এসে জড়ো হয়েছে। রাজা মহেন্দ্র সিংহাসনে বসে আছেন। পাশে জলচৌকিতে রানিমা। মেঝের ওপর শতরঞ্চিতে নবেন্দ্রর দলবল। বাঁ ধারে আরেকটা ফাঁকা চেয়ার সাজিয়ে রাখা।

একধারে স্টেজ সাজানো হয়েছে। নিবু নিবু আলো জ্বলছে চারদিকে। কেমন একটা ভুতুড়ে ভাব।

হঠাৎ এই ম্যাজিক শোয়ের আয়োজন কেন তা রাজা মহেন্দ্র বুঝতে পারছিলেন না। আবার যেন আবছা আবছা একটা কিছু বুঝতেও পারছেন। তবে তলিয়ে বুঝতে তাঁর একটু ভয় ভয় করছে। ম্যাজিক দেখাতে ধরে আনা হয়েছে বুড়ো ভজহরিকেই।

ম্যাজিক শুরু করার আগে ভজহরি স্টেজের পেছনে পরদার আড়ালে সাজগোজ করতে গিয়ে টের পেল তার হাত-পা ভয়ে ঠক ঠক করে কাঁপছে। বহুকাল পরে তার নিয়তি কেন তাকে এখানে টেনে আনল তা সে বুঝতে পারছিল না। আরও ভয়ের কথা হল, কুমার বাহাদুরকে তার ভারী চেনা চেনা ঠেকছিল। বছর পাঁচেক আগে ভজহরির একজন সহকারী ছিল। তার নাম বৃন্দাবন। ভারী ভাল হাত ছিল বৃন্দাবনের। এক লহমায় শক্ত শক্ত খেলা শিখে ফেলত। বুদ্ধিও ছিল তুখোড়। খুব বিশ্বাসী ছিল বলে ভজহরি তাকে নিজের জীবনের অনেক কাহিনী শুনিয়েছিল। কিছুদিন ভজহরির চেলাগিরি করে একদিন সে হঠাৎ উধাও হয়ে যায়।

আজ কুমার বাহাদুরকে দেখে হঠাৎ বৃন্দাবন’ বলে ডেকে ফেলায় সে কী বিপত্তি! কুমার বাহাদুর এমন রক্ত-জলকরা চোখে চেয়ে রইলেন যে, ভজহরির বুক হিম হয়ে গেল। কুমার বাহাদুরের স্যাঙাতেরা তো এই মারে কি সেই মারে। হাতজোড় করে ক্ষমাটমা চেয়ে তবে রেহাই পায়।

বুকটা বড় ঢিপ ঢিপ করছে ভজহরির। বহুকাল আগেকার সেই ম্যাজিক শো দেখানোর স্মৃতি ফিরে আসছে বার বার। তাতে ভজহরির শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছে, জল তেষ্টা পাচ্ছে। কিন্তু উপায়ও নেই। কুমার বাহাদুরের হুকুম হয়েছে সেই রাতে ভজহরি যেসব খেলা দেখিয়েছিল সেগুলোই দেখাতে হবে।

সাড়ে ছ’টায় ম্যাজিক শো শুরু হল। ভজহরি টুপি থেকে খরগোশ বের করার খেলাটা দেখাতে দেখাতে আড়চোখে লক্ষ করল বাঁ ধারের চেয়ারগুলো এখনও ফাঁকা। কোনও রাজা মহারাজাকে দেখা যাচ্ছে না।

এরপর দড়ির খেলা, তাসের খেলা, বলের খেলা। চোখ বেঁধে তির ছুঁড়ে আপেল বিদ্ধ করার খেলাও দেখাতে হল। তফাতের মধ্যে জিমির বদলে এবার লালু আপেল মাথায় নিয়ে দাঁড়াল।

আর আশ্চর্যের বিষয়, আজও অবিকল সেদিনের মতোই পুটুং করে সুতোটা ছিঁড়ে গেল এবং ভজহরি তিরটা সময়মতো আটকাতে পারল না। হাততালির শব্দ শুনে তাড়াতাড়ি চোখের বাঁধন খুলে ভজহরি দেখল তিরটা ঠিক গিয়ে আপেলটাকে গেঁথে ফেলেছে আর বেকুবের মতো দাঁড়িয়ে আছে লালু।

খুব ধীরে বাঁ ধারে চোখ ঘুরিয়ে ভজহরি যা দেখল তাতে তার হৃৎপিণ্ড থেমে যাওয়ার কথা। বারোটা চেয়ারে বারোজন মহারাজ বসে আছেন। গম্ভীর মুখ। কপালে ভ্রুকুটি।

ভজহরি ঠক ঠক করে কাঁপতে লাগল। দরবার ঘরের বাঁ ধারে সেই সিঁড়ি, সেই দরজা।

তার অবস্থা দেখে হঠাৎ কুমার বাহাদুর উঠে তার কাছে এসে নিচু স্বরে বলল, “কিছু দেখা যাচ্ছে?”

ভজহরি রাজাদের দিকে কম্পিত আঙুল তুলে কেবল বলল, “ওই ওই…”

“ওঁরা কি এসেছেন?”

“হ্যাঁ… হ্যাঁ… ওই তো…”

“সিঁড়ি! দরজা!”

“হ্যাঁ…হ্যাঁ…ওই তো…”

বলতে বলতে হঠাৎ ভজহরির শরীরটা হালকা হয়ে হঠাৎ শূন্যে ভেসে উঠতে লাগল। ভজহরি চেঁচিয়ে উঠল, “না…না…আর নয়…”

কিন্তু কে শোনে কার কথা! ভজহরি পাখির মতো দরবার ঘরের ভেতরে শূন্যে ঘুরে বেড়াতে লাগল। নামে, ওঠে, নামে, পাক খায়। আর ভজহরি চেঁচায়, “আর না…আর না…”

সবাই তাজ্জব হয়ে হাঁ করে এই অদ্ভুত কাণ্ড দেখছে।

একসময়ে ফের ভজহরি ধীরে নেমে এল তার জায়গায়। মুখ বিবর্ণ, শরীর কাঁপছে।

আর রাজারা একে একে উঠে দাঁড়িয়ে একে একে তার দিকে হেঁটে আসতে লাগলেন। ভজহরি যন্ত্রচালিতের মতো কাঁপা হাতে টুপিটা খুলে উলটে ধরল সামনে। গম্ভীর মুখে রাজারা টুং টাং করে মোহর ফেলে যেতে লাগলেন টুপির মধ্যে। ঠিক বারোটা মোহর। তারপর ধীর পদক্ষেপে তাঁরা হেঁটে যেতে লাগলেন সিঁড়ির দিকে।

কুমার বাহাদুর বিদ্যুৎগতিতে এসে ভজহরির হাত থেকে টুপিটা কেড়ে নিয়ে মোহরগুলি দেখে গর্জন করে উঠলেন, “মোহর। মোহর! সিঁড়িটা কোথায়… সিঁড়িটা..?”

ভজহরি হাত তুলে দেখাল, “ওই যে।”

ভজহরির হাত ধরে একটা হ্যাঁচকা টান মেরে কুমার বাহাদুর ছুটতে লাগলেন, “সিঁড়িটা দেখাও ভজহরি…সিঁড়িটা আমার চাই…”

আশ্চর্যের বিষয়, সিঁড়িটা আজ মিলিয়ে গেল না। সকলের চোখের সামনে সিঁড়িটা দিব্যি দেখা যেতে লাগল। সিঁড়ির মাথায় কারুকাজ করা দরজাটাও।

ভজহরিকে একটা ঠেলা দিয়ে কুমার বাহাদুর বললেন, “ওঠো, ওঠো ভজহরি, পথ দেখাও।”

কাঁপতে কাঁপতে ভজহরি সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল। পেছনে কুমার বাহাদুর, তার পেছনে কুমার বাহাদুরের দলবল।

বারোজন রাজা মিলিয়ে গেছেন দরজার ভেতরে। তবু দরজা আজ খোলা। যেন কারও জন্য অপেক্ষা করছে।

ভজহরির পেছন পেছন কুমার বাহাদুর আর তার দলবল হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকে পড়তে লাগল। শেষজন ঢুকে যাওয়ার পর দরজাটা আস্তে করে বন্ধ হয়ে গেল। তারপর ভোজবাজির মতো অদৃশ্য হয়ে গেল দরজা আর সিঁড়ি।

অনেকক্ষণ কেউ কথা কইতে পারল না। সবাই স্তম্ভিত, বজ্রাহত, বাক্যহারা।

হঠাৎ রানিমা ডুকরে কেঁদে উঠলেন, “ওগো, আমার নবেন কোথায় গেল!নবেনের কী হল! ওরে বাবা, আমি যে নবেনকে ছাড়া প্রাণে বাঁচব না। ওগো, আমার নবেনকে শিগগির ফিরিয়ে আনন…”

হঠাৎ লম্বা, ছিপছিপে, গৌরবর্ণ সাধুটি ধীর পায়ে দরবার ঘরের মাঝখানে এসে দাঁড়াল। গায়ে সেই বিলিতি কম্বল।

রানিমা তার কাছে ছুটে গিয়ে কেঁদে পড়লেন, “ও সাধুবাবা, তোমার পায়ে পড়ি, একটা কিছু করো। আমার নবেন কোথায় গেল…”

সাধুটি একটু হাসল মাত্র। তারপর দুই সবল হাতে রানিমাকে ধরে বলল, “শান্ত হও মা, শান্ত হও…”

রাজা মহেন্দ্র একটু গলাখাঁকারি দিয়ে ডাকলেন, “তা ইয়ে, শ্রীদাম আছ নাকি হে!”

“যে আজ্ঞে মহারাজ।” বলে সিংহাসনের পেছন থেকে শ্রীদাম বেরিয়ে এল।

রাজা মহেন্দ্র বললেন, “তা ইয়ে, বাপু শ্রীদাম, এবার তা হলে জড়লটার একটা সুলুকসন্ধান না করলেই যে নয়! সেটা যথাস্থানে আছে তো?”

“যে আজ্ঞে মহারাজ। সাধুবাবা গা থেকে কম্বলটা নামালেই হয়।”

একটু বাদে যখন সাধুর বাঁ বগলের নীচে জডুলটার সন্ধান পাওয়া গেল, তখন মহেন্দ্র সখেদে বললেন, “জঙুল তো যথাস্থানেই আছে দেখছি হে শ্রীদাম। কিন্তু তোমাদের রানিমার আবার পছন্দ হলেই হয়।”

সাধুকে কোলে টেনে নিয়ে রানিমা কেঁপে কেঁপে কাঁদছিলেন, “ছিঃ বাবা, মাকে কি এত ছলনা করতে হয়! কী ছিরি হয়েছে চেহারার! একমুখ দাড়ি-গোঁফ! আর শীতে কত কষ্ট পেয়েছিস বাবা! কতকাল পেটভরে খাসনি বল তো! তা বাবা এবার আমি ঘটিবাটি বেচে হলেও তোকে দু’বেলা পেটভরে খাওয়াব।”

শ্রীদাম একটা গলাখাঁকারি দিয়ে বলল, “রানিমা, ঘটিবাটি না বেচলেও চলবে।”

রাজা মহেন্দ্র মৃদুস্বরে বললেন, “গুপ্তধন নাকি হে!”

“একরকম বলতে পারেন।” বলে সিংহাসনের পেছন থেকে একখানা কারুকাজ করা ভারী বাক্স নিয়ে এসে সামনে রেখে বলল, “মোট পাঁচশোখানা আছে।”

“এই সেই লোচনের বাক্সখানা নাকি?”

“যে আজ্ঞে মহারাজ।”

“তা ইয়ে, শ্রীদাম।”

“যে আজ্ঞে।”

“এই নবেনকেও যে তোমার রানিমার বেশ পছন্দ।”

“তাই দেখছি মহারাজ।”

“তা নতুন নবেনকে বলল যেন ঘামাচি হলে জডুলটা আবার না চুলকোয়।”

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8
Pages ( 8 of 8 ): « পূর্ববর্তী1 ... 67 8

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress